শপথভাঙার ছুতো

 
এক।

প্রতিদিনই সেই পুরনো রাস্তায় হেঁটে যাই,
যেখানে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল।
সেদিন, আমি ওই কোণাটায় দাঁড়িয়ে
তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম;
হাতে গোলাপ ছিল কি রজনীগন্ধা, মনে নেই।
আমার চোখে স্মৃতিরা সব ভিড় করে,
কিন্তু ওরা কিছুই খুঁজে পায় না।
আমার পথগুলি পথ পেরিয়ে যায়,
ওরা কেবল আমার সাথেই দেখা করে না।
আমি চলেযাওয়া রিকশাগুলি দেখি, বাসগুলি অনুসরণ করি।


এখন আমার আশা কি ভরসা, শেষ সবই।
আমি কি তোমাকে সত্যিই চিনতাম?
আমি কি তোমাকেই চুমুটা খেয়েছি?
তুমি কেবলই স্বপ্ন ছিলে? নাকি সেখানে কিছু বাস্তবতাও ছিল?
আমি কিছুই জানি না।
আমি কি তবে নিজেকেই হারালাম?


অর্ধসত্য এবং অবিশ্বাস্য প্রতারণায় পূর্ণ এই পৃথিবীতে
নির্ভর করার মতো আর কিছুই না থাকলেও, বিশ্বাস করো,
এমন-কী, আমি যখন তোমার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করি বা
বিব্রত হই, তখনও আমি নিজের কাছেই শপথ করে বলি,
তুমি আমায় ঘৃণা কর, তুচ্ছ ভাব, তবু এটা সত্য, সবকিছুর পরও
আমাকেই বিশ্বাস কর, আমার ভালোবাসায় নির্ভর কর।


দুই।
সে চলে গেছে,
সে আজ বহুদূরে চলে গেছে।
এই ঘর, এই শরীর………সব অন্ধকার করে দিয়ে সে চলে গেছে।
যখন সে ভালোবেসে আমায় কাছে টেনেছিল,
তখন তা এতটাই তীব্র ছিল, আমার অন্য কিছুই করার ছিল না।
জানি, সে আমাকে ভাববে, মনে রাখবে, ভুলতে পারবে না,
কিন্তু ওতে কী এসে যায়! কেউ পাশে নেই মানেই তো নেইই।


আমি তাকে থামাতে পারিনি, হয়তো চেয়েছি বলেই পারিনি।
না চাইলেই বরং পাওয়া হয়ে যায়, এমন অনেক কিছুই থাকে ভালোবাসায়।
চকচকে চিৎকারের মতো ট্রেনের সিগন্যাল……কিংবা ফুরফুরে স্মৃতি,
কিছুই মাথায় থাকে না, অবোধের মতো আমি কেবল জানি,
সে এখনও আমাকে চায়। এই জানাটা মিথ্যে হয় যদি,
আমার কাছে কাউকে দেয়ার মতো অবশিষ্ট থেকে যাবে যা,
তবে সে এক আমিই---যা আমি আমাকেই দেবো, ঠিক করেছি।


এমন সময় কে যেন, তাড়াহুড়ো করবেন না,
গোপন কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
ভালোবাসার সময়টি পাকা হয় না, মশাই!
শুনে আমি আরও অদম্য, অবাধ্য হয়ে উঠলাম!
কেন, আমি নিজেই জানি না।


তিন।
রহস্যকে ভালোবাসি বলেই হয়তো আমি তোমাকে
বসন্তের ফাটলে চিনতে পারিনি।
কতটা স্পর্শকাতর আর ছোঁয়াচে
মাতাল মাদকতামাখা ভালোবাসা
লুকিয়ে আজও তোমার জন্য কবিতা লিখি,
তা তুমি ভাবতেই পারবে না!


আমি জীবনের রং ভালোবাসি!
সূর্য এবেলা কেবল স্বর্গে ও আত্মায় থাকুক!
আমি রংধনুর রঙিন পোশাকটি পছন্দ করি।
আমার চারপাশে সবুজ রৌদ্রের হাসি জ্বলছে
অশ্বত্থ গাছটিতে, যে খুব দীর্ঘ, দীর্ঘ সময়ের
জন্য আমার বন্ধুত্ব পেয়েছে। সুখ এত উচ্ছল, অনেকটা গ্রীষ্মের আকাশে
রঙিন ঘুড়ির মতো, আগে মনে হয়নি!
আমি কেবল সত্যিকারের ধনী হয়ে বাঁচার জন্যই
আলোর নানান রঙের উপর নির্ভর করি।
আমি একা---ঘরে কি বাইরে, গাড়িতে কি রাস্তায়।
আমাকে খুশি করার মতো কেউ নেই, কিছু নেই।


পৃথিবী বিশাল, তবে শূন্য। প্রাণহীন প্রেমের কবিতা,
কবিতায় প্রেম, এইসব সেকেলে হয়ে আছে, বহুদিন হল।
তুমি যেদিন আমার জীবন থেকে চলে গেলে,
সেদিন থেকে আমি চিৎকার না করে বাঁচতে শিখে গেছি।
কোনো ইচ্ছে, স্বপ্ন কিংবা আশা থেকে নয়,
আমি চুপ করে থাকতে শিখেছি
আমার চারপাশে চোখ মেলে তাকানোর জন্য, সবকিছুকে থামিয়ে দেয়ার জন্য।


তবে যদি বলো, তোমার চোখের সাথে দেখা করিয়ে দেবে,
কেবল তখনই আমি আমার পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারি হাসিমুখেই!
আমার যত প্রতিশ্রুতি, জাহান্নামে যায় তো যাক,
শপথগুলির চুল পেকে যাক, হাঁটুক ওরা লাঠিতে ভর করেই!
হৃদয়ের গান শুনব বলেই তো বেঁচে আছি,
আত্মাকে ভেঙে যেতে দেবো না ভেবেই তো এতকিছু!


আমি আবারও ফোনের দিকে তাকাচ্ছি,
একটা কল আসবে, প্রতীক্ষায় আছি, না এলে যাবে……
আমি শুধু সেই সময়টির জন্য অপেক্ষা করছি,
যখন আবারও শ্বাস নেবো তৃপ্তিভরে, সব চিৎকার থেমে যাবে---
ভেতরের কি বাইরের।


চার।
প্রেম কী, ঠিক বোঝানো যায় না।
এর যা ব্যাখ্যা, তা সহজ, একইসাথে জটিল।
সেখানে কান্না আছে, দুঃখও আছে, স্বপ্ন আছে, ভালোবাসাও আছে।
আছে কোমলতা, রুক্ষতাও, শক্তি রয়েছে এবং বেশ দুর্বলতাও রয়েছে।
ভালোবাসতে কেমন লাগে, কেউ তা ঠিক বুঝিয়ে বলতে জানে না।
তবে যতক্ষণ আমি কেবল এর মধ্য দিয়েই যাচ্ছি,
ততক্ষণ আমাকে কারও খুঁজে বের করতে হবে না।


সবকিছুই চলে যায়---কি সমস্যা, কি দুঃখ।
যত্নে আবৃত থেকে, এক আধ্যাত্মিক আঁধারে,
বিশ্বাসঘাতকতায়, ক্ষতিতে, উচ্চাভিলাষে, দুর্দশায়
কখনওবা ভুলেও যেতে পারি, জীবন ক্ষণিকের, জীবন নশ্বর।
এবং শূন্যতায় ঘেরা। যদি ভালোবাসা না থাকে,
তবে আমাদের মধ্যে কিছুই আর বাকি থাকবে না।


যদি আমাদের কোনও অনুভূতি কি আবেগ, কোনোটাই না থাকে,
যদি এমন হয়, আমরা আমাদের জীবনের গায়ে
অবিরাম দাগ টেনে চলেছি বা সে দুর্বোধ্য পথে অলস ঢঙে গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছি,
তবে এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে আমরা জীবনটাকেই পুরোপুরি নষ্ট করে দিচ্ছি।


পাঁচ।
এ মহাপৃথিবী আমাদের নানান পথ দেখায় আর বুদ্ধি বলে।
আমরা শেষ দরোজার দিকে এগিয়ে যাই, যাত্রাপথটা কমিয়ে আনি,
প্রেমের কবিতা, কবিতাপ্রেম আমাদের কাছে মুখোশহীন কিছু দূত পাঠায়,
ওরা পথ দেখায়, ইশারা দেয়। যদি আমরা ভাল করে না দেখি, সেই
অবিরত ইশারায় একটি পথের চিহ্ন, যা আমাদের আত্মার খোঁজ পাঠায়,
সেটি হয়তো কোনো কাকতাল কিংবা অলীক স্বপ্ন, বা
ভাগ্য নিছকই---ভাল কি খারাপ!


আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজই কেবল একটি কাজ হয়ে ওঠে---
আলোর দিকেই চলা আর সমস্ত কিছুকেই গ্রহণসাপেক্ষে থাকতে দেয়া………
সেখানে প্রেম দাঁড়িয়ে প্রথম সারিতেই!
আমরা চলি এক বাঁধা শিডিউলে---বাড়ি, পরিবার, কাজ, ট্রাফিক জ্যাম।
এইসব শুনে যদি কারও হৃদয় ধড়ফড় করে, থেমে যাও দেরি হবার আগেই!
সব পড়ার, সব বোঝার দায় নিয়ো না, তবু শোনো, মন দিয়ে শোনো!
এই পৃথিবীতে কাকতালীয় কোনও ঘটনাই নেই,
ঘটনাগুলি আমাদের কেবলই প্রেমের দিকে নিয়ে যায়।