ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৯৫তি অংশ)

ভাবনা: ছয়শো উনষাট

………………………………………………………

পুরুষমাত্রেরই পৌরুষ থাকে। এর প্রকাশ করতে না পারলে পুরুষ অস্বস্তিতে ভোগে। পুরুষমানুষ পৌরুষ দেখায় তার আর্থসামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থা আর অবস্থান ব্যবহার করে। পৌরুষ দেখানো আর ভাব নেয়া, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার; যেমনটা গর্ব আর দম্ভ। কিছু কিছু পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অপকর্ষের কারণে পরিবারে ও সমাজে পৌরুষের অসুস্থ প্রদর্শন চলতে থাকে। কয়েকটি ক্ষেত্র দিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবা যাক।

এক। আমরা আশেপাশে তাকালে একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করি। আমরা দেখি, একই পদমর্যাদার দুইজন মানুষের সামাজিক ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইমেরুর। একজনের ভাবের ঠ্যালায় মাটিতে পা-ই পড়ে না, আরেকজনের অতো ভাবটাব নেই। কেন এরকম হয়? দেখা যাক, একজন মানুষ কখন ভাব নেয়? তখনই যখন সে তার পক্ষে সর্বোচ্চ যতদূর যাওয়ার সম্ভব, ততদূর পথ পাড়ি দিয়ে ফেলে। সে যা করেছে, এর চাইতে বেশিকিছু করে দেখানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার দৌড় কিংবা যোগ্যতা অতোটুকুই। প্রথমজনের ক্ষেত্রে এরকমটাই হয়েছে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, যেটুকু পথ হাঁটা হল, কারোর পক্ষে আরও অনেকদূর পাড়ি দেয়া সম্ভব, তাহলে সে ওইটুকু পথকে তার সমস্ত পথের কিছু অংশমাত্র ধরে নেবে, তার যাত্রা এখনও শেষ হয়নি, থেমে যাওয়ার সময় আসেনি, এবং পরের পথ পাড়ি দেয়ার ব্যস্ততা তাকে ভাব নেয়ার অবসরটুকু আর দেয় না। সাধারণত যার ভাব যত বেশি তার যোগ্যতা তত কম। সে ভাব দেখিয়ে তার অযোগ্যতাকে কৌশলে লুকিয়ে রাখে। কথায় বলে, “ছোটলোক বড় হলে বন্ধুকে কাঁদায়।” খুব সত্য কথা।

দুই। আমরা কিছু লোককে দেখি, যারা পরিবারের লোকদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। নিজের সমস্ত অসুস্থ পৌরুষ দেখায় ঘরের বউয়ের সাথে। কারা করে ওরকম? যে রিকশাওয়ালাটি ঘরের বাইরে চড়থাপ্পড় খায় আর ঘরে গিয়ে বউ পেটায়, তার সাথে ঘরের বউয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে যে বাবুসাহেব, তার পার্থক্য শুধু কয়েকটি সার্টিফিকেটের। দুইজনেরই মনোবৃত্তিক বৈশিষ্ট্য কমবেশি একই ধরণের। নড়বড়ে সামাজিক অবস্থানের পুরুষদের পৌরুষ হয় অসুস্থ ও আদিম। বড় সার্টিফিকেট কখনওই ছোটলোককে বড় করতে পারে না।

তিন। একজন সহকারী সচিব পরিচিতজনের সালামের উত্তরে হাসিমুখে বলেন ওয়ালাইকুমআসসালাম; সাথে ওই লোকের এবং উনার পরিবারের সদস্যদের খবরাখবরও জিজ্ঞেস করেন। যখন সেই একই অফিসার, সালাম দিলেন যিনি, শুধু তাঁর খবর নেন, তখন বুঝতে হবে, তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব হয়েছেন। উপসচিব হওয়ার পর শুধু ওয়ালাইকুমআসসালাম বলবেন। যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি হলে সেটা ছোট হয়ে যাবে ওয়ালাইকুমে। যখন সালামের উত্তর হবে হাসিমুখে নিঃশব্দে মাথা নোয়ানো, তখন বুঝে নিতে হবে অতিরিক্তসচিব মহোদয় দয়া করে যা দিয়েছেন, সেটাই মহাপ্রসাদ! সেই একই অফিসারকে সালাম দেয়ার পর যদি তিনি এমনভাবে তাকান যে, উনি যে তাকিয়েছেন, এ-ই ঢের, তবে উনি নিশ্চয়ই অধঃপতনের (পড়ুন, পদসোপানের) শেষ পর্যায়ে, মানে সচিব! একদিন সেই মানুষটিই পরিচিতজন এবং অপরিচিতজনদের নিজ থেকেই ডেকে ডেকে সালাম দেন, পরিবারের সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, উনি তখন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা! বড়ই করুণা হয় এদেরকে দেখলে! তবে সুখের বিষয়, এরকম অফিসারদের সংখ্যা এখন আমলাতন্ত্রে আগের যেকোনো সময়ের চাইতে অনেক কম। আমার প্রায়ই মনে হয়, আইন করে একটা সিস্টেম দাঁড় করিয়ে আমলাদের বই কেনা ও পড়াটা বাধ্যতামূলক করে দেয়া উচিত। আমলারা যত বেশি বই পড়বেন, তত বেশি মানবিক হবেন।

চার। অফিসের বসরা ভাল হবে না, এটাই স্বাভাবিক। একজন ভাল বস, একটা ভাল পোস্টিংয়ের চাইতে অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ। বসদের প্রবৃত্তিই হল এরকম, অধস্তনদের অবস্থানকে অবমূল্যায়ন করবেন এবং সারাক্ষণ চাটুকার পরিবৃত হয়ে থাকতে পছন্দ করবেন। অনেক বসই প্রায় এটা ভুলে থাকেন, কর্মকর্তা আর কর্মচারীকে দিয়ে একইভাবে কাজ করানো সম্ভব নয়। আমাদের দেশের কালচার হল, অফিসের কাজ নয়, বসকে খুশি রাখাই আপনার প্রধান কাজ। যদি কখনও এমন হয়, আপনার ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আপনার বসের চাইতে উন্নত, তবে উনি একধরণের অসুস্থ নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করবেন এবং আপনাকে উনার ব্যক্তিসত্তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে চাইবেন। যেসব লোকের পরিচয় ও সামাজিক অবস্থান শুধু চাকরির জোরেই, তারা বস হিসেবে এবং বন্ধু হিসেবে সাধারণত ভাল হন না। তারা সারাক্ষণ এই চিন্তায় মগ্ন থাকেন, কীভাবে তার অধস্তনদের ক্ষতি করতে পারবেন। ছোটলোক ছোট অপরাধে বড় শাস্তি দিয়ে আত্মসুখ অনুভব করে। চাকরির মায়া বড় মায়া। সে মায়ায় অধস্তনরা বসকে মেকি সম্মান দেখায় আর আড়ালে পৃথিবীর সকল শ্রাব্য-অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে। যে বস মনে করেন, অবস্থানগত কারণে উনিই সবার চাইতে জ্ঞানী, তার অধীনে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। তাদের সকল দম্ভ আর লাফালাফি চাকরির সীমিত গণ্ডির মধ্যেই। চাকরি শেষ তো সব শেষ। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অবসরগ্রহণের পর এ ধরণের ক্ষতিকর স্বৈরাচারী বসকে পুরোনো জুনিয়র কলিগরা দূরে থাক, রাস্তার নেড়িকুত্তাগুলিও গোনে না।

পাঁচ। বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলেন, চায়ের কাপটা নিয়ে আসতে দেরি হয়ে গেল বলে বয়ফ্রেন্ড ওয়েটারকে ইচ্ছেমত গালাগালি করল। সুযোগ বুঝে দুটো চড়ও বসিয়ে দিল। কেন দিল? মেয়েমানুষ সামনে থাকলে অথর্বদের বাহুবল বাড়ে। যার সিংহ শিকার করার শক্তি নেই, সে একবার বন্দুক হাতে পেয়ে গেলে গাধা শিকার করে মৃত গাধার শরীরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে রাখে নির্লজ্জের মতো বাসার ড্রয়িংরুমে টাঙিয়ে রাখার জন্য। যে পুরুষের মেরুদণ্ড নেই, সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য মেরুদণ্ডের জায়গায় একটা বাঁশ বসিয়ে দেয়। ওতে কাজ চলে হয়তো, তবে ওই অসহায়ত্ব দেখতে বড় কুৎসিত লাগে! কিছু বেকুব শ্রেণীর মেয়ে আছে, যারা ঘিলুর অভাবে ছেলেদের পেশীকে ঘিলু ভেবে ভুল করে। যে ছেলে যত বেশি অন্তঃসারশূন্য, সে ছেলে তত বেশি বাহুবলের উপর নির্ভরশীল।

ছয়। ছোটলোকের ছোটকাজে নজর দেয়ার সময় সবসময়ই বেশি থাকে। বড়কাজ করতে হলে বড় যোগ্যতা লাগে। যার সেটি নেই, সে পৌরুষ দেখাতে অনেকটা বাধ্য হয়েই ছোটকাজে বড় ভাব নেয়। বড়লোক করে জানায়, ছোটলোক বলে জানায়। যার মাথার জোর যত কম, তার ঔদ্ধত্যের জোর তত বেশি। চায়ে চিনি কম হল বলে বাসার কাজের বুয়াকে আধা ঘণ্টা ধরে শাসায়। বেচারা করবেটা আর কী! কাজের বুয়াকে শাসাতে তো আর বাড়তি কোন যোগ্যতা লাগে না। বসের একটা অন্যায় সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে বসকে আধা মিনিট শাসাক না একটু দেখি! শাড়িপরা জীবকে শাসিয়ে যে পুরুষ নিজেকে ‘ব্যাটা’ মনে করে, তার একমাত্র শিশ্নছাড়া পুরুষ হওয়ার আর কোন যোগ্যতাই নেই।

সাত। আরেক শ্রেণীর ফেসবুক সেলিব্রিটিদের দেখবেন, ফেসবুকের বাইরে যাদের কুকুরও ‘ফলো’ করে না। ভার্চুয়াল জগতে ওদের ভাব বরাবরই বেশি থাকে। বিশাল সংখ্যক ফলোয়ার যোগাড় করা ছাড়া জীবনে আর তেমন কোনো অর্জনই তাদের ঝুলিতে নেই। যাকে মানুষ মাথায় তুলে নাচে, সে ভাবে, আকাশটা একটু নিচে সরে এসেছে, সে হাতটা বাড়ালেই আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারবে। সে বিশ্বাস করে, আকাশটা আমার! মানুষের নাচ বন্ধ হয়ে গেলে, তখন সে থাকে মাটিতে। তখন সে আর আকাশ ছোঁওয়ার কথা ভাবতেও সাহস করে না। মাটি থেকে আকাশ ছুঁতে কিছু বাড়তি অবস্থান ও যোগ্যতা লাগে। অনলাইন পৌরুষ, অফলাইন খোজাত্ব!

আট। পয়সার একটা উত্তাপ আছে। এটা যার পয়সা, তার আশেপাশের সবকিছুকেই পুড়িয়ে দিতে চায়। যার পয়সা যত বেশি, ‘আমি সবকিছুকেই কিনে ফেলতে পারি’ এই মূর্খতা তার তত বেশি। পয়সার ভাব ধরে যে লোক, তার কাছে কোনোভাবেই বিক্রি না হলে আপনি খুব সহজেই তার অস্তিত্বকে পাত্তা না দিয়ে মহাসুখে বেঁচে থাকতে পারেন। ধনীর চাটুকারিতার পেছনে থাকে প্রয়োজন নয়, লোভ। এ জগতে সে ব্যক্তিই সবচাইতে ঐশ্বর্যশালী, যে ধনী আর ক্ষমতাবানদের বিন্দুমাত্রও কেয়ার না করে চলতে পারে। যার পৌরুষ স্রেফ অর্থের মধ্যেই, সে সাধারণত খুবই দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। এ ধরণের বিত্তশালীকে একবার নিজের দৃঢ়তা বুঝিয়ে দিন; এরপর দেখবেন, উনিই আপনাকে সমীহ করে চলছেন। কারোর কাছে আর্থিক দায়বদ্ধতা আর ক্রীতদাসত্ব, দুইই সমান।

নয়। যে শিক্ষক যত কম জানেন, সে শিক্ষক পরীক্ষার প্রশ্ন তত কঠিন করে পৌরুষ দেখান। একজন ছাত্র কম জানেই বলেই কিন্তু সে ছাত্র। নাহলে তো সে শিক্ষকই হত। প্রশ্ন কঠিন করা মানে নিজের নাজুকতা লুকানোর চেষ্টা করে, সেটিকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরা। অনেক শিক্ষককে দেখেছি, ক্লাসে এসে নিজের সিজিপিএ’র গল্প করতে থাকেন। তাদেরকে দেখে মনে হয়, তাদের জন্মই হয়েছে সিজিপিএ পাওয়ার জন্য। এর চাইতে বেশি কিছু করে পৌরুষ দেখানোর শক্তি উনাদের ছিল না। তাদের অনেকেই পরীক্ষার খাতায় মার্কস কম দেন। উদ্দেশ্য, যাতে ছাত্ররা বেশি পড়াশোনা করে। এ পদ্ধতিটা ছাত্রদের বেশি পড়াশোনা করতে উৎসাহিত করার সবচাইতে বাজে পদ্ধতি। খাতায় মার্কস কম না দিয়ে যদি ওদেরকে বুঝিয়ে দেয়া যেত পড়াশোনাটা কেন করবে, তাহলে সেটা বোধ হয় বেশি কাজে আসত। বেশি বেশি ফেল করিয়ে বেশি বেশি পড়াশোনা করানো গেছে, এমন ঘটনা পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

দশ। আরেকজনকে ছোট করে নিজে বড় হওয়ার পৌরুষ দেখান কিছু কিছু পুরুষ। সেভাবে বড় হওয়াটা সহজ, কারণ ওতে শুধু গীবত করতে জানলেই চলে। পৃথিবীতে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা জন্মগতভাবেই পরশ্রীকাতরতায় অসীম প্রতিভাসম্পন্ন। পরশ্রীকাতরতা নিজের মানসিক শক্তি কমিয়ে দেয়। আমি মনে করি, যদি ছুরি বসাতেই হয়, যে প্রকৃত পুরুষ, সে ছুরিটা বসায় বুকে, পিঠে নয়। আপনার চারপাশে কিছু মানুষ আছেন, হয়তো যাদের সম্পর্কে ভাববার সময় পর্যন্ত আপনার নেই, এমনকি তাদের অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নিয়ে আপনার বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই, অথচ আপনার সম্পর্কে আজেবাজে কথা ছড়িয়ে আপনাকে হেয় করার অফুরন্ত সময় ওরা কীভাবে কীভাবে যেন ঠিকই বের করে নেয়। আহা! কত সময় ওদের হাতে! সত্যিই ঈর্ষা হয়! প্রত্যেক অফিসেই কিছু কিছু বস আছেন, যারা বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ই মাথাটা ফেলে রেখে শুধু কানটা নিয়ে অফিসে চলে আসেন। অফিসে আসার পর থেকেই শুধু কানের উপর ভর করে অফিস চালাতে থাকেন। যার মাথাই নেই, সে বেচারা কানকথা বিশ্বাস করবে নাতো কী করবে? কানকথায় সিদ্ধান্ত নেয়ার পৌরুষ কানের পৌরুষ, মাথার নয়। প্রচলিত ধারণা, মেয়েরা ঈর্ষাপরায়ণ হয়। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় অনেকবেশি ঈর্ষাপরায়ণ হয়। আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে কিছু ঈর্ষান্বিত অসুস্থ পুরুষের পৌরুষের বীভৎস প্রদর্শনে নাভিশ্বাস ওঠে প্রতিনিয়তই। আমার কাছে ঈর্ষাপরায়ণ পুরুষদের চিরকালই হিজড়া মনে হয়েছে। যার কিছু করে দেখানোর ন্যূনতম যোগ্যতাও আছে, তাকে আর যা-ই হোক ঈর্ষায় জীবনযাপন করতে হয় না।

পৌরুষ যার মধ্যে আছে, তার মধ্যে হিপোক্রিসি নেই। সে দুর্বলকে আঘাত করে নয়, সবলের আঘাত সহ্য করে নিজের শক্তি বাড়িয়ে নিতে শেখে। যে ক্ষমাটা করে দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না, সে ক্ষমাটা পৌরুষ না থাকলে করা যায় না। কোন পুরুষের পৌরুষ বোঝা যায় তার নিচের অবস্থানের কারোর সাথে তার ব্যবহার দেখে। নষ্ট হওয়ার সুযোগ পেলে কতটা নষ্ট না হয়ে থাকা যায়, সেটা দেখে পৌরুষ চেনা যায়। পৌরুষ তারই, যার শক্তি বাহুতে নয়, মাথায়। আমরা এমন একটা সমাজ চাই, যে সমাজ অদৃশ্য চুড়ি-ফিতাপরা পুরুষমানুষ থেকে মুক্ত! আমরা এমন পৌরুষ চাই, যে পৌরুষের আগুন জ্বলে গনগনে সিগ্রেটের ধোঁয়াশায় নয়, ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতেও নয়, বরং চোখের কোনায় লুকিয়েথাকা নিজেকে গড়ে নেয়ার প্রবল জেদে!

ভাবনা: ছয়শো ষাট

………………………………………………………

সেদিন একটা পোস্টের কমেন্টে লিখেছিলাম, মেয়েরা সাধারণত ৩ ধরনের হয় : দুষ্ট, দুষ্টু, দুষ্টা।

অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন, এ আবার কী?………… আচ্ছা, বলছি …………..

দুষ্ট মেয়েরা দুষ্ট টাইপের হয়। ওরা কী কী করে?

দুষ্টমি করে, শেক্সপিয়ারের ছলনাময়ীদের মতই ছলনায় বাঁচে।

প্যাঁচ লাগায়, প্যাঁচ না লাগালে পেটের ভাত হজম হয় না।

সংসারে ভাঙন ধরায়, এর কথা ওকে গিয়ে লাগায়, ওর কথা একে গিয়ে লাগায়।

দুষ্টবুদ্ধি দেয় এবং নেয়, ওদের ব্রেইনের ডিজাইনটা এমনভাবে তৈরি, বুদ্ধির পুরোটাই শয়তানিতে ঠাসা।

হাজব্যান্ডকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে দেয়, কারোর সুখ সহ্য করতে পারে না।

বয়ফ্রেন্ডকে কারোর সাথে, এমনকি ছেলেদের সাথেও মিশতে দেয় না।

সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়, এমনকি ফেসবুকে People You May Know’তে যদি কোন মেয়ের নাম আসে, নির্ঘাত জিজ্ঞেস করে বসে, এই মেয়েকে তুমি কীভাবে চিন? ফেসবুক তোমাকে ওর সাজেশন পাঠায় কেন?

হুদাই গাল ফুলিয়ে থাকে এমনভাবে যে, ঘুষি মেরে সত্যি সত্যি গাল ফুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

সংসারটাকে জিবাংলা স্টারপ্লাসের সংসার বানিয়ে ফেলে।

শাশুড়ির শাড়ির টাকা বাঁচিয়ে নিজে দামি শাড়ি কিনে।

দুষ্টু মেয়েরা ‘যাহ্ দুষ্টু!’ টাইপের হয়।

ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ করে ও করায়, ওদেরকে নিয়ে ধুম করে রাস্তার পাশের কাশখেতে বসে যেতে ইচ্ছে করে।

একটু ঢং করে ও আধটু ঢং করায়, ওদেরকে খেপিয়ে দিতে না পারলে মনে হয়, জীবনটাই বৃথা!

রাগ নয়, অভিমান করে। ওদের অভিমানে উল্টেথাকা ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেয়ে বলতে ইচ্ছে করে, এই পচাটাকে বড় ভালোবাসি!

গাল ফুলিয়ে থাকে এমনভাবে যে, ধরে টেনে দিতে ইচ্ছে করে। মাথায় নাকে গালে আঙুলের উল্টোপিঠ দিয়ে টোকা মারতে ইচ্ছে করে।

মাঝরাতে হুট করে ঘুম থেকে উঠে বলে, আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে হবে। চল!

কোন কাজ করার সময় ওকে সময় না দিলে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকে, ‘একটু যাও, আমি আসছি’ বললেও যায় না।

মুখে যা বলে, চোখের চাহনিতে তার দ্বিগুণ বলে। চোখের যাদু এমনই যে, ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে!

খুব কিউট কিউট প্রাণীর নাম দিয়ে প্রিয় মানুষটাকে ডাকে।

ওকে ওর প্রিয় মানুষটি সোনা, বাবু, মণি, যাদু, পচা কিংবা অন্য যেকোনো নামেই ডাকুক না কেন, সেই নামে না ডাকলে বুঝতে পারে, নিশ্চয়ই ও কোন একটা ভুলটুল করেছে। বড় মিষ্টি করে কেঁদে ফেলে!

ওর প্রিয় মানুষটার কাছে সবসময়ই অবুঝ কিশোরী হয়েই থাকে। (অবশ্য, মেয়েরা সারাজীবনই অবুঝ কিশোরী হয়েই থাকে। না থাকলে, এটা ওর দোষ নয়, ওর প্রিয়তমের দোষ।)

দুষ্টা মেয়েরা আবদুল্লাহ উপন্যাসের ‘মাইয়ামানুষ জাহান্নামের লাকড়ি’ টাইপের হয়।

কম ভালোবাসে, বেশি বেশি প্রেম করে। প্রেম কম পেলে প্রয়োজনে প্রেমিক বদলে ফেলে।

সকালে একজনের সাথে ‘আমার জানু’ ক্যাপশনে দিয়ে ছবি আপলোড করে রাতের বেলায় অন্যজনের সাথে রঙ্গ করে।

কুটনামিতে বিশেষ নাম করে।

নষ্টামিতে কখনও কখনও ছেলেদেরকেও ছাড়িয়ে যায়।

হ্যামলেটের মা গারট্রুডের কার্বনকপি হয়। পরপুরুষ মাত্রই আপন ভাবে। সবাইকেই ধারণ করতে পারে, এরকম বড় হৃদয়ের অধিকারিণী হয়।

জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে না পারলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে, ক্ষতি করার চেষ্টা করে। (এটা কী আসলেই ভালোবাসা? যে ভালোবাসে, সে ক্ষতি করে কীভাবে?)

বান্ধবী একটু ভাল থাকলে রাগে জ্বলতে থাকে। নিজে স্মার্টফোন কিনতে পারল না, রুমমেট কিনল; তখন রাতের বেলায় রুমমেট ঘুমিয়ে পড়লে ওর ফোনটা নিয়ে এক গ্লাস পানিতে রেখে দেয়।

পরীক্ষার খাতায় ‘আমার প্রিয় সখ প্রেম প্রেম খেলা’ লিখতে পারে না বলে মনে মনে মনখারাপ করে। পুরুষমানুষের মতই ভালোবাসাহীন শারীরিক প্রেমে বিশ্বাস করে।

টিস্যু পেপারের মতো করে বয়ফ্রেন্ড বদলায়, এমনকি বিয়ের পরেও। পুরুষমানুষ মাত্রই যেমনি বহুগামী প্রবৃত্তির, তেমনি দুষ্টা মেয়েরাও।

এর বাইরেও অনেক ধরনের মেয়ে আছে, যেমন…………

বৃক্ষমেয়ে : এরা গাছ গাছ টাইপের। কাছে এলে ভাল লাগে, না এলে আরও ভাল লাগে। এদের ছুঁয়ে দেখলেও ‘কিছু’ হয় না।

পণ্ডিতমেয়ে : এদের দেখলে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না, শুধুই সম্মান আর পা ছুঁয়ে সালাম করতে ইচ্ছে করে।

ঐরাবতমেয়ে : এদেরকে দেখলে ‘আন্টি, স্লামালিকুম’ বলতে ইচ্ছে করে।

পরীমেয়ে : এদেরকে দেখলে জ্বিন হয়ে আকাশে উড়ে যেত ইচ্ছে করে।

ঢংগীমেয়ে : এদেরকে দেখলে তুলে আছাড় মারতে ইচ্ছে করে।

খ্যাতমেয়ে : ওদের সাথে গল্প করার চাইতে স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে তেলাপোকা মারাও অনেক ভাল, এটা মনে হয়।

প্যানপ্যানানিমেয়ে : ওদের সাথে যতক্ষণ থাকবেন, ততক্ষণই মনে একটা প্রশ্নই এসে বারেবারে আঘাত করবে : জীবন এত বড় ক্যানে??

বেহায়ামেয়ে : ওদেরকে দেখলে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করবে।

নাকউঁচামেয়ে : ওদের সাথে কথা বললে ঘুষি মেরে নাক থ্যাবড়া করে দিতে ইচ্ছে করবে।

আটাময়দাসুজিমেয়ে : ওদেরকে দেখলেই গান গাইতে ইচ্ছে করবে : ওগো বৃষ্টি, ওর মুখের উপর পড় না!

বিলাইমেয়ে : ওদের মধ্যে সারাক্ষণ গাঘেঁষাভাব প্রবল। ওদের সাথে প্রেম করার সময় মনে হবে, এরকম বেড়াল পালার চাইতে মুরগি পালাও ভাল।

মিসডকলমেয়ে : ওদের মিসডকলের জ্বালায় প্রায়ই এয়ারপ্লেনে চড়তে বাধ্য হবেন।

পকপকানিমেয়ে : ওরা ফোন করলে মোবাইলটা কয়েক মিনিট কান থেকে দূরে রেখে আবারও কানে ধরলে দেখবেন, একই কথাটাই ঘুরিয়েফিরিয়ে বলছে।

(ধুররর………আর কত ফাজলামো করা যায়! লিমিটেরও তো একটা ফাজলামো আছে! এমনিতে আছি বিখ্যাত সাতক্ষীরা টু ঢাকা অতি জঘন্য রাস্তার উপরে; বাসে। এমন খানাখন্দ অজপাড়াগাঁয়ের রাস্তায়ও থাকে না! এ রাস্তায় বাস তো চলে না, যেন দুলে। রাস্তায়ই রিয়েল নৌকাভ্রমণের অ্যাডভেঞ্চার! সামনের সিঙ্গেল সিটটা পুরো হেলে আছে আমার পায়ের উপর। ল্যাপটপের স্ক্রিনটা অনেক বাঁকিয়ে কিবোর্ডের উপরে আলো ফেলে ফেলে ঘাড় সামনের দিকে হেলে অনেক কষ্ট করে টাইপ করতে করতে এতক্ষণ ধরে উপরের ফাজলামি, পাগলামি, ছাগলামি করলাম। এভাবে লেখা বড়ই বিরক্তিকর এবং কষ্টকর! ঘাড় পিঠ ব্যথা করে, চোখের উপর ভাল রকমেরই চাপ পড়ে। ……………. তবে, একটা কথা ঠিক, দুষ্টু মেয়ে ঘরে না এলে জীবনটা হয়ে যাবে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সেই গল্পের জীবনের মতই পানসে। গল্পটা বলি : মোল্লা নাসিরুদ্দিন বিয়ের পর বাসররাতে প্রথমবারের মতো ঘোমটা সরিয়ে নতুন বৌয়ের মুখটা দেখলেন। দেখে প্রচণ্ড হতাশ হলেন। বৌ যখন মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, আমি এ বাড়ির কার কার সামনে পর্দা করব?” তখন উত্তরে তিনি বললেন, “আর কারোর সামনে করার দরকার নাই, শুধু আমার সামনে করলেই হবে!” ………….. তাই, দুষ্টুতে আপত্তি নাই!)

ভাবনা: ছয়শো একষট্টি

………………………………………………………

আমি ঢাকায় এলে সাধারণত মাহবুবের বাসায় থাকি। ও আমার খুব খুব প্রিয় একজন মানুষ, সবচাইতে কাছের ছোটভাইদের একজন। আমি জীবনে যে ক’জন অসাধারণ ভালমানুষ দেখেছি, ও তাদের অন্যতম। আন্টিও আমাকে বড়ছেলের মতই দেখেন, এমনকি সময়ে সময়ে শাসনও করেন। আমি সাধারণত কারোর কাছ থেকে উপহার নিই না। কিন্তু গত ঈদে আন্টি যখন আমাকে একটা নতুন পাঞ্জাবি দিয়ে বললেন, “আমার বড়ছেলে নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া ঈদ করবে, তা কী করে হয়?” আমি আর কিছুই বলতে পারিনি। আজকেও ওর বাসায় উঠলাম। সকালে ওর সাথে ব্রেকফাস্ট করার সময় কিছু কথা শেয়ার করলাম, যে কথাগুলি লিখতে ইচ্ছে করছে। (ভুল হল একটু, ওরা বাসাটা এখন আর ‘ওর বাসা’ বলার মতো অবস্থায় এ পরিবারের সাথে আমার সম্পর্কটা নেই। কখনও কখনও আন্তরিকতায় অধিকার জন্ম নেয়। বাসাটা এখন ‘আমার বাসা’। ভালোবাসায় বাসা গড়ে ওঠে, কত সহজেই!)

তখন অন্যকোনো চ্যানেল ছিল না; ছোটবেলায় রাত ৯টায় বিটিভি’তে নাটক চলত। ওইসময়ে পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে স্বাভাবিকভাবেই মা নাটক দেখতে দিত না। আমাকে আমার পড়ার রুমে দরোজাজানালা বন্ধ করে রেখে পাশের রুমে লো ভলিয়্যুমে টিভি দেখত। মা’র ওভাবে করে নাটক দেখতে খুব কষ্ট হত, শোনাই তো যেত না! আমার রুমে অতো সাউন্ড আসত না, তবে আমি যেটা করতাম, সেটা হল, জানালার ফোকর দিয়ে দেখতাম, তৌকির কী বলে, কীভাবে বলে, বিপাশা কেন হাসে, কতটুকু ঠোঁট বাঁকায়। (মেয়েরা এমনিই হাসে, এটা বোঝার বয়স ১২-১৩ নয়।) এভাবে করে ১ ঘণ্টা কাটানোর জন্য ওয়েট করতাম। মা কখনও খেয়াল করলে খুউব বকে দিতেন। তখন আবারও একটুখানি পড়তাম। ওই বয়সটা ছিল, পড়াশোনা না করলে তো আব্বু-আম্মুর লস, আমার তো কোনো লস নাই, এটা বিশ্বাস করার বয়স। সেই ১ ঘণ্টা না হত পড়াশোনা, না হত নাটকদেখা। ১ ঘণ্টা পার হলেই আমার ছুটি। যেহেতু আমাকে টিভি দেখতে দেয়া হয়নি, সেহেতু ১০টার পর পড়লেও আমার ইচ্ছা, না পড়লেও আমার ইচ্ছা। সেসময় টিভি না দেখার স্যাক্রিফাইস অনেক বড় স্যাক্রিফাইস। মাঝে মাঝে যেটা হত, বাবা পেছন থেকে এসে জানালার ফাঁকে নাক সেঁটেদেয়া আমার কাঁধে হাত রাখত, আর বলত, “টিভি দেখবি? যা, দেখ গিয়ে!” আমি তো মহাখুশি! আমাকে টিভিরুমে দেখলে মা খুব রেগে উঠতেন, আর তখন বাবা বলতেন, ও একটু নাটক দেখুক না! খাওয়ার পর ও ২ ঘণ্টা এক্সট্রা পড়ে নেবে। “কীরে? পড়বি তো?” আমি তো ওতেও রাজি! সেসময় মনে হত, আমাকে যে নাটকটা দেখতে দেয়া হচ্ছে না, ওটাই সবচাইতে সুন্দর নাটক। নাটক দেখার কিছু নিয়ম ছিল। যেমন, ধারাবাহিক নাটক দেখা যাবে, কিন্তু প্যাকেজ কিংবা সাপ্তাহিক নাটক দেখা যাবে না। কারণ, ধারাবাহিক নাটক দেখতে না দিলে নাটকের কোনো পর্বই দেখে কোনো লাভ নেই। অবশ্য কারেন্ট চলে গেলে তখন আর কিছুই করার থাকত না। সেটাকে আমরা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতাম। আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য কারেন্ট চলে যাওয়ার রাত ছিল বারান্দায় বসে বসে রাত দেখার ও বোঝার রাত। শিক্ষক ছিল আমার বাবা। (এটা নিয়ে অন্য একটা লেখায় লিখেছি, তাই এখানে আর লিখছি না।)

নাটক দেখতে দিলে তো বাড়তি কিছু সময় পড়াই যায়। সেসময় আমাদের বাসায় ডাইনিং টেবিল ছিল না; নাটক দেখা শেষ আমরা সবাই নিচে মাদুর পেতে একসাথে খেতে বসতাম। তখন বাবা বলত, “মম, ওকে মাঝে মাঝে টিভি দেখতে দিয়ো। নাহলে তো ও পড়েই না। ১ ঘণ্টা না হয় পড়া, না হয় টিভিদেখা।” (আমার মায়ের নাম মমতা, ডাক নাম মম।) আমি তো শুনে খুশিতে নাচতে থাকতাম। বাবার কোল ঘেঁষে বসতাম আরও। তখন বাবা আমাকে বলত, “বাবা, একসাথে এমন দুইটা কাজ করবি না, যে দুইটা কাজই তোর ভালভাবে করা দরকার। দো দিল বান্দা, কলেমাচোর, না পায় বেহেস্ত, না পায় গোর।” “বাবা, এটার মানে কী?” “এটার মানে হল, তুই প্রার্থনা করার সময় অন্যকাজ মাথায় রাখলে প্রার্থনা ঠিকমতো হবে না। পড়াশোনাটা প্রার্থনা করার মতো। এটা করার সময় অন্যকাজ করার কথা মাথায় আসলে সেটা করে ফেলবি। এরপর কিছুটা বাড়তি সময় ধরে পড়াশোনা করে নিবি। প্রার্থনাও এরকম। ঠিক সময়ে না করলে বাড়তি কিছু পরিশ্রম করে নিতে হবে। নাহলে সেটা পূর্ণ হবে না।” সেসময় অতো বুঝতাম না। শুধু ‘দো দিল বান্দা, কলেমাচোর, না পায় বেহেস্ত, না পায় গোর।’ এ কথাটা মোটিভেশন হিসেবে কাজ করতো। বাবা ওটা প্রায়প্রায়ই বলতো।

আজ বুঝি, আমরা যতক্ষণ কোন একটা মিশনে থাকি, ততক্ষণই আমাদের ইবাদতের সময়। ইবাদতের সময় অন্যকোনো ভাবনা মাথায় আসলে কোনভাবেই ইবাদতের পরিপূর্ণ ফল পাওয়া সম্ভব নয়। যারা কোন একটা উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কাজ করার সময়ে বাকি অন্য সব কাজকেও প্রাধান্য দেয়, তাদের কোন কাজই ভালভাবে হয় না। ইবাদতের সময় যেমন অসম্ভব কষ্ট স্বীকার করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয়, ঠিক তেমনি একটা মিশনে থাকার সময় আরাম আর সুখ করে সে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। যেকোনো ধরনের পড়াশোনা করাটা ইবাদতের মতই। প্রচণ্ড ধৈর্য, আন্তরিকতা আর ইচ্ছাশক্তি না থাকলে পৃথিবীর কোনো ইবাদতই সফল হত না। যুগে যুগে পয়গম্বর, মহাপুরুষরা এটাই প্রমাণ করে গেছেন। ইবাদতের সময় অনেক কষ্টস্বীকার করে শুধু ইবাদতই করে যেতে হয়। অন্যকোন বিষয়কে ইবাদতের সময় মাথায় আনা যাবে না। এতে ইবাদতের বরকত নিশ্চিতভাবেই কমে যায়, আমি এটা মনে করি। ইবাদতের সময় নিয়তের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। নিয়তের জোর যার কত কম, প্রাপ্তির পরিমাণ তার তত কম। হাদিসে আছে, “ইন্না মাল আ’মালু বিন্নীয়্যাত।” এর মানে, প্রত্যেকটা কাজ মানুষের নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিয়ত ঠিক থাকলে এবং সেই নিয়তের প্রতি একনিষ্ঠ থাকলে যেকোনো কাজেই সফল হওয়া সম্ভব।

Intuition is much more important than logic. কোন একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় যদি দ্বিধায় থাক, কী করা উচিত, তবে সে সময় নিজের ভেতরের ‘আমি’কে জিজ্ঞেস করে দেখ। ও কী বলে দেখ। ওটাই হল ইনটিউশন। যদি লজিক অন্যকিছুও বলে, তবুও তুমি তোমার ভেতরের ‘আমি’র কথা শোনো। কেন? দুটো কারণে।

এক। তুমি প্রায়ই দেখবে, তোমার ইনটিশন যা বলে, তা কোন না কোনভাবে ঠিক। কখনও কখনও পৃথিবীর কিছু সাময়িকভাবে (for the time being) ব্যাখ্যাতীত বিষয়ের উত্তরও আমাদের রহস্যময় মস্তিষ্কের কোন এক গূঢ়তম অংশে লুকিয়ে থাকে, যেটার খোঁজ আমরা হয়তো বা কখনওই পাই না। হঠাৎ হঠাৎ তেমন কোন চেষ্টা ছাড়াই একেকটা উত্তর সিগন্যাল আকারে বেরিয়ে আসে। সেটা দ্রুত গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা যার যত বেশি, সে তত দ্রুত সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারে।

দুই। যদি তুমি তোমার ইনটিউশনের কারণে কোনো ভুল সিদ্ধান্তও নাও, তবুও সেটার ফলে তোমার যে ক্ষতিটা হবে, সেটা মেনে নেয়ার মানসিকতা আর ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তোমার মধ্যে অবচেতনভাবেই তৈরি হয়ে যায়। ধর, ইনটিউশনের পথে না গিয়ে লজিকে চলে যদি তুমি একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে। যদি সে সিদ্ধান্ত তোমাকে ৫ লেভেলে পৌঁছে দেয়, তবে ধরে নিচ্ছি, সেখান থেকে ১০ লেভেলে পৌঁছাতে তোমার সময় লাগবে ১০-১২ বছর। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ধর তুমি তোমার ইনটিউশনের কথা মেনে একটা আপাত ভুল সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললে, আর তুমি নেমে গেলে লেভেল ০’তে। সেসময় তোমার মধ্যে একটা প্রচণ্ড আফসোস কাজ করে যেটার সাথে নিজের ভাললাগার জন্য ভুল করার ভালোবাসা আর অসীম দায় জড়িয়ে থাকে। সে ভালোবাসাটা তোমার মধ্যে যে ড্রাইভটা তৈরি করে, সেটার আবেগজড়ানো শক্তি (impulse) তোমাকে অনেক অনেক দ্রুত সামনের দিকে ঠেলে দেয় আর তুমি এমন শক্তিতে সে একই লেভেল ১০’য়ে পৌঁছে যাও, যেটা অন্য সব সাধারণ মানুষের অতীত অভিজ্ঞতার বিচারে সম্পূর্ণই অভিনব ও অলৌকিক। এ কাজটা করতে তোমার সময় লাগতে পারে বড়োজোর ৩-৪ বছর। মানে, ইনটিউশন পাওয়ারকে ঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে একজন আপাত ব্যর্থ মানুষ একজন সফল মানুষের তুলনায় অনেক কম সময় একই উচ্চতায়, এমনকি এর চাইতেও বেশি উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারে।

“ভাইয়া, আপনি আসামাত্র বললেন, কালকে বাসে ওরা আপনাকে কম্বল দেয়নি, তাই এসি’র ঠাণ্ডায় আপনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি, রাস্তাও নাকি ভীষণ এবড়োথেবড়ো ছিল। নাস্তা করে এসেই ২-৩ ঘণ্টা ঘুমাবেন, ঘুম থেকে উঠে ঘুরতে বের হবেন। অথচ, আপনি এসেই লিখতে বসে গেলেন। এই এনার্জি কই পান, ভাইয়া?”

“ব্যাপারটা এনার্জির না, মাহবুব, ব্যাপারটা প্যাশনের। সবাই সব কাজ পারে না। তুমি যে কাজটাকে ভালোবাস, সে কাজটার প্রতি তোমার অনেক ভাললাগা কিংবা মুগ্ধতা কাজ করে, যেটার কোন মূল্যই হয়তো অনেকের কাছে নেই। কিন্তু তোমার প্যাশনের প্রতি তুমি নিজে আন্তরিক আর বিশ্বস্ত থাকবে। এটা খুব বেশি দরকার। প্যাশনকে ভালোবাসতে হয়, বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে নয়, নাহলে তুমি তোমার প্যাশন থেকে বাড়তি কিছু পাবে না। এটার প্রতি আন্তরিকতা তোমার পরিশ্রম করার ক্লান্তিও দূর করে দেয়। মানুষ কিন্তু ক্লান্ত হয় যতটা না শারীরিক কারণে, তার চাইতে ঢের বেশি মানসিক কারণে।”

ভাবনা: ছয়শো বাষট্টি

………………………………………………………

এক।

সবকিছু এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

কিছু ভালোবাসা এখনও বাকি। ওর ঔদাসীন্যে বিরক্ত হয়ে তুমি নতুন কিছু ভাববে ভাববে করছ। করছ, কিন্তু ভাবছ না।

এসব শুধু তুমিই জানতে। আর কেউ না। নিপুণ অভিনয়ে দ্বিধাও ঢেকে যায়……….

নাহ্! এভাবে হয় না! অনেক সহ্য করেছি। এনাফ ইজ এনাফ!

এসব জেনে কেউ কাছে এসেছিল। আর কিছু নয়, শুধু তোমাকে ভালবেসেই।

তোমার মনের ভেতরের কেমিস্ট্রিটা নতুন ছেলেটা জানে একটু একটু। তবে অতোটা না, যতোটা জানলে ও তোমাকে নিয়ে নিজের মতো করে ভাবতো না।

ও জানে না, উদাসীন ছেলেটা হঠাৎ ফস্ করে ‘ভালোবাসি’ বলে ফেললে তুমি ওকে ফেলে আবারও ওই পুরোনো সম্পর্কেই ফিরে যাবে। ও জানে, তুমি সরে এসেছ; তুমিই জানিয়েছ।

তোমার জন্য এটা নাহয় একটা সংশয়ী ভালোবাসার ওয়েটিং রুম, কিন্তু ও যে এটাকেই পুরো জীবন ধরে বসে আছে, তার কী হবে? জীবনের ব্যাপ্তির হিসেবটাকে বড় গোলমেলে করে বুঝিয়েই ছাড়বে বলেই কাছে এসেছিলে তবে?

ছেড়ে দেবো ভাবছি বলে কিছু নেই। যা আছে, তা হল, ছেড়ে দিয়েছি, কিংবা ছেড়ে দিইনি। এর মাঝামাঝি কিছু নেই।

যে তোমায় অবহেলা করল, ওরটা ভাবছ, আর যে তোমারই প্রশ্রয়ে তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, ওর কথা মুহূর্তেই ভুলে গেলে? যাকে আশ্রয় দিতেই পারবে না, তাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলে কোন সুখের আশায়? সবাইই কি আর মুহূর্তের সুখের আশায় হাত ধরে? আর ফিরবে না ভেবে যাকে ছেড়ে এসেছ বলেছিলে, সেই একই তুমি কীভাবে সহজেই বলে ফেললে, ফিরে যাচ্ছি, পারলে ক্ষমা করে দেবেন!……… হায়! এও হয়!!

মেয়েরা কোন প্রেমটাকে বড় করে দেখে কে জানে! পুরোনোটা? নাকি, নতুনটা? নাকি, দুটোকেই অপশন বানিয়ে বসে থাকে আরও নতুন, আরও অভিনব, আরও এক্সপেরিমেন্টাল কোনো প্রেমের প্রতীক্ষায়? ওদের মন বদলায়, সাথে প্রেমও। ওরা নিজেরাই কি জানে ওরা আসলে কী চায়, কীভাবে চায়, কতটুকু চায়? ……………. এটা নিয়ে একগাদা পোস্টডক্টরাল থিসিসও লিখে ফেলা পারে!

মেয়েরা, তোমরা পার বটে!! ছোটবেলায় খেলনা ভাঙ, বড়বেলায় জীবন ভাঙ! কেন বলতো? জীবনের চাইতে সস্তা আর কোনো খেলনা খুঁজে পাও না নাকি?

দুই।

২৯ অক্টোবর ২০১৫

আমি কিছু জিনিস মেনে চলার চেষ্টা করি। সেগুলির মধ্যে এই লেখাটি লেখার সময় মাথায় এসেছে, এমন কিছু কিছু শেয়ার করছি :

এক। প্রতিদিন ঘুমান গড়ে সর্বোচ্চ ৬ ঘণ্টা। বেশি সময় নয়, ভালভাবে ঘুমানোই বড় কথা। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মোবাইল সাইলেন্ট করে আর ল্যাপটপ দূরে রেখে ঘুমাবেন।

দুই। মোবাইলের ড্রাফ্‌টসে কিংবা একটা নোটবুকে আপনার মাথায় বিভিন্ন মুহূর্তে যে ভাল ভাল কথা কিংবা চিন্তাভাবনা আসে, সেগুলি লিখে রাখবেন। সাধারণত খুব সুন্দর চিন্তাগুলি দুইবার আসে না।

তিন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট নিয়ম করে কোন একটা মোটিভেশনাল বই পড়ুন কিংবা লেকচার শুনুন। এ সময় নিজের ইগোকে দূরে রাখবেন।

চার। কোন সময় মন যদি খুব অশান্ত হয়ে যায়, এবং কিছুতেই সেটাকে শান্ত করা না যায়, তবে ১০ মিনিট হাঁটুন আর হাঁটার সময় নিজের পদক্ষেপ গুনুন। আরেকটা কাজ করতে পারেন। সেটি হল, মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা বের করে দিয়ে মাথাটাকে সম্পূর্ণ ফাঁকা করে দিয়ে চুপ করে ১০ মিনিট আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। বিবেকানন্দের পত্রাবলী কিংবা রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র পড়তে পারেন, রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পারেন। মন শান্ত হয়ে যাবে।

পাঁচ। প্রতিদিন সকালে উঠে সেদিন কী কী কাজ করবেন, সেটি একটা কাগজে ১০ মিনিটে লিখে ফেলুন। কাগজটি সাথে রাখুন। আগের দিনের চাইতে অন্তত একটি হলেও বেশি কাজ করার কথা লিখবেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মিলিয়ে নিন, সবগুলি করতে পেরেছেন কিনা।

ছয়। স্টুপিডদের সঙ্গ এড়িয়ে চলুন কিংবা আপনার আশেপাশের লোকজনকে ভাল কিছু করার উৎসাহ দিন। আপনার আশেপাশের বন্ধুদের কাজ করার ধরন এবং সফল হওয়ার অভ্যেস আপনাকে প্রভাবিত করতে পারে। আপনার স্বামী যত স্টুপিড হবে, আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্টুপিড হওয়ার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। স্টুপিড স্ত্রী অপেক্ষা স্টুপিড স্বামী পরিবারের জন্য বেশি বিপদজনক। আমি ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখেছি, বাবা যতক্ষণই কাজে থাকতেন, ততক্ষণ খুশিমনে থাকতেন। তখন থেকে আমার মধ্যে এই ধারণা হয়ে যায়, কাজের মধ্যে থাকলে খুশি থাকা যায়। আপনার ফ্যামিলি থেকে যা শিখেছেন, সেটা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। তাই আপনি এমন কিছু আপনার ফ্যামিলিতে করবেন না, যেটা আপনার পরবর্তী প্রজন্মকে ওভাবে করেই ভাবতে শেখাবে।

সাত। যে কাজটা করা দরকার, সে কাজে জেদি হওয়ার চেষ্টা করুন। কাজটার শেষ দেখে তবেই ছাড়ুন।

আট। যিনি আপনাকে তাঁর জীবনে অপরিহার্য মনে করেন না, তাঁকে আপনার জীবনে অপরিহার্য মনে করার বাজে অভ্যেস থেকে সরে আসুন। যে মানুষটা আপনাকে ছাড়াই সুস্থভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, তার জন্যে দম আটকে মরে যাওয়ার তো কোন মানে হয় না। আপনি যত বেশি তার জন্য ফিল করবেন, তিনি তত বেশি এক ধরনের অসুস্থ জয়ের আনন্দ উপভোগ করবেন। ভুল মানুষকে ভুলে থাকতে জানাটা মস্ত বড় একটা আর্ট। আপনি কত সময় ধরে তার সাথে ছিলেন, সেটা বড় কথা নয়; বরং সামনের সময়টাতে কত বেশি তাকে জীবন থেকে ডিলিট করে থাকতে পারবেন, সেটাই বড় কথা।

নয়। খুব দ্রুত পড়ার অভ্যাস করুন। পড়ার সময় কীভাবে অপ্রয়োজনীয় অংশগুলিতে চোখ বুলিয়ে যেতে হয়, সেটা শিখুন। প্রয়োজনীয় অংশগুলি দাগিয়ে দাগিয়ে বারবার পড়ুন এবং মাথায় সেগুলির একটা ফটোকপি রেখে দিন। এতে আপনার পড়ার কাজটা করার সময় কমে যাবে।

দশ। আপনার বর্তমান অবস্থার দিকে তাকান। দেখবেন, কিছু কিছু বিষয়ে স্রষ্টার অনুগ্রহে আপনি অনেক বিপদ কিংবা দুর্ভাগ্য থেকে বেঁচে গেছেন এবং ভাল আছেন। প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে শুকরিয়া আদায় না করে ঘুমাবেন না। কৃতজ্ঞতাবোধ সম্মান, মানসিক শক্তি এবং শান্তি এনে দেয়।

এগারো। দ্য সিক্রেট, আউটলায়ারস, দ্য সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি এফেক্টিভ পিপল, দ্য পাওয়ার অব নাউ, দ্য মঙ্ক হু সোল্ড হিজ ফেরারি, ইউ ক্যান উইন সহ বিভিন্ন মোটিভেশনাল বইপত্র পড়ুন। বিভিন্ন গ্রেটম্যানদের বায়োগ্রাফি বেশি বেশি পড়ুন। দ্য প্রফেট, গীতবিতান এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ অনুভব করে পড়ুন। এসব বই পড়ার সময় অবশ্যই বিশ্বাস করে পড়তে হবে। যদি আপনি পৃথিবীতে সবকিছুই যুক্তি দিয়ে বিচার করেন, তবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা আপনার জন্য কঠিন হতে পারে। তবে বইগুলিতে যা যা আছে, সেগুলির মধ্য থেকে আপনার দরকারি জিনিসগুলিকেই গ্রহণ করুন।

বার। মাসে অন্তত দুইদিন রোযা রাখুন। রোযা মানসিক শক্তি বাড়ায়, সহনশীল এবং বিনীত হতে শেখায়।

তের। ব্যাগে অন্তত একটি ভাল বই রাখুন আর সুযোগ পেলেই পড়ুন। মোবাইলেও পিডিএফ আকারে বই রাখতে পারেন।

চৌদ্দ। প্রতিদিন অন্তত একজন ব্যক্তিকে সাহায্য করুন কিংবা ক্ষমা করে দিন। এতে আপনার নিজের প্রতি সম্মানবোধ বাড়বে। নিজেকে সম্মান করুন সবচাইতে বেশি।

পনের। সপ্তাহে একদিন বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোর হওয়া দেখুন। এটি আপনার ভাবনাকে সুন্দর করতে সাহায্য করবে।

ষোলো। একটা সহজ বুদ্ধি দিই : অন্য মানুষকে সম্মান করে না, এমন লোকের সঙ্গ এড়িয়ে চলুন। উদ্ধত লোকের কাছ থেকে তেমন কিছুই শেখার নেই।

সতেরো। নিজের চারিদিকে একটা দেয়াল তৈরি করে রাখুন। সে দেয়ালেঘেরা ঘরে আপনি নিজের মতো করে নিজের কাজগুলি করার জন্য প্রচুর সময় দিন। এতে আপনি অন্যদের চাইতে একই সময়ে বেশি কাজ করতে পারবেন। সবাইকেই সময় দিলে আপনি নিজের কাজগুলি ঠিকমতো করতে পারবেন না।

আঠারো। প্রতিদিন একটা ভাল বইয়ের অন্তত ৩০ পৃষ্ঠা না পড়ে ঘুমাতে যাবেন না। ফেসবুকিং করার সময় বাঁচিয়ে বই পড়ুন। বই পড়ে, এমন লোকের সাথে মিশুন। যে ছেলে কিংবা মেয়ে বই পড়ে না, তার সাথে প্রেম করার কিছু নেই। আর যদি ভালোবেসেই ফেলেন, তবে তাকে বইপড়া শেখান।

উনিশ। আপনার চাইতে কম মেধা আর বুদ্ধিসম্পন্ন লোকজনের সাথে সময় কম কাটান। তবে কখনওই তাদেরকে আঘাত করে কোন কথা বলবেন না। একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির সাথে একবার কথা বলা ২০টা বই পড়ার সমান। ভুল লোকের সাথে সময় কাটানোর চাইতে একা একা থাকা ভাল।

বিশ। প্রতিদিন আপনি যতটুকু কাজ করতে পারেন, তার চাইতে কিছু বাড়তি কাজ করুন। বাড়তি কাজটি ঠিকভাবে করতে পারলে নিজেকে কিছু কিছু উপহার কিনে দিন, কিংবা করতে ভাল লাগে, এমন কোন কাজ করুন।

একুশ। সপ্তাহে একদিন ঘড়ি এবং মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে একেবারে নিজের মতো করে সময় কাটান। সেদিন বাইরের পুরো দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলুন এবং যা যা করতে ভাল লাগে কিন্তু ব্যস্ততার কারণে করা হয় না, সেসব কাজ করে ফেলুন।

বাইশ। মাথায় যদি কোন উল্টাপাল্টা কিংবা নেতিবাচক চিন্তা আসে, তবে সেটিকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করবেন না; বরং আপনি নিজে সেটি থেকে বেরিয়ে আসুন।

তেইশ। আপনার মোবাইল ফোনটা আপনার জন্য কেনা, অন্যের জন্য নয়। মাঝে মাঝে বেছে বেছে কল রিসিভ করুন। আমাদের বেশিরভাগ কলই গুরুত্বপূর্ণ হয় না, আর সময়ও নষ্ট করে। যে কলটি আপনার মন কিংবা মেজাজ খারাপ করে দেবে বলে আপনি আগে থেকেই জানেন কিংবা বুঝতে পারেন, অপরিহার্য না হলে সেটি রিসিভ করবেন না।

চব্বিশ। আপনি সম্মান করেন কিংবা পছন্দ করেন, এমন কোন ব্যক্তির ১০টি ভাল গুণ কাগজে লিখে ফেলুন। এরপর আপনি বিশ্বাস করুন যে, সে গুণগুলি আপনার মধ্যেও আছে এবং যতই কষ্ট হোক না কেন, সে গুণগুলির চর্চা করতে থাকুন। উনি যেরকম, সেরকম হওয়ার অভিনয় করুন। উনি যেভাবে করে কাজ করেন, একই স্টাইলে কাজ করুন। এ কাজটি ২ সপ্তাহ করে দেখুন, নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

পঁচিশ। মাঝে মাঝে সফট মেলোডির ওরিয়েন্টাল কিংবা ওয়েস্টার্ন ইন্সট্রুমেন্টাল শুনুন; হেডফোনে কিংবা একা রুমে বসে। কিছু ভাল মুভি দেখুন। কিছু মাস্টারপিস পেইন্টিং দেখুন। এবং একটা কাগজে একটা ভাল মিউজিক শুনে কিংবা মুভি আর পেইন্টিং দেখে আপনার কী অনুভূতি হল, লিখে ফেলুন। এটা ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন।

ছাব্বিশ। অন্যরা করার আগেই নিজেই নিজের বাজে দিকগুলি নিয়ে মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে ঠাট্টা করুন। এতে করে আপনার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।

সাতাশ। প্রতিদিনই এমন দুটি কাজ করুন, যেগুলি আপনি করতে পছন্দ করেন না। করার সময় বিরক্ত লাগলেও থেমে যাবেন না। যেমন, এমন একটি বই পড়তে শুরু করুন, যেটি আপনার পড়া উচিত কিন্তু পড়তে ইচ্ছা করে না। কিংবা এমন একজনকে ফোন করুন যাকে ফোন করা দরকার কিন্তু করা হয়ে ওঠে না। কিংবা বাসার কমোডটি পরিষ্কার করে ফেলুন। এতে করে আপনার দ্রুত কাজ করার ক্ষমতা বাড়বে। যে কাজটি করতে গিয়ে অন্যরা ৩০ সেকেন্ডেই বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করে, সেটি যদি আপনি অন্তত ২২ মিনিট ঝিম ধরে পারেন, তবে আপনি অন্যদের চাইতে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে থাকবেন।

আটাশ। আপনি যেমন হতে চান, তেমন লোকের সাথে বেশি বেশি মিশুন। খেতে পছন্দ করে, এমন লোকের সাথে মিশে আপনি ওজন কমাতে পারবেন না।

উনত্রিশ। দিনে একবার টানা ৩০ মিনিটের জন্য মৌন থাকুন। ওইসময়ে কারোর সাথেই কোন কথা বলবেন না। খুব ভাল হয় যদি চোখ বন্ধ করে পুরোনো কোন সাফল্যের কিংবা সুখের কোন স্মৃতির রোমন্থন করতে পারেন। এটা মানসিক শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

ত্রিশ। প্রায়ই ভাবুন, আপনি এই মুহূর্তেই মারা গেলে আপনার পরিবারের বাইরে আর কে কে আপনার জন্য কাঁদবে। ওরকম লোকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কী কী করা যায়, ভাবুন এবং করুন।

একত্রিশ। আপনার হাতে মাত্র দুটো অপশন : হয় রাতে দেরিতে ঘুমাতে যান, অথবা সকালে ভোর হওয়ার আগে উঠুন। যদি রাতে সত্যিই একা থাকতে না পারেন, তবে সেকেন্ড অপশনটাই বেটার, কারণ বেশিরভাগ লোকই রাতে জাগে আর গল্প করে সময় নষ্ট করে। ভোরের আগে উঠতে পারলে, আপনাকে বিরক্ত করার কেউ থাকবে না, তাই আপনি পড়াশোনা করা ছাড়া আর তেমন কোন কাজই পাবেন না।

বত্রিশ। আমরা যা-ই করি না কেন, সেটা যদি খুব উল্লেখযোগ্য কিছু হয়, তবে সেটা নিশ্চয়ই অন্তত ১০ বছরের ১০ হাজার ঘণ্টার পরিশ্রমের ফলাফল। পৃথিবীতে কেউই রাতারাতি কিছু করতে পারে না।

তেত্রিশ। কোন একটা কাজ করতে হুট করেই পরিশ্রম করা শুরু করে দেবেন না। আগে বুঝে নিন, আপনাকে কী করতে হবে, কী করতে হবে না। এরপর পরিশ্রম নয়, সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করুন।

চৌত্রিশ। পৃথিবীতে কেউই জিরো থেকে হিরো হয় না। আপনাকে ঠিক করতে হবে, আপনি কোন ব্যাপারটাতে হিরো হতে চাচ্ছেন। আপনি যে বিষয়টাতে আগ্রহ বোধ করেন না, কিংবা যেটাতে আপনি গুরুত্ব দেন না, সেটাতে সময় দেয়া মানে, স্রেফ সময় নষ্ট করা। আপনি যেটাতে সময় দিচ্ছেন, সেটাই একদিন আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে চেনাবে।

পঁয়ত্রিশ। বুদ্ধিমত্তা আর অর্জনের মধ্যে সম্পর্ক খুব ভাল নয়। যার যত বেশি বুদ্ধি, সে তত বেশি এগিয়ে, এরকমটা সবসময় নাও হতে পারে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে ভাল রেজাল্ট-করা স্টুডেন্টদের শতকরা মাত্র ২০ ভাগ গ্রেটদের তালিকায় নাম লেখাতে পারে। বাকি ৮০ ভাগ আসে তাদের মধ্য থেকে যাদেরকে নিয়ে কেউ কোনদিন স্বপ্ন দেখেনি। তাই শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও নিজের সাথে লড়াই করে যান।

হ্যাপি লিভিং!!

ভাবনা: ছয়শো তেষট্টি

………………………………………………………

দয়া করে ইনবক্সে নিচের কথাগুলি বলে জ্বালাবেন না:

# কীভাবে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারি? (আমি যা লেখার লিখে দিয়েছি। এর বাইরে কিছুই বলার নেই। আমি বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ইনবক্সে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি আমারও জন্মের আগে!)

# বিসিএস পরীক্ষা সংক্রান্ত হাজারো ঝামেলা ও জিজ্ঞাসা (আমি বিসিএস বিশেষজ্ঞ নই। পড়াশোনার চাপে আমি বিসিএস নিয়ে গবেষণা করার সময় পাইনি।)

# এনএসআই / নিবন্ধন পরীক্ষা সহ আরও হাজারো পিএসসি’র পরীক্ষাপ্রস্তুতি, ব্যাংক জব, বিদেশে পড়াশোনা, চাকরি নিয়ে কোটি কোটি প্রশ্ন (আমি এ জীবনে একটাই চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি, এবং সেটি হল : ৩০তম বিসিএস পরীক্ষা। এই এক বিসিএস পরীক্ষা ছাড়া পৃথিবীর আর কোন পরীক্ষা নিয়েই আমি কিছু জানি না।)

# আপনি কোন স্টাইলে পড়তেন? কত ঘণ্টা পড়তেন? আপনি কি সে সময় ফেসবুকে আসতেন? রাতে কতক্ষণ ঘুমাতেন? ভাত খাওয়ার সময় কি টেবিলে বই রাখতেন? গোসলে কত সময় লাগত? ……..ব্লা ব্লা ব্লা!! (পাছে কেউ জিজ্ঞেস করে বসে, “ভাইয়া, আপনি বিসিএস ভাইভা পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় কি গোলাপি রঙের জাঙ্গিয়া পরে গিয়েছিলেন?” এই ভয়ে আমি ভাইভার ড্রেস নিয়ে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি!! বাকিটা বুঝে নেন!)

# পড়াশোনায় কীভাবে মনোযোগ বাড়ানো যায়? (অবশ্যই ‘ফেসবুকের মায়েরে বাপ’ বলে ফেসবুক থেকে একশো কোটি হাত দূরে থেকে!)

# ক্যারিয়ার বিষয়ক এক হাজার এক রকমের প্রশ্ন (আপনার ক্যারিয়ার গোল্লায় যাক! আমার কী! আমার ইনবক্স আপনার ক্যারিয়ারের জন্য নিবেদিত না।)

# পড়াশোনার রুটিন করে দেয়া (সামনে থাকলে জাস্ট তুলে আছাড় মারতাম!)

# আমি অমুক ইয়ারে পড়ি। এখন থেকে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি কীভাবে নিতে পারি? (কষ্ট করে আমার নোটসে গিয়ে শত শত ঘণ্টা ব্যয় করে আমি যে নোটগুলি লিখেছি, সেগুলি পড়েন। সেগুলি পড়ার সময় না থাকলে স্প্রাইট দিয়ে ভিজিয়ে মুড়ি খান।)

# আমি অংকে/ ইংরেজিতে দুর্বল। আমি কীভাবে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারি, পরামর্শ দিন। (আপনি পড়াশোনা না করে মাস্তি করসেন, তাই আপনি দুর্বল। আমি কী করব?)

# ‘ভাইয়া, কেমন আছেন’ দিয়ে শুরু করে বিসিএস গাইডের নাম জানতে চাওয়া (এ জ্বালায় আমি ইদানীং ইনবক্সে ভয়ে কুশল বিনিময় করা ছেড়ে দিয়েছি।)

# বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝামেলা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান চেয়ে পরামর্শপ্রার্থনা (আপনার বিএফ’য়ের সাথে ঝামেলা হলে আপনার সামনে একটাই পথ খোলা: আমার কাছে নাচতে নাচতে চলে আসা। এর বাইরে আর কিছুই জানি না।)

# আপনার অমুক অমুক লেখার লিংকটা দিন, আপনার অমুক লেখাটিকে পিডিএফ করে আমাকে এই ইমেইল অ্যাড্রেসে পাঠান (আমার যতটা নোট, তার ১০% নোটও যদি আপনার থাকত, তবে এ কাজটা কেউ করে দিতে বললে, আপনি কী বলতেন উনাকে?)

# আমি কীভাবে করে আপনার মতো করে লিখতে পারি? আমি কীভাবে আপনার মতন রেজাল্ট করতে পারি? (মুজতবা আলীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনি কীভাবে করে এত ভাল লিখেন, যদি একটু বলতেন!” “আমি আপনাকে বড়োজোর আমার সন্তানকে দেখাতে পারি। কিন্তু সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া দেখাতে বললে তো বিপদ!”…..এই ছিল উনার উত্তর!!)

# আমাকে কিছু ভাল মুভির, বইয়ের নাম দিন। (আমি এ বিষয়ে অনেক পোস্ট দিয়েছি, নোট লিখেছি। সেগুলি কষ্ট করে খুঁজে দেখুন। সময় না থাকলে গুগল মামাকে জিজ্ঞেস করুন।)

# আপনি অমুক অমুক বিষয় নিয়ে চুপ কেন? কিছু লিখছেন না কেন? (আমি এই পৃথিবীকে উদ্ধার করার দায়িত্ব নিয়েছি, একথা লিখে কখন, কোথায় বন্ডসাইন করেছিলাম?)

# ‘আমাকে আপনার ফেসবুক বন্ধু বানান’ সংক্রান্ত চরম পর্যায়ে বিরক্ত করা!! (কেন বানাব? আপনি কে? আমার পোস্টের জন্য আমার বন্ধু হতে হবে কেন? আমার সব পোস্টই তো পাব্লিক-করা। আপনি এমন কে যে আপনাকে বন্ধু বানাতে হবে? আপনি কি কুৎসিত অবয়বের জ্ঞানী ব্যক্তি? নাকি, মাথামোটা সুন্দরী? আপনি কে এমন? নাকি, আপনি আমার পরিচিত?)

# আপনার ফোন নাম্বারটা দিন। (দেবো না। আপনার সাথে ফোনে ক্যারিয়ার প্যানপ্যানানি করার জন্য আমি হাঁ করে বসে থাকি না। এ নিয়ে বিরক্ত করবেন না।)

আরও হাজারো রকমের প্রশ্ন, ব্যক্তিগত/ পারিবারিক/ সামাজিক/ রাষ্ট্রীয় সমস্যা, আবদার, অভিযোগ, অনুযোগ আর আমার মাথা, উনার/ উনাদের ছাতা!! মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে মনের দুঃখে বিয়ে করে বৈরাগী হয়ে গান গাইতে থাকি, সাধের লাউ বানাইলো মোরে……………

কিডিং অ্যাপার্ট, আমার এসব ক্যারিয়ার, বিসিএস/ আইবিএ প্রস্তুতি, মোটিভেশনাল ব্যাপার নিয়ে লিখতে আসলেই ভাল লাগে না। আমি ভালোবাসি মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে লিখতে, নানান সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে ভাবতে, প্রেম-ভালোবাসার সাতকাহন শোনাতে। আমার নিজের সবচাইতে প্রিয় ৫টি লেখার লেখার নাম জিজ্ঞেস করলে সেখানে হয়তো ১টি লেখার নাম বলব, যেটি ক্যারিয়ার/ প্রস্তুতিকৌশল/ মোটিভেশন নিয়ে। তবুও লিখি তো, নাকি? কাদের জন্য এত কষ্ট করে সময় বের করে লিখি? আপনাদের জন্যই তো! এর বাইরেও কেন আমাকে জ্বালাতে হবে? কোন সুস্থ-স্বাভাবিক মানবসন্তানের পক্ষে এ পরিমাণ ইনবক্স মেসেজের রিপ্লাই দেয়া সম্ভব নয়। সবিনয়ে বলছি, আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি আমাকে ক্ষমা করতে না পারলে, আমি আপনাকে ব্লক করব। আসলেই করি এবং সামনেও করব, আই ডু মিন ইট! প্রয়োজনীয় মেসেজগুলি আর দেখতে পারি না ইদানীং। সবাই শুধু ভুল বোঝে………… আমি অতিবিরক্ত!! আমি আপনাকে অনলাইন পড়াশোনা করানোর কিংবা কাউন্সেলিংয়ের মহান দায়িত্ব নিয়ে ফেসবুকিং করি না। অনেক হয়েছে। জাস্ট স্টপ ইট অন মাই ইনবক্স!!

ভাবনা: ছয়শো চৌষট্টি

………………………………………………………

(আমার কিছু ব্যক্তিগত ভাবনা আমার ভাবনাদেয়ালে শেয়ার করলাম। কারোর ভাল না লাগলে, এড়িয়ে যান।)

এক। অতীতের যে যে কাজ করার কারণে আপনার জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে, সেসব কাজের একটা তালিকা করে আপনার বালিশের কাছে রেখে দিন আর ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার করে পড়ে নিন কিংবা সেসব নিয়ে ৫ মিনিট ভাবুন। সেসব থেকে কীভাবে করে দূরে থাকা যায়, প্লান করুন। পরেরবার যখন একই কাজটি করতে যাবেন, তখন অবচেতন মনেই আগেরবারের ব্যর্থতার কথাটা স্মৃতিতে চলে আসবে। যদি সেটা থেকে কীভাবে নিজেকে দূরে রাখা যায়, সে প্ল্যানটা করা না থাকে, তবে আগের ব্যর্থতার স্মৃতি পরেরবারের কাজের মানকে প্রভাবিত করতে পারে।

দুই। আপনাকে আগামী ১০ দিনে কী কী করতে হবে, সেটা নিয়ে না ভেবে আজকের দিনে কী কী করতে হবে, সেটা নিয়ে ভাবুন এবং কাজগুলি করতে শুরু করে দিন। এতে কাজকে সহজ মনে হবে।

তিন। আপনার বিপরীত লিঙ্গের কাউকে, যাকে হয়তোবা কখনওই পাবেন না, তাকে সপ্তাহে একটি প্রেমপত্র লিখুন; একেক সপ্তাহে একেকজনকে। সেখানে তার বিভিন্ন গুণের কথা লিখুন। ফেসবুকে শেয়ার করতে পারেন চাইলে। এটা নির্মল মানসিক আনন্দদান করে। (এই যেমন, আমি সপ্তপদী’র সুচিত্রা সেনকে নিয়ে প্রায়ই বাইকে চেপে ঘুরতে যাই……….চারুলতা’র মাধবী মুখার্জির সাথে চোখের ভাষায় দুষ্টুমি করতে থাকি………কিংবা, অড্রে হেপবার্নের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবি, এই বুঝি রোমান হলিডে’র সেই মিলিয়ন ডলার লুকটা দিল বলে…..!!)

চার। আপনার মৃত্যুর পর আপনার কবরের গায়ে কী লেখা থাকবে বলে আপনি চান? সেটা কল্পনায় আনুন এবং সেটা করার চেষ্টা করতে থাকুন। আমারটা বলছি : এখানে যে মানুষটি শুয়ে আছে, সে মৃত্যুর আগে বেঁচে ছিল।

পাঁচ। যে কাজটি করা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিন্তু করতে ভাল লাগে না, সেটি অর্ধেক সময়ের মধ্যে করে ফেলার টেকনিক আবিষ্কার করুন। তাহলে আপনি যা যা করতে ভালোবাসেন, সেগুলি করার জন্য সময় পাবেন।

ছয়। আপনার সম্পর্কে ১৫টি নেতিবাচক পয়েন্ট লিখে ফেলুন। সেগুলির কোনটা থেকে আপনি কতদিনে মুক্তি পেতে চান, সেটা পয়েন্টের পাশে লিখে রাখুন। মাঝে মাঝে সে কাগজটা উল্টে দেখুন, যে যে পয়েন্ট থেকে মুক্তি পেয়েছেন, সেটি সেটি কেটে দিন। আপনার করতে ভাল লাগে, এমনকিছু করে আপনার ছোট ছোট সাফল্যকে সেলিব্রেট করুন।

সাত। আপনি যে যে কাজ করতে ভয় পান, কিন্তু করা উচিত, সেসব কাজের একটি তালিকা বানান। তালিকাটি বড় করেই বানান। যত বিরক্তই লাগুক, প্রতিদিন একটি করে কাজ করতে শুরু করুন এবং এভাবে করে কয়েক সপ্তাহে কতটুকু এগিয়ে গেলেন, মিলিয়ে দেখুন।

আট। আমরা আসলে কী করতে ভালোবাসি, সেটা জানাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেটা একবার জানতে পারলে, আর সেটাতে নিজের আন্তরিকতা আর প্রচণ্ড পরিশ্রম দিতে জানলে পিছিয়ে থাকার কোন কারণ নেই। আমাদের সবচাইতে বড় সমস্যা, আমাদের আসলে কী ভাল লাগে, আমরা সেটাই জানি না।

নয়। কোন একটা বিষয়ে কাজ করা শুরু করার আগে যথেষ্ট সময় নিয়ে ভাবুন কাজটা কীভাবে করবেন, কতটুকু করবেন, কেন করবেন। ধৈর্য সহকারে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়ে মানুষ অনেকদূর যেতে পারে। নিজের ইন্টিউশনকে গুরুত্ব দিন।

দশ। কোনকিছুকেই অন্ধভাবে ফলো করবেন না। কারোর বাঁধা ছকে না পড়ে নিজের ছক নিজেই বানান। যেকোনো পরামর্শকে নিজের সুবিধা মতো কাস্টমাইজড করে নিন।

এগার। খুব রেগে গেলে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে উল্টো থেকে ১০০ থেকে ১ পর্যন্ত গুনতে থাকুন, কিংবা দেয়ালের অথবা সিলিংয়ের কোনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আপনার নিজের সম্পর্কে ১০টি ভাল চিন্তা করুন। এতে রাগ কমে যাবে।

বার। গ্রেটম্যানদের নিন্দা করবেন না, নিন্দা শুনবেন না। ওরকম করলে অহংকার বাড়ে। আপনি যার সমপর্যায়ের নন, তার সম্পর্কে খারাপ বলার কোন যোগ্যতাই আপনার নেই, এটা মন থেকে বিশ্বাস করুন।

তের। জীবনের সকল ক্ষেত্রে অতিপণ্ডিত এবং অতিবুদ্ধিমানদের এড়িয়ে চলবেন। এরা সাধারণত হয় আপনার ক্ষতি করবে নিজের লাভের জন্য, কিংবা আপনার আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেবে।

চৌদ্দ। টিভি দেখার সময় বাঁচিয়ে প্রার্থনা করুন, বই পড়ুন, মিউজিক শুনুন, কিংবা ভাল একটা মুভি দেখুন।

পনের। নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে কাইজেন পদ্ধতি কাজে লাগান। কাইজেন মানে হল, না থেমে একটু একটু করে আরও ভাল অবস্থায় যাওয়া। অল্প অল্প করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান, কিন্তু থেমে যাবেন না।

ষোল। প্রতিদিন ২ মিনিট করে ঘড়ির কাঁটার দিকে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকুন। এসময় অন্যকোন ভাবনা মনে আসতে দেবেন না। এভাবে করে টানা ২১ দিন করুন। এতে আপনার চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়বে।

সতের। প্রতিদিন আপনি আগের দিনের চাইতে কোন কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেন, একটা নোটবুকে তারিখ দিয়ে লিখে ফেলুন। আগের দিনের অসমাপ্ত কাজগুলি করার জন্য আজকের দিনের কাজ কমাবেন না, কাজ করার সময় বাড়িয়ে দিন।

আঠার। প্রতিদিন নিজের পছন্দের একটি গান গলা ছেড়ে গাইতে পারেন, কিংবা নিজের পছন্দের একটি কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন। যে যা-ই বলুক, আপনার নিজের ইচ্ছেটাকে সেলিব্রেট করুন। আপনি গান গাইবেন আপনার নিজের জন্য। যেটি আপনাকে আনন্দ দেয়, সেটি যদি কারোর কোন ক্ষতি না করে করতে পারেন, তবে সেটিকে নিয়ে কাউকে কোন বাজে কথা বলতে দেবেন না, কিংবা কারোর কোন বাজে মন্তব্যকে কেয়ার করবেন না।

উনিশ। বেশিরভাগ সময়ই ক্লান্তি একটি কল্পনা। আপনি যে বিষয়টা করতে ওই মুহূর্তে পছন্দ করছেন না, সে বিষয়ে আপনার মস্তিষ্ক বারবার সিগন্যাল পাঠায়, আপনি ক্লান্ত! আপনি ক্লান্ত! পড়ার সময় ক্লান্তি এলে পড়তে ইচ্ছে করে না, কিন্তু সে সময়ে কোন বন্ধুর সাথে ঘুরতে যেতে বললে কিন্তু ক্লান্তি কাজ করে না। কোন বিরক্তিকর কাজে ক্লান্তি এলে ওইসময়ে কোন সুখকর কাজ দ্বিগুণ পরিমাণে করে সময়টাকে ঠিকভাবে কাজ লাগান।

বিশ। মনোযোগ বাড়ানোর একটা টেকনিক ফলো করতে পারেন। আপনার রুমের এমন কিছু ছোটখাটো জিনিস দেখতে থাকুন, যা আপনি আগে কখনওই খেয়াল করেননি। সেগুলি নিয়ে ভাবতে থাকুন। সেগুলি থেকে কী কী জিনিস এই মুহূর্তেই রুম থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়, ভাবুন এবং রেখেই দিন দূরে! যা আপনার দরকার নেই, তা থেকে মুক্ত হোন। প্রায়ই এমন হয়, একটা অপ্রয়োজনীয় জিনিস হাজারটা প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে নেয়।

একুশ। যাকে আপনি কোন একটা কাজে সহযোগিতা করতে পারবেন না, তাকে কখনওই বলবেন না যে সে কাজটি করতে পারবে না। যে আপনাকে কোন একটা কাজে সহযোগিতা করতে পারবে না, তাকে কখনওই বলার সুযোগ দেবেন না যে আপনি কাজটা করতে পারবেন না।

বাইশ। যারা ভাবেন, আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের, আমি কী-ই বা করতে পারব, তারা আসলে নিজেকে ফাঁকি দেয়ার রাস্তা তৈরি করে দিতে থাকেন। এরকম চিন্তা থেকে নিজেকে ক্ষমা করে দেয়ার প্রবণতা তৈরি হয় এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করার মানসিকতা গড়ে ওঠে। এ ধারণার প্রতিদিনের চর্চার মাধ্যমে আপনি নিজেকে দুর্বল করে দিতে থাকেন, কাজের মান এবং কাজের প্রতি উৎসাহ কমতে থাকে। যাদের সাথে মিশলে আপনার ওই ধারণা আর চিন্তাভাবনা বেশি করে জাগে, তাদের সাথে কম কম মিশুন। আপনি জীবনে যেটা করতে চাইছেন, সেটা যদি আপনাকে করতে চেষ্টা করার সুযোগ দেয়া হয়, আপনি নিশ্চয়ই সেটার যোগ্য। নাহলে তো সেটা আপনাকে করার সুযোগই দেয়া হত না।

তেইশ। যে কাজটি আপনার করা খুব দরকার, সেটি প্রতিদিন অন্তত ৪ ঘণ্টা করে টানা ২১ দিন করুন; কাজটা করতে ভাল লাগুক কিংবা না লাগুক।

চব্বিশ। যে কাজটি আপনি জানেন, আপনাকে করা বন্ধ করে দিতে হবে, সে কাজটি করতে থাকবেন না। আপনি সে সময়ে অন্যকিছুতে মন দিন।

পঁচিশ। যখন যা খেতে ইচ্ছে করবে, খেয়ে ফেলবেন। আপনার সবচাইতে সুন্দর পোশাকটিকে কোন বিশেষ দিনে পরার জন্য ফেলে রাখবেন না, আজকেই সেই বিশেষ দিন। কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করলে, সুযোগ হলেই চলে যাবেন। অতিরিক্ত পয়সা জমিয়ে রাখবেন না। যে দিনটির জন্য অতো পয়সা জমিয়ে রাখছেন, সে দিনটি আপনার জীবনে নাও আসতে পারে। নাচতে ইচ্ছে করলে একটুখানি নেচে নেবেন। এটাই জীবন!

ছাব্বিশ। যদি রান্না ভাল হয়, তবে যিনি রেঁধেছেন, তাকে ডেকে তার রান্নার প্রশংসা করুন। যারা আপনার চাইতে পদমর্যাদায় কিংবা অবস্থানে ছোট, তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলার প্র্যাকটিস করুন। যারা আপনার সেবা করছেন, তাদেরকে মাঝেমধ্যেই অকৃপণভাবে ধন্যবাদ দিন। আপনার কাছের মানুষটিকে, যাকে ভালোবাসেন, তাকে তার মৃত্যুর আগেই একগুচ্ছ গ্ল্যাডিওলা দিয়ে বলুন, ভালোবাসি! নাহলে সে ফুল তার মৃত্যুর পর কবরের এককোনায় রেখে আসতে হবে। কী লাভ? মৃত মানুষ তো আর ফুলের সুন্দর গন্ধ নিতে পারে না! মৃত হয়ে যাওয়ার বড্ড অসুবিধে এই যে, মৃতরা পৃথিবীর সব সৌন্দর্য থেকেই বঞ্চিত।

সাতাশ। এই তীব্র গরমে গনগনে চুলার অসহ্য উত্তাপ সহ্য করে রোজা রেখে যেসকল মা/ স্ত্রী/ বোন/ আত্মীয়া তাঁদের পরিবারের জন্য ইফতার বানাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ স্যালুট জানাই।

আসুন, প্রতিদিন ইফতারের সময় তাঁদের হাসিমুখে ধন্যবাদ দিই। এই মাসে অফিসিয়ালি আমাদের কর্মঘণ্টা ও পরিশ্রম, দুইই কমে যায় আর উনাদের কর্মঘণ্টা ও পরিশ্রম, দুইই অনেক বেড়ে যায়। যদি তাঁরা তাঁদের কাজের জন্য বেতন পেতেন, তবে এই মাসে তাঁদের বেতন বাড়তো অন্তত ৭৫ শতাংশ। এই পবিত্র রমজানের মাসে তাঁরাই প্রকৃত নায়ক!

আটাশ। সুযোগ পেলেই শিশুদের সাথে একেবারে ওদের মতো করে মিশুন, খেলুন, গল্প করুন। ওদেরকে বিভিন্ন গিফট দিন। ওদের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠুন। এটা আপনাকে আশ্চর্যরকমের নির্মল আনন্দ দেবে।

বাঁচুন, বাঁচতে দিন!!

ভাবনা: ছয়শো পঁয়ষট্টি

………………………………………………………

সালটা খুব সম্ভবত ২০০৯। ডিসেম্বরের কোন এক সন্ধ্যা। চট্টগ্রামের জামাল খানের চেরাগি পাহাড়ের মোড়। পিঠেপুলি, চটপটি, ফুচকা আর লিকার চায়ের গরমে শীতের সন্ধ্যার ওম জেঁকে বসেছে সে মোড়ের পরতে পরতে। সে রঙিন সন্ধ্যায় কথার তুবড়ি ছুটছিলই তো ছুটছিল!

ছেলেটি প্রতিদিনের মতো সিগারেট ফুঁকছে আর ধুমসে আড্ডা দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংকের সামনের জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসকরা বেকার মেধাবী ছেলে; ধাক্কা খেতে খেতে ধরেই নিয়েছে, চাকরিবাকরি মামাচাচা ছাড়া হয় না। ঘুম থেকে ১২টায় উঠে, ১ ঘণ্টা ধরে আয়েশ করে ব্রাশ করে, ব্রাঞ্চ (brunch) সারে, রিটায়ার্ড বাবার অভিসম্পাত আর মায়ের চোখের জলের আটপৌরে আলপনায় ওর সকালটা ফুরোয় ২:৩০টায়। এরপর মেসেঞ্জার অন করে বিছানায় একটু গড়িয়েটড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়, পড়ন্ত বিকেলে প্রেমিকার চোখে সন্ধ্যানামা দেখে। যার কিছু নেই, তারও একটি প্রেমিকা থাকে। স্বপ্ন দেখে, একদিন সেও একটা চাকরি জুটিয়ে প্রেমিকা অন্যঘরে যাওয়ার আগেই নিজের ঘরে পাকাপাকিভাবে নিয়ে আসবে। সেকথা সে মেয়েটাকে বলেও। পৃথিবীর অন্য ১০টা পুরোনো বোকা প্রেমিকার মতো এই রূপসীও বিশ্বাস করে, একদিন সত্যি সত্যি ওরকম দিন আসবে। ওই স্বপ্নদেখা পর্যন্তই সন্ধ্যাটা থমকে থাকে। ফ্রি ফ্রি স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগে তো! স্বপ্নপূরণের জন্য কাজ আর এগোয় না। স্বপ্ন স্রেফ স্বপ্নেই মরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। প্রেমিকার বিয়ের কথা চলছে। এমনসময়ে কী করতে হয়, বেকার ছেলেটি জানে না, কিংবা জানতে ইচ্ছে করার সাহসটুকু করে না। শুধু জানে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। মিথ্যে স্বপ্নের বুননে ঝলমলে হলদে সন্ধ্যাবাতি জানিয়ে দেয়, সাড়ে ৭টা বাজে, ওকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে। মেয়েটা বাসায় ফেরে, ছেলেটা প্রতিদিনকার আড্ডায় যায়। ওখানে ওর বন্ধুরা আছে। সবাই ওর মতো; বেকার মানুষ, ব্যস্ত ভীষণ! যতটা বেকার, ততটাই ব্যস্ত! চাকরি নেই, তবুও অন্তত একটা করে প্রেমিকা আছে। সময় কেটে যায় দিব্যি! পরিশ্রম করার ইচ্ছে কম, স্বপ্ন দেখার সাধ বেশি। বাবার কষ্টের টাকায় ভাত গিলে আর নিজের টিউশনির টাকায় বাদামখাওয়া প্রেম করে। পরিবারের বোঝা কাঁধে না নিয়ে নিজেই বোঝা হয়ে আছে অনেকদিন ধরেই। ঈশ্বরপ্রদত্ত বাবার হোটেল আছে, ফ্রিতে থাকাখাওয়া যায়। আশেপাশের লোকজন ধিক্কার দেয়, ওটা সয়ে গেছে, এখন আর গায়ে লাগে না। ওরা ঘুমায়, জেগে উঠে আবারও ঘুমিয়ে পড়বে বলে। মাঝেমাঝে চাকরির জন্য পরীক্ষাটরীক্ষা দেয়। ঠিকমতো পড়াশোনা করে না; পরীক্ষা দেয়, এটাই সান্ত্বনা। চাকরি পায় না, সিস্টেমের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে, বলে বেড়ায়, “ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় নাকি? মামাচাচা নেই, কে বলবে আমার জন্য? সব শালারা করাপ্টেড!” বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে একটাসময়ে সে আন্দোলনে রাস্তায় নামে, ফেসবুকের ওয়াল তোলপাড় করে। পড়াশোনা করার চাইতে ওটাই ঢের সহজ। প্রেমিকাও ভাবে, ও তো অন্তত চেষ্টা করছে! একদিন আমরাও ওই ফানুসের মতো ইচ্ছেঘুড়ি হব। ………… ১১টায় বাসায় ফিরে, রাতটা কাটায় ভার্চুয়ালে। ফেসবুকে বড় বড় কথায় জানিয়ে দেয়, ও কিছুতেই ছোট নয়। কিছু থাক না থাক, একটা স্ট্যাটাস তো আছে! ফোনের ঝড়ে রাতের আবেগ তুলোর মতো উড়তে থাকে। চ্যাটিং আর ডেটিংয়ের নেশায় রাত ভোর হয়। মা জানে, ছেলে রুমের দরোজা বন্ধ করে পড়ছে। বাবাকে বোঝায়, তুমি দেখো, আমাদের নিতুর বিয়েটা বাবলাই দেবে!

একটা চাকরি দরকার, চাকরি! মধ্যবিত্তের প্রাণ না থাকলেও চলে, কিন্তু চাকরি লাগেই! দিন কাটে, রাত ফুরোয় স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের প্রতীক্ষায়। সাদরে দাসত্ববরণের শতাব্দীপ্রাচীন আয়োজন চলে ঘরে ঘরে।

সেই শীতের সন্ধ্যাটি সবকিছু বদলে দিল! ওই বেকার যুবকটি দেখল, ব্লুজিন্স-ইয়েলোটিশার্ট পরা একটা ছেলে জীপ থেকে নামল। সাথে একজন পুলিশের পোশাকপরা বডিগার্ড, সারাক্ষণ শশব্যস্ত স্যারের সেবায়। ওই ছেলেটি একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে গেল। ওখানকার অনেক লোকই ওকে চেনে। অনেকেই হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করছে, কুশল বিনিময় করছে। জানা গেল, সেই ছেলেটি পুলিশে চাকরি করে; এএসপি। ২৪ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। একেবারে হতদরিদ্র অবস্থা থেকে উঠেআসা একজন সেলফমেইড মানুষ। পুলিশে চাকরি পাওয়ার সুবাদে ওর অর্জন তিনটি : এক। ওর গ্রামের বাড়িতে নতুন টিনের চাল লাগিয়েছে। ওর বুড়ো মাকে এখন আর জংধরা টিনের ফুটোয় গলেপরা বর্ষার পানি সরাতে হয় না। দুই। গ্রাম্য অশিক্ষিত বুড়ো বাবা-মা’কে ওর সরকারি গাড়িতে করে চট্টগ্রাম শহরটি ঘুরে দেখিয়েছে। অপার বিস্ময়ে ওর বাবা-মা জেনে গেছে, ওদের ছেলেকে থানার ওসিও ‘স্যার’ ডাকে! তিন। ওকে এখন আর শত সেলাইয়ের ছেঁড়াশার্ট পরে বাইরে যেতে হয় না। প্যান্টের হাঁটুর কাছের ফুটোটায় আঙুল ঢুকিয়ে কেউ আর মজা করতে পারে না। ………… চাকরি পাওয়ার আগে শহরে সে এক বড় ভাইয়ের রুমে ফ্লোরে থাকত, এতে ওর ভাগের মেসভাড়া অর্ধেক দিলেও চলত। বেঁচে-যাওয়া টাকায় গ্রামের কলেজে ইন্টারপড়ুয়া ছোটবোনের পড়ার খরচ আর নিজের খাওয়ার খরচটা মেটাত। ৪টা টিউশনি করতে হত। ওতে যে টাকা আসত, সে টাকা কারোর কারোর একটা টিউশনির টাকার সমপরিমাণ। ডিগ্রি কলেজের স্টুডেন্টদের এর চাইতে দামি টিউশনি জোটে না।

সেই একটি আশ্চর্য সন্ধ্যা সবকিছু পাল্টে দিল। নিজের প্রতি প্রচণ্ড ধিক্কার ক্ষোভ জেদ আর অভিমানে সেই ছেলেটি পুরোপুরি বদলে গেল। হঠাৎই জেগেওঠা সময়ের দাবিতে অভিযোগ করার অভ্যেস থেকে সরে এসে পরিশ্রম করার মানসিকতা গড়ে তুলল। ও হয়ে গেল একেবারে অন্যমানুষ! পরপর ৩বারের চেষ্টায় সে এখন বিসিএস প্রশাসনের ৩১ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। ওর বাবাকে এখন আর মুখ লুকিয়ে রাখতে হয় না। ওর মাকে সবাই বলে ‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মা’। ওর কথা এলে বন্ধুরা গর্ব করে বলে, একটাসময়ে আমরা একসাথে আড্ডা দিতাম।

জীবন আমাদের কখন কোথায় নিয়ে যায়, সেটা নিয়ে আগে থেকে আমরা কেউই কিছু ভাবতেও পারি না!