ভালোবাসায় নয়, স্বপ্নে বাঁচা

সাত বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। পালিয়ে। তখনও তার পড়াশোনা শেষ হয়নি, আর আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। সেসময় আমার আব্বু মৃত্যুশয্যায়। ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ। কারো দোহাই শুনিনি, আব্বুকে মৃত্যুর মুখে রেখে চলে গেছি তার সাথে। অল্প বয়সের নতুন ভালোবাসার কাছে বিশ্বস্ত পুরনো ভালোবাসা হার মানল।

অনেক কষ্ট করেছি তখন। ভেবেছি, একদিন সুখী হবো। আমার কাছে তখন পুরো পৃথিবীর চাইতেও আমার সম্পর্কের দাম বেশি। আমার বরের একটা জব হল, প্রথম শ্রেণীর। ভাবলাম, আল্লাহ্ আমার মুখের দিকে চেয়েছেন, এইবার টাকার সুখ পাবো। আমি এখন ভাবতেও পারি না, তখন কতটা স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম প্রেমের জন্য। একসময় এই টাকাই আমার কাল হল। তার হাতে টাকা আসতে শুরু করল, এর সাথে শুরু হল আমার প্রতি তার চরম অবহেলা।

একটা ফেইক আইডি দিয়ে সে বাজে মেয়েদের সাথে কন্টাক্ট করত। আমার সন্দেহ হত, ওকে কিছু জিজ্ঞেস করলে নানাভাবে এড়িয়ে যেত। ২০১৫ সালে একবার আমার হাতে ধরা পড়ল। মাফ চাইলো, মাফ করে দিলাম।

সে কখনওই আমার কোনও খোঁজ রাখত না। তবে হ্যাঁ, আমি তাকে খারাপ স্বামী বলতে পারবো না, কারণ সে আমাকে শাড়ি, চুড়ি, স্নো, পাউডার এরকম পার্থিব কোনও কিছুরই কোনও অভাবে রাখেনি চাকরি হবার পর থেকে।

আমি বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেলে ও কখনওই আমার কোনও খোঁজ নিত না। প্রেম করে বিয়ে করেছি বলে ও ভাবত, আমার এমনিতেই তো যাওয়ার কোনও জায়গা নেই, অতো খোঁজখবর নেয়ার তো কিছু নেই, আমাকে তো থাকতেই হবে! ওর মনে আমার জন্য কোনও ভালোবাসাই ছিল না।

ভুলটা আমারই, কারণ আমি ওকে অল্পেই বিশ্বাস করেছি। এবং, বারবারই বিশ্বাস করে গেছি!

২০১০ সাল। আমি তখনও ফেসবুকিং জানতাম না। জাস্ট মেসেঞ্জার ইউজ করে চ্যাটিং করতাম। তখন তার চ্যাটনেম ছিল ‘লাশ মামা’। নামটা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হল। বান্ধবীরা সবাই একসাথে চ্যাট রিকোয়েস্ট দিলাম। আমারটা অ্যাক্সেপ্টড হল। ওর সাথে গল্প করতে শুরু করলাম। ও খুবই মজা করে কথা বলতো, আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, আর বেশ ভদ্র আচরণ করত। একদিন কথায়কথায় সে বললো, তার মা জরায়ুর ক্যান্সারে ভুগছে, স্কয়ার হাসপাতালে উনার চিকিৎসা হচ্ছে। উনাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যেতে হবে বাকি চিকিৎসার জন্য। এরপর সে জানাল, তার আব্বু নেই। একটা ছোট বোন ছিল, সেও ক্যান্সারে মারা গেছে। এ পৃথিবীতে তার আর কেউই নেই। খুব মায়া হল তার কথা শুনে। ভাবলাম, আহা, সে কতো অসহায়! তার সব কথাই বিশ্বাস করেছিলাম। সে আমাকে বলল, তার হাতে এখন চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা নেই। আমি যদি ওকে কিছু টাকা ধার দিতে পারি, তবে মা সুস্থ হলে সে আমার টাকা শোধ করে দেবে। তার মায়ের চিকিৎসার জন্য আমার মায়ের আড়াই ভরি গয়না চুরি করে তার হাতে দিলাম। পরে অনেকটা ধরা পড়ে গেলেও কোনওভাবেই স্বীকার করলাম না অলংকার চুরির কথা। এটা নিয়েও অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। বাসায় প্রচুর মারও খেয়েছি, কিন্তু কোনওভাবেই ওর কথা বলিনি।

এর মধ্যে আমার আব্বুর ক্যান্সার ধরা পড়ল। সবাই সল্যুশন দিলো, আগে মেয়ের বিয়ে, এরপর চিকিৎসা। আমি আব্বুর একটাই মেয়ে, আমার এক ছোটভাই আছে। তখন তাকে সব বললাম। সে আমাকে আশ্বস্ত করতো এই বলে যে, তার মায়েরও তো ওই একই রোগ, এবং উনি তো বেঁচে আছেন। এটা কোনও ব্যাপারই না! আরও বলল, তুমি ওয়েট কর, আমাকে একটু সময় দাও, আমি তোমাকে বিয়ে করব, বাসায় বোঝাও।

ডিসেম্বর ২০১০। বাসায় যতই বলি, আমি একজনকে ভালোবাসি, আমি ওকেই বিয়ে করব, কিছুতেই কেউ আমার কোনও কথাই শোনে না। উল্টো এসব কথা শুনে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার জন্য সবাই মিলে আরও উঠেপড়ে লাগল। খুব বেশি ঝামেলা শুরু হলে আমি আর সহ্য করতে না পেরে ১২ তারিখ রাতে একপাতা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেললাম। পাতায় দশটা ছিল না, দুটো কম ছিল। কিছুই হল না আমার। মাঝখান থেকে শুধুশুধু আব্বু-মা পেরেশান হয়ে গেলেন। মা ওই ঘুমের মধ্যেই আমাকে সেদিন বেধড়ক পিটান। আর আব্বু শুধু হাহুতাশ করছিলেন। আমার কেবলই প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল, কিন্তু সবই শুনছিলাম। তখন খুব মায়া হচ্ছিল মা-আব্বু’র জন্য।

মনেমনে ঠিক করলাম, নাহ্! আর না। আমার বর্তমান বরকে একটা টেক্সট্ দিলাম দেখা করার জন্য। ভাবলাম, এই দেখাই শেষদেখা।

আমাকে লেবু, আরও কী কী যেন খাওয়ানো হয়েছিল বমি করানোর জন্য। কিন্তু তেমন কিছুই লাভ হয়নি। বাসায় লেবু, আদা, লবঙ্গ, যা পেয়েছি, তা-ই খেয়ে নিয়েছি, তবু কিছুতেই বমি হল না।

১৩ ডিসেম্বর ভোরবেলা ঝিমাতেঝিমাতে আব্বুর ঘরে গিয়ে দেখি, উনারা ঘুমাচ্ছেন। সারারাতই তো আমার জন্য জেগে ছিলেন। আম্মুকে বললাম, কলেজে যাই। উনি বললেন, খবর্দার! তোমার বাসা থেকে বের হওয়া নিষেধ! তোমার আর কলেজে গিয়ে কাজ নেই! বলেই ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলেন। আমিও এ সুযোগে বেরিয়ে পড়ি।

গিয়ে দেখি, কলেজের সামনে সে দাঁড়িয়ে। আমি ওকে বললাম, আমার দ্বারা আর সম্ভব না! বাসায় একেবারেই রাজি হচ্ছে না। ঘুমের ওষুধ খেলাম, তাও তোমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হল না। সে বললো, আমি আমার মাকে, বোনকে আর বোনের জামাইকে রাজি করিয়ে ফেলেছি। তারা রেডি আছে। এখনই তোমাকে নিয়ে গাজিপুর চলে যাবো, এরপর ওখানে বিয়ে করে ফেলবো। তখন সবাই মেনে নিবে। আমার মাথায় কিছুই কাজ করছিল না তখন। ও আমাকে যা-ই করতে বলল, আমি তা-ই করলাম।

ও আমাকে প্রথমেই নিয়ে গেল তার মায়ের কাছে। তার মা ঢাকা মেডিক্যালে চাকরি করেন। তখন আমার হবু শাশুড়ি বললেন, আজ থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমার। তুমি আমার মেয়ে। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। তখন সব কথাই মধুর মতো লাগছিল। কাজি অফিসে চলে গেলাম তার সাথে। বিয়ে হল। সেদিন পর্যন্ত আমি আমার বরের সম্পর্কে যা জানতাম, তার বেশিরভাগই ছিল মিথ্যে কথা। যা আমি বিয়ের পর ধীরেধীরে বুঝতে পারি। বিভিন্নভাবে একের পর এক সব সত্য আমার সামনে চলে আসতে থাকে।

সেদিন সন্ধ্যায় আমার আব্বুর কাছে আমার শাশুড়ি ফোন করলেন। উনার মুখে ছিল যেন যুদ্ধজয়ের হাসি, আর আমার অসুস্থ অসহায় আব্বু কোনও কিছুই না বলে কেবল থ’ হয়ে শুনছিলেন। আমার জন্য আমার আব্বুকে আমার শাশুড়ির অনেক বক্রোক্তি সহ্য করতে হল। বিয়ের পর ওরা আমাকে ওর বোনের বাড়িতে নিয়ে তুলে, একই এলাকাতে। সে বাড়িতে সেদিন রাতে আমার আব্বু আমার খালুকে পাঠান আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। ওরা তাকে অনেক অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। আমার বর উনার ঘাড়ে হাত দিয়ে পর্যন্ত ধাক্কা মেরেছিল! ওর বোনের জামাই বলেছিল, আর কখনও আসলে একদম পুলিশে ধরিয়ে দেবো। আমি কেন জানি কিছুই বলতে পারিনি, একটুও প্রতিবাদ করতে পারিনি।

আমার আব্বুর তখন কেমোথেরাপি চলছে। সে ঘটনার পর তীব্র মানসিক কষ্টে আব্বু হঠাৎ বেঁকে বসলেন; বললেন, কেমো আর নেবেন না। উনি বারবারই বলছিলেন, কী হবে এই মুখ নিয়ে বেচেঁ থেকে! নানি, মামা অসংখ্যবার আমার ফোনে কল করে বললেন ফিরে যেতে, আমি ফিরে গেলে আব্বু সব মেনে নিয়ে সামাজিকভাবে অনুষ্ঠান করে আমাদের দুইজনকে বরণ করে নেবেন। আমি বিরক্ত হয়ে মোবাইল অফ করে দিয়েছিলাম। পরে আমার বরকে অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে, শাশুড়ির পা ধরে কান্নাকাটি করে, এক সপ্তাহ পর বরকে নিয়ে ফিরে গেলাম আব্বুর বাসায়। আম্মু-আব্বুর কাছে দুজন মাফ চাইলাম।

তখন আমার বর আব্বুকে বলল, আমার মা অনেক অসুস্থ, উনার জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়েছে, ইন্ডিয়া গিয়ে অপারেশন করিয়ে জরায়ু ফেলে দিয়ে এসেছি। এটা শুনে আব্বু খুব মনখারাপ করলেন এবং আমার শ্বশুর ফ্যামিলির জন্য উনার মধ্যে একটু সহানুভূতির জন্ম নিল।

তখন ক’দিন আব্বুর বাড়ি থেকে এরপর ফিরে গেলাম শ্বশুরবাড়ি। এইবার ওরা আমাকে ওদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেলো। আধাপাকা বাড়ি, দুইটা ছোটঘর, একটা বারান্দা। মাটির চুলায় রান্না হয়। আর রাতবিরাতে রান্নার প্রয়োজনে স্টোভ। আমার বর আমাকে বলেছিল, তার মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে স্কয়ার হসপিটালে, সেখানে অনেক টাকার দরকার, ওকে প্রায়ই ঢাকায় দৌড়াতে হয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসবের পুরোটাই ছিল বানানো মিথ্যে কথা।

সাংঘাতিক ব্যাপার হল, তার মায়ের ক্যান্সার—এটাই ছিল আমাকে আর আমার আব্বুকে বলা সবচাইতে বড় মিথ্যে! আমার শাশুড়ির ক্যান্সার হয়নি, শুধু আমার সিমপ্যাথি আর আমার কাছ থেকে কিছু টাকা পাবার জন্য সে এটা বলেছিল! অবিশ্বাস্য! একটা মানুষ কতোটা পাষাণ আর বর্বর হলে এমন মিথ্যে বলতে পারে!

এক-এক দিন এক-একটা করে সত্য আমার সামনে আসতে থাকলো। তার মাও এইসব ব্যাপারে জানতো না, আর পরে যখন আমি উনাকে সব বলেছি, উনি বিশ্বাস করেননি। অবশ্য উনি যেমন মানুষ, বিশ্বাস করার কথাও না।

তবে হ্যাঁ, একসময় বর আমাকে খুব ভালোবাসতে শুরু করল। সে তো স্টুডেন্ট ছিল, অর্থ উপার্জন করতেন একমাত্র আমার শাশুড়ি, তাই সংসারে অনেক অভাব-অনটন ছিল, তবে সেসময় ভালোবাসার কোনও অভাব ছিল না।

আমার চুল আঁচড়ানোর একটা চিরুনিও ছিল না, প্রচণ্ড শীতের সময়ও হাতেপায়ে মাখার মত কিছু ছিল না। আমি বাপের বাড়িতে এসে সব নিয়ে গেলাম—ছোটখাটো সবকিছুই, যা যা আমার ব্যবহার্য। আমার আব্বু আমাকে অনেক শপিং করে দিলেন।

আমার শ্বশুরবাড়িতে বলতে গেলে কিছুই ছিল না, তবু আমি সুখী ছিলাম। মুটিয়ে যাওয়ার ভয়ে রাতে ভাত খেতাম না, বর আদর করে ভাত খাইয়ে দিতো। ও তো বেকার ছিল, কলেজেও অতো ক্লাস করতে হত না, সারাদিন বাসায়ই থাকতো। বেকারদের হাতে ভালোবাসার জন্য অফুরন্ত সময় থাকে। অল্প বয়সে পাওয়া বেকার যুবকের ভালোবাসা সবসময়ই স্বর্গীয়! অনেক ভালোবাসাবাসিতে ভরপুর ছিল আমাদের দিনগুলি।

একদিন আব্বুর বাড়ি যাবো, তার আগের দিন রাতে আমার বর আমাকে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলেছিল, “কেন যাওয়া লাগে বাপের বাড়ি, হুঁউউউ? না গেলে হয় না, সোনা? তোমার ওখানে যাওয়ার কথা শুনলে আমার কলিজায় চাপ লাগে, মনে হয়, যদি আর ফিরে না আসো!” ওর কথা শুনে আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম, মনেমনে ভাবলাম, আমিই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মেয়ে! এ জীবনে আর কিছু না পেলেও আমার কোনও দুঃখ থাকবে না।

সে প্রচুর মিথ্যে বলতো। মাঝেমধ্যে আমাদের ঝগড়া হতো তার বলা বিভিন্ন মিথ্যেগুলি নিয়ে। কিন্তু আমি নিজেই আবার সেধেসেধে ওর রাগ ভাঙাতাম, সব মানিয়ে নিতাম। রাগারাগি হলে সে কখনওই আমাকে মানানোর চেষ্টা করতো না; এমনও হয়েছে, আমরা একই ছাদের নিচে, অথচ একটানা তিন-চারদিন আমাদের মধ্যে কোনও কথাই হয়নি, শোওয়ার সময় সে অন্যপাশ ফিরে ঘুমাতো। ওর সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারতাম না, না পেরে আমিই সব ঠিক করে ফেলতাম। তার মিথ্যেগুলি সম্পর্কে আমি কখনওই কাউকে কিছু বলিনি; এই অপরাধবোধ কাজ করতো যে, নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছি, এখন তো আর কেউ আমার কথা কানেই তুলবে না, উল্টো আমাকেই দোষী বানাবে আর বড়বড় কথা শোনাবে। কী দরকার?

ওদিকে আমার মনে তখন নানারকম ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আব্বু খুব অসুস্থ। আব্বু আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমার এই বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট আব্বুই পেয়েছেন, যা এখনো আমাকে কুড়েকুড়ে খায়!

কিছুদিন পর। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, আমার বরের ছোটবেলা থেকে একটা প্রেম চলছিল, এমনকি ওদের বিয়ের কথাও ঠিক ছিল। মেয়ের বাড়ি আমাদের পাশের বাড়িটাই। মেয়েদের বাড়ির ওপর দিয়েই আমাদের আসাযাওয়া করতে হতো, কারণ আর কোনও রাস্তা ছিল না।

ওদের মধ্যে নাকি কঠিন প্রেম ছিল! পাশাপাশি বাড়ির সেই মেয়ে আমার বরের সব কাজ করে দিতো—কাপড় ধোয়া, রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, এটাসেটা। ওদের এ প্রেমের কথা আমি কোনওদিনই বুঝতে পারিনি। খুব কষ্ট পেলাম। যতোবারই ওই মেয়েকে দেখতাম, ততোবারই তাদের প্রেমের কথা মনে হতো। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগলো যখন জানলাম, ও নাকি ওই মেয়ের সাথে রাগ করে আমাকে বিয়ে করেছে। শুধু তাকে দেখানোর জন্য আমাকে ঘরে নিয়ে এসেছে। কী একটা ব্যাপার নিয়ে ওদের ঝগড়া হয়েছিল, আর তখন ওর সাথে বাজি ধরে আমাকে বিয়ে করে বাজি জিতেছে। এসব শুনে নিজেকে এতো ছোট মনে হল! মনে হচ্ছিল, আমি তার ময়লা রাখার ডাস্টবিন! সংসারজীবনে তখন বরের ভালোবাসাই ছিল আমার বেঁচেথাকার একমাত্র অবলম্বন। আমি তাকে ভীষণ রকমের ভালোবাসতাম। তার সব অন্যায়ই কেমন যেনো হজম হয়ে যেত আমার!

ওর আসল রূপটা আস্তেআস্তে বের হতে লাগল। ও আমাকে বলতে শুরু করল, “তুই তো ফকিরের মেয়ে! নাহলে আমার ঘরে খালিহাতে চলে এসেছিস কেন? কী পেয়েছি আমি তোকে বিয়ে করে? সাথীকে বিয়ে করলে আর কিছু না হোক, অন্তত কিছু জমি হলেও তো পেতাম!” শাশুড়ি আমাকে সরাসরি কিছু বলতেন না, তবে আশেপাশের লোকজনের সাথে এ নিয়ে আমাকে শুনিয়েশুনিয়ে আলাপ করতেন। আমি কোনও কথা কানে তুলতাম না, শুধু দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম। আব্বুর কাছ থেকে আমি কিছুই নিইনি, কারণ আমি বিশ্বাস করতাম, আমার আব্বু আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন, সেটাই আমার চলার জন্য যথেষ্ট। সম্পদ, খাটপালঙ্ক, সোনাদানা, এসব দিয়ে আমি কী করবো? তখন বুঝলাম, ছেলেরা মেয়েদের মত করে ভাবে না। ওদের দরকার সুন্দরী, যোগ্য, ধনী, কর্মঠ, রাঁধুনি স্ত্রী।

এই ফাঁকে ছোটছোট কিছু কথা বলে রাখি। আমার বিয়ের পর ৬-৭ মাস আমাকে মাটিতে বিছানা করে ঘুমাতে হয়েছে। ঘরের জানালায় গ্লাস ছিল না, বৃষ্টির পানি, ড্রেনের দুর্গন্ধ আসতো। বিয়ের পর খাওয়ার কষ্টও করেছি অনেক। বর কিছুই করতো না, এমনকি টিউশনিও করতো না। ওর কাজ ছিল কেবল খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো আর ঘুমানো। ক্লাসেও যেত না তেমন একটা। ঘুম থেকে উঠত দুপুর দেড়টার দিকে। এরপর চা খেয়ে দুপুরের খাবার খেত। আবার কিছুক্ষণ বিছানায় গা গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে ওর কিছু বেকার বন্ধুর সাথে ঘুরতে বের হয়ে যেত। ফিরত রাত করে। প্রায় দিনই এটাই ছিল ওর রুটিন। ওদিকে কাজের মেয়ের মতো দিন কাটতো আমার, কিন্তু ভাবতাম, এটাই বুঝি আমার প্রাপ্য!

বিয়ের এগারো মাসের মাথায় আব্বু মারা গেলেন। তখন আমার অনার্স ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলছে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! পুরো পৃথিবীটাই হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেলো। আমাকে ভালোবাসার আর কেউ অবশিষ্ট রইলো না। এদিকে হঠাৎ করেই আমার শাশুড়ি অসুস্থ হলেন, চোখে ছানি ধরা পড়ল, অপারেশন হল, একটা চোখ ভালো হল, আরেকটা নষ্ট করে ফেলতে হল। তখন উনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। নড়াচড়া করতে পারতেন না, বিছানাতেই সব করতেন, আর আমি সব পরিষ্কার করতাম। আমার বর আমাকে বলেছিল, তার কাছে তার মা-ই সব, তাই আমি আমার শাশুড়িকে মাথায় তুলে রাখতাম; এখনও রাখি। কিন্তু তিনি আমাকে তাঁর আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতেন, ওই বাড়িতে আমার অবস্থান কেবলই কাজের মেয়ের মতন। আমার প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে আমি সারাদিন না খেয়ে ছিলাম। আমার বর আমাকে উইশও করেনি, সারাদিন সে বাসায়ও ছিল না। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ও নাকি সেদিন ওর বন্ধুদের নিয়ে কোথায় যেন একসাথে বসে বাংলা মদ খেয়েছে। ওদিকে কী হল, আমি নিজেই ঠিকমতো খেতে পেতাম না, আর আমার শাশুড়ি বললেন বাচ্চা নিতে! কথাটা আমি কানে তুললাম না। খুব কষ্ট করে শাশুড়ির মুখের কথার সকল নির্যাতন সহ্য করে পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম।

আমার বরকে তার মা প্রতিদিন ৫০ টাকা হাতখরচ দিতেন। ওই টাকা জমিয়েই চলত আমার পড়াশোনা। আমার বরের কাছে আমি আমরণ ঋণী থাকবো শুধু এই কারণে। সে আমাকে যতো কষ্টই দিক, যতো অবহেলাই করুক, যত অবিচারই করুক, কখনওই আমার পড়াশোনা বন্ধ করেনি। এরপর আমার পীড়াপীড়িতে সে কিছু টিউশনি যোগাড় করে, ওতে খুব সামান্য টাকা আসত, তবে তা দিয়েই আমাদের দুইজনের মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। আমি তখন টিউশনি করতে চেয়েছি, গার্মেন্টসে জব করতে চেয়েছি, ও করতে দেয়নি।

খুবই কষ্টের পড়াশোনা আমার। ভোর ৬টায় রওনা হতাম গাজিপুর থেকে। ইডেনে এসে ক্লাস করে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে ২.৩০টা-৩টা বেজে যেতো। এরপর রান্না করতাম, তারপর খেতে পেতাম। সংসারের সমস্ত কাজ শেষ করে গোসল করতে-করতে সন্ধে হতো। শাশুড়ি চাকরি করতেন, আমি উনার কামাই খেতাম, তাই কখনওই তাকে কোনও কাজ করতে দিইনি। পড়াশোনা যা হত, তার সবই রাতের বেলায়, কিছু সময়ের জন্য।

ফার্স্ট ইয়ারে একটা বিষয়ে ফেল করলাম। পরে সেটা সহই পয়েন্ট আসল ৩.০২। সেকেন্ড ইয়ারে পেলাম ২.৯৮। ২০১৪ সালে আমার বরের একটা সরকারি চাকরি হল। কলকারখানা অধিদপ্তরে, শ্রম পরিদর্শকের। আমার তখন মনে হয়েছে, যাক্‌! এইবার আল্লাহ্‌ আমার মুখের দিকে চেয়েছেন! প্রথমপ্রথম দিনগুলি বেশ ভালোই কাটছিল। বাসায় টাকা আসতে শুরু করল, কিন্তু একই সাথে ভালোবাসার উষ্ণতাটা কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকলো। আমার সাথে তার আর তেমন কোনও কথা হয় না। ও স্মার্টফোন কিনলো, বাসায় কম্পিউটার আসলো। আমি আব্বুর বাড়ি আসলে সে কোনও খোঁজই করতো না আর। আমি কল দিলে কথা হতো, না দিলে কোনও কল দিত না। কেমন যেন রোবটিক হয়ে গেল সবকিছু! বিত্ত বাড়ল, চিত্ত কমল।

আমার কোনও ফাগুন নেই, কোনও ভালোবাসা দিবস নেই, কোনও পহেলা বৈশাখও নেই। আমার কোনও জন্মদিনই তো ছিল না, বাকিগুলি তো অনেক পরের কথা! বেশি খিটমিট করলে এলাকার ফুচকার দোকানে নিয়ে যেত। ফুচকা খাও, কোল্ডড্রিংস গেলো, রিক্সায় মুক্ত হাওয়ায় ঘোরো, ব্যস্‌! এরপর বাড়ি ফিরে সে তার ফোন নিয়ে ব্যস্ত, আর আমি সংসার নিয়ে। বাচ্চা নেয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করলাম। কিছুতেই হচ্ছিল না, ডাক্তার দেখানোর পর উনি বললেন, হরমোনাল ইমব্যালেন্স, তবে এটা তেমন কোনও সমস্যা না। উনি আমাদের চেষ্টা করে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।

প্রথম ২০১৫ সালে আমার বরের ফোনে ধরা পড়লো একটা ফেইক আইডি দিয়ে আজেবাজে মেয়েদের ভাড়া করার কাহিনি।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন! পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল! খুব নিঃস্ব, অসহায়বোধ করছিলাম! ভীষণ কান্নাকাটি করলাম। বললাম, ছেড়ে দাও আমাকে, আমি এমন চরিত্রহীন লোকের সাথে থাকব না। প্রয়োজনে মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাব, তবুও তোমার মতন লোকের সাথে থাকতে পারব না।

ও অনেক কান্নাকাটি করল, মাফ চাইলো খুব করে। হায়, মেয়েমানুষের বেহায়া হৃদয়! মাফ করেও দিলাম! এরপর কিছুদিন আমার খুব যত্নআত্তি করত। যে-ই আমি ভাবতে শুরু করেছি, হয়তো ওর মধ্যে আমার জন্য ভালোবাসা জন্মাচ্ছে, ঠিক তখনই আবারও ও আগের মত হয়ে গেল।

দিন কাটছে, আর তার অবহেলা বাড়ছে। আমি যা-ই বলি না কেন, সবকিছুতেই—না। বিয়ের পর এখন পর্যন্ত আমরা কোথাও বেড়াতে যাইনি, এক আমার আব্বুর বাড়িতে ছাড়া, তাও সে কখনওই হাতে করে কিছুই নিয়ে যায় না, একেবারেই খালিহাতে যায়। বায়না ধরলাম, কক্সবাজার নিয়ে যাও। কাজ হয়নি। ওর কোনও সময়ই নেই, খুবই ব্যস্ত সে!

২০১৬ সালের মার্চ মাসে আমি আব্বুর বাড়ি ক’দিন থেকে মাত্রই ফিরেছি; সেদিন রাতে তার ফোনে দেখি, তার আরেকটা ফেইক আইডিতে এক মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ চ্যাটিং চলছে সেই ২০১৪ থেকে। দেখে মাথা পুরাই খারাপ হয়ে গেল আমার! একেবারেই ভেঙে পড়লাম। তাকে এ নিয়ে জেরা করতে থাকলে সে বললো, সরি, ভুল হয়ে গেছে, আর কক্ষনো হবে না। গড প্রমিজ!

সেই মেয়ের কাছে সে বলেছে, আমার নাকি মানসিক সমস্যা আছে। আমি শারীরিকভাবে অক্ষম। আমার মেজাজ গরম, রুক্ষ। আমাদের সম্পর্কটা নাকি ডিভোর্সের পর্যায়ে চলে গেছে! এরকম আরও অসংখ্য মিথ্যে।

স্রেফ টিকিয়ে রাখার দায়ে আমরা সম্পর্কটা চালিয়ে নিতে লাগলাম। সামাজিক দায়বদ্ধতা না থাকলে হয়তো অনেক আগেই আমরা আলাদা হয়ে যেতাম। ডিভোর্সের সোশাল কস্টটা সত্যিই অনেক হাই, নইলে এ সমাজে অহরহই ডিভোর্সের বন্যা বয়ে যেত। কত দম্পতিই তো স্রেফ একসাথে থাকতে হয় বলেই একসাথে থাকে! আমি ওকে টেক্সট দিলে কখনওই রিপ্লাই পাই না। শেষ কবে ও আমায় ‘ভালোবাসি’ বলেছে, আমার মনে নেই। হোক মিথ্যে, তবু ওর মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শুনতে বড় ভালো লাগে। ওর কাছ থেকে আর কিছু না, মিথ্যে করে হলেও একটা ‘ভালোবাসি’ আমার দিনটাকেই অন্যরকমের সুন্দর করে দেয়! শেষ কবে ও নিজের ইচ্ছেয় আমাকে চুমু খেয়েছে, আমার তাও মনে নেই। দূরত্ব কেবল বাড়তেই থাকে।

আমি সেইবার তার মাকে জানাই সব কিছু। তখন সে তার মায়ের কাছে ক্ষমা চায়। তার মা আমাকে অনেক করে বোঝায়। সংসার করতে হলে মেয়েদের অনেক ধৈর্য রাখতে হয়, অনেক কিছু মেনে নিতে হয়, এতো মাথা গরম করলে হয় না, অনেক সহ্য করা শিখতে হয়, মেয়েদের হতে হয় মাটির মত, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমিও মেনে নিই, চুপ করে থাকি।

ক্রমেই স্বামী-স্ত্রীর দৈনন্দিন সম্পর্কটা নিতান্ত বাধ্যতায় পরিণত হয়। তার নিবিড়তম স্পর্শেও ভালোবাসার কোনও ঘ্রাণ নেই। আমি তার একটু ভালোবাসার জন্য আর্তনাদ করতে থাকি! তার আদর, চাহনি, স্পর্শ, কোনওকিছুতেই কোনও ভালোবাসা ছিল না। ভালোবাসার কথা বললে তখন সে শুধু বলতো, কী লাগবে, বলো? এনে দেবো।………হ্যাঁ, সব এনে দিতোও, কিন্তু সে আমার মনের চাহিদাটাই কখনও বুঝতে পারতো না। আমাদের মধ্যকার প্রেম ব্যাপারটাও পুরোপুরি উধাও হয়ে গিয়েছিল!

২০১৬-এর সেপ্টেম্বরে জানতে পারি, জীবনে প্রথমবার আমি মা হতে যাচ্ছি। খুশিতে কেঁদে ফেললাম। আমার বরও সত্যি খুব খুশি হয়েছিল। আনন্দে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। ভাবলাম, সব বদলে গেছে!

হায়, নারী ভাবে এক, পুরুষ করে আরেক! এ বছর ফেব্রূয়ারিতে আবারও ধরা পড়ে ওই একই মেয়ের সাথে গভীর প্রেমালাপ—মেসেঞ্জারে, ভাইবারে, ইমোতে, হোয়াটসঅ্যাপে। তাদের নিয়মিত দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। ওরা অনেক জায়গায় বেড়াতেও যাচ্ছে! তখন আমার সাতমাস চলছে। কী পরিমাণ মানসিক অশান্তিতে ভুগেছি, কাউকে বলতে পারিনি। শুনেছি, মা হবার সময়টাতে মানুষ সেই মাকে বেশিবেশি ভালোবাসে, সময় দেয়। আমার জীবনে এর উল্টো হল। তখন সে আমার পেটের বাবুকে ছুঁয়ে কথা দিলো, সে আর কখনওই ওই মেয়ের সাথে কোনও যোগাযোগ রাখবে না। আমি মেনেও নিলাম। ভাবলাম, নিজের সন্তানকে ছুঁয়ে তো কেউ মিথ্যে বলতে পারে না! আমার মধ্যে এ ধারণাটা বদ্ধমূল ছিল। একইসাথে তখন তাকে বললাম যাতে সে জীবনেও আর কখনও আমাকে স্পর্শ না করে! আমি তাকে ঘৃণা করি, শুধু আমাদের বাবুটার জন্যই আমি তার সাথে থাকবো।………শুনে সে বললো, আচ্ছা।

এর ক’দিন পর তার জন্মদিন। আমি ওই শরীর নিয়েই তার জন্য কেক কিনে আনলাম, তার পছন্দের সব খাবার রান্না করলাম। ভাবলাম, আমি বেশি ভালোবাসলে সে হয়তো ভালো হয়ে যাবে।

সে মাসে আব্বুর বাড়ি চলে আসি ডেলিভারির জন্য। কিছুদিন পর একদিন সে আসে আমাকে দেখার জন্য। সেদিন তার ফোনে আবারও দেখলাম সেই মেয়ের সাথেই আলাপ। এবারের আলাপে ধরা পড়ল, তারা ২০১৬’তে কক্সবাজার গেছে, সেখান থেকে সেন্টমার্টিন, দুজন মিলে অনেক মজা করেছে। কদিন পরপরই তারা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে যায়। উত্তরাতে একটা জায়গা ঠিক করা আছে, ওখানে তারা একসাথে একান্ত সময় কাটায়। তারা বিয়ে করবে, এটাও ঠিক করেছে।

এবং………শুধু এই মেয়েই না, সে নিয়মিত অন্য মেয়েও ভাড়া করে। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন।

নিজের ওপরই ঘেন্না ধরে গেছে আমার। অনেকবার ভেবেছি, মরে যাই! বেচেঁ থেকে আর লাভ নেই। কীসের জন্য বাঁচব? আর যার আব্বু এইরকম, সে-ই বা এ পৃথিবীতে এসে কী দেখবে? এসবের কী অর্থ?

কিন্তু সেই বাবুটাই আমাকে মরতে দিলো না। আমি তার জন্যই বেঁচে আছি। আহা, মানুষের বাঁচার জন্য অজুহাতের কোনও অভাব হয় না!

সেই মেয়ের জন্য তার যে পরিমাণ অস্থিরতা আর পাগলামি, তার ছিটেফোঁটাও আমার জন্য নেই।

সে যথারীতি এবারও বলে, ভুল হয়েছে, আর হবে না। তবু সে একবারও বলে না, সে আমায় ভালোবাসে! আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে কি না, তাও বলে না। আমার প্রায়ই মনে হয়, আহা, একটিবারও যদি হাতটা ধরে সে বলতো………ভালোবাসি! তার চোখে আমার জন্য একটুও ভালোবাসা দেখলে আমি তার সব অপরাধ হাসিমুখে ক্ষমা করে দিতে পারব!

আমি এসব কথা আমার মা, ভাই কাউকেই কিছু বলতে পারি না। এখন শুধু ভাবছি, বাবু হবার পর পুরোদমে পড়াশোনা করবো। মাস্টার্সে ভালো করতে হবে। অনার্সে ৩.১২ পেয়েছিলাম। ফার্স্ট ক্লাসটা যেকোনও মূল্যে ধরে রাখতে হবে।

সারাদিনে তার একটা কলও পাই না। তার ভিতর বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধও নেই মনে হয়।

যার সাথে তার এতকিছু হল, কিংবা হয়ও, সেই মেয়েও বিবাহিতা। ওর কথা ভাবি, আর মনে আসে, একটা মেয়ে কতটা খারাপ হতে পারে! কীভাবে পারে!

সেদিন দুপুরে অনেকক্ষণ বসে কেদেঁছি। টানা ১২ ঘণ্টা কিছুই খাইনি। যখন দেখি, বাবু নড়াচড়া করছে না, তখন বাধ্য হয়ে খাই। সাঙ্ক কস্ট নিয়ে ফেসবুকে একটা অনুপ্রেরণামূলক লেখা পড়ে মনেমনে ঠিক করি, যা গেছে, তা তো আর ফিরে পাবো না। যা আছে, তাকে নিয়েই ভালোভাবে বাঁচব। কোনও কুলাঙ্গারের জন্য নিজের জীবন শেষ করবো না।

কী যে ভীষণ কষ্ট হয়, বলে বোঝাতে পারবো না। এক সময়ের ভালোবাসা এভাবে বদলে যাবে, কখনও কল্পনাতেও আসেনি!

মেয়েদের ঈশ্বর কী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, জানি না। আমরা সবই পারি! কেউ দীর্ঘ সময় ধরে অন্য কাউকে স্পর্শ করে আসছে জেনেও আমরা তার সেবা করি, তার জন্য চিন্তা করি, তাকেই ভালোবাসি, আর………একদিন সে ভালো হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে—এ প্রতীক্ষায় বেঁচে থাকি! ব্যাপারটা ধৈর্য নাকি বাধ্যতা, এটা কেবল ঈশ্বরই জানেন! আমি খুব ভালো করে জেনে গেছি যে আমি তাকে ছেড়ে দিলেই বরং সে খুবই ভালো থাকবে। এটা মনে এলেই আবার ভাবি, সে নাহয় ভালো থাকবে, কিন্তু আমি তো থাকবো না। সে আমার খুব কষ্টে-পাওয়া স্বপ্নের মানুষ। আমি তাকে খুবই ভালোবাসি। ওর জন্য আমি সবকিছুর পরও জীবন দিয়ে দিতে পারি। আমি রোজই তার প্রেমে পড়ি, আর প্রতি মুহূর্তে আশায় থাকি, বেশি না, অন্তত একবারের জন্য হলেও সে আমার প্রেমে পড়ুক! আহা, কেবল একতরফা ভাবনা যদি পৃথিবীর সবকিছু বদলে দিতে পারতো!

আমি ভালোথাকার অভিনয় ভালো পারি। আগে পারতাম না, এখন শিখে গেছি। এতকিছুর পরও কাউকেই বুঝতে দিই না কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার ভেতরে! মা-কে কোনও কিছু বলার তো প্রশ্নই আসে না! মাকে এখনও পর্যন্ত যা কষ্ট দিয়েছি, তার বেশি নিতেই পারবে না! তখন যদি আব্বুর মত………আমি আর কিছু ভাবতে পারি না!

তবু স্বপ্ন দেখি। সে বলেছে, ভালো হয়ে যাবে, নামাজ পড়া শিখবে, কুরআন পড়া শিখবে, ওই মেয়ের সাথে আর ঘুরবে না। আমার আর এসব বিশ্বাস হয় না। তবে বিশ্বাস যে হয় না, ওকে তা বুঝতে দিই না। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি একাএকাই ভালোথাকার। তার কাছ থেকে ভালোবাসা দূরে থাক, আর কিছুই আশা না করার!

ভালোবাসাহীনতায় বেঁচেথাকা যে কী কষ্টের! আমি স্বপ্ন দেখছি, আমার সন্তান আমাকে ভালোবাসবে হয়তো! আমি ওকে পাগলের মত ভালোবাসব, ওকে আমি আমার মত করে মানুষ করব! মানুষ তো কেবলই নিজের জন্য বাঁচে না, সে বাঁচে তার ভালোবাসার কিছু মানুষের জন্য; প্রায়ই, কেবল একজন মানুষের জন্য………আর কখনওবা, তার সবচাইতে ভালোবাসার মানুষটির ভালোবাসা মেখে বাঁচার স্বপ্নেই সে বাঁচে!