মৃত্যুক্ষুধা

 
একজন সালমা বেগম। রূপপুর দিঘির পশ্চিমপাড়ে যে বস্তিটা আছে, সে বস্তির কোনও এক নোংরা স্যাঁতসেঁতে কোনায় সালমা বেগমের ভাঙা কুঁড়েঘরটা। চালের বস্তা, পুরনো শাড়ির টুকরো আর দুই-একটা বাঁশ দিয়ে কোনওমতে চারটি দেয়াল তুলে দিনাতিপাতের যে ব্যবস্থা, এখানে তার নামই ঘর।


সালমা বেগমের বয়স ষাটের কাছাকাছি। এই পৃথিবীর সাড়েসাতশো কোটি মানুষের ভিড়ে তাঁর কেউই নেই। পৃথিবীর মোট ৫১ কোটি ১০ লাখ বর্গকিলোমিটার জায়গার মধ্যে সালমা বেগমের আশ্রয় হয়েছে ওই ছোট্ট বস্তির নোংরা কোনাটায়। কেউ কেউ টাকার বস্তা ঢেলে জায়গাজমি কিনে বড়ো বড়ো দালান তুলে ফেলে রাখে অব্যবহৃতই, আর এদিকে সালমা বেগমদের ঘুমানোর জন্যও একচিলতে জায়গাও মিলে না। এই প্রকট বৈষম্যের কালোথাবায় পৃথিবীর আগাগোড়াই একটা পোড়া-থ্যাবড়া ডেকচির তলানির মতোই বেঢপ হয়ে গেছে বহুদিন হলো।


অনেকদিন আগের কথা। এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে সালমা বেগমের জন্ম। কোনও এক অজপাড়াগাঁয়ে বেড়েওঠা সালমা বেগমের বিয়ে হয়েছিল মাত্র বারো বছর বয়সে পাশের গ্রামের মোতালেবের সাথে। শ্বশুরবাড়িতে হালের বলদ আছে, দুয়েক খণ্ড চাষের জমি আছে। গোয়ালে বাঁধা দুধেল গাইও আছে একটা।


বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মোতালেব। মোটামুটি চলতে-পারার-মতো একটা সংসার নিয়ে সালমা বেগমকে বারো বছর বয়সে বিয়ে করে ঘরে তোলে মোতালেব। দেখতে পুতুলের মতো ছোটোখাটো গড়নের সালমা তখন বাগানে সদ্যফোটা গোলাপকুঁড়ির মতো। কাঁচাহলুদের মতো গায়ের রং, কুমড়োর মতো বড়ো বড়ো ডাঁসা ডাঁসা দুটো চোখ, ঘাড় বাঁকিয়ে বেড়েওঠা স্বর্ণলতার মতো বাঁকানো দুটি ঠোঁট। ওই দুঠোঁটে যেন রাজ্যের সমস্ত হাসির মজুত! বড়ো বড়ো চোখের পাপড়িগুলোর টিপটিপ চাহনি থেকে যেন জ্যোৎস্না ঝরে পড়ে। ঘন কালো লম্বা চুলে যেন মেঘেদের ভেলায় কৃষ্ণকলির মেলা বসেছে।


এমন উপচেপড়া রূপের ঢেউয়ে মোতালেব মাতাল হতো প্রতিদিনই।


যেদিন বউ হয়ে সালমা মোতালেবের ঘরে ঢুকে, মোতালেব সেদিন লজ্জা লজ্জা চোখে উঠোনের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মধ্যে কিছুটা সংকোচ, কিছুটা কুণ্ঠা, কিছুটা দ্বিধা। নতুন মানুষটির মুখোমুখি হবার আগে কিছু শঙ্কা তো থাকেই!


একটা গোটাজীবন একসাথে পাড়ি দেবার সংকল্প নিয়ে যে মানুষটিকে মোতালেব ঘরে তুলেছে আজ, তার সাথে জীবনের রাস্তায় সে প্রথমকদমটা ফেলল মাত্র আজই! এখান থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে এই পথচলার সমাপ্তি ঘটবে, তার হিসেবনিকেশ অন্তরিক্ষের স্রষ্টার হাতেই নাহয় থাকুক।


মোতালেব নতুন বউয়ের ঘরে ঢুকেছে দুরু দুরু বুকে। মোতালেবকে ঘরে ঢুকতে দেখে ছেলেপুলে, বউ-ঝিয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুচকি হেসে হেসে। নড়েবড়ে খাটের এককোনায় জড়সড় হয়ে গুটিয়ে বসে আছে ছোট্ট একটা পরী। নতুন বরকে ঘরে ঢুকতে দেখে কিছুটা সংকোচ, কিছুটা লজ্জা এবং কিছুটা ভয়ে নতুন বউ আরও গুটিয়ে বসল।


দুজন দুজনকে প্রথমদেখার দিন আজ। দুজনেই ভীষণ জড়তায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। কে আগে কথা বলবে, কে আগে নীরবতা ভাঙবে, এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের দেয়াল ভেঙে কাঁপা কাঁপা হাতে মোতালেব নতুন বউয়ের হাতটা আলতো করে একটু ছুঁয়ে দিল। পৃথিবীর সমস্ত কম্পন যেন জড়ো-হওয়া ওই দুটি হাতে গিয়ে জমা হলো মুহূর্তেই! ওই ছোঁয়ার কম্পন নতুন দুজন মানুষকেই কম্পিত করে চলেছে অবিরাম। এভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ। একসময় নীরবতা ভেঙে অনেক সময় ধরে কথা হলো ওদের। জীবনের প্রতিটি উত্থানে পতনে, সুখে দুঃখে কিংবা জয়ে পরাজয়ে একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতিতে সেদিন দুটি পাখির রাত ফুরিয়ে ভোর হলো।


এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন।


ভালোবেসে নতুনবউকে মোতালেব ছোটপরী বলেই ডাকত। বউ হয়ে ঘরে এলেও সালমার গা ছেড়ে শৈশববেলার খোলসটা খুলে পড়েনি এখনও। এখনও তেলাপোকা দেখলে চিৎকার দিয়ে উঠে, মাকড়ের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে উল্লাসে ফেটে পড়ে। টিকটিকির খসেপড়া লেজ দেখে সমব্যথী হয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে এখনও। এখনও গাছের মগডালে উঠে পা দুলিয়ে দুলিয়ে পেয়ারা পেড়ে খায়, মেঠোপথের শরীর ধরে এখনও হেলেদুলে ঘুরে বেড়ায়। বিয়ের রশি কিংবা সংসারের তালা, কোনওটাতেই যেন বাঁধা পড়ে না সে। বয়সই-বা আর কত! মাত্রই তো তেরোতে পড়ল! এই বয়সে কতই-বা জ্ঞানগম্যি হয় মানুষের!


এভাবে চঞ্চলতা আর কিছুটা দস্যিপনায় শ্বশুরবাড়িতে কেটে গেল প্রায় এক বছর। তেরো পেরিয়ে চৌদ্দতে পা দিল সে। এরই মধ্যে কিশোরী সালমার শরীরের ভেতর বেড়ে উঠছে আর এক শরীর। হ্যাঁ, সালমা মা হবে। আর পাঁচ-ছয় মাস পরেই জন্ম নেবে একটি নতুনমুখ। সবখানে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। এবার হয়তো সালমা শান্ত হবে, সংসারের জালে আটকাবে সে।


এতকিছুতেও সালমার অত মাথাব্যথা নেই। শৈশবের কোল থেকে জেগে না-উঠা সালমা এখনও আকাশের উড়ন্ত ঘুড়িটির মতোই। এভাবেই কাটছিল দিন। হাসিখুশিতে-ভরা ছোটোখাটো একটা সংসার, সেখানে একটা ছোটপরী। আবার সেই ছোটপরীর শরীরজুড়ে বেড়ে-ওঠা আর এক ছোটপরী। সেই নতুনপরীর আগমনবার্তায় উৎসুক সবাই।


মোতালেবেরও পরীরই শখ। মায়ের মতোই দেখতে পরী পরী হবে তার ছোটপরীটা, সে এমনি করেই ভাবে।


সুখস্বপ্নে বিভোর প্রাণের সাগরে হঠাৎ অমাবস্যা ভর করল।


একদিন হালের গরু গোয়ালে বেঁধে ক্ষেতে গিয়েছিল মোতালেব। ধান কেটে ঘরে তোলার মৌসুম এখন। বেশ কিছু ধানীজমি আছে তার। সেই ধান মাড়াই করে গোলায় ধান ভরবে। সেই ধানের কিছু বিক্রি করে বাকিটুকু নিজেদের সারাবছরের জন্য রেখে দিতে হয়। এ সংসারে বড়ো হিসেব কষে চলতে হয়। নয়তো ক্ষুধার চাবুকে জীবনের ছাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পেটের ক্ষুধা কখনও বাকি মানে না। ক্ষুধার সব হিসেবই করতে হয় নগদ নগদ। যখনই ক্ষুধা, তখনই খাদ্য। এই ক্ষুধার কোনও বকেয়াখাতা নেই।


মোতালেব জমির ফসল দেখছিল। আহা, বড়ো আদরের ফসল! এই ধান সে কতই না আদরে গড়ে তুলেছে! প্রতিটি কৃষকের কাছে তার ঘামে জন্মানো ফসল সন্তানতুল্য। ফসলই কৃষকের সন্তান, ফসলই তার বাপ-মা।


ক্ষেতে কাজের ফাঁকে হঠাৎ কীসের জানি কামড়! নাম-না-জানা কোনও এক সাপ হুস্‌ করে মোতালেবের বাঁ পায়ের পাতায় বসিয়ে দিল কামড়। উফফফ্‌ করে শব্দ করে মোতালেব ওখানেই বসে গেল। কামড়ের কিছুক্ষণ পরেই সারাশরীরে কেমন জানি এক অসহ্য যন্ত্রণা! সে যন্ত্রণা ক্রমে বেড়েই চলছে। কাজ ফেলে মোতালেব কোনওমতে ঘরে ফিরল। ঘরে পাতানো চাটাইয়ে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে যন্ত্রণা গিলে খাচ্ছে সে।


বিষ ক্রমেই সারাশরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণা যতই বাড়ছে, মোতালেব ততই ছটফট করতে লাগল। মোতালেবকে অমন ছটফটাতে দেখে সালমা দৌড়ে এসে কী করবে না কী করবে ভেবে না পেয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করল। আশেপাশের লোকজন জড়ো হচ্ছিল। ওঝা আনা হলো। মোতালেবকে ধরাধরি করে কোলে করে উঠোনে এনে চাটাইয়ে শোয়ানো হলো।


ওঝা কী কী সব পরীক্ষা করার পর বলল, ‘বড়ো কঠিন বিষের সাপে কেটেছে গো বাপু! এ বিষ নামানো বড়ো দায়!’ এ কথা শুনে ভড়কে গিয়ে সালমা আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।


ওদিকে ওঝা কী কী সব ফুসমন্তর পড়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছে বিষ নামাতে। সময় যত গড়াচ্ছে, মোতালেবের বিষের যন্ত্রণা ততই বাড়ছে। ছটফটানিও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে। সাপ ও সাপের চৌদ্দগুষ্টিকে সমূলে গালাগালি করেও বিষের নিয়ন্ত্রণ কমানো যাচ্ছে না। ওঝার অসংখ্য মন্ত্রের একটিও বিষের কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। পৃথিবীর কোনও নিয়মের তোয়াক্কা না করেই মোতালেব বমি করে উঠল হঠাৎই।


এবার ওঝার সমস্ত বিশ্বাস আর মন্ত্রতন্ত্রকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে মোতালেব দাঁতে দাঁত খিঁচে চোখেমুখে ফেনা বের করে দিয়ে আকাশের দিকে ব্যথাতুরা চোখে দৃষ্টি ছুড়ে শেষ একবার ‘মা’ বলে চিৎকার ছেড়েই চিরতরে চুপ হয়ে গেল। জগতের সমস্ত নীরবতা নিজের গায়ে জড়িয়ে নিয়ে মোতালেব নিঃশ্বাস-নেওয়া বন্ধ করে দিল।


ওঝা ব্যর্থ শেষচেষ্টাটি শেষে মোতালেবের হাঁ-করা মুখ ও খোলা চোখদুটোতে হাত বুলিয়ে বন্ধ করে দিয়ে নিজের চোখ মুছতে লাগল। ‘ও মা রে! ও মা রে!’ বলে বিলাপ করে মোতালেবকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে লাশের গায়ের উপর আছড়ে পড়ল সালমা। একটা জলজ্যান্ত মানুষ কত সহজেই লাশ হয়ে যায়!


আহারে জীবন! আহারে জীবন! জীবনের প্রথমপৃষ্ঠা উলটাতে না উলটাতেই জীবনের শেষপৃষ্ঠার করুণ অবতারণা! একসাথে সারাজীবন চলার অঙ্গীকার দিয়ে শুরু-করা জীবনের প্রথমসোপানেই সকল সমাপ্তি ঘটিয়ে দিয়ে মোতালেব সালমাকে সাদাশাড়ির জীবন দান করে গেল। সে কথা দিয়েছিল, সালমার জীবনে কখনও রঙের অভাব হবে না। অথচ এখন সালমার জীবনে এক সাদারঙটি বাদে আর কিছুই নেই। ভালোবাসা ও সুখের জোছনায় বাঁধা যে ঘরের চাল, সে ঘরের চাল ভেদ করে অমাবস্যার কালোরঙে ছেয়ে গেল সারা ঘর, উঠোন, দরোজা ও ঘরের চৌকাঠ।


একমুহূর্তেই সালমার চৌদ্দবছরের কিশোরীবয়স দৌড়ে দৌড়ে চল্লিশ, পঞ্চাশ, একশো পেরিয়ে গেল। সমস্ত শরীরজুড়ে ঘুমিয়ে-থাকা শৈশবের ঘুম ভেঙে গেল আচমকাই!


স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে সালমা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেল। হাসে না, খেলে না, প্রয়োজন ছাড়া একটাও কথা বলে না। তেলাপোকা দেখলে আর চিৎকার দেয় না, মাকড়শার ডিম দেখে খুশিতে খিলখিল করে হাসে না, গাছের ডালগুলোতেও চড়ে না। জীবন তাকে অনেক বড়ো করে দিয়েছে এই ছোটবয়সেই।


উঠোনের পুকুরপাড়ে বসে গাছে হেলান দিয়ে উদাস হয়ে পুকুরের ওপারে চিরতরে শুয়েথাকা স্বামীর কবরের দিকে ঠায়দৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকে সে। এভাবে সে কাটিয়ে দিত সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধে। একা থাকতে যার ভীষণ রকমের ভয়, জীবন তাকেই একাথাকার নিয়মেই বেঁধে দিল। একেবারেই চুপ হয়ে গেল সালমা। কী জানি কত ব্যথা জমিয়ে রাখত সে ছোট্ট ওই বুকটাতে।


এই তো সেদিনই বিয়ে হলো। এখনও হাতের মেহেদির রঙটাও তো মুছেনি ভালো করে। অথচ জীবন থেকে স্বামীর চিহ্নটাই মুছে গেল চিরদিনের জন্য।


স্বামীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই সাদাশাড়ির আঁচলে বাঁধা-পড়া জীবনের আঁচল ধরে আগমন ঘটল আরও একটা জীবনের। সালমা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। জন্ম দিয়ে সন্তানের মুখ দেখেই হেসেওঠাই হলো পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য বাঁধানিয়ম। এ নিয়মের উলটোরথের নিয়ম ধরে সদ্যোজাত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সালমা। কী জানি কোন কোন পুরনো ব্যথা জেগে উঠেছিল সে হতভাগিনীর বুকে।


এভাবেই কেটে গেছে দুইটা বছর। মেয়ে হাঁটতে শিখেছে। আধো আধো বোলে কথাও বলে। সে সময় ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে সালমার শ্বশুরও মারা গেলেন। শাশুড়ি তো মারা গিয়েছিলেন মোতালেবের জন্মের সময়ই। ফলে সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল সালমা।


এদিকে গ্রামে খাবারও জুটছে না। গ্রামে সবাই-ই তো গরীব, কে কাকে খাবার দেবে? যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের কে-ইবা সালমাকে বসে বসে খাওয়াবে? তাই দূরসম্পর্কের একজনকে যে-কোনও একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়ার জন্য বলল সালমা। ওই লোক শহরে এক মেমসাহেবের বাসায় কাজ করার কথা জানাল, অর্থাৎ সালমাকে শহরে যেতে হবে কাজটা নিতে হলে। উপায়ান্তর না দেখে সালমা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, সে শহরে যাবে। কাজ একটা তো সে পেয়েইছে, আর একটা জুটিয়ে নিয়ে কোনও এক বস্তিতে গিয়ে উঠবে মেয়েকে নিয়ে।


সালমা বেগম তা-ই করলেন। শহরে এসে বুয়ার কাজ নিলেন। রূপপুর বস্তিতে এককামরার একটা ঘর ভাড়া নিলেন। যে মেমসাহেবের বাসায় কাজ করেন, সেই মেমসাহেব বেশ দয়ালু মহিলা ছিলেন। তিনি আরও একটা বাসায় সালমাকে কাজ জুটিয়ে দিলেন। দুই বাসাতে কাজ করে কোনওমতে দিন কেটে যাচ্ছিল সালমার।


পৃথিবীতে তার এখন একমাত্র মেয়ে ছাড়া আর কেউই নেই। ওই মেয়েই সালমা বেগমের পুরো একটা পৃথিবী। এই ছোট্ট পৃথিবীটাকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করলেন সালমা বেগম। শুরু করলেন বেঁচেথাকার লড়াই। জীবনের লড়াই, বেঁচেথাকার লড়াই, দুমুঠো ভাতের লড়াই, নিজে বাঁচা এবং মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। মেয়েকে মানুষ করার স্বপ্নে সালমা বেগম আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলেন।


দুইবছর বয়সি মেয়ে এখন দারুণ করে হাঁটে, কখনও দৌড়ায়ও। মেয়েটি দেখতে হয়েছে সালমা বেগমের মতোই, ওকে একদম পরীর মতো লাগে দেখতে।


সালমা যে বস্তিতে থাকেন, সেখানে একটা ছোট পুকুর আছে। একদিন কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে সালমা রান্না করতে গেলেন। এই ফাঁকে মেয়ে খেলার সময় হাঁটতে হাঁটতে বস্তির ওই পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। রান্নার খেয়ালে থাকায় মেয়ের দিকে তেমন খেয়াল করতে পারেননি সালমা। খেলতে খেলতে পা ফসকে টুপ্‌ করে পুকুরে পড়ে গেল মেয়েটা। অতটুকুন ছোট্টপায়ে তো আর কোনও ভারসাম্য ছিল না, বেচারি পড়েই পাথরের মতো ডুবে গেল সেই পুকুরে।


রান্নাশেষে হঠাৎই মেয়ের কথা মনে পড়ল সালমার। হন্যে হয়ে এবাড়ি ওবাড়ি খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। এভাবে কয়েক ঘণ্টা খুঁজলেন মেয়েকে। কিছুতেই খোঁজ মিলছে না। একজন একজন করে সবার কাছেই জিজ্ঞেস করা হলো মেয়েকে দেখেছে কি না। কিন্তু কারওই নজরে পড়েনি। সালমা বুক ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তড়পড় তড়পড় করতে লাগলেন। কোথাও মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারও কয়েক ঘণ্টা পর সালমাকে বস্তির একজন মহিলা ডেকে পুকুরপাড়ে নিয়ে গেলেন।


সালমা দেখলেন, নিথর নিস্তব্ধ মেয়ের শরীর পুকুরের জলের উপর প্লাস্টিকের বোতলের মতো ভেসে আছে। হাত-পা এলানো। আকাশের দিকে মুখ-করা। ফুলেওঠা শরীর। কয়েক জন ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েকে তুলে এনে পাড়ে শোয়ালো।


এ দৃশ্য দেখেই সালমা বেগম ধপাস করে পুকুরপাড়েই বসে গেলেন। কেন জানি তিনি কাঁদতে পারছেন না। কথাও বলছেন না। পাথরের মতো দুচোখে একদৃষ্টে মেয়ের শুইয়ে-রাখা পুতুলশরীরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। ক্ষুধায় ঠাসা জীর্ণশীর্ণ দুবছরের ছোটোখাটো পুতুলশরীরটা পানি ঢুকে ফুলে দশবছরের বাচ্চার শরীরের মতো হয়ে গেছে। বড়োবাবুদের ঘরের পুষ্টিপ্রাপ্ত বাচ্চার মতো ফোলা ফোলা শরীর হয়েছে পরীটার। পেটটা ফুলে উপরের দিকে উঠে আছে, যেন কয়েকজন্মের ক্ষুধা মেটাতে পেট পুরে খেয়ে নিয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে সে।


এই ঘুম আর ভাঙার নয়।


পৃথিবীভর্তি মানুষের ভিড়ে সালমা বেগমের আর কেউ রইল না। জীবনের চরম তিরস্কারে রিক্ত শূন্য সালমা বেগমের সাদাশাড়ির আঁচলে লেগেথাকা সামান্য লালরঙটাও উঠে গেল চিরতরে। তাঁর জীবনে আর কোনও রঙই অবশিষ্ট নেই আজ। শূন্যতার অতলে তলিয়ে-যাওয়া সালমা বেগমের ক্ষীণহাসিটুকুরও আর একটিও কারণ রইল না।


বস্তির পাশে যে কবরস্থানটা আছে, সেখানেই কবর দেওয়া হলো মেয়েকে। ছোট্ট পরীটির একটুকরো ক্ষুধার্ত শরীরটিকে গেড়ে দেওয়া হলো সাড়ে তিনহাত মাটির তলে। ওখানেই আরামে নিশ্চিন্তমনে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট পরীটি। তার এখন আর ক্ষুধা নেই, কোনও কান্না নেই, কোনও বায়না নেই। বড়ো শান্ত হয়ে গেছে সে।


এমনি করে ঘুরল আরও অনেকগুলো বছর। সালমা বেগম আগের মতো জোয়ান নেই। বিয়ে থা-ও করেননি আর। ওই বস্তিতেই থেকে গেছেন। বিয়ের জন্য বলেছে অনেকেই। অনেকে গ্রামে চলে যেতেও বলেছে। কিন্তু গ্রামে কেউ তো নেই, এক স্বামীর কবর ছাড়া।


যে বস্তির পাশে মেয়েকে কবর দেওয়া হয়েছে, সালমা বেগম সে বস্তিতেই থেকে গিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন গোটা চল্লিশটা বছর। মেয়েকে ছেড়ে দূরে কোথাও থাকতে পারবেন না, তাই তিনি আর বস্তি ছেড়ে কোথাও যাননি। দুবছর বয়সের মেয়ের স্মৃতি বুকে চেপে রেখে রেখে মেয়ের কবরের পাশেই বিলিয়ে দিলেন জীবনের চল্লিশটা বছর। এই চল্লিশ বছর ধরে বুকের ভেতর বয়ে বেরিয়েছেন দুইবছর বয়সি মেয়ের জ্বলন্ত অসংখ্য স্মৃতি। বয়ে বেরিয়েছেন মেয়ের ছোট ছোট হাত-পা, ফিক করে হেসেওঠা হাসির রেখাটা, মসৃণ চিকন দাঁতগুলি, আধপেটা ভাতে-ভরা শুকনো পেটটা, পিটপিট করে ওঠানামা-করা চোখের পাতাগুলো। ক্ষুধায় হঠাৎ হঠাৎ কেঁদেওঠা মেয়ের চোখের নোনাজলগুলোও স্মৃতি করে জমিয়ে রেখে দিয়েছেন কলজেটার ভেতর।


চল্লিশটা বছর কেটে গেলেও সালমা বেগমের দুবছর বয়সি মেয়ের বয়স আর বাড়েনি, সেই দুবছরই রয়ে গেল। পৃথিবীর বয়স চল্লিশ বেড়েছে, পৃথিবীর সবকিছুর বয়সও চল্লিশ করে বেড়ে গেছে। স্রষ্টার সাথে বসবাসকালও চল্লিশ বছর বেড়ে গেল, নিজের শরীরের চামড়ার বয়সও চল্লিশ বছর বেড়ে গেল, তবুও দুবছরের সেই মেয়ের বয়স দুবছরেরই থেমে রইল। সালমা বেগমের দুচোখের কোণে মেয়ের বয়স দুইয়েই আটকে রয়ে গেছে। তাঁর বাকি জীবনেও সেই ছোট্ট পরীর বয়স দুবছরই থেকে যাবে। কেউ মারা গেলে তার বয়স আর বাড়ে না।


আহা জীবন!


বস্তির আশেপাশেই বড়োলোকদের বাসায় কাজ নিতেন সালমা বেগম, দূরে কোথাও কাজ নিতেন না। ওভাবেই কাটত দিনগুলি। কোনও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে আর এক বাড়িতে কাজ নিতেন। তবুও বস্তি ছাড়তেন না। কেউ কখনও জানতে পারেনি, কেন তিনি বেশি বেতনে দূরে কোথাও কাজ পেলেও ফিরিয়ে দিতেন, জানত শুধু তাঁর দুবছরের মেয়েটির কবরের মাটি আর তাঁর হৃদয়। সালমা বেগম এতটাই পাথর হয়ে থাকতেন যে কাউকে কখনও তাঁর দুঃখের কথা বলতেন না। যাদের দুঃখ অল্প কিংবা অতটা বেশি নয়, তারাই শুধু নিজের দুঃখের কথা বলে বেড়ায়। সালমা বেগমদের দুঃখের কথা কেউ কখনও জানতে পারে না। এ পৃথিবীর তীব্রতম ব্যথাটি সব সময় ভুক্তভোগীর বুকের মধ্যে নীরবে আড়ালই থেকে যায়।


সালমা বেগমের বয়স এখন বেড়েছে। শরীরের চেয়ে মনের বয়স বেড়ে গেছে শতগুণ। মানুষের মন শতবর্ষী শরীরের ভার বহন করতে পারলেও, মানুষের শরীর শতবর্ষী মনের ভার বহন করতে পারে না। তাই বয়সের তুলনায় দ্বিগুণ বুড়িয়ে গেছেন সালমা বেগম। শরীরও ভেঙে গেছে একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা আর দৈন্যের চাপে ক্রমপিষ্ট হতে হতে।


এভাবে চলতে চলতে একসময় ২০২০ চলে এল। সালমা বেগমের বয়স সাতান্ন পেরিয়ে ষাট ছুঁই ছুঁই। তিনি গতবছর থেকে মানুষের বাড়িতে আর কাজ করতে পারেন না। অসুস্থতার কারণে কেউ কাজে রাখেও না তাঁকে, কেউ এতটা শীর্ণদেহের মহিলাকে কাজ দেয়ও না। তাই বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে হয় তাঁকে। যাঁর বাড়ি থেকে একসময় তাঁর স্বামী জীবিত থাকাবস্থায় হতদরিদ্র কেউ এসে খালিমুখে ফিরতে পারত না, তাঁকেই এখন বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে চলতে হয়। এর নামই নিয়তি! এই নিয়তি কর্মফলের অনুগামী নয়, কেবলই বিধিলিপির অনুগামী।


গতবছর থেকে ভিক্ষা করতে শুরু করেছেন সালমা বেগম। এত বছর ধরে যাদের কাজ করে দিয়ে সেবা দিয়েছেন তিনি, তাদের কেউই এখন আর খোঁজ নেয় না। কারও মোবাইল থেকে ফোন করলেও তাঁর কণ্ঠস্বর বুঝলে কেটে দেয়। যতক্ষণ কাজ ততক্ষণ খোঁজ, কাজ নেই তো খোঁজও নেই। এই পৃথিবীতে অনেকেরই অনেক টাকা আছে অপচয় বা অপ্রয়োজনীয় খরচ করার জন্য, তবু সালমা বেগমদের দেওয়ার মতো একটি টাকাও ওদের পকেটে নেই। মাঝে মাঝে কেউ কেউ বাসায় এসে কিছু খাবার-টাবার দিয়ে যায়। খাবার একদম ফুরিয়ে গেলে রাস্তায় ভিক্ষা করতে বের হন সালমা বেগম। দিন দুয়েক চলার মতো টাকা হলে আর বের হন না। ওটা খেয়েই কাটান। শেষ হয়ে গেলে আবার ভিক্ষায় যান। এভাবেই চলছে।


২০১৯-এর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে চীনে জীবনঘাতী ভাইরাস কোভিড-নাইনটিনের সংক্রমণ হয়। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। ক্রমেই এই বেপরোয়া সংক্রমণ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে চলে যায়। এ পৃথিবীতে যারা বেঁচে আছে, তারা বা তাদের পূর্বপুরুষদের কেউই এমন দুঃসময় কখনও দেখেনি। এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারাপৃথিবীর দেশে দেশে জারি হলো লকডাউন।


সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হলো। বের হলেই পুলিশের কড়ানজরদারিতে পড়তে হবে। রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, অসহায় ও দুঃস্থ মানুষ ঘরে বন্দিদশায় জীবন কাটাতে লাগল। ওরা তো দিনের খরচ দিনেই জোগাড় করে, সে টাকা দিয়েই ওদের মুখের খাবার জোটে। ওদের তো আর জমানো টাকা নেই, তাই এই লকডাউনে ওদের কারও ঘরেই কোনও খাবার নেই।


যাদের জমানো পয়সা আছে, বেতন বন্ধ হয়নি, ওরা বেশি বেশি সদাই কিনে ফ্রিজভর্তি করে রেখে আরামসে ফ্যান-এসি’র হাওয়া খাচ্ছে। যারা কাজ করতে বের হতে পারছে না, বের হলেও কোনও কাজ পাচ্ছে না, ওদের জন্য মাঝেমধ্যে এখান থেকে ওখান থেকে সহায়তা আসে অতিসামান্য কিছু। ওতে নাহয় চলে কিছুদিন, কিন্তু তারপর? পেটের ক্ষুধা কি লকডাউন বোঝে, না কি ভাইরাস চেনে? পেটের সীমান্তজুড়ে এক খাদ্য বাদে পৃথিবীর সবকিছুই, সব নিয়মই---অখাদ্য, অপ্রযোজ্য, অপ্রয়োজনীয়।


এমন বিরূপ পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোটি কোটি টাকার ত্রাণসহায়তা দেওয়া হলো। দরিদ্র, দিনমজুর, খেটে-খাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য দেওয়া ত্রাণসহায়তার অর্ধেকই বড়োকর্তারা হাপিস করে দেওয়ার পর, বাকিটা জনপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ওদের পেটে বাকি অর্ধেক ত্রাণের অর্ধেকটা চেটেপুটে হজম হয়ে যাওয়ার পর বাদবাকি উচ্ছিষ্ট-ত্রাণ এলাকার অভাবী অনাহারী মানুষগুলোকে দেওয়া হয়। সেখানেও হয় না সুষমবণ্টন। অনেক প্রকৃতই দরিদ্র জনগোষ্ঠী কোনও ত্রাণই পায় না। ত্রাণবিতরণের নামে চলে আত্মপ্রচার, ফটোসেশন, হরিলুট। ফেসবুক সরগরম হয়ে ওঠে বড়ো বড়ো বুলিতে। নেটিজেনরা নানান প্রতিবাদী পোস্ট করতে থাকেন, যেগুলির পেছনে মূল উদ্দেশ্য লাইক - কমেন্ট - শেয়ার পাওয়া, প্রতিবাদ করা নয়। কিংবা প্রতিবাদ করাই উদ্দেশ্য হলেও সে প্রতিবাদের ফল আদৌ কিছু হচ্ছে কি না, তার দিকে খেয়াল রাখার সময় বা ক্ষমতা সম্মানিত নেটিজেনদের নেই। দুঃসময় এলে ফেসবুকে ভণ্ডদের দৌড়াদৌড়ি অনেক বেড়ে যায়।


ওদিকে বস্তায় বস্তায় ত্রাণ এলেও যাদের তা পাওয়ার কথা, তারা পায় তার সামান্যই। অনেক বড়ো নেতার গুদামে জমা হতে থাকে বস্তায় বস্তায় ত্রাণের চাল, ডাল। অন্যদিকে খাবার না পেয়ে দুর্গত মানুষ আরও দুর্গত ও অসহায় হয়ে পড়ে। ওরা কিছু বলতে পারে না, কেননা প্রতিবাদ করার জন্য জন্ম ওদের হয়নি, ওদের জন্ম হয়েছে চুপচাপ সহ্য করার জন্য। হুজুররা দয়া করে যা দেন, ওদের জন্য সেটাই অনেক কিছু! এইটুকু সহ্য যারা করতে পারছে না, তাদের কেউ কেউ অভিমানে আত্মহত্যা করছে। অভিমানটা কার উপর, মৃত্যুর আগে সেই দুই-একজন অভিমানী মানুষ তা জানতে পারেনি।


সারাদেশে লকডাউন পরিস্থিতিতে কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। সালমা বেগম ভিক্ষা করতেও পারছেন না। কেউ এখন তাঁর খোঁজ নিতেও আর আসে না। আগে যা-ও কেউ কেউ কিছু খেতে দিয়ে যেত তাঁকে, কিন্তু এখন তো সে খাবারটাও আসে না তাঁর ঘরে। সালমা বেগম শেষ কবে পেটভরে ভাত খেয়েছেন, তাঁর মনে নেই।


গত তিনদিন ধরে ঘরে একমুঠও চাল নেই। মুড়ি আর পানি খেয়ে বেঁচে ছিলেন কোনওমতে, এখন তা-ও নেই। সালমা বেগমের হাড়জিরজিরে শরীরটা আর চলছে না। সামান্য কিছু চাল থাকলে পানিতে ফুটিয়ে নুন দিয়ে হলেও খাওয়া যেত, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা পাওয়ারও কোনও উপায় নেই।


থুড়থুড়ে শরীরটাকে কোনওমতে ঘর থেকে টানতে টানতে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বাটি নিয়ে রাস্তায় বসেছেন সালমা বেগম। যে-ই না তিনি রাস্তায় বসেছেন, ঠিক তখনই কোত্থেকে জানি তিন-চার জন এসে তাঁকে তাড়িয়ে দিল। শহরে লকডাউন চলছে, এখন বের হওয়া যাবে না। ওরা তাঁকে রাস্তায় বসতেই দিল না। অথচ ওদের কেউ খোঁজই নিল না, এই বৃদ্ধা ভিখিরিনীর ঘরে আজ রান্না হয়েছে কি না, তিনি না খেয়ে আছেন কি না।


রাস্তায় কোনও জনমানবও নেই যে সালমা বেগম একমুঠ ভাত কারও কাছ থেকে খুঁজে খাবেন। কোনও উপায় না দেখে অগত্যা কাঁপতে কাঁপতে ভাঙা ভাঙা পায়ে সালমা বেগম ঘরে ঢুকে হাত-পা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে পড়লে যদি ক্ষুধার জ্বালা থেকে একটু বাঁচা যায় আরকি!


গত তিনদিন ধরে দুমুঠ করে মুড়ি আর একগ্লাস জল খেয়ে আছেন তিনি। এখন তো মুড়িও শেষ। এখন কী খাবেন সালমা বেগম? এ এমন সময়, যে সময়ে ভিক্ষাও মেলে না। হায়! গতমাসে কারা জানি বস্তিতে এসে দুই কেজি চাল দিয়েছিল তাঁকে। সাথে ডাল, পেঁয়াজ। দুই কেজি চালে কত দিনই-বা চলা যায়! এই মুহূর্তে ঘরে কিছুই নেই বলতে কিছুই নেই! আজ থেকে উপোস থাকতে হবে। এই বুড়োবয়সে উপোস! এই জীর্ণশীর্ণ শরীরে তা কি সহ্য হয়! আহারে জীবন! এ জীবনে কেন যে সালমা বেগমদের নিঃশ্বাসের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়!


সালমা বেগমরা খেতে না পেয়ে অনাহারে থাকে। ওদিকে বড়ো বড়ো লোকজন সালমা বেগমদের চাল-ডাল লুট করে গুদামভর্তি করবেন, এসব বেচে সে টাকা দিয়ে নিজের উপচে-পড়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টটাকে আরও মজবুত করবেন, দরকার হলে টাকা জমিয়ে জমিয়ে অহেতুকই পচিয়ে ফেলবেন, তা-ও ক্ষুধার্ত সালমা বেগমদের খেতে দেবেন না। কোনওভাবেই দেবেন না।


এভাবে আরও দেড় দিন। চোখের জলের সাথে কলের জল মিশিয়ে খেয়ে খেয়ে সালমা বেগম এখনও নিঃশ্বাস আটকে রেখেছেন। অতিরিক্ত পরিমাণে ক্ষুধার্ত থাকার কারণে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছেন না।


রাত এসে দিন যায়, দিন ফুরিয়ে রাত গড়ায়। সালমা বেগমের ক্ষুধার তীব্রতা কলের জলের স্রোতে আরও হু হু করে বাড়তে লাগল। ক্রমেই তিনি দু্র্বল থেকে আরও দুর্বল হচ্ছেন। ক্ষুধার তাড়নায় তিনি কথাবলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললেন। পাত্র থেকে জল ঢেলে খাবেন, শরীরে এমন শক্তিও আর নেই।


সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। সালমা বেগমের সূর্য যেন আর উঠতেই চায় না। সূর্যের প্রখরতা বেড়ে চলছে, সাথে বাড়ছে গ্রীষ্মের খরতাপ। বস্তির এই নিভৃতকোণে একজন সালমা বেগমের জীবনের রশ্মি এই রৌদ্রেও যেন ঝাপসা থেকে আরও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তাঁর জীবনের দিন আর রাত এক হয়ে গেছে, অকেজো শরীরটা ক্ষুধার রশিতে ঝুলে গিয়ে বিছানাতেই আটকে গেছে।


এভাবে আরও দেড় দিন সম্পূর্ণ অনাহারে কাটল। চোখের কোটরে চোখ ঢুকে চামড়ার ভাঁজে ঢেকে গেছে তাঁর দুচোখ। গালের দুপাশ ভেঙে দাঁতের মাড়ির অবস্থান চামড়ার উপরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সালমা বেগমের গায়ে কয়েকটা মশামাছি বসেছে। ওদের তাড়ানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তিনি এই পৃথিবীর সমস্ত রকমের ঘূর্ণন চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছেন এখন।


সালমা বেগমের শেষ এই মুহূর্তেও একমুঠ ভাত খেতে খুব ইচ্ছে করছে। একমুঠ ভাত খাওয়া---এটাই তাঁর জীবনের শেষইচ্ছা। বিছানায় প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতরাতে কাতরাতে সালমা বেগম মনে মনে ভাবছেন, শুকনো ঠোঁটদুটোতে একটু ভাতের ছোঁয়া লাগলেই তিনি বুঝি এখুনিই জেগে উঠবেন! চোখের সামনে একগ্রাস পরিমাণও ভাত দেখলে সেই ভাতটুকু খাওয়ার শক্তি তাঁর গায়ে এখনও ভর করবে! আহা আশা!


খোদার কাছে জীবিত থাকতেই মৃত্যুর পর প্রাপ্য বেহেশতকেও একপ্লেট ভাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়ে হলেও সালমা বেগম ঠিক এই মুহূর্তে ভাত খেতে চাইছেন। শুধুই ভাত! শুকনো হলেও হবে। একমুঠ ভাত পেলে নুন মিশিয়ে গপাগপ খেয়ে নেবেন সালমা বেগম। না, সেটুকুও মিলছে না। পৃথিবীভর্তি এত এত ভাত, বড়োলোকদের বাসাভর্তি ভাতের গুদাম, তবুও যেন এই শেষবেলায়ও একগ্রাস নুনেমাখা ভাত মিলছে না সালমার। যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়ছে তো বাড়ছেই! চোখের কোণ বেয়ে টপটপ করে দুই-চার ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে। ঝরেপড়া সে অশ্রুতে কতশত ব্যথা মিশে আছে, তার খোঁজ কেউই জানে না।


সালমা বেগমের আশেপাশে কেউ নেই। মোতালেব একদিন কথা দিয়েছিল, পাশে থাকবে---সালমার হঠাৎ মনে পড়ে যায়। রুগ্নখাটের পাশে তাঁর দুবছরের পরীটিকে দেখতে পাচ্ছেন সালমা! সে হাসছে, মা মা বলে ডাকছে। মোতালেব কোথায় গেল? একটু আগে না ছিল এখানে! সালমা বেগমের ঠোঁট কাঁপছে…।


যন্ত্রণার তীব্রতা বাড়তে বাড়তে ক্ষুধার চাবুকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হয়ে পুরোদমে শক্তিহীন হয়ে গেলেন সালমা বেগম। প্রতিটি সেকেন্ডই কাটছে ভয়ংকর মৃত্যুযন্ত্রণায়। পেটের শুকনো চামড়াটা আরও শুকিয়ে শুকনোপাতার মতো ভেতরে তিন ইঞ্চি দেবে গেছে। দুইগালের মাংসগুলো কুঁচকে গিয়ে মাড়ির দাঁতগুলো স্পষ্ট গোনা যাচ্ছে একটা একটা করে। ঠোঁটদুটো কাঠের মতো শক্ত হয়ে সরু দুই শুকনো নদীর মতো সামনে দুইমাড়ির গোড়ায় গিয়ে আটকে আছে। এই আটকে-থাকা দুই ঠোঁটের ফাঁক ভেদ করে সামনের সবকটা দাঁত চোয়ালের সীমানা ডিঙিয়ে বেরিয়ে এসেছে।


মালতীলতার ডগার মতো যে শরীর, সে শরীরে মাংসের ছিটেফোঁটাও নেই আর। শুকনো চামড়াটা পাতলা শাড়ির মতো হাড়গোড় আর কঙ্কালটাকে ঢেকে রেখেছে। ওই চামড়ার তলে কেবল ২০৬টা ক্ষুদ্রাকৃতির কাঠামো বাদে আর কিছুই নেই। চামড়ায়-মোড়ানো একটা জ্যান্তকঙ্কাল! অতৃপ্ত - ক্ষুধার্ত - দুঃখী একটা প্রদীপ, একটা নিভু নিভু শিখা।


হঠাৎ সালমা বেগমের পেটের তলানি থেকে বুক পর্যন্ত কেমন একটা প্রচণ্ড হ্যাঁচকা টান দিল! এই টানে শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে পৌঁছে যাচ্ছে তীব্র মৃত্যুযন্ত্রণা। কলজের ভেতরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। সমস্ত যন্ত্রণার বিরুদ্ধে শক্তিপ্রয়োগ করেও সালমা বেগম কেবলই নিঃশ্বাস নিতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না। বন্ধ হতে-চাওয়া দমের সাথে অনবরত যুদ্ধ করেও পেরে উঠছেন না কিছুতেই!


না, তিনি আর পারছেন না!


দাঁতমুখ খিঁচুনি দিয়ে চোখদুটোকে বড়ো করে মুখটাকে ঈষৎ হাঁ রেখেই অস্থিচর্মসার শরীরটা থেকে প্রাণবায়ুটা বেরিয়ে গেল। তাঁর মুখ দিয়ে সামান্যতম শব্দও বের হলো না মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে। শুধু প্রাণটা বেরিয়ে যেতে যেতে তাঁর চোখে শেষবারের মতো ভেসে উঠেছিল অল্পসময়জুড়ে পাওয়া স্বামীর সুখ, চল্লিশবছর ধরে পাহারায়-রাখা দুইবছরের আয়ুতে স্থির হয়ে-যাওয়া মেয়ের জাদুমুখখানি।


সালমা বেগম নন, তাঁর লাশটা এখন খাটের উপর। তখনও তাঁর চোখের কোণ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে। এই জলে কত ক্ষুধার যন্ত্রণা মিশানো আছে, সে খবর পৃথিবীর কেউই জানতে পারেনি। পৃথিবীর এত এত ব্যস্ততার ভিড়ে সালমা বেগমের খোঁজ কেউ আর রাখেনি। সালমা বেগমরা মৃত্যুর পর সম্মানিত নেটিজেনদের উপাদেয় স্ট্যাটাসে পরিণত হন। এই তুচ্ছ মনোযোগটুকু পেতেও সালমা বেগমদের মরতে হয়।


সমস্ত পৃথিবীর মুখে লাত্থি মেরে, সমস্ত নিয়মের মুখে থুতু ছিটিয়ে, একরাশ ঘৃণা উৎসর্গ করে, একপৃথিবীসমান ক্ষুধা আত্মায় ধারণ করে সালমা বেগম এই ঘৃণ্য অভিনয়মঞ্চ থেকে মুক্তি নিলেন। এ মুক্তি শান্তির, সুখের, স্বস্তির। এ পৃথিবীতে ক্ষুধা থেকে মুক্তির চাইতে মহত্তম মুক্তি আর কী আছে? সালমা বেগমের এই মুক্তি চিরদিনের মুক্তি। অসহ্য ক্ষুধায় কাতরানোর থাবা থেকে মুক্তি।


বস্তির সেই কোনায় সালমার নিথর হাড্ডিসার মৃতদেহটা ওভাবেই পড়ে ছিল চারদিন। পচে-যাওয়া শরীরের গায়ে পোকায় কিলবিল করছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরে-যাওয়া সালমার হাড্ডি পেঁচিয়ে-থাকা সামান্য মাংস ও শুকনো চামড়াটাকে ঘিরে ধরে কিলবিল করে খেয়ে ক্ষুধা মেটাচ্ছে অগনিত পোকার দল। এক ক্ষুধার্তের শরীর খেয়ে ক্ষুধা মেটাচ্ছে অন্য ক্ষুধার্তরা। ওরা খেয়ে নিচ্ছে সালমা বেগমের গাল, ঊরু, পেট, নাড়িভুঁড়ি…এমনকি কলজেটাও, যে কলজেটা অজানা হাজারো ব্যথায়, যন্ত্রণায় ঠাসা ছিল। জীবিতাবস্থায় নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে না পারলেও সালমা বেগম মৃত্যুপরবর্তী সময়ে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর ক্ষুন্নিবৃত্তির পাকাবন্দোবস্ত করে দিয়েছেন।


পঞ্চম দিন। পচা-লাশের দুর্গন্ধে চারপাশ রি রি করছে। এক লোক এই উৎকট দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে খুঁজতে সে ঘরে ঢুকে পচাগলিত, পোকায়-ভরা বিকৃতশরীর দেখে ওয়াক থু শব্দে বমি করে সেখান থেকে দৌড়ে চলে এল।


পুলিশের গাড়ি পৌঁছালো। সালমা করোনায় মারা গেছে সন্দেহে কেউ লাশদাফনের জন্য লাশের ধারেকাছেও যাচ্ছে না। পুলিশ লাশের স্যাম্পল নিয়ে তা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো। বস্তির লোকজন লাশটাকে প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়িয়ে দূরের ভাগাড়ে গর্ত করে সেখানে ছুড়ে ফেলে মাটিচাপা দিয়ে দিলো। এই পৃথিবীতে ক্ষুধার কাছে কোভিড-নাইনটিন যে কতটা দুগ্ধপোষ্য শিশু, তা ওদের কারও মাথায়ই আসেনি। আর আসবেও না!


রিপোর্ট এল। সালমা বেগম করোনায় মারা যাননি, রেকর্ড হলো। এই মানুষটি ঠিক কী কারণে মারা গেলেন, তা কেউই জানল না। মানুষটির মৃত্যুর সঠিক কারণ রেকর্ডের খাতায় কোথাও উঠে আসেনি। রিপোর্টে লেখা হলো: নরমাল-ডেথ! আহা, কী সহজেই এইসব পোশাকিনাম খাতায় উঠে আসে…!


ঠিকই তো আছে! ক্ষুধায় গরীব মরবে, এর নাম নরমাল-ডেথ ছাড়া আবার কী!


ছানিপড়া বিবেকের চোখ আর ঘুণেধরা সমাজের মাথায় একপৃথিবী দায় ছুড়ে দিয়ে অহরহই অজানা অচেনা অসংখ্য সালমা প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঠায় মরে যাচ্ছে। এই হিসেব কখনও…জিডিপির খাতায় উঠবে না, তুখোড় সাংবাদিকের কলম জানতেই পারবে না, প্রাজ্ঞ নেটিজেনদের দামি ফেসবুক স্ট্যাটাসে আসবে না।


এই সালমারা শেষদিনের শেষবিচারের জন্য অপেক্ষা করছে। সালমাদের মুখের ভাত লুট করে, সালমাদের খুন করে যে বড়োবাবুরা তাদের চালের গুদামে জমিয়ে যাচ্ছে অনাহারীদের হাড়গোড়…যুগের পর যুগ ধরে, তাদেরও একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সেইদিন খোদার দরবারে সালমাদের সমস্ত ক্ষুধা নিখুঁতভাবে মাপা হবে। সেইদিন এইসব খুনের বিচার হবে। সেই শেষবিচারে রক্ষা পাবে না কেউই!