ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (২৯শ অংশ)

ভাবনা: একশো সাতানব্বই।

……………………………………..

দেখলাম ফেদেরিকো ফেলিনির লা স্ট্রাডা।

ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর দ্য ৪০০ ব্লোস (এই মুভিটা দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই যে এটা পরিচালকের প্রথম কাজ।), ভিত্তোরিও ডি সিকোর বাইসাইকেল থিভস (আমাদের সত্যজিত এই মুভি দেখে ঠিক করেছিলেন, উনিও মুভি বানাবেন।), মাজিদ মাজিদির চিল্ড্রেন অভ হেভেন, ওয়াল্টার সালেসের দ্য মোটরসাইকেল ডায়রিস, ঋত্বিক ঘটকের নাগরিক, সত্যাজিত রায়ের অপু ট্রিলজি এইসব ছবির পর আমার ঝুলিতে গতরাতে আরও একটা নিউরিয়ালিস্ট ঘরানার গল্পের ছবি জমল।

Why was I born? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই যারা সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয় স্রেফ মৃত্যু এখনও আসেনি বলে, যাদের জন্য জীবনযাপন মানেই মৃত্যুকে কোনও রকমে পাশ কাটিয়ে চলা, ওরকম ২ জন প্রান্তিকশ্রেণীর নরনারীর প্রেম আখ্যান ‘লা স্ট্রাডা’। জাম্পানো রাস্তায়-রাস্তায় খেলা দেখায়, রাস্তাতেই ঘুরে বেড়ায়; সাথে থাকত রোসা। রোসা মারা গেলে তার ছোট বোন গেলসোমিনাকে মাত্র ১০ হাজার লিরা’র বিনিময়ে গরীব মায়ের কাছ থেকে কিনে নেয় জাম্পানো। জাম্পানো জীবিকার প্রয়োজনে গেলসোমিনাকে সাথে রাখে। লা স্ট্রাডা শব্দের অর্থ হল দ্য রোড বা পথ। গেলসোমিনার মায়াবী মুখ, সাবলীল অভিব্যক্তি, প্রেমময় অভিমান, সরল ভালোবাসা; এই সবকিছুকে ছাপিয়ে এই ছবিতে বড় হয়ে উঠেছে রাস্তার আখ্যান। যে নারী চোখের ইশারায় সবকিছু বুঝিয়ে দেয়, তার ভালোবাসি, আপাতত ভালোবাসছি না, রেগে আছি, কষ্ট পেয়েছি—এইসব মুখে না বললেও চলে। আমাদের সুচিত্রা সেনের মতই এই ছবির নায়িকা জিউলিয়েতা ম্যাসিনা ছবির চরিত্রের সারল্য, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, অভিমান সবকিছুই চোখ আর মুখের নিপুণ এক্সপ্রেশনে ফুটিয়ে তুলেছেন। মুভি না দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না, কতটা নিখুঁতভাবে উনি কাজটি করেছেন!

মেয়েরা যাকে পছন্দ করে, যদি কোনও ভাবে জানতে পারে, সেই ছেলেটা অন্য কোনও মেয়েকে কোনও এক সময়ে পছন্দ করত, কিংবা এখনও করে, তাহলে জিজ্ঞেস করতেই থাকে করতেই থাকে, ওই মেয়েটা এরকম করত কি না, ওরকম করত কি না—যা কিছু সে করে কিংবা করে না কিংবা করতে পারে না; ওই মেয়েটার কথা সে কী ভাবছে—সেই ছেলে ওর কথা আদৌ ভাবুক আর নাই বা ভাবুক, মেয়েটার কী কী ওর চেয়ে সুন্দর কিংবা অসুন্দর; এইরকম আরও অনেক কিছু। এই সব প্রশ্নের উত্তরে ছেলেটা যতই ‘না’ বলুক, যতই এড়িয়ে যাক, ওতে কোনও কাজই হয় না; বরং এভাবে করে মেয়েটা নিজের অজান্তেই ছেলেটাকে আরও বেশি করে যেন ওই মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দেয়, এমনকি সে যদি ওর কথা ভুলেও যায়, তবুও! এই ছবিতেও আমরা ফিমেল সাইকোলজির এই খেলাটা দেখি, যখন গেলসোমিনা প্রায়ই জাম্পানোকে জিজ্ঞেস করে, রোসা এটা করত কি না, ওটা বলত কি না, এই কাজটা কীভাবে করত, জাম্পানো রোসার সাথে কী করত, কী করত না, কীভাবে করত—সব কিছুই। মেয়েদের এই কৌতূহলগুলোই যেন মেয়েদের মেয়ে করে রাখে, আর তখন ওদের ভালো না বেসে কিছুতেই পারা যায় না। ভালোবাসায় তো ন্যাগিং থাকবেই, যদিও এই ন্যাগিং ছেলেদের মধ্যে ততটা প্রকট নয়। তবে কি একেবারে সব কিছু দিয়ে নিজের মত করে ভালোবাসার ক্ষেত্রে ছেলেরা পিছিয়ে? এটা কি ঔদাসীন্য? নাকি, নির্লিপ্ততা? নাকি, নিঃস্পৃহতা? নাকি, অশরীরী প্ল্যাটোনিক ভালোবাসার প্রতি সহজাত পুরুষসুলভ অনাগ্রহ? থাক, সে আলোচনা এখানে নয়।

এই ছবিতেও আমরা তা-ই দেখি। জাম্পানো আর গেলসোমিনা যে সার্কাসে কাজ করত, সেখানের আরেক কর্মী ইল মাত্তো, যে জাম্পানোকে প্রায়ই কোনও না কোনও ছুতোয় খেপিয়ে দিতো, ওকে একদিন রাগের মাথায় খুন করে রগচটা জাম্পানো। আইরনি হল, যখন জাম্পানোর দুর্ব্যবহার, পরনারীতে আসক্তি, শারীরিক আঘাত, ঔদাসীন্য সহ আরও অনেক ব্যাপারে বিরক্ত-হতাশ হয়ে গেলসোমিনা ঠিক করেছিল, সে জাম্পানোকে ছেড়ে যাবে, তখন এই ইল মাত্তোই গেলসোমিনাকে বলেছিল, পৃথিবীতে কোনোকিছুই কারণ ছাড়া ঘটে না, জাম্পানোর সাথে সে রয়েছে, থাকুক; সে যেন জাম্পানোকে কখনও ছেড়ে না যায়; যদিও সে নিজেই গেলসোমিনাকে ভালোবাসত এবং ভালোবাসার স্যুভেনির হিসেবে সে তার নিজের গলা থেকে চেইন খুলে গেলসোমিনার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। ইল মাত্তোর হেসেখেলে সহজভাবে জীবন কাটানোর ধরন ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটে-চলা মানুষদের পর্যন্ত ভাল লাগবে। লাইফ ইজ বিউটিফুল, বাইসাইকেল থিভস, চিল্ড্রেন অভ হেভেন, অ্যামিলি, ইকিরু এবং এমন আরও কিছু মুভিতেও আফসোস ছাড়া সহজভাবে জীবনকে কাটানোর ব্যাপারগুলো মুগ্ধভাবে খেয়াল করার মত। ওই খেয়ালী খুন গেলসোমিনার মনে তীব্র আঘাত দেয়। সে কিছুতেই এই ব্যাপারটাকে ভুলতে পারছিল না, ফিরেফিরে ইল মাত্তোর কথাই বলছিল নিজের অজান্তেই। জাম্পানো এই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আহত নারীকে রাস্তার পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে চলে যায়। সে আবারও বোহেমিয়ান জীবন কাটাতে থাকে। কয়েক বছর পর এক অপরিচিতাকে সে একটা গান গাইতে শোনে, যেটার সুর সে গেলসোমিনাকে শিখিয়েছিল। সে ওই নারীর সাথে কথা বলে জানতে পারে, সে ফেলে আসার পর কিছুদিনের জন্যে অসহায় গেলসোমিনার ঠিকানা হয়েছিল ওদের বাড়িতে, পরে সে মারা যায়। সে ওই গান শিখেছে গেলসোমিনার কাছ থেকে। এই কথা জাম্পানোর বুকে পুরনো সুর পুরনো স্মৃতি জাগিয়ে দেয় যেন! ওয়ার্ডসওয়ার্থের সলিটারি রিপারের সুরও কি এভাবে করেই কবিকে বিহ্বল করেছিল?

গেলসোমিনার সকল আবেগ-অনুভূতি-অভিব্যক্তি-ভাবালুতার প্রতি জাম্পানোর নিঃস্পৃহতা-ঔদাসীন্য-বিরক্তি যে গেলসোমিনাকে একদিন এটা ভাবতে বাধ্য করেছিল যে সে জাম্পানোকে ছেড়ে যাবে, সেই গেলসোমিনাকেই যখন জাম্পানো বাড়ি রেখে আসতে চায়, তত দিনে সে জাম্পানোকে ভালোবেসে ফেলেছে; এতটাই যে, সে ভাবে, যদি সে জাম্পানোকে ছেড়ে যায়, তবে মানুষটা কাকে নিয়ে বাঁচবে? (If I don’t live with you, who will?) নারীর এই চিরন্তন ভালোবাসার কাছে পরাজিত পুরুষের বৈষয়িক বুদ্ধির প্রতি আমাদের প্রচণ্ড ধিক্কার জন্মে যখন দেখি, অভ্যস্ত জীবনকে পেছনে ফেলে রেখে অনভ্যস্ত আপাতমুক্ত জীবনের মোহ জাম্পানোকে কুন্দেরার উপন্যাসের মত ভাবায়, জীবন হয়তো অন্য কোথাও। আমাদের বারবার মনে হতে থাকে, জীবিকার কাছে জীবনের কী নির্মম পরাজয়! মুভির শেষ দৃশ্যে দেখি, নায়ক অ্যান্টনি কুইন জীবনের সকল সুর হারিয়ে মুখ থুবড়ে কাঁদতে থাকে সাগরপাড়ে; সামনে পড়ে থাকে স্বচ্ছল অর্থহীন দুর্ভার একটা জীবন। পরিচালক কি এখানে অতি ক্যারিয়ারিস্ট মনোবৃত্তি মাঝেমাঝে জীবনকে কতটা নিষ্প্রাণ ট্র্যাজিক করে তোলে তার প্রতি কোনও ইঙ্গিত দিয়েছেন?

পাদটীকা। সার্বিয়ান ব্যান্ড তাদের দলের নাম ‘লা স্ট্রাডা’ নির্বাচন করেছে এই ছবি থেকেই। বব ডিলান তাঁর বিখ্যাত মিস্টার টাম্বুরিন ম্যান গানটি তৈরি করেছেন এই ছবির প্রভাবেই। এ মুভির অসাধারণ নায়িকা জিউলিয়েতা ম্যাসিনা পরিচালক ফেলিনির স্ত্রী।

ভাবনা: একশো আটানব্বই।

……………………………………..

ছোটবেলায় মহালয়ার দিনে খুব ভোরে মা ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন। আমরা সবাই মিলে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের নেশা জাগানিয়া কণ্ঠে মহালয়া সংগীত শুনতাম। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলত সংগীতে দেবী দুর্গার আগমনী আবাহন। সেই কথায় আর সুরে প্রাণে যে চাঞ্চল্য আর পবিত্রতার সৃষ্টি হত, সেটা এখনও হয়। ছোটবেলার আনন্দ-অনুভূতিগুলি অতটা বদলায় না। কিছু-কিছু ভেতরের বিষয় আসলে কখনওই শরীরমন থেকে মুছে যায় না। এসব নিয়েই মানুষ। এসবের উপর কেউ আঘাত হানলে, সেটা যত যৌক্তিকই হোক না কেন, মানুষ কিছুতেই সেটা মেনে নেবে না। এটাই স্বাভাবিক, চিরন্তন। তাই উগ্র আস্তিকতার বাড়াবাড়িতে অন্য ধর্মের প্রতি আক্রমণ কিংবা উগ্র নাস্তিকতার অসুস্থতায় সকল ধর্মের অসারত্ব ঘোষণা, এর কোনওটাই আমরা কেউ সহজভাবে নিই না, কখনও নেবোও না। আমি এতদিন ধরে যা ধারণ করে ভাল আছি, তুমি এমন কে যে আমাকে বলছ, আমি ভুল কিছু ধারণ করে ভুলভাবে ভাল আছি? আমি তো তোমার কোনও বিশ্বাস নিয়ে তোমাকে ঘাঁটাতে যাচ্ছি না। সব ধর্মের মূল কথাই তো একটি : Live, let live. এটা থেকে সরে আসাটা দুর্বলতা আর অজ্ঞতার পরিচয় দেয়। মানুষ তো তার কর্মের জন্য দায়ী, জন্মের জন্য নয়। ধর্ম তো আর জন্মের পর কেউ নিজ বিচার-বিবেচনায় বেছে নেয় না। যে বিষয়টার কৃতিত্ব কিংবা অকৃতিত্ব আমার নয়, সেটি দিয়ে আমাকে বিচার করলে, সে বিচার বিবেচনা-বুদ্ধিহীনতারই পরিচয় দেয়।

সেই ১৯৩৭ সাল থেকে যে মহালয়া সংগীত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ মহালয়ার স্নিগ্ধ ভোরবেলায় আমাদের হৃদয়মনকে একটা অবিচ্ছিন্ন লয়ে আর সুরে দোলা দিয়ে-দিয়ে জাগিয়ে আসছে, সেটির রচনা ও প্রবর্তনায় ছিলেন বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। আকাশবাণীতে ১৯৩২ সালে প্রথম যখন এই অপূর্ব প্রভাতসংগীতটি বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গ্রন্থনায় পাঠ হয়েছিল, তখন এর নাম ছিল ‘শারদ বন্দনা’।

“আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ম্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্ত্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবনমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী ঊষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ।”

শুনলে কেমন জানি একটা আশ্চর্যরকমের পুরনো ভাললাগা কাজ করে না? মনে হতে থাকে না, বুঝি সেই দিন ফিরে এল! এটা শুধু সংগীত নয়, এটা একটা অনুভূতি! আমাদের বেড়ে ওঠার অনেক অনুষঙ্গের মধ্যে এটি একটি। ছোটবেলায় পুজোর সময় পড়তে হত না। পড়তে না হওয়াটা সবসময়ই খুব আনন্দের। মহালয়ার সংগীত মানেই, পড়তে হবে না, এমন কিছু দিনের শুরু! রক্তের মধ্যে সেই পুরনো অকৃত্রিম টানটা এখনও অনুভব করি।

ভদ্র মহাশয়ের ভাবাপ্লুত কণ্ঠের আগমনী আবাহন উদ্বোধনী পূর্ণতা পায় পর পর তিনবার বজ্রনির্ঘোষ শঙ্খধ্বনিতে। এরপরেই আমরা অসীম মুগ্ধতায় শুনি ……বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন…….. আহা! সমস্ত শরীরমন যেন একেবারে জেগে ওঠে! এই গানটিও বাণীকুমারেরই লেখা, পঙ্কজকুমারের সুর করা। এ গানটি যিনি গেয়েছেন সেই সুপ্রীতি ঘোষের কথা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। তিনি ছিলেন বিশ শতকের সামনের সারির শিল্পীদের অন্যতম। আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, এবং নজরুলগীতিতে তাঁর অবদান প্রাতঃস্মরণীয়। তবে তিনি আমাদের অনুভূতিতে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন মহালয়ার ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’র মাধ্যমে। এই গানটি শুনলেই সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করে এখনও মনে হয়, পুজো এসে গেছে! পুজো এসে গেছে!! এ অনুভূতি যে কী অপার্থিব, সেটা লিখে বোঝানো যাবে না। তখন মনে হয়, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর অনুভূতি ‘পুজো শুরু হয়ে গেছে!’ এ অনুভূতির দাম লক্ষ টাকা!

১৯৭৬-এর ২৩ শে সেপ্টেম্বর জরুরী অবস্থা চলাকালীন মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে সরিয়ে ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’ নাম দিয়ে এক বিকল্প অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল। সেটিতে রূপদান করেছিলেন অভিনেতা উত্তমকুমার, সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর সহ বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। পরবর্তীতে বাণীকুমারের অনেকটা একক প্রচেষ্টায় আমাদের মহালয়ার গান আবারও আমাদের গর্বের অংশ হয়ে যায়। সম্রাট শাজাহানের যেমনি তাজমহল, তেমনি বাণীকুমারের মহিষাসুরমর্দিনী। এমনকি বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ব্রাহ্মণ নন বলে উনাকে দিয়ে মার্কন্ডেয় সপ্তশতী চন্ডীর সংক্ষিপ্তসার কিংবা মহাশক্তি-সম্বন্ধে বৈদিক ও তান্ত্রিক তত্ত্বের ব্যঞ্জনা পাঠ করানো যাবে না কোনও ভাবেই, এরকম একটা আন্দোলন সূচনাতেই শক্ত কঠোর হাতে রুখে দেন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য, অর্থাৎ বাণীকুমার। তিনি নজরুল, জরাসন্ধ সহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি নিজেও একজন ভাল লেখক ছিলেন। বেতার নাটকে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

ভাষ্যকার, শ্রুতিনাট্যকার, নাট্যকার বা নাট্যাভিনেতা হিসেবে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা থাকলেও তাঁর সর্বাধিক পরিচয়, তিনি বেতার মাধ্যমে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্তোত্রকার এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ধারাভাষ্য করেছিলেন। পিতৃপক্ষের শেষে দেবীর আগমনী বার্তা ঘোষণাতেই মহালয়ার মাহাত্ম্য নিহিত। আর এই ক্ষণটিকে মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে আমাদের প্রাণে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ার পেছনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমারকে আমরা শারদক্ষণে প্রণাম জানাই। কিছু-কিছু সৃষ্টিশীল মানুষের কাজে, চেষ্টায় আমাদের সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি সেই শৈশব থেকেই একটু-একটু করে গড়ে ওঠে। এই অনুভূতিতে অন্যকিছু চাপিয়ে দেয়া হলে আমাদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। যার অস্তিত্বই নেই, তার কিছুই হারানোর ভয় থাকে না। সে তখন দ্রোহঘোষণা করে। তাই, শ্রেষ্ঠ মত বলে আসলে কিছু নেই। মানুষ যেভাবে করে ভাল থাকে, কিংবা ভাল থাকতে সেই জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার আগে থেকেই শিখে এসেছে, অতএব অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সেটাকে মিথ্যে কিংবা ভুল প্রমাণিত করতে গেলেই সেটা জোর করে, কণ্ঠরোধ করে চাপিয়ে দেয়া হয়। লেনন অনেক বড় শিল্পী, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার কাছে, যে হেমন্ত আমার হৃদয় মন প্রাণের পরিচর্যা করেছেন পরম বিশ্বস্ততায় সেই শৈশব থেকেই, তাঁকে আমি লেননের চাইতে ছোট মানি কী করে? অনুভূতির শুদ্ধতায় পৃথিবীর কোনও যুক্তিই চলে না। ধর্মের অনুভূতি পৃথিবীর শুদ্ধতম অনুভূতিগুলির অন্যতম।

আজ মহালয়া। পুণ্য শাঁখে চতুর্দিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে : দেবী এসেছেন! দেবী এসেছেন!!

ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। সবাইকে শারদীয়া শুভেচ্ছা। সবার পুজো ভাল কাটুক।

(কোনও এক মহালয়ার ভোরে লেখাটি লিখেছিলাম।)

ভাবনা: একশো নিরানব্বই।

……………………………………..

আমারে নিবা মাঝি লগে? এই কথাটাতে নারীর চিরন্তন রূপ ধরা দিয়েছে৷ তোমরা কপিলার চরিত্র আলোচনা করার সময় এই ব্যাপারটাতে খুব ভালোভাবে হাইলাইট করবে৷ দ্যাখো, কপিলা কিন্তু বাংলা সাহিত্যে খুব শক্তিশালী একটা নারীচরিত্র ………. ব্লা ব্লা ব্লা ……….. ম্যাডামের নাম ভুলে গেছি৷ (মানে, বলব না।) আমরা ডাকতাম, কপিলা ম্যাডাম৷ উনি ক্লাসে সারাক্ষণ কপিলাকে নিয়ে বলতেন৷ সবসময় বলতে-বলতে এক সময় উনি দেখতেও একটু কপিলা-কপিলা টাইপ হয়ে গিয়েছিলেন৷ ম্যাডামকে আমার সেই সময়ে খুউব ভালো লাগত৷ শুধু উনাকে খুশি করার জন্যেই কপিলার চরিত্র বিশ্লেষণ লাইব্রেরিতে বই ঘেঁটে-ঘেঁটে কোটেশন-টোটেশন দিয়ে নোট করেছিলাম৷ (যদিও ওই প্রশ্নটা পরীক্ষার জন্য ‘ইম্পর্টেন্ট’ ছিল না।) নোট দেখে ম্যাডামের সে কী হাসি, তা দেখে আমি সে কী খুশি! ম্যাডাম সুন্দরী ছিলেন না, তবুও কী একটা যেন ছিলেন৷ চট্টগ্রাম কলেজের ২০০২ ব্যাচের বন্ধুরা, ফিজিক্সের সেইরকম ড্যাশিং রাফিকা ম্যাডামের কথা যাদের এখনও মনে আছে (মানে, ভুলতে পারনি আরকি!), তাদের কি চপলাচাহনি কুবেরের ভাবপ্রেমিকার কথা একটুও মনে নেই?

গ্রীষ্মের রাগী দুপুর৷ চিটাগাং কলেজের গ্যালারি ক্লাসরুম৷ দোতলায় বোধ হয়৷ যে গ্যালারিগুলোতে জানালার পাশে বসে চিটাগাং কলেজ আর মহসীন কলেজের মাঝের রাস্তাটা চোখে পড়ে, সেগুলোর একটাতে ক্লাস হচ্ছে৷ ওইদিন বেশ কিছুক্ষণ ধরেই খুব কিউট একটা ইঁদুরের বাচ্চার কান নাড়ানাড়ি আর ছোটাছুটির কাছে কিশোরবেলার প্রেমিকার(!) কপিলা সম্পর্কিত লেকচার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে৷ সেইসব দিনগুলিতে ক্লাসে বসে-বসে অন্য কিছু করার বয়েস ছিল৷ বুড়ো-বুড়ো বটগাছগুলির পাতার ফাঁকে-ফাঁকে রাস্তার লোকজন হাঁটে, গাড়ি ছোটে৷ জানালার জংধরা খয়েরি গ্রিলে বিশ্রীরকমের বড়োবড়ো কয়েকটা পিঁপড়া একটা শুকনো পাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে৷ পাতায় কী আছে, কে জানে! আমার সামনের বেঞ্চের ছেলে দুটো ফ্রন্ট রো-তে বসা মেয়েদের দিকে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দেবে বলে লুকিয়ে-লুকিয়ে কাগজে যা লিখেছে, তা আমি লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখে ফেলেছি বলে মনেমনে হাহাহিহি করছি৷ (তখন এরকম মোবাইলের চল হয়নি৷ বাবাদের হাতেও মোবাইল ছিল না৷ কথা বলতে মিনিটে বোধহয় ১০ টাকা লাগত।) একটা মেয়ে (নাম বলব না) গাঢ় কমলা রঙের লিপস্টিক দিয়ে সঙ সেজে এসেছে৷ সবাই তাকে ‘অমুকের বউ’ বলে-বলে ক্ষ্যাপাচ্ছে৷ আমরা সি সেকশনে ছিলাম, ওই অমুক অন্য সেকশনে ছিল৷ একেবারে ওপরে লাস্ট বেঞ্চে জানালার পাশে বসে-বসে প্রতিদিনের মত ওইসব দেখছিলাম৷

মিল্কভিটার শাদাশাদা ভ্যানগুলো এসে থামত, সেইদিনও থেমেছিল৷ হঠাৎ দেখি, একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে চিৎকার করতে করতে রাস্তা পার হচ্ছে৷ দুধের ভ্যানটার পেছনের চাকার পাশে বসে হামাগুড়ি-দেয় এমন বয়েসি একটা শিশু ওপরের দিকে হাঁ করে আছে৷ ভ্যানের গায়ে জমে-যাওয়া দুধ ফোঁটায়-ফোঁটায় চাকার পাশের নিচু রডটা দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল হয়তো৷ ওরকম তো পড়েই৷ শিশুটা তা-ই খাচ্ছিল বোধ হয়৷ চাকার আড়ালে ওকে ঠিক চোখে পড়ছিল না৷ অবশ্য, চোখে পড়লেও দেখতে হয় না যাদের, ওই শিশুটা ওই সমাজের৷ ভ্যানটা স্টার্ট নেবেনেবে করছে, শিশুটা চাকার পাশেই খুশিতে হাততালি দিচ্ছে৷ চাকা একটু এগোলেই শিশুটার অনর্থক অস্তিত্ব পৃথিবী ছেড়ে শুধু কবিতার পঙক্তিতেই ঠাঁই পাবে একেবারেই, এরকম জায়গায় ছিল শিশুটা৷ তা দেখে বাচ্চা মেয়েটা (ওর বড় বোন নাকি?) দৌড় দিয়েছিল৷ রাস্তার মাঝখান দিয়ে ওভাবে দৌড়ালে দেখেশুনে দৌড়ানো যায় না৷

মিল্কভ্যানটা আর স্টার্ট নেয়নি বলে শিশুটা সেইদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল৷ ড্রাইভার যে শিশুটাকে বাঁচাতে গাড়ি স্টার্ট দেয়নি তা নয়, (ওকে দেখাই তো যাচ্ছিল না, বাঁচাবে কী!) একটা হলুদরঙের ট্যাক্সির ধাক্কায় ছিটকে-পড়া বাচ্চা মেয়েটার নিথর শরীর ঘিরে জড়ো-হওয়া ভিড়ে সে-ও ছিল দর্শক হিসেবে, তাই দিতে পারেনি। সেইদিন বাথরুমে যাওয়ার নাম করে ক্লাস থেকে রাস্তায় ছুটে যাই৷ (সত্যি কথা বললে ম্যাডাম হয়তো যেতে দিতেন না; অবশ্য এইসব ছোটোলোকদের অ্যাক্সিডেন্টে ভদ্রলোকদের যাওয়ার দরকারই বা কী? ওরা তো বেঁচেই আছে, এখনও মরে যায়নি, স্রেফ এই জন্যই৷) না, মেয়েটা জ্ঞান হারায়নি৷ পা কেটে গেছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে, হাতও মচকে গেছে মনে হয়েছিল৷ যন্ত্রণায় কাতরাতে-কাতরাতে সে তার ভাইকে খুঁজছিল৷ সে জানে, সে বেঁচে থাকার মানেই ওই ছোট্টো শিশুটার একটুখানি হাসি, আর কিছু নয়৷ কেউ-কেউ তো অন্য কারও হাসির জন্যই বেঁচে থাকে৷ কিছু লোক ওকে ধরাধরি করে ওষুধের দোকানে নিয়ে গেলো৷ (ওখানে ব্যান্ডেজ করা যায়।) দুজন অমানুষ ওর হাত থেকে পড়ে-যাওয়া খুচরো কয়েন আর ছেঁড়াফাটা কাগুজে নোট পকেটে পুরেছিল; আমি দেখেছি৷ হয়তো ওরা আসলে অমানুষ নয়, ওরা আরও গরীব৷ অবশ্য এত বেশি অসহায় গরীবলোক মানুষই বা হতে যাবে কোন যুক্তিতে? অমানুষই তো ওরা!

দৌড়ে ক্লাসে এসে ব্যাগ নিয়ে পরের ক্লাসে ‘মে আই কাম ইন, স্যার’ বলে ঢুকে পড়ি। পরের ক্লাসটা ছিল ফিজিক্সের৷ আমার একটা অভ্যেস ছিল, ক্লাসে বসে-বসে ‘গীতবিতান’ পড়া, ওটা ব্যাগে থাকত সবসময়৷ ২-১ জন বন্ধুর সাথে প্যারেড কর্নারে বসে গীতবিতানের লাইন মুখস্থ বলার চাপাবাজি করতাম৷ মাঝেমাঝে ক্লাসের মেয়েদের ইম্প্রেস করতে বাংলা ক্লাসে নমস্য লেখকরা আমাদের কারও-কারও ঠোঁটে আসতেন৷ (পরে বুঝেছি, মেয়েরা ওতে পটে না, বরং সে ছেলেকে ছাগল ভাবে।) সেইদিন ফিজিক্সের ক্লাসে রবি ঠাকুর আর মোজাম্মেল স্যার দুজনই ফেল মেরে বসেছিলেন ওই রাস্তার কাগজকুড়ুনি ভিখিরি মেয়েটার কাছে৷

থ্রিটোয়েন্টিনাইন….! থ্রিটোয়েন্টিনাইন……..!! সেইদিন কেউই বলেনি, প্রেজেন্ট প্লিজ! ৩২৯ রোলনাম্বারের কিশোরটা ব্যাগে মুখ গুঁজে (কিশোর বয়েসিদের, অন্য অনেক কিছুর মতই, কান্নাটাও ব্যক্তিগত৷ তাই ওরা দেখিয়ে কাঁদে না) লাস্ট বেঞ্চে ভেজাভেজা চোখে বসেছিল বলে নয়, ওর প্রক্সি দিত যে ছেলেটা, সে ওইদিন ক্লাস করেনি, তাই৷)

ভাবনা: দুইশো।

……………………………………..

আমার জন্মতারিখ ২ নভেম্বর। আনন্দের বিষয়, শাহরুখ খানের জন্মও ওই দিনে। আমি উনাকে পছন্দ করি। বড় মানুষকে অপছন্দ করার সহজাত প্রতিভাটা ঈশ্বর আমাকে কোনও এক রহস্যময় কারণে দেননি। আমি বড় মানুষদের অন্ধভাবে পছন্দ করার অপরিসীম প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ। টেন্ডুলকারও একটু কষ্ট করে ওইদিন জন্মালেও পারতেন। আমার ভাল লাগত। ২ নভেম্বর আর ২৪ এপ্রিল একই কথা। তাই অন্তত আমার ভাললাগার জন্যে হলেও……..

আমি রাশিটাশিতে বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা, রাশিফল সবাই দেখে আর বেছে নেয়, ওটার যতটুকু ভালো লাগে, ততটুকুই। এই যেমন, রোমান্স শুভ, এই টাইপের। আমি নিজেও তা-ই করি। আমি খেয়াল করে দেখেছি, যেদিন-যেদিন আমার রোমান্স শুভ থাকে, সেদিন-সেদিন আমি বসের বকা বেশি খাই। এটার কোনও রহস্য থাকতে পারে, যেটা আমি জানি না। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় পেয়েছিলাম, প্রকৃতি রহস্য পছন্দ না করলেও রহস্য করতে পছন্দ করে। খুব ঠিক কথা! অবশ্য যার গার্লফ্রেন্ড নাই, সে বসের বকা খাবে না তো কি মুড়ি খাবে? পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে বকা দেয়ার জন্যও কাউকে লাগে। গার্লফ্রেন্ডমাত্রই তো বসের কাছাকাছি। আচ্ছা, যাদের গার্লফ্রেন্ড আছে, ওরাও কি রোমান্স শুভ হলে গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে বকা খান? (উত্তরটা কমেন্টে সত্যিসত্যি আশা করছি।) বসের বকা অপেক্ষা গার্লফ্রেন্ডের বকা উত্তম। আমার রাশিতে রোমান্স শুভ দেখলেই আমার বুক ধড়ফড় করা শুরু করে। আমার জন্মতারিখ বিচারে ওয়েস্টার্ন অ্যাস্ট্রোলজি বলে, আমি বৃশ্চিক রাশির জাতক। ওরিয়েন্টালে বলে, আমি কুম্ভ। আমার মা আমাকে কুম্ভ(কর্ণ) ভাবতে বেশি পছন্দ করেন। আমি যা করি, তা হল, রাশিফল দুটোই দেখি। এরপর বীজগণিতের সেটের নিয়মে দুটোকে ইন্টারসেকশন করে যেটা-যেটা ভালো মনে হয়, সেটা-সেটা নিয়ে নিই। রোমান্স শুভ নিতে না পারাটা ভয়াবহ কষ্টের একটা ব্যাপার। তাই, কষ্টে আছি, ভয়াবহ কষ্ট।

আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে এই গানটার জন্যে আজীবন মনে রাখব। সুন্দর-সুন্দর গান যারা লিখে, সুর করে, গায়, ওদেরকে আমার শুধুই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, সবসময়ই আপনআপন লাগে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবলকে দেখলেই আমার মনে হয়, উনার জন্য আমরা সব কটা জানালা খুলে দাওনা’র অপূর্ব সুরটা পেয়েছি। আবার এল যে সন্ধ্যা শোনার সময় হ্যাপি আখন্দের জন্যে বুকের ভেতর কেমন যেন একটা কষ্ট অনুভব করি। আচ্ছা, কিছু মানুষ মৃত্যুতেও অন্যদের সেলফিশ এক্সপেকটেশন থেকে মুক্তি পান না, না? শুধুই মনে হতে থাকে, উনি বেঁচে থাকলে হয়তো আমরা আরও কিছু পেতাম। শুধু ব্যক্তি মানুষটার জন্য মানুষটাকে মনে রাখে উনার নিজের পরিবার। বাকিদের মনে রাখার মধ্যে স্বার্থপরতার একটা ব্যাপার আছে। বড়ই গৌরবের সেই স্বার্থপরতার উপলক্ষ হতে পারা! আর কে নারায়ণের Under The Banyan Tree গল্পের সেই অমোঘ কথাটি মনে পড়ে গেল: What is the use of the lamp when all its oil is gone? খুব খুব খুব সত্যি একটা কথা!

আমি পেপারটেপার খুব একটা পড়ি না। শনিবারের প্রথম আলো পড়ার সময় প্রথমেই যে জিনিসটা আগ্রহ নিয়ে পড়ি, সেটা হল, ছুটির দিনে’তে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সপ্তাহের রাশিফল পাতাটা। এটা করি ২টা কারণে। উনার প্রতি ভালোবাসা থেকে এবং উনার লেখাতে সেন্স অব হিউমারের জন্য। আমি খেয়াল করে দেখেছি, উনার কিছু-কিছু কথাকে ভাল লাগাতে ইচ্ছে করে। কেন করে, এটা বলা শক্ত। ভাল লাগাতে ইচ্ছে করার কোনও কারণ থাকে না, এটা হয়ে যায়। তবে এইটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই ভাল লাগার ক্রেডিট উনার দেয়া রাশিফলের নয়, লেখার ধরনের। রাশিফলে আমার বিশ্বাস নেই বলে বলতে এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে, উনার রাশিফল আমার সাথে অনেক সময়ই মিলে যায়। উনি ওয়েস্টার্ন অ্যাস্ট্রোলজি ফলো করে লেখেন। এক দিনেরটা বলি। ওটা আমার পছন্দ হয়েছিল। বৃশ্চিকে উনি লিখেছেন : শূন্য ঘর আর ঘরময় শূন্যতা এক নয়…….যেমন দূরে থাকা আর দূরেদূরে থাকা এক নয়। পছন্দ হওয়ার দুটো কারণ আছে। এক। ওটা আমার পছন্দ হয়েছে। দুই। উনি ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’ লিখেছেন।

যারা হুমায়ূন আহমেদ পড়েন, তাদের জন্যে ২টা ক্যুইজ : এক। উনার হিমু চরিত্রটা কোন লেখা প্রভাবিত? মানে, কোন বইটা পড়ার পর উনি ঠিক করেছিলেন, উনি হিমুকে সৃষ্টি করবেন? দুই। উনি ঠিক করেছিলেন, উনি কবিতা লিখবেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য, আরেক হুমায়ূন উনাকে কবিতা লেখা থেকে নিজের অজান্তেই সরিয়ে এনে গল্পের হুমায়ূন করে দিয়েছেন। সেই মহান পরোপকারী মানুষটি কে?

ভাবনা: দুইশো এক।

……………………………………..

“গার্গী, এমন গাধাও মানুষ হয়?”

বিনতা কি জানত, গার্গীর মত তাকেও নিজের বুকের রক্তনদীতে তার ভালোবাসার রামকে বির্সজন দিতে হবে? হৃদয়-পুজোর নৈবেদ্যের একি প্রসাদ!

এ ভালোবাসাটাও না কেমন যেন অদ্ভুত, তাই না আকাশ? যত খাঁটি, তত কষ্টের।

বিনতা আজ ভীষণ ভীষণ ভীষণ একা, আকাশের চাইতেও একা! ওই আকাশ বড় ভাল গো! একাদের জায়গা দিয়ে দেয় ওই বুকে, পরম মমতায়! আকাশের সাথে মিতালি ওর কষ্ট ধুয়ে দেয় অনেকখানিই। ওই সাদাফালির অসীম আকাশের গা-লেপটে কী এক দৈবিক যাদু খেলে-খেলে যায়—সেই আকাশের জন্মক্ষণ থেকেই, আজও একই ভাবেই! আকাশের সবকিছুতেই ওর নেশা জাগে, বুকে হৃদয়ে রোমকূপে কেমন এক শিহরণ ওকে জানাতেই থাকে জানাতেই থাকে—এই এক আকাশই কখনও তোমায় ছেড়ে যাবে না। ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরোওওও…….! ওভাবেই বেঁচো! বড় আরামের সে বাঁচা! বেঁচেই দ্যাখো না!

আর যা কিছু হারাক থাকুক, এ ভালোবাসা কখনও হারাবে না—বিনতা এখন জানে। ওর চোখজোড়ার স্বচ্ছ শরীরটা যখনি ওপরে মেলে ধরে, তখনি আকাশটা ভীষণ ভালোবেসে বলে ওঠে, “বিনতা…….বিনতা…….বিনতা! এই বোকা মেয়ে! শোনো। তুমি একা নও গো, আমি আছি তো পাশে! এই দ্যাখো! তোমার নীল বেদনার সবটুকু ছড়িয়ে দাও আমার নীলে। কষ্টটুকু আমায় দিয়ে ওড়ো, বাঁচো চুটিয়ে! জন্মালে বাঁচতে হয় যে! আমায় এমন প্রেমে জড়িয়েছ, আমার প্রেমিকা আবার একলা হয় কী করে? আমি আছি না? আমি হারাব না, আছি, থাকব তোমার ভালোবাসার চিরসাথী হয়ে! বিশ্বাস রেখো! আমিও যে তোমায় ভালোবাসি!”

বিনতার আশ্বস্ত হাসি বলে, “তাই নাকি গো, দুষ্টু আকাশ? তুমি আমার পাশ থেকে হারাবে না? জানো, সেদিন তোমায় আমার ‘ও’র গল্প বলেছিলাম না? তোমাকে ঘিরে আমাদের কত্তো স্বপ্ন ছিল, জানো? মাঝে-মাঝে, স্বর্গের দরোজা ভেঙে পালিয়ে আসা রুপোলী আলোয় আমরা দুজন মিলে কোনও এক দূরের গ্রামের সারি-সারি বাঁশঝাড় পেরিয়ে মেঠো রাস্তায়-রাস্তায় ঝিঁঝিঁপোকার ঝিঁঝিঁ-গানে ভাসব, খুশি ওর সমস্ত বাঁধ ভেঙে আমাদের ভিজিয়ে দেবে, আমরা আনন্দে গাইব হাওয়ার সুরে……. চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে॥……. হাসছ যে বড়? খুউব, না? গলা নাহয় একটু বেসুরোই, তাই বলে কি ভালোবাসাটাও বেসুরো, বলো? এই শুনো না শুনো না, আর হেসো না গো, হেসো না। ভাবতে পারো, আমার ‘ও’ আমায় ভালোবাসতো বলে কি আমার গানে মেতে ছিল, নাকি আমার গানে মেতে ছিল বলে আমায় ভালোবাসতো, সে খোঁজ আমি নিইনি বটে, তবে, এটুকু মনে আসে, রোজ-রোজ আবদার করত ওকে গান শোনাতে! শোনাতেই হত গো! আমার বেসুরের সপ্তসুরের মায়া যেন ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত ওই দূরে…….অনেক-অনেক দূরে, যেখানে দুটি আত্মার পবিত্র নরোম ছোঁয়ায়, ভালোবাসার এক নতুন সুখের মায়ায়, হাজার-হাজার বছর পার হয়ে যায়, অথচ, মনে হতে থাকে, এই একটু মুহূর্ত গেল বুঝি! ওই টের না-পাওয়ার দাম যে কতখানি! আজ কত-কত দিন হয়ে গেল, সে সুখ আমি পাইনি গো আকাশ! বড্ডো বেশি একা লাগে, কান্নার দলা গিলে ফেলতে খুউব কষ্ট গো! বড় ক্লান্ত আমি…….এই আমি’কে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় এক অমোঘ মৃত্যুর খুব কাছে, কাছাকাছিই—কে টানে, কেন টানে, কীভাবে টানে—সে উত্তরটাও খোঁজা বাদ দিয়েছি, সেও অনেক দিন হয়ে গেল। আচ্ছা শুন না, সেই কোনও এক দিন, নৈঃশব্দ্য আমাদের ছুঁয়ে দিয়েছিল। সেদিন, ওই তেপান্তরের সবুজ গালিচায় ‘ও’ আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল পরম আদরে। অনন্ত মহাকাল, মুহূর্তকালের কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। মনে আছে, সেদিন আমরা তোমার চাঁদের জোছনায় ভিজে একাকার হয়েছিলাম? সে কী অনুভূতি! অত তীব্র! অমন স্পষ্ট! জানো আকাশ, আমার এই না-পাওয়ার সুখের গল্পে দুটি ফুটফুটে পরী ফুরফুর করে উড়ত—বড়বোন প্রাপ্তি, আর ছোটবোন প্রত্যাশা। ওরা দুবোন আমার কল্পনার ওই ঝলমলে রাজ্যে একটু-একটু করে বেড়ে উঠছিল। এখনও, ওরা আমায় ভীষণ আদর করে, আগলে রাখে, আমার দুঃখটাকে দূর হাওয়ায় ভাসিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উড়িয়ে দেয়—আর আমি ভাবি, এমন সত্য, আর কী আছে? এ মায়ায় কী যে সুখ কী যে সুখ, তুমি যদি বুঝতে! আচ্ছা আকাশ, বলো না গো, কাঁচের টুকরোর মতন নাকি হৃদয় ভেঙে যায়!—সত্যিই যায়? যে মানুষ কাঁচ গড়ে, সে মানুষই কাঁচের অমন হেঁয়ালির কাছে কতটা অসহায়! ভাবা যায়? কাঁচের টুকরো তো টুকরোই থেকে যায়, হৃদয়ের টুকরোও কি তবে তা-ই? এই প্রেম, ভালোবাসা, বিশ্বাস কি এতই ঠুনকো হয়ে গেল যে, কাঁচের মতন ভেঙেচুরে সব শেষ করে দিয়ে ওদের স্রষ্টাকেই রিক্তহাতে ফিরিয়ে দেয়? মানুষের মধ্যে মায়া ঢুকে গেলে বড় বিপদ গো, আকাশ! আর বের করে দেয়া যায় না, মুছে ফেলা যায় না। সে মায়া বাড়তে-বাড়তে, একসময়, মনের চাইতেও বড় হয়ে যায়, হৃদয়ের চাইতেও অবাধ্য হয়ে পড়ে, সাম্রাজ্যের চাইতেও ছড়িয়ে থাকে। বলে দাও না আকাশ, ওই দুই ছোট্টো পরী যখন বড় হয়ে হাজার প্রশ্নে কুপোকাত করবে আমায়, তখন আমি কী করবো? আমি যে কিছুই জানি না গো! আমি শুধু বিসর্জন দিয়েই চলেছি আমার সব জ্যান্ত স্বপ্নগুলোকে। দেবী দুর্গার ভাসানে কী কষ্ট, তা কি ওই ভক্ত ছাড়া কেউ বোঝে গো? বোঝে না বোঝে না। তাই, ওদের চোখ ঊষর মরুভূমিকেও এক ফুঁয়ে হেলায় হারিয়ে দেয়। ওরা দ্যাখে, একটা মাটির পুতুল ভাসছে, ভেসে যাচ্ছে, ডুববে একটুপরই—এই তো! আর কিচ্ছুটি বোঝে না, মাথায় আনে না। ওইটুকুতেই ওদের বাঁচা! শুনো না গো আকাশ, একটু বৃষ্টি দাও না। আমার যে দেখিয়ে কাঁদতে বড় লজ্জা লাগে! চোখের জলে আর শেকল পরাতে পারি না! কী যন্ত্রণা! বড় কষ্ট! দাও না গো বৃষ্টি! কেঁদে ওঠো! কথা দিচ্ছি, তোমাকে একা ঝরতে হবে না, এই বন্ধুটি তোমার কান্নার সাথী হবে সেই পুরনো বিশ্বস্ততায়। বুকটা বড্ডো ভারি হয়ে আছে গো! কিছুসময় চিৎকার করে অঝোরে কাঁদবো। আমি হালকা হতে চাই, পাখির পালকের মত ভাসতে চাই, রেশমি চুলের মত দুলতে চাই।—আর পারছি না! আজ তোমার বৃষ্টির শরীরকে আলিঙ্গন করে নাহয় অপ্রাপ্তির খাতায় পড়েথাকা আরও কিছু স্বপ্নকে বিসর্জন দিই…….”

“প্রিয় গার্গী, হ্যাঁরে, মানুষই গাধা হয়!”

ভাবনা: দুইশো দুই।

……………………………………..

“………..আমার যত লেখা চুরি করে লোকে নিজের নামে চালিয়েছে, এ লেখাটি সেগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বার চুরি হয়েছে। ওসব চোরছ্যাঁচড়ার দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের ডিরেক্টর থেকে শুরু করে একেবারে সার্টিফিকেটসর্বস্ব গণ্ডমূর্খরাও আছেন।”

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক’ কথাটি উল্লেখ করায় যে ভদ্র মহোদয়গণ কিঞ্চিৎ ‘মাইন্ড খেয়েছেন’ তাঁদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা:

এক। আপনি অন্য কারও লেখা কপি করে নিজের ওয়ালে শেয়ার করতেই পারেন। এটা ভাল কাজ। এতে করে আপনার পোস্ট যাঁরা খেয়াল করেন, তাঁদের অনেকেরই কাজে আসবে। তো মশাই, আপনি যার লেখাটা দিচ্ছেন, তার নামটা তো জানেনই, নাকি নয়? তাহলে ‘সংগৃহীত’ লিখে শেয়ার করার কী দরকার? ওর নামটা লিখে দিতে কি খুব কষ্ট হয়? নাকি এই ভয়টা কাজ করে, যদি আপনার ফ্রেন্ড-ফলোয়ারদের কেউ-কেউ উনার ঝুলিতেও চলে যায়! যখন কেউ ওই লেখায় কমেন্ট-টমেন্ট করে, তখন ‘লেখাটা আপনার নিজের’ টাইপের ভাব না দেখালেই কি বরং ভাল হয় না? নিজের সন্তান দেখতে যেমনই হোক না কেন, তাকে বড় করে দেখানোতে গৌরব আছে। আপনার সন্তান, আপনার অহংকার। আরেকজনের লেখাকে নিজের বলে জাহির করে ভাব নিচ্ছেন, পরবর্তীতে যখন যে কমেন্টটা করেছে, ওই বেচারা কিংবা বেচারি আপনার কাছ থেকে আরেকটা ভাল লেখা এক্সপেক্ট করবে, তখন আপনি বিপদে পড়ে যাবেন না? নাকি আবারও কপিপেস্ট মেরে দেয়ার জন্য নতুন কাউকে খুঁজবেন? গাধা প্রসব করে গাধার বাচ্চা, সিংহশাবক নয়। আগে সিংহ হয়ে দেখান, এরপর গর্জন করুন। তার আগেই হুদাই এই বিপদকে দাওয়াত দিয়ে বাসায় আনছেন কেন?

দুই। যারা লিখতে পারে না, তাদের সাথে আমি লেখা-চুরির কষ্ট নিয়ে কথা বলতে কিংবা কোনও ধরনের আর্গুমেন্টে যেতে রাজি নই। যে পুরুষ নপুংসক, সে নিজের সন্তানের মায়া কীভাবে বুঝবে? তার যে সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতাই নেই!

তিন। আমি লেখক নই, আমি বড়জোর ফেসবুকে স্ট্যাটাস প্রসব করি। তাই, লেখকের উদারতা আমার মধ্যে অনুপস্থিত। আমার অনুদার ও নীচ হওয়ার মত যথেষ্ট সময় হাতে থাকে, কারণ বড় লেখকের লেখার মত আমার লেখা খুব বেশি সংখ্যক লোক কপি করে না। দুএকজন কপিটপি করে, আর আমি ছোটলোকের মত চিল্লাচিল্লি করতে শুরু করি। আমি জানি, আমি ছোটলোক। তা মহাত্মা, ছোটলোকের লেখা চুরি করেন কেন?

চার। হার্ভার্ডের শিক্ষকও যদি গ্রামের অশিক্ষিত রাখালের কোনও সৃষ্টি চুরি করেন কিংবা চুরি করার চেষ্টা করেন সেই মুখ্যসুখ্য রাখালের নামটা গোপন করে, তবে সেই বেচারা রাখালটি ওর রাগ ঝাড়ার সময় হার্ভার্ডের শিক্ষক মান্যপ্রবরকে অন্য কী বলে সম্বোধন করতে পারে? হার্ভার্ডের স্যারকে তো হার্ভার্ডের স্যারই বলতে হয়, তাই না? হার্ভার্ডের একজন কুম্ভিলক স্যারকে কিছু বললে শুধু তাঁরাই সেটিকে স্বেচ্ছায় নিজের ঝুড়িতে টেনে নিয়ে ক্ষুব্ধ হবেন, যাঁদের মধ্যেও কুম্ভিলক-প্রবৃত্তি আছে। কিছুদিন আগে শ্রদ্ধেয় লেখক হুমায়ূন আজাদের কিছু-কিছু লেখা প্ল্যাজিয়ারিজমের অভিযোগে প্রমাণসহ অভিযুক্ত হয়েছে। এতে করে কিন্তু কোনও ভাবেই পুরো লেখকসমাজের মানসম্মান ধুলোয় মিশে যায়নি।

অনেক বকবক করে ফেললাম। এখন অল্প কথায় বলি। আমি অতিফাউল টাইপের একটা মানুষ। এই গণ্ডমূর্খের লেখা নাম না দিয়ে চুরি করলেন, ধরা খেলেন; কথা দিচ্ছি, সাথে-সাথে এই অধম আপনার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করার কাজে লেগে যাবে। চোরের কোন উঁচুনিচু জাতপাত নেই। চোরের একমাত্র জাত, সে চোর। হয় আমার লেখা আমার নাম উল্লেখ করে শেয়ার করুন, অথবা নিজে লিখে দেখান। ধন্যবাদ।

ভাই, আমি নিজেও অ্যাকাডেমিক প্ল্যাজিয়ারিস্ট। গুগল মামার দয়াদাক্ষিণ্যে আমিও আপনার মতই অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে প্রেমিকাকে ‘পটিয়ে’ প্রেম করার চিন্তা কোনও দিনও মাথাতে আনিনি। আমার প্রেমিকাকে চুম্বনের অধিকার ওই বুড়োর সাথে শেয়ার করার পারার মত উদার হতে পেরেছি কি কখনও? তা যদি না পারি, তবে কেন ওই ক্ষণিকের নির্বোধ আত্মতৃপ্তি? নিজের প্রেমিকাকে চুমু খাওয়া শিখুন নিজের ঠোঁটে! গাড়ির ড্রাইভারের গাড়িটাকে নিজের গাড়ি বলে মিথ্যে-মিথ্যে দাবি করে প্রেয়সী ‘ম্যানেজ’ করার চাইতে নিজে গাড়ি কেনার যোগ্যতা অর্জন করাই তো গৌরবের, তাই না? মিথ্যে দিয়ে সাজানো জীবন বড় ঠুনকো জীবন হে!!

Say NO to non-academic plagiarism!!

(এক সময় কেউ আমার লেখা চুরি করলে খুব খেপে যেতাম। সেই সময়ের একটা পোস্ট এটি। এখন আর খেপি না। যার যেভাবে ইচ্ছা, আমার যেকোনো লেখা যথেচ্ছ ভাবে চুরি করে নিজের নামে চালাতে পারেন। নো প্রবলেম!)

ভাবনা: দুইশো তিন।

……………………………………..

বিল কত?

৬৫ টাকা।

সে পকেট থেকে কিছু খুচরা পয়সা আর ছেঁড়াফাটা অনেকগুলো কাগুজে ছোটো-ছোটো নোট বের করলো। গুনে-গুনে ৬৫ টাকা ফুটপাথের দোকানির হাতে দেয়ার সময় ওই ১০-১১ বছরের শিশুটির চোখেমুখে আমি যে খুশি আর তৃপ্তির অহংকার দেখেছি, সেটা খুব স্পষ্টই বলে দেয়, আমাদের হাসিকান্নার অনুভূতিটুকু কতটা একই রকমের। ওয়েস্টিনে বার্থডে পার্টির সাথে সেইদিনের ফুটপাথে পার্টির তফাত কতটা? অর্থের অর্থ এখানে বড্ডো বেশিই নিরর্থক। খুশি হয়ে ওঠাই অনেক বড় ব্যাপার। ইসস্! খুশি হতে কী যে দারুণ লাগে!

কত লোকেরই তো নেক্সট্ বার্থডে দেখার সুযোগ হয় না। ওদের দলে আমিও যদি থাকতাম, পৃথিবীর কী-ই বা এমন এসে যেত তাতে? একটা বছর বেশি বাঁচলাম, এটাই তো বোনাস! বেঁচে থাকাতেই সুখ। আনন্দে সুখ, কষ্টে সুখ। কষ্ট পায়নি যে, সে সুখের মানে বোঝে না। খোঁজও রাখে না।

এই তো সেদিনের কথা। যে বিধবা মহিলাটি আমার অফিসের বারান্দা ঝাঁট দেয়, তার একমাত্র ছেলের জন্মদিনে সে আমাদের সবাইকে অপূর্ব পায়েস রান্না করে খাওয়াল। এর আগে তার নাম পর্যন্ত জানতাম না আমি। পরিচ্ছন্ন বারান্দা স্রেফ নোংরা করেই খুশি ছিলাম এত দিন। অথচ পায়েস খাওয়াল বলে ওর স্থায়ী ঠিকানা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেছি! ছিঃ! কী নীচ আমি! ভেবে দেখলাম, এই পায়েসের যে দাম সে দিয়েছে হৃদয় দিয়ে, অতটা দাম কখনও কি দিতে পেরেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথ? পারবে কোত্থেকে? অতটা রাখার জায়গা কোথায় ওতে?

সেই এইটুকুন পিচ্চিটার কথায় ফিরে আসি। ওর আত্মসম্মানবোধ দেখে থ’ হয়ে গেছি সেই দিন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, হাফ গ্লাস দুধ আর বনরুটি খাওয়ানোর পরও সে তার টোকাই বন্ধুদের জিজ্ঞেস করছিল, ওরা আর কিছু খাবে কি না। অমাবস্যার রাত সাড়ে আটটাকে অতটা উজ্জ্বল হতে কখনও দেখিনি আগে।

আমার কফিটা আর খাওয়া হয়নি সেদিন। নিজের অজান্তেই চোখের লোনা পানি কফির কাপে পড়েছিল বলে নয়, আমি ঠাণ্ডা কফি খাই না, তাই।