সমর্পণের ক্ষত

আমি রাজবাড়ীর মেয়ে। বাসায় বাবা, মা, আমি আর আমার ছোটভাই। বাবা একটা সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে, মা গৃহিণী। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেশ ভালো আছি। অনেক অর্থবিত্ত নেই, তবে মনে প্রশান্তি আছে। টলস্টয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসের প্রথম লাইনটা খুব মনে আসে: সুখী পরিবারগুলি একই রকমের; প্রতিটি দুঃখী পরিবার তার নিজের নিয়মেই দুঃখী। হ্যাঁ, আমাদের পরিবারটি সুখী। আমাদের অনেক টাকাপয়সা নেই, তবে আমাদের ঘরভর্তি আনন্দ ছড়িয়ে আছে সবখানে। শুধু আমাদের এই চারটি মানুষের গল্পটা যে এমন, তা নয়। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের সাথে আমাদের সম্পর্কটাও বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ। আমাদের মধ্যে কেউ ভালো থাকলে অন্যরাও ভালো থাকে, কেউ খারাপ থাকলে অন্যরাও খারাপ থাকে। ছোটকাল থেকেই দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ির সবার অনেক আদরযত্নে বড় হয়েছি।

ছোট থেকেই আমি খুব সিরিয়াস ধরনের স্টুডেন্ট। পড়া ফেলে সময় নষ্ট করা আমার ধাতে ছিল না। বাড়ির সবাইকে বেশিবেশি পড়াশোনা করতে দেখেদেখে বড় হয়েছি। বড় হতে চাইলে পড়তেই হবে—এই আপ্তবাক্যটি হৃদয়ে ধারণ করে আমাদের পরিবারের সবাই মানুষ হয়েছে। নিজের মধ্যেও ওই চেতনা প্রোথিত ছিল ছোটবেলা থেকেই। আমার বাবা-চাচা-মামা এবং কাজিনরা সবাই অনেক প্রতিষ্ঠিত, সমাজের সবাই ওদের সম্মান করে। এই পারিবারিক প্রেরণা থেকেই আমি নিজের ক্যারিয়ারের প্রতি বেশ আন্তরিক ছিলাম আগে থেকেই। তবে হ্যাঁ, যদি ফলাফল বিচার করা হয়, তবে আমি আমার পরিবারের সবচাইতে গাধা স্টুডেন্ট। আমাদের এক বন্ধু আছে, সোহম। ওর উচ্চতা ছয় ফুট এক ইঞ্চি। ওকে কেউ ওর উচ্চতা নিয়ে ভালো কিছু বললে ও মজা করে বলে, হ্যাঁ, আমিই আমার পরিবারের সবচাইতে খাটো পুরুষ সদস্য! পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমার অবস্থাও ছিল অনেকটা ওরকম।

আমি অনেক পড়াশোনা করতাম, তবে পড়ার পদ্ধতিটা হয়ত ঠিক ছিল না। তাই পড়ার পরিমাণের অনুপাতে আমার রেজাল্ট ভালো হত না। তবে পড়াশোনায় অন্যদের চাইতে একটু পিছিয়ে গেলেও শিষ্টাচারের দিক থেকে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে ছিলাম, আর ঠিক এ কারণেই আমার পরিবারের সবাই আমাকে অনেক আদর করতো। আমি খুব চুপচাপ স্বভাবের বলে পরিবারে আমাকে অন্যদের চাইতে একটু আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়। কাজিনদের মধ্যে আমি সবার ছোট হওয়ায় অনার্স পাস করার পরও আমি সবার চোখে পিচ্চিই থেকে গেছি। সবাই কেমন জানি মনে করে, আমি তো ছোট, আমি কিছু বুঝি না। আমার অনেক ভুল সবাই হাসিমুখে ক্ষমা করে দেয়।

গত বছর স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মাসিতে অনার্স কমপ্লিট করেছি। সিজিপিএ’ও ভালো। ঢাকায় আছি ৫ বছর হল। বাড়ি ছেড়ে আছি, অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তবু সবকিছু মিলিয়ে জীবন ভালোই চলেছে। বন্ধুরা, আড্ডা, ঘোরাঘুরি, পড়াশোনা। বেশ দারুণভাবেই উড়ে গেছে ৫টা বছর। এ সময়ে সবার সাথে অনেক মিশেছি, মজা করেছি। আমি অনেক ফাজিল টাইপের ছিলাম। কোনও হ্যান্ডসাম ছেলেকে দেখলে বান্ধবীরা সবাই মিলে টিজ করতাম, ওর ওটা ভালো, ওটা বাজে—এমন সব কথা বলে খুব হাসাহাসি করতাম, তবে পরে আবার সব ভুলেও যেতাম। আমার মেয়ে ফ্রেন্ডই ছিল বেশি, ছেলে ফ্রেন্ড ছিল না বললেই চলে, এমনকি ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টেও অপরিচিত কেউ ছিল না। রক্ষণশীল ছিলাম, এমন নয়; তবে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতাম।

থার্ড ইয়ারে যখন পড়ি, তখন একটা ঘটনা ঘটে। আমার ভার্সিটির এক ফ্রেন্ড মুনতাহা, ওর এক সিনিয়র ফ্রেন্ড সুহান, নর্থসাউথে পড়ে। ও একদিন আমাকে মুনতাহার আইডিতে দেখে, আর মুনতাহাকে বলে, হৃদিতাকে আমার খুব ভালো লেগেছে, ওকে একটু আমার ফ্রেন্ড হতে বলিস তো! মুনতাহা আমাকে বলে দেয়, সুহান ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিলে আমি যেন অ্যাক্সেপ্ট করি। আমি বললাম, ওকে। অপেক্ষা করে ছিলাম, কিন্তু ওর কাছ থেকে কোনও রিকোয়েস্ট এলো না। পরদিন মুনতাহা আবার বলে যে সুহানের আইডিতে নাকি সেটিংস-এ কী যেন প্রবলেম, তাই ও রিকোয়েস্ট দিতে পারছে না, আমি যেন ওকে রিকোয়েস্ট দিই। এটা শুনে আমি ক্ষেপে যাই, চেঁচামেচি শুরু করি। এরপর আবার কী মনে করে যেন সুহানকে রিকোয়েস্ট দিই, ও প্রায় সাথেসাথেই অ্যাক্সেপ্ট করে।

ওইটুকুই! মাঝেমধ্যে সুহান আমাকে টেক্সট পাঠাত ফেসবুকে, আমি রিপ্লাই দিতাম। ও আমার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড, এ জাতীয় কিছু কথা ও মুনতাহাকে বলেছিল। আমি সুহানের ব্যাপারে কখনওই ইন্টারেস্টেড ছিলাম না, কারণ ও দেখতে আমার চাইতে অনেক ভালো ছিল, আর স্টুডেন্ট হিসেবেও আমার চাইতে ভালো ছিল। আমি পড়ি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে, নর্থসাউথ থেকে আমরা কত পিছিয়ে, আর আমি দেখতেও মোটামুটি, তাই ওর ব্যাপারে আমার আগ্রহ তৈরিই হয়নি। ওর সাথে গল্প করতাম, তবে ওকে নিয়ে কখনওই সিরিয়াসলি কিছু ভাবতাম না।

সুহান নর্থসাউথ থেকে বিবিএ কমপ্লিট করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’তে ফাইন্যান্সে এমবিএ করছিল। যা-ই হোক, ফোর্থ ইয়ারের শুরুর দিকে সুহান একদিন আমাকে বলে যে সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। যদিও আমাদের কথা অনেকদিন ধরেই হচ্ছিল, তবু ব্যস্ততার কারণে আমাদের কখনও দেখা হয়নি। আমি বিভিন্ন কথা বলে এড়িয়ে গেলাম। এরপরও কথা চলছিল। ফোর্থ ইয়ারের মাঝামাঝি ও আবারও একদিন ফোন করে দেখা করতে বলে। ওইদিন আমার একজাম ছিল বলে দেখা করতে পারিনি।

ওর সাথে আমার কখনওই গভীর বন্ধুত্ব কিংবা এ জাতীয় কিছু ছিল না। সে ইউনিসেফ-এর একটা প্রজেক্টে চাকরি করতো। অফিসের কাজে ওকে প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হত। একদিন এই দেশে তো আরেক দিন ওই দেশে, এরকম ছিল ওর জবটা।

এর মাঝে আমার অনার্স কমপ্লিট হল। আমি আমার বাড়িতে গেছি ঢাকা থেকে, পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছি, হঠাৎ দেখি, ফেসবুকে ওর মেসেজ। চ্যটিং-এর এক পর্যায়ে ও বলল, ও আমাকে ভালোবাসে, ও আমাকে বিয়ে করতে চায়, এই, সেই, এমন অনেক কথা। আমি ভাবলাম, ফাজলামো করছে। আমিও ওর সাথে ফাজলামো করতে থাকলাম। আসলে আমি কখনওই ওকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবিনি। তাই ওর কথাটা মোটেও সিরিয়াসলি না নিয়ে ফাজলামো করে যাচ্ছিলাম।

আমি ইন্টার্নশিপের জন্য ঢাকায় ফিরে এলাম। আবারও তার টেক্সট! আমার ভাইবার আছে কি না, জিজ্ঞেস করল। আমি ভাইবার নাম্বারটা দিলাম। কিন্তু নেট এতো স্লো ছিল যে ওর সাথে কোনও কথাই হয়নি সেদিন। এর আগে ওর সাথে ফোনে কথা হয়েছে মাত্র ৩বার। আমাদের যা আলাপ হত, সবই মেসেঞ্জারে। যা-ই হোক, আমাদের গল্প কখনও স্বাচ্ছন্দ্যে হয়নি। নেট প্রবলেম, ব্যস্ততা, ইত্যাদি সমস্যা থাকতই।

কিন্তু এইবার সে ভালো রকমেরই সিরিয়াস হয়ে উঠল আমার ব্যাপারে। দেশের বাইরে গিয়ে আমাকে ভাইবারে কল দিল। কথা হল। প্রায় প্রতি রাতেই ওর সাথে কথা চলতে লাগল। কথা খুবই অল্প সময়ের জন্য হত, তবে নিয়মিতই হত। একদিন সন্ধ্যা ৭টায় আমাকে ফোন করে বলল, বের হও, আমি তোমার সাথে দেখা করব। খুব জরুরি দরকার আছে। এতো সন্ধ্যায় বের হওয়া সম্ভব নয়, বলে আমি ‘না’ করে দিলাম। এরপর ও বলল, তাহলে কালকে সকালে। আমি রাজি হলাম। পরদিন আমি যখন রেডি হয়ে ওর সাথে দেখা করার জন্য বের হচ্ছি, ঠিক তখনই ও টেক্সট পাঠাল যে অফিসের জরুরি কাজ পড়ে গেছে, তাই দেখা করতে পারবে না। ও খুবই সরি। ওইদিন রাতে আমাকে ফোন করে আবারও অনেক সরিটরি বলল, কিন্তু আমি রাগ করে ওকে জানলাম যে, আর কখনওই আমি ওর সাথে দেখা করতে পারব না। এর মাঝে পহেলা ফাগুনে হঠাৎ সুহানের ফোন! ও আমার সাথে দেখা করতে চায়। সে আমার বাসার দিকে রওয়ানা হয়েছে আমার সাথে দেখা করার জন্য। আমি যেন তৈরি হয়ে থাকি।

ঘটনাগুলি সব গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু। যা-ই হোক, আমাদের দেখা হল। জীবনে প্রথমবারের মত রিক্সায় কোনও ছেলের পাশে বসলাম। আমি অনেক নার্ভাস ছিলাম। ও যে কী পরিমাণ দুষ্ট, বলার মত না! তখন ও খুব ডিপ্রেসড ছিল। কোর্সের একটা সাবজেক্টে খারাপ করে এক ইয়ার লস করেছিল। ওইদিকে আবার চাকরির ঝামেলা। আমাদের অনেক গল্প হল, ঘোরাঘুরি হল, খাওয়াদাওয়া হল। ঘণ্টা কয়েক একসাথে সময় কাটানোর পর ও আমাকে একটা রিক্সা ঠিক করে দেয়, আমি ওটা নিয়ে বাসায় চলে আসি। সেই রাতে ও আমাকে ফেসবুকে নক করে জিজ্ঞেস করল আমি ওকে বিয়ে করব কি না। আমি উত্তর দিই, তুমি তো একটা পাগল। তোমাকে বিয়ে করে কী করব? কেন জানি না, আমি ওর সাথে চ্যাটিং করার সময় ননস্টপ হাসতে থাকি। আরও কিছু কথাবার্তার পর একসময় আমরা লগআউট করে ঘুমিয়ে পড়ি। এরপর দিন ওর কোনও খোঁজ নেই। ফোন অফ, মানে ও এখন দেশের বাইরে। অথচ আগের রাতে ও আমাকে বাইরে যাওয়া নিয়ে কিছুই বলেনি। সে রাতে আমাকে আবারও ভাইবারে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি ওকে বিয়ে করব কি না। আমি বলি, তুমি আগে দেশে আসো তো, এরপর দেখা যাবে। পাগল একটা!

ও দেশে ফিরে আসল তিনদিন পরই। কিন্তু দেশে আসার পর ও আমাকে আর এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এদিকে কেন জানি ওকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। কেবলই ওর কথাগুলি মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল আর ওর মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল। ও দেখতে হ্যান্ডসাম, এ জন্য যে ওকে ভালো লেগে গিয়েছিল, তা কিন্তু নয়। আসলে আমার ভার্সিটি লাইফ শেষ হয়ে যাওয়াতে আমি খুব একাকিত্ব অনুভব করছিলাম। অবস্থা এমন যে, আমার ফ্রেন্ডদেরও আমার সাথে কথা বলার সময় নেই। সবাই নিজনিজ ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। আমার তো বড় ভাই নেই, জব ক্যারিয়ার এসব নিয়ে যে কারও সাথে আলাপ করব, এমন কাউকেও পাচ্ছিলাম না। আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, এ সময়ে জীবনে পাশে কেউ একজন থাকলে খুব ভালো হয়। মেয়েরা এমনই! মেয়েরা যে একা চলতে পারে না, তা কিন্তু নয়; তবে ওরা চায়, কেউ একজন ওদের বলে দিক, এদিকে যাও, ওদিকে যেয়ো না। পথটা বলে দিলে ওরা সে পথে একা চলতে পারে। নিজ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মেয়েদের কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। এমনকি যে সিদ্ধান্তটা ওরা নেবেই নেবে, ওরা চায়, সে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেউ একজন ওদের বলে দিক, এই সিদ্ধান্তটা নাও!

এভাবে আরও কিছুদিন কেটে গেল। ও বিয়ে নিয়ে আর কিছুই বলে না। একদিন আমি নিজেই ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি আসলেই আমার ব্যাপারে সিরিয়াস? ও বলল, হ্যাঁ, সিরিয়াস। ব্যস্‌ হয়ে গেল! এর মাঝে আমি মুনতাহাকে ফোন করে আমাদের এই ব্যাপারটা হাল্কাভাবে জানাই। মুনতাহা বলল, তোর লাইফ, তুই ভেবে দেখ। ও কিন্তু কলেজ আর ভার্সিটি লাইফে অনেক ফাজিল টাইপের ছিল, ওর অনেক গার্লফ্রেন্ডও ছিল। ওদের দুএকজনের সাথে ও ঘনিষ্ঠও হয়েছিল, শুনেছি। আমি মুনতাহাকে বললাম, পাস্ট ইজ পাস্ট। আগে যা ছিল, ছিল। এখন ভালো হলেই হয়। আর এখন তো ওর পড়াশোনা শেষ, চাকরি করছে, প্রফেশনাল কোর্স করছে। এখন তো আর এসব করার বয়স না। এরপর আমি সুহানকে ফোন করি। নানান কথার মাঝে ওকে বলি, দেখ, আমার লাইফে কিন্তু কোনও পাস্ট নেই। আমার লাইফে এমন কিছুই নেই, যা আমাকে তোমার কাছ থেকে লুকাতেই হবে। আমি একেবারেই ক্লিন। তুমিই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। তুমি ভালো করে চিন্তাভাবনা করে আগাও যে তুমি আমাকে তোমার জীবনে রাখতে পারবে কি না। আমি তোমার কোনও পাস্ট দেখবো না, তবে আমাকে বিয়ে করলে বিয়ের পর আমার প্রতি শতভাগ লয়াল থাকতে হবে তোমাকে। আমার আর কিছুরই দরকার নেই। আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি শতভাগ স্বচ্ছ থাকব। আমাদের মাঝে কোনও ব্যাপারেই কোনও দেয়াল থাকবে না। বিয়ের পর যদি কখনও দেখি যে তোমার আর কারও সাথে কোনও ধরনের ইনভল্ভমেন্ট আছে, তবে তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে আমার এক মুহূর্তও সময় লাগবে না। ওটা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। আমি চাই না ওরকম কিছু হোক। তাই আমি আমার অবস্থান আর দর্শনটা তোমার কাছে পরিষ্কার করে নিলাম, যাতে তোমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। তুমি প্রয়োজনে সময় নাও, কিন্তু এমন কিছু কোরো না, যার জন্য আমাদের দুজনকে সারাজীবনই পস্তাতে হয়। আমি যা বলছি, ভেবেই বলছি, এবং এই মানসিকতা থেকে আমি কিছুতেই সরে আসব না।…………আমার সব কথা শুনে ও বলল, হুম্‌ ঠিকই তো বলেছ! আমি রাজি।

এটা ঠিক যে অন্য রিলেশনগুলির মত আমাদেরটা ছিল না। ও অনেক অদ্ভুত টাইপের, কেয়ারিংও না। ও মনের যত কথা, মনের মধ্যেই চেপে রাখত। তেমন কিছুই শেয়ার করতো না। আমি ওর কেয়ার নিতাম, ওকে আমার পুরো সময়টাই দিয়ে দিতে চাইতাম, কিন্তু ও সবসময়ই বিজি। এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হত, আবার ঝগড়া হলে সে মহাসিরিয়াস হয়ে যেত আমাদের রিলেশনের ব্যাপারে। বারবার ফোন করতাম আমি নিজেই। ও অতটা করতো না। ফোনে কথা বলতো অনেকটা রোবটের মত। কাজের বাইরে একটা কথাও বলতো না। এইভাবেই চলছিল। তবে এটাও ঠিক যে সুহান ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছিল নিজেকে বদলাতে। অনেক ইম্প্রুভও করছিল ধীরেধীরে। ভালোই চলছিল আমাদের সম্পর্কের গাড়িটা।

একটা উদ্ভট ব্যাপার হত। আমাদের রিলেশনটায় যত খরচ হত, এই যেমন, ঘোরাঘুরির খরচ, খাওয়ার বিল, বিভিন্ন সেলিব্রেশনের খরচ, নানান টুকিটাকি খরচ, এই সবকিছুই আমিই দিতাম। ও কখনওই কিছু দিত না। কেন দিত না, এটা আমি কখনও ওকে জিজ্ঞেস করিনি। ও কোনওদিনই মানিব্যাগটা পকেট থেকে বের করতো না। ও কখনও রিক্সাভাড়া দিয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। আমাদের মধ্যে এটা নিয়ে কখনও কোনও ঝামেলাও হয়নি। আমার এটা খারাপও লাগেনি। একটা গার্লফ্রেন্ড যতটা করে, এই একটা বছর আমি ওর জন্য ততটাই করেছি। ওর এমবিএ এখনও শেষ হয়নি। ও যখন দেশের বাইরে ছিল, তখন ফরম ফিলআপের ডেট চলে যাচ্ছে বলে আমি ঢাকা থেকে সাভারে ওর ভার্সিটির ক্যাম্পাসে গিয়ে ওর ফরম ফিলআপ করে নিয়ে এসেছি। ওর সেমিস্টারের বইপত্রও আমি কিনে দিয়েছি। ভার্সিটির গ্রেডশিট ওঠানো, ওকে ডাক্তার দেখানো, ওর বিভিন্ন টেস্ট করানো, মেডিক্যাল রিপোর্ট সংগ্রহ, সবই কাজই আমি করেছি, এমনকি এসবকিছুর যত বিল, তাও গেছে আমার কাছ থেকেই, অথচ আমি তার কাছ থেকে যদি কখনও কোনও ব্যাপারে কোনও সাপোর্ট চাই, সে সবসময়ই বিজি। তারপরও আমি ওকে বলতাম, আমি সবকিছুই ম্যানেজ করে ফেলতে পারব, যদি তুমি পাশে থাকো, ঠিক থাকো। সবই ভালো চলছিল। ও ফ্রি সময় পেলে আমাকে নিয়ে বের হত, আমরা একসাথে সুন্দর কিছু সময় কাটাতাম, আবার যে যার বাসায় ফিরে যেতাম। ফোনেও নিয়মিত কথা হত।

একদিন দেখলাম, ওর প্রোফাইল পিকচারে স্বাগতা নামে এক মেয়ে ওকে ‘জিজু’ বলে কমেন্ট করে। সেই কমেন্ট দেখে আমার ফ্রেন্ড মৌমিতা ওই মেয়েকে কমেন্টে জিজ্ঞেস করল কেন সে সুহানকে জিজু বলে ডাকল। ওই মেয়ে কোনও রিপ্লাই দেয়নি। আমার সেই ফ্রেন্ড আবার সুহানকে পছন্দ করতো। আমি ব্যাপারটা সুহানকে বলি। সুহান আমাকে বলে যে আগে ওর যে রিলেশনটা ছিল, সেটা ভেঙে দিতেও নাকি স্বাগতা অনেক ঝামেলা করেছিল। এখন নাকি আমার সাথে ওর রিলেশন আছে বলে আবারও এমন করছে। আমি এটা নিয়ে ওর সাথে ঝামেলা শুরু করলে ও আমার সাথে রাগারাগি করে আর বলে, কালকে আমার একজাম, তোমার সাথে এরকম ফালতু ঝগড়াফ্যাসাদ করার সময় আমার নেই। এর পরপরই ও ওর আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট করে বের হয়ে যায়।

ওইদিন রাতে আমি আমার ফ্রেন্ডকে বলি, ও যেন ওই মেয়েকে আমার সাথে কথা বলতে বলে। এর কিছুক্ষণ পর ওই মেয়ে আমাকে ইনবক্সে নক করল। আমি ওকে বলি, তুমি এমন করছ কেন? প্লিজ, ঝামেলা কোরো না, সুহানের সাথে আমার রিলেশন চলছে। এরপর সে মেয়ে আমাকে যা বলে, তা শুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়! সে মেয়ের সাথে নাকি সুহানের ৮ বছরের রিলেশন! শুনে আমি বুঝে যাই যে মেয়েটা মিথ্যে বলছে, কারণ সুহানের ফার্স্ট ইয়ারে যে রিলেশনটা ছিল, সেটার কথা তো সুহান আমার কাছে লুকায়নি, তাহলে স্বাগতার কথা কেন লুকাবে? আবার সে মেয়ে দাবি করল দুইদিন আগে নাকি সুহান তার সাথে সারাদিন ঘোরাঘুরি করেছে, অথচ সেদিন তো সুহান আমার সাথে ছিল! আমি ওটাও বিশ্বাস করলাম না। এরকম আরও নানান কথা মেয়েটা আমাকে বলতে লাগল। তবে সুহানের এমন কিছু সিক্রেট ব্যাপারও ও বলে দিল, যেগুলি কোনওমতেই ওই মেয়ের জানার কথা না। আমি ভীষণ কনফিউজড হয়ে গেলাম! ওদিকে আবার মৌমিতা আমাকে সারারাত টেক্সট করে ওই মেয়ের সাথে আমার কী কথা হচ্ছে, সেগুলির স্ক্রিনশট নিয়েছে, আর বারবারই বলেছে যে ওই মেয়ে নাকি মিথ্যে বলছে না! ও নাকি আরও কারকার কাছ থেকে এরকম আরও খবর যোগাড় করেছে। এসব কথা সুহানের সামনাসামনি বললে সুহান নাকি পালাবারই পথ পাবে না। এরকম আরও অনেক উল্টাপাল্টা কথাবার্তা! আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল! সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। ভোর সাড়ে ৩টায় সুহানকে টানা ফোন করে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। ওকে সবকিছু জানাই। ও সবই অস্বীকার করে। আবার এদিকে মৌমিতা আমাকে টানা ফোন করে যাচ্ছিল। আমার অন্য নাম্বারে টেক্সট পাঠিয়ে জানাল যে ওকে যাতে আমি সুহানের সাথে কনফারেন্সে আনি, তাহলে ও এমন সব প্রমাণ উপস্থাপন করবে যে সুহানের মুখই বন্ধ হয়ে যাবে! সুহানকে এটা বললে ও কিছুতেই রাজি হল না। এরপর মৌমিতার কথামত ওকে বলি, তাহলে তুমি এই মুহূর্তেই আমাকে তোমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড দাও, তোমার সাথে স্বাগতার কী কী কথা হয়েছে, আমি দেখতে চাই। এটা বলা মাত্রই ও কলটা কেটে দিয়ে আমার নাম্বারটাই ব্লক করে দেয়।

এসব ঘটনায় আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। দুইদিন সুহানের সাথে কোনও কথা হয়নি। এরপর আমি রাজবাড়ী চলে যাই। এক সপ্তাহ পর সুহানের ফোন আসে। ও শুধু এইটুকু স্বীকার করে যে মৌমিতার সাথে ওর একসময় কথা হত, দেখাও হত কখনও-কখনও, তবে সেটা রিলেশনের মত কিছু না। আর ওই মেয়েটা ওকে পছন্দ করে বলেই ওর প্রোফাইল পিকচারে ওইরকম কমেন্ট করেছে, তবে ওদের মধ্যে কিছুই নেই।

আরও এক সপ্তাহের চেষ্টায় ও আমাকে কৌশলে ম্যানেজ করে সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। ওদিকে বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার কোনও রিলেশন আছে কি না। বাবা আমার বিয়ের ব্যাপারটা ভাবছে। বাবাকে আমি সুহানের কথা বলি। তখন বাবা আমাকে ৬ মাস সময় দিয়ে বলে যে এর মধ্যে আমাদের বাসায় প্রপোজাল পাঠালেই হবে। এরপর সুহান পুরোপুরি নিজের পায়ে দাঁড়ালে বাকি সব হবে। আমি খুবই উত্তেজিত হয়ে সুহানকে বাবার কথাটা বলি। এটা শুনে ও তেমন খুশি হল না, বরং ওর টেনশন বেড়ে গেল। আমি ওকে বারবারই বললাম যে আমার কোনও রেস্পন্সিবিলিটিই ওকে নিতে হবে না, আমার খরচ আমি নিজেই চালিয়ে নিতে পারব, তবু ও টেনশনে অস্থির হয়ে গেল! আমি ঢাকায় ফিরে যাই। সেসময় ফেসবুকে ‘দূরত্বের আগে’ আর ‘পুতুলবিয়ের ইতিকথা’ নামে দুটো লেখা পড়ি। পড়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়! তখন ওকে আবারও বলি, তুমি আমার কাছে সবকিছু ক্লিয়ার করো। তুমি আমাকে এরকম অন্ধকারে রাখতে পারো না। আমি আর এমন যন্ত্রণা নিতে পারছি না।………বারবার এসব বলা সত্ত্বেও তার একটাই কথা, সে আমাকে সবকিছু পরিষ্কার করে বলবে, তবে এখন না, ছয়মাস পর বলবে!

আমি আরও অস্থির হয়ে পড়ি। আমি বুঝতে পারছি না, ও যদি নিজের কাছে ক্লিয়ার থাকে, তাহলে আমার কাছে সবকিছু ক্লিয়ার করতে ওর প্রবলেম কী! ও যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসে, তবে আমার কাছে কেন এতো প্রাইভেসি থাকবে ওর? আমি কেন ওর ফোনটা ঘাঁটতে পারি না? ওর মেসেঞ্জার চেক করতে পারি না? এইভাবে ৬ মাস অপেক্ষা করে থাকা যায়? ও যদি তখন আমাকে ‘না’ করে দেয়, তাহলে? আমি তো মরেই যাব! ওকে এটা বললেই ওর একটাই কথা: এখন সে নাকি এসব ঝামেলা মাথায় নিতে পারবে না, তার জবটা তো চুক্তিভিত্তিক, তাই একটা স্থায়ী জবের চেষ্টায় সে অনেক টেনশনের মধ্যে আছে!

ওদিকে আবার আরেক কাহিনি! সুহান মৌমিতাকে নক করে আমার সম্পর্কে কী জানি বলে, আর মৌমিতা আমাকে ওর ছোটভাইয়ের আইডি থেকে নক করে বলে আমি যেন ওকে আনফ্রেন্ড করে দিই। ওর ছোটভাইয়ের আইডি থেকে কেন টেক্সট করেছে জিজ্ঞেস করলে বলে, সুহান নাকি ওর আইডি’তে ঢুকতে পারে। বলেই আবার বলে, না, না, আমি এমনি ফান করে বললাম। এর বেশি কিছু বলতে ও রাজি হয়নি। আমি মৌমিতার কথামত ওকে আনফ্রেন্ড করে দেয়ার পর দেখি, আমার প্রায় ৫-৬টা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট চলে আসে, যাদের একজনকেও আমি চিনি না। ইনবক্সে ওদের পরিচয় জানতে চাইলে ওরা প্রত্যেকেই বলে, ওরা নাকি মৌমিতার ফ্রেন্ড, মৌমিতাই ওদের বলেছে, ওরা যেন আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠায়। মৌমিতাকে ফোন করে এটা জিজ্ঞেস করলে ও বলে, ওরা নাকি সুহানের ফ্রেন্ড! আমার এসব দেখে পাগলপাগল লাগতে থাকে। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, এর কিছুই আমি বুঝতে পারছিলাম না।

পরদিন সকালে সুহানকে এটা নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে ও বলে, মৌমিতা নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ, ও চাইছে, আমাদের রিলেশনটা ভেঙে যাক, ও একটা সাইকো, ওকে বিশ্বাস করার কিছু নেই, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি মানতে না চাইলে ও বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে, বুঝেছি। আমি মৌমিতার মায়ের সাথে এটা নিয়ে কথা বলব নাকি? উনার মেয়ে এসব কী শুরু করেছে? তোমাকেও শোনাই কনফারেন্সে?…….তখন আমি বলি, না থাক, লাগবে না। আমরা দুজন ঠিক থাকলে বাইরের লোকের কথায় কী এসে যায়? তুমি আমার কাছে সব ক্লিয়ার করো। আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারছি না। আমার সাথে এমন অদ্ভুত ব্যাপার কেন ঘটবে? ও কেবলই বলে, ধৈর্য ধরো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

তখন ও আবারও দেশের বাইরে যায় অফিসের কাজে। এক সপ্তাহ পর ফিরে এলে আমি জোরাজুরি শুরু করে দিই। ওকে বলি, হয় আমাকে সবকিছু ক্লিয়ার করো, নাহয় আমাকে তুমি পাবে না। এরকম মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হলে আমি পাগল হয়ে যাব।………ও বলে, ঠিক আছে, আগামী ২৫ তারিখ আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বলব। আমার সবকিছুই আমি তোমাকে দেখাব। শুনে আমি শান্ত হই। ভাবলাম, আচ্ছা, আর তো মাত্র ১৯ দিন, দেখতে দেখতেই কেটে যাবে, এতদিন ধৈর্য ধরলাম, আরেকটু ধরি না!

২৪ তারিখ রাত সাড়ে এগারোটায় সে আমাকে টেক্সট পাঠায়: আমি তোমাকে কিছুই দেখাতে পারব না, আর কোনও কৈফিয়তও দিতে পারব না, যেমন করে আছো, তেমন করে থাকতে পারলে থাকো, নইলে নিজের রাস্তা মাপো।……….ওকে ফোন করে আমি অনেক কান্নাকাটি করতে শুরু করি। বলি, আমার লাইফটা কেন এরকম করে দিলে? কী ক্ষতি করেছি আমি তোমার? আমি তো তোমার জীবনে জোর করে আসিনি, তুমিই বারবার ডেকে আমাকে এনেছ। তাহলে এমন কেন করছ? আমার অপরাধটা কোথায়?………ও বলে, আমি যদি তোমাকে আমার মেসেঞ্জারের কনভারসেশন দেখাই, তাহলে তুমি আরও বেশি কান্নাকাটি করবে। এমনকি, আত্মহত্যাও করে ফেলতে পারো। হাহাহাহা………আমি বললাম, যদি লয়াল থাকতে না পারো, তাহলে আমি কীকরে তোমার সাথে সারাজীবন থাকব? তুমি আমার সাথে এমন করছ কেন? আমাকে নিয়ে তোমার যে কনফিউশন আছে, এটা আগে বলনি কেন? আমি তো অনেকবারই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি। তখন কেন কিছু বললে না? তোমার কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে আমি বাসায় পর্যন্ত বলে দিলাম, আর এখন কিনা তুমি……….বলে, আচ্ছা, শান্ত হও। আমার একজাম আছে। আমাকে একটু পড়তে দাও। আমি রেজাল্ট খারাপ করলে কিন্তু এর দায় তোমাকেই নিতে হবে!

আমি ভাবি, এই একটা বছরে আমি তার জন্য কী করিনি! ওর যা দরকার, মুখ থেকে বের করার আগেই ওর সামনে নিয়ে হাজির করেছি। ওর গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম আছে, তাই আদা কেটেকেটে জুস বানিয়ে বোতলে ভরে ওকে দিয়ে আসতাম। ব্যাগে করে ওর ময়লা কাপড় বাসায় এনে ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে ওকে দিয়ে আসতাম। প্রায়ই খাবার রান্না করে টিফিন-ক্যারিয়ারে নিয়ে যেতাম। ওর পরীক্ষার সময় সারারাত জেগে প্রার্থনা করতাম। তার প্রতিদান কি তবে এটা? আমি বাসায় কী বলব?

হ্যাঁ, আমি অনেক রাগ করতাম ওর সাথে, কারণ ও আমাকে সময় দিতে পারতো না। সপ্তাহে ৫ দিনই চাকরি করে, ১ দিন রেস্ট, আর ১ দিন এমবিএ ক্লাস। আমি রাগ করলে ও সবসময়ই সরি বলে মানিয়ে ফেলে; মানছি, সবকিছুই ঠিক আছে, কিন্তু এই একটা ব্যাপারে ও খুব গোঁয়ার্তুমি করে—প্রাণ গেলেও নাকি ও আমাকে মোবাইলের কনভারসেশন দেখাবে না!

ও কখনওই আমার কোনও শখ বা আবদার পূরণ করেনি। আমি কথা বলার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম, কিন্তু দিনে ও সবসময়ই মহাব্যস্ত, আর রাত হলেই ওর ঘুম পায়। এমন হাজারহাজার ব্যাপার আছে, যা আমার জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছে! আমার কী করা উচিৎ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ফ্রেন্ডরা সবাই জানে আমার রিলেশনের কথা, বাসায় জানে, বাবাকে কত কথা বললাম ওকে নিয়ে……….আর ও কিনা এখন এমন করছে!

আমার কান্না দেখলে নাকি তার কষ্ট হয়, সে আমার দুঃখ সহ্য করতে পারে না, আমাকে সুখী করার জন্য সে জীবন দিয়ে দিতে পারে—সে আমাকে এইসব বলে। শুনলে আমার কেবল হাসি পায়। মুখে অনেক কিছু বলে, কিন্তু আমার দুদণ্ড শান্তির ব্যবস্থাই সে করে না। এ হল ওর ভালোবাসার নমুনা! সে নিজেই নিজের লয়ালিটি নিয়ে কনফিউজড, আমি কীভাবে শিওর হবো? আমি তাকে এতো হেল্প করলাম, তার জন্য আমার এতো ত্যাগ, এতো ভালোবাসি ওকে………এসবের উত্তম পুরস্কার সে আমাকে দিয়ে দিচ্ছে! সারাজীবন এতো সুন্দরভাবে চলে শেষে এসে কিনা একজন ভুল মানুষের জন্য আমার ক্যারিয়ারটা এমন করে ধ্বংস করে দিলাম! ওর এসব আচরণের কথা আমি কাউকেই কিছু বলতে পারি না। নিজের মনেই ভাবি আর কষ্ট পাই।

ওর মা আর বোন নাকি আমাকে পছন্দ করে না। ও সেদিন আমায় কথায়কথায় বলে, তুমি কোনও একটা জবে ঢুকে যাও। দ্রুত! আমার অনেক টাকার দরকার। আমি খুব ক্রাইসিসের মধ্যে আছি। ওর কথাবার্তা আমার কাছে কেমন জানি ঠেকেছে! আরও বলছে যে সে নাকি কোনও কিছুই ম্যানেজ করতে পারছে না, তার নাকি সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। ওর জবটাও নাকি চলে যাবে। এখন আর আমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ওকে বললাম, এসব কথার মানে কী? আমি তো শুরুতেই তোমার সাথে সব কথা ভেঙে নিয়েছি। তুমি আমার সব কথায় রাজি হয়েছ বলেই তোমার সাথে রিলেশনে গেছি, নইলে তো কখনওই যেতাম না! ও বলে, আগের কথা টেনে লাভ নেই, বর্তমান নিয়ে বাঁচো। আমি কিছুই বুঝতে পারি না। আমি যখন ওর সাথে রিলেশন শুরু করি, তখন তো ওর অনার্সই শেষ হয়নি, আদৌ শেষ হবে কি না, তাও তো সে জানত না। আমি কখনওই ওকে খোঁচা বা খোঁটা দিয়ে কথা বলিনি, কারণ আমি তো সব জেনেশুনেই এগিয়েছি। আমি ওকে প্রায়ই বলতাম, তোমার যা আছে, আমি তা-ই দিয়ে চলতে পারব। তুমি না খেয়ে থাকলে আমিও না খেয়ে থাকব। বাঁচলে দুজন একসাথে বাঁচব, মরলে দুজন একসাথে মরব। আমি তোমাকে কখনওই টাকার অভাবে ছাড়ব না; যদি কখনও ছাড়িওবা, তোমার ব্যবহারের জন্যই ছাড়ব। তুমি আমার জীবনের প্রথম ও একমাত্র ভালোবাসা। তোমাকে আমি সারাজীবনই এমন করে আগলে রাখব। তোমার সুখের জন্য আমি জীবন দিয়ে দিতে পারি!

আমি সবসময়ই ওর প্রতি শতভাগ বিশ্বস্ত থেকেছি, শতভাগ চেষ্টা করেছি ওকে ভালো রাখতে, কিন্তু ও আমার জীবনটাই এভাবে নষ্ট করে দিল! সারাজীবন ওর হাত ধরে সুখে বাঁচার যত স্বপ্ন দেখেছি, সেগুলির অত্যাচারে আমার অসহ্য লাগছে। স্বপ্নের তাড়না সহ্য করা ভীষণ শক্ত! আমি কখনওই চাই না, ফেসবুকের ওই দুই গল্পের শুভ্র অমিত আর মনিরের নামের পাশে সুহান নামটা বসুক! আজ যে এতো কষ্টে থাকব, গতকাল এ সময়ে তা একবারের জন্য ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি! খুব তীব্র কষ্টেরও কোনও পূর্বাভাস থাকে না। জীবনটা কেমন অদ্ভুত!

আমি এখন একজন ব্যর্থ মানুষ। আমি হেরে গেছি! কেউ এসে আমাকে বকুক! সফল মানুষের বকা খাওয়ার মধ্যেও এক ধরনের তৃপ্তি আছে! আমার এসব ঘ্যানরঘ্যান কে-ই বা শুনতে চাইবে? কেনই বা কেউ আমায় সময় দেবে? আমি কে? আমি কেউ নই। আমার কষ্ট নিয়ে আমাকেই পচে মরতে হবে। এটাই আমার নিয়তি। এ পৃথিবীতে আমি বড্ড বেমানান, উটকো, অপাংক্তেয়।

আহা, আমি একসময় কারও চোখে পুরো পৃথিবী হয়েই ছিলাম! হায়, এখন যে আমি সেই একই চোখে সাড়ে তিনহাত জমিও নই!