মানুষ কীসে বাঁচে

 
কখনও-কখনও একেকটা দিন একেকভাবে শুরু হয়। সবদিনই অন্য সবদিনের মতো হয় না। প্রতিটি ক্যারিয়ার আড্ডার পর আমি বিচিত্র ধরনের ফিডব্যাক পাই। আজকের দিনটা শুরু হয়েছে ফিডব্যাক দিয়ে। একের পর এক ফিডব্যাক এসেছে তো এসেছেই! আজকের দিনটা ছিল ফিডব্যাকের দিন। সবগুলো শেয়ার করার মতো না। তাই, বেছে-বেছে কিছু শেয়ার করছি। সাথে আমার নিজের কিছু অনুভূতিও খুব অল্প কথায় বলছি।
# আমি আমার লাইফের পুরনো কিছু কষ্টের কথা শেয়ার করার সময় অনেককেই দেখেছি, রুমাল বের করে চোখ মুছছেন। ওদের আবেগ অনুভূতি খুব গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। শুধু এই লোভেই স্বপ্নের ফেরি করে বেড়ানো যায়।
# একজন রোটারিয়ান আমাকে বললেন, "বিশ্বাস করুন ভাই, (কোয়ান্টামের) গুরুজির পর আমি এই জীবনে এই প্রথম একজনকে দেখলাম প্রায় ৮ ঘণ্টা কথা বলে সবাইকে এরকম মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। আমি আমার বড় ছেলেকে কেন সাথে করে আনলাম না! খুব আফসোস হচ্ছে।"
# ভাইয়া, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমিও আপনাকে কালকের আগ পর্যন্ত চিনতাম না। আমি হারিয়ে যাওয়া কেউ না। আমি খুব ভাল আছি। আমি আপনার ওই নোবডিও না, সামবডিও না। আমি মোটামুটি অ্যানিবডি। কোনও ব্যাপার না। এই বেশ ভাল আছি। খাই, দাই, ঘুমাই, আর আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করি। আমার জীবনের লক্ষ্য একটাই, সুগৃহিণী হওয়া। আমার ওসব ক্যারিয়ার ভাবনাটাবনা নাই। কালকে আমার বয়ফ্রেন্ড জোর করে ধরে আমাকে আপনার আড্ডায় নিয়ে গেছে। ও ফেসবুকে আপনার ফলোয়ার। আপনি নাকি ওর রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করেন নাই। তাই ও আপনাকে একই সাথে পছন্দ করে এবং অপছন্দ করে। আমি গেলাম, শুনলাম, এবং আমার জীবনের অনেক কঠিন প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। অনেকবেশি সহজ উত্তর। এই প্রশ্নগুলো হয়তো আমি কাউকে কখনওই করতে পারতাম না। আমার আরও একটা লাভ হয়েছে। আমার একটা কনফিউশন দূর হয়েছে। আমি ঠিক করে ফেলেছি, আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকেই বিয়ে করবো। ও নিশ্চয়ই আমার ভাল চায়। নাহলে, আমাকে ওখানে ধরে নিয়ে যাবে কেন? খুব ভালমানুষ না হলে, কোন বেকুব আপনার সাথে ওর গার্লফ্রেন্ডকে পরিচয় করিয়ে দেবে? আপনি ভালরকমেরই রিস্কি! আমার কথায় কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। ভাল থাকবেন। (এই টেক্সট পেয়ে নিজের সৌন্দর্যে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেছি!)
# কয়েকজন ছেলে আমাকে এসে বললো, "ভাইয়া, আজকে আপনাকে ওয়াদা করে গেলাম ৩৫তম'তেই ক্যাডার হয়ে দেখাবো ইনশাল্লাহ!"
# একজন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "ভাইয়া, নিজেকে আজকের পর থেকে অনেক বড় মনে হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, আমি কোনওভাবেই কারওর অসম্মানের পাত্র না।" উনার আবেগজড়ানো কণ্ঠ এখনও আমার কানে বাজে।
# আমি এই মানুষটার ওয়ালে সব সময় পড়ে থাকি। কেন? বিসিএস পরীক্ষায় সারা বাংলাদেশে প্রথম স্থান অধিকারী এই জন্য? না, সেটা নয়। তাহলে চুয়েট সিএসই ডিপার্টমেন্টের এর বড় ভাই, এইজন্যে? নাকি, আইবিএ এমবিএ অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট সেজন্য? এসব কিছুই না। মানুষটার কথার মাঝে শক্তি আছে, প্রাণ আছে। যেন ছুঁয়ে দেখা যায়।
# “দোস্তো, বিশ্বাস কর, কালকে লোকজন ফ্লোরে বসে-বসে উনার কথা শুনসে। ৪ ঘণ্টা ফ্লোরে বসেছিল। অবিশ্বাস্য! কেউ ওদেরকে যেন সুপারগ্লু দিয়ে আটকায়ে রাখসে।”
# আপনি যখন টিউশনি নিয়ে আপনার একটা তীব্র কষ্টের কথা শেয়ার করলেন, তখন আমি দেখেছি, আপনার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসছে, কিন্তু আপনি কীভাবে যেন নিজেকে সামলে নিলেন! আপনার সেই স্টুডেন্ট কতোটা অকৃতজ্ঞ হলে ওরকম দুর্ব্যবহার করতে পারে, সেটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল। আমার পাশে আমার এক বন্ধু বসেছিল। আমি মাথা নিচু করে কাঁদছি আর ওকে দেখলাম, ওর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চেয়ারে ঘুসি মারছিল। মনে হচ্ছিল, যেন ওই স্টুডেন্টকে পেলে তখুনি একটা ঘুসি বসিয়ে দেয় আরকি! ও বলছিল, শালা! বুয়েটে পড়ে মনে করসিস, অনেককিছু পেয়ে গেসিস। স্যারকে কষ্ট দিয়ে কেউ কোনওদিনও কিছু করতে পারে নাই। তুইও পারবি না, শালা!
# দাদা, আপনাকে যারা অসম্মান করেছে, তাদেরকে আপনি সমুচিত জবাব দিয়ে দিয়েছেন। আপনি যা করতে পারবেন না বলে সবাই ভেবেছে, আপনি সেটাই করে দেখিয়েছেন। আপনার জীবনের গল্প শুনে মনে হচ্ছে, আমিও পারবো। আমার কষ্ট তো আর আপনার কষ্টের চাইতে বেশি না! আমি কিছুতেই হারিয়ে যাবো না! কিছুতেই না!
# দাদা, আজকের পর থেকে আর কখনও অতীত নিয়ে বেশি ভাববো না। অতীত তো আর ফিরে পাবো না। কিন্তু আমি চাইলে আমার এই বর্তমানকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতকে, আমার মা যেভাবে চান, সেভাবে করে গড়তে পারি। আপনি পেরেছেন, আমিও নিশ্চয়ই পারবো।
# চোখে পানি এসে যাবে, নিজেকে সামলে রাখতে পারবো না, এইসব জেনেও অনেক রিস্ক নিয়ে আপনার কিছু-কিছু লেখা পড়ি। আজকে সামনাসামনি দেখতে গেলাম। আমি অনেক কাঁদতে পারি। এতোটা বেশি পারি, আজকের আগে জানতাম না। আমার জীবনের বেদনার কথাগুলোই তো আপনি কীভাবে যেন বলে দিলেন!
# স্যার, আমার বন্ধুরা সবাই আপনার কাছে পল্‌স’য়ে পড়তো। আমাকেও পড়তে বলতো, কিন্তু আমি পাত্তা দিতাম না। আজকে আপনার সেমিনারে গ্যালারির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কীভাবে যে এতক্ষণ সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম, নিজেও জানি না। একটা মজার ব্যাপার বলি। আমার ঠিক পাশের সারির ২ সিট খালি হয়েছিল, আমি টেরই পাইনি। এখন আফসোস হচ্ছে, আপনার কাছে নাইনটেন-ইন্টারে কেন পড়লাম না?
# ভাইয়া, আপনার মতন এরকম ম্যারাথন স্পিকার জীবনে আর দেখি নাই। আমি আর কয়েকটা মোটিভেশনাল সেমিনার করেছি। আপনি যতো সময় ধরে ননস্টপ কথা বলেছেন, এবং সবাইকে চুপ করে শুনতে বাধ্য করেছেন, এটা পয়সা দিয়ে টিকেট কেটেও অনেক জায়গায় দেখা যেত না। ভাল কাজের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
# ভাইয়া, ইন্টারের পর দুইদুইবার ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েও চান্স পাইনি। গ্রামের কলেজ থেকে অনার্স পাস করে এখন মাস্টার্স পড়ছি। নিজেকে খুব অপরাধী আর গর্দভ ভাবতাম। মাঝেমাঝে ইচ্ছে হতো, মরে গিয়ে বেঁচে যাই। আমি যে কিছু একটা করতে পারবো, এটা কেউ কোনওদিনও বলেনি। সবাই শুধু দূরদূর ছাইছাই করে। আজকের পর থেকে আমি আর কোনওদিন কারওর কথা শুনবো না। আমি কিছু একটা করতে পারবো এবং এটাই সত্যি।
# আজকে জীবনের কিছু নতুন অর্থ শিখলাম। জীবনের অর্থ টাকা নয়, প্রতিষ্ঠা নয়, ভাল চাকরি নয়, দামিদামি গাড়িবাড়ি নয়। জীবনের অর্থ জীবন থেকেই খুঁজে নিতে হয়। জীবন অন্য কোনওখানে।
# জীবনে আরও বড় হোন, আরও সম্মান অর্জন করেন, এই প্রার্থনা করি। অন্যের মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দেওয়া বড় কঠিন কাজ, যা আপনি পেরেছেন। আপনার পোস্ট পড়ে মোটিভেটেড হই। আজকে আপনার স্পিচ শুনে হারানো আত্মবিশ্বাস কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছি। আমার তেমন কিছুই চাওয়ার নেই। শুধু প্রার্থনা করবেন আমার মা’কে যেন আমি সন্মানিত করতে পারি যেমনটা আপনি পেরেছেন।
# ক্যাডার হওয়ার যদিও অনেক বেশি ইচ্ছে নেই, তারপরও আজকে আপনার ও স্যারদের বক্তব্যে এমন অনেক কিছু ছিল যা চুয়েট ক্যাম্পাসে হারিয়ে আসা কনফিডেন্স ১০০০ গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে এত সুন্দর ও সুশৃঙ্খল আয়োজনের জন্য।
# আপনি বলেছিলেন, একটা মানুষ কতোটা পণ্ডিত, এটা কারওর দেখার বিষয় নয়। দিনের শেষে সবার মাথায় থেকে যায়, উনার ইম্প্রেসিভ আচরণ, ইম্প্রেসিভ কথাবার্তা, ইম্প্রেসিভ অ্যাটিচিউড। এটা খুবখুব সত্যি কথা। আপনাকে দেখেও বুঝলাম। আমি এখন থেকে এটা করার চেষ্টা করবো।
# ভাইয়া, আপনি ঢাকাবাসীকে ঠকিয়েছেন। চিটাগাংয়ে এতো গল্প বলেছেন কোন দুঃখে? আমাদের তো বলেন নাই। আমাদের শুধু পড়াশোনা করতে বলেছেন! আমাদের সাথে আপনার গল্প করতে ইচ্ছা করে নাই কেন, আগে সেটা বলেন।
# আজকে সেমিনারে ৩ জিনিস একসাথে ছিল। হাসি। কান্না। অনুপ্রেরণা। কীভাবে পারলেন! হ্যাটস অফ দাদা!
# আপনার লেখাগুলো দেখলেই আমার ভয় হয়! কারণ ওগুলো যে আমাকে পড়তেই হবে! অবশেষে না কেঁদে যে পারবো না, তাও নিশ্চিত!! তবুও পড়বো এবং কাঁদবো। এতো সাধ করেও আমরা কখনও-কখনও কাঁদি। পতঙ্গের আগুনে আত্মাহুতি দেয়ার মতো! আল্লাহপাক আপনাকে সুস্থ রাখুক।
# ভাইয়া, আমি আজকে বাসায় এসে আমার অসুস্থ আম্মার কাছে ওয়াদা করেছি, একদিন আমিও অনেক ভালকিছু করে উনাকে সবার সামনে অনেক সম্মানিত করবো। এটা আমি করবোই, ভাইয়া। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।
# ভাইয়া, আমি অত্যন্ত অস্থির প্রকৃতির একজন মানুষ। আমি শেষবার কবে ৩ ঘণ্টার একটা মুভি পুরোটা দেখেছি, মনে করতে পারবো না। কিন্তু আজকে প্রায় ৪ ঘণ্টা ধরে আপনার কথা শুনেছি। বাসায় এসে যখন বললাম, আমার আম্মা কিছুতেই এটা বিশ্বাস করছিল না।
# ভাইয়া, আমার আব্বু মারা গেছে ২ বছর হল। আজকে আপনার একটা স্টোরি শুনে জাস্ট ব্যাগে মাথা গুঁজে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছি। পাশের ওরা বিরক্তও হয়েছে বোধ হয়। আপনার কথাই ঠিক। আমি যা করি, যা করি না, আব্বু বেঁচে থাকতে কিছু দেখতেন, কিছু দেখতেন না। তিনি আজ নেই। তিনি এখন উপর থেকে আমার সবকিছুই দেখছেন। আমি খারাপকিছু করলে আজকে আর কীভাবে আব্বুর চোখ ফাঁকি দেবো? আপনি এটা বলে দিলেন কীভাবে? কাল থেকে প্রচণ্ড কষ্টে আছি, ভাইয়া। আমি নিজের কাছে নিজে ওয়াদা করেছি, আমি অনেক বড় হব, আম্মুকে খুশি করবো।
# আরেকজন সিনিয়র রোটারিয়ান আমাকে বললেন, "ভাই, আমার জীবনে আমি আজ প্রথম টানা প্রায় ৮ ঘণ্টা কারওর লেকচার শুনলাম। আমি বাথরুমে যাওয়ার পর বারবারই মনে হচ্ছিল, কিছু মিস হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়, কিছু মিস হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়!"
# আপনি একজন ইয়াংম্যান। আপনি পয়সা ছাড়া এই কষ্টটা করছেন শুনে আমার প্রথমে কেমন যেন একটু সন্দেহ হয়েছিল। আজকে প্রোগ্রামের পর মনে হচ্ছে, আপনার প্রাপ্য সম্মানীটা দেয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। সবকিছু পয়সায় পাওয়া যায় না। কথাটা আরেকজন রোটারিয়ানের।
# অনেকেই হলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা কেউ ঢুকতে পারছিল না। ভেতরে কোনও জায়গা ছিল না। আমি যখন আমার স্পিচ শুরু হওয়ার আগে বাইরে ওয়াশরুমে গেলাম, ওরা আমাকে ঘিরে ধরে এবং বলে, "স্যার, আমরা ভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে এসেছি। আমাদেরকে একটু ঢোকার ব্যবস্থা করে দিন। আমরা নিচে বসবো, প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে থাকবো। তবুও একটু ঢুকতে দিন। ওরা আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না।" ওরা আক্ষরিকভাবেই সিঁড়িতে আর ফ্লোরে বসে পড়েছিল।
# "স্যার, আজকে থেকে আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য। যে করেই হোক, আমি আমার আব্বা-আম্মাকে খুশি করবো।"
# দাদা, আপনি আপনার নিজের কিছু গল্প বলার সময় আপনার গলা কাঁপছিল। কিন্তু আপনি সামলে নিয়ে কথা বলে গেছেন। আমি নিজেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমি অবাক হয়ে গেছি, আপনি কীভাবে কথাগুলো বলে ফেললেন! দাদা, সত্যি বলছি, আপনার জায়গায় আমি হলে ঝেড়ে কাঁদতে শুরু করতাম!
# আয়ান বলছিল, দাদা, আমি যদি ক্যাডার হওয়ার আগে এরকম একটা সেমিনার করতাম, তবে আর কেউ কোনওদিন বিসিএস নিয়ে না বললেও আমি নিশ্চিতভাবে ক্যাডার হয়েই দেখাতাম। ও নিজেও ক্যান্ডিডেটদের উদ্দেশ্যে খুব চমৎকার কিছু কথা বলেছে। অনেক গভীর বিশ্বাস থেকে বলা কথাগুলো আমার মতো অনেকের মনই ছুঁয়ে গেছে। ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটা আড্ডা আয়োজন করার চেষ্টা করছে। দেখা যাক। স্নিগ্ধ ভাই, ভার্সিটি ক্যাম্পাসে আড্ডার কোনও আপডেট আছে? আড্ডাটা কয়েকটা ডিপার্টমেন্ট মিলেও করা যায়।
# আমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলাম কেন, সেটা শেয়ার করার পর আমার মা প্রচণ্ড কাঁদতে থাকেন। আশেপাশের লোকজন উনাকে শান্ত করেন।
# নামাজের ব্রেকের সময় বাদল সৈয়দ স্যারকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আমার জন্যে সময় আর কতক্ষণ বরাদ্দ? স্যার উত্তরে বললেন, তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা বল। আজকে যারা এসেছে, ওদের অনেকেই এইমুহূর্তে তাদের সবচেয়ে ভাললাগার সময় কাটাচ্ছে। তুমি ওদের জন্যে বল। স্যারের একটা প্রেজেন্টেশন ছিল। সেটাতে স্যার জীবনদর্শন আর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা নিয়ে কয়েকটা গল্প শেয়ার করেছেন। একটা বিষয়কে অন্য দশজন যেভাবে করে ভাবে কিংবা দেখে, সেটা থেকে সরে এসে অন্যভাবে দেখলে জীবনের কতো সুন্দর অর্থ দাঁড়ায়, সেটা স্যারের কাছ থেকে শিখলাম। স্যার একজন অসাধারণ মানুষ, এতোদিন শুধু এইটুকুই জানতাম। আজকে জানলাম, স্যার একজন চমৎকার বক্তাও। স্যারকে ধন্যবাদ। (স্যার, রাবেয়া ভাবির উপস্থাপনাও খুব চমৎকার ছিল। পরে ভাবির কাছ থেকে শুনলাম, আজকেই উনি প্রথম উপস্থাপনা করেছেন। আমি এর আগে এটা বুঝতেই পারিনি! ভাবি একটা কথায় বলেছিলেন, মিস্টার দাউদ। হাহাহাহা............খুব মজা পেয়েছি!!)
সবচাইতে বড় যে প্রাপ্তি........... আজকের অনুষ্ঠানের শেষে দাউদ (বাদল সৈয়দ) স্যার আমার মা'কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে আর সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্যে মঞ্চে ডাকলেন। আমার মা যখন মঞ্চে উঠছিলেন, তখন দর্শকশ্রোতা সারির সবাই নিজ থেকেই আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে মা'কে সম্মান দেখালেন, হাততালি দিলেন। এটা দেখে আমি চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। এটা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি। একটা ছেলের জীবনে এর চাইতে বড় সম্মান আর কী চাওয়ার থাকতে পারে? ঈশ্বর আমাকে আমার যোগ্যতার তুলনায় অনেকবেশিই সম্মানিত করেছেন। আমি মন থেকে শুকরিয়া আদায় করি। আমি আজকের দিনে এসে ভাবি, স্রেফ বেঁচে ছিলাম বলেই কতোকিছুই না পেয়েছি। বেঁচে থাকাটাই অনেক বড় কিছু। এই যে বেঁচে আছি, জীবন এতোএতো বোনাস দিয়ে দিয়েছে, এর কিছুটা কি আমার আশেপাশের সবার প্রাপ্য নয়? কেন পেলাম এতকিছু? ঈশ্বরের কী ইশারা এতে? কারওর জীবনকে স্পর্শ না করে শুধু একা বাঁচার জন্যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়নি নিশ্চয়ই!
এবার একটা অন্যধরনের ফিডব্যাক শেয়ার করছি। আজকে সকালে এটা আমার ইনবক্সে আবিষ্কার করলাম। ফিডব্যাকটি পড়ে সত্যিসত্যি অভিভূত হয়ে গেছি। এভাবে করে কেউ আমায় কখনও লিখেনি। ওটা পড়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে ছিলাম। এটাও ঠিক করে ফেললাম, আমার নিজেকে বদলানোর সময় এসেছে। নিজেকে প্রকাশ করার ধরন পরিবর্তন করে নিলে এতে অনেকের সুবিধে হবে। আমি ক্যারিয়ার আড্ডায় যাওয়ার আগে প্রিপারেশনে খুব একটা সময় দেই না। নিজে যা বিশ্বাস করি, যাকিছু সত্য বলে মানি, (এবং যা ওইসময়ে বলতে মনে থাকে) তা-ই বলি। তাই অনেকেই কথাগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে পারেন। এখন থেকে প্রিপারেশনের ব্যাপারটাতে একটু মনোযোগী হতে হবে। পত্রলেখিকাকে আমি চিনি না। উনি আমাকে কখনও লেখেনওনি। উনার মেসেজ পড়ে, উনার নিজের বিশ্বাসের প্রতি এতোটা গভীর সম্মানবোধ এবং নিজের অস্তিত্বের সাথে সাময়িক দ্বন্দ্ব, অতঃপর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা, তাও নিজের মতো করেই, এটা আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। আমি উনাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করি এবং আমাকে এই ধাক্কাটা দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানাই। বন্ধু, তোমায় স্যালুট!
একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে কেবল নিজের মধ্যে রাখতে না পারার যে যন্ত্রণা, সেটার সাথে আপনি পরিচিত নন বলেই এমন সব কাজ করতে পেরেছেন এবং পারছেন। আপনার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বগুলোকে সবার সামনে এনে হাজির করতে আপনার বুক কাঁপে না? এটা কেন করেন? সবার কী এমন দায় যে আপনার কষ্টগুলোকে ফিল করবে? কষ্টের হাজারো রকমফের আছে। আপনি কি এটা সচেতনভাবেই করেন? করলে, কেন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমি জানি আপনি কী করেছেন। এবং এও জানি, আপনি যা করছেন, ঠিক করছেন না। সুতরাং কোনওপ্রকার ঢং করবেন না। শুধু এইটুকু বলার জন্য টেক্সট করলাম, “মাফ চাই! এ জন্মের মত মাফ করেন! আপনার যেমন আলাদা একটা জগৎ, একান্ত ব্যক্তিগত কিছু ব্যাপার আছে, তেমনি অন্যদেরও আছে। মনে রাখবেন, কেউ একজন অবশ্যই আপনার খোঁটা শোনবার জন্য, আপনার অযাচিত কর্মকান্ড সহ্য করবার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। আমি বলছি, আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।” আপনার উপর আমার কিংবা আমার উপর আপনার কোনও দাবি বা প্রত্যাশা থাকার তো কথা না! কিন্তু তারপরও ব্যাপারটা দিনকে দিনকে বিশ্রী রকমে মোড় নিচ্ছে। আমি চাই না, আপনার কিছু আমি নিই। এর কারণ, আপনার কোনওকিছু ফেলে দেয়ার সময়ই তো আমার নেই। নেয়া তো অনেক পরের কথা। (আমার ধারণা, আপনি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে বুদ্ধিমান, আমি কী বলতে চেয়েছি, ঠিক বুঝেছেন নিশ্চয়ই!) আমি আপনার উপর বিরক্ত, বিরক্ত নই শুধু, মহাবিরক্ত! আমি এই যন্ত্রণা থেকে নিস্তার চাচ্ছি। একটা সময়ে আমি আপনার ফলোয়ার ছিলাম, এখন তাও নই। আপনাকে ফলো করার দরকার আমার নেই। বন্ধু হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না! আপনার ফলোয়ার কেবল তারাই হবে যারা জীবনে সফল হতে চায়। আমি সফলতা চাই না। সুতরাং আমি এখন আর আপনার অনুসারী নই, কিছুই নই। আপনার উপর রাগও করতে ইচ্ছা হয় না কেবল এই কারনেই। আপনি টেক্সট পড়ে দয়া করে এটাকে অন্যভাবে নেবেন না, কিংবা লোকজনকে বলে বেড়াবেন না যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে আগ বাড়িয়ে আপনাকে এতকিছু লিখেছে (তবে এটা যদি অবিকৃত অবস্থায় জনসমক্ষে আনেন তাহলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারবেন)। মেসেজের রিপ্লাই দেবার দরকার নেই। আপনার কড়া কথা শুনতে আমার ভাল লাগবে না। আমি মনেপ্রাণে চাই আপনার সাথে যাতে আর কখনও মানসিক দ্বন্দ্বে জড়াতে না হয়। ভাল থাকবেন।
মজার ব্যাপার হল, এই ফিডব্যাকটা আমার ওয়ালে শেয়ার করার পর মজার কিছু কমেন্ট এসেছে। এরপর আমি আমার আগের ভাবনা থেকে কিছুটা হলেও সরে এসেছি। নাহ! আমি এভাবে করেই সবাইকে বাঁচতে শেখাবো। কিছু কমেন্ট শেয়ার করছি।
Chowdhury Nixon: কারওর ফিডব্যাক পড়ে নিজেকে পাল্টানোর কিছু নেই, দাদা। একজন মেয়ের যদি আপনার উপস্থাপনা কৌশল ভাল না লাগে তার দায় আপনার না, কারণ বাকি সবার ভাল লাগছে। বরং ভাল না লাগার দায়টা উনি নিজে নিলে ব্যাপারটা শোভন হত। নিজের ক্ষুদ্রতা আমরা কেন ছড়াবো? তবে লেখাটা পড়ে কেমন যেন ব্যক্তিগত দায় বলে মনে হল!!
প্রিয় লেখিকা…...কিছু-কিছু মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বগুলো অন্যকিছু মানুষের কাছে স্বপ্নপূরনের ধাপ। কষ্ট ফিল করার দায় নেয়ার জন্য কেউ আড্ডায় যায়নি, যায়ও না। যারা যায় তারা দ্বন্দ্বটাকে কাটানোর জন্য যায়, আপনি যদি বুঝে যান, আপনার জীবনে ঠিক এই জায়গায় মোড়টা নিলে সুশান্ত দাদার মত বিপদে পড়বেন না, তাহলে অন্যের জীবনের দ্বন্দ্বটা একটা শিক্ষা হয়ে যায়, তার জন্য যদি কেউ যায়, তবে তাকে ওরকম বলছেন কেন, ভাই? আমি নিজে কখনও যাইনি আড্ডায়, সময়সুযোগ হয়নি বলে, স্রেফ সুযোগ হয়নি বলেই যাইনি। তবে বিশ্বাস করুন, আমিও সফল হতে চাই জীবনে! (আমি নিজেও কিন্তু ক্যাডার জবে আছি।)
আচ্ছা, কেন এভাবে বললেন, বোন? বেকার হওয়ার যন্ত্রনা কি আপনি জানেন? কখনও বেকার অবস্থায় ফুটপাত থেকে রুটিকলা খেয়ে বন্ধুর বাসায় এসে বিরানি খেয়েছি বলেছেন? চাকরির ইন্টারভিউ দিতে-দিতে কখনও বলতে হয়েছে…..পরের চাকরিটা অবশ্যই হবে, বাবা! আত্মীয়স্বজন এড়িয়ে চলেছেন কখনও, শুধু ‘বেকার’ ডাকটা এড়ানোর জন্য?! সুশান্তদার এত ছেলেপুলের স্বপ্ন দেখানোর দায়টা আপনি দেখলেন না? শুধু ব্যক্তিগত কষ্টের দায়টুকুই দেখলেন!!??
Nipa Roy: শচীন টেন্ডুলকারের ‘প্লেয়িং ইট ইন মাই ওয়ে’ নামের একটা বই রিসেন্টলি পাবলিশড হয়েছে। এই বইয়ের নামটার মতো করেই আমিও বলতে চাই, “দাদা, প্লে ইট ইন ইওর ওয়ে। নো নিড টু চেঞ্জ।” আর তাছাড়া, নিজেকে নিজের মতো করে প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই আছে। এটা কারওর ভাল না লাগলে, সে না হয় দূরে সরে যাক। বাকি সবাই তো ওটা পছন্দ করছে।
Ahmed Ishmam: মাই ডিয়ার আবেগি আপা, জাস্ট টেল আস হাউ ম্যানি ইউ হ্যাভ মোটিভেটেড, হাউ ম্যানি টাইমস দে টোল্ড ইউ দ্যাট দে উড নট গিভ আপ অনলি ফর ইওর হেল্প।
Hasina Johora: আপনার কষ্টগুলো, কথাগুলো তো আপনার একার নয়....আপনার কথাগুলো শুনলে আমাদের মনে হতে থাকে, এ তো আমার নিজের জীবনেরই গল্প, আমার নিজের মনের কথাগুলোই তো শুনছি....আর তাই তো আপনাকে বিচ্ছিন্ন কেউ মনে হয় না। আপনার গল্পগুলো শুনে অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে আমরা আলোর ভরসা করতে শিখি। আপনি মহান, তাইতো নিজেকে ছোটো করে হলেও নিজের জীবনের গল্পগুলো আমাদের শোনান। নিজেকে এভাবে প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ। আপনি কেন চেন্জ হবেন??!!
(কেউ একজন ইনবক্সে): দাদা, আপনি কী বুঝতে পারছেন না, কেউকেউ চায় আপনাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলতে? আপনার ব্যক্তিগত কষ্টগুলো কি শুধুই ব্যক্তিগত? ওগুলো কি অনেকটাই নৈর্ব্যক্তিক নয়? কথাগুলো কি আশেপাশের সবাইকেই ছুঁয়ে যায় না? সবাই কি নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবে না আপনার সেমিনারের পর? তবে, কেন আপনি এতোদূর এসে নিজেকে গুটিয়ে নেবেন? কোনওভাবেই না, কিছুতেই না, কখনওই না।
বিশিষ্টজন সাংবাদিক ও কবি আবুল মোমেন স্যারকে শ্রদ্ধা জানাই আমাদের অনুষ্ঠানটাতে প্রধান অতিথি হয়ে এসে সময় দেয়ার জন্যে এবং রোটারি ক্লাবের সবাইকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি স্বপ্ন খুঁজেফেরা কিছু মানুষের জন্যে এতো সুন্দর একটা ক্যারিয়ার আড্ডা আয়োজন করার জন্য।
শেষকথা। টলস্টয় জিজ্ঞেস করেছিলেন, মানুষ কীসে বাঁচে? আমি বলি, মানুষ বাঁচে ভালোবাসায়।
I want to inspire people. I want someone to look at me and say, “Because of you, I didn't give up.”