যে ঘরে ওদের ঢোকাই বারণ

 আমি যখনই তোমায় লিখতে যাই, ভাবতে বসি,
এতটা দরদ কোথায় পাই? তোমায় আবার লিখব কী!
তুমি তো আমার সেই ঘরটা, যেখানে ইচ্ছে হলেই আরাম করে ঢুকে পড়া যায়!
আমি যে তোমার মধ্যেই থাকি, আমাদের মাঝে আড়ালই-বা কী!
বুকটা তোমার…আমারই বালিশ--ওখানেই মাথা, ওখানেই নালিশ!
আমার নিজের বলতে নেই তো কিছু, যা-কিছু নিজের, সব তোমারই!
ওই হাতটা রেখেই দেখো…এই বুকের ঠিক মাঝখানেতে…
মেলাও নিজেই, সেখানে কেবল তুমিই আছ!
আমি যে তোমায় জানতে চাই, তাই তো নিজের বুক খুঁড়ি!
সভ্যতা খুঁড়ে ইতিহাস মেলে, সাগর খুঁড়লে ঝিনুক,
চাঁদ খুঁড়লে কেবল নুড়িপাথরই…খুঁড়লে আমায়…আর কিছু না-ইবা মিলুক,
তোমাকে তো পাবেই পাবে!
 
কীই-বা আমি লিখব, বলো, তোমায় নিয়ে!
আমার মাথায় শব্দ আছে…বেশি নয় তো…মাত্র কটাই,
লিখতে বসি, তার ফুরোয় সবই, হই তখন…নিজের কাছেই জব্দ ভীষণ!
আমি সাগরপারে দাঁড়িয়ে থেকে তীর আঁকি,
আমি ভোরের আলোর আখর দিয়ে হিম আঁকি,
আমি নদীর বুকে ভাসতে গিয়ে জল আঁকি,
আমি বনে-পাহাড়ে ঘুরেঘুরেই গাছ আঁকি,
আমি কষ্ট গিলে হেসেখেলে নীল বেদনার মুখ আঁকি,
আমি দুঃস্বপ্নে মগ্ন থেকেও সোনালি দিনের স্বপ্ন আঁকি,
আমি পেটের ভেতর ক্ষুধা রেখে যত্ন করে ঘুম আঁকি,
আমি আকাশের চোখে চোখটা রেখে রংতুলিতে তারা আঁকি,
আমি রৌদ্র দেখে তুলোর মতো ভাসতে-থাকা মেঘ আঁকি,
আমি ভুল কাউকে ভালোবাসলে চোখের জলে মায়া আঁকি…
এই মনে যা আসে, এই দুচোখে যা ভাসে, ওই দুঠোঁটে যা হাসে…
কালিতে, কলমে…রঙের তুলিতে কাগজের পিঠ নিয়ে নেয় তা খুব অনায়াসে!
তবু কেন…যখন লিখি তোমায়…খুব চেষ্টাতেও…
বর্ণ কি বোধ…ফুরোয় সবই! সত্যি আমি জানি না, কেন!
বোধহয় তুমি অনেক বিশাল…এই হাতের ছোট্ট মুঠোয় ধরে কি অতো?
 
আমি বহুকাল ধরে নিজের ঘরেই আগন্তুক হয়েই ছিলাম!
যে দিন তুমি আমার হলে, এ ঘরও আমার নিজের হল,
সে দিন আমার সকল অভাব ফুরোলো যেন!
আমার যত কষ্ট দুঃখ, বেদনা ক্লান্তি, রাগ অনুযোগ, স্বপ্ন মায়া, সুখ স্বস্তি…
ওসবের একটা জায়গা হল…ওরা একটা ঠিকানা পেল!
আমি এখন নির্ভাবনায়…নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারি!
ওসব আর হারিয়ে যাবার ভয়টুকু নেই!
এই যে তোমার মধ্যে ঢুকি…দিনে কি রাতে…টুক্‌ করে রাখতে ওসব,
তুমি কি সত্যি টের পাও না…একটুখানিও?
 
বাইরে যখন জোছনা দারুণ…তখন ভাবি, আজ তো ছুটি!
আজকে আমি তোমায় নিয়ে ভিজব চাঁদে ইচ্ছেমতন!
আমি কেবল তোমাকে ভেবেই ব্যস্ত হই…সকাল হলে ব্যস্ত হই,
দুপুর ডাকলে ব্যস্ত হই, ব্যস্ত বিকেল পিছলে যখন সন্ধে হয়,
তখনও খুবই ব্যস্ত রই…রাত নামলেও হয় না ছুটি…তোমাতেই খুব ব্যস্ত রই!
সবারই তো ছুটি হয়…ছুটিতে তো সবাই যায়…তখন ওরা ঘর গোছায়,
কাপড়টা ধোয়, যত্ন করে দোর সাজায়…আমার অমন ছুটি কই?
আমার বুঝি অবসরে থাকতে নেই? ছুটির ঘণ্টা শুনতে নেই?
আমার বুঝি নিজের কোনও ঘর নেই? সে ঘরে কোনও কাজ নেই?
আমার দেহে ক্লান্তি বুঝি আসতে নেই? এই মনটার বেড়াতে বুঝি যেতেই নেই?
 
আজকে নাহয় আমার একটা ছুটি হোক!
আজ সারাদিন ঘরে থাকব…রঙের ছটায় তোমায় আঁকব।
আচ্ছা, তুমিও যে দিন ছুটিতে থাক,
ভুল করেও কি আমায় আঁক?
আজকে আমার তোমার সাথে সত্যি আড়ি!
এই যে আমায় এত উপহার পাঠাও বাড়ি,
তার বদলে স্পর্শটা পাঠাও না কেন?
ওসবে তোমায় ঘ্রাণ নেই তো,
তবে ওসব দিয়ে আমার কী কাজ?
 
আজটা নাহয় ঝগড়া করেই কাটিয়ে দিই!
অনুযোগে, অভিমানে রাত অবধি দিন কাটাই!
আচ্ছা, আমায় তোমার দেখতে বুঝি মন চায় না?
পাশে বসে আধটু সরে একটু ছুঁতে, চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে…
যাকে অমন করে পাগলী ডাক, একটু তার কথা শুনতে…একটিবারও মন চায় না?
এই যে এত বকছি কেমন অনর্গলই, খুব বকে দিয়ে থামিয়ে দিতে মন চায় না?
তুমি কেমন একটা কী যেন! বল না কিছু, চাও না কিছু…তোমার বুঝি প্রশ্ন নেই?
যদি তা না থাকে, তবে এত উত্তর পেটের ভেতর…কাকে দেই? আমার যে কোনও মানুষ নেই!
আজ তো আমার ছুটি, মশাই…তাই মনের সুখে করছি লড়াই!
 
এই, তোমার নাক বোঁচা, গালটাও তো থ্যাবড়া দেখি!
চোখের কোণটা ট্যারা নাকি? চুলও তো দেখি অর্ধেকই নেই!
এই ছেলেটা! তুমি এত মোটকু কেন হাতির মতন?
ঘাড়টা কেমন নামিয়ে হাঁট, পিঠটা তোমার কুঁজো না তো?
ওই থুতনির পেছনে দাড়ি কই? এই শার্টটা পেলে কোথায়…কই?
প্যান্টও দেখি জবড়জঙ্গ! জুতোতে তো ফিতেই নেই! দোকানে গেলে এ সব বুঝি ফ্রিতে দেয়?
এই ছেলে, তুমি চুপ কেন? তোমার বুঝি দাঁত নেই? কথা বলতে তো-তো কর?
এই, তোমার কোনও ঝগড়া নেই? আমার সাথে বাধিয়ে ফেলার ঝামেলা নেই?
 
আচ্ছা, তুমি এমন কেন? আসো না, একটা ঝগড়া হোক!
তুমুল, ভীষণ ঝগড়া হোক! আমি তখন কাঁদব খুব!
বৃষ্টি নামবে ঝুপঝুপাঝুপ! তোমার সাথে ঝগড়া করে ইচ্ছে করেই হেরে যাব!
তোমায় আমি ভালোবাসি তো! ভালোবাসলে ঝগড়া হয়,
ঝগড়া হলে কান্না হয়, কান্না হলে…আদর করে অভিমানটা ভাঙাতে হয়!
বোকা ছেলেটা! প্রেম করলে এ সব কিন্তু জানতে হয়!
জানো সবই…তবু দেখাও তো না! আমি যদি কেঁদে ফেলি,
তুমি কি তখন হাসবে খুব? না কি কাছে ডেকে আদর করে
মান ভাঙাবে?
…আহা, ভারি মজার…এমন একটা ছুটির দিন…কবে আসবে?
 
সেই দিনটা অফিস থেকে ছুটি নেব।
চুটিয়ে সে দিন করব প্রেম,
কানামাছি, লুকোচুরি…খেলব সব!
তোমার বুকে ঘষব নাক,
এক ঘুষিতে ফাটাব ভুঁড়ি,
ঘাড়ের পিছে কামড়ে দেব,
আঙুলে শরীর জড়িয়ে নেব!
আরেকটা দিন আবারও যদি ঝগড়া হয়,
এক সমুদ্র কান্না হয়, তবে শাড়ি পরে সাজব খুব!
হাত ভর্তি করে মেহেদি দেব, যত্ন করে চুল বাঁধব,
দুই পায়ে আলতা পরে…তোমার আসার অপেক্ষা করব।
সে মেহেদির পাকা রঙটা জলে ধুয়ে মেশার আগেই…
সে দিন নাহয় বাসায় একটু ফিরো আগেই!
আমায় দেখে জড়িয়ে ধোরো, আদর কোরো, কানেকানে আস্তে বোলো…
বোকা মেয়ে! এমনি করে ঠোঁট উল্টে, গাল ফুলিয়ে লক্ষ্মী মেয়ে কাঁদে নাকি?
 
আমার এই ঘরটা বেশ বড়ো, জানো?
কেমন বড়ো? এক পৃথিবী সমান বড়ো!
তুমি না এলে এই বড়ো ঘর ভরব আমি কেমন করে?
আচ্ছা, তোমার কেন ঝগড়া নেই? একটুখানিও দাবি নেই?
আমার সাথে রাগ নেই? আমি না এলেও অভাব নেই?
…তোমার বুঝি আমার প্রতি টান নেই?
থাকেই যদি, কেন দেখাও না তা? লুকিয়ে রাখ?
দাঁড়াও, এবার একটা ছুটি হোক…দেখবে তখন,
ভালোবাসাকে ছুঁই কেমন!
 
তুমি যখন চুপ থাক, কথার উত্তরও পাই না আর,
তখন আমি খুব কাঁদি! এই যে এত ম্যাথস বোঝ, অভিমানটা কেন বোঝ না?
দেখো, একদিন ঠিক ফুরিয়ে যাব!
সে দিন আমার কথাও সব ফুরিয়ে যাবে!
সে দিন তুমি মুক্ত, স্বাধীন…তবু…
আমার ঘরটা কিন্তু সাজিয়ে রেখো যত্ন করেই!
ঘরটা যে আমার আপন খুব…ওকে
সময়সময় আদর কোরো…ভেঙে ফেলো না, পুড়ে ফেলো না,
ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে বুকের মধ্যে আগলে রেখো!
সেখানে কেবল তুমিই থেকো!
আর যেন কেউ ভুল করেও ঢুকে না পড়ে!
সে ঘরটা কেমন, তুমিই বুঝো…বুঝতে দিয়ো না আর কাউকেই!
যেমনি এখন, তেমনি তখনও…সে ঘর আমার…কেবল আমার একারই ঘর!