সময়

আমি হাঁটতে থাকি, অন্ধকার নামতে থাকে।
আমি ভাবতে থাকি, অন্ধকার নামতে থাকে।
না, এজন্য আমার মন খারাপ নয়।


আমি কৌতূহলী ছিলাম, আমি পড়তে ভালোবাসতাম।
আমি অনেক কিছু জানতাম না, তবে কিছু কিছু জিনিসের সব কিছুই জানতাম।
ফুল ঝরে যেতে দেখলে আমি সেই ফুলের নাম বলতে পারতাম।
কোন জাদুটা সুখ ছড়ায়, এবং কোন জাদুতে দুঃখ ঝরে ঝরে পড়ে, আমি তা-ও জানতাম।
আমি দেখেছি, বিস্মৃতির কণামাত্র তাগিদ অনুভব না-করেও, মানুষ খুব সহজেই ভুলে যেতে পারে।
না, এজন্য আমার মন খারাপ নয়।


আমি বৃষ্টির সাথে দিন কাটিয়েছি;
জলের দুঃখ দেখে যারা দুঃখী হয়েছিল,
সেই দলটিতে আমিও ছিলাম, তোমরা দেখোনি।
শেষ পাতাটিও ঝরে যাবার সময় গাছেরা কীভাবে কাঁদে,
তা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি।
সাহসীদের ভয় পেয়ে কাঁদতে দেখেছি,
ওদের দেখে বাকিরা সবাই মিলে হাসছিল, আমি দেখেছি তা-ও।
না, এজন্য আমার মন খারাপ নয়।


বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটেছি,
ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে পা ভিজিয়েছি দীর্ঘসময় ধরে,
বহু বহু প্রেতমূর্তিকে কোন‌ও এক অজানা উচ্ছ্বাসে কলকল শব্দে হেসে উঠতে দেখেছি সময়ে অসময়ে।
ভালোবাসতেই জানে না যারা, তাদেরও ভালোবাসা নিয়ে বড়াই করতে দেখেছি।
ওরা যখন ভালোবাসার নামে ক্রমাগত কুর্নিশ করে যায়,
ঠিক সেই মুহূর্তে চাঁদের কান্না দেখে আমি একদৌড়ে পালিয়ে গিয়েছি।
যে সকল সুখের স্বপ্ন প্রথমযৌবনে দেখেছিলাম,
তার প্রত্যেকটিই, একসময়, ভুলে বসেছি।
না, এজন্য আমার মন খারাপ নয়।


আমার অনুভবের প্রতিটি অলিতে গলিতে আমি অসংখ্যবার ঘুরে বেড়িয়েছি,
আর‌ও কিছু মানুষের অনুভব আমার সেইসব অনুভবে মিশে ছিল।
ওসব নিয়ে সময় ঠিকই দিব্যি কেটে যেত।
বহু চিঠি পেয়েছি, সেইসব চিঠির উত্তর লিখতে গিয়ে, কখন‌ও কখন‌ও, কলম থেমে গেছে।
এর কারণ জানতে চেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় বসেছি বহু বহু বার।
আমার জন্মদিনগুলিতে মানুষের অভিবাদন পেয়েছি যত যত বার,
তত তত বার বুঝে নিয়েছি, একটি জলজ্যান্ত মৃত্যু বিস্মৃতির অপেক্ষায় আমার চোখের সামনে ঝুলছে।
না, মাহেন্দ্রক্ষণটি ঘনিয়ে আসছে, এটা ভেবে তখন আমি একটুও দুঃখ পাইনি।
এই জীবনে প্রচুর শব্দ খরচ করেছি, জমা রেখেছি।
মানুষের সাথে কথা বলেছি,
ল্যাম্পপোস্টদের সাথে গল্প করেছি,
ছবিরা কে কী বলে, তা বুঝতে চেয়েছি।
শেকল পরেছি, শেকল খুলেছি।
মানুষের হাত দেখলে বলে দিতে পারতাম,
কোন হাতটি হাত ছেড়ে দেবার জন্যই জন্ম নিয়েছে।
না, এজন্য আমার মন খারাপ নয়।


এখান থেকে ওখানে গিয়েছি,
ওখান থেকে এখানে ফিরেছি।
এই আসা-যাওয়ার পথে শিখেছি---
এই পৃথিবী সর্বত্রই, সর্বদাই বৃদ্ধ হতে সদাপ্রস্তুত।
আমি যতটা হারিয়ে গিয়েছি এখান থেকে,
ঠিক ততটাই হারিয়ে গিয়েছি ওখান থেকেও।
মনের ভেতরটা যতই মনোযোগী হয়েছে,
মনের বাহিরটা তত‌ই ঝুঁকেছে ঔদাসীন্যের প্রতি।
সমুদ্রের কাছে গিয়ে দেখেছি,
আমার মধ্যে যতটা বিস্তৃতি, ঠিক ততটাই ঋণী হয়ে উঠেছি সমুদ্রের কাছে, কখন‌ও টের পাইনি।
একাকিত্বের ভয়ে কুঁকড়ে কুঁকড়ে
আমি সারাজীবন‌ই মানুষ খুঁজেছি।
খুঁজতে খুঁজতে একাকিত্ব‌ই বেড়ে গেছে ক্রমাগত।
কিছু মানুষকে ধুলোয় মিশে যেতে দেখেছি,
যাদের ইমারত হয়ে গড়ে ওঠার কথা ছিল।
সূর্যের আলোকেও পক্ষপাতিত্ব করতে দেখেছি,
---কার‌ও কারও ঘরে, তার ঢোকাই বারণ।
একরোখা একাকিত্বের ঘণ্টাধ্বনির শব্দে
আমার আত্মা কেঁপে উঠেছে বারে বারে, কেউ তার খোঁজ‌‌ই রাখেনি কোন‌ও দিন‌ই।
না, এজন্য আমার মন খারাপ নয়।


কত কত বার এই শরীরে আগুন ধরে আবার নিভেও গেছে,
আজ তার সব কিছু মনেও আর পড়ে না।
চাঁদ উঠলে ঠায় তাকিয়ে থাকতাম, মনে থাকত।
সমুদ্রের গায়ে গায়ে চাঁদের আলোর যতটুকু হারিয়ে যেত,
ততটুকু আলোহীনতা নিজের আত্মার সাথে মিশিয়ে মিশিয়ে নিজেকে ধারালো করার চেষ্টা করেছি।
না, এজন্য আমার মন খারাপ নয়।


যতদিন পেরেছি, নদীর অসীম স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচেছি।
ঢেউ এবং স্রোতের বন্ধুত্ব আমাকে কাবু করতেই পারল না যখন,
তখন আমি শুকনো নদীর বুকে জলের পুরনো অশ্রুর দাগ দেখে দেখে দুঃসহ স্মৃতির রোমন্থন করেছি।
সেই রোমন্থনও আমায় শেষপর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।
না, এজন্য আমার মন খারাপ নয়।
সময় হলে সব আলোতেই অন্ধকার হয়ে আসে।