রাত তবু খোয়ায় না কৌমার্য

 
চোখে লেপটে থাকে একটা চুপচাপ রাত্রি।
থমথমে শহর। অস্বাভাবিক শান্ত চারিদিক।
গাছের একটা পাতাও কাঁপছে না।
চঞ্চল পাখিটা অবসরে; নীড়ে, নিজের সংসারে।


হাওয়ার চোখে ছিল ক্লান্তি।
রাতের আকাশ একা, বিচ্ছিন্ন, মুখর।
মেঘের দল নিশ্চল।
চাঁদের গায়ে চেতনা নেই।
একটা চাঁদের ভেতরে আর একটা চাঁদ।


আমি বসে আছি। একা। বরাবরের অভ্যস্ততায়।
গোটা একটা অখণ্ড রাত্রি। যাপিত হবার অপেক্ষায়।
তিনআঙুলের সৈন্যদল; বিশ্বস্ত, অথচ অবাধ্য।
কিছু কালো অক্ষরের অভেদ্য ব্যূহ।
হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢাল, তলোয়ার।
ঝনঝন শব্দ হচ্ছে, কানে তালা লেগে যাচ্ছে।


আমার সামনে বসেথাকা…
একলা আমিটা আমার।
জ্যোৎস্নাটা আমার, তার সাথে বোনাস হিসেবে
আটপৌরে রাত্রির পুরোটা ভাগ।


কেউ আসবে। কেউ আমায় দেখতে আসবে।
আসবে, এসে পাশে বসবে।
সে আমায় এই অনন্ত রাত্রি একলা কাটাতে দেবে না।
সে এসে ভাগ চাইবে। রাত্রির। আলোর। আঁধারের। এবং, আমার।
আমি ভয় পাব। ভয়ে নিজেকে বিস্রস্ত ও বিহ্বল হতে দেবো।
একাকিত্বকে হারিয়ে ফেলার মুহূর্তে একধরনের ভয় হয়।


একজন ‘তুমি’ আসবে।
খুব কাছ থেকে সেই তুমি’র চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব।
তাকে আমি চিনি। তাকে আমি এবং আমরা প্রতিরাতে দেখি।


প্রিয় ‘তুমি’, আমায় দেখে তোমার মধ্যে কিছু অভিমান জমবে।
তুমি থেকে যেতে চাইবে, আমায় রাখতে বলবে।
দূরে সরাতে চাইলে যে থাকতে চাওয়াই নিয়ম!
আর থাকতে চাইলে দূরে সরিয়ে দেওয়াই নিয়ম!


আমার এই ভ্রূযুগলে, খোঁপার বেলিফুলে
মায়া ছড়ানো, রোদ মাখানো।
এই টান, এই স্বস্তি, এই আশ্রয়
উপেক্ষা করার শক্তি তোমার নেই।


হঠাৎ মনে যদি আসে,
নাহয় থেকেই যাই! থেকে গেলে কী হবে!
তখন দুজন মিলে রাত জাগব,
ঘুম তাড়াব, ভোর টানব।
পুরাতন পাপের পুনরাবৃত্ত সুখ আনব। অতএব,
আমার একলা রাতের অসহ্য ক্ষণগুলি ফুরিয়ে যাবে।


এর পর। আর একটা রাত। আরও একটা ভরপুর নিঃসঙ্গতা!
মনে হবে, কাউকে ডাকি! ডাকলে কেউ নিশ্চয়ই আসবে!
পরক্ষণেই ভাবব, যদি সেও চলে যায়!
এভাবেই, পৃথিবীর খাতায় লেখা-না-হওয়া
আমার আরও একটা রাত বিনিদ্র কেটে যাবে।


কেটে যাবার আগে, একটা ছোট্ট পাখিকে কাছে ডাকবে।
পাখিটাকে দেখব। সেই পাখি দুষ্টু, মিষ্টি। একটু পাজি, আর একটু রাগী!
সেই পাখিকে কেবলই আদর করা যায়, কাছে রাখা যায় না।
আমি কেঁদে ফেলব। আমি প্রতিরাতে কেঁদে ফেলি।
আমি কাঁদলে কেউ ধরতে পারে না। তাই, আমি একজন সুখী মানুষ।


পাখিটা পরের রাতেও আসে।
পাখিটা থেকে যাবার প্রতিশ্রুতি নিয়েই আসে, তবে
থেকে যাবার জন্যে কখনও আসে না।
রাতের জন্যে আমি তৈরি, না কি
আমার জন্যে রাত তৈরি, তা বুঝতে বুঝতেই,
পরবর্তী হিসেবি পলকটা ফেলবার আগেই
আরও একটা একলা রাত নেমে আসে।