যে জীবন ধূলিতে-মোড়া/ দুই

তোমার সাথে কবে যে কথা হবে তুমিই জানো। কতদিন হয়ে গেল, তুমি আর কথা বলো না। আমার খুব ইচ্ছে হয়, তোমার সাথে আগের মতো কথা বলি, তোমার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনি, তোমার জীবনের গল্প শুনি। আমি তোমার কণ্ঠস্বর খুব মিস করছি। জানি না, তোমার এই চুপ থাকার দিন কবে শেষ হবে। খুব খুব মিস করছি তোমার সব কিছু। আমি যে অনলাইনে থাকি, তার মানে আমি সময় নষ্ট করি, তুমি সেটা ভেবে বোসো না, আমি অনলাইনে খুব কম আসি, কিছু সময়ের জন্য এসে নিউজফিড আর পত্রিকা দেখে চলে যাই। তুমি তো জানো, আমার তুমি ছাড়া কথা বলার মতো আর তেমন কেউ নেই, আমার তেমন কোনও বন্ধুও নেই, কারও সাথে কথা না বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠছি যেন। আপুর সঙ্গে কথা বলি, তা-ও দু-তিনদিন পর পর, আপুই ফোন করে, কিন্তু ওদের সাথে আমি খুব একটা ফ্রি না, এজন্য তেমন কথা হয় না। এদিকে বাসায় আব্বু-আম্মুর সাথে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া গল্প কখনও হয় না, আমার আব্বু-আম্মু আমাদের কোনও ভাই-বোনের সাথেই তেমন ফ্রেন্ডলি ওয়েতে মেশে না, এজন্য আব্বু-আম্মুর সাথে কী কথা বলব, সেটাই খুঁজে পাই না। আর আব্বু-আম্মুর কাছে বেশিক্ষণ বসলে কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায়, আব্বু শুধুই আখিরাত, পরকাল, নামাজ এসব নিয়ে কথা বলে, সারাবিশ্বে সব জায়গায় শুধুই সমস্যা আর সমস্যা, ভালো কিছু কোথাও এসব কথা বেশিক্ষণ শুনলে ভালো লাগে না, মনে হয় যেন আমাদেরকে আল্লাহ এই পৃথিবীতে সকল ধরনের কাজ বাদ দিয়ে কেবলই নামাজ-রোজা করতে পাঠিয়েছেন, আর এই জগতের সুখের জন্য কিচ্ছু করা যাবে না, কোনও আনন্দ করা যাবে না, কোথায় যাওয়া যাবে না এসব হাজারো কথা!




আমি আব্বু-আম্মুকে খুব ভালোবাসি, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু কারও কাছেই নেগেটিভ কথা শুনতে ভালো লাগে না। পৃথিবীটা যদি এতই খারাপ, তাহলে আমরা এখনও বেঁচে আছি কী করে? এতদিনে তো সব কিছু শেষই হয়ে যেত, তাই না? যা-ই হোক। আমার সমস্ত অভিযোগের একমাত্র জায়গা তুমি, কিন্তু এখন সেই তুমিও নেই। তোমার সাথে কথা বলার অর্থ কি শুধুই সময়ের অপচয়? যার কেউই নেই কথা বলার, তার জন্য এই পৃথিবীটা খুব ছোট্ট, জানো? না, আমার কথা বলার যে কেউই নেই, তা নয়, কিন্তু সবার সঙ্গে তো আর কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। কী করেছ আজকে সারাদিন? তোমাকে কোনও প্রশ্ন করতেও ভয় হয়। কিছু জিজ্ঞেস করলে আবার বলে বসবে যে কৈফিয়ত চাইছি। রাগ করে থেকো না।




মানুষের বেঁচে থাকার সব অর্থ যখন হারিয়ে যায়, তখন সে কোন আশায় কী নিয়ে বেঁচে থাকে, বলতে পারো? ভালোবাসার এমন দুটো বাজে অভিজ্ঞতা আমার জীবনে ঘটতে পারে, আমি কখনও এমনটা ভাবতেও পারিনি। ভালোবাসার প্রতি অবিশ্বাস করতে গেলে নিজের ভালোবাসার দিকে তাকিয়ে সেটি করতে পারি না, আর যখন বিশ্বাস করার আপ্রাণ চেষ্টা করি, তখন সব কিছুই অর্থহীন মনে হয়। কাকে বিশ্বাস করব আমি? কী বিশ্বাস করব? স্বার্থের ছায়া যখন ভালোবাসার থেকে বড়ো হয়ে থাকে, তখন ভালোবাসাও সূর্যাস্তের মতো এভাবে মিলিয়ে যায়, তাই না? কতটা স্বার্থপর হয় মানুষ? যখন তোমরা কাউকে নিয়ে খেলা করো, তখন নিশ্চয়ই এসব মনে থাকে না? কেন থাকবে? এসব মনে রেখে খেলতে গেলে তো খেলার আসল মজাটাই মাটি হয়ে যাবে, তাই না? তোমরা তো শুধুই মজা বোঝো, অন্যেরা গর্তে পড়ুক, পড়ে মরে তো মরুক, তোমাদের তাতে কী এসে যায়!




আমার স্রষ্টা আসলেই নিষ্কর্মা, জানো? আমি নিজেই নিজের জন্যে কিছু করতে পারছি না, সেখানে আমার স্রষ্টা আর কী করবে! এ কারণেই আমার স্রষ্টা নিষ্কর্মা। আজ থেকে আমি ধরে নেব, আমার স্রষ্টা নেই। যে স্রষ্টা আমাকে সারাজীবন এভাবে একটার পর একটা কষ্ট দিয়ে কেড়েই নিয়ে গেছে, সে স্রষ্টা দিয়ে আমি কী করব! না, আমি কিছুই পাইনি আমার স্রষ্টার কাছে, আমাকে এতদিন যা দেওয়া হয়েছে, আমি তার সাথে মানিয়ে নিয়েছি, আমাকে আমার মনমতো কিছুই দেয়া হয়নি, তাহলে আর স্রষ্টা দিয়ে কী কাজ! সব কিছু যখন মেনেই নিতে হচ্ছে, কিছুই যখন হাতে নেই, সব কিছুই যখন খেলনা হয়ে গেছে, আমি নিজেই যখন একটা খেলনা হয়ে গেছি, তখন ওসব বস্তাপচা ফালতু যত্তসব আবেগ ধরে রেখে কী হবে? এর চেয়ে বরং সব শেষ করে দিয়ে, নিজেকে ঝেড়ে ফেলাই ভালো। আমার কোনও স্রষ্টা নেই, যখন আমি পড়ে যাচ্ছি কিংবা যখন আমার সব ভালোবাসার জিনিস, পছন্দের জিনিসই কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তখন নতুন করে ভিখিরি সাজার কী আছে! আজকে থেকে কোনও নৈতিকতা, আদর্শ, আবেগ এসব কিচ্ছু সঙ্গে নিয়ে হাঁটব না। আজকে থেকে আমি মন যা চায়, সেটা ভালো খারাপ যা খুশি হয় হোক, তা-ই করব, কেবলই নিজের স্বার্থ দেখব। এক নিজেকে বাদে আমি আর কাউকে চিনি না!




তোমার নাহয় এই গোটা পৃথিবীতে চার-পাঁচজন হলেও কাছের মানুষ আছে, কিন্তু আমার যে এক তুমি ছাড়া, আমাকে বোঝে, এমন একটা মানুষও নেই? তা-ও তুমি চলে গেলে? আমি নাহয় যা নয় তা-ই বলেছি, তারপরও তুমি তো পারতে বুঝতে! তুমি যে বলতে আমি চলে গেলে তুমি আদৌ থাকতে পারবে না, আমরা আলাদা হয়ে, একজন আরেকজনকে ছেড়ে খুব বেশি দিন থাকতে পারব না? তাহলে সেই তুমিই যে দিব্যি আছ? সব কিছুই কেমন ঝাপসা মনে হয়, জানো? এই পৃথিবীর কোনও কিছুই যেন আর স্পষ্ট দেখতে পাই না, বুঝতে পারি না। মনে হয় যেন আমার জীবনের সব অভিজ্ঞতায়, সব কিছুতেই সময়ের অপচয় হয়েছে মাত্র, আমি বুঝতে পারিনি কিছুই, শিখতে পারিনি কিছুই এই জীবনের কাছ থেকে। আমি কি সত্যিই এতটা অবুঝ? এতটা বোকা আমি? আমি সবসময় শুধু ভুল মানুষগুলোকে নিয়ে হাঁটি? কিন্তু আমার জীবনে কখনও তো সেই ঠিক মানুষটি এলই না! আমি তো শত ভুল করে কিংবা না করেও বারে বারে নিজের ভুল মনে করে, মেনে নিয়েও তোমার কাছে গেছি, তোমার কাছে নত হয়ে থেকেছি, এ ছাড়া আর কী করব আমি? তুমিই বলো কী করলে তুমি আসবে? কীভাবে চললে তোমরা থাকবে আমার জীবনে?




এখন আমি ভীষণ ক্লান্ত তোমাদের হাতে-পায়ে ধরতে ধরতে। একজন ভালোবাসার মানুষের কাছে, একজন বন্ধুর কাছে, একজন আত্মীয়ের কাছে…সবার কাছে নিজেকে নত করে সবাইকে ভালোবেসে তাদের নিয়ে থাকতে চাওয়াটাই কি আমার বড়ো দোষ? আমি চাই তোমাদের ভালোবেসে থাকতে, এটাই আমার দোষ, বলো? তোমরা সবাই কি এতটাই ভালো যে আমি একা থাকতে পারি না বলে তোমাদেরই সকলের দ্বারে দ্বারে আশ্রয় খুঁজে মরছি? কেন ভাবো এমন করে? আমি তো চেয়ে এসেছি একসাথে মানিয়ে নিয়ে চলতে, আর এটাই তোমাদের কাছে আমার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা মনে হলো? যদি একবার আমি সকলের কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিই, তাহলে তোমরা হাজারো ভালোবাসার কিংবা মায়ার জাল বিছিয়ে রাখলেও কি পারবে আমাকে সেই চলে যাওয়া পথে ধরে ফিরিয়ে আনতে? শুধু এটুকু জানিয়ে রাখছি সে সময় এলে আর কখনও তোমরা কেউই পারবে না আমাকে ফেরাতে। হয়তো সেদিন আমি নিজেই আর নিজেকে ফেরাতে পারব না তোমাদের কাছে।




পৃথিবীর যাবতীয় কিছুর উপর থেকে আমার ভালোবাসা, আকর্ষণ উঠে যাচ্ছে, কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছি আমি, আর কিছুই যেন সহ্য হয় না আমার, এতটা ক্লান্তি এতটা অনাস্থা আর ভয় জমে যাচ্ছে সব কিছুর প্রতি যে শত চেষ্টাতেও সেই বরফের পাহাড় গলবে কি না আমি জানি না! ইদানীং আমি নিজেকেই যে আর চিনতে পারি না! কী করে চিনব? যে মানুষ বারে বারে ধোঁকা খায়, নিজেকে দগ্ধ করে, সে তো নিজের প্রতিই একসময় সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে! মায়া কেউ জোর করে ছাড়ায় না, জানো? এই মায়া এমনই এক জিনিস, যেখানে একবার ডুবে গেলে, কেউ আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না। পথ চলতে চলতে, পড়ে যেতে যেতে সব কিছু ঝরে পড়ে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে থাকে, সব কিছু দূরের, সব কিছু অস্পষ্ট মনে হতে থাকে। এই গোটা জীবনটাই আমার কাছে এখন যেন এক মরীচিকার মতো, যা-কিছুই সত্য বলে ছুঁতে যাই, তা-কিছুই ছুঁয়ে দেখি, কেবলই এক ছায়ার পিছু ছুটেছি এতটা কাল। চারপাশে কেবলই ছায়াদের ভিড়, কোথাও কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নেই, কোথাও কেউ নেই আমার।




একটা চরম ফাজিল তুই। তুই জানিস, আমি কষ্ট পাচ্ছি, প্রতি মুহূর্তে মরে যাচ্ছি, আর তুই মজা নিচ্ছিস এটা বুঝেও। তুই জানিস যে আমি তোর প্রতি দুর্বল, তোকে ছাড়া আমার ভালোথাকা অসম্ভব, এজন্যই তুই ইচ্ছা করে আমাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মজা নিচ্ছিস। তুই মানুষ না। তুই একটা…আমি যে মরে যাচ্ছি দম বন্ধ হয়ে, কেন তবুও তুই কিছুই বলছিস না? এমন খেলা করার অর্থ কী? তুই একটা…গলা টিপে মেরে ফেলতাম এই মুহূর্তে কাছে পেলে, দুই হাত দিয়ে কিল-ঘুসি যত খুশি মারতে থাকতাম যতক্ষণ খুশি, ইচ্ছামতো দুই হাতে সব চুল ধরে টানতাম, যত খুশি মারতাম…এমন কেন করছ তুমি আমার সাথে? আমি মরে যাব, প্লিজ, এখন তো একটু আসো, কথা বলো! আমি সত্যিই মরে যাব তুমি এমন করলে। প্লিজ, অনেক অনেক করেছ, এবারে অন্তত আমাকে ক্ষমা করো? তোমার পায়ে পড়ি, তুমি যা বল, যেভাবে চাও, যা চাও, তা-ই হবে, আমি তোমার কথায় উঠব, তোমার কথায় বসব, আর কক্ষনো কোনও অভিযোগ অনুযোগ করব না আমি। আমি মরে যাচ্ছি, প্লিজ, তুমি একটু বোঝো? আর কষ্ট দিয়ো না, প্লিজ। আমি আর কোনওদিন, কক্ষনো এমন করব না। আমি তোমার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। আমাকে মাফ করে দাও না!




তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই, আমার কিচ্ছু নেই, আমার সব কিছু তুমি, আমার পুরো জীবনটাই তুমি। তুমি নেই, তাই যেন আমার দম গলায় এসে আটকে আছে, যে-কোনও সময় আমি দম আটকে মরে যেতে পারি। প্লিজ, মাফ করো, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি যা যা করতে বলো সব করব, তোমার পায়ের কাছে পড়ে থাকব, তোমাকে সারজীবন ধরে মাথায় করে রাখব, তোমাকে সুখে রাখব, শান্তিতে রাখব, তোমাকে খুশি রাখার জন্য যত যা করতে হয় সব কিছু করব! প্লিজ, আমাকে এখন মাফ করো, অনেক হয়েছে এসব, আমি মরে যাব, প্লিজ, একটুখানি বোঝো আমাকে? আমাকে তুমি মেরে ফেলো, তা-ও আসো, আমাকে অন্য শাস্তি দাও, কিন্তু এভাবে কথা না বলে, ভালো না বেসে, যোগাযোগ না রেখে, আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুযন্ত্রণা দিয়ো না! আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক আদরে রাখব, আদর করব, তোমার যা ইচ্ছা আমি তা-ই করব এখন থেকে। প্লিজ, আমি মরে যাচ্ছি। প্লিজ?




আমার বোন আসলে আমাকে ফোন দেয় দুশ্চিন্তা দেওয়ার জন্য। আমি ফোন রিসিভই করতে চাই না, কিন্তু রিসিভ না করে আমি কই পালাব? একদিন, দুইদিন, তিনদিন? তারপর তো আমাকে ফোন ধরতেই হবে, তাই না? আর ফোন দিয়েই রাজ্যের যত আজেবাজে কথা। আসলে সে আমাকে ফোন দেয়ই দুশ্চিন্তা দিয়ে আমার ঘুম নষ্ট করতে। আমার আর ভালো লাগে না কিছু। চারপাশে এত চাপ যে আমি মরেই যাব। আর তুইও সময়মতো গায়েব হয়েছিস। আমি কী করব এখন? কই যাব? কার কাছে যাব? আমার বোন আজকে আবার আমাকে বিয়ের কথা বলেছে, সে আবারও জানতে চাইছে আমি কারও সাথে প্রেম করি কি না। আমি কী বলব? আমি প্রেম করি বললে তো তাকে ওদের সামনে নিতে হবে, আর না করি বললে ওরা ধরেবেঁধে বিয়ের জন্য চাপ দিবে। একজন মানুষ কতবার বিয়ে করে? আমি তো মন থেকে একজনকেই বিয়ে করে বসে আছি, এদিকে সে আমাকে বউ বলে গ্রহণ করে না, করবেও না বলে দিয়েছে। আমি যে কারও সাথে প্রেম করব, সেই যোগ্যতা তো আমার নেই, আবার চাকরির মাথাও তৈরি হচ্ছে না।




চারদিক থেকে এত্ত চাপাচাপি করলে আমি কই যাব? মরব? চাকরি তো হবে, পড়াশোনা যেহেতু করছি, সেহেতু একটু দেরি হলেও চাকরি তো হবেই, কিন্তু আমি এতদিন এত চাপের মধ্যে থেকে কই যাব? আমার আর জীবনে কাউকে বিয়েও করা হবে না, প্রেম তো না-ই। তাহলে আমি এত্ত চাপ একসাথে কীভাবে নিব? মোটকথা, আমি কই যাব, কী করব, কোথায় গেলে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারব? আমার জামাই আমাকে অস্বীকার করে, আমার বাসার লোক আমাকে বিয়ের জন্য, চাকরির জন্য চাপতে থাকে, আমি কই যাব এখন? আমার বোন আজকে আমাকে বলেছে, তুই একটা কী? একটা প্রেমও করতে পারিস না! আশ্চর্য! প্রেম কি খুঁজে খুঁজে করার জিনিস!? আমি কি জনে জনে ছেলেদের ধরে ধরে বলব, এই যে, আপনি কি আমার সাথে প্রেম করবেন? আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়েছে? আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন? এসব বলব, তাই না? আর এদিকে আমার মনের যে ভাঙাচোরা অবস্থা, এ নিয়ে আমি কী করব? নিজেকে নিয়ে আমি এত্ত বড়োসড়ো বিপাকে পড়ব, কোনওদিন ভাবতেও পারিনি। বিয়েই কি জীবনের সব? কিন্তু না, যতদিন একলা থাকব, ততদিন আমার চারপাশের সবাই এভাবেই আমাকে বিয়ে বিয়ে করে সারাক্ষণ চাপতে থাকবে। আমাকে যত জলদি সম্ভব এদের কাছ থেকে সরতে হবে একটা যা হোক চাকরি ধরে, না হলে এরা আমাকে দুশ্চিন্তা দিয়েই মেরে ফেলবে।




আমার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবী থেকেই সরে যাই। তোরা বিয়ে করেছিস না সবাই? সবাই খুব সুখে আছিস তো, তাই না? সুখে সুখে ঝগড়া করিস, সুখে সুখে বাইরে শান্তি খুঁজিস। আমার আর ভালো লাগে না এসব রোজ অশান্তি, এদিকে তুইও আমাকে যন্ত্রণা দিস, রোজ একইভাবে কষ্ট দিয়েই যাচ্ছিস। হে আল্লাহ, তুমি একটা কিছু করো, আমাকে তুলে নাও আর কিছুই যদি না পারো। আজকে আপু আমাকে বলেছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে চাইতে। কী চাই আমার? জামাই, চাকরি? আর? যদি জিজ্ঞেস করি ওদের কাছে যে কী চাইব, তখন পারলে ওরা পুরো পৃথিবী তুলে এনে আমার সামনে এনে বলবে, ‘সব চা!’ হাতে একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে আমাকে নামাজের পাটিতে বসিয়ে দেবে, যেন আল্লাহ আলাদিনের চেরাগ হাতে করে বসে আছেন, যেই না আমি চাইব, সেই সাথে সাথে আমাকে তা দেওয়া হবে! ওরা ভাবে, জীবনে কিছু চেষ্টা না করে কেবল আল্লাহর কাছে চাইলেই সব পাওয়া হয়ে যায়! কী আশ্চর্য মানুষ সব এরা এক একটা?




আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য তো আমার মনের বিষয়। আমি ধার্মিক ও সৎ মানুষ, যা করি মন থেকেই করি, ওদের চাপে বাধ্য হয়ে কেন প্রার্থনা করতে হবে আমাকে? ওদের এসব ভণ্ডামি, লোকদেখানো আয়োজন আমাকে টানে না। পড়াশোনা করি, যা যা কিছু করার করছি, যদি হবার থাকে তো হবে, না হলে যা হবে তা-ই মানতে হবে। এ ছাড়া আর কী করব আমি? এত দুশ্চিন্তা ভালো লাগে না আমার, আর বিয়ে, প্রেম এগুলো তো না-ই! যাকে ভালোবাসছি সে-ই আমার সব কিছু এখন থেকে, আর অন্য কিছু মাথায় ঢুকবে না আমার। জোর করে লাভ নেই। নিজের বিরূদ্ধে গিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক কিছু করেছি আমি, এখন আর না। এখন আমার যা ইচ্ছা হয় আমি সেটাই করব, অন্য কারও মনমর্জিমতো চলা আর সম্ভব না। কিন্তু তার আগে আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে, এই অন্ধকুঠির থেকে নিজেকে বের করতে হবে। তারপর অন্য চিন্তা। তুমি প্লিজ একটু কথা বলো, আমি দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি! তুমি আর বাড়তি দুশ্চিন্তা দিয়ো না। এদিকে আমি সিলেবাস শেষ করতে পারছি না, সেই চিন্তায় একটা দিনও আমার ঘুম হয় না। যদি মার্চে পরীক্ষা হয়, তাহলে এবারও আমি ফেইল করব!




আমি কী করব! এত পড়ি সারাদিন, সব কিছু বাদ দিয়ে সারাদিন বই নিয়ে বসেই থাকি, হাত-পা-পেট-পিঠ সব ব্যথা হয়ে থাকে! আজকে তো পিঠব্যথায় পড়তেই পারলাম না সারাদিন, রেস্ট নিয়ে গ্যাপ দিয়ে আবার পড়ি আবার পড়ি, তবু শেষ হয় না কেন কিছু! এত পড়া কই থেকে আসে, খোদা! ওদিকে আমার বোনটা হচ্ছে আস্ত একটা বদের বদ, ফোন দিয়ে দিয়ে আমার মাথাটাই নষ্ট করে দেয়! ওর জন্মই হয়েছে আমাকে জ্বালানোর জন্য। ও আসলে একটা দুশ্চিন্তার বাসা! কী হয় মানুষের বিয়ে না হলে? কী হয় চাকরি না হলে? এত দুশ্চিন্তা আমার মাথায় দিতে হবে সারাক্ষণ! আমি কার কাছে যাব, কোথায় গেলে একটু শান্তি পাবো আমি? এরা আসলে সবসময় এদের মনমতোই আমাকে চালাতে চাইবে, আমাকেই এদের কথা পাত্তা না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে চলতে হবে, ডাস্টবিনে যাক সব অন্যে কে কী বলল! এখন বিয়ে, চাকরি নিয়ে জ্বালাচ্ছে, সব হলে তারপর বলবে, বাচ্চা নাও বাচ্চা নাও, তারপর একটার পর একটা চলতেই থাকবে অনগোয়িং প্রসেসে…




কী অদ্ভুত জীবন নিয়ে দৌড়ে চলছে সবাই। জন্মাও, পড়াশোনা করো, চাকরি করো, বিয়ে করো, বাচ্চা দাও, তারপর বাচ্চার পিছে দৌড়াও…এভাবেই চলছে সবাই, আর যেহেতু সবাই এভাবে চলছে, সেহেতু আমাকেও সবার মতো টাইমলি এসব কিছু করতে হবে, টাইমে আগে পরে কিংবা নিজের ইচ্ছামতো, নিজের নিয়মে আমি জীবনটাকে যেভাবে চালাতে চাই সেভাবে চালাতে পারব না! কী সাংঘাতিক ব্যাপার! ভাবা যায় জীবন কেমন একটা ঝড়ের বেগে চলছে! অথচ এই বেগ টের পাবার নয়। একটার পর একটা, একটা আরেকটার হাত ধরে বিবর্তিত হচ্ছে, তার অর্থ, যদি আমি হাত-পা গুটিয়ে বসেও থাকি, তাহলেও জীবন আমার থেমে থাকার জন্য নিজেকে থামিয়ে দেবে না একমুহূর্তের জন্যেও, তাহলে কী দাঁড়ায়? এত কীসের তাড়া, কিংবা যদি দৌড় দিলামই-বা তাহলেও কি জীবনের আগে যেতে পারব? কেউ পেরেছে কি কখনও? ধ্যাৎ! যত্তসব ফালতু কাজ একটার পর একটা করতেই হবে, নইলে কিছুই হবে না জীবনের উন্নতির! এমন ভাবনা কে ঢোকালো আমাদের মাথায়? জীবন যে কেটে যাচ্ছে এত ব্যস্ততা, এত দৌড়ের মাঝে, সেটাই কি আর আমাদের মনে আছে?




যেদিন সব ক্লান্তির শেষ দিন আসবে, সেদিন তো জীবনটাই মুছে যাবে, বাঁচা আর হবে কবে! তার চেয়ে থাকি না বেঁচে, আমি নাহয় অন্যদের চেয়ে কিছু দিন পর থেকে বাঁচা শুরু করি! আগে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াই, নিজে কিছু একটা করি, তারপর হোক যা হবার? অন্য কারও কথা আজকে শুনে মেনে চলতে বাধ্য হলেও একটা এমন দিন যেন আমার জীবনে আনতে পারি, যেদিন আর কারুরই আমাকে কোনও কিছু মানতে বাধ্য করার সাহস থাকবে না, জীবনকে আমি যে পথে, যেরকমভাবে সাজাতে চাইব, সেরকমভাবে সে পথেই যেন চালাতে পারি! অনেক তো চললাম অন্যের কথা, অন্যের পছন্দ মতন। এখন নাহয় একটুখানি নিজের মতো করে বাঁচি, কারও সাথে নিজেকে তুলনা করা ছাড়া? কারও সাথে না দৌড়ে কেবল নিজের সাথে নিজের দৌড় হোক এবার? আমি আসলে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি এত দৌড়াতে দৌড়াতে। কিছুই ধরতে পারছি না, অথচ দৌড়ে চলেছি। এভাবে দৌড়ালে কখনওই কোথাও যাওয়া হবে না আমার। আর যা-ই হোক, এভাবে অন্যের কথামতো সব কিছু করে গেলে নিজের মতো করে বাঁচা হবে না কোনওদিনই।




তা ছাড়া এটাও তো সত্যি যে কেউ কারও দায়িত্ব নেয় না, আমার দায়িত্বও আমাকেই নিতে হবে, অন্য কেউ নেবে না, যা সহ্য করার জীবনভর আমাকেই সহ্য করে যেতে হবে। আমার যত ক্ষত, আমার যত আঘাত, আমার যত প্রাপ্তি, আমার যত অপ্রাপ্তি দিনশেষে আর কে ভোগ করবে এক আমি ছাড়া? তাহলে সবার কথায় এত সিরিয়াসলি নিয়ে কী হবে? আমি যে গতিতে যে উদ্দেশ্যে চলছি, আমাকে সেই পথে সেই নিজের মতো করে হাঁটতে হবে। আমার হাঁটাটা তো আর অন্যেরা পারবে না করে দিতে। এরপরও যদি সব কিছু অগোছালোই থাকে, যদি মনের মতো একটা জীবন না-ইবা পাই, তাহলে তা-ই হোক। আমাকে আসলে এখন কান বন্ধ করে কারও কথায় পাত্তা না দিয়ে পড়তে হবে, যার যা খুশি, যা ইচ্ছা বলে বলুক, তবু আমি আমার মতো চলি। আশ্চর্য লাগে, কেউ দায়িত্বও নেবে না আবার প্রেসার দিতে থাকবে, যখন আমার সব কিছু আমারটা আমাকেই দেখতে হবে, আমাকেই আমার সব দায়িত্ব নিতে হবে, তখন এরা আছে কী করতে? আর আমিইবা এদের কথায় নিজের শান্তি উচ্ছন্নে কেন দিচ্ছি? আমি কিছু করতে না পরলে আমিই খারাপ থাকব, তাতে তো অন্য কারও কিছুই না, অথচ কী অবলীলায় এরা এক একজন এমন চিন্তা দেখায় যেন এদের এক-একজনের পেটের ভাতই হজম হচ্ছে না দুশ্চিন্তায়! হঠাৎ আমাকে নিয়ে সবার এত্ত চিন্তা কই থেকে এল?




চাকরি না পেলে, বিয়ে না হলে সবাইকে আমার দায়িত্ব নিতে হবে, আমার বাড়তি একটা বোঝা ওদের টেনে বেড়াতে হবে, আসল চিন্তাটা তো এটা, কিন্তু মুখে বলবে অন্য কথা, ভাব দেখাবে অন্য কিছুর! আমি এমনিতেই কারও ঘাড়ে থাকব না, এখনও তো শুধু আব্বু-আম্মু ছাড়া কেউই আমাকে কোনও প্রকার হেল্প করে না, আমিও তো কারও কাছে কিছুই চাইতে যাই না, তাহলেও কেন এই বাড়তি ভয়! আমি নিজের দায়িত্ব নিজেই নেব, আর কাউকে আমার চিন্তা করতেও হবে না, এতটুকু সময়ের সাথে সাথে ওরা বুঝে যাবে ঠিকই। এখন ভয়ে আছে, পাছে ওদের সবাইকে আমার বোঝা টানতে হয়, এজন্যেই এসব বলছে। ওরা এটা বোঝে না, আমি নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারলে বাঁচি, আমারও ইচ্ছে নেই কারও গলায় দড়ি বেঁধে কিংবা কারও মাথার উপরে বোঝা হয়ে কিংবা কারও গলায় নিজেকে ঝুলিয়ে দিতে। নিজেকে আমি একাই চালাতে পারব। আমার সব কিছু নিয়ে আমার চিন্তা আছে, অন্য কেউ সে বাড়তি চিন্তাটুকু না করলেই বরং সে ভালো থাকবে।




তবে এ-ও ভালো হলো, আমি তাদের মনের কথা বুঝে নিলাম, তারা কে কেমন। তারা কে কতটা আমাকে নিয়ে চিন্তা করে, আমার ভালো চাইবার নামে কে কী মনে মনে চিন্তা করে, সবই আমার জানা। এইসব জেনে বরং খুব ভালো হলো। অন্তত বাকি জীবনটা আমি এমন ভ্রান্ত বিশ্বাস নিয়ে থাকতাম যে সবাই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে, কেয়ার করে, সেই ভ্রান্তিটা কেটে গেল। এখন আমি ধীরে সুস্থে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারব, নিজের পথ নিজে তৈরি করে নিতে পারব, কেননা আমার কোনও পিছুটান নেই। আমি একলা, এটাই আমার বড়ো সম্পদ, একটি মাত্র সম্ব্ল।




তুমি খুব করে চাইছ আমি শান্ত হয়ে যাই? অস্থির না হই, পাগলামো না করি আর? তবে তা-ই হোক। অনেক করেছি ওসব। যে মানুষটার কাছে আমার সব কথাই মূল্যহীন, পাগলামো, যার কাছে আমি কেবলই একজন অস্থিরমতি চিন্তার পাহাড়, তবে সে আর না বলুক কিছু। তুমি কিংবা তোমরা খুব চাও, আমি বদলে যাই। কেমন বদল চাও? যেন নিশ্চুপ হয়ে যাই? যেন একজন মুখোশের আড়ালের মানুষ হয়ে যাই? এমনই হই যাতে কেউ ভেতরের খবর না রাখে? ভেতরের খবর জেনে গেলেই বন্ধুও শিকারি হয়ে ওঠে! অনেকটা মাতাল মানুষের মতো করে গেছি সব কিছুই। আবোল-তাবোল বকেছি নিজের সাথে, তোমার সাথে, তোমাদের নিয়ে, তোমাকে নিয়ে। কখনও বোঝার চেষ্টা করিনি, যাকে সবাই বোঝে, তাকে সব কিছু এভাবে বলে কয়ে বোঝাতে হয় না। যে জাগ্রত অবস্থাতেও ঘুমিয়ে থাকার ভান করে আছে, যে আমার কথা আসলে শুনতেই চাইছে না। তাকে যত যা-কিছুই বলা হোক না কেন, সেগুলো আখেরে তার মন অবধি পৌঁছাবে না। আমি এখন থেকে চুপ করেই থাকব। ভেতরটা তোলপাড় হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও বাইরে আর কখনওই তা প্রকাশ পাবে না।




হঠাৎই ভালোবাসার স্রোতে ভেসে গিয়ে আমি নিজেকে ভুলে গেছি, যেন নিজের ছায়াও আমার কাছে ভয়ানক মনে হয়, সবসময় নিজের ও নিজের ছায়ার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাইছি আমি! কেন এমন হচ্ছে? কেননা আমি নিজের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছি। নিজের মুখোমুখি হলেই আমি টের পেয়ে যেতাম, আমি আর সেই আগের আমি নেই, কতটা বদলে গেছি নিজের অজান্তেই, সেসব কিছু পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে, আর এই সত্যকেই মেনে নিতে চাইছি না যে আমি আসলে পুরনো আমি নেই। সেই শান্ত, ধীর, চিন্তাশীল, সদাজাগ্রত, নিজের কাজে সচেতন থাকা সেই মানুষটা নেই আর আমি। আমার ভেতরের সব কিছু অনেকই বদলে গেছে এতদিন, যা-কিছু সুপ্ত ছিল কিংবা জাগ্রত ছিল, তার সবই কোথায় যেন হারাতে বসেছি। কিন্তু এখন আর ভুল হবে না। এখন সব কিছু আবার আমার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। সব কিছুকে এই বুকের মধ্যে রেখে দিব্যি মুখোশের আড়ালে আমিও ঢেকে রাখব নিজেকে। তোমাকে ছাড়া বাঁচা যায় না, তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না, তোমার সাথে কথা না বলে দম বন্ধ হয়ে আসছে, ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে, চোখ বন্ধ করলেও তুমি এসে যাও, মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে কেবলই আমার সমগ্র চেতনা জুড়ে তুমি, খুব যন্ত্রণা হচ্ছে তোমাকে ছাড়া, আমার পক্ষে আর কারও হওয়া সম্ভব নয়, কোথাও যাওয়া সম্ভব নয় আর এই ভুবন ছেড়ে, এইসব পাগলামো আর অস্থিরমতি কথা আর কখনও বলব না তোমাকে। আমার সব কিছু চলবে এবার ভেতরেই কেবল।




শুধু ভালোবাসলেই চলে না, ভালোবাসাকে লালন করাও জরুরি। সম্পর্কের শুরুতে বোঝা যায় না সম্পর্কের পথ ধরে হেঁটে যাওয়া কতটা যে কঠিন। সম্পর্ক তো হয়েই যায়, কিন্তু সেটাকে লালন করা, যত্ন করা…সে যে অনেকসময়ই নিজের নাগালের বাইরে মনে হয়। ধরে নিয়েছি, একটা শূন্য বাক্স নিয়ে এসেছিলাম তোমার জীবনে, তোমার বাক্সটা আমার কাছে আর আমার বাক্সটা তোমার কাছে বাঁধা। তোমার বাক্স খুলে দেখি, ভালোবাসাগুলো এখনও কত জীবন্ত, প্রাণবন্ত, অথচ আমি কেবল অভিযোগ অনুযোগ, কথা দিয়েই ভরে গেছি আমার বাক্সখানি! এ কীভাবে সম্ভব? ভালো তো আমিই বেসেছি বেশি, তাহলে আমার বাক্সটাই ভারী হবার কথা ছিল, কথা ছিল শুভ্রতায় ভরিয়ে দেবো তোমার চারপাশ, কিন্তু আমার অভিযোগ, প্রত্যাশা, শব্দমালার স্তূপে সেই কোমল শুভ্রতাটুকুই চাপা পড়ে গেছে তলে। এখন আর ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায়, তা কেবলই পাথর। তোমার হৃদয়টাকে কাঁটাছেঁড়া করেছি খুব, তাই না? আমাকে ক্ষমা করো। আমার কাছে ভালোবাসার অর্থ ভালোবাসাই শুধু, এইটুকু বোঝাতেই অনেক অজানা পথ পাড়ি দিয়েছি, তোমার মনের অনেক চোরাগলি ঘুরে বেড়িয়েছি রোজ, অথচ নিজেকেই আজ আমি আর চিনতে পারি না। কখন তুমি এলে আমার হৃদয়ে টেরই পেলাম না। আমার হৃদয়ের সেই বিশাল প্রাচীর ভেদ করে কখন যে তুমি অন্দরমহলে ঢুকে পড়লে টেরই পাইনি।




পেলে হয়তো সদরদরজায় দাঁড় করিয়েই বলে দিতাম, দাঁড়ান ওখানেই, আর ভেতরে আসবার চেষ্টা করবেন না, এরপর আর যাবার জায়গা নেই। নিজেকে বন্ধ করে রাখিনি, তুমিও ঢুকে গেছ গভীরে, এখন তোমার আমার ভেতরের সবটাই জানা। এখন আমার দুর্বলতাটুকুও জানো তুমি, তাই ইচ্ছেখুশিমতো ব্যথা দাও, আঘাত করো, যা খুশি নিজের ইচ্ছেমতো করেই চলো, আমিও কিছু বলতে পারি না, বাধা দিতে পারি না, বের করে দিতে কিংবা তাড়িয়ে দিতে পারি না। কিংবা এখন তোমাকে বের করে দিয়ে সদরদরজা বন্ধ করে দিলেও যে মানুষ ভেতরটা জেনে গেছে, সে দূর থেকেও যে-কোনও সময় আক্রমণ করতে পারে, সে আমি জানি, আর এটাই হয়তো তোমার প্রধান হাতিয়ার। একটা মানুষ যখন আরেকটা মানুষের হৃদয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে, তখন সেখানে আর কারও কোনও জোর চলে না। আজ বুঝতে পারি যে আমি কতটা তুমিকেন্দ্রিক, আমার সারাপৃথিবী বলতে কেবলই তুমি, আমার চারপাশ ঘিরে, আমার সকল চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু তুমি, আমার চারপাশে তুমি তোমার ভালোবাসার এত বড়ো আর এত উঁচু দেয়াল তৈরি করেছ যে সে দেয়াল টপকে অন্য কিছু দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওটা অত বড়ো দেয়াল যে আমি কিছুতেই তা টপকে বাইরে দেখতে পাবো না। আমার চিন্তার জগৎ কিংবা আমার বাইরের জগত সব কিছু ঘিরে কেবল তুমি আর তুমি। এটা যদি আবেগ হয়, তাহলে এই আবেগ থেকে আমি চাইছি বের হতে, খুব চেষ্টা করে চলেছি রোজ এই আবেগগুলোকে ঝেড়ে ফেলে বাইরের বাস্তবতার জগতটাকে দেখতে, কিন্তু এই আবেগ কেন জানি আমার রক্তের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে একে কিছুতেই আলাদা করা যায় না।




এখন আমার মাঝে কোনটা আমি আর কোনটা আবেগ, তা-ও বুঝতে পারি না। কেন এমন হলো? আমি কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিলাম তোমার কাছে এক তোমাকে ছাড়া? অথচ তুমি আমার সম্পূর্ণটাই সাপটে নিয়ে নিলে, তা-ও এমনভাবে যে আমার মাঝে আমার কোনও চিহ্নটুকু পর্যন্ত রইল না! আমার ভেতরে আমি তো নেই, এই আমিটা এখানে পড়ে আছি, এটা কেবল একটা খোলস মনে হয় আমার কাছে। আমার আসলটা তোমার কাছে চলে গেছে অনেক আগেই, আমার সবটুকু যখন তোমার কাছে নিয়েই গেছ, তাহলে শুধু এই পোশাকটা, শুধু এই খোলসটা রেখে গেলে কেন? তোমার ফেলে-যাওয়া এই ফাঁকা খোলস দিয়ে আমি কী করব এক সাজিয়ে রাখা ছাড়া? এমন প্রাণহীন, ধূসর, জীর্ণশীর্ণ খোলস কেউ তো তার ঘর সাজাবার জন্যেও নেয় না! আমাকে দিয়ে কী হবে কারও? যে খোলসে আত্মাই নেই, সে খোলস কী কাজে আসে আর? আমি নিজেকে দিয়ে আর কিছু করাতে পারি না, জানো? সব কিছু থেকেই আজকাল আমার মন সম্পূর্ণ উঠে গেছে, সব কিছু কেমন অদ্ভুত রকমের অর্থহীন মনে হয়। এই আত্মা ছাড়া খোলস কে-ইবা নিতে চাইবে, বলো? আমার ভেতরটা তো মৃত। এই মৃত খোলসটা টেনে নিয়ে বয়ে বেড়াতে আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, যদি একটি বার জানতে!




আমার জীবনে ভালোবাসা জিনিসটা খুব দুর্লভ, যা হাজার খুঁজেও পাওয়া যায় না। এ এমনই এক ধন, আমি তো কখনও বুঝিইনি যে ভালোবাসা বলে কিছু আছে, সবসময় ভালোবাসার অনুভূতিগুলো অন্যের কাছে শুনে হেসে উড়িয়ে দেওয়া সে-ই আমিই কিনা আজ এতটা নির্জীব আর অসহায় হয়ে পড়ে আছি স্রেফ কিছু অনুভূতির তাগিদে? কোথা থেকে আমাকে কোথায় নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল এই ভালোবাসা? এই একটা মাত্র অভিজ্ঞতা আমার পুরো জীবনের মানেই বদলে দিয়েছে। এখন মনে হয়, যার কাছে তার ভালোবাসার মানুষটাই নেই, সে আসলেই কতটা দরিদ্র, তাই না? এখন আর কোনও চাকচিক্য আমাকে টানে না, এমন সব কিছুই যা আমাকে আগে টানত, তার সবই যেন হঠাৎই নিরর্থক হয়ে গেছে। কী দিয়ে ভুলিয়ে রাখি নিজেকে? কোন সে মোহে ডোবাই নিজেকে? আমার যে আশেপাশের সব কিছুর উপর থেকেই মোহটা চলে গেল! কেবল বাধ্যবাধকতায় জীবন কাটাতে এত যে কষ্ট, তা আগে কখনও বুঝিনি এমন করে। জীবন আমার সাথে সবসময় এমন বাজি কেন খেলে, বলতে পারো? ছোটো থেকেই একটার পর একটা বাজি খেলেই চলেছে জীবন আমার সাথে, যেন জীবনকে আমিই টেনে ধরে রাখতে চাইছি, অথচ জীবনই আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মনের ভেতরে মন থাকলে না সেটাকে কাজে লাগাবার প্রশ্ন আসে? আমার ভেতরে যে মনটাই নেই, তাই হার মানাতে পারছি না আর এই খোলসটাকে।




বলাটা কত সহজ, তাই না? ছেড়ে যাব, ভুলে যাব, আমার কিছু এসে যায় না, তাকে ছাড়াও চলা যায় আরও কত্ত কী, তাই না? কোথায় গেল আমার সেই উদ্ভট আচরণগুলো? আর তো সেগুলো নেই-ই আমার মাঝে! আর তো ভেতর থেকে কেউ বলে না, এটা কোনও ব্যাপার! কত মানুষ আমার চারপাশ ঘিরে, অথচ আমার চোখ কেবলই তোমাকে খোঁজে। চারদিকে কত স্বর, অথচ আমার কান কেবলই তোমার স্বর খোঁজে, পাগলের মতো একে ওকে হাতিয়ে বেড়ায়, এদের মধ্যে কোনওটা যদি তুমি হও, সে আশায়! রিপ্লেস হয় না, রিপ্লেস করা যায় না। জীবনে সব কিছুর রিপ্লেসমেন্ট হয় না। জানো, আগে জানতাম সবারই জীবনে খুশি হওয়া খুব সহজ, এখন বুঝি, নিজের জন্য ঠোঁটের হাসি কিনে আনা সবচাইতে দামি ও কঠিন কিছু! একটা গোটা জীবনের দামেও কখনও কখনও ওই সামান্য হাসিটুকুও কেনা যায় না, জানো? সে নির্মল, সৎ এবং শুদ্ধ হাসির দাম এই জীবনের চাইতেও অনেক অনেক বেশি!




এখন মনে হয়, পৃথিবীটা অনেক ভারী, বাসের অনেক অযোগ্য, তুমি ছাড়া। আমার জীবনের উদ্দেশ্যই যে হারিয়ে গেছে, আর কী হবে বেঁচে থেকে? জীবনের যত অভিজ্ঞতা ছিল, ওগুলোকে নিজের সম্বল ভাবতাম, বেঁচে থাকবার শক্তি পেতাম সেগুলো নিয়ে, অথচ আজ ওগুলো সবই যেন অকেজো আর ভিত্তিহীন মনে হয়। আজ মনে হয়, ভালোবাসা সত্যিই না এলে বাঁচতে অন্তত পারতাম! এ কেমন জীবন পেলাম, হাত ফসকে সবটুকু জীবন পড়ে গেল কেবল ওই পাত্রখানি ছাড়া। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তুমি, আমার আত্মার একমাত্র আত্মীয় তুমি, আমার জান তুমি, আমার চোখের তারা তুমি, আমার আদরের ফুল তুমি, আমার গলার মালা তুমি, আমার হাতের চুড়ি কানের দুল তুমি, আমার চোখের ঘুম তুমি, আমার অলস দুপুর তুমি, আমার রাত্রিশেষ তুমি, আমার চলার একমাত্র সাথি তুমি, আমার ভালোবাসা তুমি, আমার জীবনের জীবন তুমি। এতদিন এই হারানো মেনে নিতে পারছিলাম না, তাই পাগলের প্রলাপ বকেছি, আর আজ বুঝতে পারছি ক্ষতির হিসেব, যা হারিয়েছি পুরো জীবন দিয়েও সে দাম আমি মেটাতে পারব না! ফিরে এসো তুমি, ঘরে ফিরে এসো। তোমার ঘরের প্রতিটি জিনিস কেবলই তোমার অপেক্ষায়।




ভালোবাসা নিয়ে যেসব কথা তুমি বলো ইদানীং, ওগুলো আগে কেন কখনও বলোনি? বিশেষ করে আমাদের সম্পর্কের আগে? বললে অন্তত তোমার মতো মানুষকে ভালোবাসার ভুল কখনওই করতে যেতাম না। কেন, জানো? কারণ তোমার ওই কথাগুলো শুনলে ভীষণ ঘৃণা হয় নিজের প্রতি আমার। যা লিখো, হয়তো কোনওটাই ভেবে লিখো না। তোমাকে ভালোবাসার দায়টা যেমন তোমার ছিল না, তেমনি এই যে বুঝতে পেরেছি, তুমি কখনও আমার হবে না, সুতরাং আমাকে সব কিছু আমার স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে হবে, এই বোধটাও আশা করি তোমার কাছ থেকে শিখবার প্রয়োজন নেই। অনেক সময়ই এমন হয়, জানো, কাউকে কোনও রাস্তা দেখালে সেই মানুষটিই তাকে সেই রাস্তায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে যায়! আসলে তুমিও তো মানুষ, আমি তোমাকে ফেরেশতা কেন ভাবতে গিয়েছি! সেখানেই আমার সব থেকে বড়ো দোষ। যে মা আমাদের ভাষা শিখিয়েছিলেন, সেই মাকেই আমরা যখন জীবনের পাঠ শেখাই, কী করে সন্তান মানুষ করতে হয় শেখাই, তখন মায়ের বলার কিছুই কি থাকে? ভালবাসাটা যে তোমাকে শেখালো, যে তোমাকে ভালোবাসার পথ দেখাল, তাকেই তুমি ভুলে যাবার, মেনে নেবার, মানিয়ে নেবার পাঠ শেখাও! কী অদ্ভুত, তাই না, বলো!




আরও অনেক কিছুই শেখাতে পারি আমি, যা হয়তো তোমার জানা নেই। শিখবে আমার কাছে? কোনওদিন বোধ করি শিখবে, ওই যে বললাম অনেক কিছু জানি, তোমাকে শেখাতে গেলে সবসময় তোমাকে কাছে নিয়ে ধরে বেঁধে শেখাতে যাব, এমনটাই-বা কেন ভাবো? শেখাবার তো অনেক কৌশল আছে, অনেক রাস্তায় সেখানো যায়, ভালোবাসার পাঠ। তুমি না চাইলেও দেখো কোনও একদিন ঠিকই শিখে যাবে। এই যে যেমন তোমার কাছ থেকে আমাকে ভালোবাসার পাঠ শিখতে হয়, তেমনি আরও অনেক কিছুই তুমি শিখে যাবে চলতে চলতে। যদি কখনও জানতে, তোমার ওই বর্ণগুলো আমাকে কতটা ক্ষতবিক্ষত, কতটা রক্তাক্ত করে, তবে হয়তো বুঝতে। আর যা-ই হোক, ভালোবাসার মানুষকে দূরে থেকেও ভালোবাসায় রাখবার, শান্তি দেবার যোগ্যতা তোমার নেই। কারও ক্ষুদ্রতা তো তখনই বোঝা যায়, যখন সে কোনও ক্ষুদ্রকে রক্তাক্ত করে।