সাইলেন্ট ওয়েডিং (২০০৮)

সাইলেন্ট ওয়েডিং। ২০০৮ সালে বানানো এ রোমানিয়ান সিনেমার গল্পটা ১৯৫৩ সালের। মার্চের ৫ তারিখ। স্ট্যালিন মারা গেছেন। একটা বিয়ে হচ্ছে। খুব চুপিচুপি। বিয়েটা হতেই হবে, তবে সময়টা এমন একটা সময়, যখন বিয়েটা হওয়া যাবে না।

কীরকম?

স্বামী-স্ত্রী মাঝরাতে মিলিত হবে। হতেই হবে। প্রকৃতির তীব্র দাবি! একই খাটে ওদের ছোট্ট বাবুটা ঘুমাচ্ছে। তাই কাজটা এমনভাবে করতে হবে যাতে ওর ঘুম ভেঙে না যায়। কাজ (মাইর) হবে, সাউন্ড হবে না। খুবই সাবধানে, নিঃশব্দে। কাজটা হল। মোটামুটি সফলভাবেই। তবে শেষের দিকে এসে অর্গাজমের মুহূর্তে একটু অসাবধান হয়ে যায় ওরা। বাচ্চার ঘুম ভেঙে গেল। যা হওয়ার, তা-ই হল। উপযুক্ত দাম না মিটিয়ে আনন্দ পাওয়া যায় না।

বিয়েটায় ফিরে আসি। একটা বড়ো কক্ষ। আয়তাকৃতির কয়েকটা টেবিলকে পাশাপাশি ঘেঁষে বসানো হয়েছে। বিয়ের খানাপিনা কক্ষে ঢুকল। খুব সন্তর্পণে। টেবিলের পায়ার নিচে বাঁধা হল চট। মদের বোতল আর গ্লাসের বাইরে জড়ানো হল কাপড়। কোনো শব্দ হওয়া যাবে না। খাবার সাজানো হল। লম্বাটে টেবিলের একদিকে বসেছে বর-কনে। বাদকদলও আছে। অতিথি হিসেবে টেবিলভর্তি মানুষ। শিশুরাও আছে। ঘরের ভেতর শুনশান নীরবতা। বাইরে কুকুরের ডাক।

সবার মনে খুশি, মুখ বন্ধ রেখে ওরা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে। বোতলের ছিপি খুলে গ্লাসে মদ ঢালার সময় ওপর থেকে না ঢেলে গ্লাস কাত করে ধরে গ্লাসের গা বেয়ে মদ ঢালা হচ্ছে। শব্দ এড়াতে। মুখ বন্ধ রেখে সবাই হাসিমুখে মদের গ্লাস উঁচিয়ে চিয়ার্স করল। বর-কনেকে শুভকামনা জানাল তাও অস্ফুট স্বরেই। কাছাকাছি বসেছে যারা, ওরা কাপড়ে জড়ানো গ্লাসে গ্লাস ঠেকাল, শব্দ হল না। খাবার নেয়ার পালা। নিচ্ছে। চামচ, ছুরির শব্দ হচ্ছে। পুরো টেবিলে। অগত্যা সিদ্ধান্ত এলো, ওসব সরিয়ে রাখা হোক। সবাই হাত দিয়ে খাবার তুলে নেবে। কেউ একজন তার চামচটা জমা দেয়ার সময় অসাবধানে থালায় ফেলে দিল। শব্দ হল, তাকে সতর্ক করা হল।

সবাই খাচ্ছে। টেবিলের সবাই, টেবিলের বাইরের সবাই। বাদকদল, শিশুরা। এমন শব্দ নেই যা কক্ষের বাইরে যেতে পারে। হঠাৎ টুকটুক আওয়াজ। সবাই ভাবছে, কোত্থেকে? মেয়ের বাবা আবিষ্কার করলেন, এক বৃদ্ধ মনের ভুলে একটা চামচ হাতে রেখে দিয়েছেন, সে চামচ দিয়েই অবচেতনে টেবিলের পায়ায় আঘাত করছেন, যেমন করে আমরা নিজের অজান্তেই পা নাচাই আরকি! খাওয়া চলছে। আবারো শব্দ! সবার দৃষ্টি এক লোকের দিকে। উনি শব্দ তৈরি করছেন। এমন শব্দ, যাকে থামানো মুশকিল। উনি নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেন। কয়েক মুহূর্ত। পারলেন না। শব্দ বেরোচ্ছে। সবাই ভীত চোখে ওদিকে তাকাচ্ছে। বিব্রত নয়, ভীত। এ খতরনাক সুর একটানা বেরোতে শুরু করল। অপ্রতিরোধ্য শব্দ। শব্দ থামানোর অন্য কোনো উপায় না দেখে মেয়ের বাবা মদের বোতলের ছিপিটা খুলে সে লোকের দিতে বাড়িয়ে দিতে চাইলেন, যাতে ছিপিটা শব্দযন্ত্রের নির্গমন-ফুটোয় ভরে শব্দ আটকে দেয়া যায়। দৃশটা হাসির, কিন্তু সবার চোখের দিকে তাকালে মুহূর্তটির নিস্তব্ধতা বরং কষ্টই দেয়।

বাইরে কুকুরগুলি চেঁচাচ্ছে। মেয়ের বাবা একবার উঁকি মেরে এলেন, সেই শব্দ বাইরে গেছে কি না, ঘরের বাইরে কেউ এসেছে কি না। ওদিকে লোকটা ভেতরের সব হাওয়াশব্দ পুরোপুরি বের করে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। তিনি বিব্রত নন, উৎফুল্ল। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আবারো খাওয়া শুরু হল। মেয়ের বাবা হাতের ইশারায় বাদকদলকে বাজাতে বললেন। সে দলের এক মহিলা ভুলে হাতের অ্যাকরডিয়নটা সত্যিই বাজিয়ে ফেলল। সবাই উনার দিকে তাকিয়ে মনে করিয়ে দিল, বাজাতে হবে না, বাজানোর অভিনয় করতে হবে। বাজানোর সময় উল্লাস থাকবে, বাদ্যযন্ত্রের উপর হাত চলবে ঠিকই, কিন্তু এমনভাবে, কোনো শব্দ বেরোবে না। তেমনিভাবেই চলল।

হঠাৎ ওদের একজন ঢেকুর তুললে শিশুরা শব্দ করে হেসে উঠল। ওদের সতর্ক করা হল। চুপ! খাওয়া চলছে, বাদকদল বাজাচ্ছে। আনন্দ আছে, শব্দ নেই। শিশুদের মুখ রুমাল দিয়ে বেঁধে রাখা হল, যদি ভুলে শব্দ করে ফেলে, সে ভয়ে। লোকে খাচ্ছে, আঙুল চাটছে। নিঃশব্দে। ওদিকে বর কনের স্কার্টটা তুলে পায়ের ভাঁজে বামহাতটা চালিয়ে দিল। হাতটা একটু উপরে উঠতেই স্বাভাবিকভাবে কনে একটু উত্তেজিত হয়ে একটা শব্দ করল। সবাই উদ্বিগ্ন চোখে ওদিকে তাকাল। বাদকদলের চোখেও উৎকণ্ঠা। কী হল? বর মুখ চেপে হাসছে। সবাই হাসল, কনেও হাসল। একজন জোরে হেসে উঠতে চাইল শ্মশানের সেই নীরবতা ভেঙে। ওই ভুলোমন বুড়ো লোকটি, যিনি চামচ দিয়ে শব্দ করছিলেন। উনাকে থামিয়ে দেয়া হল। প্রাণখুলে হাসা যাবে, তবে আওয়াজ ছাড়া। সবাই করছেও তা-ই।

হঠাৎ! মাছি! কোত্থেকে যেন উড়ে এসে রুমে ঢুকল। ভনভন ভনভন। মাথার উপর উড়ছে। সবাই ওদিকে তাকিয়ে। মাছি এদিকে ওড়ে, সবার মাথা এদিকে ঘোরে। মাছি ওদিকে ওড়ে, সবার মাথা ওদিকে ঘোরে। মাছি দৌড়ায়, টেবিলভর্তি মাথা দৌড়ায়। মাছি ওপরে-নিচে নাচে, একই তালে মাথাও নাচে। মাছি হঠাৎ ল্যান্ড করল। এক আধটেকো মাথার উপর। মুখোমুখি বসা লোকটি ঠাস করে একচড়ে মাছি খতম করে দিল। বন্ধুর মাথায় চাপড় দেয়ায় পাশের লোকটিও তার মাথায় চাপড় দিল। মেয়ের বাবা যথারীতি পরিস্থিতি সামলে নিলেন।

সবাই চুপ। ওয়ালক্লকের পাখিটা মুখ বের করে ডেকে উঠল হঠাৎ। মেয়ের বাবা পাখির টুটি চেপে ধরলেন। শব্দ নেই। বর-কনের ঠিক উল্টো দিকে এক দম্পতি বসেছিলেন। লোকটা তার স্ত্রীর বুকের ভাঁজ থেকে কিছু টাকা বের করলেন। সে টাকা বিয়ের উপহার। সবাই খুশিতে তালি দিল। নিঃশব্দেই। আরও কেউকেউ উপহারের টাকা বের করল। সব টাকা জড়ো করে কনের চেয়ারে রাখা হল, কনে টাকার স্তূপের উপর বসল। তখন তাকে বরের চাইতে উঁচু দেখাচ্ছে। টাকা মানুষকে নিচু থেকে উঁচু করে দেয়।

আরেক দফায় চিয়ার্স! পান চলছে। রাত ৩টা। কোথা থেকে যেন শব্দ আসছে। দরোজা খোলার শব্দ। সবাই সতর্ক! বোঝা গেল শব্দটা রুমের বাইরে কোথাও হচ্ছে। সবাই নিশ্চিন্ত। এবার একটা মজার ঘটনা ঘটল। বরটি দাঁড়িয়ে মুখ নেড়ে টেবিলের ওদিকটায় থাকা লোকটির উদ্দেশ্যে কী যেন বলল। লোকটি বুঝতে পারল না। ইশারায় বলল, পাশের জনকে কানেকানে বলো, সে তার পাশের জনকে বলবে। কানকথা এগোচ্ছে। ওই যে এক ভুলোমন বুড়োর কথা বলেছিলাম না? সেই বুড়োর বুড়ি যখন তার কানে কথাটা দিল, তখন সে কথাটা অর্ধেক বুঝে কিংবা না বুঝেই তার নিজের মতো করে পাশের জনের কানে পৌঁছে দিল। বুড়োর কানে কথাটা আসার আগ পর্যন্ত সবার মুখাবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সে কথা হাসির কোনো কথা নয়। অথচ এক কান থেকে আরেক কানে যেতেযেতে মূল কথাটা কয়েকবার বদলে গিয়ে এমন একটা কথা টেবিল ঘুরে কনের কানে পৌঁছল, যা বর বলেইনি। গুজব এভাবেই ছড়ায়। যার মাথা আছে, সে গুজব নেয় মাথা দিয়ে; যার মাথা নেই, শুধুই কান আছে, সে গুজব নেয় কান দিয়ে। যা-ই হোক, টেবিলে আবারো হাসির নিঃশব্দ বন্যা বইতে লাগলো।

হঠাৎ!! হুইসেল! ঘোড়ার খুরের শব্দ। কিছু লোক চেঁচিয়ে কথা বলছে। সবার চোখ আর কান ওদিকে। না, ওরা চলে গেল। ভয় নেই। বাদকদলকে ইশারা করা হল, বাজাও! ওরা বাজাচ্ছে, গাইছে। শব্দ নেই। বর কনের হাত ধরে তুলল। ওরা নাচছে, সবাই তালি দিচ্ছে, বাদকের দলও বসে নেই। রুমে এবার শব্দ হচ্ছে—জুতোর। শিশুরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মুখে রুমালবাঁধা, ওদের চোখ মরামাছের চোখের মতো, ভাবলেশহীন। নাচার এক পর্যায়ে কী মনে করে যেন কনের মন খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে বরের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিষণ্ণ চোখে টাকার স্তূপের উপর ধপাস করে বসে পড়ল। কয়েকটা টাকা নিচে পড়ে গেল। সবাই কনের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে।

দেখা যায়, বাইরে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বজ্রের শব্দ। দুইএকজন ভয়ে বুকে ক্রুশ কাটল। কনের মন খারাপ, সবার মন খারাপ। বৃষ্টি নামল। বাইরে ঘন বৃষ্টির শব্দ। বিজলির তীক্ষ্ণ ডাক। ক্ষোভে ক্রোধে অভিমানে কনের বাবা টেবিলে তাঁর চওড়া তালু দিয়ে জোরে আঘাত করলেন। চাপা নীরবতা ভেঙে চিৎকার করে বললেন, বাজনা বাজাও, আনন্দ করো, আজ তোমাদের রাত! বাজনা বেজে উঠল, সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, আনন্দের বাঁধ ভেঙে গেল, শিস বাজছে, সবাই ঘুরেঘুরে নাচছে, গাইছে, আর কোনো বাধা নেই, খাও, দাও, ফুর্তি করো! উল্লাস!

হঠাৎ কম্পন! যিশু কাঁপছেন, আলো কাঁপছে। ঘরের দেয়াল কাঁপছে। দেয়ালের ঘড়িটা খুলে পড়ে গেল। তাকে রাখা জিনিসপত্র একএক করে পড়ে যাচ্ছে। পুরো ঘর কাঁপছে! সিলিং খসে ধুলো পড়ছে। ঘর ভেঙে যাচ্ছে। দেয়াল ফুঁড়ে সৈন্যদল ঢুকল। ওরা ঘরের সবাইকে বেধড়ক মারছে, ছেলে বুড়ো কেউ বাদ যাচ্ছে না। রক্ত, আর্তনাদ! একটা গুলির শব্দ! কনের বাবা গুলিবিদ্ধ। কিছু সময়ের মধ্যে মৃত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রক্তের দাগ সরানোর চেষ্টা করলেন, দাগ সরল না, ছড়াল। মেঝেতে টাকা ছড়িয়ে আছে। ছড়ানোছিটানো অসহায় অর্থ! কিছু সৈনিক খাবার লুটে নিল। নারী এবং একটি শিশু বাদে ওরা সবাইকে ধরে নিয়ে গেল। একটা ছেলে পিঠে পাখা লাগিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। ওদের দলনেতা ওকে এক গুলিতেই বাকি জীবনটা আকাশে ওড়ার ব্যবস্থা করে দিল। আঁধার পিছলে আলো ফুটছে, কনে নিথর চোখে চলেযাওয়া ট্রাকটার পথে তাকিয়ে আছে। তার বুকে স্বপ্ন নেই, রক্ত আছে।

ওপরের দৃশ্যটি এ সিনেমার অমূল্য সম্পদ। এ সিনেমাটি যতটা সিনেমা, তার চাইতে অনেক বেশি মিউজিক্যাল ড্রামা। দেখলে মনে হয়, স্টেজে কিছু মানুষ নাচছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজছে। ‘সাইলেন্ট ওয়েডিং’ একই সাথে রোম্যান্টিক কমেডি, পলিটিকাল ড্রামা এবং প্যারানর্মাল কোয়েস্ট। ছোট্ট একটা গ্রামের সকল সারল্য, সুখ, স্বপ্ন নিমিষেই মিলিয়ে গেল একটা নির্বাক বিয়ের মধ্য দিয়ে। সিনেমার পরিচালক মূলত একজন থিয়েটার নির্মাতা এবং কার্টুনিস্ট। হয়তো তাই এ সিনেমায় থিয়েটারের ফ্লেভার পুরো মাত্রায়, জীবনকে কার্টুনের ফ্যান্টাসিতে উপস্থাপনভঙ্গি লক্ষণীয়। এ সিনেমা আলোর স্বাদ দেয়, আঁধারের বিষাদ মাখায়।