যে ছায়া আলোর অধিক/ আট

 
আমাকে বাঁচাতে ইচ্ছে করে না কারও! আমি বেঁচে থাকি, এ দায় এই পৃথিবীর একটা মানুষেরও নেই। এটা ভাবলেও আমার বুক কাঁপে!
আমার স্টুডেন্টের মা মারা গেছেন! ছোট মেয়েটা ক্লাস থ্রিতে পড়ে! চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখার পর থেকে সে ট্রমাটাইজড হয়ে আছে! কিছু মুখে দেয় না, সারাদিন ঘরের সবাইকে মারে, দুপুর তিনটা-চারটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমায়!
ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বন্ধু আছে?
উত্তর এল, নাহ্! আমি একা থাকতে ভালোবাসি!
আমি ওর বাসায় পড়াই বলে ও আমাকে মারেনি। আমার ছাত্রী বলল, আপু, আজ ওকে ভাত দিইনি! দেখো না, ও আমার সারাশরীর মেরে কী করেছে! আমি বললাম, কোথায় সে? ওকে ডাকো।
ও আমার সামনে এল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, সোয়েটার কেন পরলে না? ঠান্ডা লাগছে না তোমার? বলল, সবার মা তাদের সোয়েটার পরিয়ে দিয়েছে! আমি বললাম, তাতে কী? তোমার আপু তো তোমাকে সোয়েটার পরিয়ে দিতে চেয়েছে! পরলে না কেন?
এবার সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বলল, আমি বলেছি, পরব না, কিন্তু আমাকে কেন জোর করল না সে! মা তো সব সময় জোর করে পরিয়ে দিত আমি পরতে না চাইলেও। আমি খেতে না চাইলে এখন আর কেউ আমাকে জোর করে খাওয়ায় না। কেন খাওয়ায় না? মা তো সব সময় জোর করে খাইয়ে দিত। কেন আমাকে কেউ এখন আর জোর করে না? কেন আমাকে কেউ আর ভালোবাসে না?...বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
ওই ‘জোর’ ছোট্ট কথাটার মধ্যে যে কতশত অভিমান, অভিযোগ লুকিয়ে ছিল পুরো পৃথিবীর প্রতি, সেই কান্নার শব্দ ভেঙে আমি সেই অর্থ খুঁজে পেয়েছিলাম! তাই চোখের সামনে যা দেখা যায়, যতটুকু বোঝা যায়, তা-ই সব সময় শেষকথা হয় না! Outward appearance does not express the real character of a man. আমি আমার ছাত্রীকে বললাম, কোনও ভিখিরিকে নয়, ভগবানকেও নয়, বরং ওকে ভালোবাসো! তোমার বোনের মধ্যেই ভগবান আছেন। ওকে এতটাই ভালোবাসো যে ছেড়ে যেতে চাইলেও ছাড়বে না! জোর করতে শেখো। ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষকে জোর করতে হয়। ভালোবাসা কিছু জোরের দাবি রাখে। জোর না করলে মানুষ খুব অভিমান করে বসে। দেখলেই তো!
She needs to be loved like me! ‘অ্যা মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের জেরিকে লেখিকা কোনও কিছু গিফট দিলে জেরি লেখিকার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত! সে জানত না কীভাবে ধন্যবাদ দিতে হয়! কিন্তু লেখিকা তার চোখের দিকে তাকালে দেখতে পেতেন--He only looked at the gift and at me, and a curtain lifted, so that I saw deep into the clear well of his eyes, and gratitude was there, and affection, soft over the firm granite of his character.
লেখিকা যখন বললেন, Have you seen her, Jerry—lately? জেরির উত্তর ছিল, I see her every summer. She sends for me. জেরি একটা কল্পনার রাজ্য তৈরি করে সেখানে তার মায়ের সাথে কমিউনিকেট করত! জেরির মা ছিল না, কিন্তু মায়ের সাথে কথা বলতে, মায়ের ভালোবাসা অনুভব করতে তার মনের সংবেদনশীলতাই যথেষ্ট ছিল। আমি কোনও দিন আপনাকে দেখিনি! হয়তো আর দেখবও না! তবুও একটা কল্পনার জগত তৈরি করে আমি আপনার সাথে কথা বলি! আমার ঈশ্বর জানেন, এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমি কতটা অকপট, সরল, আন্তরিক! Eternal bonding does not require physical presence. If I leave you someday, can you ever feel my stupidity, childish behaviour & unconditional love?
আমি জানি, আমি একটা বিরক্তিকর মানুষ আপনার কাছে! তবুও তো কিছু কথা থাকে! মেসেজগুলো কিন্তু মেসেজ না, অ্যা পিউর ডেমনস্ট্রেশন অব মাই ফিলিংস! প্লিজ, একটু বুঝুন! Don’t be like others. আপনি আমাকে কল দিয়েছিলেন কেন? অপমান করার জন্য? না কি ভুল বোঝার জন্য? একজন শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, নীরজা, কাউকে ঠিক ততটুকই মূল্য দিবে, যতটুক তুমি তার কাছ থেকে পাবে! এই তিন মাসে আপনার জন্য যত ভালোবাসা মিশিয়ে মেসেজ লিখেছি, আর আপনাকে ভেবে যতটুক কষ্ট পেয়েছি, সেই সময়টা বই পড়লে অনেক কাজ হতো! জীবনে আমার মতো সময় কেউ হারায়নি! আমি এক ভুল বারবার করি! কেন এমন আমি!
আপনাকে স্বস্তি দিলাম, যান! ভালো থাকবেন। একা একা, আমাকে ছাড়া।
একজনকে ঠিক ততটাই মূল্য দেয়া উচিত, যতটা আমরা তার কাছ থেকে পাই! অনুভূতি ঠিক ততটাই ব্যয় করা উচিত যতটা আমাদের জন্য অন্য একজন রাখে! একতরফা কিছুই থাকে না চিরকাল! এই সব সহজ সত্য ২৬ বছরে না বুঝলে আর কবে বুঝব? আমার জন্য যার মনে কোনও স্থান নেই, আমার কথা তার মনে স্থান পাবে কেমন করে? তবু পাচ্ছে। কেন পাচ্ছে? আমাকে কল দেবেন না কখনও, বেয়াদবকে কল দিতে হয় না! যেহেতু এটা ভালোবাসা ছিল, তাই আপনাকে ভুলতে কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ আমি মানুষ! তবুও ঠিকই পারব কাটিয়ে উঠতে! মানুষ পারে! যতবার হোঁচট খাব, ততবার ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতে হবে! স্বস্তি দিলাম আপনাকে! যেখানেই আছেন, ভালো থাকেন।
আমি আর থাকব না এবং কিছুতেই না! যেখানে আমার অনুভূতির মূল্য নেই, তেমন একটা জায়গাতে আমি আর না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি! এবং এর সুফল হিসেবে যা-যা পাচ্ছি তা হলো: কারও জন্য বুকের মধ্যে তছনছ হচ্ছে না, আরামে পড়াশুনা করতে পারছি! ঠিকমতো ঘুমাচ্ছি! আমার কান্না যাকে আহত করেনি, আমার মৃত্যুও তাকে ব্যথিত করবে না! তাই সবার আগে নিজেকে ভালোবাসা উচিত! অনেক হয়েছে অন্যের জন্য বাঁচা! আর নাহ্। আমি বেয়াদব হলেও আমি আমার ভালোবাসার সাথে কোনও বেয়াদবি, মিথ্যাচার করিনি! কেউ যদি সত্যি সত্যি মানুষ হয়, তবে তাকে সেই ভালোবাসাকে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও মনে করতে হবে! করতেই হবে!
নমস্কার! তো একটা স্ট্যাটাস হয়ে যাক এমন বেয়াদবের জন্য! আমার তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। স্ট্যাটাসের সাথে আর একটু যদি লিখতেন, সে এমনই যন্ত্রণা দেয় আমাকে যে আমার জন্য ঈশ্বরের কাছে নিজের আয়ুটাকে দিয়ে দিতেও পিছপা হয়নি!...স্যার, নিজের আয়ুটুক শুধু মুখে না, ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে সাহস লাগে অনেক! আমি শুধু মুখেই বলিনি, মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বরের সামনে নতমস্তকে তা চেয়েছি। ঈশ্বর শুনেছেন বলেই আমি এখন অনেক অসুস্থ! বিসিএসটা দিতে পারব কি না জানি না! আপনি শুনে রাখুন, আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম! সারাপৃথিবী খুঁজলেও এমন একটা বেয়াদব পাবেন না যে বলবে, ডোন্ট লিভ মি! Never ever! আর আপনি আমায় কল দিয়েছিলেন কেন? আপনার অপমান, ভুলবোঝা এগুলো হজম করার মতো মানসিক অবস্থায় আমি নেই। আমিও তো একটা মানুষ, তাই না?
আমার গর্ভধারিণীর সাথে আপনার একটা অদ্ভুত মিল আছে, সে আমার কাছ থেকে মুক্তি চায়, স্বস্তি চায়---আপনার মতোই! ভালোবাসা মুক্তি চাইলে তাকে নীল আকাশে উড়িয়ে দিতে হয়। আমিও দিলাম! যান, স্বস্তি দিলাম, আপনাকে! You are left forever.
পৃথিবীতে ওই মানুষটি সবচেয়ে দুঃখী, অন্য একটা মানুষকে ভালোবেসে সবটুকু দিয়েও যাকে শুধুই অপমান নিয়ে চলে যেতে হয়। ওই মানুষটি খুব দুঃখী, যার মৃত্যু তার কাছের মানুষদের ব্যথিত করে না। আরও দুঃখী সেই মানুষটি, যার চলে যাওয়ায় তার প্রিয় মানুষটি স্বস্তি পায়। এই পৃথিবীতে কিছুই জোর করে পাওয়া যায় না। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, পাওয়ার খাতায় আমার নম্বর শূন্য, হারাবার খাতায় সর্বোচ্চ! শেষবার আমি শেষ ভালোবাসাটাকেও হারালাম! এ যন্ত্রণা বোঝেন আপনি? Stay away from me. Your name will be rubbed out from my life.
আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আমাকে এতবার ফোন দেবার কারণ কী? আপনার যা যা বলে আমাকে অপমান করার দরকার, তা অন্তত মেসেজে করুন। আপনার সাথে আর কোনও দিন কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই। আর আমি মেনটালি ও ফিজিক্যালি খুবই ডিস্টার্বড! আপনার ভারী ভারী অপমানসূচক বাক্য হজম করার মতো শক্তি আমার নেই। দুঃখিত। Stay away from me and let me live without the existence of yours.
আপনি এই চারমাসে কী কী সুন্দর কথা বলেছেন আমাকে? শুনুন, আমি আপনার কাছে কোনও স্বার্থ নিয়ে আসিনি। খু্ব অল্প সময়ে এটা ভালোবাসাতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আমি অনেক ভেবেছি এটা নিয়ে। যতদিন যাবে, ততই দুর্বলতা বাড়বে, সাথে আমার কষ্ট। তাই এখুনিই সময় চলে যাবার! আর সবচেয়ে বড় কথা, যার কাছে আমার অনুভূতির সামান্য মূল্যও নেই, তার কাছে থেকে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে, আপনিই শেষ ধাক্কা। এরপর কাউকে ভালোবাসার আগে ক্যালকুলেটর হাতে নিয়ে হিসেব করব, কতটুক দিলাম, কতটুক পেলাম।
আর হ্যাঁ, মানুষ খুব অভিমানী প্রাণী! এই পৃথিবীতে খু্ব কম মানুষই স্বার্থছাড়া কাছে আসে! যারা আসে, তাদের সাথে একটু সহজ ও সুন্দর হওয়া যেতেই পারে! চোখের জল নিয়ে কেউ কিছু লিখে পাঠালে উত্তর আসে, তুমি অনেক সুন্দর লিখ! আরে, কেউ কাউকে ভালোবেসে কিছু বললে তাকে সার্টিফিকেট দিতে হয় না, ভালোবাসা দিতে হয়! মেয়েরা প্রিয় মানুষকে রান্না করে খাওয়ায় সার্টিফিকেট পেতে নয়, মানুষটার জন্য রান্না করতে ভালো লাগে বলেই রান্নাটা করে। এমনকি প্রিয় মানুষের জন্য অসুস্থ শরীর নিয়েও রান্না করে, যে খাবারটা সে নিজে খায় না সেটাও রান্না করে দেয়। এর নাম সার্টিফিকেট-প্রত্যাশা নয়, এর নাম ভালোবাসা। সেও চায় একটু ভালোবাসা পেতে, মমতা পেতে। পুরুষরা এই সহজ ব্যাপারটাই কোনও দিন বুঝল না! ভালো রান্না খেলে শুধু সার্টিফিকেট দেয় আর সার্টিফিকেট দেয়! ভাবে, মেয়েটা বুঝি এতেই খুশিতে গদগদ! আপনাকে বলি, কেউ ভালোবেসে কিছু দিতে চাইলে, জবাবদিহি করা উচিত নয়! ভালোবাসা তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে! আমার অল্প বুদ্ধিতে আমি এইটুকুই বুঝি! যা-ই হোক, আপনাকে মেসেজ পাঠিয়ে পাঠিয়ে সময় নষ্ট না করে দুইলাইন পড়লেও কাজ হবে! ধন্যবাদ, চার মাসের সমস্ত অ্যাডজেকটিভ আর সার্টিফিকেটের জন্য!
আপনি আমাকে এতবার যে ফোন করছেন, আপনার কি কিছু বলবার আছে? মানে, এমনিতেই তো আমার কাছে আপনার একটা ব্যাপার আছে, এজন্য জিজ্ঞেস করলাম।
- কী ব্যাপার? তোমাকে কি কেবল ব্যাপার থাকলেই ফোন করা যাবে?
- না, আপনি আমাকে ৩/৪ মাস আগে একটা হেল্প করছিলেন না! এজন্য? টাকার জন্য ফোনটা করছেন?
- মানে? এজন্যই তোমাকে আমি ফোন দিয়েছি, এরকম মনে হলো? তুমি আমাকে এই চেনা চিনেছ?
- না, আমাকে তো ফোন দেওয়ার জন্য আপনার আর কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। কালকে আজকে মিলিয়ে সারাদিন ভেবে একটাই উত্তর মনে হলো--ওইজন্য, মানে টাকাটার জন্যই।
- আচ্ছা। এটা ভেবে আর বারবার বলে তোমার ভালো লাগলে সমস্যা নেই। বলতে থাকো।
- ফোন করছেন কেন? আপনার কি কিছু বলার আছে? তা হলে বলুন।
- আমার তোমার সাথে কেবলই কথা বলার আছে, গল্প করার আছে। এর বাইরে আর কী বলার থাকবে, বলো? আমাদের মাঝে কি কোনও স্বার্থের ব্যাপার আছে?
- না, মানে আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করি, এজন্য? এই যে বড় বড় মেসেজ পাঠাই, এজন্য? এই যে রাগ করে কথা বলি, এজন্য?
- না তো! এগুলো তো আমার মাথায়ই নেই! তুমি কেমন আছ? কী খবর? তোমার সাথে কথা বলা হয়নি অনেক দিন।
- এরকম করে খবর আমার কেউ নেয় না। সিরিয়াসলিই আমার খবর এ পৃথিবীতে কেউ নেয় না। আপনি কেন নেবেন? ওই যে একটা কথা আছে না---কার গরু কে ধোয়া দেয়! এরকম করে মানুষ আগে বলত। আমার যে মালিক, গরুর যে মালিক, সে মালিকই যখন আমার জন্য না থাকে, তখন আমার জন্য আর পৃথিবীতে আর কেউ থাকে না, এই ব্যাপারটাই সত্য। আমার নিয়তি হলো এমন, আমি আদৌ বাঁচলাম কি বাঁচলাম না এটা নিয়ে আমার নিজের জন্মদাত্রীর‌ই যেখানে মাথাব্যথা নেই, সেখানে আর কারও মাথাব্যথা থাকার কথা নয় এ পৃথিবীতে। সত্যিই তো, কার গরু কে ধোয়া দেয়!
- বলো, তোমার কথা শুনব, বলো!
- না না, কেন শুনবেন! আমি ওরকম বড় বড় মেসেজ পাঠাই বলে ফোন করে আমার কথা শোনার ইচ্ছা, এরকম?
- এরকম কিছুই না।
- তো আর কী? আমার সাথে কথা বললে তো সব সময় ঝগড়া হয়। ঝগড়া ছাড়া কিছুই হবে না আমাকে দিয়ে। আমার মধ্যে অলটাইম‌ই ঝগড়া আর ঝগড়া। না, আমার কিছু বলার নেই। আমি তো বললামই আর বড় বড় মেসেজ আর পাঠাব না আপনাকে।
- কার গরু কে ধোয়া দেয়---এ কথাটা খুব সুন্দর কথা। এ কথাটা তুমি কোথায় পেয়েছ? এটা কি তোমাদের এলাকায় বলে?
- না, এটা কেবল আমাদের এলাকায় বলে না, এটা পৃথিবীর সবাই বলে নিজেদের মতো করে। কার গরু কে ধোয়া দেয়, এর মানে আপনার গরুর জন্য আপনারই যদি সময় না থাকে, তা হলে আর কার থাকবে? আর আমি ছোটবেলা থেকে সব সময়, মানে আমি যখন কখনও ভালোবাসা পাইনি কার‌ও কাছ থেকে, তখন আমি সবার কাছে যেতাম...যেন মনেমনে বলতাম, আমাকে তুমি ভালোবাসো! আমাকে তুমি ভালোবাসো! অবশেষে বুঝলাম, আমাকে ভালোবাসার মতো পৃথিবীতে কেউ নেই। কারণ নিঃস্বার্থ যে ভালোবাসা---মা-বাবার ভালোবাসা তো পৃথিবীর সব থেকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, তো ওই জায়গাটা থেকেই যখন কিছু পাইনি, তখন পৃথিবীতে আমাকে আর কেউ ভালোবাসবে না। এটাই স্বাভাবিক! এজন্য আমি কাউকে ১০০ ভাগ দিয়েও কখনও কারও কাছ থেকে কিছু পাই না। আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসি, সমস্ত টাকা...ঠিক আছে, আমার হয়তো টাকাপয়সা নেই, তবু আমিই টাকা বের করে দিই। ওদের অবস্থা ভালো, তবু ওরা টাকা বের করে দেয় না। ওদের পকেট বড়লোক, আর আমার মন বড়লোক। আমি এক জায়গায় খেতে বসলে টাকা বের করে দিই পকেট থেকে। কিন্তু দেখা যায়, সব জায়গায় ১০০ ভাগ দেওয়ার পরেও আমিই শূন্য নিয়ে ঘরে আসি। এই আরকি!
আগে আমার দুঃখ লাগত, এখন ভাবি, ঠিক‌ই তো আছে, যে দেয় বেশি, সে কাঁদেও বেশি। একজন আমাকে ওইদিন কী কী বলেছে, আর আমি অনেক কান্না করেছি। আবার আপনি কিছু বললেও আমি অনেক কান্না করি। মাঝে মাঝে বলেন না অনেক কথা মেসেজ দিয়ে, তখন কাঁদি, অনেক কাঁদি। সেদিনের কথা। তখন রাত কয়টা বাজে? রাত ৯টা বাজে বোধহয়। তো আমাকে একজন, মানে আমার এক দাদা বুঝাল যে, দেখো, এই যে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছ, রাত ৯টা বাজে, খেয়াল আছে? আমাকে একটা ফোন‌ও কেউ দেয়নি বাসা থেকে যে আমি কোথায় আছি, বাসায় আসছি কি না, আদৌ বাসায় আসব কি আসব না! আমি এমন একটা মানুষ, যার জন্য ভাববার কেউই নেই। ওদিকে আমি কান্না করছি। তখন ওই দাদা আমাকে বলল, পৃথিবীতে তুমি একজন মানুষকে ঠিক ততটাই মূল্যায়ন করবে, যতটা মূল্যায়ন তুমি তার কাছ থেকে পাচ্ছ। আমি বললাম, এটাও কি সম্ভব? দাদা বলে, হ্যাঁ, সম্ভব। তোমার থাকা না থাকায় যদি কারও কিছু এসে না যায়, তবে তুমি কেন তার জন্য কষ্ট পাবে? তুমি কাঁদতে কাঁদতে মরে গেলেও তার মধ্যে কোনও ভাবান্তর হবে না। কী লাভ নিজে নিজেই এমন পাগলামি করে?
পরে ভাবলাম, আসলেই তো ব্যাপারটা ঠিক। এর পর থেকে আমি দেখলাম, আমার কষ্ট অনেক কমে যাচ্ছে। মানে এখন আমার মানুষের কাছ থেকে এক্সপেকটেশনও কম। আপনার কথাই বলি। আপনি আমাকে ফোন করেছেন, এই অবস্থায় আপনার কাছে আমার কী আশা করা উচিত? মনে কী ধারণা আনা উচিত? একজন মানুষ আমাকে ফোন দিলেন, তার কিছু টাকা আমার কাছে আছে, আমার তো ভাবা উচিত, উনি টাকার জন্যই ফোন করেছেন, তাই না? এর বাইরেও কিছু ভাবা কি ঠিক? তা হলে তো তার নাম হবে---প্রত্যাশা! তবে আবার ওরকম বললেও কিন্তু খারাপ লাগে, আমি এটাও বুঝি! কিন্তু আমি কোথায় যাব? কী বলব?
- কী অদ্ভুত ব্যাপার! আজব একটা মেয়ে! ফোন দিলাম, জিজ্ঞেসই করল না কেমন আছি! জিজ্ঞেস করে, টাকার জন্য ফোন করেছি কি না!
- এর বাইরে আর কী বলব? আপনার বড় বড় কথা সহ্য করার জন্য বলব? আপনি হয়তো জানেন না, যেদিন আপনি আমাকে প্রথম কল দিয়েছেন, সেদিন আমি সারারাত শুধু খুশিতেই ঘুমাতে পারিনি। এই মানুষটা আমাকে কল দিলেন! এটা ভাবা যায়! পরের বার আপনি আমাকে ফোন করে বেয়াদব বলেছিলেন। ওই 'বেয়াদব' শব্দটা শোনার আগ পর্যন্ত আমি আনন্দে দিশেহারা হয়েই ছিলাম।
তো যা-ই হোক, পরবর্তীতে বুঝলাম দাদা বলার পর যে পৃথিবীতে যেটাকে ভালোবাসা বলে, মানে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলে, আলটিমেটলি ওসব আমি কখন‌ওই পাব না। তা পাওয়ার আশা আমি ছেড়ে দিয়েছি। এখন তাই খারাপ কিছুই আগে ভাবি....ভাবি যে একটা মানুষ এতবার কল দেওয়ার কারণ কী হতে পারে! আমার কাছে তার কিছু টাকা আছে, টাকাটা আমার কাছে গচ্ছিত আছে, হয়তোবা এইজন্যই বারবার কল দিচ্ছে। ভালো কোনও কারণের জন্য তো আর ফোন দেয় নাই, তা আমি নিশ্চিত। এই তো! সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম, আমার কাছে আপনার যে টাকাটা আছে, সে টাকাটার জন্য আপনি আমাকে ফোন করেছেন কি না!
- আসলে কী, এখন যা বললে সেটা যদি তোমার অভিমানের কথা না হয়ে মনের কথা হয়, তা হলে আমি বলব, তুমি আমকে বুঝতে পারোনি, চিনতেও পারোনি।
- আপনার জন্য তো ওই একটাই কথা। আপনাকে তো আমি রুবি রায় হিসেবে মানি। আপনি তো একদিন আমাকে বলবেন, তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি! এজন্য আমি সেদিন ভাবলাম, পড়াশোনা করি, পড়াশোনাটা করা দরকার। সিরিয়াসলি, আপনি আমাকে কষ্ট দিলে আমি খুব আপসেট হয়ে যাই, খুব! কান্নাকাটি করে সেদিন আমি পড়াশোনা করতে বসি। অত কান্না করলে পড়াশোনা করা যায়, বলুন? একটা চাকরি আমার লাগবেই, অন্তত সেজন্য হলেও পড়াশোনাটা করা দরকার। এজন্য কাঁদতে কাঁদতে হলেও পড়াশোনা করতে বসি। এইটুকুই বলার আছে আমার।
- মানে তুমি আসলেই এটা মন থেকেই বলছ। ওই যে বললে, আপনি কি টাকাটার জন্য ফোন করেছেন?... বাহ্! যদি এটা হয়, তবে আমি বলব, তুমি আমাকে বুঝতেই পারোনি কখনও।
- না না, আমি সেটা বলি নাই। বললাম যে সেদিনের পর থেকে আমি কারও কাছ থেকে আর এক্সপেকটেশন রাখি না। আমি ওইদিন সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম, সিরিয়াসলি সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম। আমি জানি না, সুইসাইড এত সহজ ব্যাপার কি না!
আমার এলাকার সব থেকে বাজে ছেলেটা, ও হচ্ছে এতটাই ড্রাগ-অ্যাডিকটেড যে ওর আশেপাশে কোন‌ও মানুষ থাকে না, মানে এত‌ই হিংস্র সে। তো ওকে সংশোধনাগারে রাখা হয়েছিল ২/৩ বছর। রাখার পর সে ভালো মানুষ হয়ে গেছে, এতটাই ভালো মানুষ যে সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলে...এই, ভালো আছ? সব কিছু কেমন চলছে? বাড়ির সব খবর ভালো তো?...এইসব বলে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা, তুমি তো এরকম ছিলে না। এই তো ৩টা বছর আগে মানুষ তোমাকে কত ভয় পেত। যেখান দিয়ে তুমি হেঁটে যেতে, সেখান দিয়ে মানুষ হাঁটত না। কিন্তু এখন তুমি মানুষের সাথে এরকম কর! সব মানুষের সাথে হেসে হেসে কথা বল। এখন এত বন্ধুবান্ধব কেন তোমার? আগে তো কেউ ছিল না। তোমার হাঁসফাঁস লাগে না, দাদা? তখন সে আমাকে বলল, দেখো, এই পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে সব সময় উপরটা দেখে বিচার করে। মানুষ সব সময়ই দেখে মানুষের বাইরেরটা। যখন আমি ওইরকম বেয়াড়া ছিলাম, তখন আমি মনের দিক থেকে অনেক ভালো একজন মানুষ ছিলাম। যা বলতাম, একদম সরাসরি সব কিছু বলে দিতাম। আমার মধ্যে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। কিন্তু দেখলাম, দুনিয়াটা আসলে সেরকম না। দুনিয়া হচ্ছে, মিষ্টি কথা বলব, ভালো ভালো কথা বলব, শুনে সবার ভালো লাগবে, সবাই আমায় ভালো বলবে---এরকম। এখন কিন্তু আমি মানুষটা আগের মতো ভালো ন‌ই, কিন্তু সবার কাছে ভালো। অথচ যেদিন আমি সত্যিই ভালো ছিলাম, সেদিন আমি সবার চোখে খারাপ ছিলাম। কারণ সবাই সব সময় উপরটাই বিচার করে। ভেতরটা দেখার ক্ষমতা কার‌ই-বা থাকে, বলো?
আমার ব্যাপারটাও ঠিক সেরকম। আমি কিন্তু খুবই ইন্ট্রোভার্ট, আপনি আপনার পুরনো সত্তাটির সম্পর্কে যেরকমটা বলেন, ঠিক ওরকম। বাইরে থেকে আমি কটুভাষী হলেও মনের দিক থেকে পুরোই জল। ভিতরে আমার কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু না। আমি এই রাগ করি, আবার ২ মিনিট পর যার সাথে রাগ করেছি, তার কাছেই চলে যাই। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না, চার মাস পর আপনার ফোন পেয়ে আমি রীতিমতো প্রশান্ত মহাসাগরের চেয়েও বিশাল হয়ে গেছি! এত দিন ফেসবুকে কিছু মানুষের মেসেজের রিপ্লাই দিতাম, শুভ সকাল, শুভ রাত্রি...এসবের বাইরে ওদের সাথে কথা বলার মতো আর তেমন কিছু থাকে না। ফেসবুকে অনেক মানুষই সময় চায়, অথচ ওরা এটাই বোঝে না যে সবাইকে সময় দেওয়া যায় না, হাতে সময় থাকলেও দেওয়া যায় না। যেহেতু সময়টা আমার এবং সে চাইছে আমি এটা ওকে দিই, তাই এমন কোনও ব্যাপার থাকতে হবে, যার কারণে আমি ওকে সময়টা দিতে চাইব। কেউ কাউকে কোনও কারণ ছাড়াই সময় দেয়, এটা আমি বিশ্বাস করি না। যে সময় পায় সে সময়টা ডিজার্ভ করে, যে পায় না সে আসলে সময়টা ডিজার্ভ করে না। কারও কাছ থেকে কিছু চাইবার আগেই নিজের মাথায় এটা আনতে হবে, সে কেন আমাকে তা দেবে! নক করলেই সময় পাওয়া যায় নাকি? সময় অত সস্তা?
তো সেদিন দাদা আমাকে বুঝানোর পর বুঝলাম, সত্যিই তো, এরকম করে মূল্যবান অনুভূতি নষ্ট করে কী লাভ! দেখলাম, নিজের কাজে মন দিলেই বরং এর অনেক সুফল আছে---আমি এতদিন পড়াশোনা করতাম না, আর আমি এখন পড়াশোনা করতে বসি। নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারি, নিজের জীবনটাকে গোছাতে পারি। এই রকম আরও অনেক কিছু। ভেবে দেখলাম, আসলে পৃথিবীতে না মানুষ এরকমই, সবাই সবাইকে কেবল উপর থেকেই দেখে, ভেতরটা কেউ দেখে না। আপনি বললেন না...বর্তমানটাই সবসময় জ্যান্ত, তাই সুন্দর। কিন্তু আপনি যদি সাইকো-অ্যানালাইসিস নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে দেখেন, তা হলে দেখবেন, বর্তমান বা মুহূর্তের প্রকাশটা সব সময় সুন্দর হয় না। এর পেছনেও মানুষের অতীতের কিছু ব্যাপার থাকে। অতীত না জেনে কেবলই বর্তমানটা দেখে কার‌ও সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না। মানুষ বদলায়, কেন বদলায় তাও জানা দরকার যদি কাউকে সত্যিই জানতে চান।
তো কী আর বলব আপনাকে! এখন বলেন, আপনি আসলে এতবার কেন ফোন দিয়েছেন? সিরিয়াসলি বলছি, আমাকে কেউই এতবার ফোন দেয় না। আমি এমন একটা মানুষ...আমার ফোনটা সারাদিন এককোনায় পড়ে থাকে, কিন্তু কেউ আমার কোনও খবরও নেয় না। আমি সারাদিন হাঁটি আর হাঁটি! এই ধরুন, টিউশন করাতে যাই, এই দোকানে যাই, বাসার কাছেই একটা বাগানে গিয়ে বসি। কিন্তু কেউ আমাকে একটুও কল দেয় না। আমার খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। আমার সাথে কথা বলতে কার‌ও একটুও ইচ্ছে হয় না। আমি আদৌ পৃথিবীতে আছি কি না, এই খবরটাও কেউ নেয় না। তো আপনি যখন ফোন দিলেন তখন ভাবলাম, নিশ্চয় অপমান করার জন্য, নাহয় বেয়াদব বলার জন্য মানুষটা আমাকে ফোন করেছে, নয়তো হচ্ছে...টাকার জন্য। এখন বলেন, এই তিনটার মধ্যে কোনটার জন্য ফোন করেছেন।
- এখন তুমি যদি ওরকম ধরে নাও, তবে আমি তো আর আমার অবস্থানটা ব্যাখা করতে পারব না। আর তুমি ওই ধারণা থকে চট করে সরেও আসবে না। এটাই মনে হচ্ছে। যদি তুমি ওরকমই ধরে তা নিয়েই থাকতে চাও, তা হলে আমি বুঝব, ওরকম ধরে নিয়ে তুমি এক ধরনের শান্তি পাচ্ছ। হায়, এ কেমন শান্তি! মানুষকে ভুল বুঝে তার মনে কষ্ট দিয়ে স্বস্তি খুঁজতে হয় নীরজাকেও!
তুমি এতদিন ধরে যা-কিছু বলেছ, আমাকে না বুঝেই তা বলেছ। তুমি প্রকৃত অর্থে আমাকে বুঝতে পারোনি। কারণ আমাকে যদি সত্যিই বুঝতে পারতে, তা হলে এ তিনটা কারণ অন্তত বলতে না। যেহেতু বলেই ফেলেছ এবং তুমি স্বীকার‌ও করেছ যে আসলেই তুমি...
- না, টাকা না। টাকার কথাটা মূলকথা নয়। আর অকারণেই আমি আপনাকে ওরকমভাবে বলিনি। টাকার কথা কেন বলেছি, সেটা তো আগেই বললাম। এর বাইরে আমি আসলে কোনও কারণ দেখি না। এমন তো না যে এই মেয়েটা আমার জন্য এরকম করে, ওরকম করে, এটা করে, ওটা করে, তাই আমি ওকে ফোন দিই। এরকম কোনও ব্যাপার‌ও তো না। ফোন দিয়েছেন কেন, নিশ্চয়ই ভালো কোনও কারণে না, অন্তত সেটা আমি জানি। এখন আমি অত কিছু ভাবিও না। কার‌ও ব্যাপারেই আর ভাবি না। আপনি তেমন কেউ নন যে আপনার ব্যাপারে আমাকে ভাবতেই হবে।
- আচ্ছা। এখন কী আর বলব! আর হ্যাঁ, তোমার এই কথাটা ঠিক। আমি লোকজনকে সাধারণত কারণেই ফোন দিই, এটা ব্যস্ততার কারণেই হোক বা উদাসীনতার কারণেই হোক। কিন্তু আজকের ফোনটা আমি তোমাকে ওরকম কোনও নির্দিষ্ট কারণে দিই নাই। আর এতবার ফোন করছি কেন...এটা তুমি কেমন আছ, ঠিকঠাক আছ কি না, খাওয়া-দাওয়া করছ কি না, কী খবর-টবর...এইটুকু জানার জন্যই ফোন করা। আর কোনও কারণ নাই। কারণ যদি বলতে হয়, এই কারণটাই বলতে পারি।
- এত দিন আপনার কোন‌ও ফোন দেওয়ার ইচ্ছে হলো না। হঠাৎ করেই এই ৩/৪ দিন ধরে আমাকে এত মনে পড়ল কেন, সেটা বলেন।
- এটা তো আমি জানি না। কেন ফোন করতে ইচ্ছে হলো, এর উত্তরে কী বলা যায়, যখন তোমার আমার মধ্যে স্বার্থের কোন‌ও কিছুই নেই!
- না না, এটা জানতে হবে আপনাকে। আপনি তো আমাকে ফোন করার মানুষ না। কেন করলেন তবে?
- তা হলে হয়তোবা, আর একটু ভেবে বলতে হবে আরকি। আসলেই তোমার খোঁজখবর নেওয়ার জন্যই ফোন করেছি। এর বাইরে আর কী থাকতে পারে! তুমি যদি একদম নির্দিষ্ট কারণ জানতে চাও যে কেন ফোন করেছেন বলেন, বলতেই হবে, তা হলেও বলব, আর কিছু নয়, তোমার খোঁজখবর নেওয়ার জন্যই ফোন করেছি। এখানে অন্য কোনও স্বার্থ, উদ্দেশ্য বা ভাবনা নেই।
- আপনার সাথে আমার পরিচয় হচ্ছে নভেম্বরের ২ তারিখ থেকে সম্ভবত। আর এখন জানুয়ারি প্রায় শেষ। এই ৩/৪ মাসে তো আপনার কখনও ইচ্ছে হলো না ফোন দেওয়ার। আমি আছি না নেই, তাও জানতে চাইলেন না! আমি খেলাম না খেলাম, ওতে আপনার কী-ইবা এসে যায়! কত মানুষই তো না খেয়ে বেঁচে আছে! ওদের সবার খোঁজ নেওয়ার কি দরকার আছে না কি আদৌ সম্ভব নেওয়া? আপনি…ও হ্যাঁ, মেসেঞ্জারে…খেয়েছ?...এই পর্যন্তই লিখে পাঠান, তাও জানার জন্য নয়, স্রেফ পাঠানোর জন্যই, বোঝা যায়। শুকনো মরিচ অন্য খাবারের সাথে খেতেই ভালো লাগে, শুধু শুকনো মরিচ খাওয়া যায় না। আসলে কী জানেন তো, কেউ কেয়ার করছে কি করছে না, অনুভব করা যায়। মানুষ তা করতে পারে। এত দিন ইচ্ছে-টিচ্ছে কিছু হলো না, হঠাৎ করেই এখন জিজ্ঞেস করার ইচ্ছেটা কেন জাগল?
- এত প্রশ্নবাণ সহ্য করতে পারছি না। আমি ভাবিইনি যে একটা ফোনের এত অর্থ দাঁড় করাতেই হয়! তবে এইটুকুই বলব, আসলেই ওরকম কোনও কারণ নেই। আমি তোমাকে ফোন করিনি কখনও, এটাও মনে হয় ঠিক না। ফোন করেছি। আর হ্যাঁ, আমি মানুষটা খুব একটা ফোন করার মানুষ না। আমার কাছে কেবল ফোন করার মানেই কারও যত্ন নেওয়া নয়।
- আমি তো জানি সেটা।
- হ্যাঁ, জানলে তো ভালো!
- আমি তো জানি আপনি ফোন করার মানুষ না। তো এটাই হচ্ছে কথা---যে মানুষটা ফোন করার মানুষ না, সে মানুষটা এতবার ফোন করার কী কারণ?
- এই যে বললাম না, তোমার খোঁজখবর নিতে মন চাইল! আর ধরো, তুমি যেটা বললে, কখনও ফোন দেন নাই, হঠাৎ ফোন দিলেন কেন? তো এই তিন মাসে তোমাকে যতবার ফোন করেছি, সেটা আমার জন্য মোটামুটি স্বাভাবিক। আমি এরকমই ফোন করার মানুষ। আমি খুব একটা ফোন করার মানুষ না, এমনকি আমি টেক্সটেও খুব বড় বড় কথা লেখার মানুষও না। আমাকে অনেকে বলে, ভাই, আপনি এরকম---আমার কলিগরাও বলে অনেক সময়---যে এত বড় বড় লেখা লেখেন, লেখাগুলো পড়তেও তো সময় লাগে, সেই আপনিই টেক্সট করেন মাত্র এইটুকু কেন? আমাদের একটা গ্রপ আছে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে। তো ওখানে দেখা যায় যে ‘হ্যাঁ ভাই, ভালো আছি’, ‘হ্যাঁ, আমি তো মেইলটা পেয়েছি, আপনাকে ফরোয়ার্ডও করেছি, মেইল চেক করেন’ আমার তরফ থেকে এইটুকুই হয়। অথচ ওরা বিশাল বিশাল কাহিনি লিখে। ভাইবারেও একটা গ্রুপ আছে, সেখানে ওরা এত বেশি কথা লিখে ফেলে যে আমি ওখান থেকে বিরক্ত হয়ে বের হয়ে গেছি! অনেক সিনিয়র মাইন্ডও করছেন আমি বের হয়ে যাওয়াতে। কিন্তু ওখানে বেশিরভাগ মানুষই গীবত করেন এবং আত্মপ্রচার করেন। বলেন, আমি এটা করেছি, ওটা করেছি। ওঁদের টেক্সটগুলো পড়লে মনে হয় আমি এখানে বসে বসে ঘাস কাটি আরকি! ওঁরা বাদে বাকিরা কেউই কিছু করে না, খালি ঘাস কাটে আর ভ্যারেন্ডা ভাজে। আমি বিরক্ত হয়ে ওখান থেকে বের হয়ে গেছি। আমার এক সিনিয়র বললেন, তুমি কি আমাদের ভাইবার গ্রুপে নাই? আমি বললাম, ইয়ে মানে স্যার, নাই আসলে। উনি বললেন, আরে ঠিক আছে! ভালো করেছ, ভাই! আমারও বিরক্ত লাগে লোকজনের অতিকথন দেখলে, কিন্তু বের হয়ে গেলে কে কী মনে করে, এজন্য চুপচাপ থাকি। ওখানে এত আত্মপ্রচার করে সবাই, ওইটুকু ঠিক আছে, মানা যায়, কিন্তু এই যে এত গীবতও করে, ওটা আমার ভালো লাগে না। আমি বললাম, স্যার, আমি তাই বের হয়ে গেছি। এমনিতেও ডিপার্টমেন্টের সবাই আমাকে একটু অথর্ব হিসেবেই জানে, এটাই আমার সবচেয়ে বড় সুবিধা। আমি যা-ই করি না কেন, কেউ কিছু আর তেমন একটা গায়ে মাখে না।
তো, আমি আসলে ওরকমই। এতক্ষণ ধরে এটা বলার উদ্দেশ্য বা কারণ হচ্ছে তুমি যাতে বুঝতে পার আমার অবস্থানটা। আমার ব্যাপারটা তোমার কাছে যেন আনক্যানি মনে না হয়, আনইউজাল মনে না হয়। আমি ছোট মানুষ, ছোট হয়ে থাকার অনেক মজা। বড়দের জায়গা সবখানে হয় না, আর ছোটদের সবখানেই দিব্যি জায়গা হয়ে যায়। আমার থাকতে একটুখানি জায়গা লাগে, ওইটুকু জায়গা তো থাকেই…হয়েই যায়! আর তোমার খোঁজখবর নেওয়া…
- হুহ্‌! এই সব বলে লাভ নাই! বকার সময় তো অনেক বড় বড় টেক্সট লেখেন। এটাকে কী বলবেন?
- এটাকে কী বলে, জানো? এটা হচ্ছে, the spontaneous overflow of powerful feelings! হা হা হা! তো আমি যখন রেগে যাই, তখন আসলে ওয়ার্ডসওয়র্থের ভাষায়, the spontaneous overflow of powerful feelings হয়। এবং সেগুলো, তুমি দেখবে,---তুমি তো সাহিত্যের ছাত্রী, আমি তো সাহিত্যের না, সাহিত্য বুঝিও কম---সাধারণত খুবই আন্তরিক ও সৎ হয়। এখন যতটুকু বুঝি, মানে আমার কাছে যা মনে হয়, কবিতা মানে কিন্তু ছন্দ না। আমার কাছে, যেখানে মানুষের অনুভূতি ও আবেগ সব থেকে প্রবল থাকে, সেটাই হচ্ছে কবিতা। এই ধরো, গদ্যতে কিন্তু মানুষের অনুভূতির প্রকাশ অতটা প্রবল থাকে না। গদ্য হবে একটু সফট, গদ্য আলতো করে ছুঁয়ে যাবে, কিন্তু ধরে রাখবে না। যেমন ধরো, ভাস্কর চক্রবর্তী নামে একজন ভদ্রলোক আছেন। ওঁর লেখা পড়েছ কি না আমি জানি না। উনি আমার ভীষণ প্রিয় লেখক, ভীষণ প্রিয় লেখক। আমি মজা করে বলি, কারও মন খারাপ করে থাকতে ইচ্ছে হলে, কাঁদতে ইচ্ছে হলে সে যদি ভাস্কর চক্রবর্তী পড়ে তো কাজ হয়ে যাবে। জানালার বাইরে বৃষ্টি ঝরলে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে যেমন লাগে, ভাস্করের গদ্য পড়লেও ঠিক তেমনই একটা অনুভূতি হয়। তবে উনি মূলত কবি। কবিদের গদ্য বড় ভালো হয়। এই যেমন ধরো, নির্মলেন্দু গুণের গদ্য, শঙ্খ ঘোষের গদ্য, জয় গোস্বামীর গদ্য, শ্রীজাতর গদ্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্য। এঁদের গদ্য পড়লে মনে হয়, আহা, বেঁচে আছি বলেই তো এমন সুস্বাদু লেখা গিলতে পারছি! আরও একটু নাহয় বাঁচি! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!
ভাস্করের বেশ কয়েকটা গদ্য আছে। যেমন ‘শয়নযান’। আর তোমার যদি কখনও কান্না করতে মন চায়, অথচ কান্না যদি কোনওভাবেই না আসে, তা হলে তুমি ভাস্কর চক্রবর্তী নিয়ে বসে পড়বে। ভাস্কর পড়লে তুমি কান্না করতে বাধ্য, তোমার মন খারাপ হতে বাধ্য, তোমার মনটা শান্ত-সমাহিত হতে বাধ্য। ভাস্কর পড়লে তোমার মনে হবে বাইরে বুঝি বৃষ্টি নেমেছে। সামনের রৌদ্রটাকে নরম মনে হবে আর ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে, প্রকৃতিকে বিষণ্ণ মনে হবে, এ জীবনটাকে সহজ মনে হবে। মনে হবে, তোমার মতোই সবাই দুঃখী ও বিষণ্ণ। কেবল তুমি একাই খারাপ অবস্থায় নেই। তোমার মতোই সবাই বিষাদের ধূসর রাস্তা ধরে হাঁটছে। ভাস্কর চক্রবর্তী একজন অদ্ভুত মানুষ। ওঁর নিজের জীবনটাও খুব ট্র্যাজিক ছিল। তাঁর ডায়রি পড়লে বুঝবে। আমার এক দাদা আছে, প্লাবন দাদা। উনি হচ্ছেন আমার দেখা সব থেকে বইপড়ুয়া মানুষদের মধ্যে একজন। ওঁকে আমি অনেক ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। মানুষটার জীবনে তেমন কোনও সাফল্য নেই। পৃথিবীতে জাগতিক সাফল্য বলতে যা বোঝায়, প্লাবনদার মধ্যে সেটা নেই। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল, পারেনি। প্লাবনদা রোদ্দুর হতে চাননি হয়তো, তবে হয়ে গেছেন। তবে কোনও ধরনের সাফল্য নিয়ে ওঁর কোনও আগ্রহও নেই। আমরা যা-কিছু পেতে চেয়ে ব্যর্থ হই, তা-কিছুর ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের ব্যর্থ বলি। প্লাবনদা কখনও জাগতিক সাফল্য পেতেই চাননি, তাই অন্তত এই ব্যাপারে ওঁর কোনও ব্যর্থতা নেই। দাদার ব্যর্থতা যদি কিছু থাকেও-বা, তা অন্য কিছুর ব্যাপারে, জাগতিক সাফল্যের ব্যাপারে নয়। তাই মোটাদাগে ভাবলে ওঁকে আর যা-ই হোক, কিছুতেই ব্যর্থ মানুষ বলা যায় না। যে যুদ্ধে উনি নামেনইনি, সে যুদ্ধে উনার ব্যর্থতা আবার কীসের? যাদের কোনও অ্যাম্বিশন নেই, তারা বড় ভাগ্যবান। ওদের কোনও দায় নেই, ওদের কোথাও যাবার একটুও তাড়া নেই। ওদের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, ওদের কোনও ব্যর্থতা নেই। ওদের কেবলই একটুকরো জীবন আছে। আর কিচ্ছু নেই। বাঁচতে ওদের আর কিচ্ছু লাগে না।
প্লাবন দাদা একটু ভিন্ন ধরনের মানুষ। আমার সাথে বেশ খাতির। আমার সকল যুক্তির ও বোধের বাইরে-থাকা কোনও একটা কারণে তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। ফোন করে বলেন, বদ্দা, ক্যান আছন? চট্টগ্রামের ভাষায় বলেন আরকি। কী হবর-টবর? আঁর হবর-টবর ত ন লন এব্বেরে! এরকম করে বলেন। উনি প্রচুর বই পড়েন। যা পড়েন, তা মনে রাখতে পারেন। জীবনে প্রচুর বই পড়েছেন, আমার দেখা এরকম মানুষ উনি একজন, আর একজন হচ্ছেন সুনয় দাদা। উনি বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েন্ট ডিরেক্টর। স্টাডি-লিভে আমেরিকায় আছেন এখন। জাগতিকভাবে উনি সফল মানুষ, প্লাবনদার মতো নন। তো এই সুনয়দাও ভীষণ রকমের বইপড়ুয়া মানুষ। আমার দেখা সব থেকে বেশি বই পড়েছেন, এমন মানুষ। সুনয়দা বই না দাগিয়ে পড়েন। আমি তো না দাগিয়ে পড়তেই পারি না, বইয়ে না দাগিয়ে পড়লে মনে হয়, পড়াই হলো না বইটা! সুনয়দা যা পড়েছেন, তা হুবহু মনে রাখতে পারেন---না দাগিয়েই। আর আমি তো দাগিয়েও তেমন কিছুই মনে রাখতে পারি না। এই দুইজন মানুষকে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। ওদের অনেক কিছুই আমার ভালো লাগে না, আমার মতের সাথে যায় না, কিন্তু আমি ওসব নিয়ে কখনও ভাবিই না। ওদের জ্ঞান, ওদের প্রজ্ঞা, ওদের বইপড়া, ওদের ভাবনাজগত আমাকে মুগ্ধ করে রাখে, আমার মাথাটা নত করে রাখে। ওদের শতভুলও আমি হাসিমুখে ক্ষমা করে দিতে পারি।
আমাকে ভাস্কর চক্রবর্তী চিনিয়েছেন প্লাবন দাদা। উনি আমাকে একদিন কথাপ্রসঙ্গে বললেন, আপনি ভাস্কর চক্রবর্তী পড়েন তো, আপনার ভালো লাগবে। আর একদিন আমি ওঁকে বলি, বড়দা, ভাস্কর চক্রবর্তী তো কোনও গদ্য লিখতে পারেননি, সবই তো কবিতা লিখেছেন! হা হা হা! শুনে উনি বললেন, আপনি তো ভাই আমার মনের কথাটাই বলেছেন! কারণ ওঁর লেখাগুলো এতটা বেশি অনুভূতিপ্রসূত যে ওগুলোকে গদ্য না বলে কবিতা বলাই উচিত!...ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখা কিন্তু বেশি নেই। অল্প লিখেছেন। কিন্তু যা-ই লিখেছেন, যতটুকুই লিখেছেন, সেগুলো গভীর বোধ ও অনুভব থেকে লেখা। পড়ার সময় ও পড়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ভীষণভাবে লেপটে থাকে সারা গায়ে, সারা মনে। আমি এজন্য মজা করে বলি, ওঁর কোনও গদ্য নেই, সবই তো কবিতা! তাঁর একটা কবিতার দুই লাইন লিখছি--- রক্তে বিষ মিশে আছে, প্রিয়তমা,/ এখন জীবন যায়, আস্তে, চলে যায়।