ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (১৮শ অংশ)

ভাবনা: একশো বিশ।

……………………………………..

সেদিন আমার ছোটভাই কিছু ছবি পাঠালো, মায়ের হাতে লাগানো গাছের ফুলের ছবি। মায়ের বাগান করার খুব শখ। ছবিগুলো দেখে মনে হলো, ফুলের সাথে মায়ের হাসি কীভাবে যেনো মিশে আছে। তৃষ্ণার্ত মানুষ জলের ছায়া দেখেও কেমন যেনো শান্তি পায়, আমিও পেলাম। ছোটভাই বলে, দাদা জানিস, মা বারান্দায় কত ফুলের গাছ লাগিয়েছে! আমার রুমে ঢুকলে এ্যাত্তো ভালো লাগে! ইচ্ছে হয়, বাইরে গিয়ে বারান্দার গ্রিল ধরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি।

আহা, শুধু মায়েরাই পারে, ঘরকে বাগান আর বাগানকে ঘর করে তুলতে!

যখন ফুল ফোটে, মা তখন হাসতে থাকে। তখন কী যে সুন্দর দ্যাখায় মাকে! “মা, কতো সহজ আনন্দে তুমি খিলখিল করে হাসতে পারো। মা, তুমি কি জানো, হাসলে তোমাকে কী যে ভালো লাগে?” এই সহজভাবে বাঁচার ম্যাজিক হয়তো আমি কখনোই শিখতে পারবো না, শেখার আগেই হুট করে একদিন চলে যাবো। চলে যাওয়ার সময় খুব কষ্ট লাগবে; ম্যাজিক শিখতে না পারার কষ্ট।

আজকের সকালটা একটু মায়াজাগানো। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় ঘুমভাঙা শহরের ব্যস্ততা দেখতে-দেখতে অফিসে আসছি, হঠাৎ গাড়িতে এফএম-এ আমার ছোটোবেলার দুটো গান কী গভীরভাবে ছুঁয়ে গেল! মায়ের মুখে যে কটা গান শুনতে-শুনতে বড় হয়েছি, সবগুলোই আমার খুব কাছের, অনেক আপন। আজ বাজছিলো প্রতিমা। বড় সাধ জাগে, একবার তোমায় দেখি……………এর দুএকটা গান পরেই বাজলো, একটা গান লিখো আমার জন্য/ না হয় আমি তোমার কাছে ছিলেম অতি নগণ্য।

শুধু এই ছোটোবেলার গানগুলো শুনতেও বেঁচে থাকা যায়। আমার মায়ের গানের গলা অপূর্ব মিষ্টি। মনে হচ্ছিলো, মা নিজেই যেন গাইছেন। মা এই দুইটা গান প্রায়ই করেন। উনার ভীষণ প্রিয় গান! কী যে ভালো লাগে শুনতে!

আমার দাদু যখন মারা যান, তখন মায়ের বয়স ৪। বড় মামার হাতে মা-মামা’রা মানুষ হয়েছেন। খুব অল্প বয়সে মায়ের বিয়ে হয়। মা তখন সতেরো বোধহয়। খুব সুন্দরী ছিলেন দেখতে। মায়াজড়ানো চোখ, স্নিগ্ধ নিষ্কলুষ অবয়ব, শান্ত স্বভাবের। বিয়ের পর মেয়েদের সবাইকে আপন করে নিতে হয়; অন্য ঘরের অন্য মানুষদের নিজের করে নিতে শিখতে হয়। এই আর্ট বিধাতা শুধু মেয়েদেরকেই শিখিয়েছেন। তাই মেয়েমাত্রই মহান আর্টিস্ট। সবাইকে এভাবে আপন করতে-করতে একটা সময়ে নিজের কাছেই নিজে পর হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আবদার রাখতে-রাখতে বাপের বাড়ির আদরের খুকুমণিটা আস্তেআস্তে হারিয়ে যেতে থাকে। এটাই নিয়তি। সুখের ঘর সাজাতে মেয়েরা আরেকবার নিজেদের সাজিয়ে নেয়। ওরা আরেকবার জন্মে, তাই মেয়েমাত্রই দ্বিজ। আমার বাবা ছিলেন আগাগোড়া সংস্কৃতিমনা রুচিশীল মানুষ। আমরা রবীন্দ্র-নজরুল-অতুল-রজনী লতা-কিশোর ঘরানার ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনেশুনে বড় হয়েছি। বাবা মাকে সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। মার অনেক ছোটোছোটো চাওয়া ছোটোছোটো সুখ বাবা বুঝতেন। তবুও এখানে কথা থাকে। মেয়েরা কতোটুকুই বা স্বামীকে বলে! মা বিয়ের আগে আবৃত্তি করতেন, গাইতেন, প্রচুর বই পড়তেন। বিয়ের পর সেসবের চর্চা আর রাখতে পারলেন কই? দাদুর মতো বড় মামাও অধ্যাপনা করতেন। কড়া শাসনে ছোটো ভাইবোনদের মানুষ করেছেন। যে মেয়ে ছোটোবেলায় বাবাকে হারায়, সে কতোটুকুই বা সাধআহ্লাদ করতে পারে! মাও পারেননি। দাদু বেঁচে থাকলে মাকে এতো অল্প বয়সে মাকে বিয়ে দিতেন না হয়তো। আর দশটা মেয়ের মতোই মাকে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে খুশি করতে গিয়ে নিজের অনেক ছোটোছোটো সুখ বিসর্জন দিতে হয়েছে। অনেকের পড়ার খরচ দিয়েছেন নিজের জমানো টাকা থেকে। আমার বাবা আর সেজো মামার কাছ থেকে যে হাতখরচ পেতেন, সেটা দিয়ে অনেক গরীব লোককে সাহায্য করতেন। একেবারে এলোমেলো হয়েযাওয়া অনেককেই বুঝিয়েশুনিয়ে সুপথে এনেছেন। মাকে কখনো গলার স্বর উঁচু করে উনার শ্বশুরবাড়ির কারো সাথে কথা বলতে দেখিনি। অনেকসময় নীরবে কেঁদেছেন, মুখে কিছু বলেননি। পৃথিবীর আর কোন প্রান্তেই আপনি এরকম মেয়ে পাবেন না, যে সম্পূর্ণ নিজের গুণে একটা অন্য ঘরকেও নিজের এবং নিজেদের ঘর করে তুলতে পারে। বাঙালি মেয়েরা তাই অনন্য। আমার মায়ের বাগান করার শখ। বিয়ের আগেও করতেন। কানুনগোপাড়াতে স্যার আশুতোষ কলেজের টিচার্স কোয়াটারস, যেখানে মা বেড়ে উঠেছেন, সেখানে মায়ের বাগান ছিলো। মা এখনো বাগান করেন। মায়ের হাতের লেখা মুক্তোর মতো ঝরঝরে। যখন ছোটো ছিলাম, মা রাত জেগে-জেগে আমাদের দুই ভাইয়ের জন্যে নোট করতেন। মা একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াতেন। অনেক ছাত্রকে বিনে পয়সায় প্রাইভেট পড়িয়েছেন, বইখাতা কিনে দিয়েছেন। ওদের অনেকেই আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। মা বলতেন, বাবা, মানুষের আশীর্বাদ নিবি সবসময়। মানুষের আশীর্বাদ কাজে লাগে। বাবা ওকালতিতে ব্যস্ত থাকতেন, সন্ধ্যায় পড়াতে বসতেন কিছু সময়ের জন্যে; আমাদের পড়াশোনার প্রায় সব তদারকি মা-ই করতেন। শ্রী সারদাদেবীকে কোট করে মা বলতেন, শোন বাবা, সহ্য করবি। তোর কতকিছুই তো অনেককে সহ্য করতে হয়। এই সহ্য করার শিক্ষা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। কথা শুনিয়ে দেয়া বলতে যা বোঝায়, সেটা মায়ের কাছে কখনোই দেখিনি। আমি আমার নিজের জীবনে এর চর্চা করেছি। মা বলতেন, খুব রাগ হলে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকবি। দেখিস না, মাটি কতো সহ্য করে!

গান ২টা শুনেই মাকে ফোন করলাম। প্রতিমা গাইছেন, অবিকল যেনো আমার মায়ের গলা। মা’কে এটা বলতেই মা খিলখিল করে হেসে উঠলো। সারল্যমাখা ভাবনাহীন ঝলমলে হাসি। আহা, জীবনে শুধু এই হাসির জন্যই বেঁচে থাকা যায়! হে ঈশ্বর! তুমি আমার কিছু আয়ু মা’কে দিয়ে দিয়ো।

প্রিয় মা, আজকের দিন পর্যন্ত এমন একটা দিনও এলো না যেইদিন তুমি আমাকে আমি খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস না করে লাঞ্চ কিংবা ডিনার করেছো। ফোনটা রাখার সময় যখন চুমু খাও, তখন কী এক গভীর অনুভবে ভাবতে থাকি, স্রেফ এই একটা চুমুর প্রতীক্ষাতেও তো বেঁচে থাকা যায়! কীভাবে পারো মা এতোটা ভালোবাসতে? এভাবে হাসিখুশি থেকো, মা। মা, তুমি কি জানো, হাসলে তোমাকে কী যে ভালো দেখায়?

আমি আশা এবং নিরাশা দুটোরই চরম সীমানায় থেকেছি। আমি জানি, সামনে যখন শুধুই শূন্যতা থাকে তখন কেমন লাগে। কতটা আশায় মানুষ স্রেফ বেঁচে থাকে, তাও জানি। লাইফ অব পেন্যান্স কী, তা আমাকে কোনো থিওসোফিক্যাল লেকচার পড়ে শিখতে হয় নি৷ খুব কষ্টে আছেন, এর চেয়ে বেশি কষ্টে থাকা যায় না, এইরকম দাবি যাঁদের, তাঁদের বলছি, একটা সময়ে মৃত্যুর প্রহর গোনার ব্যাপারটা পর্যন্ত আমার কাছে অর্থহীন মনে হতো৷ ওরকম প্রহর গুনতে হলেও তো অন্তত বেঁচে থাকতে হয়; সেই বেঁচে থাকাটাও কী এক ভীষণ যন্ত্রণার বিলাসিতা! মনে আছে, একদিন, যেদিন আমি অনেক ভেবেটেবে ঠিক করেছিলাম, আগামী দিনটা আসার আগেই আমার জীবনে আমি নিজেই আগামী জীবনটা আনবো, সেদিন, যাদেরকে দেখার জন্যে হলেও স্রেফ নোবডি হয়ে এমনিএমনি অন্তত বেঁচে থাকবো, এই তীব্র ভাবনার কাছে হেরে গিয়ে আমার হাতের বিষের কৌটাটা খালিহাতে ফিরে গিয়েছিলো, তাদের মধ্যে ছিলে তুমি, বাবা আর পাপ্পু। এখন বুঝি, শুধু বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়। মা, স্পষ্ট মনে আছে, সেইবার যখন খাগড়াছড়িতে পাথরের পাহাড় থেকে পিছলে গিয়ে অনেক নিচে পড়তে-পড়তে বেঁচে গেলাম আরেকটা এবড়োথেবড়ো বড়োসড়ো পাথর দয়া করে আমার ডান-পা’টা আটকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিয়ে বাঁচিয়ে দিলো বলে, সেইদিনও পাথরের গা পিছলে-পিছলে মৃত্যুর কাছাকাছি ঘেঁষতেঘেঁষতে আবছাভাবে যাদের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম জল শ্যাঁওলা আর স্যাঁতস্যাঁতে পাথরে ঠিকরে পড়া আলোতে, সেখানেও তোমার মুখটাই প্রথমে ছিলো। সেসময় ভাবছিলাম, একটু পরেই তো নিশ্চিতভাবেই মৃত্যুর সাথে হ্যান্ডশেক করতে যাচ্ছি; এর আগেই ফাঁকিটাকি দিয়ে ঈশ্বর কিংবা প্রিয়জনের ভাবনাছায়ায় শরীরমন যতোটুকু ভিজিয়ে নেয়া যায় আরকি! আমি হলফ করে বলছি, সেইদিনও তুমি ঈশ্বরকে বরাবরের মতোই হারিয়ে দিয়েছিলে!

মাগো, ভালো থেকো।

ভাবনা: একশো একুশ।

……………………………………..

জাহানারা ইমামের মৃত্যুসংবাদ হুমায়ূন আহমেদকে দেন আসাদুজ্জামান নূর। সংবাদটি জানার পরের অনুভূতি নিয়ে তিনি লিখেছেনঃ

মা জায়নামাজে বসলেন।

আর আমি একা-একা বসে রইলাম বারান্দায়। একধরণের শূন্যতাবোধ আমার ভেতর জমা হতে থাকল। কেবলই মনে হতে থাকল, একটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। কী পরিমাণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এই মানুষটির প্রতি আমার ছিল, তা তাঁকে জানানো হয়নি। আমার একটাই সান্ত্বনা, মৃত্যুর ওপাশের জগত থেকে আজ তিনি নিশ্চয়ই আমার বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করতে পারছেন।

পড়ে আঁতকে উঠলাম। বারবারই মনে আসতে লাগল, আজ যদি বাসায় আর না ফিরতে পারি? যদি ………. মাকে ফোন করলাম। এরপর বাবাকে। ছোটোভাইকেও জিজ্ঞেস করলাম, ও কেমন আছে, কী করছে। কেন করলাম? সত্যিই কোনো কারণ নেই। কিন্তু মনে হল, ওরা খুশি হয়েছে। কেন? এরও কোনো কারণ নেই। প্রকৃতি কিছু ব্যাপারে রহস্য পছন্দ করে। বিশেষ করে, ভালোবাসার ব্যাপারে। ঠিকই তো! বাবাকে বলা হয় না, ভালোবাসি। মাকে গালে চুমু খেয়ে কখনো বলি না, ভালোবাসি। ছোটোভাইকেও, ও যে খুব অসাধারণ একজন মানুষ, এটাও তো কোনোদিনও বলা হয়নি। কেন হয়নি? এসব কিছু নাকি বলা যায় না। অথচ পৃথিবীতে ওরাই একমাত্র আছে, যারা ভালোবাসি বললে সরল মনে বিশ্বাস করবে। বাকিরা কারণ খুঁজবে। যদি এমন হয়, আর কোনোদিনও বলতেই না পারি? আমি এর আগেই চলে যাই? কিংবা…………..না, আর ভাবতে পারছি না। বাসায় ফিরবো।

ঈশ্বর মানুষকে খারাপ কাজের শাস্তি দিতেই পৃথিবীতে পাঠানোর সময় সাথে করে ভালোবাসার অনুভূতি দিয়ে দিয়েছেন। আমরা কেন সব কথা মনে রেখে দিই? কেন সময় থাকতেই ভালোলাগার কথা, ক্ষমা চাওয়া বা অন্যসব অনুভূতি প্রকাশ করি না? আমার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছেন ২ বছর আগে। যেদিন উনি মারা গেলেন, সেদিন মৃত্যুর আড়াই ঘণ্টা আগে বন্ধুর সাথে বাবার ফোনে কথা হল। কথা শেষ হওয়ার আগেই লাইনটা কেটে গেল। বন্ধু শুয়ে ছিল, আলসেমি করে বাবাকে আর কলব্যাক করেনি, ভেবেছিলো, কথা তো হলোই, পরে কল করবে। বাবা আর সময় দেননি। বাবার শেষ কথাটা ছিল, “বাবা, তুই কেমন আছিস? ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস তো? আমি আর তোর মা সামনের ঈদে…….” বন্ধু গত আড়াই বছর ধরে কখনোই খুঁজে পায়নি বাবা মাকে নিয়ে ঈদে কী করতে চেয়েছিলেন। ওর বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা নির্বাক হয়ে গেছেন। কিছুই বলতে পারেন না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। হয়তো উনি নিজেও জানেন না তার স্বামীর কী ইচ্ছে ছিল, কিংবা জানলেও প্রকাশ করতে পারেন না। প্রিয়জনকে সময় দিতে হয়, কারণ মৃত্যু কখনো সময় দেয় না।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নিয়ে গত ২৫/০৪/২০১৩ তারিখ এই কথাগুলি লিখেছিলাম:

বেঁচে থাকতে পারে তারাই, যাদের বেঁচে থাকাটা অন্য কেউ চায়, যাদের ভালোবাসার লোক আছে৷- শীর্ষেন্দু (সাঁতারু ও জলকন্যা)

আমাদের পোশাককন্যারা বেঁচে থাক, এটা আমরা আমরা চাই না, এমন কিন্তু নয়৷ তবে এই চাওয়ায় কোনো ভালোবাসা নেই; আছে স্বার্থপরতা, মুনাফাভাবনা, ঔদাসীন্য৷ আমরা মিথ্যে কথার বেসাতিতে ওদের জীবন নিয়ে খেলি৷ ওদের মরেই গিয়েই দেখিয়ে দিতে হয় বারবার—এই আমরাও বেঁচে ছিলাম৷ কখনো বুঝেছিলে, কীসে তোমার বিত্ত বাড়ে? অর্থনীতির চাকা ঘোরে কীসের জোরে? ভাববার সময় হয়েছিলো? একটুও? . . . . . . . ওরা তো বেশি কিছু চায় না৷ স্রেফ খেয়ে-পড়ে বেঁচেবর্তে থাকতে পারলেই ওদের হয়ে যায়৷ আমরা আকাশছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর ওদের পায়ের তলায় রেখে৷ ভাবি, গরীব মানুষ, বেঁচে আছে, এটাই তো বোনাস৷ আর কী চাই বাপু? ওদের আর কিছু লাগে না৷ আমাদের মরে-যাওয়া বিবেকের কবরে এক দলা থুতু ছিটিয়ে দিয়ে ওরা মরে৷ সবসময়৷ মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হয়৷ আমরা বলি, উঃ! কী কষ্ট! মনে মনে ভাবি, আমার কী! আমার কেউ তো নেই ওখানে! থাকবেও না কোনোদিন৷ বাদ দিই, আমার কী-ই বা করার ছিলো? . . . . . . . কী বিশ্রী নিরুত্তাপ নিরুদ্বিগ্ন বেহায়া অসভ্য নির্ভার অভ্যস্ততা আমাদের! আমরা চালিয়ে নেয়ার কালচারে বিশ্বাসী, অভ্যস্ত৷ সেখান থেকে কখনো বের হয়ে আসি না৷ আচ্ছা, সেলাই দিদিমনিদের মৃত্যুশোকের আয়ু কত দিন? শোক আছে কি আদৌ? শোকের অস্তিত্ব-ই তো মিডিয়া-নির্ভর৷ তাই বড্ডো ঠুনকো৷

শুয়োর, কুত্তা, গর্দভ ওদের বড়ো সুবিধা এই যে, ওদের কিংবা ওদের বাচ্চাদের কেউ ওই নামে গালি দেয় না। কারণ, ওরা তো ওটা-ই। আমাদের বড়ো অসুবিধা এই যে, আমাদের গালাগালিতে ওদের চেয়ে বেটার অপশন আমরা এখনো আনতে পারিনি। যদি ওরা কথা বলতে পারতো, নিশ্চয়ই ‘মানুষ’ কিংবা ‘মানুষের বাচ্চা’, এর চেয়ে যুতসই গালি আর হতো না। আমরা সব বয়সেই বড়ো বেশি রোমান্টিক, রসিক—এমনকি মৃত্যু নিয়ে, কষ্ট নিয়ে। সাভার ট্র্যাজেডিতে যে হতভাগ্যরা বেঁচে গেছে, তারা মৃতদের ঈর্ষা করতেই পারে আমাদের এই রোমান্টিক রসিকতার ঠ্যালায়। . . . . . প্রাণ খুলে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে পারলে নিজেকে একটু হাল্কা লাগতো। তাও পারছি কই? ওতে তো থুতু উপরের দিকে ছিটতে হয়। নিজের মুখেও এসে পড়ে। অতটা সাহসী তো হইনি এখনো।

খুব নিচু সিলিংয়ের বারান্দা ধরে হেঁটে যাচ্ছি আমরা। মাথা হেঁট করে-করে। যার যতো বড়ো মাথা, তার মাথা ততো বেশি হেঁট। আমাদের ভারি মাথার ভার সামলানোর মতো অতো শক্তি আর আমাদের অবশিষ্ট নেই। আমাদের মতো বিজ্ঞজনের মানবতার বুলি কপচানো আর কোনো এক ইমপোটেন্ট সুলতানের হারেম-যুবতীকে ভোগলিপ্সা—দুটোই সমানভাবে হাস্যকর।

ভাবনা: একশো বাইশ।

……………………………………..

বাংলার মাটিতে আজ পণ্ডিতের ঘনঘটা। ডাইনে পণ্ডিত, বাঁইয়ে পণ্ডিত, উপ্রে পণ্ডিত, নিচে পণ্ডিত, সামনে পণ্ডিত, পিছে পণ্ডিত। ফেসবুকের চারপাশে চর্মচক্ষু মেইল্যা দেখি পণ্ডিতের হাটবাজার। নিজেরে পুরাই বলদাবলদা লাগে। চেহারাসুরতেও কেমন একটা বলদাবলদা ফ্লেভার চইলা আসতাসে! ভাবতাসি, আবার আগের মতো কোচিংয়ে ক্লাস নেয়া ইশটার্ট করুম, অতি যত্ন সহকারে পোলাপান (থা)পড়ামু। যতক্ষণ ক্লাসে থাকি, অ্যাট লিস্ট ততক্ষণ মনে হয়, কিসু বান্দা আমার চাইতে কম জানে, কিংবা মনে করে, কম জানে।

সিক, সাইকোপ্যাথ ও হিপোক্রিটমুক্ত ফেসবুক চাই। আমার ফেসবুকওয়াল থেকে কৃতবিদ্য পণ্ডিতরা দয়া করে দূরে থাকুন। এই প্রোফাইলের মালিক একজন অতিমূর্খ এবং সে মূর্খ থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আপনার পাণ্ডিত্যের দৌড় বোঝার ক্ষমতা তার নেই। আমি চাই, আমার ওয়াল সকল ধরনের প্রফেশনাল চাপাবাজি, গলাবাজি, হিপোক্রিসি, আঁতলামি এইসব থেকে ১০০ হাত দূরে রাখতে। আমি এখানে আসি স্রেফ আনন্দ পেতে। এর বাইরে আর কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আমার কোনোকালেই ছিল না, এখনো নেই, আর ভবিষ্যতের কথা জানি না। কোনো ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ ও প্রশংসা না করে আমার সাথে যুক্ত থাকার জন্য বিনম্র অনুরোধ করছি। আপনি আমার সাথে যেরূপ আচরণ দেখাবেন, কথা দিচ্ছি, আমিও আপনার সাথে অনুরূপ আচরণ করবো। তবে নেতিবাচক আচরণের ক্ষেত্রে অযথা অনেক সময় ও শ্রমের অপব্যবহার হয় বিধায় আমি সবসময়ই সেটা এড়িয়ে চলি। আমি অতি নিম্নশ্রেণীর সিভিল সার্ভেন্ট। আমি জানি, আমার দায়িত্ব কী, এবং এটা দেখভাল করার পবিত্র দায়িত্ব আপনার উপর ন্যস্ত নয়, এটা বোঝার মতো মানসিক পরিপক্বতা আমি আপনার কাছ থেকে আশা করি। ওইটুকু পরিপক্বতা না থাকলে আপনি দূরে গিয়ে শব্দ না করে মুড়ি খেতে থাকুন। খাওয়ার শব্দ এড়াতে প্রয়োজনে মুড়ি স্প্রাইট দিয়ে ভিজিয়ে খান। দয়া করে আমাকে আমার চাকরি দিয়ে বিচার করবেন না, আমিও আপনার চাকরির বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখাবো না। জেনে রাখুন, এই প্রোফাইলের মালিক একজন অত্যন্ত খিটখিটে স্বভাবের অভদ্র ও অসহিষ্ণু মানুষ। আপনি তার সমালোচনা করতে পারেন, তবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে অভ্যস্ত হলে দয়া করে এখানে আসবেন না। আপনার সাথে ঝগড়া করার সময় কিংবা মানসিকতা তার নেই। এই রাজ্য একান্তই তার ব্যক্তিগত রাজ্য। সে এখানে প্রফেশনালিজম কপচাতে আসে না। সে জীবন কাটানোর পাশাপাশি চাকরি করে, চাকরির পাশাপাশি জীবন কাটায় না। আপনার এতে কোনো আপত্তি থাকলে আপনি এই বাজে মানুষটির ওয়ালে অনুগ্রহ করে আসবেন না। আমার ওয়ালে আসার আগে সেন্স, কমনসেন্স আর সেন্স অব হিউমারকে পকেটে রেখে আসবেন না। নাহলে দয়া করে দূরে থাকুন। আমি অতি নিকৃষ্টশ্রেণীর জীব। উৎকৃষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেছি, পারিনি। সরি। ধন্যবাদ।

অনেক কঠিন-কঠিন কথা বলে ফেললাম। এবার একটু সহজ কথা হোক। তিনটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছি।

চিড়িয়াখানায় একটা বানরের খাঁচায় অনেকগুলো বানর থাকে। কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছে, দেখি বলুন তো, সোয়া এক ঘণ্টায় তাদের মধ্যে যেকোনো একটা বানরকে গড়ে কতোজন দর্শক দেখে?

কঠিন হয়ে গেল? আচ্ছা, এবার একটা সোজা প্রশ্ন করি। Happy Birthday to You……….. এই গানটার সুরের সাথে আরেকটা গানের সুরের মিল আছে।

দেখি বলুন তো কোন গানটা?

এবার সবচেয়ে সহজ প্রশ্ন। গান দুটো কার কার লেখা?

একটার সঠিক উত্তর দিতে পারলে ফুচকা খাওয়াবো।
দুইটার সঠিক উত্তর দিতে পারলে কফি খাওয়াবো।
তিনটার সঠিক উত্তর দিতে পারলে আমাকে আপনি ফুচকার সাথে তেঁতুলের জলের বদলে ব্ল্যাক কফি খাওয়ালেও কিছুই মনে করবো না!! কারণ, আপ্নে মানুষ না!! আপ্নে______ (Fill in the gap!)

ভাবনা: একশো তেইশ।

……………………………………..

I’m a Shikh by born, not by choice. Blame me for anything I’m by choice. For the last 11-12 years I’ve never prayed formally and I’ve never suffered for it. God has always been such a good friend to me. I’ve never made any troubles with Him, He has never made any troubles with me. We’re on such good terms! God must not be so crazy as to being angry with someone only for not eulogizing Him. He is wise, he is just. To me, being a good person has always been more important than being religious. Being religious is easy, being righteous is difficult. People choose the easy path. Had been God that childish, He’d have killed me thousand times by now for not being outwardly pious. We create God by our will, define what He likes and does not like, and rape religion to justify everything we want to justify. I was not asked what religion I want to live by after I’d been born. After my birth people around declared me Shikh even without my permission! Religion comes to us when we’re blind to judge the world we’re born in. To some, food can make or unmake religion! To me, food is, what I like to eat and what I can digest. I never believe in any food-based religious culture. Let not religion contain us, rather let’s contain religion. The only religion I do believe in is, LIVE & LET LIVE.

ধর্ম নিয়ে বেশিরভাগ লোকের ভাবনা বিচিত্র ও অজ্ঞতাপ্রসূত। আমি কী অনুভব করবো, কী অনুভব করবো না, এটা পর্যন্ত ঠিক করে দেয়ার লোকজন আছে! ভাল ঝামেলা হয়ে গেল তো! একেকজন একেকরকম করে ভাবে। কারো ভাবনাকেই অন্ধভাবে নিয়ে নেয়া ঠিক নয়। এমনকি, যখন কোনো প্রাতঃস্মরণীয় কিংবা অনুকরণীয় ব্যক্তি কোনো ভুল করে বসেন, তখনো সেই ভুলটা আমরাও করতে পারবো, এমন বিশ্বাসও বাতুলতা মাত্র। এই প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা কথা মনে পড়ে গেল। মুজতবাকে উনার স্ত্রী একদিন বললেন, তুমি যে ড্রিঙ্কট্রিঙ্ক কর, ছেলেরাও তো তোমাকে দেখে শিখবে। মুজতবা বললেন, কেনো গিন্নী, আমি যে ২২টা ভাষা জানি, সেগুলোর মধ্য থেকে ২-১টাও ওরা শিখুক না!

আমরা ধর্মকে যতটা না হৃদয়ে স্থান দিয়েছি, তার চেয়ে ঢের বেশি স্থান দিয়েছি খাওয়ার টেবিলে। ধর্ম এত ঠুনকো না যে, কিছু ফুড-হ্যাবিটেই এটা চেনা কিংবা অচেনা হয়ে যাবে। জীবনে বড়োহওয়া ছোটোহওয়া এইসব ব্যাপারের সাথে ধর্মের সম্পর্ক খুব প্রকট কিংবা প্রত্যক্ষ নয়। আমার নিজের কথা বলি। আমি কালকের জন্যে বাঁচি না, আজকের জন্যে বাঁচি, প্রতি মুহূর্তের দুনিয়াতে বাঁচি। একটু পরে যদি হুট করে ‘নেই’ হয়ে যাই, তবে কোনো আফসোস যেনো না থাকে, সেভাবে বাঁচার নামই বাঁচা। বেঁচে আছি, ভালোভাবে চলতে পারছি, অন্যকে ভালোভাবে বাঁচার রাস্তা করে দিচ্ছি কিংবা অন্যের ভালোভাবে বাঁচার রাস্তাটা আটকাচ্ছি না—এর নামই ধর্ম।

অতিআস্তিক্য কিংবা অতিনাস্তিক্য নিয়ে বাড়াবাড়ি করার নাম ধর্ম নয়, এর নাম ধর্ম-ব্যবসা কিংবা অধর্ম-ব্যবসা। একটা ব্যাপার শেয়ার করি। মাঝে-মাঝে কিছু লোক এসে বলে, ভাই, আমিও শিখ, আপনিও শিখ; আমাকে এই ফেভারটা করেন। এই কথা শুনলে মনে হয়, উনি আমার অফিসার সত্ত্বাকে হেয় করছেন। আমার বড়ো পরিচয়, আমি একজন ভারতীয়, আমি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য। সবাইকে সমভাবে সেবা দেয়া আমার দায়িত্ব। আমি ওরকম একজনকে একবার বলেছিলাম, ভাই, আপনি শিখ, এটা যেমন আপনার কোনো গুণ নয়; তেমনি আমি শিখ, এটা আমার কোনো দোষ নয়। কাউকে ভাল লাগলে তার ভাল জিনিসগুলি গ্রহণ করবো, খারাপ লাগলে তার খারাপ জিনিসগুলি এড়িয়ে যাবো। এইতো! এইখানে ধর্মের কী ভূমিকা? কারো ভালোগুলো গ্রহণ করার সময় যতোটা স্বার্থপর হতে হয়, খারাপগুলো কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার সময় ঠিক ততোটাই বুদ্ধিমান হতে হয়। অন্য ধর্মের যে দিকগুলি আমার ভাল লাগে না, সেগুলি নিয়ে কপচাকপচির কী আছে? ধর্ম তো দর্শন ছাড়া আর কিছু নয়, খুব স্বার্থপরভাবে সব ধর্মের নির্যাস হৃদয়ে ধারণ করার মধ্যে জীবনের সার্থকতা নিহিত। সবাই তো আর ঠিক একইরকম করে ভাবে না, একইভাবে বাঁচে না। যত মত, তত পথ। প্রত্যেকটা পথেরই নিজস্ব কিছু সৌন্দর্য আছে। আসুন না, আমরা শুধু সেই সৌন্দর্যটুকু নিয়েই বাঁচি।

ভাবনা: একশো চব্বিশ।

……………………………………..

দুইদিনের বাসভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা লিখছি।

এক। ঢাকার পথে . . . . . . .আমার পশ্চাতের আসনে উপবিষ্ট এক শাখামৃগ মুঠোফোনে তাহার ব্যবসায়িক শ্যালকের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করিতেছে, দিবসকালে শাখায়-শাখায় বিচরণ করিয়া তাহার বাণিজ্য করিবার এতোটুকুও ফুসরৎ হয়তোবা মিলে নাই; শাখামৃগী তাহার কনিষ্ঠা ভগ্নীকে তদীয় রন্ধননৈপুণ্যের বিশদ বিবরণ দিতেছে আর তারস্বরে ক্রন্দনরত তাহার দুগ্ধপোষ্য শাবককে থ্রেট মারিয়া কহিতেছে, এই বান্দরের বাচ্চা! খবরদার কানবি না! তুইল্যা আছাড় মারমু! (ভদ্রমহিলার আত্মোপলব্ধি আর সত্যভাষণে আমি রীতিমতো মুগ্ধ!) ইহাতে নিষ্পাপ শাবকের ক্রোধ এবং উত্সাহ উভয়ই উত্তরোত্তর দ্বিগুণ হইতেছে।

OMK!! ও মোর খোদা!! তুমি রাত্রিকালীন ভ্রমণে সকল যাত্রীকে সাময়িকভাবে মূক করিয়া দাও না ক্যান?

পার্শ্ববর্তী এক বয়োবৃদ্ধ উত্কটবিকট নাসিক্যগর্জনে সুখনিদ্রাযাপন করিতেছে। বড়ো অভিলাষ মনে, তাঁহার নাসিক্যরন্ধ্রযুগলে কতকটা তুলা গুঁজিয়া দিই এক্ষণে।

আহা! আহা!! ইহা আমি কী প্রত্যক্ষ করিলাম! আমার আসনের দুই সারি সম্মুখে এক বিকটদর্শনা ওষ্ঠরঞ্জক দিয়া স্বীয় ওষ্ঠযুগল রাঙাইতেছে। কাহার মনোরঞ্জনার্থে? এমন নিশীথে! এই অন্ধকারে এই শাকচুন্নীর আকর্ষণে অদ্যকার নাইটকোচে তাহার প্রাণনাথ ভূত মহাশয় আসিবেন কি?!

দুই। সামনের ট্রাকের মহিষগুলার লুকে কেমন জানি একটা বলদবলদ ফ্লেভার আছে, দেখলেই মনে হয় বুদ্ধিসুদ্দি কম। ভাবতেসি, বাসের হর্ন শুইন্যা যদি দুএকটা মহিষ রাস্তার উপরে লাফায়ে পড়ে, তাহলে কী হবে? আচ্ছা, মহিষ কি নাচতে পারে? আমার ফাইনাল কাউন্টডাউন গানের মিউজিকের সাথে মহিষের নাচ দেখতে ইচ্ছা করতেসে। ওই বলদা মহিষগুলা ব্যাপক ভাবে আছে। ওইগুলারে ধইরা কাতুকুতু দিতে মঞ্চাইতেসে।

সামনে খেতের আইলে বইসা এক লোক সিগারেট ধরায়ে মনের সুখে হিসু করতেসে। কোনো কারণ ছাড়াই লোকটার পাছায় জোরে একটা লাত্থি মারতে মঞ্চাইতেসে। লোকটা বুড়া। বুড়া লোকের পাছায় লাথি মারলে পাপ হয় কিনা সেটা নিয়া আমি কিঞ্চিৎ কনফিউসড। তাই, বুঝতেসি না, কী করবো। কিন্তু ইমিডিয়েটলি মারা দরকার। ব্যাটার চেহারাছুরত লা স্ট্রাডা মুভির নায়কের মতো, দেখলেই খালি থাবড়াইতে মঞ্চায়। জ্যাম ছুটে গেলে আর মারা যাবে না। আফসুস আফসুস! মনের সুখে লাত্থি মারতে না পারার আফসোস ব্যাপক। যারে যখন মঞ্চায় তখন পাছায় লাত্থি মারতে না পারলে বাঁইচা থাইকা কী লাভ?

আমাদের বাসে ক্যাটক্যাটে লাল লিপস্টিক দেয়া একটা মেয়েকে দেখতে অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ-এর মেয়েটার মতো লাগতেসে। ওর সাথে টাংকি মারতে পারলে সেইরাম ফিলিংস আসতো। প্রবলেম হইলো, ওর পাশে ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। একটা লাইসেন্স করা রিভলভার থাকা দরকার ছিলো। থাকলে এতক্ষণে ওই ওরাংওটাংছানা ফিনিশ্‌! এখন মনে হইতেসে, পিস্তল ছাড়া বাসে উঠলে জীবন বৃথা।

সামনের সিটে দুই মহিলা ঈদের শপিং বিষয়ক চাপাবাজি করতেসে। পাখিড্রেস না কিনে দেয়ায় একজনের কইন্যারত্ন দুই দিন কিছু খায় নাই। কানতে-কানতে কইন্যার আন্ধা হওনের জোগাড়। মহিলার ধারণা, পাখিড্রেস পড়লে উনার কইন্যারে দেখতে বিলাইরিনা কাইফের মতো লাগতো, কিন্তু উনার হাজবেন্ড রাজি না। এই আটার বস্তার বিলাইপ্রসব করার কোনো কারণ দেখতেসি না। দুই মহিলার ফাউল বাতচিত শুইন্যা আমার মাথায় ননস্টপ দ্য গুড, দ্য ব্যাড, দি আগলি’র মিউজিক বাজতেসে। ব্যাপক পেরেশানির মধ্যে আছি। গড ব্লেস দেয়ার হাজবেন্ডস্‌।

শিম্পাঞ্জি-শিম্পাঞ্জি টাইপ চেহারার এক লোক চিল্লাইয়া-চিল্লাইয়া তার বউরে বুঝাইতেসে ক্যামনে আমাগো বাস কুমিল্লাতে আটকাইয়া আছে। জ্যামে বাস আটকাইয়া আছে, আর সেইটা ১৫ মিনিট ধইরা বুঝানোর কী আছে, ঠিক বুঝলাম না। মাইয়ামাইনষ্যে বেশি প্যারা দ্যায় নাকি পুরুষ মাইষ্যে বেশি প্যারা ন্যায়? এইটা একটা গবেষণার সাবজেক্ট হইতে পারে। আমি বললাম, ভাই, কষ্ট করে আরেকটু জোরে বললে তো আর মোবাইল ফোনই লাগতো না। পয়সাটাও সেভ হতো। এরপর দেখি, ব্যাটা কটমট চোখে আমার দিকে তাকাইয়া আছে। ভাবিতে লাগিলাম, আঁই কিচ্চি?

আমার পাশের সিটে এক ছেলে গার্লফ্রেন্ডের সাথে ম্যারাথন গল্প করতেসে, আর আমি উপাস থাইকাও বইসা-বইসা মুড়ি চাবাইতেসি। কিসু তুলা পাইলে ভালো হইতো, কানে গুঁইজা রাখতাম। একখানা পত্র লিখতে মঞ্চায়। কারে লেখা যায়, ভাবতেসি। বাসে মোশারফ করিমের নাটক চলে। ‘বউয়ের জ্বালা’ নাটক। ব্যাপক বিনুদুন! নাটক দেখি, আর ভাবি, বিয়া করে কোন সুখী বলদা?!

ভাবনা: একশো পঁচিশ।

……………………………………..

দাদাঠাকুর নামে পরিচিত লেখক শরৎচন্দ্র পণ্ডিত অত্যন্ত আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও কারো কাছে কখনো হাত পাতেননি। এন্ট্রান্স পাস করার পর অর্থাভাবে আর পড়াশোনা করতে পারেননি। তিনি তাঁর প্রবল রসবোধ আর পাণ্ডিত্যের জন্য অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। কিন্তু, কখনোই কারো কাছে আনুকূল্য আশা করেননি।

যত বড় মানুষই হন না কেন, তাঁকে কেউ কোনও ব্যঙ্গবিদ্রূপ করলে ছেড়ে কথা বলতেন না। তিনি ‘বিদূষক’ নামে একটা পত্রিকা চালাতেন। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একদিন দেখা হতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর, বিদূষক শরৎচন্দ্র, কেমন চলছে-টলছে?”

দাদাঠাকুর উত্তর দিলেন, “আর কী বলব চরিত্রহীন শরৎচন্দ্র, একরকম করে কেটে যাচ্ছে।”

তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয় মেলে আরেক ঘটনায়। একবার লালগোলার মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় দাদাঠাকুরের অসামান্য রসবোধে মুগ্ধ হয়ে তখনকার দিনে (১৯২০ সালের দিকে) ২৫ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। মহারাজের ইচ্ছে ছিল, দাদাঠাকুর তাঁর পত্রিকাটা যেন আরো ঢেলে সাজান। দাদাঠাকুর এতে রাজি হননি। তিনি ছিলেন পুরোপুরি সেলফমেড একজন মানুষ। সবিনয়ে বলে দিলেন, “মহারাজ, আমার অনেকদিনের সাধ, আপনার মতো বড়লোক হব। কিন্তু আপনারই টাকা দিয়ে আপনার মতো বড়লোক হব, তা তো হয় না মহারাজ।”

অনেক ছেলেকেই দেখি, বিয়ের সময় শ্বশুরের কাছ থেকে যৌতুক নেয় কিংবা নিতে চায়। এতে করে তাঁর যতোটা অর্থবৃদ্ধি ঘটে, স্ত্রী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে ততোধিক সম্মানহ্রাস ঘটে; সে বিয়ের পর আর মাথা উঁচু করে চলতে পারে না। শ্বশুরের টাকায় বড়লোক হতে গিয়ে নিজেকে আর নিজের পরিবারকে ছোটো করতে অনেক ছেলেকেই দেখেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্বশুরের টাকা নেয়া হয় লোভ থেকে, প্রয়োজন থেকে নয়। এমনকি বিয়ের সময় মেয়ের বাবা স্বেচ্ছায় বা একরকম জোর করেই যৌতুক কিংবা কোনো উপহার দিলেও জামাতা এবং তার বাড়ির লোকজনের প্রতি পরবর্তীতে তাঁর সম্মানবোধ কমে যায়। এরকমও অনেক দেখেছি। অফিসের বসের জ্বালায় এমনিতেই অফিসে বাঁচা দায়, তার উপর শ্বশুরের টাকায় বিয়ে করলে বাসায়ও একটা বিগবস্‌ জুটে যায়। স্বাভাবিক! আপনি বউয়ের বাপের টাকায় বিয়ে করবেন, আর বিয়ের পর বউ আপনাকে অসীম শ্রদ্ধায় পুজো করবে, এরকম তো হয় না!

দাদাঠাকুরের সেন্স অব হিউমার ছিলো চমৎকার!

কলকাতা বেতারকেন্দ্রে দাদাঠাকুর কথিকায় নিয়মিত অংশ নিতেন। একদিন অনুষ্ঠান শেষে বেতারকেন্দ্র থেকে বেরোবার সময় তাঁর সাথে দেখা হলো নবীন গায়ক রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাকে প্রায়ই এখানে দেখি, তুমি কে?”

রামকুমার সসংকোচে বললেন, “আমি গাই।”

দাদাঠাকুরকে আর পায় কে! মুচকি হেসে বললেন, “তা, সকাল-বিকেল ক’সের দুধ হয়?”

দাদাঠাকুরের জীবনীকার নলিনীকান্ত সরকার চোখের ছানির অপারেশন করিয়েছেন। ব্যাপারটা কী, জিজ্ঞেস করাতে, নলিনীবাবু বললেন, ঈশ্বরপ্রদত্ত লেন্সের বদলে ডাক্তাররা কাঁচের লেন্সের চশমা দেন। কোনো কারণে পা পচলে যেমন পা কেটে কাঠের পা দেন ডাক্তারবাবুরা, সেরকম।

দাদাঠাকুর সব শুনে বললেন, “দ্যাখ, কাঠের পা কিন্তু আসল পায়ের চেয়ে ভালো।”

নলিনীবাবু সবিস্ময়ে বললেন, “কেনো?”

দাদাঠাকুর বললেন, “কাঠের পায়ে মশা কামড়ায় না।”

আহা, বাংলার নারীকুলের মস্তিষ্কে দাদাঠাকুরের অক্ষয় প্রেতাত্মা ভর করুক।

ভাবনা: একশো ছাব্বিশ।

……………………………………..

বসন্তসুচিত্রা’র দীপ জ্বেলে যাই, কিংবা অশোকসুচিত্রা’র হসপিটাল যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের বলছি, ওই মুভিগুলির সময়ে উত্তমসুচিত্রা জুটিতে ভাঙন ধরান সুচিত্রা নিজেই। কী একটা নিয়ে উত্তমকুমারের সাথে মনোমালিন্য চলছিলো মিসেস সেনের। সপ্তপদী এলো হসপিটাল’এর পরের বছরই। ওখানে আবার উত্তমসুচিত্রা। মুভির আগে পরিচালক অজয় করের পরামর্শে সুচিত্রার অভিমান ভাঙাতে মহানায়ক নিজেই ফোন করে অনুরোধ করেন সুচিত্রাকে। শোনা যায়, সুচিত্রা নাকি এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ইগোর খেলায় মেয়েরাই তো জিতে! অগত্যা, কী আর করা! ছবির সহপ্রযোজক উত্তমকুমারকে ফোনটা করতে হয়েছিলোই! ভাগ্যিস উত্তম ফোনটা করেছিলেন! নাহলে আমরা কি সপ্তপদী পেতাম? পেলেও ওরকম করে নাক ফুলিয়ে আর কে-ই বা বলতে পারতো, ও আমাকে টাচ্ করবে না! সবার নাক ফোলানো তো আর হৃদয়ে ঢেউ তোলে না! কারো কারো নাক ফোলানো দেখলে বরং ইএনটি সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ওই ছবিতে রিনা ব্রাউনের ইগোর কথা মনে আছে তো? মেয়েরা বেশিরভাগ সময়েই বোধহয় ওরকম। একটু অবহেলাও সহ্য করতে পারে না। এমনকি অবহেলাটা সত্যি-সত্যি অবহেলা না হলেও! টু ফেসড্ উইম্যান’এর বিরূপ সমালোচনার পর গ্রেটা গার্বো যখন অভিনয় করা ছেড়ে দেন, তখন সবারই তাঁর বিখ্যাত উক্তি, আই ওয়ান্ট টু বি লেফট্‌ অ্যালোন—চুপচাপ মেনে নিয়ে এই বিশ্ববিশ্রুত সুন্দরীর রূপের রোমন্থন করা ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিলো?

আমরা তখন সেভেনে। একদিন বাংলার কাজল স্যার ক্লাসে এসে এক ছেলেকে বেত দিয়ে সে কী মার! স্যার সবাইকে ওর পরীক্ষার খাতাটা উঁচু করে দেখালেন। বেচারা বাংলা দ্বিতীয় পত্রের খাতায় উত্তম-এর বিপরীত শব্দ লিখেছিলো সুচিত্রা। উত্তমসুচিত্রা জুটি একটা প্রতিষ্ঠানের সমান প্রভাব বিস্তার করেছিলো।

বুঝুন, উত্তমকুমার ওইদিন ফোনটা করায় আমরা কী পেয়েছি!

কোনো একসময় রাগ কিংবা অভিমান করে আনফ্রেন্ড কিংবা ব্লক করে-দেয়া সেইসময়ের কোনো প্রিয় বন্ধুর সাথে এইসময়ে আবার বন্ধুত্ব হলে খুব দারুণ লাগে না? আবার বন্ধুতার শুরু হোক না একটা ছোট্টো টেক্সট্ দিয়ে: এ্যাত্তো অভিমান! ভাবলেও সুন্দর একটা অনুভূতি কাজ করে না? হয়তো বন্ধু অভিমান করে আছে সেই অভিমানী অ্যালবাট্রস্ পাখিটার মতো, যে আকাশে ওড়া শুরু করতে হয়েছিলো বলে তীব্র অভিমানে আর কখনোই মাটির দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। ডানা দুটো অনেক বড়ো তো, তাই বুঝি ভেবেই নিয়েছিলো, স্রেফ নিজের ডানায় ভর করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে। অভিমান ঝেড়ে ফেলতে এ্যাত্তোগুলা শান্তি! ও না বলুক, সরিটা আপনিই বলে দিন না! ইসস্‌! বন্ধুতা কী মিষ্টি করে বলিয়ে নেয়! উত্তমকুমার যেমন করে বলেছিলেন! উত্তমসুচিত্রা খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। সত্যিই কি তা-ই, মানে শুধু বন্ধুই ছিলেন? প্রচণ্ড ভালোবাসা নিয়ে সহজ বন্ধুত্বের অভিনয় করা কঠিন। ধরুন, কারোর সাথে আপনি ওরকম অভিনয় করেই যাচ্ছেন। যার সাথে করছেন, সেও এটা মেনে নিচ্ছে। এখানে দুটো ব্যাপার থাকতে পারে। সে হয়তো বা জানেই না যে আপনি অভিনয় করছেন, অথবা যেকোনো কারণেই হোক সে আপনার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইছে অথচ সেই সম্পর্কের কোনো নাম দিতে চাইছে না। আপনি চাইছেন, আপনাকে ভালোবাসুক আর নাই বাসুক, অন্তত বন্ধু ভাবুক। প্রয়োজনে যেকোনো মূল্যে। যদি এমন হয়, ও শুধুই ওই মূল্যের বিনিময়ে আপনাকে বন্ধু ভাবছে, তাহলে আপনি কি সেই মানুষটার কাছে সবসময়ই হেরে যাচ্ছেন না, যাকে ও সত্যিই ভালোবাসে কিংবা বাসবে? দূরে থাকুক এসব সাতকাহন। উত্তমকুমার আর সুচিত্রা সেনের সম্পর্কে যতটুকু পড়েছি, তাতে আমার কিছুতেই মনে হয়নি, ওদের মধ্যে নিছকই বন্ধুত্ব ছিল। উনারা অনেক বড় মাপের আর্টিস্ট তো, তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্ঝঞ্ঝাটে অভিনয়টা চালিয়ে গেছেন—জীবনের মঞ্চে, ছায়াজীবনের মঞ্চে।