ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৪৭শ অংশ)

ভাবনা: তিনশো তেইশ

…………………………………

এক।

যখন আমি ইন্টারে পড়ি, এক সাংবাদিকের কাছে একটা কবিতা দিয়েছিলাম, উনি প্রকাশ করলেন না।

সেই কবিতায় আমি রাস্তার একটা ছেলের কথা লিখেছিলাম। কলেজে যাওয়ার সময় দেখতাম, ও বাসে ভিক্ষে করত। বাচ্চা একটা ছেলে। বড় মায়াভরা মুখটি। খুব ইচ্ছে করত, ওর চুলে একটু হাত বুলিয়ে দিই, গালটা ছুঁয়ে দেখি। কখনো পারিনি! ওকে খুব মিস করি। এখন তো ও অনেক বড় হয়ে গেছে, তাই না? ওর মা ছোট্টবেলায়ই মারা গেছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে, ও কি এখন তিনবেলা খেতে পায়? ওর সৎমা কি এখনো ওকে মারে খুব? ওর কি এখনো রাতে ঘুমোনোর আগে মায়ের জন্য কান্না পায়? ও কেমন আছে? ও কি বেঁচে আছে? নাকি রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ে………আমার খুব ইচ্ছে ছিল, কোনো এক বৈশাখে ওকে একটা নতুন জামা কিনে দেবো, কিন্ত ওর সাথে আর দেখা হয়নি। আহা, কোনো বৈশাখী মেলায় হঠাৎ যদি ওর সাথে দেখা হতো! ও আচমকা সামনে এসে বাঁকা দাঁতে হেসে বলত, আপু, আমাকে চিনতে পারোনি? আমি সানজিদ, ওই যে…….যাকে নিয়ে তুমি গল্প লিখবে বলেছিলে!

ও যখন খুব ছোট, ওর মা মারা যায়। ওর বাবা আবার বিয়ে করে। সেই মায়ের আরো দুই ছেলে হয়। মা মরে গেলে বাবা যেন কেমন হয়ে যায়। বাবা মরে গেলে সন্তান মায়ের কাছে যতটা নিরাপদ, মা মরে গেলে সন্তান বাবার কাছে ততটা নিরাপদ নয়। ওর নতুন মা ওকে খুব মারত। কখনো ঠিকমত খেতে দিত না। ও ভিক্ষে করত। কিন্ত দেখতাম, ছেলেটা ভালভাবে ভিক্ষেও করতে জানত না! ওর যত কষ্ট, সব চোখের মণিতে জমা হত…….

আমি দেখেছি, ওর চোখের নিবিড়ে, বুকের গভীরে অস্পষ্ট এক যন্ত্রণার ছাপ। ও বেশি কথা বলতে পারত না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকত। হয়ত একটু মমতা খুঁজত। যখন কোনো বাচ্চার মা তাকে আদর করে বলত, বাবু, এটা খাও, ওটা খাও, ও হাঁ করে সেই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। ও তখন ভিক্ষে করতে ভুলে যেত, খিদে পেয়েছে বলতে ভুলে যেত, ‘আমাকে দুটা টাকা দিবা’ বলতে ভুলে যেত। হয়ত ও একমুঠ খাবারের চেয়ে বেশি চাইত এক টুকরো নির্ভেজাল মমতা! এ পৃথিবীতে খাবার চাইলে হয়ত পাওয়া যায়, কিন্তু অকৃত্রিম মমতা পাওয়া খুব কঠিন।

দুই।

আমার কোনো কালেই স্বপ্ন ছিল না যে আমি সরকারি চাকরি করব। আসলে সত্যি বলতে, আজ পর্যন্ত নিজের লক্ষ্যটাই ঠিক করতে পারলাম না কী হতে চাই আমি! কী চাই, সেটা বের করা খুবই জরুরি। যদি না-ই জানি, কীসের পেছনে ছুটছি, তবে সে ছোটাটা সময় নষ্ট করা মাত্র। হ্যাঁ, একটা ইচ্ছে অবশ্য ছিল, তা হল, বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করব। এরপর সেখানে চাকরিবাকরি করব। একেবারে পুরোদস্তুর সেটেলড্‌ হওয়া যাকে বলে আরকি! তবে সেটাও যে লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছি, তা বললেও ভুল হবে। কারণ, লক্ষ্য হিসেবে নিলে তো সেটার পেছনেই ছুটতাম। সত্য বলতে কী, সেভাবে কখনো ছুটিনি। আমি জীবনে কোনো কিছুর পেছনেই ছুটলাম না, তাই দলছুটই রয়ে গেলাম। আমি হাইটের দিক থেকে যেমন অনেক খাটো মানুষ, এই ধরুন, পাঁচ ফুট আড়াই হবো হয়ত, রেজাল্টের দিক দিয়েও খাটোই বলা যায়। এসএসসি’তে এ, এইচএসসি’তে বি, আর অনার্সে হয়ত টেনেটুনে সিজি থ্রি থাকবে। পড়াশোনা করছি খুলনার একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে। আসলে আমি পুরোপুরি লক্ষ্যছাড়া বললে ভুল হবে। বাবা ইঞ্জিনিয়ার, রেলওয়েতে আছেন। সেখান থেকে ইচ্ছে জন্মেছিল আমিও ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু সে আর হয়ে উঠল কই! ইন্টারে খারাপ রেজাল্টের পর নিজেই নিজের গতিপথ পরিবর্তন করি। অনার্সটা আইন নিয়েই করি। তবে ওকালতি বোধহয় আমায় দিয়ে হবে না। আমি দেখতে কনভিন্সিং না, উচ্চারণেও জড়তা আছে। সেটা আমার বাবা বুঝে গেছেন। তাই গত একুশ বছরে আমায় কিছু না বললেও, আমার উপর কিছু চাপিয়ে না দিলেও এবারে এসে একটা আবদার করলেন। বললেন, আমি যেন একটু সিরিয়াসলি বিসিএস আর বিজেএস-এর ট্রাই করি। উনি আর কিছুই চান না আমার কাছ থেকে। বাবা সম্পর্কে যদি বলি, উনি অনেক মেধাবী এবং অনেক পরিশ্রমী একজন ছাত্র ছিলেন। তবে ভাগ্য তাঁর সহায় হয়নি। নয়ত সরকারি কোনো উঁচু পদেই তিনি থাকতেন। রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে। স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়বেন। তবে সব স্বপ্ন সবসময় পূরণ হয় না। বাবারা সাত ভাইবোন ছিলেন। ঠাকুরদাও রেলওয়েতে ছিলেন, তবে খুব উচ্চপদস্থ কেউ ছিলেন না। তাই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো উনাকে। তাই বাবা-কাকারা লজিং-এ থেকে পড়ালেখা করতেন। বাবা যখন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পাস করলেন, তখন উনার স্বপ্ন, বুয়েটে পড়বেন আর তখনই আমার ঠাকুরদা মারা যান। বাড়ির বড় ছেলে ছিলেন আমার বাবা, তার আগে এক বোন আছেন। সেই বড় বোন এবং বাবার ছোট আরেক বোনের বিয়ে ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার উপর দায়িত্ব পড়ে বাকি পাঁচজনের। আর তাই নিজের স্বপ্নকে কবর দিয়ে হাল ধরতে হয় পরিবারের। ইঞ্জিনিয়ার ঠিকই হয়েছেন তবে সেটা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। চট্টগ্রাম পলিটেকনিকাল থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং নিয়ে পাস করেছিলেন। আর সেই জন্যই রেলওয়েতে দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আমার বাবা আমাকে কখনো বলেননি, তুমি এখানে পড়ো, ওখানে যাও। সবসময় স্বাধীনতা দিয়েছেন। আর তাই তার এবারের আবদারটা আমি রাখতে চাই। আমার লক্ষ্যের জন্য নয়, আমি এবার লড়তে চাই আমার বাবার স্বপ্নটা পূরণ করার জন্য। আমার জীবনে আমি একবারই দারুণভাবে সফল হয়েছিলাম আর সেটা ছিল নাসিরাবাদ বয়েজ স্কুলে ক্লাস নাইনে টিকেছিলাম। অনেক আবেগ ঝাড়লাম, এবার আসি বাস্তবতায়। আমি বিসিএস-এর মতো পরীক্ষায় নামবো, তার জন্য আমার কোনো রসদ নেই। আমি ভার্সিটির শেষ সেমিস্টারের ছাত্র। আমি আগে থেকে কোনো প্রিপারেশন নিইনি। কিন্তু স্বপ্নটা অনেক বড়। যদিও এসব শুনলে যে কেউই হাসবে, হয়ত ভাববে পাগলের প্রলাপ বকছি। স্বপ্ন এবার বিসিএস-এ প্রথম হওয়া। কেউ না কেউ তো প্রথম হবেই, সে মানুষটা নাহয় আমিই হলাম! জানি না এক বছরে আমি প্রস্তুত হতে পারবো কি না বিসিএস-এর জন্য। তবে এটা জানি, আমাকে পারতে হবে। আর আমার নিজের উপর নিজের সে আত্নবিশ্বাসটা আছে যে আমি যদি কষ্ট করি, তাহলে আমি পারবই। ফেসবুকে ‘সাপলুডুর জীবন’ নামের একটা লেখা পড়ে নিজেকে নিয়ে আবারো ভাবতে শিখেছি। মনে হয়েছে, এই যে আমি, যাকে দেখলেই সবাই ধরেই নেয়, ওকে দিয়ে কিছু হবে না, সে মানুষটা যদি দারুণ কিছু করতে পারে আর সবাইকে চমকে দেয়, তবে কেমন হয়? আজ থেকে আমি বিসিএস-এ প্রথম হতেই পথে নামলাম। এ যাত্রায় যত ঝড়ই আসুক, আমি থামবো না, পিছু হটবো না। আমি আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবো না। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করবো। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে। দেখা যাক, উনি আমায় কোথায় নেন। তবে এমন ভাবে পরিশ্রম করবো, যাতে আমি যদি ব্যর্থও হই, তবু বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সততা নিয়ে বলতে পারি, বাবা, আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি, কোনো ফাঁকি দিইনি। আমি পারিনি, কারণ, হয়ত এটা আমার ভাগ্যে ছিল না। নিজেকে ক্ষমা করতে না পারার চাইতে কষ্ট আর হয় না। আজ আমি শপথ করলাম, নিজেকে ক্ষমার অযোগ্য করে দেবে যে গাফিলতি, তেমন কোনো কিছুই আমি সামনের এক বছরে কিছুতেই করব না।

ভাবনা: তিনশো চব্বিশ

…………………………………

আমি যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসি, তখন আমি ২৫ কি ২৬। কোর্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে হত। বিয়ের ২ বছর পর আদৃতা আমায় জানাল, সে মা হতে চলেছে। শুনে অন্য রকম একটা ভাললাগার আবেশ আমার পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সে অনুভূতি লিখে বোঝানোর মত অতো শক্তি বিধাতা আমায় দেননি। আমার আর আদৃতার ভালোবাসার প্রথম ফসল আসছে। ভাবতেই পারছিলাম না আমাকে কেউ বাবা বলে ডাকবে! তখন আমরা যে শহরে থাকতাম, সে শহরে অতো ভাল মেডিক্যাল চেকআপের ব্যবস্থা ছিল না। একটা ছোট্ট শহরে ছোট্ট স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা দুজন মানুষ আমরা। তবু যতটা পারতাম, আদৃতার জন্য মেডিক্যাল চেকআপের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতাম। ও মাঝেমাঝে বলত, এত কেয়ারিং কেন তুমি, হুমম্‌? তোমার এ ভালোবাসা আমার জন্য, নাকি তোমার বেবিটার জন্য? সত্যি করে বলোতো, কার জন্য? ও এলে আমায় আর আগের মত ভালোবাসবে না? ওর এমন প্রশ্ন শুনে নিজের কাছে উত্তর খুঁজে ফিরতাম। আদৃতাকে আমি এমনিতেই অনেক ভালোবাসি, তাহলে এই যে বাড়তি ভালোবাসা, বাড়তি যত্ন, বাড়তি টেনশন, এসব সত্যিই কার জন্য? সেদিনের পর ৩৪ বছর কেটে গেল, উত্তরটা আজো খুঁজে পাইনি।

তুই যখন প্রথম হাত-পা নাড়ছিস, আমি তোর মায়ের পেটে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমি তোকে ছুঁয়ে দেখতে পারছি। কখনো-বা তুই কাঁদিস কি না বুঝতে তোর মায়ের পেটে কান পেতে দিতাম। আদৃতা বলত, এই বোকা! বাবু এখনো কাঁদতে জানে নাকি? আগে ওকে আসতে দাও! তুই যতদিন তোর মায়ের পেটে বড় হচ্ছিলি, সেসময় তোর মাকে দেখতে আরো বেশি সুন্দর দেখাত। যখন তোর মা স্নান শেষে ভেজা চুল সরিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরত, তখন ওকে দেখতে কী যে অপূর্ব লাগত! সে সময়ের ওকে দেখলে সুচিত্রা সেনও হয়ত লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলত। তখন তো অতো ইউএসজি’র চল ছিল না, আমিও করাইনি, তাই আমরা জানতামই না, তুই কি ছেলে নাকি মেয়ে। কিন্তু আমি মনেমনে ঠিক করে রেখেছিলাম, মেয়ে হলে নাম রাখবো মায়া। হুমম্‌……মায়া! কারণ,, তুই এ পৃথিবীতে না আসতেই এত মায়ার বাঁধনে সকলকে এমন বেঁধে ফেলেছিলি যে এ নাম ছাড়া আর কোনো নাম তোকে মানাতই না। আর যদি ছেলে হয়, তাহলে তোর ঠাকুরমা তোর নাম রাখবে, এমনটাই কথা ছিল। তোর মা প্রায়ই বলত, “এই যে এত কষ্ট পাচ্ছি, এর মধ্যে অনেক সুখ লুকিয়ে আছে, জানো? বর্তমানের কষ্টই তো ভবিষ্যত সুখের সূতিকাগার। এখন প্রায়ই আমি একা থাকি। তুমি অফিসে থাকো, আমার পাশে কেউ অতোটা আসেও না। তখন মনে হয়, এই যে বর্তমানের একাকীত্ব, এটা সারাজীবনের একাকীত্ব ঘুচিয়ে দেয়ার জন্যই। একটি সারাজীবনের বন্ধু পাবো, এই আনন্দে তো কিছুকাল বন্ধুহীন হয়ে থাকাই যায়, তাই না, বলো? আমি ওকে নিয়ে খুব ভাল থাকি, জানো? আগে এই অনুভূতিটা সম্পর্কে ধারণাই করতে পারিনি কখনো। আমি বাদে আর কেউ কিছুতেই বুঝতে পারবে না, আমি যে কতটা স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। এখন আমার সবকিছুই ভাল লাগে। এমন-কী কারো কোনো মন্দ কথাও এখন আর আমায় আগের মত কষ্ট দেয় না। আমি যখনই কিছু ভাবি, তখনই মনে হয়, আমার সকল ভাবনা তো আমার বাবুটার উপর প্রভাব ফেলবে—ওরও যে একটা চিন্তাজগত গড়ে উঠছে আমারই চিন্তার আদলে। ওর কথা ভেবে আমার মাথায় কখনোই কোনো অভিযোগ, কষ্ট, দুঃখ, নীচতা কাজ করে না।”

এমনি করে দেখতেদেখতে ৯ মাস কেটে গেল। ২ নভেম্বর। তোর মায়ের লেবারপেইন উঠল। আমার খুব টেনশন হচ্ছিল তোকে নিয়ে আর তোর মাকে নিয়ে। তোর মাকে খুব ভালোবাসি যে! কোনো অভিযোগ করতে জানে না, কোনো কিছু চাইতে জানে না, কেবলই ভালোবাসতে জানে। এমন একটা মানুষকে ভালো না বেসে থাকা যায়, বল! হঠাৎ তোর কান্না ভেসে এল। কারো কান্না শুনলেও যে এত আনন্দ হয়, এটা আগে জানা ছিল না। তোর ঠাকুরমা তোকে আমার হাতে তুলে দিল। একটা সদ্যোজাত দেবশিশু আমার হাতে! আমার সন্তান! এটা ভাবতেই কী যে শিহরণ খেলে যাচ্ছিল পুরো শরীরে, সে কথা ভাবলে এখনো আনমনে হেসে উঠি! তোর মুখটা এত মিষ্টি ছিল যে সেসময় তোর মুখের দিকে তাকিয়েই আমি আমার সব যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিন তোর সাথে আরো দুটো জন্ম হয়েছিল—আমার আর তোর মায়ের। আমি বাবা হলাম, তোর মা মা হল। তোর ছোট্টছোট্ট হাত, পা, চোখ। পুতুলের মতন মায়াবী শরীর। তুই কেমন পিটপিট করে সবার দিকে তাকাচ্ছিলি। তোর ওই শান্ত দুই চোখ দেখে তোর ঠাকুরমা তোর নাম রাখল ধীনেত্র। সেই ছোট্ট সোনামণি তুই একটু-একটু করে বড় হতে লাগলি। একপা, দুইপা করে হাঁটতে শুরু করলি। তুই যখন কাঁদতিস, আমার বুকটা তখন ফেটে যেত। তোকে কত বুদ্ধি খাটিয়ে যে শান্ত করতাম আর বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম!

একবার তোর খুব জ্বর হয়। তুই খুব কান্না করছিলি। বারবারই বলছিলি, বাবা, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দেখে আমি চোখের জল আটকে রাখতে পারছিলাম না। পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। তোর দাদু আমাকে অমন করতে দেখলে হাসত। বলত, বাবা, শান্ত হও, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর দাদু বড় ভাল মানুষ ছিলেন, উনি আমার কষ্টটা বুঝতে পারতেন। তোর হাসিমুখটা আমার কাছে সবচাইতে দামি ছিল। মনে হত, এই হাসির জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি। তোর মুখের আধোবোলে যেদিন প্রথম আমি বাবা ডাকটা শুনতে পাই, সেই দিনটার কথা আমি কোনো দিনই ভুলতে পারব না। মনে হচ্ছিল, এর চাইতে সুন্দর শব্দ আমি এর আগে কোনোদিন শুনিনি। আমি তোকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলতাম, খোকাসোনা, আবার বলতো! তুই আবারো বলতিস। শুনে আমার কী যে আনন্দ হত। তুই আমার চোখের সামনে বড় হয়েছিস। তোকে চোখের সামনে বাড়তে দেখার চাইতে সুন্দর দৃশ্য আর কখনো দেখিনি। তুই এসে আমাদের পুরো লাইফস্টাইলটাই বদলে দিয়েছিলি। তুই অন্য দশটা বাচ্চাদের মত ছিলি না। ছোটবেলা থেকে তোর সব কিছুতেই আগ্রহ। বাবা, এটা কী? বাবা, ওটা কী? কেন, বাবা? কীকরে হল, বাবা? এমন আরো কত কী যে প্রশ্ন! তোর মাকে আমি বলে দিয়েছিলাম, তুই প্রশ্ন করলে যাতে কখনোই তোকে না বকে। আমি জানি না তুই কোত্থেকে যে রাজ্যের প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে আসতিস! বেশ দুরন্তও ছিলি ছোটবেলায়। তোকে সামলাতে গিয়ে তোর মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। আমি বাসায় ফিরে দেখতাম তুই তোর মায়ের কী যে হাল করে রেখেছিস! তোর মায়ের নাওয়াখাওয়া, ঘুম, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যেত তোর দেখাশোনা করতে গিয়ে। এসব দেখলে নতুন করে তোর মায়ের প্রেমে পড়ে যেতাম। সন্তান বড় করতে মায়ের চাইতে বেশি আত্মত্যাগ আর কারুরই নেই। একটা কথা বলি বাবা, আমার কথাটা রাখিস। তুই আজকে যা কিছুই হোস না কেন, জেনে রাখিস, তা হয়েছিস তোর মায়ের জন্যই। জীবনে আর যা-ই করিস, মাকে কখনো কষ্ট দিস না, বাবা। একদিন তোর মায়ের বয়স হয়ে যাবে, সেদিন তোর মা বড্ড ছেলেমানুষ হয়ে যাবে। যেমনি করে তোর সব অবোধ অবাধ্যতা সহ্য করে তোর মা তোকে বড় করেছে, তেমনি করে তোর মায়ের সব ছেলেমানুষি মেনে নিস, বাবা। তুই যদি মাকে কষ্ট দিস, তবে তোর মায়ের এত ত্যাগ যে মিথ্যে হয়ে যাবে, বাবা!

৫ বছর ঘুরল। তোর মায়ের কোল জুড়ে সুমেধ এল। তোরা দুইভাই ছোটকাল থেকেই বন্ধুর মত ছিলি। দুইভাই যখন একসাথে গল্প করতিস, খেলতিস, দূর থেকে দেখতে আমার বড় ভাল লাগত। মনে হত, আমার চেয়ে সুখি আর কে আছে! তোর মা আধুনিক গান খুব পছন্দ করত। আমার ভাল লাগত রাগাশ্রয়ী বাংলা গান আর উর্দু গজল। বাসায় সবসময়ই গান বাজতেই থাকত। সুরের কোনো বর্ণবদ্ধ ভাষা হয় না, সুরের ভাষা কেবল সুরেই গাঁথা। গান কোনো ভাষায় হয় না, গান কেবলই অনুভূতিতে হয়। ছোট থেকেই তোর মায়ের কড়া শাসনে বড় হয়েছিস। তোর মা তোকে পড়াশোনার মধ্যেই রেখেছে সবসময়ই। এসএসসি আর এইচএসসি’তে ভাল রেজাল্ট হল তোর। আমাদের সবার ইচ্ছেয় তুই মেডিক্যালে ভর্তি হলি। সেই থেকে কেন জানি না পড়াশোনা থেকে তোর মন উঠে গেল। মুভি, মিউজিক, বই নিয়েই তোর পুরো সময়টা কেটে যেত, কিন্তু তোর পড়ার বইগুলি ছুঁয়েও দেখতিস না। স্টুডেন্ট পড়াতিস, পরে ড্রেসশপ দিয়েছিলি। আমি বুঝতে পারতাম, তুই সেসময় ভাল ছিলি না, খোকা। তুই তো বড্ড চাপা স্বভাবের সেই ছোটবেলা থেকেই, তাই মুখফুটে কাউকেই মনের কোনো কথা বলতিস না, কিন্তু তোর চোখ দেখে আমি সবই বুঝতে পারতাম। তোর চোখের ভাষার পুরো গঠনটাই যে আমার চোখের সামনে হয়েছে। সে ভাষায় আমার কাছে দুর্বোধ্য তুই হবি কীকরে? জীবনে কত মানুষ তোকে ব্যথা দিয়েছে, সে খোঁজ তুই কখনোই কাউকে দিসনি। আমাকে কিংবা তোর মাকে কখনো বুঝতে দিসনি তুই যে কী ভীষণ কষ্টে বেঁচে আছিস! আমি ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ, উনি তোকে ঠিক পথে ফিরিয়ে এনেছেন, যে সম্মানটা তোর প্রাপ্য, সেটাই তোকে দিয়েছেন। তোর জন্য আজকের সময়টা আসা খুব জরুরি ছিল। তুই খুব খাটতিস। রুমের দরোজা বন্ধ করে পড়াশোনায় ডুবে থাকতিস। একসময় কেমন জানি হয়ে গিয়েছিলি তুই। কারো সাথে কোনো কথা বলতিস না, নিজের মত করে আড়ালে নিভৃত কোণে একনাগাড়ে পড়াশোনা করতিস।

এখন তুই দেশের বড় সার্জন। টিভি’তে তোর ইন্টার্ভিউ দেখি, কত জায়গায় তোকে ডাকে কথা বলতে। নানান দেশে ঘুরে বেড়াস, সবাইকে স্বপ্ন দেখতে শেখাস। শুনেছি, তোর নাকি অনেক ভক্ত। কত মানুষ তোকে ভালোবাসে, তোর কথা শুনে নিজেদের বদলে নেয়। তোকে তো কাছে পাই না, তাই তোর কিছু প্রোগ্রাম ইউটিউবে তোর মা-সহ দেখি। জানিস বাবা, তোর মা এখনো মাঝেমাঝে তোর কথা ভেবে কাঁদে। কিছু খাওয়ার আগে তুই খেয়েছিস কি না ভাবে। তোর বাঁধানো ছবিগুলি নামিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মোছে। তোর মা খুব সরল মানুষ রে, বাবা! এখনো বড্ড অভিমানি, একদম ছোট্ট বাচ্চাদের মত। মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলিস। ওইটুকু পেলেই তোর মা অনেক খুশি। বউমাও অনেক ভাল। আমরা ওর কাছ থেকে কিছুই চাই না, শুধু চাই, ও যেন তোকে ভাল রাখে, তুই যেন ওকে নিয়ে সুখে থাকিস। জানিস বাবা, তুই যখন বাসায় আসিস, তার এক সপ্তাহ আগে থেকে তোর মা প্লান করতে থাকে, কী রাঁধবে, তোকে কী খাওয়াবে, এসব। তুই বাসায় থাকিস না, সুমেধকে নানান কাজে বাইরে থাকতে হয়, তোর মা বাসায় একাই থাকে। আমারও বয়স হয়ে গেছে, প্রায়ই বিপি আপডাউন করে, সুগারটাও হাই, আর কত দিনই বা বাঁচব, বল! নিজেকে নিয়ে আর ভাবি না, তোদের দুইভাইয়ের সুখের কথা ভাবি।

আমার একটা অনুরোধ রাখবি, বাবা? আমি যেদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো, সেদিন আমার মুখে আগুন দেয়ার সময় তোরা দুইভাই কাঁদিস না। সবাই তো একদিন চলে যাবে, কিন্তু কেউ তো আর তোদের বাবা হয়ে মরতে পারবে না। তোরা আমার সন্তান, এই তৃপ্তি নিয়ে আমি হাসিমুখে চলে যাবো। জীবনের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, এ জীবনে সব সুখেরই পূর্ণতা আমি পেয়ে গেছি তোদের কাছ থেকে। এখন আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। তোরা ভাল থাকিস, বাবা। আমার আশীর্বাদ আর ভালোবাসা তোদের সাথে আছে।

ভাবনা: তিনশো পঁচিশ

…………………………………

এক।

: আম্মা দেইখা সবকিছুতেই আপনাকে বেশি পাত্তা দেয়, আপনার সব কথা শুনে………আমি তো আপনাকে পাত্তাই দেই না!

: হে হে হে……পাত্তা যে দেন না, দ্যাটস্‌ গ্রেট! কিন্তু, আপনার পাত্তা যে আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, এটাই-বা আপনি নিশ্চিত হলেন কীভাবে?

(আহা! আমার তখনের চেহারাটা!)

যে মরু—

অনন্তকাল

রুক্ষ ধুলোর ঝড়ের সাথে

বাঁচে নিত্য সখ্যে,

তিনভাগে

জল যতই থাক না পড়ে,

তাতে—

তার কী-ইবা অমন যায় যে এসে!

দুই।

আমার আম্মা বদ! মহিলাটার সাথে তো বহুদিনের বসবাস………হুট করে কোন না কোন দিন আবার ঐ পারের ডাক পড়ে যায়, তাই আমার অনুপস্থিতিতে এই বদবেটিকে যে দেখাশোনা করবে, তার সুবিধার্থে কিছু লিখে রাখছি। (অনেকটা নোট টু মাই সাকসেসর-এর মত)

১. আম্মার তিনমাত্র বিনোদন—বাইরে খেতে যাওয়া, শপিং করা আর টিভি দেখা। এগুলোর ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।

২. রান্না মজা না হলে সেটার কথা আম্মা সর্বনিম্নে দশবার বলে, কাজেই যদি কিছু রান্না করার পর বুঝতে পারো, মজা না হবার আশংকা আছে, তাইলে কান দুইটাকে যথাযথভাবে প্রস্তুত রাখবা!

৩. যেকোনো ইলেক্ট্রিক জিনিস ব্যবহার করার পর, বিশেষ করে ইস্ত্রি, শুধু সুইচ অফ করবা না, অবশ্যই প্লাগটাও খুলে রাখবা, কারণ, আম্মা কোনো সুইচই মনে রাখতে পারে না। যেকোনো কিছু অন করার জন্য লাগাতার সবকটা সুইচই অন করে!

৪. কোনো খারাপ ঘটনা, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে, যতটা পরে জানানো যায়, ততটা পরেই আম্মাকে জানাবা।

৫. দুশ্চিন্তা করার মতো কোনো কথা রাতে আম্মাকে বলবা না, কারণ, সেটা নিয়ে আম্মা সারারাত চিন্তা করবে।

৬. যদি বাসায় এমন কোনো গেস্ট আসার কথা থাকে, যাকে আম্মা পছন্দ করে না, তাহলে তার বাসায় আসার কথাটা জাস্ট আসার আগের দিন আম্মাকে জানাবা।

৭. বাসায় ব্যবহার্য জিনিসপত্র বা খাবার সব সময় বেশি করে রাখবা। তুমি কম ব্যবহার কর, সমস্যা নাই, কিন্তু বেশি থাকতে হবে। কারণ, মনে কর, আম্মা দেখল, বাসায় সয়াবিন তেল অল্প আছে। এবার তুমি লুকায়া বাইরে থেকে তেল এনে যদি তরকারিতে প্রয়োজনের তিনগুণ তেলও দিয়ে রাখো, তবুও আম্মা বলবে, তেল হয় নাই! কিন্তু যদি বিশাল এক গ্যালন তেল থাকে আর তেল প্রয়োজনের চেয়ে কমও দাও, তবুও আম্মা মনে করবে, ঠিকই আছে!

৮. আম্মাকে মাসে একবার বাইরে খেতে নিয়ে যাবা, আর সপ্তাহে দুই-একদিন বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়াবা।

৯. বিভিন্ন দিবসগুলোতে আম্মাকে শাড়ি কিনা দিবা। ঐগুলা আম্মা পরুক বা আলমিরাতে ফালায় রাখুক……

১০. আম্মা মাসে হয়ত দুই-তিনদিন শুধু পারফিউম, লোশন, ফেসওয়াশ, শ্যাম্পু ইউজ করে, কিন্তু ঐ তিনদিনেই বোতল খালি! যেকোনো কিছু ব্যবহারের ক্ষেত্রে এইটাই আম্মার স্টাইল! মনে রাখবা!

১১. শপিং করতে গেলে, একটু সতর্ক থাকবা……কারণ, আম্মা চট করে একটা দোকানে ঢুকে চট করে একটা শাড়ি ধরে বলবে, “আমি এইটাই নিবো। টাকা দিয়ে দাও!” এইবার দোকানি এই ৩ হাজার টাকার শাড়ি ৬ হাজার টাকা চাইলেও, আম্মা কোনোভাবেই সেই শাড়ি না কিনে দোকান থেকে বের হবে না! উল্টো বলবে, “আরে বাবারা! আর বইলো না, আমার মেয়েটা হইসে দুনিয়ার কিপ্টা! বুঝসো?…………এই! দাও, দাও, ওদেরকে ৬ হাজার টাকা দিয়া দাও।”

১২. আম্মা মাঝেমাঝে কয়েক দিন একাধারে হুদাই চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে। পারলে সেই কয়দিন মাথা যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রাখবা।

১৩. আম্মা মাঝেমাঝে রাতে একাএকা কথা বলে। লুকায়া শুনার চেষ্টা করবা—কী সাবজেক্ট নিয়া কথা বলতেসে। যদিও মানুষের পার্সোনাল কিছু লুকিয়ে শুনা অপরাধ, তবুও এটা করবা আম্মার স্বার্থেই। কারণ, অনেক আগে একদিন আমি খেয়াল করলাম আম্মা খুবই করুণভাবে আল্লাহর কাছে কী যেন বলতেসে। আমি শুনার চেষ্টা করলাম। শুনলাম, উনি বলতেসেন, “আল্লাহ, এখন আমারে নিয়ো না। পরে নিয়ো, আমি বলব।” কী ভয়ংকর! তার মানে, আম্মার ভেতর মৃত্যুভয় কাজ করতেসে প্রবলভাবে। এর কিছুদিন পর আমি কথায়কথায় আম্মারে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, মৃত্যুকে নিয়া এত ভয় পাওয়ার কিছু নাই, সবাই মরবে, মৃত্যু সুন্দর……কারণ, আমরা যাঁর, মৃত্যু তো তাঁর কাছেই চলে যাওয়া।

১৪. আম্মার, প্রচণ্ড রকমের বিরক্ত করার অভ্যাস। অন্যকে বিরক্ত করার প্রতিযোগিতা হইলে উনি নিশ্চয়ই পুরস্কার পাইতেন। সুতরাং এই ব্যাপারে নিজেকে প্রস্তুত রাখবা।

১৫. উনার কথার কোনো আগামাথা নাই। এই যেমন মনে কর, আজকে বললো নুডলস বানানোর সময় বেশি ভাজাভাজা করতে। আরেক দিন যখন বেশি ভাজা দিবা, তখন বলবে, “নুডলস এত ভাজে নাকি? কম ভাজতে হয়!”

১৬. আম্মা মাঝেমাঝে মাঝরাতে বা শেষরাতের দিকে অন্ধকার ঘরে হাঁটাহাঁটি করেন! রাতদুপুরে অন্ধকারে কারো পায়ের আওয়াজ পেলে চোর ভেবে আবার লাঠিসোটা নিয়ে তাড়া কইরো না! তাই বলে আবার………চোরকে আম্মা ভেবে ঘুমায় থাইকো না!

১৭. আম্মা সবসময় সুন্দর গ্লাস, মগ, প্লেট, বাটি, চামচ ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। আম্মারে ভুল করেও পুরানো বা অসুন্দর কোনো কিছুতে খাবার দিবা না।

১৮. বেশিরভাগ সময় আম্মা চামচ দিয়ে খায়। নির্দিষ্ট এক ধরনের টেবল চামচ আর কাঁটা চামচ আছে—ওগুলাই দিবা…..দুইরকমই ডাবল করে দিবা।

১৯. আম্মা নিয়মিত চকবার আর সেভেনআপ খায়……এই দুইটা সবসময় স্টকে রাখবা……আর চিপস মাঝেমাঝে খায়……

২০. প্রায়ই আম্মা ট্যাং-এর শরবত খায়। এক গ্লাস পানিতে ৭ চামচ ট্যাং দিয়ে বানাবা…….তারপর একটা কথার জন্য প্রস্তুত থাকবা—একটুও টক হয় নাই!

২১. অনেক সময় আম্মা না বুঝেই অহংকার-দেখানো-টাইপ অনেক কিছু বলে ফেলে……(যেটা তিনি নিজেও বুঝেন না যে এমন করে বলাটা ঠিক নয়)…..এমন কিছু করলে বা বললে, সাথেসাথে আম্মার হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবা……

২২. আম্মার সাথে মাঝেমাঝে অকারণেই ঝগড়া করবা! হ্যাঁ করবা, কিন্তু খেয়াল রাখবা, সেইটা যেন তোমার উপর বিরক্ত হওয়া পর্যন্তই যেয়ে থেমে যায়, কষ্ট পর্যন্ত যেন না যায়। যেহেতু আমারই আম্মার সাথে সবচেয়ে বেশি সময় থাকা হইসে, সেহেতু আম্মার সাথে আমার খারাপ ব্যবহারও করা হইসে সবচেয়ে বেশি। উনার সাথে করা খারাপ ব্যবহারের ফাইভ পার্সেন্টও আমি আমার সারাজীবনে যত মানুষের সাথে দেখা হইসে, তাদের সাথে করি নাই……(আমি কী করবো! আম্মা বদ বেটি তো!) আল্লাহ্ যদি আমায় মাফ করে দেন…….আমি চাই না আর কেউ আম্মার সাথে এতটা খারাপ ব্যবহার করুক।

(আরো অনেক কিছু আছে……ওসব আম্মার একান্ত ব্যক্তিগত বলে, দিলাম না।)

ভাবনা: তিনশো ছাব্বিশ

…………………………………

এক।

আমি যে বিল্ডিং-এ থাকি, সেটা চারতলা। নিরাপত্তার জন্য আমাদের সামনে বড় গেট আছে। গেটে সবসময়ই তালা লাগানো থাকে। তালা খুলে ঢুকতে হয়, তালা খুলে বের হতে হয়। আমাদের বিল্ডিং-এ যুবক বয়সি কেউ থাকে না।

কিছুদিন আগে আমি ছাদে হাঁটছিলাম। ঘড়িতে রাত সাড়ে নয়টা। প্রায় দুই ঘণ্টা সেখানে ছিলাম। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছিলাম আর মাঝেমাঝে ফেসবুকে ঢুকছিলাম। আমাদের বিল্ডিং-এর সামনে নতুন একটা বিল্ডিং হয়েছে। পাঁচতলা। সেখানে ব্যাচেলর ছেলেরা থাকে। পাঁচতলার একটা ছেলে ওদের ব্যাল্কনিতে আসে। এত রাতে পাশের ছাদে একটা মেয়েকে একা হাঁটতে দেখে সে শিস বাজাতে শুরু করে, সাথে খুব জোরেজোরে এটা অশ্লীল গান গাইতে থাকে। ওর উদ্দেশ্য, আমার অ্যাটেনশন ড্র করা। আমি দুই ঘণ্টা ধরে ব্যাপারটা মাথায় নিইনি। নিউজফিড স্ক্রল করছিলাম, গান শুনছিলাম। কিছুদিন ধরেই ফেসবুকে মেয়েদের হয়রানির নানান ঘটনা পড়ে আমি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত ছিলাম। প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে, আমি যখন ছাদ থেকে নামবো, তখন আবার দেখি, ওই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে জোরেজোরে হাসছে, শিস বাজাচ্ছে। হঠাৎ আমার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল, ভাবলাম, আমরা মেয়েরা কখনো কিছু বলি না, সব কিছুই চুপচাপ প্রতিবাদহীন সহ্য করে যাই বলেই এত অঘটন ঘটছে। মনে হল, ওকে কিছু একটা বলা উচিত।

এই যে ভাইয়া!

জ্বি! আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ। আপনি অমন করে শিস বাজাচ্ছেন কেন?

আমিইইই……? শিস……….বাজাচ্ছি!

আমি অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি, আপনি শিস বাজাচ্ছেন, গান গাইছেন। কেন? মেয়ে দেখলেই এসব করতে ইচ্ছে করে, না?

আপনি এত রাতে ছাদে কী করেন?

আমি আমার বাসার ছাদে এত রাতে কী করি, সেটার কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে?

তো আমি আমার বাসার ব্যাল্কনিতে শিস বাজাবো, নাকি গান গাইবো, সেটা আমার ব্যাপার।

বেয়াদব! ফ্যামিলি থেকে ভদ্রতা শেখায়নি?

………এইটুকু কথা হওয়ার পরই আমি নেমে চলে আসছিলাম, এরপর সে আরো জোরেজোরে হাসতে লাগল, আবারো শিস বাজাতে লাগল।

আমি আবার ছাদে দৌড়ে গিয়ে বললাম, আর একবার শিস বাজালে জুতার বাড়ি খাবি, বেয়াদব কোথাকার! তোদের কারণেই আজকে এত কিছু হচ্ছে পৃথিবীতে!

সে চিৎকার করে বলল, আপু, আপনি আপনার মুখের ভাষা ঠিক করেন।

এরপর আমি আর কোনো কথা না বলে নেমে চলে আসি। আর সে খুব বড়বড় কথা শোনাচ্ছিল জোরেজোরে। আমার বান্ধবিকে এই ঘটনা বললাম। সে উল্টো আমাকে বলল, “তুই ভুল করেছিস। ছেলেটা চাইছিল তোর অ্যাটেনশন নিতে, আর তুই ওকে এ কাজটা ঠিকভাবে করতে হেল্প করেছিস। তোর বোকামি ওকে সাকসেসফুল করে দিয়েছে। বুঝলি?” “আমার পয়েন্টটা ওকে সফল বা ব্যর্থ করার ব্যাপারে নয়। এই যে আমাদের দেশে এত মেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে, আমাদের মেয়েদের কি এর বিরুদ্ধে কিছু বলা উচিত না?” “ইফ ইউ বার্ক অ্যাট দ্য ডগস্‌, ইউ উইল অনলি রুইন ইয়োর পিস্‌।” “আমার মনে হয়, বর্তমানে দেশের যে সিচ্যুয়েশন, তাতে মেয়েরা যদি সবাই ডিফেন্সিভ হয়ে যায়, তাহলে তো একসময় ওরা মেয়েদের আর ডিসরেস্পেক্ট করার সাহস পাবে না।” “এ দেশে সব কিছুই পার্সোনাল। তুই যদি হ্যারাসড হোস, সেটা যেমন পার্সোনাল, তেমনি তুই যদি হ্যারাস্মেন্ট থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারিস, সেটাও পার্সোনাল। এ নিয়ে কারো বেশি মাথাব্যথা নেই, যতটা সম্ভব ঝামেলা এড়িয়ে গা বাঁচিয়ে চলাই ভাল। গা বাঁচিয়ে চলার নাম জীবন নয়, ঠিক আছে, কিন্তু সেধেসেধে ঝামেলা বাড়ালে, পরবর্তীতে সে ঝামেলা আবার নিজেকেই সল্ভ করতে হবে। তুই নিজ থেকে ওই বেয়াদবকে পাত্তা না দিলে সে তো তোকে হ্যারাস করার সুযোগ পেত না।” “সে যা করছিল, সেটা কি হ্যারাস্মেন্ট নয়?” “হ্যাঁ, তা ঠিক। বাট ইট ওয়াজ নট পার্সোনাল আনটিল অ্যান্ড আনলেস ইউ রেস্পন্ডেড! তোর ঝামেলা তুই নিজেই বাধিয়েছিস!” “আসলেই এ দেশে সব কিছুই পার্সোনাল। আমার আঘাত আমারই আঘাত, তোর আঘাত তোরই আঘাত, তার আঘাত তারই আঘাত। এভ্রিথিং ইজ পার্সোনাল! প্রতিবাদ করা যাবে না, এ দেশ মেনে নিয়ে বাঁচার দেশ। ঠিক আছে, বুঝেছি।”

দুই।

জীবনকে উপভোগ করতে হলে অন্যের জন্য কিছু করতে হয়।

খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা।

এবং, সেই অন্যটি যদি হয় কোনো বাঙালি, তবে এক বা একাধিক তীব্র আঘাত গ্রহণ করার জন্য মানসিক পূর্বপ্রস্তুতি দরকার।

তাহলে উপায়? আনন্দে তো বাঁচতেই হবে! অন্যের জন্য কাজ করব ঠিকই, তবে কাউকেই বিশ্বাস করব না। কাজটা কঠিন, তবে কাজের।

ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল হ‌ওয়া এবং ভিন্নমতের মানুষের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের পরামর্শ শুনতে বেশ লাগে। তবে আমরা জাতিগতভাবে ‘আমরা সবাই রাজা’ মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা জর্জরিত। মজার ব্যাপার, এটা যে একটা অসুস্থতা, আমরা সেটাই বুঝি না। অত‌এব, আপনি যতই ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল হোন না কেন, আপনি আহত হবেনই! আপনার মতের প্রতি কেউ যদি নিঃস্পৃহ থাকত বা মতের খণ্ডন বিরুদ্ধমত দিয়ে করত নৈর্ব্যক্তিকভাবে, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা মত পছন্দ না হলে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসি। অসহায়দের জন্য ওটাই যে লাস্ট ডিফেন্স! বাঙালি সন্তান যদি হার্ভার্ডফেরত‌ও হয়, তবু সে এমন দুর্বলতা থেকে মুক্তি পেতে চায় না।

আমরা অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন, কপট, মূর্খ। তাই আমরা অনেক ভাল সার্টিফিকেট আর চাকরি পকেটে নিয়ে ঘুরব, কিন্তু কখনোই মানুষ হবো না। ইটস্ দ্য ফেইট অব দিস নেশন।

ভাবনা: তিনশো সাতাশ

…………………………………

তারিখটা ৩০ অক্টোবর ১৯৫০। মহেশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁর অফিস রুমে গিয়ে দেখলেন, তাঁর চেয়ারে বসে আছেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক জনাব জয়নাল হক। (এই নামটা ছদ্মনাম।)

কেন? আপাতদৃষ্টিতে সঙ্গত একটি কারণে। প্রধান শিক্ষক স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য আর ওই সহকারী শিক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সহকারী শিক্ষকের স্থান প্রধান শিক্ষকের উপরে। তাই পরিষদের সবার মতামত ছিল এই, উনারই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হওয়া উচিত। পুরো ইউনিয়নে উনার পদমর্যাদাই তো সবার উপরে! একজন ইউপি চেয়ারম্যান কেন একজন ইউপি মেম্বারের অধীনে চাকরি করবেন? হোক না প্রধান শিক্ষকটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড মার্কস নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স করা; আর সহকারী শিক্ষকটি নাহয় বিএ পাস, তবু সামাজিক মর্যাদা তো উনারই বেশি, তাই না? প্রধান শিক্ষক বংশ পরম্পরায় জমিদার, তাই হয়ত মহেশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের জায়গাটা দান করেছেন, স্কুল প্রতিষ্ঠাও করেছেন, স্কুলের যত সম্পদ আছে, তার সিংহভাগই উনি দিয়েছেন (মহেশখালী আলোকিত হওয়ার পেছনে মহেশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এই বিদ্যালয়ের অ্যালামনাই আছেন।); সবই ঠিক আছে, কিন্তু তার অর্থ তো কোনোমতেই এ হতে পারে না যে, উনি একজন ইউপি মেম্বার হয়ে ইউপি চেয়ারম্যানকে ডিঙিয়ে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হয়ে যেতে পারেন! কিছুতেই এমন হতে দেয়া যায় না! প্রধান শিক্ষক নাহয় মহেশখালীর ইতিহাসে প্রথম ভার্সিটি-গ্র্যাজুয়েট, এলাকার কল্যাণে সবচাইতে বেশি দান উনারই; ঠিক আছে, সবই মেনে নেয়া গেল, তাই বলে উনার অধীনে ইউপি চেয়ারম্যান কীকরে চাকরি করতে পারেন? অসম্ভব! অবাস্তব! এ তো রীতিমত অরাজকতা! এলাকার প্রভাবশালীরা এমনটাই মনে করেন।

সেদিন ভীষণ অভিমানী এই প্রধান শিক্ষক তাঁর আসনে উপবিষ্ট সহকারী শিক্ষককে শুধু এইটুকু বলেছিলেন: “আপনি যখন প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসেই গেছেন, সে চেয়ারে আমি আর বসব না। ভাল থাকবেন।” বলেই স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়িতেও ফিরলেন না, ওই অবস্থায়ই মহেশখালী থেকে চলে গেলেন রংপুরে। সেখানে কারমাইকেল কলেজ-এর বাংলা বিভাগে যোগদান করলেন। বছরখানেক পর স্যার আশুতোষ কলেজ-এ যোগদান করে চলে গেলেন কানুনগোপাড়ায়। সেখানেই কাজ করেছেন আমৃত্যু। থাকতেন টিচার্স কোয়ার্টার্সে। জীবদ্দশায় উনি আর কখনো মহেশখালীতে ফিরে যাননি। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে উনি ছিলেন দেবতুল্য। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য ছিল প্রবাদপ্রতিম। লোকে বলে, কেউ কখনো উনার ধুতি-পাঞ্জাবিতে একটু ময়লা দেখেনি, ভাঁজ দেখেনি। সারাজীবনই অকাতরে দান করে গেছেন। কানুনগোপাড়ায় শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে উনার অবদান এখনো সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

উনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, নাট্যাভিনেতা এবং আবৃত্তিকার। কলকাতাসহ বহু জায়গায় অনেক নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন, নিজেও অভিনয় করেছেন। ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা প্রকাশের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন ছিলেন বলে উনার কোনো পাণ্ডুলিপি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। উনি সবসময়ই নেগেটিভ রোলে অভিনয় করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ৪ ডিসেম্বর ১৯৬৪ তারিখ, যেদিন উনি মারা যান, সেদিনও উনি নিজের রচনা ও নির্দেশনায় ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ নাটকে মীরজাফরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। (সে গল্প আমার অন্য লেখায় আছে।) সেদিন উনার বয়স ছিল ৫৩ বছর। মৃত্যুর পর উনার সব বই এবং রচনা মহেশখালীতে নিয়ে আসা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি ও দেশীয় রাজাকাররা উনার জমিদারবাড়িতে অগ্নি-সংযোগ করলে উনার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের কয়েক হাজার বইয়ের সাথে উনার সমস্ত পাণ্ডুলিপি পুড়ে ছাই যায়।

তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এই সুপণ্ডিত ব্যক্তির নাম অবিনাশ চন্দ্র পাল। ১৯৪৬ সালে স্থাপিত মহেশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অনারবোর্ডে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকদের তালিকার প্রথম নামটি—বাবু অবিনাশ চন্দ্র পাল, এম.এ. বি.টি. (কার্যকাল ০১-০১-৪৬ হতে ৩০-১০-৫০) আমার মা উনার ছোটো মেয়ে। দাদুর মৃত্যুর সময় মায়ের বয়স ছিল সাড়ে তিন বছর।

মহেশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে অবিনাশ স্যার নামে আরো একজন স্যার ছিলেন, যিনি ’৭৫-এর পরে শপথ নিয়েছিলেন, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত পায়ে স্যান্ডেল পরবেন না। উনি সত্যিসত্যিই খালিপায়ে স্কুলে যেতেন। ৯৬’তে অবশেষে স্যান্ডেল পরেন……

পুনশ্চ। ৩০ অক্টোবর ১৯৫০ থেকে ২৩ মে ২০১৮। প্রায় ৬৮ বছরের ব্যবধান। এ দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছি। কিন্তু একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করেছেন? মনমানসিকতায় আমরা এখনো আগের অবস্থানেই রয়ে গেছি, এবং খুব সম্ভবত, আজ থেকে ৬৮ বছর পরও ঠিক এমনই রয়ে যাব। এমন মানসিকতা আমাদের ঐতিহ্য। আমরা আমাদের ঐতিহ্যরক্ষার ব্যাপারে বরাবরই নিষ্ঠাবান।

ভাবনা: তিনশো আটাশ

…………………………………

এক।

ছবিটা মজার……কালোকালো যে উটগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আসলে ছায়া। ছবিটা জুম করলে, ব্যাপারটা বুঝা যায়।

মানুষের জীবনের অনেক কিছুও—এই ছবিটার মতো…..মিথ্যেগুলো, অমন হাঁ হয়ে থাকে যে………সত্যগুলো ঢাকা পরে যায়…….জীবনটাকে জুম করলে বুঝা যায়। সে জুমটাই-বা করতে পারে কয়জন?

একটা সময়, মানুষ নিজেকে ছাড়া চারপাশের সবাইকে ভালোবাসে, ভালোবাসতে চায়, নিজেও অন্যের ভালোবাসা পেতে চায়।

ভালোবাসা নিতে আর দিতে, সে জীবনের চতুর্দিকে হন্যে হয়ে ছুটে…….তখন কেউ তাকে ভালোবাসে না, এমন-কী তার ভালোবাসা নিতেও চায় না……….

অবিরাম ছুটতে-ছুটতে, মানুষের অবজ্ঞা আর অবহেলা পেতেপেতে একটা সময় সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, একই সাথে এটাও বুঝতে পারে, এই পৃথিবীতে মানুষ কল্পনার চেয়েও বেশি স্বার্থপর………এখানে, নিঃশ্বাসও স্বার্থে আটকে থাকে…….নিজেকে ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে ভালোবাসা—একান্তই মূল্যহীন। পৃথিবীতে নিজের চেয়ে আপন আর কেউ নেই।

তখন ধীরেধীরে সে অন্য সব কিছুর প্রতি মোহ কাটিয়ে, নিজেকেই ভালোবাসতে শুরু করে……..নিজেকে সময় দেয়, নিজের সমস্ত কিছুর ব্যাপারে সচেতন হয় এবং নিজেই নিজের যত্ন নিতে শুরু করে…….

ক্রমাগত সঠিক পরিচর্যায় একসময় সে নিজেকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যায়, যখন তার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়……….মানুষ তখন তাকে, মানে, আসলে তার অবস্থানকে আর তার কাজকে ভালোবাসতে শুরু করে…….এই ভালোবাসায়……মিথ্যেও থাকে, সত্যও থাকে…….মানুষ তাকে ভালোবাসতে চায়, আবার তার কাছ থেকে ভালোবাসা পেতেও চায়……..

হা হা হা……কিন্তু ততদিনে সে আর কোনো ভালোবাসাকেই বিশ্বাস করে না……ভালোবাসা’র বাইরের জগতের সাথে তার এক অন্যরকমের ভালোবাসা হয়ে যায়……..

এখন আর সে—ভালোবাসতেও চায় না, ভালোবাসা পেতেও চায় না…….কোনো ভালোবাসারই তার কোনো প্রয়োজন নেই……..

একদিন যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সে অস্থির ছিল, তৃষ্ণার্ত ছিল, সেই ভালোবাসাকেই আজ সে মুচকি হেসে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়……

রৌদ্রময় সুন্দর ঝকঝকে বিকেলে………চায়ের ধোঁয়ায় চুমুক দিয়ে, অদৃশ্য আয়নায় তাকিয়ে সে বলে ওঠে—ভালোবাসি!….জীবন সুন্দর।

দুই।

কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ পরিবর্তন করে নতুন করে প্রকাশ করাটা আমার কাছে একেবারেই ভাল লাগে না। শুধু যে ভাল লাগে না, তা নয়, একটু যেন কষ্টও লাগে।

পুরনো প্রচ্ছদ বাদ দিয়ে নতুন প্রচ্ছদে বই ছাপালে যেমনি বইটা নতুন হয়ে যায় না, তেমনই আবার……আগের বইটাও যেন আর থাকে না।

একটা বই প্রকাশের সাথেসাথে সেই বইয়ের প্রচ্ছদ, যেমনই হোক, প্রাসঙ্গিক কি অপ্রাসঙ্গিক, মানানসই বা বেমানান, যেমনই হোক, ভেতরের গল্পের সাথে সেই প্রচ্ছদের একটা গভীর সম্পর্ক হয়ে যায়।

পরবর্তীতে যখন কিছুকাল পরে বা অনেকটা সময়ের পরে, সে বইটা নতুন প্রচ্ছদে ছাপা হয়, তখন যেন সেই সম্পর্কে কোথায় একটা ছন্দপতন হয়……ভেতরের সব কিছু ঠিক থাকলেও কোথায় যেন একটা হাহাকার থাকেই!

আদর্শিক দৃষ্টিতে, প্রচ্ছদ পরিবর্তন ব্যাপারটা কেমন, তা জানি না, কিন্তু আমার কাছে এটা এক প্রকার ক্রাইম মনে হয়।

বহুকাল আগে কোনো লেখক ভালোবেসে তার বই যে প্রচ্ছদে ছাপিয়ে গেছেন, জীবনভর সেই বই যত কপিই ছাপানো হোক না কেন, সে প্রচ্ছদেই ছাপানো উচিৎ……

অবশ্য আমার ‘উচিৎ’ বলাটা ঠিক হবে না………কারণ,, কোনো লেখক যদি সেটা চান, তিনি তো তা করতেই পারেন………তার কাছে পরিবর্তন করার ব্যাপারটা ভাল লাগতেও পারে।

তবে আমি যদি লেখক হতাম, থুক্কু লিখিয়ে হতাম, তাহলে নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ পরিবর্তন করতে, কখনোই দিতাম না!

(দ্বৈত বলে, “এই যে হ্যাল্লুউউউ! আফা, আফনের এইসব কথা না বলিলেও চলিবেক! আফনে লিখিকা হইবেন না, আর সেই সম্ভাবনার, কুনু সম্ভাবনাও নাই…….কাজেই, চুপ মাইরা যান……হি হি হি…..” আমি বলি, “অইইইইককক, চুউউউপপপ! যা! দূর হ তুই! দূরে গিয়া বাঁইচ্চা থাক………হে হে, মরতে কইলাম না…….কারণ, মরলে চলবে না, কিছু যন্ত্রণাকে বাঁচায় রাখতে হয়—নিজে বাঁচার প্রয়োজনেই! শুধু ইকটু দূরে থাকলেই হয়! মানুষের পক্ষে যন্ত্রণা ছাড়া বাঁচা সম্ভব না!………হে হে হে…..)

তিন।

মনের পাশে জায়গাদেয়া আপন, কাছের মানুষগুলো—আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত—যে কেউই হোক, ‘বিশেষ’ কেউ হয়ে গেলে বা হয়ে যেতে থাকলে, ব্যাপারটা কখনো-বা যেমনি আনন্দের হয়, তেমনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুঃখেরই।

বিশেষ কেউ হতেহতে তারা কেমন যেন ধীরেধীরে নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতে থাকে…….এর সবটা দায় যেমনি নতুন অবস্থান বা চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতির নয়, তেমনই তা আবার একান্ত তাদের নিজেদেরও নয়।

তারা শুধু নিজেদেরই দূরে সরিয়ে নেয় না, এর পাশাপাশি অন্যদেরও কাছে ভিড়তে দেয় না।

তখন তাদেরকে চাইলেও কাছের মানুষগুলো আগের মতো আর ভালোবাসতে পারে না, কারণ, কী যেন এক অদ্ভুত কারণে…….তাদের অনেকেই ধরেই নেয় যে, তারা বিশেষ কেউ বলেই তাদের প্রতি সবার এই ভালোবাসা……..কিংবা এতটা কেয়ার নেয়া বা তাদের বিপদে খুব করে পাশে থাকার পেছনে নিশ্চয়ই লোকের কোনো না কোনো স্বার্থ আছে!

অথচ তারা কিন্তু জানে, এই ভালোবাসা, মায়া ব্যাপারগুলো ওরা বিশেষ কেউ হবার আগেও ছিল, আবার বর্তমানের বিশেষত্ব চলে গেলেও থেকে যাবে।

তবুও তারা কেন যেন সেই একই ভাবনায় আটকে থাকে।

তবুও তারা ভাল থাকুক। বড় বা ভাল অবস্থানের বিপরীতে তাদের মনটা—ছোট না হয়ে বরং সমান্তরালে চলুক বা আরও বড় হোক।

কেননা, সংকীর্ণ মন নিয়ে জীবনের কোনো সুখই ঠিকভাবে উপভোগ বা উপলদ্ধি করা যায় না।

সবাই ভাল থাকুক……..

ভাবনা: তিনশো উনত্রিশ

…………………………………

এক।

মাঝেমধ্যে মন চায়………একগাদা আয়না সাথে নিয়া চলাফেরা করি।

কিছু মানুষ থাকে না………আপাদমস্তক আজব! আচম্পিক! বেল্লিক! উদ্ভট! উৎকট! উৎচুক! উজবুক! সব গেটাপ নিয়া বাইরে বাইর হয়, তাগোরে ধইরা একটা কইরা আয়না ধরায় দিব…….

আমি নিশ্চিত, এরা বাসা থেইকা যেই আয়নায় নিজেগোরে দেইখা বাইর হয়, সেইটা কোনো বাস্তব আয়না না, সেইটা কোনো কল্পলোকের কাল্পনিক আয়না……যেই আয়নায় তাকাইলে, নিজেরে বাদ দিয়ে দুনিয়ার অন্য সব কিছু দেখা যায়!

দ্বৈত, চুপ থাক তুই! খবর্দার, একদমই মুখ খুলবি না…….(এইটা এখনই বকরবকর শুরু করবে, তাই ওরে থামায় দিসি। হে হে………)

সবার পছন্দ আলাদা, যেকোনো মানুষ তার নিজের ইচ্ছামতো যখন খুশি তখন, যেমন ইচ্ছা তেমন পোশাকে আর সাজে, যেখানে খুশি সেখানে যাবে—এই সব কিছু জাইনাই বলছি!

দুই।

আমার সাথে এগুলো কী ঘটছে, জানি না। এইতো মাত্র তিন বছর আগেও কখনোই তো জীবন এমন ছিল না। আমি শুধু জানি, পৃথিবীতে এই একটা মানুষ ছাড়া আর কাউকে আমি আমার আত্মার অংশ হিসাবে মেনে নিতে পারব না।

না, আমার ওকে দেওয়ার মত আসলেই কিছু নেই, কিছুই নেই—দু’চোখ ভরা জল ছাড়া। আমি এমন বিষণ্ণ কথামালায় ওকে ভারাক্রান্ত করতেও চাই না।

সে আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা, ভাললাগা, আমার পৃথিবী; আমার সবকিছু। হয়ত কেউই বিশ্বাস করতে পারবে না, প্রতি মুহূর্তে আমি বেঁচে থাকার শ্বাস নেই সেই একজনের প্রতি পদক্ষেপের স্পন্দনে। আমার পুরো পৃথিবী টলে ওঠে, যদি সে বিপদে থাকে, চারপাশ ঝাপসা হয়ে যায়, যদি সে কোনো কারণে কষ্ট পায়, যদি সে উৎকন্ঠিত হয় কোনো বিষয়ে, আমি সারাটাদিন তা নিরাময়ের উপায় খুঁজেখুঁজে অস্থির হই, এই আশায়, যদি ওর অস্থিরতার বিন্দুমাত্র নিজের মাঝে নিয়েও ওকে একটু শান্তি দিতে পারি! কিন্ত আমার সে ক্ষমতা কই! ভীষণ ক্ষুদ্র এই আমি তার বিশালতার মাঝে কেবলই হারিয়ে যাই বারবার! আমি তাঁকে কেবল খুশি দেখতে চাই, নিঃশঙ্ক আর সত্যিকার অর্থে আনন্দিত দেখতে চাই। পুরনো সকল ব্যথা আর বেদনার ঊর্ধ্বে থাকবে যে আনন্দ! সেই একজন যে শুধু তুমিই! হয়তোবা তুমি কখনো জানবেই না এ কথাগুলি, তবু আমি চাই, তুমি ভাল থাকো, আমি শুধু তোমার ছায়া হয়েই বাঁচব নাহয়। আর কিছুই কখনো চাইব না। শুধু আমাকে বেঁচে থাকতে দিয়ো তোমার প্রতি স্বপ্নে কিংবা দুঃস্বপ্নে, হৃদয়ের অন্দরমহলে না হোক, অন্তত চিলেকোঠায়।

কুহক…….

আমাদের রক্তের গ্রুপ তো একই; তোমার শরীরে যখন ব্লাডের প্রয়োজন হবে, তখন তোমাকে ব্লাড দেয়া যাবে, তোমার শরীরে আমার রক্ত প্রবাহিত হবে, তোমার রক্তে আমার রক্ত মিশে যাবে, তাতে কোনো পাপ হবে না। কিন্তু আমার মন যখন চাইবে প্রিয় মানুষটার উষ্ণতা নিতে, সেটা আমি নিতে পারবো না, কারণ, এতে পাপ হবে।

এ সমাজের খুব অদ্ভুত নিয়ম, না! ধর্ম, সমাজ, রীতি, নীতি…….কতো কিছু যে ভালোবাসাকে শেকল পরায়! অথচ ভালোবাসাটা কখনো ওসব মেনে আসেই না!

তিন।

এক বোকা মন যখন

তার (B) প্রিয় মানুষের (A) কল্পনায়

কষ্টের ক্লান্তির নীরব চিৎকারে অস্থির,

ঠিক সে সময়—

সে মানুষটি (A) হয়ত তার (A) কাঙ্ক্ষিত কারো (C) সাথে, তার (C) দেয়া আদরের আহ্লাদে সরব শীৎকারে সস্থির……আহা!

যখন কেউ (B) তার ভালোবাসার মানুষের (A) জন্য কষ্টে চোখের জলে বুক ভাসায়, তখন হয়তো ‘কেউ (C)’ তারই (A) আদরে উন্মাদনায় আর রাগমোচনে গা ভাসায়…….

বোকা মনগুলো এমনই হয়…….কারণ, জীবন এমনই……..

কিংবা, মন বোকা হলে

জীবন এমনই হয়………

………………………………..

তোমার ওপাশ থেকে

‘আমি’ বলে নেই কিছুই!

সত্যিই তো—

যার অস্তিত্বই নেই,

তার সাথে আর

কী-ইবা করবে তুমি, বলো!

তাইতো

তুমি কিছু করোনি,

কিছুই করোনি তুমি,

কিচ্ছু করোনি!

যা হয়েছে, তার সবই করেছে

কেবলই আমার মিথ্যে কল্পনারা……..

মনে আছে, খুব তাচ্ছিল্যে একদিন বলেছিলে—

“………………………”

বলেছিলাম, দর্পের আগুন ঠিক নিভে যায়—বিশ্বাস করোনি সেদিন।

সত্যিই—নির্লজ্জতা, ছাড়ছেই না আমার পিছু!

চার।

অনুভূতি?

হুমম্‌, থাকেই তো সব! শুধু কষ্ট আর রাগ হলে, নিজেকে আরো কষ্ট দিতে—আন্ধাগোন্ধা একাধারে মেসেজ আর ছবি ডিলিট করতে থাকি………

আমার কাছে তো সব থাকে—ভালোবাসায়, আদরে, সযতনে।

শুধু আপনিই ওদের কেড়ে নেন……..কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন।

ওদের তো কষ্ট হয়, খুউউব কষ্ট হয়; হোক জড়, তবুও…….

এই যে ওদের নিয়ে নেন, এজন্য কখনোই আপনাকে আমি ক্ষমা করবো না!

(কেড়ে নেন মানে হলো, আমাকে এত্তগুলা কষ্ট দেন, তখন আমি সব ডিলিট করতে থাকি……..এভাবে কতকিছু হারিয়ে গেছে…….ওদের জন্য কতটা কষ্ট হয় আমার…….হুহহ্……….

আপনি একটা আস্ত জ্বিনের বাদশা! আপনাকে ধইরা এক্কেবারে খাইয়া ফেলবো, নয়ত একদম চাইপ্পা মাইরা ফেলবো!)