রাত্রির পায়ে নৈঃশব্দ্যের নূপুর

 
বড়ো বড়ো শসা রেঁধেছি। মসুরের ডাল আর চিংড়ি দিয়ে।
কোনও মশলা দিইনি। শুধু হলুদ আর মরিচ। কাঁচামরিচ।
জানো, খেতে কী যে মজা হয়েছে!


রাঁধছি আর ভাবছি, এই স্বাস্থ্যকর খাবারটা তোমার জন্যে রাঁধব।
যখন খাচ্ছিলাম, তখন ওটা কেবল তোমাকেই খাওয়াতে ইচ্ছে করছিল।


খাওয়াশেষে লাইট বন্ধ করে চোখ বুজে অনেকক্ষণ শুয়ে ছিলাম।
কেমন জানি কেঁদে ফেলেছি!
ইদানীং আমি খুব সামান্যতেই কেঁদে ফেলি।


তুমি ওইদিন চিংড়ির কথা বলছিলে।
দারোয়ানকে দূরের বাজারে পাঠিয়ে আনিয়েছি।
চিংড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। তা-ও তিনবার পাঠালাম। এরপর পেল।
তোমার জন্যে ফ্রিজে রেখে দিয়েছি।


আজকে রাঁধতে গিয়ে তোমার জন্যে বুক ছিঁড়ে যাচ্ছিল।
জানো, আমার ভয়ংকর রকমের অ্যালার্জির সমস্যা!
চিংড়ি-খাওয়া একেবারেই বারণ। তবু রেঁধেছি, খেয়েছি। কেঁদেছি।


আমি পুরোটাই তুমিকেন্দ্রিক হয়ে গেছি।
এটাতে, ওটাতে। এখানে, ওখানে।
এদিকে, ওদিকে। একাজে, ওকাজে।
সব জায়গাতেই শুধু তোমার ছায়া।


কিছু খেতে গেলে তোমার কথা মনে পড়ে,
কান্না পেলে তোমার কথা মনে পড়ে।
তখন তোমার দেওয়া তোমার ব্যবহৃত
যেকোনও একটা টিশার্ট পরে কাঁদি।


গত তিনদিন ধরে
তোমার খয়েরিরঙের টিশার্টটা পরে আছি। ধুইনি।
তোমার গায়ের ঘ্রাণ ওখানে লেপটে আছে।
স্নানের আগে খুলে স্নানসেরে আবার পরি।


আগামী তিনদিন লালটা পরব।
তারপরের তিনদিন নীলটা।
আর একটা হলদেরঙের গেঞ্জি আছে। ওটা বেশ গরম,
তাই পরতে পারি না। ওটা শীতে পরার জন্য রেখেছি।


আমি সচরাচর এত ঢিলেঢালা পোশাক পরি না। বাসাতেও না।
কিন্তু তোমার এই ইয়া বড়ো বড়ো টিশার্ট পরে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে।
মনে হয়, তুমি আশেপাশেই আছ। কাছেই। খুব কাছেই!
টিশার্ট শুঁকলেই তোমার নিঃশ্বাসের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।


আমাকে রুমমেটরা খুব খ্যাপায়, কী কী যে বলে ওরা!
ওরা আমাকে দেখে হাসে, আমিও ওদের দেখে হাসি।
কেন হাসি, জানো? ওরা তো শুধুই টিশার্টটা দেখে,
তোমাকে তো আর দেখে না!


তুমি যে পোশাকটা যত বেশি পরেছ, তা তত বেশি প্রিয় আমার কাছে।
নীল টিশার্টটা তুমি তেমন পরোইনি। বলেছিলে, একবারই পরেছ।
ওটা এখনও নতুন। ওটাতে আমি সত্যি সত্যিই তোমার কোনও ছোঁয়া পাই না।
আমি ওটা তেমন পরি না।


আমি তবু ওটা রেখে দিয়েছি।
থাক না কিছু দামি জিনিস আমার কাছে!
আমারও তো কিছু ঐশ্বর্য রাখতে ইচ্ছে করে!
তোমার কিছু একটা যখন ছুঁয়ে দেখি,
তখন নিজেকে অনেক ধনী মনে হয়। ওসব তুমি বুঝবে না।


জীবনের প্রায় সব কিছুই বড্ড আপেক্ষিক।
কিছু ছোটোখাটো ভুল, কিছু কষ্ট কিংবা ক্ষতি,
অপ্রাপ্তি আর দূরত্ব, কিছু পেয়েও হারানো…থাকুক না!


কিছু না-পাওয়ায় পূর্ণতা আছে। কিছু ভুল থাকে, যা শুদ্ধতার চেয়েও অনেক শুভ্র।
আসলে কী, জানো, জীবনে কেবল পরীক্ষাই দিয়ে যাচ্ছি,
অথচ কোনও পরীক্ষারই যেন কোনও রেজাল্ট হচ্ছে না।
দিয়েই যাচ্ছি, ক্লান্ত হচ্ছি। ক্লান্তি ঝেড়ে আবারও পরীক্ষা দিচ্ছি।
সেই জন্ম থেকেই দিয়ে যাচ্ছি। হয়তো মৃত্যুর আগমুহূর্তেও দিতে হবে!


বয়স বাড়ছে, আয়ু কমছে। অথচ জীবন থমকে আছে ঠিক আগের জায়গাতেই!
এমনও জীবন হয়! ভাবা যায়?


এক একটা রাত্রির পায়ে যখন নৈঃশব্দ্যের নূপুর কানে বাজে,
তখন প্রায়ই ভাবি, জীবন তো ছোটই।
এভাবে কয়েকটা দিন যদি যায় তো যাক না!