ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৯৩তি অংশ)

ভাবনা: ছয়শো পঁয়তাল্লিশ

………………………………………………………

ভাইয়া, পড়াশোনা করতে কখনোই ভাল লাগতো না; এর ফলও হাতেহাতে পাইসি। ম্যাট্রিকে গোল্ডেন এ+ পাইসিলাম। চিটাগাং কলেজে ভর্তি হলাম। সবাই ভালো স্টুডেন্ট হিসেবে জানতো। ইন্টারমেডিয়েটে পড়াশোনা অনেকটা ছেড়েই দেই। স্যারদের বাসায় যেতাম আর আসতাম, পড়াশোনা কিসু করতাম না, রাস্তায়-গলিতে আড্ডাবাজি করতাম, বাসায় ফিরতাম ১০টার পর। বাবা-মা’র কথা শুনতাম না, উল্টা ঝগড়া করতাম, বাসায় চিল্লাচিল্লি করতাম। মনে হতো, ওইটাই জীবন। ভাইয়া, চিটাগাং কলেজ থেকে কেউ ফেল করে না, ইন্টারমেডিয়েটে ফেল করা সত্যিই কঠিন। আর আমি সেটাই করসিলাম। সায়েন্সে পড়তাম, কিসুই পারি না, বানায়ে কী লিখবো, সাদা খাতা জমা দিসি ভাইয়া। নিজেকে এই প্রথমবারের মতো চিনতে পারলাম। দেখলাম, সবাই দূরদূর ছাইছাই করে, কেউ দুই পয়সারও পাত্তা দেয় না। খালি মা-বাবা কিছু বলতো না, শুধু কাঁদতো, শুধু কাঁদতো। অথচ, আমি আগে ভাবতাম, বাকিরা সবাই আমার আপন, মা-বাবা’কে শত্রুর মতো লাগতো। খুব কান্না পেতো ভাইয়া, আবার কাঁদতে লজ্জাও লাগতো। মাঝে মাঝে মনে হতো, মরে যাই। আবার মরে গেলে মা-বাবা আরো বেশি কাঁদবে, এটা ভেবে কষ্টও লাগতো। আবার মরে গেলে কী হবে, কী হবে না, এগুলা ভাবতাম, ভয়ও লাগতো। পাগলের মতো ছিলাম কয়েক মাস। এরপর বাবা-মা বুঝালো, একবার ফেল করলে কিছু হয় না। আমি ভালোভাবে পড়লে পরেরবার অনেক ভালো করতে পারবো, পুরা লাইফটা তো পড়ে আছে, আমি চেষ্টা করলে অনেকদূর যেতে পারবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাইয়া, হাসি পাচ্ছে না শুনতে? কিন্তু জানেন, ওইসময়ে কেউ আমাকে ভালো কিসু বলতো না, তাই একটু ভালো কিসু শুনলে মনটা অনেক বড়ো হয়ে যেতো, মনে হতো, আমিও পারবো! আমি পরেরবার পরীক্ষা দেই, খুব বাজে রেজাল্ট করি, কিন্তু পাস করি। ভাইয়া, জানেন, পরীক্ষার সময় স্যাররা এসে আমার সামনে দাঁড়ায়ে বলতো, এই পেজটা এক টানে কেটে দাও, পুরো পেজ তো ভিজায়ে ফেলসো। আমার খুব কষ্ট লাগতো, পরীক্ষার সময়ও কাঁদতাম, চোখের পানিতে পেজ ভিজে যেতো। আমি কোনোদিন পরীক্ষায় ফেল করি নাই, ছোটবেলায় সবসময় ফার্স্ট-সেকেন্ড হতাম। সেই আমি কিনা! যাই হোক, আমার বাজে রেজাল্ট দিয়ে ভালো কোথাও ভর্তি হওয়া তো দূরে থাক, পরীক্ষাও দিতে পারি নাই। বাবা বলসিলো, প্রাইভেটে ডাক্তারি পড়াবে। বাবার অতো টাকা ছিলো না, লোন নিবে ভাবতেসিলো। হঠাৎ আমার মনে হলো, অনেক কষ্ট দিসি বাবা-মা’কে, আর না। আমি অনেকটা জোর করেই কমার্স কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হলাম, বাবাকে অন্তত আমার জন্যে কারো কাছে হাত পাততে হবে না। আত্মীয়-স্বজন, পুরোনো বন্ধু-বান্ধব, পাড়ার লোকজন কেউই আমাকে গুনতো না, কেউ না, কেউ না! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের কেউ পাত্তা দেয় না, ভাইয়া। আমিও একসময় দিতাম না, আর সেখানেই আমাকে পড়তে হইসে। কী আইরনি, তাই না ভাইয়া? নিজের উপর খুব রাগ হতো। ভাইয়া, ছোটোবেলায় ভালো স্টুডেন্ট হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে যাওয়াটা একটা বিশ্রী জিনিস, নিজেকে কিছুতেই আর ছোটো ভাবা যায় না। আগে সবাই ভালো ভালো বলতো, তখন আর কিসু বলে না। সবার উপরে কী যে রাগ হতো! মনে হতো, কেউই আমাকে দেখতে পারে না, সবাই আমার শত্রু। কেউই ভালো না বাসলে খুব খারাপ লাগে, ভাইয়া; শুধু খারাপ লাগতেই থাকে। কারোর সাথে খুব একটা কথা বলতাম না, কেউ কিসু বললে, কষ্ট পেতাম, কষ্ট চেপে রাখতাম, কিন্তু মুখে কিসু বলতাম না। মনে হতো, বলবেই তো, সব দোষ আমার। ভাইয়া, আমি ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড জেদি, মুখে কিসু না বললেও জেদ ঠিকই ছিলো। আপনি তো জানেন, ডিগ্রি ৩ বছরের কোর্স; আমি থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি সময় থেকেই আইবিএ’র জন্যে পড়াশোনা শুরু করি। আমার মনে হতো, আইবিএ’তে যারা পড়ে সবাই তো ওদেরকে ভালো স্টুডেন্ট ভাবে, ওখানে ভর্তি হয়ে যদি আমার ফেইলিউরগুলোকে একটু কম্পেন্সেট করা যায়। খুব ভালোভাবে প্রিপারেশন নিলাম। জীবনে এই প্রথম ডিসাইড করতে পারসিলাম, আমি আসলে কী চাই। ভাইয়া, আপনার একটা কথা আমার খুব প্রিয়। আপনার ফেসবুকে অ্যাবাউট মি’তে আপনি লিখসেন, It took me almost 2 decades to decide what I really want . When I’d decided finally, it took me only 1 year to get what I really want. আপনি জানেন না, আপনার অনেক কথাই আমার মুখস্ত, ভাইয়া। যা-ই হোক, আমার ফাইনাল রেজাল্ট বের হবার আগেই আমি আইবিএ’তে পরীক্ষা দিলাম, এবং টিকলাম। এখন সবাই ভাবে, আমি যে ফেল করসিলাম, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো, আমি আসলে অনেক ক্যালিবারওয়ালা ছেলে। অথচ, ওরাই একসময় বলতো, ও ফেল করবে নাতো, কে ফেল করবে? সারাদিন টো টো করে, লেখাপড়া নাই, আজেবাজে ছেলেদের সাথে মিশে, আরো কতোকিসু। ভাইয়া, বিশ্বাস করেন, ওরা যা যা বলতো, সব সত্যি ছিলো না। কিন্তু আমি তো ফেল করসিলাম, তাই ওদেরকে কিসু বলারও ছিলো না। আরো বেশি কষ্ট লাগতো যখন দেখতাম, ওরা ওই কথাগুলো আমার মা-বাবা’কেও শোনাতো। এখন ভাবি, মা-বাবা’কে কতো কষ্ট দিসি! এখন আর কেউ কিসু বলে না আমার মা-বাবা’কে। এটাই আমার কাছে সবচে’ বড়োকিছু, আইবিএ’তে পড়া একটা উছিলামাত্র। ভাইয়া, আমি বিশ্বাস করি, যদি কেউ আল্লাহর কাছে মন থেকে হালাল কিছু চায়, আর সেটা পাওয়ার জন্যে ঠিকভাবে পরিশ্রম করে, আল্লাহ কখনোই তাকে নিরাশ করেন না। ভাইয়া, আপনাকে এগুলা বলতে লজ্জা লাগতেসে, কিন্তু কেনো জানি মনে হলো, বলি। আপনার সম্পর্কে আমি কিসু কিসু জানি, আপনি নিজেও অনেক বাজে অবস্থা থেকে আজকের অবস্থানে উঠে আসছেন। আপনি লিখসিলেন, “পৃথিবীতে নোবডি হ’য়ে থাকাটা সুখের নয়৷ যে যা-ই বলুক, এটা নিশ্চিত, নোবডি-দের জন্যে এই পৃথিবীতে শুধু নাথিং-ই বরাদ্দ থাকে৷ জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, আমরা কখনো তা ভাবতেই পারি না৷” এটা খুব বেশি সত্যি, ভাইয়া। অনেক বকবক করলাম, কিছু মনে নিয়েন না। ডিগ্রি পাস করে তো বিসিএস দেয়া যায় না, দেয়া গেলে চেষ্টা করে দেখতাম। আমি মাস্টার্স শেষ করেই বিসিএস পরীক্ষা দিবো, একটু হেল্প কইরেন, ভাইয়া।

ভাবনা: ছয়শো ছেচল্লিশ

………………………………………………………

স্টুডেন্টলাইফে পাবলিক পড়াশোনার পাশাপাশি সময় বের করে টিউশনি করে, আর আমি টিউশনির পাশাপাশি সময় পেলে পড়াশোনা করতাম। আমার নিজের কোচিং সেন্টার ছিল। পলস্ কোচিং হোম। ক্লাস নাইন থেকে অনার্স পর্যন্ত পড়াতাম। একেবারে সকাল থেকে রাত অবধি। চুয়েটে অতো ক্লাসটাস করতাম না। আমি পড়াতে অসম্ভব রকমের ভালোবাসতাম। আমি যা জানি, তার সর্বোচ্চটুকু দেয়ার চেষ্টা করতাম। অনেকবেশি ডেডিকেটেড ছিলাম পড়ানোর ব্যাপারে। স্টুডেন্টদের জন্য কঠিনকঠিন নোট, লেকচার শিট তৈরি করার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ যে পরিশ্রম করতাম, সেটা এখন ভাবলেও আমি অবাক হই। প্রতি শুক্রবার সকালে বাংলা সাহিত্য পড়াতাম আর বিকেলে আইবিএ বিবিএ ভর্তি পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য ক্লাস নিতাম। একেবারে টপ লেভেলের গ্রামাটিক্যাল এক্সারসাইজ আর ভোকাবুলারির শিট রেডি করে স্টুডেন্টদের সলভ করাতাম। ইন্টারের স্টুডেন্টদের সায়েন্সের অন্তত ৩-৪টা বই সলভ করতাম, যাতে ওরা ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিক্যালে চান্স পায়। (খুব প্রফেশনাল ছিলাম, তবে কখনো কমার্শিয়ালি পড়িয়েছি, এটা আমার কোনো স্টুডেন্ট বলতে পারবে না।) তখন মনে হতো, এতোগুলো মুগ্ধ চোখ আমার দিকে ক্লাসে তাকিয়ে আছে, আমার স্টুডেন্টরা কতো ভালো রেজাল্ট করছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করছে, এটা পৃথিবীর সবচাইতে আনন্দের বিষয়। এই খুশিতেই জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। জীবন এখানেই!

২০০২-২০১১। দীর্ঘসময়। লিখতে গেলে অনেক কথা লিখতে হয়। (কখনো সময় পেলে সময় নিয়ে লিখবো, দেখি।) আড্ডার দেয়ার সোনালি সময়টা কীভাবে যে নষ্ট করেছি পড়ে আর পড়িয়ে সেটা ভাবলে এখনো আফসোস হয়। অতোটা কষ্ট কোনো স্বাভাবিক মানুষ করতে পারে স্রেফ আনন্দের জন্য, এটা মাথায় এলেও এখন বিশ্বাস হতে চায় না। অনেক পড়াশোনা করে স্টুডেন্ট পড়াতাম। ওদের সিলেবাসের বইগুলো অন্তত কয়েকশ’বার আমার নিজেরই পড়া হয়ে গিয়েছিল। ওদের বেসিক স্ট্রং করার জন্য যেভাবে পড়াতাম, সেটা ছিল ওদের জন্য রীতিমত টর্চার। (ঠিকমতো পড়াশোনা না করলে প্রচুর বকাঝকা করতাম, বেত দিয়ে মারতাম।) সব বিষয় আমি নিজেই পড়াতাম। শুধু ইন্টারের বায়োলজি আর কমার্সের সাবজেক্টগুলোর জন্য আরো ২ জন স্যার ছিলেন। পুরো একক চেষ্টায় একটা কোচিং পুরোপুরি দাঁড় করানোর রেকর্ড আর আছে কিনা আমার জানা নেই। সেসময় যে কী অফুরন্ত প্রাণশক্তি ছিল, এখন তা কল্পনাতেও আনতে পারি না। নিজের সাথেই চ্যালেঞ্জ করতাম, এই বলে যে, আমি যা পড়াই, তা যেন এর চাইতে ভালোভাবে পড়ানো না যায়। আমি জানি, এই ভাবনাটা স্রেফ পাগলামি। কিন্তু ওইসময়ে ভাবতাম, আমি পৃথিবীর সেরা পড়াটা পড়াই। ওইসময়ে ভূতের মতো পরিশ্রম করতে পারতাম। (আমার ইনকাম ছিল আমার বয়সের যেকোনো ছেলের চাইতে বেশি। এতোটাই ব্যস্ত থাকতাম যে বখে যাওয়ার সময়ও ছিল না। আমাদের ফ্যামিলি যথেষ্ট সচ্ছল। তাও আনন্দের জন্য ওসব করতাম। অনেক স্টুডেন্টকে ফ্রি পড়িয়েছি। ওদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল গরিব, কিছু ছিল যারা আমার টাকা মেরে দিত।)

আমি জানি না, আপনারা পড়ানোর ব্যাপারে আমার পাগলামো কতোটা আঁচ করতে পারছেন। আমি জানি, সেটা ভাবাও একটু কঠিন। আমি আমার ক্যালিবার ক্যারিয়ার কোনোকিছুর প্রতিই বিন্দুমাত্রও সচেতন ছিলাম না। আমি বরাবরই যা করতে ভালো লাগে তা করা’দের দলে। আমি পড়ানোতে পুরো পৃথিবীর সব সুখ একসাথে পেতাম। সেই আমি সেখান থেকে সরে এলাম। কীভাবে? কয়েকটা ঘটনা থেকে। ২টা শেয়ার করছি।

প্রতিবছর আমার অনেক স্টুডেন্ট বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়ে আমাকে ফোন করে জানাত। ওদের বাবা-মা যতটা খুশি হতো, আমার খুশি এর চেয়ে একটুও কম ছিল না। আমার খুব প্রিয় এক স্টুডেন্ট বুয়েটের ইলেকট্রিক্যালে চান্স পেয়েছিল। আমি ওকে খুব পছন্দ করতাম ওর বিনয়ী ব্যবহারের জন্য। ও যে চান্স পেয়েছে, সেটা ও আমাকে জানায়নি। আমি অনেকপরে সেটা জানতে পেরে ওকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বুয়েটে চান্স পেয়েছ জেনে অসম্ভব খুশি হয়েছি। আমি আশীর্বাদ করি, তুমি অনেকদূর যাও। ভাই, তুমি আমাকে এই খুশির খবরটা জানাওনি কেন?” ওর উত্তর ছিল, “স্যার, আমি তো অনেক ব্যস্ত ছিলাম, তাই আমার মনে ছিল না। আমি চান্স পেয়েছি কিনা এটা তো আপনারই ফোন করে আমাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। আমরা বেশিবেশি চান্স পেলে তো আপনারই লাভ, আপনার কোচিংয়েরই সুনাম। আপনি সামনেরবার আরো বেশি স্টুডেন্ট পাবেন।” আমার মনে হল, কেউ যেন আমার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। সেদিন ওকে কিছুই বলিনি, কিন্তু মনেমনে জেদ চেপে গেল।

আরেকটা ব্যাপার শেয়ার করি। আমার স্টুডেন্টদের গার্ডিয়ানরা বলাবলি করতেন, সুশান্ত স্যার আর কোনোকিছু করতে পারবেন না বলেই কোচিং চালাচ্ছেন। উনি বোধ হয় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াও ছেড়ে দেবেন। এভাবে স্টুডেন্ট পড়িয়েই জীবন কাটিয়ে দেবেন। ভালো কিছু করতে পারলে তো আর স্টুডেন্ট পড়াতেন না। কারোর কারোর ব্যবহার ছিল এমন, টাকা দিচ্ছি, স্যার তো পড়াতে বাধ্য। (আমি এখন মাঝে মাঝে ভাবি, এখনকার ডবল গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া অনেক স্টুডেন্ট যে প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় ওয়েটিংলিস্টেই জায়গা পায় না, সেখানে আমি ভর্তি পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়েছিলাম। হায়! ওরাও দম্ভ করে!)

আমি আমার জীবনে যা কিছু পেয়েছি, তার বেশিরভাগই প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে পাওয়া। আমি একটাসময়ে ভাবতে শুরু করলাম, আসলে টিউশনি আমাদের কী দেয়? এক। কাঁচা পয়সা। দুই। খুব সৌভাগ্যবান হলে, সম্মান আর কৃতজ্ঞতা। তিন। স্টুডেন্টদের ভালো রেজাল্টের সাইডইফেক্ট হিসেবে নিজের বাজে রেজাল্ট। চার। বোকাবোকা আত্মতৃপ্তি। আর কিছুই না। আমি আমার লাইফে যত স্টুডেন্ট পড়িয়েছি, তার একশ’ভাগের একভাগও আপনাদের কেউ পড়িয়েছেন কিনা, আমি জানি না। আমার নিজের কোচিং দেয়ার আগে অ্যাডমিশন কোচিং সহ ১০-১২টা কোচিংয়ে পড়িয়েছি। আমি খুব ভালো করেই জানি, স্টুডেন্টলাইফে টিউশনির ব্যাপারটাকে অন্যরা কীভাবে নেয়, এটা নিয়ে কে কী ভাবে। আমি আমার সেই প্রিয় স্টুডেন্টের কাছ থেকে কখনো পয়সা নিইনি। ওর বাবা ছিল না, তাই ওর প্রতি আমার একটা সফট কর্নার ছিল। ওকে ফ্রি পড়ানোর গুরুদক্ষিণা ও আমাকে যতোটা দিয়েছে, আমার খুব কম স্টুডেন্টই অতোটা দিতে পেরেছে। এখন আমি ওকে খুব ভালোবাসি ওর সেদিনের বেয়াদবির জন্য। আমার স্টুডেন্টদের গার্ডিয়ানদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। এই পৃথিবীতে সেটা করাই সবচেয়ে গর্বের আর আনন্দের, যেটা অন্য দশজন ভাবে, আপনি করতে পারবেন না। নিজেদের অজান্তেই এই চ্যালেঞ্জটা আমার প্রতি ছুঁড়ে দেয়ার জন্য আমি তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

আরেকটা কথা, টিউশনি ছেড়ে দেয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হল, টিউশনি সত্যিসত্যি ছেড়ে দেয়া। কয়েকবছর ধরে টিউশনি ছেড়ে দেয়াটা অনেকবার সিগ্রেট ছেড়ে দেয়ার মতো। একটা কাজ কীভাবে শুরু করা যায় কিংবা অনেকদিন ধরেই করছি এমন কোনো কাজ করা কীভাবে বন্ধ করে দেয়া যায়, সেটার সবচেয়ে সহজ টেকনিক আমার খুব খুব প্রিয় মুভি ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দি আগলি’র একটা ডায়লগ দিয়ে বলছিঃ When you have to shoot…Shoot! Don’t talk.

ভাবনা: ছয়শো সাতচল্লিশ

………………………………………………………

: হ্যালো শুনছেন?

: হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি৷ আপনি কে ব’লছেন, প্লিজ?

: রাত দেড়টা বাজে৷ আপনি জেগে আছেন কেনো? ঘুমাবেন না?

: আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না৷

: চেনার দরকার নেই৷ গল্প ক’রবেন?

: না৷ আমি রাখছি৷

ব’লেই ফোন কেটে দিলাম৷ মেয়েদের ফোন কাটলে মনে হ’তো, দুনিয়ার সব মেয়েই আমার জন্যে দিওয়ানা৷ অল্প বয়সের অদ্ভুত অহংকারী ইগো৷

দু’দিন পর৷

: যদি ফোন কেটে দেন, আমি আপনার বাবার সাথে সরাসরি কথা ব’লবো৷ উনাকে ব’লে দেবো৷

: মানে??

: আপনি আমাকে চেনেন৷ আমার সাথে কথা ব’ললে কী সমস্যা?

: আচ্ছা বলেন৷

: ভয় পেলেন? হিহি…..

কথা চলল৷ অল্পবয়েসি মেয়েদের মাথায় ছিটটিট থাকে৷ আগপাছ না ভেবেই ঝামেলা বাধাতে পারে৷ ও যদি বাবার নাম্বার যোগাড় ক’রে বাবাকে সত্যি সত্যি ফোনটোন ক’রে বসে, বাবা ভাববে, কাউকে পছন্দ করি এটা সরাসরি বলার সাহস আমার নাই৷ আমি ইচ্ছা ক’রে মেয়েটাকে দিয়ে বলাচ্ছি৷ প্রেস্টিজ থাকবে না৷ খুবই বিশ্রী ব্যাপার!

আরেকদিন৷

: আমার পরিচয় জেনে কী হবে?

: আমি অচেনা মানুষের প্রতি ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা, কোনোটাই বোধ করি না৷

: আপনি হঠাৎ বৃষ্টি দেখেননি? আমাদের প্রেমটা হঠাৎ বৃষ্টি টাইপ প্রেম৷ হিহি….

: মুভিটুভিতে নায়কনায়িকা দু’জনেই সুন্দর থাকে৷

: আপনি সুন্দর না হ’লেও আমার কোনো সমস্যা নাই৷ হিহি ……

(চুপ ক’রে থাকলাম৷ মেয়েটার সেন্স অব হিউমার আছে৷ তার মানে, ওর সুন্দরী হওয়ার চান্স কম৷)

: চুপ কেনো? হিহি …… আচ্ছা, আপনি কী ক’রছিলেন?

: গান শুনছিলাম৷

: কার গান?

: জগন্ময় মিত্রের৷

: ও …..

: উনার গান কেমন লাগে আপনার?

: হুঁ, ভালো৷

(মনে হ’লো, বানিয়ে ব’লছে৷)

: কোনটা সবচে’ ভালো লাগে?

: আসলে আমি উনার নাম শুনিনি৷

(আমি চুপ……..)

: চুপ কেনো?? আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, আমি শুনে নেবো৷ উনার নতুন অ্যালবাম বের হ’লে আমিই আপনাকে কিনে পাঠাবো৷

: উনার অ্যালবাম আর বের হবে না৷

: কেনো? উনি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন??

(মেজাজ খারাপ হ’লো৷ জগন্ময়ের ভূতও ততোদিনে ম’রে ভূত হ’য়ে গেছে৷ মেয়েটার গুণ ছিলো৷ রেজাল্ট খুব ভালো৷ প্রচুর বই প’ড়তো৷ সব মেডিকেলের বই৷ এবং সে রবীন্দ্রনাথের নাম জানে৷ এও বিশ্বাস করে, রবীন্দ্রনাথের লেখা নিশ্চয়ই ভালো৷ নইলে অ্যাতো লোক ভালো ব’লবে ক্যানো? ওকে লাইফ ইজ বিউটিফুল সহ আরো কয়েকটা মুভি দেখতে ব’লতে ব’লতে ক্লান্ত হ’য়ে একসময় বলা ছেড়ে দিই৷ ও থাকুক ওর মতো৷ তবে ওর খুব ভালো একটা দিক হ’লো, ও ভালোবাসতে জানতো, ভালোবাসতো৷ খুব ভালো রেজাল্ট-করা ছেলেমেয়েদের সাথে প্রেম করা অনেকসময়ই একটা বিরাট শাস্তি৷ ও ওরকম নয়৷ আমিই গাধার মতন ক’রে ভাবতাম৷)

সুখের ব্যাপার, আজকে ওর দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী৷ ওর বিয়ের ঘটকালি করি আমি নিজেই৷ আমি চিটাগাং কলেজে পড়ার সময় এক বন্ধুকে ব’লেছিলাম, কিশোর কুমার খাতুনগঞ্জের বড়ো চাল-ব্যবসায়ী৷ শখের বশে গানটানও করেন৷ ওয়াকম্যানে উনার আজ এই দিনটাকে শুনে ও রীতিমতো মুগ্ধ৷ আমার বন্ধুটি কিশোর কুমারকে চিনতো না৷ (সত্যিই চিনতো না৷) অ্যামেচার গায়কের প্রতি শ্রদ্ধায় ওর মাথা নত হ’য়ে গিয়েছিলো সেইদিন৷ চিটাগাং কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সামনে যে কলাপসিবল্ গেটটা সবসময় বন্ধ থাকতো সেটার সামনের সিঁড়িতে ব’সে আমি আমার ভালোমানুষ টাইপ বন্ধুটিকে বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে ওসব ব’লেছিলাম৷ সেইদিন আশেপাশের বান্দরগুলোও অতিকষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলো৷ আমি বরাবরই খুব গুছিয়ে সত্যের মতো ক’রে সিরিয়াসলি এবং সিনসিয়ারলি হার্মলেস মিথ্যা কথা ব’লতে পারি৷

বন্ধু, আজকের দিনে এটাই চাওয়া, তোদের ছেলেমেয়েকে অন্তত লতা-কিশোর শুনিয়ে বড়ো করিস৷

শ্রীজাত তাঁর কবিতায় (কোনো মেয়েকে) জিজ্ঞেস ক’রছেন,

শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি, এমন কেউ

তোমায় যদি প্রপোজ করে, কী করবে……

আজকের দিনে যখন প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’জন ক’রে বন্ধু কিংবা ছোটোভাই তাদের বিয়েতে দাওয়াত দেয়, যখন দেবদূতের মতো দেখতে বন্ধুদের কিডসের ছবিতে লাইক দেই, যখন দেখি আমার পাড়ায় দাদা ডাকার লোক ক’মে গেছে, স্কুলগোয়িং অল্পবয়েসীরা আঙ্কেল বলেটলে, যখন বিয়ে ঠিক হ’য়ে যাওয়া বন্ধুরা বলে, আগে না ক’রে দেয়া অনেক ছেলেই কিংবা মেয়েই এর চেয়ে বেটার ছিলো, তখন শ্রীজাতকে বলি, ও হ্যাঁ বলার মতো হ’লে ওকে শঙ্খ ঘোষ প’ড়তে দেবো৷ (অনেক হ’য়েছে……..) বেশিরভাগ মেয়েই কিন্তু আস্তে আস্তে তার ভালোবাসার ছেলেটার মতো হ’য়ে ওঠে৷

ভাবনা: ছয়শো আটচল্লিশ

………………………………………………………

বাবা, তোমাকে ধন্যবাদ!

আমি খুব সৌভাগ্যবান যে ছোটোবেলায় আমাদের বাসায় আইপিএস ছিলো না। সন্ধ্যায় যখন কারেন্ট চলে যেত, তখন বাবা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসতেন। আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় অপেক্ষা করে থাকতাম, কখন কারেন্ট চলে যাবে। ছোট্টো আমি আর আমার ছোটো ভাই বাবার হাঁটুর ওপরে বসে বসে বাবার মুখে শুনতাম, বিজলি বাতি চাঁদের আলোকে চুরি করে নিয়ে আমাদের ভুলিয়েভালিয়ে রেখেছে। বাবার কাছে তারা চিনতাম, চাঁদের আলো কীভাবে ছুঁয়ে দেখতে হয় শিখতাম, গাছের পাতায় চাঁদের আলো এসে পিছলেপিছলে গেলে সেটা কেমন লাগে, বাবা এইসব কথা বলতেন। এমন একটাও ছুটির দিন ছিল না যেদিন বাবা মা’কে মাছ-তরকারি কুটা, ঘর ঝাড়মোছ করা, কাপড় ধোওয়া এইসব ঘরের কাজে হেল্প করতেন না। বাবা হয়তো সবচেয়ে দামি খাবারটা নিয়ে ঘরে ফিরতেন না, কিন্তু সবচেয়ে দামিভাবে আমরা খাবারটা খেয়েছি। বাবা বলতেন, তোর মা সারাদিন ঘর সামলে রাখে বলেই তো আমি বাইরে কাজ করতে পারি। বাবাকে কখনোই মা’র রান্নার সমালোচনা করতে দেখিনি। বাবা মা’কে বলতেন (এবং এখনো বলেন) হোম মিনিস্টার। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। বাসায় শুধু ডাল-আলুভর্তা রান্না করলে যে খাবারের টেবিলে বসে মা’কে জিজ্ঞেস করতে হয়, আর কিছু নেই? এটা ছোটোবেলা থেকে কখনোই শিখিনি। বরং মা যে সারাদিন আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এই অসুস্থ শরীরেও ব্যস্ত সময় কাটান, বাবা সেটা অ্যাকনলেজ করতেন বারবার। মায়ের সব কাজের প্রশংসা করতেন। মা ছোটো বাচ্চাদের মতো খুব খুশি হয়ে উঠতেন আর সমস্ত কষ্ট ভুলে বাবার কাছে গল্প করতে বসে যেতেন সারাদিনে কী কী হল। বাবা বলেন, মেয়েরা বড্ডো ছেলেমানুষ হয়। ওদের মনে কষ্ট দিলে সেটা বহুগুণে ফেরত আসে। আমার মা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতেন। এটা করতেন স্রেফ শখে। আমাদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা, বাসার সব কাজ সামলে রাখা, সামাজিকতা ঠিক রাখা, এইসবও মা’কেই করতে হত। আমার মনে হয়, যদি আপনি আপনার স্ত্রীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেন, তবে এর ফল আপনি না পেলেও আপনার ছেলেমেয়ে পাবে। আমি এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। ফ্যামিলিতে যিনি পয়সা আয় করেন না, তিনিও কিন্তু আপনার মতোই টায়ার্ড ফিল করেন। পয়সা আয় করা বা না-করার সাথে ক্লান্তিবোধ করা না-করার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি দেখেছি, বাসার সব কাজ করার জন্য বেতন দেয়া হলে আমার মায়ের বেতন আমার বেতনের অন্তত ডাবল হত। জীবনের ছোটো ছোটো সুখগুলোকে যদি ভালোবাসা দিয়ে উপভোগ করা যায়, তবে জীবনের সব হিসেব তো মিলেই, সাথে বোনাসও মেলে। খাবার খেতে ভালো লাগে স্বাদে নয়, ভালোবাসায়। তাই বুঝি সবার মায়ের হাতের রান্না পৃথিবীর সবচে’ সুস্বাদু রান্না। যারা অনেকদিনের জন্য ঘরের বাইরে আছেন, তারা তো জানেন মায়ের হাতের মসুরের ডাল আর বেগুন ভাজি খাওয়ার লোভে পৃথিবীর সব ঐশ্বর্যকেও কতো সহজেই গুডবাই বলে দিতে ইচ্ছে হয়!

এইসব কিছু কেন মাথায় এল? প্রেসিডেন্ট আবদুল কালামের ছোটোবেলার একটা গল্প পড়লাম। আমার নিজের মতো করে লিখছি।

একদিন ডিনারে আবদুল কালামের মা তাঁর বাবার সামনে একটা পোড়া রুটি আর এক বাটি সবজি দিলেন। ছোট্টো কালাম অপেক্ষা করছিল, বাবা কিছু বলে কিনা দেখার জন্য। যেন কিছুই হয়নি, এরকমভাবে বাবা তৃপ্তিভরে রুটিসবজি খেয়ে নিলেন আর ছোট্টো কালামকে জিজ্ঞেস করছিলেন, তাদের স্কুলে কী কী হয়েছে, বন্ধুরা আর টিচাররা কে কী বলেছে। কালামের মা রুটিটা পুড়ে যাওয়াতে আফসোস করছিলেন আর দুঃখপ্রকাশ করছিলেন। তখন কালামের বাবা বললেন, আহ প্রিয়তমা! আমার পোড়া রুটি খেতে খুব মজা লাগে। আজকের রুটিটা চমৎকার হয়েছে! মা হাসিমুখে ঘুমাতে গেলেন। পরে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ছোট্টো কালাম বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, তোমার পোড়া রুটি খেতে সত্যিই ভালো লাগে? বাবা বললেন, তোমার মা আজ সারাদিন কাজ করে খুব ক্লান্ত। রুটি যে সেঁকে দিয়েছে, এটা শরীরের জোরে নয় বাবা, ভালোবাসার জোরে। পোড়া রুটি কাউকে কষ্ট দেয় না, কিন্তু দুর্ব্যবহার দেয়। শোন ব্যাটা! এই জীবনে যাদের নিয়ে থাকবি, যাকিছু নিয়ে চলবি, এর কিছুই পারফেক্ট না। তবুও এসব নিয়েও খুব সুন্দরভাবে বাঁচা যায়। ব্যাটা! জীবনটা ছোটো তো! আমরা বাঁচবোই বা ক’দিন, বল তো? আফসোস নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় কোথায়?

আমি এই গল্পটা পড়ে মনে মনে আরো একবার বললাম, বাবা, তোমাকে ধন্যবাদ!

ভাবনা: ছয়শো উনপঞ্চাশ

………………………………………………………

এক।

খাবার জিনিসের মধ্যে দিয়েই লোকে হয় সবারচাইতে আপন; অচ্ছেদ্য পারিবারিক জীবনের সম্বন্ধগুলি যেখানেই খুব মিষ্টিদেখেছি, সেখানেই লক্ষ্য ক’রেছি, স্ত্রী স্বামীকে বেশ নিত্যনূতন খাইয়ে রাখেন।

~ সতীনাথ ভাদুড়ী

ভাদুড়ীমশাই, আপনাদের জেনারেশানকে আমি বরাবরাই এই জাতীয় কিছু ব্যাপারে ঈর্ষাকরি। অধুনা আধুনিকারা রান্নাঘরের ছায়া মাড়ান হাউসমেডদের পা দিয়ে। অথবা শাশুড়িদের।রান্নার বই কিংবা টিভি-শো দেখে দেখে সিদ্দিকা কবীর সাজেন অতি যত্নে। সেই যত্নমাথার রাজ্যে আনাগোনা করে যতটা, মনের রাজ্যে ততটা নয়। রান্নাঘর থেকে বইয়ে যাওয়া যতটা সহজ, এর উল্টোটা ততটাইকঠিন! তবে সেই রান্না খাওয়ার সময় টিভি-শো’র অনিন্দ্যসুন্দরীর কথা ভেবেই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যায়। মাথাখারাপ করে দেয়া মেয়েরা সব রান্না শেখায়। তাই ওদের ঢংটাই আমায় টানেবেশি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সেই সুন্দরীর রান্না তার বেচারা বরটির ভাগ্যেও জোটে না অতটা।অন্তত সেইদিক বিবেচনায়, অধুনা শিক্ষিতা বধূ জিন্দাবাদ!

বন্ধুদের দেখেছি, বৌয়ের রান্নার তারিফে কী শুকনো মুখে থ্যাঙ্কস্ বলে। দোষটা বৌয়ের যতটা, তারচে’ বেশি বোধ হয় শাশুড়ির। উনি কেনো ধরেই নেন, বিয়ের পরেও মায়ের হাতের রান্নাই মেয়ে আর মেয়ে-জামাই খেয়ে যাবে আয়েশ করে? পড়াশোনার যোগ্যতায় যতই ওপরের দিকে হোক না কেন, বাঙালির স্বভাবই হলো অন্তত আরো-একটিব্যাপারে ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে মনের দরোজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা। অন্তত আমারতা-ই। বেহালা-বাদক আইনস্টাইন, ফুটবলার নিলস্ বোর, ছবি-আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথ বরং আমার কাছেবড়ো বেশি আদরের। হোক গান। সাহিত্য। রান্না। কিংবা অন্যকিছু। তবে যোগ্যতা না থাকলেওই ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র কদর কম। কারণ ওতে সেটা তো আর ‘অতিরিক্ত’ থাকে না!

ন্যায্য পাওনার চেয়ে উপরি, ফাও, বাড়তি—এগুলোর প্রতিউদাসীন এ জগতে কে? এই ফাঁকে ব’লে রাখা ভালো, সব ঔদাসীন্যই কিন্তু সত্যিকারের নয়। পাওনাদারের কাছ থেকে পয়সাফেরত চাইতে যে ভুলে যায়, সে-ই আসলে ভুলোমনের অথেনটিক সার্টিফিকেটটা পায়। কত কী স্বপ্ন-টপ্ন নিয়েছেলেরা বিয়ে করে, শেষ-মেশ বসে বসে কিনা Bridges of Sighs বানায়!

দুই।

এক ছেলে জেল-টেল দিয়ে চুল স্পাইক করে ক্লাসে এসেছে।চুলগুলো মাথার মাঝখানে উঁচু হয়ে শিংয়ের মতো দেখাচ্ছে। কুল কুল লুক দিয়ে ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে স্যারের দিকে তাকাচ্ছে।

https://static.xx.fbcdn.net/images/emoji.php/v9/t32/1.5/18/1f609.png

স্যার তাকে দেখে বললেন, Hey dude! Horn থাকলেই কিন্তু Horny হওয়া যায় না। 😉

বেচারা তো পুরাই ফিউজ! মেয়েদের সে কীহাসি!

আরেকদিনের ঘটনা বলি। একটু ভাব-টাব নিয়ে এক ছেলে শার্টের ৩টা বোতাম খুলে পা-টা ছড়িয়ে নবাবি স্টাইলে ক্লাসে বসে আছে। পারলে একটা সিগ্রেট ফুঁকে, এই অবস্থা।

(একই) স্যার বললেন, এই যে মিস্টার, শার্টের বোতাম লাগান। You’ve nothing to show me.

বেচারার মুখখানা সেইসময়ে দেখার মতো হয়েছিলো। হিহি . . . . . ..

আইবিএ’তে ক্লাস করাটাও খুব মজার একটা অভিজ্ঞতা। অনেক অনেক কিছু শেখার আছে এখান থেকে। স্যারদের কাছ থেকে, পিয়ার্সদের কাছ থেকে, কোর্স কারিকুলাম থেকে, এক্সট্রাকারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস থেকে, ক্লাসরুমের ভেতর থেকে, বাইরে থেকে। স্মার্টনেস, খুব দ্রুত ডেডলাইনে কাজ করা, প্রেজেন্টেশন দেয়া, ফাঁকিবাজি, বদমাইশি, কাজের লোড নেয়া (কিংবা না নিয়েও নেয়া। টিমওয়ার্কে প্রায়ই ২’য়ে ১’য়ে যোগ ক’রেও ৪ হয়। )

দুনিয়ার তাবত্‍ স্মার্ট পোলাপান আইবিএ’তে পড়ে। স্মার্টার স্যাররা ক্লাস নেন। (অথবা আইবিএ-ই পোলাপানগুলারে স্মার্ট বানাইয়া ছাড়ে।) কোনোদিক দিয়েই আইবিএ’র প্রোডাক্টদের আনডারএস্টিমেট করা যায় না। (তবে পাবলিক আমাগোরে ওভাররেটই করে বেশি। করলে অবশ্য খুব একটা মাইন্ডও করি না। হিহি . . . . . . .)

সত্যি কথা বলতে কী, আইবিএ’র প্রেমিজেসে, হোস্টেলে নিজেকে পুরাই খ্যাত্ খ্যাত্ মনে হতো। কোনো পাত্তাই পেতাম না। খুব মিস করি আইবিএ’র দিনগুলি।

তিন।

In a relationship

Engaged

Married

ফেসবুকে এই তিনটাতে বারবার চোখ আটকে যায়৷

ইদানীং কেউ আর একা থাকছে না৷ পছন্দের কাউকে নিয়ে একা একা থাকছে৷ বড়ই সুখের বিষয়৷

কেউ কেউ অবশ্য মহানন্দে মুড়ি খাচ্ছে৷ মুড়ি খাওয়ার নিয়ম হলো, দূরে গিয়ে চোখমুখ বন্ধ করে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হয়৷ ফেসবুকে অবশ্য এই টাইপের কোনো নিয়ম নেই৷ এখানে মুখ বন্ধ রেখেও দাঁত কেলিয়ে হাসা যায়, অত্যন্ত বেজার মুখেও লাইক দেয়া যায়৷

সেদিন আমাদের এক বন্ধুর জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিলাম৷ পাত্রী দেখার পর আমরা যখন বললাম, “দোস্তো, মেয়েটাকে আমাদের সবার খুব পছন্দ হইসে৷ এক্কেবারে সেইরকম! তুই রাজি হয়ে যা৷” তখনই সে সিদ্ধান্ত নিলো, সে মেয়েটাকে বিয়ে করবে না৷

আমাদের বন্ধুটি রাজি হয়নি আমাদের বলার ধরণ দেখে৷ ফেসবুকে এই সুযোগ নেই৷ এখানে সবাই সুন্দর, সবই সুন্দর; তাই এখানে শুধু লাইক দিতে হয়৷ সুন্দর হতে চাও তো ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলো৷

বিয়ে এবং মৃত্যু৷ দুটোতেই কোনো সমবয়সী কিংবা ছোটবড়ো ভেদাভেদ নেই৷ আমার এক বন্ধুর কথা জানি, যে রাগে-দুঃখে ক্ষোভে বন্ধুদের বিয়েতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো৷ সে অতিসম্প্রতি বিয়ে করেছে৷ সে এখন বোঝে, পৃথিবীতে কেউই চিরদিন ব্যাচেলর থাকে না৷ তারও অধিকার আছে একটা ফুটফুটে বাচ্চা কোলে নিয়ে কোনো কোনো বন্ধুর বিয়েতে যাওয়ার৷ পৃথিবীতে বিয়ে-করাই একমাত্র কাজ নয়৷

একা থাকার কথা বলছিলাম৷ বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। এবং বউ থাকলেই কিন্তু সবাই দেউলিয়া হয় না৷ তাই দুটোই ভালো৷ তবে দুটো একসাথে থাকা কতটা ভালো, সেটা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে৷ The only problem with books is that there is no conversation (and the other things).

বই না কিনেও লোকে দেউলিয়া হয়৷ ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত আছে৷ আবার যারা আমার মতো কিছুটা বিব্লিওম্যানিয়াক গোছের মানুষ, তারা বই না-কেনার দুঃখেও দেউলিয়া হয়৷

যার বউ নেই, তার বই আছে৷ যার বই নেই, তার ঈশ্বর আছেন৷ যার কেউ নেই, তার ফেসবুক আছে৷

সপ্তাহশেষটা জীবনের শেষ সপ্তাহও হতে পারে৷ কে বলতে পারে! বইয়ের দোকানে যাই। বই নাড়াচাড়া করে দেখি, কিনি। আমার নেশা ৩টা৷ বই, মুভি, মিউজিক৷ দাঁতেরা দাঁতের সারিতে সুন্দর, বইরা সর্বত্র৷ বাসায়, বই রাখা যায় এমন জায়গায় বই নেই দেখলে কেমন যেনো অস্বস্তি লাগে৷ বিয়ে করেছি অথচ সাথে বউ নেই, হার্ডডিস্কে স্পেস আছে অথচ মুভি নেই; দুটোই একই জাতীয় অনুভূতি৷ আর বলাই বাহুল্য, সুরবর্জিত মানুষ মাত্রেই পরিত্যাজ্য৷ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বাসায় বুকশেলফ্ রাখার জায়গা নেই, অথচ শেলফের অপেক্ষায় গাদায় গাদায় বই পড়ে আছে৷

শেষ কথা৷ সবাই সুখী নয়, কেউ কেউ ব্যাচেলর৷ জগতের সকল ব্যাচেলর সুখী হোক, মঙ্গল লাভ করুক৷

ভাবনা: ছয়শো পঞ্চাশ

………………………………………………………

একটুআগে ওয়ালিদ ভাই ফোন দিলেন জাপান থেকে। উনি ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন। উনার কিছু কথা শেয়ার করছি।

# আমার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পেছনে ৫০% কন্ট্রিবিউশন আপনার আর মাসফি ভাইয়ের। এটা আমার ওপেনলি কনফেস করা উচিত।

# পেপারে দেখলাম, সব কোচিং সেন্টারই আমাকে ওদের স্টুডেন্ট বানায়ে দিসে। আজাইরা সব লোকজন!

# আমার ইনবক্সে গত ৩ দিনে যা হইসে, সত্যিই আমি তা কখনও ভাবতেও পারি না। লোকজন আসলে সহজে কোনকিছু গ্রহণ করতে পারে না। আপনি এই সেক্টরে অন্তত প্রিপারেশন নেয়ার টেকনিকের ক্ষেত্রে পুরাই লিভিং লিজেন্ড। জানি, ওরা আপনাকেও ছাড়ে না, কিন্তু আবার আপনার টেকনিকগুলিকেও ফলো করে। কিছু ভেস্টেড গ্রুপ আছে যারা এই ধরণের কথাবার্তা বলে নিজেরা পপুলার হতে চায়। চিপ!!!

# আমি প্রায়ই ভাবি, আপনি কীভাবে এতকিছুর পরও এভাবে করে মানুষকে ইন্সপায়ার করে যাচ্ছেন! আপনি আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করসেন, ভাই। ……….. ৬৪৪! এই সংখ্যাটাই আমাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসছে। আমি প্রায়ই আপনার রিটেনের মার্কসটা মাথায় রাখতাম আর একেবারেই খুব সাইলেন্টলি আপনার সব পোস্ট খুব মন দিয়ে পড়তাম। নিজেকে শুধু বলতাম, ৬৪৪কে বিট করতে হবে, যে করেই হোক!

# ভাই, আমি কিন্তু ৩৩তম প্রিলিতে ফেলকরা ক্যান্ডিডেট। পরবর্তীতে ৩৪তম বিসিএস প্রিলির আগে ১ সপ্তাহ খুব ভাল করে পড়সি। রিটেনের আগে ২-৩ সপ্তাহ সবকিছু ছেড়ে পড়াশোনা করে আজকে চাকরিটা পাইসি।

# আমি সাধারণত বইটই খুব একটা পড়ি না, ধৈর্য কম। কোনকালেই কারোর লেখা তেমন একটা মন দিয়ে পড়সি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু জীবনে ২ জন ব্যক্তির লেখা কোন ক্লান্তি ছাড়াই পড়সি। গ্রাজুয়েশনে থাকার সময় যার লেখা পড়ে মুগ্ধ হইসিলাম, উনি আনিসুল হক, মাসফি ভাইয়ের খুব অপছন্দের মানুষ। হাহাহাহা………. পোস্টগ্রাজুয়েশনে যার লেখা সবসময়ই পড়তাম, উনি হলেন আপনি। আপনার লেখার সাবলীলতা আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। সবসময়ই চেষ্টা করতাম, আপনাকে রেপ্লিকেট করতে। যখনই কিছু লিখতাম, ভাবতাম, আপনার মতন হচ্ছে কিনা। আপনার স্টাইলটা ফলো করার চেষ্টা করসি। একটা সত্যি কথা বলি ভাই। কেউ বিশ্বাসও করতে পারবে না। ৩৪তম বিসিএস রিটেনের সময় বাংলাদেশ অ্যাফেয়ার্স আর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স পরীক্ষার আগের রাতে আমি বসে বসে যা পড়সি, তা হল আপনার আর মাসফি ভাইয়ের লেখা। একেবারে খুব মন দিয়ে পড়সি আর ভাবসি, কালকে পরীক্ষায় এভাবে করেই লিখব। আমি এসব কথা কোনদিনও আপনাকে বলি নাই। বললে ভাবতেন, তেল মারতেসি। আজকে তো আর বলতে কোন বাধা নাই। তাই আপনাকে থ্যাংকস দিয়ে নিজেকে হাল্কা করতেসি ভাই। দেশে থাকলে আপনার সাথে দেখা করতাম অ্যান্ড ইউ উড সি টিয়ার্স ইন মাই আইজ।

# এই যে আপনি ইয়াং জেনারেশনকে হেল্প করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এটা সবাই মনে রাখবে। আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ক্যারিয়ার আড্ডায় যে কথা বলেন, এর জন্য আপনি কী পান? কিছুই না। পেপারে যে পোলাপানের জন্য এত এত লিখেন, অনেক কষ্ট হয় ভাই। আমার নিজেকেও ডিবেট করার সূত্রে লেখালেখি করতে হইসে, কথা বলতে হইসে, তাই আমি বুঝি। এই যেমন সেদিন প্রথম আলো’তে যে লিখসেন, ৩৫ পয়েন্টে ৩৫তম, এরকম ছোট্ট একটা লেখা কত মানুষকে যে চাকরি পাওয়ায়ে দিবে, আপনি তা ভাবতেও পারবেন না। আমি আজকে কনফেস করতেসি ভাই, আপনি ছিলেন আমার আইডল। আমার চেষ্টাই ছিল আপনি যা করসেন, আমাকেও সেটা করতে হবে। যত কষ্টই হোক। অংক, বিজ্ঞান এসব জিনিস পারা যায়। কিন্তু যেগুলিতে অনেককিছু লিখতে হয় সেগুলিতে আমি সিমপ্লি যা করসি, তা হল, আপনার লেখার স্টাইলটা ফলো করে লেখার ট্রাই করসি। কথাগুলি কাউকে কখনও বলি নাই। আজকে আপনাকে বলতে পেরে খুব ভাল লাগতেসে।

ওপরের কথাগুলি বলার এক পর্যায়ে ওয়ালিদ ভাই বললেন, “ভাই, পরশুদিন আমার টনসিলের অপারেশন। দোয়া কইরেন।” আমি বললাম, “ভাই, আপনি টনসিলের ব্যথা নিয়ে এত কথা বলতেসেন কেন?” “ভাই, আপনি ব্যস্ত থাকেন, তাই ফোন দিই না। আজকে সুযোগ পাইসি। আমাকে বলতে দেন।”

আমি এমনিতেই ইমোশনাল মানুষ, উনার এ কথা শোনার পর চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলাম না। এই মানুষটাকে গত ৩দিন ধরে যেসব নোংরা কথা সহ্য করতে হয়েছে, ভাবতেও কষ্ট হয়! অনেকে আমাকেও জিজ্ঞেস করেছেন, দাদা, আসল ব্যাপারটা কী? কে ফার্স্ট হইসে? পরিষ্কার হওয়া দরকার। ……… আহা! মানুষের যে কত আজাইরা টাইম! ভাবলেও হিংসা লাগে!!

কিছু কথা বলে ফেলি। রাগ করবেন না। করলে করেন! কিছুই করার নাই।

এক। ওয়ালিদ ভাই যে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম হয়েছেন, এটা মেনে নিতে অনেকেরই কষ্ট লাগতে পারে। এটা পুরোপুরি জানতে একটু অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। কিন্তু এই মানুষটা তো ফরেনের মতন একটা শীর্ষস্থানীয় ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন, তাই না? যারা আজেবাজে কথা বলছেন, তাঁদের ফুল ফ্যামিলি মিলে বিসিএস পরীক্ষা দিলেও কি ফরেনে প্রথম হয়ে দেখাতে পারবেন? জ্বি ভাই, ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলাম। পারলে রাস্তার বাজে লোকজনের মত গলাবাজি না করে হয়ে দেখান। Your actions talk much louder than your words!

দুই। যারা সেকেন্ড ইয়ার থার্ড ইয়ারে পড়ছ, সামনে কখনও বিসিএস পরীক্ষা দেবে, অথচ আজেবাজে মন্তব্য করেছ, তাদেরকে বলি। অনার্সের পর প্রিলিতে পাস করে দেখাতে পারবে? বিসিএস পরীক্ষা কী, কোন ন্যূনতম ধারণাও আছে তোমাদের? ফরেনে ফার্স্ট হওয়া কী জিনিস, বোঝো? একটুখানি বুঝলেও তোমাদের কথা বলতে বুক কেঁপে উঠত। আর যারা সিভিল সার্ভিসে আসবেই না বলে ঠিক করে রেখেছ, তারা এটা নিয়ে এত চ্যাঁচামেচি করছ কেন? সমস্যা কী তোমাদের?

তিন। কে ফার্স্ট হল, আর কে সেকেন্ড হল, এটা নিয়ে ঝগড়া করলে কি আপনি চাকরিটা পাবেন? ঝগড়া এত টাইম পান কই? ওই সময়ে পড়াশোনা করতে পারেন না? অন্য মানুষের ঘরে সুন্দরী বউ দেখলে এত গা জ্বলে কেন? এই পরস্ত্রীকাতরতা ছেড়ে লাইনে আসুন।

চার। অনেকে প্রাইভেট ভার্সিটি পাবলিক ভার্সিটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। আজব! প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে পাস করে বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার বিধান তো আমাদের সরকার রেখেছেন। এটা নিয়ে কথা বলার আপনি কে? প্রাইভেট ভার্সিটিতে কি সব গাধারা পড়ে নাকি? ওসব মান্ধাতা আমলের চিন্তাভাবনা নিয়ে সিভিল সার্ভিসে আসার স্বপ্ন দেখেন? প্লিজ, এখানে আসবেন না। এরকম সংকীর্ণ চিন্তার মানুষ সিভিল সার্ভিসে না এলেই দেশের জন্য মঙ্গল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যান্ডিডেটরা এবারের মেধাতালিকার প্রথম দিকে একটু কম আসতে পেরেছেন। এটা নিয়েও কিছু কুৎসিত মন্তব্য আমাদেরকে পড়তে হয়েছে। অন্যান্য বিসিএসে যে বিভিন্ন প্রথমসারির ক্যাডারে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছে এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, সেকথা হয়তো আপনার জানা নেই। জানা না থাকলে, জেনে নিন। এরকম আজেবাজে মন্তব্য করে নিজেকে রামছাগল প্রমাণিত করবেন না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে আপনি যদি সবসময়ই কারোর মেধা বিচার করেন, তবে আপনার মূল্যায়ন প্রায়ই ভুল হবে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একথা বলছি।

পাঁচ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই সেরা, একথা বারবার বলার কী আছে? এটা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করবে, এমন গর্দভ আছে বলে তো মনে হয় না। ওয়ালিদ ভাই মাস্টার্স করেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমি নিজেও মাস্টার্স করেছি এখান থেকে। অন্যান্য ভার্সিটিও তো ছিল, তাই না? আমরা যে দুটো বিষয়ে মাস্টার্স করেছি, দেশের সেরা ভার্সিটির ওই দুটো বিভাগে ভর্তির সুযোগ না পেলে হয়তোবা অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখতাম। শুধু সিভিল সার্ভিসেই নয়, কর্পোরেট সেক্টরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই জয়জয়কার। মানছি, এটা নিয়ে বেশি লাফালাফি করার মানে অবশ্যই আছে, কারণ ৩৪তম বিসিএসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট সত্যিই অনেকবেশি গৌরবের। আমার ভার্সিটি, আমি এটা নিয়ে গর্ব করি, ওয়ালিদ ভাইও তা-ই করেন। তাই বলে অন্যকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ছোট করলে, আজেবাজে মন্তব্য করলে কিন্তু ওখানকার স্টুডেন্টদেরও কষ্ট লাগে; ততটাই, যতটা ঢাকা ভার্সিটি নিয়ে কেউ বাজে কিছু বললে আমার নিজের লাগত। আমার মা ভাল, এর মানে এটা হওয়া উচিত না যে বাকি সবার মা খারাপ।

শচীন টেন্ডুলকার বড়, নাকি ব্রায়ান লারা বড়, এ বিতর্ক এখনও এতদিন পরেও কাউকে কাউকে করতে দেখি। অথচ দেখুন, এ নিয়ে ওই দুজন গ্রেট ক্রিকেটারের কারোর কোন মাথাব্যথা ছিল না। ওদের সময় কোথায় অতো? ওরা তো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতেই ব্যস্ত। সমালোচকদের একমাত্র পুরস্কার — আত্মতৃপ্তি। ওদের যেহেতু বড় হওয়ার কোন যোগ্যতাই নেই, সেহেতু ওরা সবসময়ই লুজারদের কিংবা বড়োজোর মিডিওকারদের দলে। দেখুন, আমরা এত চিল্লাচিল্লি করছি, অথচ মৌসুমী আপু কিংবা ওয়ালিদ ভাই তেমন কোন উচ্চবাচ্য করছেন না। কেন করছেন না? উত্তরটা দিচ্ছি আমার একটা পুরোনো ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে………..

যারা বেশি বোঝেন, আমি তাদের কম বুঝি। বোঝার চেষ্টাও করি না। সময় নাই। He who can, does; he who cannot, teaches. একটা টিভি অ্যাডের কথা মনে পড়ে গেলো। চকোলেটের অ্যাড। একটা চকোলেট নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মন্তব্য করছে। কেউ বলছে চকোলেটটা ভালো, কেউ বলছে খারাপ, কেউ কেউ কনফিউসড্। একজন কিছুই বলছে না। মুখ বন্ধ। সবাই জিজ্ঞেস করলো, কী ভাই, কিছু বলছেন না কেনো? উনি কোনোরকমে মুখ খুলে উত্তর দিলেন, ভাই, বলবো কীভাবে? আমি তো খাচ্ছি! . . . . . . . এটা আমার দেখা সেরা অ্যাডগুলোর একটা। When you are in the shit, keep your mouth shut. বুদ্ধিমানরা তর্ক করেন, প্রতিভাবানরা এগিয়ে যান। একথা সবসময়েই সত্যি। বিল গেটসকে দেখুন, জুকারবার্গকে দেখুন। আরো কতো! পৃথিবীর যাবতীয় অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয় কাজের জন্যে, সমালোচনার জন্যে নয়। একদল নীরবে কাজ করে, আরেকদল সরবে সমালোচনা করে। নোবেল পান সাহিত্যিকরা, সমালোচকরা নন। সমালোচকদের জন্যে সান্ত্বনা পুরস্কার শুধুই নিভৃত আত্মতৃপ্তি। গড ব্লেস দেম।

কী বুঝলেন? মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে? মেনে নিন মেনে নিন, কারণ এটাই বাস্তবতা। সফল হওয়ার পূর্বশর্ত : সাফল্য সহ্য করা শিখতে হবে। যে জিনিস আপনি সহ্যই করতে পারেন না, সে জিনিস ঈশ্বর আপনাকে দেবেন কেন? বদহজম হয়ে যাবে তো! জীবনে বড় হতে হলে হ্যাবিচুয়াল ‘সেলফিশ’ উইকনেস টু গ্রেটনেস থাকাটা জরুরি। যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল তাদের গুণগুলোকে রেপ্লিকেট করার চেষ্টা করুন। যে লক্ষ্যেই পৌঁছাতে চান না কেনো, সেই লক্ষ্যের প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাবোধ রাখুন। আপনি সাফল্য পাননি? তো কী হয়েছে? আবারও চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে যাঁরা সফল হতে পেরেছেন, তাঁদের কাছ থেকে নীরবে বিনীতভাবে শিখুন, কীভাবে ও পথে হাঁটতে হয়। আমার ব্যর্থতার দায়ভার তো আর আমি অন্যের সাফল্যের ঘাড়ে চাপাতে পারি না, তাই না?

ভাবনা: ছয়শো একান্ন

………………………………………………………

এক। যারা এইচএসসি’তে ভালো করেছো, তাদেরকে অভিনন্দন জানাই।

সফলদের কাছের মানুষদের কাছে কিছু ছোট্টো ছোট্টো অনুরোধ করছি। খেয়াল রাখবেন, সামনের দিনগুলোতে ওদের যা কিছু অর্জন আসবে, তা যেনো এই অর্জনকে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না করে। অল্প বয়সে সাফল্যের ধকল কিন্তু অনেকেই সামলাতে পারে না। অল্পবয়সী অনেক সফলই বিশ্বাস করে বসে থাকে, জীবনটা বুঝি এখানেই শেষ! বয়স অল্প, বুদ্ধিশুদ্ধিও অল্প। আমার প্রিয় লেখক সুনীল কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আত্মতৃপ্তি মৃত্যুর সমান।” কথাটি আমার খুব খুব প্রিয়। জিপিএ ৫ পাওয়াটা খুব সামান্য কিছু না হলেও অনেক বড় কিছু নয়। যদি ওকে কখনও শুনতে হয়, “আজকাল চেয়ারটেবিলও তো জিপিএ ৫ পায়। ভাল কোন জায়গায় তো চান্সই পেলে না! আসলে মাথায় কিছু নাই। সিস্টেমে এ+ পেয়ে গেছো।” তখন কিন্তু আপনার কষ্ট হবে সবচাইতে বেশি। আমি এইচএসসি’তে স্টার মার্কস পেয়েছিলাম। চিটাগাং কলেজ থেকে সায়েন্সে আমরা স্টার মার্কস পেয়েছিলাম খুব বেশি হলে ৬০-৭০ জনের মতো, কিংবা আরও কম। এখন তো গোল্ডেন এ+ পায় এর চাইতে ঢের বেশি। আমি বুয়েটে পরীক্ষা দিতে পারিনি, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথসে কম মার্কস পেয়েছিলাম বলে। পরে চুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়েছিলাম। এখন দেখি, গোল্ডেন এ+ পাওয়া স্টুডেন্টরা ওয়েটিংলিস্টেই আসতে পারে না। সত্যিই কষ্ট লাগে। এর জন্য কিন্তু আপনারা অভিভাবকরাও অনেকাংশে দায়ী। ওকে কড়া শাসন করতে হবে, বোঝাতে হবে। ওর অনেক অন্যায় আবদারকে ‘না’ বলতে হবে। এইচএসসি পাস-করা একটা ছেলে কিংবা মেয়ে জীবন সম্পর্কে কিছুই বোঝে না, কিংবা যতটুকু বোঝে, তার বেশিরভাগই ভুল। ওর সাথে খোলাখুলি কথা বলে দেখুন। ও কী জানে? কতটুকুই বা বোঝে? ওর দুনিয়াটা অনেক রঙিন। আপনি তো জানেন, দুনিয়াটা আসলে এমন নয়। যে ভাল কোথাও চান্স পায় না, তাকে আসলে তেমন কেউ পাত্তা দেয় না। পাত্তা না পেলে বেশিরভাগ মানুষই তো দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকে অবশ্য পরবর্তীতে ঘুরে দাঁড়ায়। সেটা কিন্তু পুরোপুরিই অনিশ্চিত! আপনার দায়িত্ব, ও যাতে ভুল পথে পা না বাড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখা। ও কাদের সাথে মেশে, খবর নিন। আশেপাশে ভাল স্টুডেন্টদের না দেখলে ভাল করার ইচ্ছে জাগে না। যখন অনেক দেরি হয়ে যাবে, তখন ওকে বকাঝকা করে কিংবা মনখারাপ করে তো আর কোন লাভ নেই। ওকে ছেড়ে দেবেন না, চোখেচোখে রাখুন। ও এখনও বড় হয়নি। ও পৃথিবীর চোখে এখনও কিছুই না! কিছু হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত সবসময়ই ওর পাশে থাকুন।

যারা অতটা সফল হতে পারোনি, যতটা তোমরা আশা করেছিলে, তাদের বলছি, কম বয়সে কম-সফলদের তালিকায় ঢুকে যাওয়ার একটা মস্তো বড়ো আপাত সুবিধা আছে। তা হলো, তোমাদের সফলরা সহজ টার্গেট ভাববে। সফলদের এই ভাবনার স্বাচ্ছন্দ্যই ওদের ক্রমশ দুর্বল করে দেয়। এটাকেই কাজে লাগাও। পৃথিবীতে নোবডি হয়ে থেকো না। যে যা-ই বলুক, এটা নিশ্চিত, নোবডি-দের জন্যে এই পৃথিবীতে শুধু নাথিং-ই বরাদ্দ থাকে। জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, আমরা কখনো তা ভাবতেই পারি না। লাইফ ইজ অলওয়েজ স্ট্র্যাঞ্জার দ্যান ফিকশন। গ্রেড দিয়ে কখনওই নিজেকে যাচাই কোরো না। আমি নিজে ভার্সিটিতে আমার ব্যাচের সবচাইতে কম গ্রেড পাওয়া স্টুডেন্টদের একজন। তোমার রেজাল্ট ভাল হয়নি তো কী হয়েছে? এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও। দুনিয়াকে দেখিয়ে দাও, তুমি কোনোভাবেই ফেলনা না। তোমার শক্তিকে ঠিকভাবে কাজে লাগাও। আমাদের একটা সমস্যা হল, নিজেকে দুর্বল ভেবে জীবনের কাছ থেকে ছোট ছোট জিনিস চাই, এবং পেয়েও যাই। হায়! ওতেই খুশি থেকে জীবনটা কাটিয়ে দিই! শুয়েবসে ঘোরাঘুরি করে হেসেখেলে জীবন কাটালে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। এটা কখনওই কোরো না। তোমার এখন অসম্ভব রকমের পরিশ্রম করার সময়। তুমি এখন সবেমাত্র বড় হতে শুরু করেছ। পৃথিবী তোমাকে এখন আর ভুলের জন্য ক্ষমা করে দেবে না। তোমার ভুলটাকে যদি তুমি তোমার জীবনের শিক্ষা হিসেবে না নাও, তবে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, অনেক বড় ধাক্কা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ভুলের মাশুল দিতে সবাই পারে না, বেশিরভাগই হারিয়ে যায়। পৃথিবীতে আমরা কেউই হারিয়ে যাওয়ার জন্য আসিনি। যদি জীবনে কিছু করতে না পারি, তবে সেটার দায়ভার সম্পূর্ণই আমাদের নিজের। অন্তত তোমার চারপাশের সবাই-ই সেটাই ভাবে; হয়তো মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু তোমাকে অযোগ্যই ভাববে। সত্যি বলছি, খুব খুব কষ্ট লাগবে তখন। আমি অনেক ছেলেমেয়েকে হারিয়ে যেতে দেখেছি, শুধু এইচএসসি পাস করার পর সচেতন ছিল না বলে। তুমিও তাদের দলে ঢুকে যাবে যদি এইচএসসি’র রেজাল্টটাকেই সবকিছু ধরে বসে থাক। ভাল কোথাও চান্স পাওয়ার চেষ্টা কর। তোমাকে প্রাইভেটে পড়াতে কিন্তু তোমার বাবা-মা বাধ্য নন। তোমার হেঁয়ালিপনার মূল্য দিতে তোমার বাবা-মা চাকরি করেন না। কখনও উনাদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে দেখেছ, জীবনটা আসলে কত কঠিন? উনারা কি সারাজীবনই তোমার অক্ষমতার মূল্য দিতে তোমাকে জন্ম দিয়েছিলেন? কঠোর পরিশ্রম কর। তোমার বন্ধু তোমার চাইতে ভাল জায়গায় চান্স পেয়ে গেলে যে কী পরিমাণ মেজাজ খারাপ হবে, ভাবতেও পারবে না। নিজেকে তৈরি কর, ওসব বিশ্রামটিশ্রাম পরে হবে। এখনই সময়! আজ থেকে ১০ বছর পর কী হবে, সেটা আমরা কেউই জানি না। নিজেকে কখনওই অতোটা ছোটো ভেবো না, যেটা তোমাকে শুরুই করতে দেয় না। নিজেকে কখনওই অতোটা বড় ভেবো না, যেটা তোমাকে শেষই করতে দেয় না।

গুড লাক!!

দুই। সেদিন এক কলিগের বাসায় গিয়ে এটাসেটা নিয়ে গল্প করছি। আপুর একটা কিউট বাবু আছে; বয়স ৫-৬ হবে, ক্লাস ওয়ানে পড়ে। খুব আদুরে দেখতে; চোখদুটো ভাসাভাসা, হাতদুটোকে ঠোঁটেমুখে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে আদর করতে কী যে ভীষণ ভাল লাগে! কোলে নিয়ে বসে থাকলে শুধু দুনিয়ার গল্পো বলতে থাকে। অমুক টিচার কী করেছে, ওর ফ্রেন্ডরা কে কী বলে, ওর খেলনা কয়টা, কে কোনটা কিনে দিয়েছে, কে কে যেন কোনটা কোনটা ভেঙে ফেলেছে ….. আরও কত কী! নরোম নরোম গালদুটো টেনে টেনে শুধু চুমু খেতে ইচ্ছে করে। লম্বা লম্বা চুলগুলো রেশমি সুতোর মতন কোমল। ছড়িয়ে ছড়িয়ে হাতের আঙুলে নিয়ে খেলতে খুউব আরাম লাগে। আমি বরাবরই খুব সহজে বাচ্চাদের খুব কাছে চলে যেতে পারি।

“যাও এখান থেকে! আঙ্কেলকে ডিস্টার্ব করবে না!”

“থাক না আপু! ও তো বিরক্ত করছে না।”

“আরে না, আপনি জানেন না, খুব দুষ্টু। পড়াশোনা নাই, সারাদিন শুধু দুষ্টুমি।”

“পড়বে পড়বে। ছোটো তো এখনও।”

“হুঁ, আমি তো ছোটো!” (পিচ্চিটা আমার কোলে আরও গুটিসুটি মেরে বসে বলল।)

“চুপ! পড়াশোনা নাই, খালি বাঁদরামি, তুমি ছোটো, না?”

“আম্মু, আঙ্কেলকে চকলেট দিই? চকলেটগুলা কই?”

“চকলেট খাওয়ার বুদ্ধি, না? কিচ্ছু দিতে হবে না। যাও এখান থেকে!”

ও আমার কোল থেকে নেমে ওর আম্মুর হাত ধরে টানতে টানতে বায়না শুরু করলো, “আম্মু দাও না, আম্মু দাও না। আঙ্কেল চকলেট খাবে তো!”

“যাও এখান থেকে! হোমওয়ার্কগুলো করে ফেল।”

“না, আমি যাব না। চকলেট দাও, আমি সত্যি সত্যি খাব না, শুধু আঙ্কেলকে দিব।”

“মাইর খাবা, যাও!”

“না, আমাকে চকলেট দাও, দিতে হবে!” বলে আবারও ওর আম্মুর কামিজের কোনা ধরে টানতে লাগল।

আমার কলিগ হঠাৎ রেগে উঠে খুব জোরে উনার ওইটুকুন ছেলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। “যাও এখান থেকে!!!”

ওর ছোট্ট ফর্সা নাদুসনুদুস গালে আক্ষরিকভাবেই পাঁচ আঙুলের লাল দাগ বসে গেল। গোলগাল হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। আমি কোলে নিতে চাইলে আপু বাধা দিয়ে বললেন, “প্লিজ আস্কারা দেবেন না ভাইয়া, ছোটবেলা থেকে শাসন না করলে একেবারে মাথায় উঠবে।”

“কী বলেন আপু! ও কী বোঝে? এখনও ছোট তো!”

“আরে ভাই, বিয়ে তো করেন নাই এখনও, আপনি বুঝবেন না। এরা সব বোঝে।”

“আপু, প্লিজ এভাবে করে মারবেন না। আমার বলা ঠিক কিনা জানি না, তবুও বলছি। কিছু মনে করবেন না।”

“না ভাই, শাসন করা দরকার। পড়াশোনা কিচ্ছু করে না। গত টার্মে ১০য়ের বাইরে চলে গেছে।”

“আস্তে আস্তে হবে আপু। ছোটো তো এখনও।”

“হাহাহা……..ভাল ভাল। আচ্ছা চলেন, বের হই। জাহিদ ভাইয়ের বাসা কাছেই, হেঁটে যেতে ৫ মিনিট লাগে।”

আমরা বের হবো হবো করছি, ঠিক ওইসময়ে আপুর বাবুটাকে দেখলাম, কোত্থেকে জানি দৌড়ে এসে ওর আম্মুর স্যান্ডেলজোড়া মুছে এনে ওর আম্মুর পায়ের সামনে রেখে মাথা নিচু করে একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

ওরকম ঘটনার পর এমন একটা দৃশ্য সহ্য করাও কঠিন। চোখের পানি আড়াল করে কলিগকে বললাম, “আপু, ওকে নেবেন না?”

“আরে নাহ! ও হাউসমেইডের সাথে থাকবে। …………. এই পারুল! ওকে নিয়ে যা! তোর ভাইয়া আসলে নাস্তা বানিয়ে দিস।”

এবার আর অবাধ্য না হয়ে থাকতে পারলাম না। ওকে টেনে কোলে নিয়ে বললাম, “আপু, চলেন যাই।”

নিচে গিয়ে দোকান থেকে ওর মায়ের রক্তচক্ষু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ওকে দুটো ক্যাডবেরি কিনে দিলাম। প্রচণ্ড ভয়ে ভয়ে চকলেটদুটো ওর হাফপ্যান্টের পকেটে রেখে দিতে দিতে ওর আম্মুর দিকে ফ্যাকাসেমুখে তাকিয়ে রইলো। “আম্মু কিচ্ছু বলবে না সোনা। তুমি বাসায় গিয়ে আম্মুসহ এগুলো খেয়ো।” এরপর থেকে শুরু করে আমরা দাওয়াত শেষ করে ওকে ওর আম্মুর কোলে ফিরিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত ওর চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখেছি। হয়তোবা বাসায় ওর জন্য খুব ভয়ের কিছু অপেক্ষা করছে।

খুব কড়া মায়েদের কিছু প্রশ্ন করছি :

আপনি ছোটবেলায় বায়না ধরতেন না?

কখনও কখনও দুএকবার আবদার রাখলে আপনার বাবুটা বখে যাবে?

ছোটবেলায় কারোর সামনে বকা দিলে কিংবা চড়থাপ্পড় দিলে আপনার কেমন লাগতো? ছোটদের আত্মসম্মানবোধ কিন্তু খুব প্রখর হয়।

ছোটবেলায় আপনি কি স্কুলে সবসময়ই ফার্স্টসেকেন্ড হতেন? শিওর?? পৃথিবীর সেরা মানুষগুলো কেউই কিন্তু স্কুলে ফার্স্টসেকেন্ড হতেন না। ওদের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করে দেখুন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওদের শেখার জগতটা ছিল অন্যকোথাও।

পিটিয়ে পিটিয়ে ছেলে মানুষ করার বুদ্ধি আপনাকে কে দিয়েছে? ছোট্ট ছোট্ট আবদার রাখার সময়ে তো কিছু কন্ডিশন জুড়ে দিতে পারেন। এই যেমন, তোমাকে সব হোমওয়ার্ক করে ফেলতে হবে, নিজের ব্যাগটা কালকের মতো গুছিয়ে ফেলতে হবে, দুধ পুরোটা খেয়ে ফেলতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ও যখন ভালোবাসা দেখায়, তখনও ওর প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে থাকতে হবে?

কী ছেলে কী বুড়ো, আদর পেতে চায় না কে? সবাই তো একটু আদরের জন্যই বাঁচে। আপনার ছোট্ট বাবুটা আদর না পেলে বড় হবে কী করে?

ছেলে মানুষ করার কিছু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণধর্মী বই পাওয়া যায়, নেটেও অনেককিছু পাবেন। একটু দেখুন না পড়ে! শুধু বেতে হয়তো ও বেড়ে উঠবে ঠিকই, কিন্তু বড় হবে না, এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।

অনেক মাসীর দরদ দেখিয়ে ফেললাম। সরি, ক্ষমা করবেন। এবেলা মায়েদের জন্য একটা ভাল বইয়ের নাম বলে যাই। বাচ্চারা রাজ্যের হাজারো প্রশ্ন করে না? অনেকের সাথে কথা বলে বলে এমন অদ্ভুতসব প্রশ্ন জড়ো করে সেসবের উত্তর খুঁজেছেন অদ্রীশ বর্ধন উনার ৩ খণ্ডের বই ‘আমার মা সব জানে’তে। এই অসাধারণ কাজটার জন্য উনাকে স্যালুট করি। অনেক কষ্ট করেছেন এই দারুণ বইটা লিখতে। কলকাতার আনন্দ’য়ের বই, খুব চমৎকার ঝকঝকে ছাপা, পেইজ ভাল, বাঁধাইও বেশ ভাল। আমি এই বইটা বাচ্চাদের জন্মদিনে উপহার দিতে পছন্দ করি। সন্তানের জন্মদিনের উপহার মাদেরকেও দেয়া যাবে না কেন?