ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (২১শ অংশ)

ভাবনা: একশো একচল্লিশ।

……………………………………..

ইন্টারনেটে বাংলা ভাষা সম্পর্কিত তথ্যভাণ্ডার খুব‌ই সীমিত ও ত্রুটিপূর্ণ। অনেক চমৎকার ও দরকারি সাহিত্য উপকরণ ‌ও নিদর্শন আপনি নেটে পাবেন না। ভাল নির্ভরযোগ্য কোনও বাংলা অভিধান পর্যন্ত অনলাইনে নেই। খুবই পরিতাপ ও লজ্জার বিষয়।

বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিধান ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ আমাদের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। শ্রদ্ধেয় পরিশ্রমী লেখক গোলাম মুরশিদকে এ কাজের জন্য ধন্যবাদ। এই অসাধারণ অভিধানটির অনলাইন ভার্সন থাকলে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের খুব উপকার হত। অমন বিপুল আয়তন ও ওজনের ৩ খণ্ড অভিধান সবসময়ই সাথে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া ২২৫০ (কিংবা ২৪০০) টাকা খরচ করে অভিধান কেনার সামর্থ্য কিংবা মানসিকতা আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর নেই। আমাদের এই সম্পদ অনলাইনে থাকলে তা আমাদের পাশাপাশি অন্য অঞ্চলের বাংলাভাষী মানুষের‌ও আগ্রহ ও প্রয়োজন মেটাতে পারত। এতে বাংলাদেশের গৌরব‌ও বাড়ত। অভিধানটি তার পূর্বসূরি বঙ্গীয় শব্দকোষ, বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, কিংবা চলন্তিকার চাইতে উচ্চমর্যাদায় আসীন হওয়ার সকল যোগ্যতা রাখে। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘যথাশব্দ’ রজে-র থিসরাসের বিষয় এবং শব্দবিন্যাসের ধরনকে প্রায় অবিকল ব্যবহার করে প্রণীত বাংলা ভাষায় প্রতিশব্দের প্রথম শব্দকোষ। এ আমাদের পরম সম্পদ। আমি বলছি না বইটির দাম বেশি, তবে বইটি সবসময়ই সাথে রাখা সম্ভব কি? ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিধানগুলির সবকটিই আপনি অনলাইনে পাবেন। ফলে প্রয়োজনের সময় খুব সহজেই আপনার সেলফোনটি ব্যবহার করে আপনার যা দরকার তা আপনি পেয়ে যাবেন। এ বিষয়ে ইংরেজদের যে যত্ন ও আন্তরিকতা, সেটা আমাদের কোথায়? অনলাইনে ইংরেজি চটি সাহিত্য ব্যাকরণ—সবই পাবেন; আর বাংলায় পাবেন কেবলই চটি! কেন? অন্যান্য বিদেশি ভাষার সম্পদগুলিও অনলাইনে আছে। তেমন কোনও উদ্যোগ আমাদের নেই কেন? বাংলা একাডেমি এ কাজে হাত না দিলে কে দেবে? সরকারিভাবে আউটসোর্সিং করেও কাজটি সহজে করা যায়।

বাংলা একাডেমির অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা দীর্ঘদিন ধরেই আউট অব প্রিন্ট। সেগুলি মুদ্রণের কোনও উদ্যোগ আমরা দেখছি না। অন্যান্য প্রকাশনীর ভীষণ দরকারি যে সকল ব‌ই বাজার থেকে হারিয়ে গেছে, সেগুলিকে ফিরিয়ে আনবে কে? উনারা তো আর কাজটি করবেন না, কারণ এ অসামান্য কাজের বাণিজ্যিক মূল্য অতিসামান্য; তাই একাডেমিকেই কাজটি করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে বেকনের প্রবন্ধাবলি’র চমৎকার অনুবাদ বেরিয়েছে। সে অনুবাদ বাজারে আর পাওয়া যায় না। এমন দৃষ্টান্ত অসংখ্য। আমরা আমাদের সম্পদ আগলে রাখতে শিখিনি। বড় দুর্ভাগা জাতি আমরা।

বাংলা একাডেমি এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে অতো গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন বলে আমাদের কখনও মনে হয়নি।

বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিধানগুলো আমাদের জানাচ্ছেন, ইদ ও ঈদ দুটোই বাংলায় প্রচলিত। আলালের ঘরের দুলাল-এ আমরা পড়েছি, রমজান-ইদ-সোবেরাত আমার করা সার্থক। কিংবা, অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৫০’য়েই লিখেছেন, কি ইদ, কি মহরম কোন মোসলমান……….আলাওল, নজরুল ‘ঈদ’ বানানটি ব্যবহার করতেন। মনসুর, জীবন, বেগম, মোহাম্মদী পত্রিকায় আমরা ‘ঈদ’ পেয়েছি।

আমার অভিমত, ভাষা নিয়ম কিংবা ব্যাকরণের হাত ধরে চললে চলুক, তবে সুধীজনগ্রাহ্য প্রচলন কিংবা সাধারণ মানুষের আবেগের বিশ্বস্ত নাটাই ভাষার ঘুড়ি ওড়ালে সে নাটাইয়ের সুতো কেটে দেয়াটা অবশ্য কর্তব্য—এমন গোঁয়ার্তুমি অহেতুক ও হাস্যকর। ভাষা যেখানে যেভাবে ভাল আছে, তাকে সেখানে সেভাবেই ভাল থাকতে দেয়া হোক। ভাষার পায়ে অহেতুক নিয়মের শেকল পরিয়ে তাকে রক্তাক্ত করার কী অর্থ?

আমরা তাই ‘ঈদ মোবারক’ ‘ইদ মোবারক’ দুইই ব্যবহার করব—দুটোই যে আমাদের আপন, কোনটাকে ফেলে দেবো? এটা নিয়ে কোনও ঝগড়া বাধাব না। ওপরের দিকে থুতু ছিটালে তো নিজের গায়ে এসেই পড়ে। পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে কলহের ফল কী হয়, আমরা তো জানিই!

বাংলা একাডেমি-কে সবিনয়ে বলছি, আমাদের ভাষার সৌন্দর্য ও সম্পদ আমরা সহজে পেতে চাই, জানতে চাই, বুঝতে চাই। আপনারা সে কাজটিতে মন দিলে আমাদের বড় উপকার হয়। আমরা যারা শুদ্ধভাবে বাংলা বুঝতে, লিখতে ও পড়তে চাই, তাদের পাশে দাঁড়ানো আপনাদের কর্তব্য। আপনারা ছাড়া কাজটি করার যে আর কেউ নেই। আমরা কার কাছে যাব?

ভাবনা: একশো বিয়াল্লিশ।

……………………………………..

বহুগামিতা এবং এমন আরও কিছু অভ্যেস আছে যা থাকাটা সম্পর্কের জন্য হুমকিস্বরূপ। এমন অনেক ছেলে বা মেয়েই এমন কাউকে বিয়ে করতে চায় যে কিনা তার মধ্যে থাকা এইসব অভ্যেস সহজে ধরতে পারবে না। মানে ওরা অনেকটা শান্তশিষ্ট লেজ বিশিষ্ট টাইপ বোকা-বোকা ভাল-ভাল মেয়ে বা ছেলেকে লাইফ পার্টনার বানাতে পছন্দ করে—যাদের সাথে সহজেই চালাকি করা যায় বা সত্যটা এড়িয়ে চলা যায়, কখনওবা ধরা খেয়ে গেলেও মুখের কথার নৈপুণ্যে যাদের ম্যানেজ করে ফেলা যায় খুব সহজেই! সহজেই সব বুঝে ফেলবে আর বুঝে ফেললেই লংকাকাণ্ড করবে, এমন সারাক্ষণই গ্যাঁজগ্যাঁজ খ্যাঁজখ্যাঁজ করা ক্যাঁটক্যাঁটে মেয়ে বা ছেলেদের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়া থেকে তারা যতোটা সম্ভব বিরত থাকে।

কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, প্রায়শই দেখা যায়, একটা বড় অন্যায় করে ধরা খেয়ে গেলে সেই আলাভোলা টাইপ মানুষটাই হঠাৎ অন্য এক মানুষ হয়ে ওঠে। একবার রেগে গেলে তাকে আর কোনওভাবেই সামলানো যায় না। ফলে অনেকসময় বিচ্ছেদও ঘটে যায়।

অন্যদিকে, সারাক্ষণই ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো নিয়েও চিৎকার চ্যাঁচামেচি-করা ডমিনেটিং-টাইপ গোয়েন্দাগিরিতে পটু মানুষটাই অনেক বড় অন্যায়কেও সহজভাবে গ্রহণ করে। ক্ষমা করা দিয়ে আরেকবার সুযোগ দেয়। সম্পর্কটাকে তারা টিকিয়ে রাখতে চায়, এত সহজেই শেষ হতে দেয় না।

কোন ধরনের মানুষ কোন ধরনের কাজ করবে, আগে থেকে তার কিছুই বলা যায় না। মানুষ অচেনা প্রজাতির প্রাণী।

দিনের পর দিন কেটে যায়,

জানালাগুলো বন্ধ থাকে।

আলো আসে না, ঢোকে না হাওয়া,

রুমটা বড় গুমোট থাকে।

আঁধার আমার বড্ড প্রিয়

আমি আঁধারের, আঁধারে থাকি।

আঁধারই যখন শেষ ঠিকানা,

আলো নেই তাই কষ্টে ভীষণ

লাভ কী বলো জাগিয়ে মরণ?

আমার ধারণা, আমি ‘চিরতরে দূরে’ চলে গেলে তুমি হাহাহাহা হোহোহোহো হিহিহিহি করে হেসে উঠবে। সেই হাসিতে সুর মিলিয়ে আকাশ হাসবে বাতাস হাসবে, হাসবে বনের গাছ হাসবে নদীর মাছ।

মনে আছে, একবার বলেছিলে, আর একটাও টেক্সট পাঠালে এক্কেবারে থাপড়ায়ে দাঁত ফালায় দিব!?

ইচ্ছে করছিল, লিখে পাঠাই, আর একবারও অ্যাভয়েড করলে এক্কেবারে কামড়ায়ে দাঁত ফালায় দিব!

ইসসস্‌ এই শীতে

ঠাণ্ডা এড়াতে

করিনি গোসল

তিন তিনদিন!

সেই যে গরমে

ভীষণ তাপে

ঢেলেছি পানি

ঢের বেশি!

দিয়েছি কথা

পুষিয়ে দেবো

বাড়তি পানির বাড়তি হিসেব।

লও ফিরিয়ে, প্রকৃতিরাণী,

দিন তিনেকের বাড়তি পানি!

সে যুগের মায়েরা এ যুগেও ইয়াং! বয়সের জোরে!

এ যুগের মায়েরা ওই যুগেও ইয়াং! ফ্যাশন ফেসিয়াল ক্যামেরার তোড়ে!

আমাদের মায়েদের বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে, যে কারণে তাদের ছেলেমেয়ের বয়স যখন ৩০, তখন তাদের বয়স ৪৫। বয়স লুকানোর কোন কার্যক্রম ছাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই তারা ইয়াং। কিন্তু আমরা ৩০-এ বিয়ে করব আর যখন আমাদের সন্তানদের বয়স যখন ৩০ হবে তখন আমরা হয়ে যাব ৬০-এর বুড়ি! আরও যদি ৫ বছর গ্যাপ যায়, তাহলে তো ৬৫! আধুনিক যুগের ডিজিটাল জীবনে নিজেকে ঘষেমেজে ‘সাইজ’ করে ফ্যাশানফুশানের বদৌলতে হয়তো তখন আমরা ৪৫ সেজে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করব।

আহা সময়! কাউকে ছাড়ে না। সবাইকেই অসহায় করে রাখে।

এসব লিখি, কারণ লিখে মজা পাই। কী করব? আমাকেও বাঁচতে হবে তো!

ব্যুফেতে খাওয়ার ব্যাপারে নিয়ম করা উচিত—প্লেটে যতটুকু খাবার থেকে যাবে, সেটার জন্য পেমেন্ট করতে হবে! আজগুবি মানুষ কত্তগুলা—একটা বড় অংকের টাকা দেয়ার কষ্টে দুনিয়ার সব খাবার প্লেটে নিয়া বসে। শেষমেশ আর খেতে পারে না। যদি প্লেটে থেকেযাওয়া খাবারের জন্য টাকা গুনতে হত, তাহলে আর এত্তগুলা খাবার নষ্ট করত না।

প্রেমের ব্যাপারে নিয়ম করা উচিত—যে ছেড়ে যাবে সে যতটা কষ্ট রেখে যাবে, সেটার জন্য শাস্তি পেতে হবে। নিষ্ঠুর মানুষ কত্তগুলা—একহৃদয় ভালোবাসা পাওয়ার লোভে দুনিয়ার সব মিথ্যা আবেগ ঢেলে দেয়। শেষমেশ আসল রূপটা বেরিয়ে আসে। যদি ফেলেযাওয়া কষ্টের জন্য শাস্তি মানতে হত, তাহলে আর এত্তগুলা কষ্ট দিয়ে কেউ চলে যেত না।

আমি পায়ের মাপে জুতো কিনে বাসায় ফিরি।

বাসায় ফিরে তাকিয়ে দেখি—বিশাল জুতো, সাইজে ছোট!

বিস্ময়ে তাই জুতোর মাপে দুই পা কাটি; রক্ত ঝরাই, তবুও হাসি।

হঠাৎ দেখি, কোথায় জুতো? কেবলই ফাঁকি!

ভাবনা: একশো তেতাল্লিশ।

……………………………………..

অনেকেই আমাকে আপন ভেবে তাদের নিজেদের গোপন কথা এবং অন্যদের সম্পর্কে তাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করে। আমি মন দিয়ে সব কথা শুনি এবং অতি বিশ্বস্ততার সাথে সেসব কথা গোপন রাখি। তবে একটা কাজ করি, কেউ আমার কাছে যার সম্পর্কে যা-ই বলুক না কেন, আমি তার সম্পর্কে ভাল-ভাল কথা বলে দিই আর ওকে খারাপ লাগলেও ওর সাথে কীভাবে ভালভাবে থাকা যায়, আমি তার যতটুকু বুঝি ততটুকু বলে দিই। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই সবাই মনে করে, সে যার সম্পর্কে আমার কাছে বলছে, তাকে আমি পছন্দ করি, আর ওকে হয়তো পছন্দ করি না। সবশেষে দেখা যায়, তারা দুজন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে মিলেমিশে যায়, আর দুজনের প্রত্যেকেই মনে-মনে ভাবে, আমি তাদের দূরের কেউ। হায়! অথচ আমি চাইলেই দুজনের কাছেই ভাল হতে পারতাম!

এত গীবত করার ও শোনার চেয়ে বরং সবাই সবার সাথে ভাল থাকুক—এই দেখা ভাল। জীবন সুন্দর হোক না হোক, যুক্তিতর্ক বা হিসাব-নিকাশের কড়া চাপকল পিষুক জীবন, তবু জীবন সুন্দর হোক—সহজ সরল স্বাভাবিক ছন্দে। একটাই তো জীবন—এখানেই বাঁচতে হয়। সেটাও যদি অসুন্দর হয়, তবে আর কী-ই বা থাকে?

আমার প্রায়ই কাউকে রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এখন রাত ৩টা। ইচ্ছেটা এখনও জাগছে। আরেকটা বিকল্প ইচ্ছে মাথায় ঘুরছে। কাউকে জাপটে ধরে চুমু খেতে পারলে দারুণ হত। মন বারবারই বলে যাচ্ছে, “পিংকি! খবর্দার! একদম কামড়ায়ে ঠোঁট কেটে ফেলব!” আমার কাউকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে, অথচ কারও আমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে না। নিষ্ঠুর অসহায় মন। এমন একটা মন নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। কোনও মানে হয়? আমার প্রিয় মানুষটি, আমি যার প্রিয় নই, সে এই রাতে বাসজার্নি করছে। ওই বাসে বসে থাকতে পারলে খুব ভাল হত। না, আমি ওর পাশে বসে ওকে বিরক্ত করতে চাইছি না, আমি নাহয় এমন একটা সিটে বসতাম, যেখান থেকে আমি ওকে দেখতে পাব, কিন্তু ও আমাকে দেখতে পাবে না। এতে আমার যত কষ্ট হয় হোক, প্রয়োজনে আমি যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাব, তবু ভালোবাসার মানুষকে তো আর কষ্ট দেয়া যায় না। বোকা মনটা কেন যে তাকেই পেতে চায়, যে আমাকে চায় না, আমি বেঁচে আছি কি মরে গেছি, সেটা নিয়েও যে কখনও ভাবে না! মনকে বলি, দরকার হলে বিষ খাইয়ে আমাকে মেরে ফেল, তবু আমাকে এমন জ্বালাস না। মন শোনে না। মন আমাকে ফেলে একাই চলে যায় ওর সাথে দেখা করতে।

এক নদী কষ্ট বয়ে নিয়ে আমি সাগর হয়ে ফিরি সে ঠিকানায়, যেখানে পুরনো সে নদী মরে পড়ে আছে। এ এক নতুন নদী—মৃত নদী। কারও সময় নেই এ নদীতে এক ফোঁটাও জল ঢালবার। নিজের ‘সময়’ যদি অন্য কাউকে দেয়া যেত, তবে আমি আমার সময় থেকে কতকটা সময় ওকে দিতাম—আমায় নিয়ে ভাববার এতটুকু সময়ও যে ওর নেই!

একদিন দেখো

চারপাশটা এতটাই শূন্য,

যেখানে—

নিজেকেও খুঁজে পাবে না।

সেদিন আমায় ডেকো। আমি আসব।

এসব লিখি। আরও কতকিছু যে ভাবি!

আমরা একসাথে থাকি। আমরা খুব ভাল আছি। আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয় না, এমন না। তবে ভাল আছি। ও এক সপ্তাহের জন্য অফিসের কাজে কোথাও গেছে। বারবার সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে দিতে বলার পরও দুটা স্কাইব্লু টিশার্ট আর একটা অফহোয়াইট শার্ট কেন মনে করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম না এজন্য একগাদা বকাবকি করল।

: আমি তো ইচ্ছে করেই দিইনি।

: মানে? কেন?

: আমি ওগুলো সাথে নিয়ে ঘুমাব। প্রাণভরে তোমার গায়ের ঘ্রাণ নেবো। তুমি চলে যাচ্ছ, আমি কী নিয়ে থাকব?

: হাহাহা…..আচ্ছা আচ্ছা, সে তো ভাল কথা, কিন্তু তাই বলে আর কোনও ড্রেস ছিল না বুঝি?

: ওই তিনটা বাদে বাকিগুলো তো ওয়াশকরা। তোমার গায়ের গন্ধটা ওগুলোতে নেই তো!

(ফোনের দুপ্রান্তে দুজনই কিছু সময় চুপ……)

: বোকা সোনা বাবুইটা আমার! এটা তখন বললেই তো হত। বকা খেতে মজা লাগে, না?

: হুঁ।

: পচা একটা! একদম ধরে…….

: কী? বল না বল না!

: চুউউউউপপপ্‌…….!

প্রিয় মানুষ স্বপ্নে এসে বড় গভীর মমতায় আদর করে। বাস্তবে কেউ কখনও আসে না।

বাঁচার জন্য স্বপ্নই ভাল!

ভাবনা: একশো চুয়াল্লিশ।

……………………………………..

ভার্সিটি ক্যাম্পাস বড় নিষ্ঠুর জায়গা—শৈশব কেড়ে নেয়। শৈশবের কঠিন আর বিবর্ণ দিনগুলি ঠেলে যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম, আমি নিজেকে ‘আমি’ হিসাবে একটু-একটু করে আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। যেন পৃথিবীর সব রঙ এসে ডানা মেলল দুচোখ জুড়ে। সে কী রঙ! পুরো অন্ধ করে দেয়! আমার ধূসর সাদামাটা শীতল শৈশব পেছনে রেখে এক রঙের রাজ্যে প্রবেশ করলাম যেন। আর এই রঙ যেদিনটাতে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিত, সেদিনটা ছিল পহেলা ফাল্গুন। তাই পহেলা ফাল্গুন হয়ে উঠল আমার সবচেয়ে পছন্দের দিন। এই একটা দিনে নিজেকে আসলেই প্রজাপতি মনে হত, রঙিন পাখায় ভর করে উড়েচলা রঙবেরঙের ফুলের দেশে। কী এক শিহরণ! সেই দিনটার জন্য অধীর প্রতীক্ষা! আজও বড় আনন্দ পাই ভাবলে!

আমি প্রায়ই ভাবি, আমার সেই প্রিয় দিনটাতে আমি নিরুদ্দেশ হব। চিরকালের জন্য আমি অন্তরীণ রব। রং আর আমায় কাছে ডাকে না। আজ সব রঙিন স্বপ্ন ভীষণ কটাক্ষে আমায় কেবল দূরে ঠেলছে। এবার আমি সত্যিই নির্বাসনে যেতে চাই। একে অভিমান বলে না। এটা বাস্তবজ্ঞান। আমি জানি, এখন আর আমাকে কারও প্রয়োজন নেই। যাকে কেউ চায় না, যার জীবন কারও কাজে আসে না, তার জীবন আবার কেমন জীবন? এমন অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে বাঁচার কী মানে?

আহা ভালোবাসা! কেন সে এক মানুষ নয়? যদি ভালোবাসা অদৃশ্য না হয়ে একটা মানুষ হত, তাহলে ভালোবাসা—পৃথিবীর বাইরে লুকিয়ে থাকলেও তাকে ধরেবেঁধে এনে কুপিয়ে-কুপিয়ে প্রতি অণু পরিমাণ অংশে বিভক্ত করে ফেলতাম। আমাকে কষ্ট দেয়ার মজা ঠিক টের পেত ভালোবাসা বাবাজি। ভালোবাসা পৃথিবীর সবচাইতে কার্যকর স্লো পয়জন!

জানি, ভালোবাসা স্রষ্টার একটা উপহার। ভালোবাসাহীন পৃথিবীটা কী ভীষন কুৎসিত! হায়! এই উপহার বেশিরভাগ সময়ই শুধু অপাত্রে গিয়ে পড়ে, যার ভালোবাসার কোনও প্রয়োজন নেই কিংবা কাছে ভালোবাসার কিছুমাত্রও মূল্য নেই, মানুষ তাকেই সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে বসে থাকে।

কষ্ট—

আর, আরও…….কত পারবে কষ্ট দিতে?

কষ্টও একদিন—

ঠিক হবে ক্লান্ত। সেদিন আমার ভালথাকার দিন।

একে-একে সকলেই শিখে যাবে

ভালো না বেসে থাকতে।

ততদিনে তুমি—

অ-ভালোবাসায় বাঁচতে

শিখে নিতে পারবে তো?

কাকে কী বলছি!

এখনই তো অমন করেই বাঁচ; কেউ ধরতে পারে না—এমনই নিপুণ অভিনয় তোমার!

আকাশেতে চোখ রেখে

বৃষ্টির অপেক্ষায়

আঁধারকে সাথী করে

নির্ঘুম রাত কাটাতেই পারি।

এ আমার ইচ্ছে,

আমার স্বাধীনতা,

আমার মুক্তি……

তাই বলে

শুধু আমার জন্য

বৃষ্টি তো আর

আসবে না নেমে।

বুঝি সবই,

তবু স্বপ্নে বাঁচি। ক্ষতি কী?

নীলকষ্ট নীলজল রুদ্ধশ্বাস রুক্ষবিশ্বাস চেতন কিংবা অবচেতন মনের অস্পষ্ট দিগন্ত…….হায়! সবই আমার! হাওয়াই জীবন! কতোই আর বইবে!

কেউ-কেউ পৃথিবীতে বেঁচে থাকে কেবল দোষ কুড়োতে। ওরা দোষ জমিয়ে বাঁচে। যারা ভুল করে তারা ঠিকই বেঁচে যায়, আর ওরা ওই ভুলগুলির দোষ কাঁধে বয়ে-বয়ে বাঁচে। ভুল বুঝতেও কাউকে লাগে। ঈশ্বর ওদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যাতে অন্য সবাই ওদের ভুল বুঝতে পারে। ওরা বেঁচে থাকে ভুল বোঝাবুঝির নিরাপদ আশ্রয় হয়ে।

টিভি’তে অ্যাড চলছে। মঞ্চেরি মিল্ক ক্যান্ডির।

হাতে কী, বল দেখি?

কী? কী……?? চকোলেট? মিষ্টি?

উমম্‌হুঁ! দুউধ্‌!

অ্যাড দেখে আদৃতা হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল।

তার হাতে আসলেই দুটো দুধ, তেল ম্যাসাজ করছে।

ও খেয়াল করল, কষ্টের সময় হাসতে ভালই লাগে।

ভাবনা: একশো পঁয়তাল্লিশ।

……………………………………..

সাতসক্কালের কথামালা (আমার অবশ্য এখন এগারোসকাল, মানে আমার ঘুম ভেঙেছে এগারোটায়।)

অ্যাঅ্যাঅ্যাহহহ্‌ইইই…….(ফিসফিসিয়ে)

বলছি তোমায়, শোনো—

রোজ ভোরে যে

ভালোবাসার সবুজ ঘাসে

বিন্দু-বিন্দু শিশির জমাই

ছুঁয়ে দ্যাখো তো?

আজকে নাহয় না-ই বা ছুঁলে—

কিন্তু যেদিন থাকব না আর

তোমার পাশে,

অদৃশ্যও অদৃশ্য হয়—এমন দিনে

যাবই চলে

ওই অজানায়; খুঁজো না সেদিন।

জমবে শিশির সেদিনটাতেও,

যেমনি জমে আমার ছোঁয়ায়,

তোমার দারুণ অবহেলায়।

সেদিন তুমি ছুঁয়ে দেখো,

আমায় ধোরো

তোমার ও দুই

আলতো হাতে।

আমি নাহয় দেখব হেসে,

ভাবব সুখে,

আমি তো নেই—

সেখানে তবু আমিই আছি!

একদিন, যে কথাটা মাথার তিনহাত উপর দিয়ে যায়, সে কথাটাই সময় পাড়ি দিয়ে কোনও একদিন মাথার ঠিক মাঝ বরাবর দিয়ে ঠেকে-ঠেকে যায়।

একদা—

ন্যাড়া

বেলতলায় একবারই যেত।

আর এখন……

ন্যাড়া

কেবল বেলতলাতেই যায়!

‘শোলে’ মুভির গাব্বার সিংয়ের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে, তেরা কেয়া হোগা, ন্যাড়া?

যদি রোজ

একটিবার দেখতে পেতাম

হেঁটে যাচ্ছো

ওই শিশিরভেজা পথ ধরে…….

হাঁটছ আর হাঁটছ। পেছনে ফিরেও তাকাচ্ছ না।

ভয় পেয়ো না,

কখনওই চুরি করতাম না তোমার ইটুসখানিও সময়।

একটু দেখতাম এই দূর থেকে

প্রভাত কেন আওড়ে যায় নিশুতির গল্প

হতেম অবোধ সব বুঝেও।

১০২ ডিগ্রি জ্বরে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে সবাইকে বিরক্তিকর যন্ত্রণা দিয়ে বাসা মাথায় তোলার সুবিধাটা হল, ১০৫ জ্বরেও ঝিম মেরে এক কোণে নিশ্চিন্ত মনে পড়ে থাকা যায়, কেউ জ্বালায় না। সবাই ধরেই নেয়, ১০২-এ যে চিৎকার ফাজলামো করে, সে নিশ্চয়ই এখনও ভালই আছে! হাহাহাহাহা…….জীবন কী ভীষণ সুন্দর! জ্বরে জোরে কাঁপছি! কেউ খেয়াল করছে না, ‘কেমন আছি’ কেউ জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করছে না, আমি এখন মরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না। জীবন এত সুন্দর কেন? পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

ভালোবাসা মানে

যখনতখন

মনের ভেতর এলোমেলো সব

ভাবনা ঘোরা।

বিন্দু-বিন্দু ভাবনা, সাথে

পাহাড়সমান সব অভিযোগ

খুব আয়েশে

বলতে চাওয়া।

বিস্তৃত সবুজ মাঠ।

পাশাপাশি দুটি ঘাসফুল।

নীরব ভালোবাসার গল্প।

দুই জোড়া পা।

সরব ভালোবাসার গল্প।

প্রথম ভালোবাসার অকাল মৃত্যু।

এটাই জীবন!

আচ্ছা, ঘুমানো আর সেন্সলেস হওয়ার মধ্যে বাহ্যিক পার্থক্য কী? কিংবা, কী কী? কিংবা, আদৌ আছে কি?

রাতে কি সবাই সত্যিই ঘুমায়? কী জানি! কেউ-কেউ হয়তো সেন্সলেসও হয়। কে জানে!

কাঁদতে-কাঁদতে কিংবা গভীরভাবে কিছু ভাবতে-ভাবতে একসময় সেন্সলেস হয়ে যায়। সেন্স ফিরলে ভাবে, ঘুমিয়ে পড়েছিল হয়তো।

হতে পারে না এমন?

কী যে অদ্ভুত সবকিছুই……

জ্বর বাড়ছে। বাড়ুক! মনের সাথে একটু গল্প করি…….

উঠো আত্রেয়ী, উঠো; বাজারে যেতে হবে যে!

পারব না পারব না পারব না!

রুমের পর্দাটা সরাও।

সরালাম। তো?

সূর্যের আলো তোমায় ছুঁয়েছে?

হুমম্‌…….

দেখেছ? সেই ১৫ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে সূর্যের আলো তোমার কাছে চলে এসেছে, আর তুমি কয়েক কদম হেঁটে বাজারে যেতে পারবে না!?

কিন্তু ও তো এসেছে বিকিরণ পদ্ধতিতে, আর আমার তো যেতে হবে পরিবহণ পদ্ধতিতে। (ভ্রু কুঁচকে) বিকিরণে আবার কষ্ট কীসের?

আহা, তোমাকে তো দূরত্বের ভয়ংকর পার্থক্যটাও দেখতে হবে সোনা!

আচ্ছা তাইলে যাচ্ছি……(গাল ফুলিয়ে)

দূরত্ব দূরত্ব দূরত্ব! এই দূরত্বই সব যুক্তিকে ভোঁতা করে দেয়! অসহ্য!

ভাবনা: একশো ছেচল্লিশ।

……………………………………..

একটা খারাপ সময় চলাকালে যে মানুষ বা যে মানুষগুলোর উপর ভর করে বা সাহায্য নিয়ে বা সান্নিধ্যে থেকে খারাপ সময়টা পার করার আশ্রয় খোঁজা হয়, সে সম্পর্ক বা সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হয়, তার বা তাদের সাথে কথায় আর আচরণে স্পষ্টতা থাকতে হয়। কারণ, খারাপ সময়টা একটা সময় পার হয়ে যায়, তখন আর আগের আবেগগুলো কাজ করে না, কিন্তু পাশেথাকা মানুষটা বা মানুষগুলো একটা আন্তরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তখন তাকে চাইলেই ত্যাগ করা যায় না, আবার সাথে রাখার মতো অতোটা অনুভূতিও কাজ করে না। মানুষ তার খারাপ সময় চলার সময়ের বন্ধুর চাইতে নতুন বন্ধুর দিকে বেশি ঝুঁকে যায়। খারাপ সময়ের সময় যে পাশে ছিল না, মানুষ তাকেই বেশি সময় দেয়, মনের ঘরে প্রশ্রয় দেয়। অথচ, খারাপ সময়ের বন্ধুটিই প্রকৃত বন্ধু। প্রায়ই দেখা যায়, সে বন্ধুটি এসব অন্যায় অন্যায্য আচরণে তেমন কিছুই মনে করে না, আগের মতোই শুভাকাঙ্ক্ষীই থাকে, তবে নীরবে পাশ থেকে সরে যায়। মানুষ এমনই অদ্ভুত জীব যে এই সরে যাওয়াটুকু খেয়াল করতে পর্যন্ত পারে না! ভাল সময়ে কে খোঁজখবর রাখল, পাশে থাকল, তা দিয়ে বন্ধু চেনা যায় না। সাধারণত দেখা যায়, উচ্চ অবস্থানের বন্ধুর চাইতে নিম্ন অবস্থানের বন্ধুরা খারাপ সময়ে বেশি পাশে থাকে। উচ্চ অবস্থানের বন্ধুরা পাশেথাকাকে দয়া মনে করে, আর নিম্ন অবস্থানের বন্ধুরা পাশেথাকাকে দায়িত্ব মনে করে। তবে হ্যাঁ, এর ব্যতিক্রমও আছে।

যে ব্যক্তি উচ্চ অবস্থানের যোগ্য নয়, উচ্চ অবস্থান তাকে মানসিকভাবে সংকীর্ণ করে দেয়। যে অবস্থান দিয়ে বন্ধুত্ব মাপে, সে কখনওই বন্ধু নয়।

মানুষের জীবনে এমন কিছু ভাললাগা থাকে, যা পেতে হলে এর সাথে অনেকগুণ বেশি খারাপলাগাও পেতে হয়। তবু মানুষ ওই একটা ভাললাগা পেতে নিরানব্বইটা খারাপলাগা কী সহজেই সহ্য করে নেয়। অথচ, ওই ভাললাগাগুলো না থাকলেও জীবনের তেমন কোনও ক্ষতি হত না। খারাপগুলো নীরবে জীবনের অনেকটা ক্ষতি করে দেয়। মানুষ এটা বোঝে, তবে দেরিতে—যখন শুধরে নেয়ার সময়টা শেষ হয়ে যায়, কিংবা শোধরানোটা নিরর্থক হয়ে পড়ে।

জীবন—হায়, টের পাওয়া যায় জীবনের শেষে!

আমায় ক্ষমা করুন। আপনি ভাল থাকুন। শরীরটা ভাল না। বুকের তীব্র ব্যথায় তিনদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছি। কিছুই খেতে পারছি না, বমি হয়ে যাচ্ছে। এসব কী সহজেই আপনাকে বলে ফেলা যায়! কারণ আমি জানি, আপনি আমার কষ্টে কষ্ট পাবেন না। আপনার শরীর ভাল তো? তিন কোয়া কাঁচা রসুন খালিপেটে খাবেন প্রতিদিন। কেমন?

নাম ‘লাভ হ্যান্ডেল্‌স’। এইডা কিসু হইল? কোমরের চারপাশে যে থলথলে মেদ বাইরের দিকে বিশ্রীভাবে বেরিয়ে থাকে বৃত্তাকারে, সেটার নাম লাভ হ্যান্ডেল্‌স। কোমরের চারপাশে বাইরের দিকে মেদ বেরিয়ে আছে—এতোটাই যে, কখনও-কখনও নিচের দিকে ঝুলে যায়, খুব সহজেই চোখে পড়ে, লোকে কী ভাবছে তা ভাবতে নিজের কাছেও অস্বস্তি লাগে। কেমন না ব্যাপারটা? তবু তার ওই নাম কেন? ব্যাখ্যাটা মজার! পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে কিংবা লাভ-মেকিং বা মিশনারি বাদে অন্য অনেক পজিশনে সেক্স করার সময় আঁকড়ে ধরতে এই বাড়তি মেদের বৃত্ত দারুণ কাজে (!) দেয়; তাই ওর ওরকম নাম। তবে এই শব্দগুচ্ছে ‘লাভ’ কথাটা আপত্তিকর! ওই তিন কাজে লাভ (ভালোবাসা) আছেই, এটা ইংরেজ ভদ্রলোকদের কে বলল? এসব কাজ যতোটা হয় ভালোবাসায়, তার চাইতে বেশি হয় কামে। কাম আর ভালোবাসা এক হল? আদর কিংবা রতিতে কোনও ভালোবাসা কিংবা প্রেম না থাকলেও চলে, কেবল কামেচ্ছাই (desire for lust) যথেষ্ট। ‘হ্যান্ডেল্‌স’ অংশটা নিয়ে আমার আপত্তি নেই—একেবারে চিকনি চামেলি টাইপ জিরো ফিগার টিরো ফিগার ধরতেটরতে অতো আদর লাগে না। শরীর থাকবে মেদহীন ফিট—মানছি; তবে বেশি না, শরীরটা একটু থলথলে হোক, এতে বরং আরাম বাড়ে! তাই আমার মতে, ‘লাস্ট হ্যান্ডেল্‌স’ নামটাই পারফেক্ট! আচ্ছা, ইংরেজি ফ্রেজ্‌ পরিবর্তন করতে হলে কোথায় কার বরাবর আবেদন করতে হয়? আমি এই জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা নিয়ে আবেদন করতে আগ্রহী।

আবোলতাবোল বকলাম অনেকক্ষণ। মাঝেমধ্যে ওরকম বকলে কিছু হয় না। আমার বকা আমি বকব, যেমন ইচ্ছা তেমন বকব। যাও, আমি এটাকে নিয়ম করে দিলাম! এখন থেকে সবাই বকবে সবার মতো! যার যতো দুঃখ, সে ততো বকবে। বকে-বকে দুঃখ কমাবে।

ভাল বাবা

মমতাময়ী মা

ছোট

ছুট্টি

আপনি

সে

মায়াবতী (মেয়ে হলে)

ফানুস (ছেলে হলে)

ছায়া…….

শূন্যতা…….

(শেষ দুটো কাদের নাম, বললাম না; বললে, কষ্ট পাবেন। জীবনের সমস্ত অস্বাভাবিকতাও এক ধরনের স্বাভাবিকতা। অস্বাভাবিকতায় যাদের জীবন কাটে, তাদের জন্য ওটাই স্বাভাবিকতা। ওদের অস্বাভাবিক বলার আমরা কে? অথচ, আমাদের ওটা মেনে নিতে কষ্ট হয়, এমনকি ওরকম ভাবতেও কষ্ট হয়। তবুও আমি ওরকম ভাবি; মানে, অস্বাভাবিক ভাবনা মাথায় এসে যায়। আপন কাছের প্রিয় মানুষদের মনে-মনে মেরেও ফেলি। তারপর দেখি কেমন লাগে! যদি সত্যিকার পরিস্থিতির সাথে কল্পনার পার্থক্য থাকে অনেক-অনেক বেশি, তবে ভেবে নিই, বেশ ভাল আছি!)

জীবনে এমন অনেক কিছুই হয়, ঠিক বোঝা যায় না সেগুলি জীবনের উপহার নাকি অভিশাপ।

এক জীবন। কত কী যে দেখায়! এক জীবনে কত কী যে ঘটে!

বরাবরই আমি নিজের সমস্ত কষ্ট মনের গভীরে জমা দিয়ে বাইরে থেকে স্বাভাবিক হয়ে যাই কিংবা হতে চেষ্টা করি। যারা ভালোবাসা পায় না, তারা খুব ভাল কষ্ট গিলতে পারে। এই যেমন, আমি পারি।

দেখো, একদিন, একসাথে সব কষ্ট ফিরিয়ে দেবো। সেদিন ভার নিতে পারবে তো?

হাসি পাচ্ছে খুউউব্‌? তবে হাসো, হেসেই যাও। হাসিতে জীবন ওড়াও, যেমনি বাতাস ওড়ায় ঘুড়ি। দুটোই অর্থহীন—তবু এ অর্থেই জীবন চলে। অর্থহীনের অর্থ নিয়ে বাঁচাই জীবন!

আসলে, আপনিই ভাল আছেন! প্রতি মুহূর্তে নতুন শরীরে স্রেফ বাঁচা, আর নিজের কাজে ডোবা—এই-ই তো ভাল!

এতে অন্যকে নিয়ে ভাববার বা কষ্ট পাবার—সময়ই আর থাকে না।

এই-ই ভাল, বড় বেশি ভাল।

তবে অমন করে ভাল থাকতে সবাই চায় না; অবশ্য, ওই দলের মানুষগুলি চাইলেও অমন পারে না। হৃদয়ের শেকল লোহার শেকলের চাইতে অনেক মজবুত। সে শেকল যে পরে আছে স্বেচ্ছায়, সে বড় কষ্টে আছে। সে শেকল যে মৃত্যুর চাইতেও শক্ত!

যে ভালোবাসার যোগ্য যে নয় কিংবা যে ভালোবাসার মূল্য যে বোঝে না, তার কাছে সে ভালোবাসা খুব বেশিদিন থাকে না।

ভালোবাসার পাহাড়টা একদিন ঘৃণার পর্বত ফেরত দিয়ে ঠিকই কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

ওরা ভাবে,

একা আমি

দুঃখী আমি

অভিমানী আমি

মাতাল আমি—

হয়তো পাগল!

একাই ভাবি, একাই বকি।

কী করে ওদের বোঝাই বলো

আমার সাথে তুমিও থাক

অদেখার শরীরে মিশে!

তোমার সাথেই গল্পে মেতে

একা আমি একাই হাসি।

জীবনের তো অনেক রকমের খসড়া হয়, তা-ই না, বলো? আমি নাহয় এ খসড়াতেই বাঁচব! ছোট্ট জীবন—কেটে যাবে!

ভাবনা: একশো সাতচল্লিশ।

……………………………………..

আজ রথযাত্রা। এর উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত। কয়েকটা বলছি।

কৃষ্ণের মামা কংস কৃষ্ণ ও বলরামকে হত্যার উদ্দেশ্যে মথুরায় নিমন্ত্রণ করেন। তাঁদেরকে নিয়ে আসার জন্য অকুরকে গোকুলে পাঠান। গোপীদের বিদায় দিয়ে কৃষ্ণ বলরামকে সঙ্গে নিয়ে মথুরার উদ্দেশ্যে রথে যাত্রা করেন। কংসের সাথে লড়াইয়ে জিতে রথে চড়ে ফেরার পথে কৃষ্ণ মথুরায় ভক্তদের দর্শন দেন। সেই জয়যাত্রাই আজকের রথযাত্রা।

একবার শ্রীকৃষ্ণ বড়ভাই বলরাম ও ছোটবোন সুভদ্রাকে নিয়ে দ্বারিকা নগরীর শোভা দেখতে রথে বের হন। সেই দিনটিকে উদযাপন করতেই রথযাত্রা।

মহাভারতের আঠারো দিনের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি বা পাণ্ডবদের সর্বময় চালিকাশক্তি হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। ভক্তরা রথযাত্রার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণকে সারথি করে তাদের সংসার-রথের সকল দায়িত্ব সমর্পণ করেন।

বলরামের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ মৃত্যু বাসনায় মহাযোগ অবলম্বন করে মাটিতে শুয়ে রইলেন। তখন জরা নামে এক ব্যাধ কৃষ্ণের পদযুগলকে ভুল করে হরিণ ভেবে তীরবিদ্ধ করলেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে শঙ্কিতমনে শরাহত কৃষ্ণের পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, এই ঘটনা পূর্ব নির্ধারিত। তাদের উভয়ের পূর্বের এক জন্মের কর্মফলের কারণেই জরাব্যাধের হাতে তিনি দেহত্যাগ করছেন। তথাপি, জরাব্যাধ বারবার অনুশোচনাপূর্বক কৃষ্ণভজনের অনুমতি প্রার্থনা করলে শ্রীকৃষ্ণ জরাব্যাধকে আদেশ দিলেন যে, তিনি যেন প্রথমে দক্ষিণে গিয়ে পরে পূর্বদিকে সমুদ্র উপকুলে ধরে হেঁটে যান; এভাবে গিয়ে যেখানে সমুদ্রের জলে তিনি কৃষ্ণের চিতার কাঠ ভেসে যেতে দেখবেন, সেখানে সেই কাঠ সংগ্রহ ও প্রতিষ্ঠাপূর্বক তিনি যেন আরাধনার ব্যবস্থা করেন। এরপর শ্রীকৃষ্ণ তাঁর লৌকিক দেহ ত্যাগ করেন। অতঃপর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের মরদেহ সৎকারের জন্য দ্বারকায় না পাঠিয়ে সমুদ্র উপকূলে দাহ করার মানসে চিতায় উঠিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করেন। জরাব্যাধ শ্রীকৃষ্ণের আদেশ অনুসারে সমুদ্র উপকূল ধরে হাঁটতে-হাঁটতে পুরীতে এসে পৌঁছেন। এদিকে জ্বলন্ত চিতায় মরদেহ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হওয়ার পূর্বেই সমুদ্রের এক প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে চিতার আগুন নিভে যায়। কিছু দেহাবশেষসহ চিতার কাঠ সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে থাকে। জরাব্যাধ পুরীর কাছে সমুদ্রের জল থেকে শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ সেই কাঠ সংগ্রহ করে গভীর অরণ্যে সেইগুলো স্থাপনপূর্বক দারুব্রহ্ম বা জগন্নাথরূপে আরাধনা করতে থাকেন। এই জরাব্যাধই ছিলেন অরণ্যচারী শবরদের রাজা বিশ্ববসু। ওই সময় ভারতের পুরী শহরের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে কৃষ্ণ পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। দেশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের অনুরোধে বিশ্ববসু তদকর্তৃক সংগৃহীত চিতার কাঠ (শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ) রাজাকে দান করেন। মূর্তি নির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী রাজার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন, মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তার কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রাণীসহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তারা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রাণী কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন, মূর্তি তখনো অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তার সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ। পরবর্তীকালে ব্রহ্মার আদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ওই অর্ধনির্মিত মূর্তির মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের অস্থি স্থাপন করে মূর্তিতে চক্ষু, দৃষ্টি এবং প্রাণের সংস্থানপূর্বক তা আরাধনার ব্যবস্থা করেন। নির্মিত তিনটি মূর্তি হল জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা।

রথযাত্রা উৎসবের সময় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি মূল মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বের করে এনে কাঠের তৈরি তিনটি বিরাট রথে করে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভক্তরাই এই রথগুলো টেনে নিয়ে যান। যেখানেই জগন্নাথ মন্দির আছে, সেখানেই এই ধরনের রথযাত্রা আয়োজিত হয়।

এখন দেখা যাক, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে রথ নিয়ে কী লেখা আছে।

কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, যম তাঁর পুত্র নচিকেতাকে বলছেন, যে ব্যক্তি বুদ্ধিমত্তাকে তার জীবনরথের সারথি করেন, যার মন তার পঞ্চইন্দ্রিয়কে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে, তিনি ওইভাবে এ সংসারে বিচরণ করে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারেন।

রামায়ণে রামচন্দ্র বিভীষণকে বলছেন, আমাদের সংসারযাত্রার রথটির চাকা হল সাহস আর জেদ, অপরিবর্তনীয় সত্য আর চরিত্র হচ্ছে এর পতাকা, এর চারটি ঘোড়া শক্তি, বিবেচনা, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ আর বদান্যতা, এবং ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই হল এর সারথি। এমন রথে লোকে সকল সংসারবাধা অতিক্রম করতে পারে।

মহাভারতে কৃষ্ণ অর্জুনের রথের সারথি হয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে জয়ের দিকে পরিচালিত করেছেন। জীবনযাত্রার রথে সংসার পাড়ি দেয়ার সময় কেউ যদি তার সমস্ত নিয়তি যথার্থ সারথির উপর সমর্পণ করেন, তবে তিনি পূর্ণতার পথে চলতে পারবেন।

রথযাত্রা হচ্ছে মূলত আমাদের হৃত আত্মার পুনরুদ্ধার কৌশল। আমাদের হৃদয়ে কৃষ্ণ, অর্থাৎ ঈশ্বরকে স্থান দেয়ার ধ্যানই রথযাত্রা। এই ধ্যানের প্রথম ধাপ হচ্ছে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করা। কাম, ঈর্ষা, ঔদ্ধত্য, লোভ, ক্রোধ আর মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করার মাধ্যমে পরিশুদ্ধির কাজটি করা যায়। শুধু নিজেকে নয়, অন্যকেও সুন্দর হৃদয় ধারণ করতে সাহায্য করা রথযাত্রার দর্শন। রথে জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা থাকেন। জগত মানে পৃথিবী আর নাথ মানে পতি। জগন্নাথ অর্থ জগতের পতি, অর্থাৎ জগতের সকল কর্মকাণ্ডের প্রভু। বল মানে শক্তি আর রাম মানে আনন্দ। বলরাম হচ্ছেন, যিনি আমাদের আত্মিক শক্তি দান করেন যাতে আমরা ঈশ্বরের আশীর্বাদগুলি উপভোগ করতে পারি। সু মানে ভাল আর ভদ্রা মানে কল্যাণ। ফলে যখন জগন্নাথ বলরাম আর সুভদ্রা একসাথে থাকেন, তখন এ ত্রিশক্তি মানুষের জীবনকে মঙ্গলময় করেন, মানুষ তার সৌভাগ্যকে পুনরুদ্ধার করতে পারে। আমরা সে ত্রিশক্তির আরাধনা করি, নিজেদের হৃদয়ে সে ত্রিশক্তিকে ধারণ করি। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, “আমি সকলের হৃদয়ে আছি।” হৃদয়ে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান থাকলে আমাদের দেহ একটা রথ ছাড়া আর কিছু নয়। সে রথের সারথি আমাদের হৃদয়। রথের সুন্দর যাত্রাই আমাদের জীবনের সুন্দর যাত্রা। রথযাত্রা মূলত আমাদের জীবনকে সত্য ও সুন্দর পথে পরিচালিত করার দার্শনিক প্রয়াস মাত্র।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কণিকা’য় লিখেছেন—

রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।

পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’,

মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’—হাসে অন্তর্যামী।

আমরা যে ঈশ্বরের আরাধনায় নিজেদের নিয়োজিত করি, সে ঈশ্বর পথে থাকেন না, দেবালয়ে থাকেন না, কোনও বিগ্রহে অধিষ্ঠিত থাকেন না। ঈশ্বরের অধিষ্ঠান সাধকের নিজের হৃদয়ে। যদি সে হৃদয় না জাগে, তবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে আমরা চিরকালই বঞ্চিত থেকে যাব। নিজের অন্তর্শক্তির উদ্বোধনই সর্বোচ্চ স্তরের প্রার্থনা। যে নিজের আত্মশক্তিকে চিনতে পারে না, স্রেফ বাহ্যিক ধর্মনিষ্ঠা ও অগাধ বিশ্বাসের উপর ভর করে বেশিদূর যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। ধর্ম বোধের বিষয়, বিশ্বাসের নয়। জ্ঞান ও চেতনাশূন্য ধর্মীয় বাহ্যিকতার অনুকরণ অসহায় অন্ধত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান আমরা যতোটা পালন করি, যদি তার সামান্যতমও বুঝতাম, তবে ধর্মের সৌন্দর্য আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলত। ঈশ্বর আমাদের সৌভাগ্য দান করেন কর্মের মধ্য দিয়ে, আচরিত ধর্মের মধ্য দিয়ে নয়। বিশ্বাস ও অনুকরণ ধর্ম নয়, বোধ ও কর্মই ধর্ম।