মাই নাইট অ্যাট মডস (১৯৬৯)

“ইডিয়ট!”

মড যখন জঁ-লুইয়ের দিকে তাকিয়ে অসীম বিস্ময় নিয়ে কথাটা ছুঁড়ে দেয়, সে মুহূর্তে তার ভেতরে আগুন জ্বলছিল কি না, আমি সে রায় দিলে তা হবে নিছকই অনুমান-নির্ভর, তবে শেষ কবে কোন মুভির ডায়লগ অনুভব করে এতটা ধাক্কা খেয়েছিলাম, মনে নেই। রীতিমতো কেঁপে উঠেছিলাম যেন! মডের উপর উথালপাথাল রকমের ক্রাশ খেয়ে মাথাটা এখনো ঘুরছে। ঘুরছে এবং সুখ পাচ্ছি। আমার চোখে, ব্রেইন ইজ সেক্সিয়ার দ্যান বডি। আর যখন কারো ব্রেইন আর বডি, দুটোই নেশা ধরিয়ে ছাড়ে, এমন দুর্লভ মেলবন্ধনে সত্যিই অপূর্ব এক অনুভূতির জন্ম হয়!

………..ও হ্যাঁ, আরেকটা ডায়লগ হৃদয়ে ধাক্কা মেরেছিল বহু আগে: “ও কিন্তু আমাকে টাচ করবে না!” ‘সপ্তপদী’তে উত্তমকুমারের ব্যাপারে সুচিত্রা সেনের এমন স্নবারি, তবে সে ধাক্কা আজকের এই ইডিয়ট-ধাক্কার কাছে শিশুতোষ।

জঁ-লুইয়ের সাথে মডের পরিচয় হয় দুইজনের এক কমন ফ্রেন্ড ভিডালের মাধ্যমে। জঁ-লুই মডের অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটায়। সে রাতে দুইজনের মধ্যে যে কথোপকথন, তা এ সিনেমার সুন্দরতম অংশ। প্রিয় পাঠক, ওদের মধ্যে ‘কিছু’ হয়নি। উত্তম-সুচিত্রার ফ্লপ সিনেমা ‘একটি রাত’ যেমনি দর্শকদের ‘মনের ইচ্ছে’টা পূরণ করেনি, ‘মাই নাইট অ্যাট মডস’-এর সে রাতটি দেখে সংবেদনশীল দর্শকমাত্রই অসীম আফসোসে ডুবে যাবেন, এতটাই যে, হয়তো মড কিংবা জঁ-লুইয়ের আফসোস তার তুলনায় নস্যি! সে আফসোসে কনজারভেটিভ ধ্যানধারণার জঁ-লুইয়ের উপর আপনার চরম মেজাজখারাপ হবে।

তীব্র সংস্কার কীভাবে মানুষের প্রাণের দাবিকে গলাটিপে অবরুদ্ধ করে রাখে, জঁ-লুই তার নিখুঁত উদাহরণ। সে বিশ্বাস করে, জগতের প্রতিটি ঘটনা ও অনুভূতি যুক্তির অনুবর্তী হতে বাধ্য। তবে তার বাহ্যিক আবরণ (পারসোনা) কতটা হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার অনুগামী, সিনেমা শেষ হবার পরও তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আছে এমন কিছু মানুষ, ভীষণ লাজুক—যা করতে চায়, করে না; সংস্কার আর কামনারঅন্তর্ঘাতে সারাক্ষণই পুড়তে থাকে। সে দলের প্রতি মডের তীব্র শ্লেষ: আমি এমন মানুষকেই পছন্দ করি, যারা জানে তারা কী চায়। হ্যাঁ, এ গল্পের জঁ-লুই জানে না, সে আসলে কী চায়। তার ক্যাথলিক সংস্কার তাকে মডের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয় আরেক ক্যাথলিক ফ্র্যান্সোয়াজের কাছে, যাকে সে ভালোবাসেনি, কিন্তু বিয়ে করেছিল। সে বিয়ে সংশয়ী ভালোবাসার বিয়ে, যা ছিল হৃদয়ের টানে নয়, সংস্কারের টানে। মডের ব্যক্তিত্ব আর মেধার কাছে ব্যক্তি ফ্র্যান্সোয়াজ একেবারেই ফ্যাকাসে, বিবর্ণ।

মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের এমন আইরনি এবং জটিলতা এরিক রোমারের ফিল্মোগ্রাফির একটা বৈশিষ্ট্য। ‘মাই নাইট অ্যাট মডস’ মুভিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সুযোগ ও নিয়তি, অতীত ও বর্তমান, দ্বিধা ও আফসোস—এমন কিছু চিরন্তন উপাদানের নিখুঁত মিশেল এ মুভিটিকে ওয়ার্ল্ড মাস্টারপিসের তালিকায় চিরস্থায়ী স্থান করে দিয়েছে। দর্শনের আলাপ ও মনস্তত্ত্বের অভিঘাত, এই দুইয়ের প্রয়োগ-সঙ্গতি পুরো সিনেমাজুড়ে এমন একটা আবহ তৈরি করে রাখে, যা দর্শকের চোখকে পর্দায় আটকে থাকতে বাধ্য করে!