শেষ অনুরোধ

 
আমি মুগ্ধ। তিতুমীর কলেজ থেকে ম্যানেজমেন্টে অনার্স, ওখান থেকেই মাস্টার্স। আমার প্রেমিকা রাত্রি, আমার ব্যাচেরই। ওর সাবজেক্ট ছিল ফিজিক্স।


প্রথম যখন গাজীপুর থেকে এখানে পড়তে আসি, তখন আমি বেশ লাজুক ছিলাম। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না কারও সাথেই। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে গেল। ওদের মধ্যে অতনুটা আবার খুব সংস্কৃতিমনা ছিল। গান, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, বিতর্ক কিছুই বাদ দিত না। সেখান থেকেই পরিচয় রাত্রির সাথে।


ও উপস্থাপনা করত। খুব ভালো যে করত, সেরকম কিছু না। কিন্তু অত সুন্দরী একটা মেয়ের ভুল ধরতে যাবেই-বা কে? অতনুর বন্ধু হওয়ার সুবাদে সব ধরনের কালচারাল প্রোগ্রামে আমি যেতাম। প্রথম দিকে অতনুর জোরাজুরিতে যেতে হতো, পরে তো রাত্রির কারণে সেটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেল।


এরকম করেই রাত্রির সাথে বন্ধুত্ব এবং পরে সেটা প্রেম অবধিও গড়ায়। রাত্রি আর আমি যখন দেখা করতাম, ও প্রায় সময়ই খোঁপায় কিংবা কানের পাশে জবাফুল গুঁজে রাখত, রক্তজবা ফুল। অপূর্ব লাগত দেখতে! মনে হতো, দুটো ফুল যেন একসাথে হাসছে।


ও কথা বলার সময় আমি ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। ফুলছেঁড়া যেমন নিষেধ, তেমনি মনে হতো, ওকে ছোঁয়ার উপরও অদৃশ্য কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। তাই আমি ওকে শুধুই দেখতাম। দেখতাম বলতে, ওর সাথে আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে, এখন আর দেখতে পাই না। ও যদিও মুখে কিছু বলেনি, আমি বুঝতে পেরেছি। কত কিছুই তো বুঝে নিচ্ছি আজকাল! বয়স হচ্ছে, বুঝতে পারছি!


আমার মাস্টার্স শেষ, রাত্রিরও। ও ইদানীং ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ‘মিসিং মাই ক্যাম্পাস, মিসিং সেমিনার-রুম…’ হাবিজাবি আরও কত কিছু! ওর যত মিস-করা জিনিস দিয়ে ভেসে যায় ফেইসবুক, আর ওর স্মৃতিতে ভেসে যায় আমার পুরো বুক। ও লাইক পায়, আমি কষ্ট পাই। ওকে কমেন্টে মানুষ সান্ত্বনা দেয়, আর আমি দিই আমার নিজেকে। ও ফেইসবুকে এটা সেটা পোস্ট করায় ব্যস্ত, আর আমি ব্যস্ত বাস্তবতার ধাক্কা সামলাতে। এখানে ধাক্কা খাই, ওখানে পড়ে যাই। জীবন এভাবেই চলছে।


আমি ম্যাথে ভালো ছিলাম না কখনওই, সেজন্য অ্যাকাউন্টিং কিংবা ফিন্যান্সে যেতে পারিনি। কোনও একটা অঙ্কের উত্তর বের করতে করতে দেখি, অন্যরা ওই সময়ের মধ্যে আরও পাঁচ-ছয়টা শেষ করে ফেলেছে! আর আমার ইংরেজির অবস্থা তো আরও খারাপ। মানুষ কথায় কথায় ছোটোখাটো যেসব ইংরেজি বলে, আমি তো সেগুলিরই অর্থ মেলাতে পারি না! কত যে ভুলভাল ইংরেজি বলে বন্ধুদের হাসিয়েছি, তার হিসেব নেই! তবে হ্যাঁ, আজ না চাইতেও অনেক ভুলের হিসেব করতে হচ্ছে।


সে-ই আমাকেই বিভিন্ন জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ইন্টারভিউর সময় কোনও প্রশ্ন ইংরেজিতে করা হলে আমি তো অনেক সময় প্রশ্নই বুঝি না, উত্তর দেবো কী! আমার চাকরি হচ্ছে না।---এর চাইতে বড়ো সত্য আমার জীবনে আপাতত নেই।


আমি পড়াশোনায় ভালো না, অন্য কোনও কিছুতেও ভালো না। এখন মনে হয়, আমি দেখতেও ভালো না। যার একটাও চাকরি হয় না, সে দেখতে ভালো হয় না। আমার কষ্ট আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। অবশ্য সেই চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছি বহুদিন হলো।


আমি আর রাত্রি কত ঘুরে বেড়াতাম একসময়! অনেক সুন্দর ছিল আমাদের সম্পর্কটা। সেইসব সময়ের কথা ভাবলে মনে হয়, আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। ওকে আমি ডাকতাম, ‘আমার মানুষটা’ নামে। সেও আমাকে একটা নামে ডাকত, ওটা বলা যাবে না। আমার এই রাত্রিই এখন হয়তো অন্য কারও রাতজাগার কারণ!


ওকে বলেছিলাম আমাকে ব্লক করতে, করেনি। আমিই করে দেবো ভাবছি। ভালোবেসেও তো সরিয়ে দেওয়া যায় মানুষকে, যায় না?


রাত্রি, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়। আচ্ছা, তোমরা দিনের বেলায় যেসব স্বপ্ন দেখাও, রাত্রি হবার সাথে সাথেই সেগুলি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কী করে? বোধহয় ওগুলিকেই বলে দিবাস্বপ্ন, তাই না? হা হা…।


শোনো, তোমার কাছে একটাই অনুরোধ। তোমার তো সৌন্দর্য আছে, ফেইসবুকে একগাদা ফলোয়ার আছে, বন্ধুবান্ধব আছে, উপস্থাপনা আছে, অত বড় একটা মঞ্চ আছে; আমার যে এসবের কিছুই নেই! তুমি আমাদের স্মৃতিগুলি মেরে না ফেলে ওগুলি আমায় দিয়ে যাবে? আমি তো জানি, একসময় তুমি হয়তো কোনও বান্ধবীর কাছে বলে হাসতে হাসতে উড়িয়েই দেবে ওসব; তার চেয়ে বরং আমায় দেবে? আমি যত্ন করে সাজিয়ে রাখব। মাঝে মাঝে বার করে রুমাল দিয়ে মুছেও রাখব আমাদের স্মৃতিগুলি আর আমার চোখ দুটোকে। ওগুলি তো তোমার একার না। তবে কেন নিয়ে যাচ্ছ? দিয়ে গেলে হয় না, রাত্রি?