সুখের মত ব্যথা

মাত্র চারটা বছর। এই সময়কালের হিসেব যদি দিন গুনে না করে দিনগুলিকে টেনেহিঁচড়ে নেয়ার অবসাদ আর কষ্টের দামে করা যেত, তবে ‘মাত্র’ কথাটা লেখা যেত না কোনওভাবেই। ‘মাত্র’ কথাটির মাত্রা বরাবরই ভীষণ রকমের গোলমেলে। কারও-কারও চার বছর উড়ে-উড়ে দুম করে ফুরিয়ে যায়, কারও-কারও চার বছর খুঁড়িয়ে চলে। সময়ের হিসেবটা সময়ের জন্ম থেকেই উদ্ভট হয়ে আছে। সম্পর্কের সুখ কবে আসে তার সমস্ত পরিপূর্ণতা নিয়ে? অমন পূর্ণতার দেখা আদৌ কি কেউ পেয়েছে কোনও কালে? সম্পর্কের পরিলেখ কি ছান্দিক হয়েছে কখনও, কারও জীবনে, ভুলেও? কখনও-কখনও, একজন মানুষ যতদিন অচেনা থাকে ততদিনই সুখের ব্যাপ্তি। কতটুকু সময় কাটলে পরে পরিচয়ের দুর্বোধ্য সমীকরণ আপনিই মিলে যায়? কতটা পথ হাঁটলে পরে হাঁটার ক্লান্তি আর অনুভবে আসে না? এমন যদি হয়, একসাথে হাঁটছি অনেকদিন ধরেই, পরিচয় দিচ্ছি আবার দিচ্ছি না, নিচ্ছি আবার নিচ্ছি না, হাঁটার আনন্দ আর পথের গানের রেশ ধরেই জীবনটা কাটছে বেশ, থাকছিই নাহয় একটু অন্ধকারেই, তবুও সেই অন্ধকারের আলোয় চোখদুটো ঝলসে উঠছে মুহূর্তে মুহূর্তেই খুশিতে, তবে কি সে আঁধারে হারিয়ে হারিয়ে জীবন কাটানোটা ভুল কিছু? হলই বা! যদি একটা প্রচণ্ড ভুলের পথ ধরেও জীবনটা সুন্দরভাবে শেষ হয়, তবে ক্ষতি কী? মৃত্যুর পর তো কোনও পাপ থাকে না, কোনও পুণ্যের হিসেব কষতে হয় না, বেঁচে থাকার সময়ের কোনও ভুলের দায় বহন করে বেড়াতে হয় না। অচেনা মানুষের সাথে অচেনা পরিবেশে ভুল পথে হাঁটাটাই সবচাইতে দারুণ। চেনাজানা শুরু হলেই কষ্টের শুরু হয়ে যায়। কষ্টের বিশ্বস্ত অনুচর অসংখ্য, সবাইই একে-একে এসে ভিড়তে থাকে।

পূরবীর বয়স যখন অল্প, তখন থেকেই ওর ছোটাছুটির স্বভাব ওর বয়সের অনেকের চাইতে ভীষণ রকমের বেশি। অমন চঞ্চল মেয়ে ও বাড়িতে আর ছিল না। সবাই বলত, দস্যি মেয়ে। সে ছোট্ট মেয়ে দেখতে এতটাই সুন্দর ছিল যে, অত সুন্দর পুতুলও হয় না। ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যাবে, এমন কারিগর কই? ওর নানির সৌন্দর্য সম্পর্কে আশেপাশের অন্তত ১০ গ্রাম জানত। পূরবীর মধ্যে যেন উনার পুনর্জন্ম হয়েছে, সবাই এ কথাই বলত। ওর দিকে কেউ একবার তাকালে, তাকিয়েই থাকত তাকিয়েই থাকত, দুষ্টুমি করার অপরাধে একটুখানিও বকার কথা মাথায়ও আনতে পারত না। এক আশ্চর্য সুন্দর ছোট্ট প্রতিমা বেড়ে উঠছিল। পাঁচ বোনের মধ্যে ও ছিল চতুর্থ। অন্য বোনদের চাইতে পূরবী একটু বেশিই সুন্দরী ছিল। এটা নিয়ে ওর অন্য বোনদের মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ্ম ঈর্ষাবোধ কাজ করত সবসময়ই। সাধারণত, কোনও মেয়েই অন্য মেয়ের সৌন্দর্য সহ্য করতে পারে না; সে মেয়ে তার মা-ই হোক, আর বোন-ই হোক। টানাটানা গভীর চোখ, গোলগাল মুখের গড়ন, সরু লম্বা নাক, মিহি রেশমি চুল। ঝর্ণার জলের শব্দের মতো কলকল ঝরত সে পুতুলের হাসির অমলিন ধারা। নিজে আনন্দে মেতে থাকত, সে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ত সবখানেই। অন্য বোনেরা একটু কম মিশত বলে ছোট্ট পূরবী নিজের সাথেই খেলত সারাদিন। স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড না হলেও প্রথম ৫ জনের মধ্যেই থাকত সবসময়ই। দুষ্টুমি করত বেশি, তাই পড়ায় সময় দিত কম, তবে কম সময়েই অনেক পড়া শেষ করে ফেলতে পারত। পূরবীর মা পূরবীকে অতটা সময় দিতে পারতেন না, খোঁজখবরও রাখতে পারতেন কম, কিন্তু ওর রেজাল্টে খুব খুশি ছিলেন। পূরবীর আড়ালে সবাইকে বলতেন, আমার পূরবী পড়াশোনায় অনেক ভালো। দেখো, বড় হয়ে ও অনেক দূর যাবে।

পুরো ফ্যামিলিতে পূরবী দেখতে সবচাইতে সুন্দরী ছিল বলে অন্য মেয়েদের চাইতে ওর দিকেই সবার চোখ বেশি আটকে যেত। নিজের মেয়ের চাইতে অন্য মেয়েকে পৃথিবীর সবাই সুন্দরী বললে খুব উদার প্রকৃতির বাবা-মাও সে মেয়েটিকে সহ্য করতে পারেন না। তাই পূরবীর আত্মীয়স্বজনরা পূরবীকে খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না, আড়ালে বিভিন্নভাবে নিন্দে করে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি অনুভব করতেন। পূরবী দেখতে খারাপ, এটা ঢালাওভাবে বললে যদি নিজের মেয়ের সৌন্দর্য একটু করে হলেও বাড়ে, এই আশায় অনেকেই প্রায়ই বুক বাঁধতেন। পূরবীর মায়ের মুখে পূরবীকে নিয়ে স্বপ্নের কথা শুনে সামনাসামনি কিছু না বললেও মনে-মনে খুবই বিরক্ত হতেন উনারা। এসএসসি পরীক্ষায় যখন ওদের এলাকায় একমাত্র পূরবীই এপ্লাস পেয়ে পাস করল, তখন সে কষ্টে সেসব আত্মীয়ের কেউ-কেউ হার্টফেলও করে থাকবেন হয়তো বা। তবে এসএসসি’র পর থেকে সবাই ওকে একটু-একটু সমীহও করতে শুরু করল। এটাই স্বাভাবিক। নিজের সন্তানকে সবাইই অন্যদের চাইতে ‘পড়াশোনায় ভালো’ ভাবতে পছন্দ করে। ‘ও পড়ে না, কিন্তু পড়লে পারে’ এই সহজাত ভাবনায় আশ্রয় খুঁজেফেরা অভিভাবক যখন উনাদের সহজাত অন্ধবিশ্বাসে আবদ্ধ ‘ও পারে না, কিন্তু পড়েছে বলে পেরেছে’ গোছের কাউকেও সামনে দেখেন, তখন ভেতরে ভেতরে যতই অন্তর্দহন হোক না কেন, চোখেমুখে এক ধরনের কৃত্রিম সমীহভাব ফুটিয়ে না তুলে পারেন না, অন্তত সমাজসিদ্ধ ভদ্রতার খাতিরে হলেও!

এসএসসি’র রেজাল্টের কয়েকদিন পর পূরবীর মায়ের মৃত্যু হয় ক্যান্সারে। ওদের আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না। অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই মা মারা গিয়েছিলেন। পূরবীর এসএসসি পরীক্ষা চলার সময় মা পাশে ছিলেন না। শেষ মুহূর্তের চিকিৎসার জন্য উনাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মায়ের ভালোবাসা পূরবী অতটা পায়নি। পাঁচ মেয়ের বাড়িতে সবচাইতে ছোট মেয়ের আগের জন আদরমমতা একটু কমই পায়। তবে এর মধ্যেও মা যতটুকু ভালোবাসা দিতেন, ততটুকুই পূরবীর জন্য অনেকখানি ছিল। কারও-কারও জন্য অসীম আদরও কম হয়ে যায়, আবার কারও-কারও জন্য স্রেফ অবহেলাহীনতাও অনেক কিছু। পূরবীকে ওর বাসায় কেউ কোনও দিন কোনও ভাবেই অবহেলা করেনি। আদরে হোক না হোক, অনাদরে কখনওই বেড়ে উঠতে হয়নি পূরবীকে। পূরবী যখন এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল, তখন ঢাকায় রোগশয্যাতেও মা নামাজ পড়ে দোয়া করতেন, যাতে পূরবী এসএসসি’তে এপ্লাস পায়। মায়ের প্রার্থনা এবং দীর্ঘশ্বাস—দুটোই পৃথিবীর সবচাইতে অব্যর্থ সত্তা।

পূরবীর বাবা খুব একটা সচ্ছল ছিলেন না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি বৈষয়িক ব্যাপারে একটু উদাসীন হয়ে পড়েন। খুব হৈচৈ-করা মেয়েটি হঠাৎ করেই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। সারাদিন বিভিন্ন উপন্যাস আর পড়ার বই পড়েই দিন কাটাত পূরবী। কলেজে পড়ার সময় অর্থের অভাবে প্রাইভেট পড়ার সুযোগও হয়নি ওর। এইচএসসি’তে ৪.৯০ পেয়ে পাস করল। ওর অন্যান্য ক্লাসমেটরা যখন ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করছে, ও তখনও জানে না, আদৌ কোন ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার ফরম কেনার জন্য ওকে কেউ টাকা দেবে কি না। একেওকে বলেটলে শেষ পর্যন্ত ওর বড় আপুকে রাজি করাল পূরবী। উনি পূরবীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরম কিনে দিলেন। পরীক্ষা হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে নাম আসে আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদে ৭ম হয় পূরবী। “কীরে? তুই পাসটাস করবি তো? নাকি, ছেলে দেখব তোর জন্য?” পূরবীর এইচএসসি পরীক্ষার পর ওর আপন ফুফু এই কথা বলে টিটকারি মেরেছিলেন। উনার মেয়ে পূরবীর সমবয়সি। ও ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিংটোচিং করেও কোথাও চান্স না পেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটা কলেজে ভর্তি হয়। পূরবীর ৭ম হওয়ার খবর শুনে আত্মীয়স্বজন সবাইকে বলে বেড়িয়েছিলেন, “পূরবী ওয়েটিংলিস্টে ৭ নাম্বারে আছে।” উনার এই নাক সিটকানি পূরবীর ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত চলছিল নিপুণ দক্ষতায়। অক্ষমরা সবসময়ই বেশি চ্যাঁচায়। যে যা পারে আরকি!

আইন পেশায় কাজ করতে গেলে অনেক জটিলতা আর চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এটা ভেবে পূরবীর বাবা প্রথমে ওকে আইনে ভর্তি করাতে রাজি না হলেও পূরবীর বড় আপু অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে রাজি করিয়েছিলেন। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার পাখা গজানোর বয়স। সে পাখা কে কীভাবে কতটা ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারল, সেটা দিয়েই পরের জীবনের পাঠ অনেকটাই লেখা হয়ে যায়। পূরবী একটু হাসিখুশি স্বভাবের ছিল, নিজেও প্রচুর হাসত, আশেপাশের সবাইকে হাসিখুশি রাখতে পারত। ক্লাসের কয়েকটা ছেলেবন্ধুর সাথে গল্প করত, আড্ডা দিত, কিন্তু ছেলেদের সাথে অতটা মাখামাখি গোছের সখ্যতা গড়ে তোলার ব্যাপারে ওর মধ্যে ভেতর থেকেই অনেক ধরনের ‘না’ কাজ করত। ‘পূরবী কি অন্ধ নাকি? চোখে দেখে না বোধহয়।’ পূরবীর প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব আর আত্মসম্মানবোধের কারণে এর চাইতে বেশি ফালতু ইয়ার্কি কিংবা নোংরা ঠাট্টা করার সাহসই পেত না কোনও ছেলেই। ও মাথা নিচু করে চলত বলে কেউ-কেউ ওরকম বলে-বলে ওকে খ্যাপানোর চেষ্টা করত। ক্লাসের অনেক ছেলেই ওকে পছন্দ করলেও সরাসরি সেটা বলার সাহস হয়ে ওঠেনি কারওই। ওর সামনে এলে অশ্লীল কোনও মজাও কেউ করতে পারত না, অথচ ও ছিল অনেক প্রাণোচ্ছল স্বভাবের একটা মেয়ে। ওর চরিত্র, সরলতা, সহযোগী মনোভাব, ছেলেমানুষি, সহজ সাবলীল ব্যবহার এসব দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ও সবার মন জয় করে নিতে পেরেছিল। ক্লাসমেটরা, ক্লাসের স্যাররা, সিনিয়ররা, এমনকি ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও পূরবীকে খুব পছন্দ করত। এভাবেই দিন কাটছিল।

টিউশনি করে আর অনলাইনে কিছু অনুবাদের কাজ করেটরে পূরবী পড়াশোনার সমস্ত খরচ নিজেই চালাত। ওর ব্যাচের অন্য মেয়েরা বিকেলের দিকে যে সময়টাতে প্রেম করত, ও সেসময়ে টিউশনিতে যেত। রাত জেগে পড়াশোনা করত, অনলাইনে বিভিন্ন কাজ করত। প্রথম তিনটা সেমিস্টার ভালোভাবে কাটল, রেজাল্টও বেশ ভালো হল। ফোর্থ সেমিস্টারে পড়ার সময় একদিন রাতে ফেসবুকিং করার সময় পূরবী আবিষ্কার করল, অবনি নামের কেউ একজন ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। পূরবী পরিচিত ছাড়া অন্য কারও রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করত না বিধায় ওকে ঝুলিয়ে রেখেছিল। এর সপ্তাহখানেক পর একদিন ক্লাসে নতুন একটা ছেলেকে খেয়াল করে পূরবী ওর বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ও কে রে?” তখন বান্ধবীর কাছ থেকেই জানতে পারল, ছেলেটার নাম অবনি, ও ওদের সাথেই পড়ে, কিন্তু ক্লাসে আসে না, শুধু পরীক্ষাগুলি দেয়, ওর নাকি ওখানে পড়তে ভালো লাগে না। পূরবী লুকিয়ে-লুকিয়ে ছেলেটাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। খুবই হ্যান্ডসাম স্মার্ট ভদ্র চেহারার একটা ছেলে। ক্লাসেই মোবাইলে ফেসবুকে ঢুকে দেখল, হ্যাঁ, ওই ছেলেটাই, যে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। তখনই রিকোয়েস্টটা অ্যাক্সেপ্ট করে একটা ‘হাই’ দিতে গিয়ে দেখল, একটা ‘হাই’ আগে থেকেই আদার্সে জমা হয়ে ছিল। পূরবী আর কিছুই পাঠাল না, মেসেজটা জাস্ট সিন করেই রেখে দিল। ছেলে যতই হ্যান্ডসাম হোক না, কোনও সুন্দরী ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটাও অ্যাক্সেপ্ট করবে, আবার হাই’টাও নিজ থেকে দেবে—এ দুটো একসাথে হয় না। এরপর পূরবী ক্লাসে গেলেই অবনিকে মনে-মনে খুঁজতে থাকত হন্যে হয়ে। অবনি তো ক্লাসে নিয়মিত আসত না, তাই বারবারই নিরাশ হতে হত ওকে। তিনদিন পর ক্লাসে টিউটোরিয়ালের একটা খাতা দিল, অবনি সেদিনও আসেনি। পূরবী টেক্সট পাঠানোর একটা সুযোগ পেয়েই ইনবক্সে লিখে দিল, “এই, তুমি ক্লাসে আস না কেন? আজকে একটা খাতা দেখিয়েছে।” সেই থেকে শুরু। কোনও রকমের হাই-হ্যালো ছাড়াই পূরবী অবনির সাথে কথা বলা শুরু করেছিল; এমনভাবে, যেন কতদিনের চেনাজানা আছে ওদের মধ্যে! নিজেকে লুকিয়ে রাখা মানুষ হয় নিজেকে প্রকাশ করেই না, কিংবা এতটাই প্রকাশ করে ফেলে যতটা স্বাভাবিকের পর্যায়ে পড়ে না। নিয়মিত চ্যাটিং হতে লাগল। পূরবী একটু-একটু করে মেসেঞ্জার আসক্ত হয়ে পড়ল। চ্যাটরুমে অনেকেই থাকলেও শুধু অবনির সাথেই কথা বলত। ওরা দুজনই একটা টেক্সটের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকত প্রতিটি মুহূর্তেই। কিছুদিন পর অবনি যখন ক্যাম্পাসে এল, তখন ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল। সেদিন দুজন মিলে প্রায় ১ ঘণ্টা সারা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ালেও হাতেগোনা ৪০-৫০টা বাংলা শব্দের বেশি শব্দ ব্যবহার করে বাক্যগঠন করে ওদের মধ্যে বাক্যবিনিময় হয়নি। সবচাইতে সুন্দর জড়তাভাঙা বাক্যটি ছিল, “এই নাও, আইসক্রিম খাও।” যেটা অবনি বলেছিল বাসে ওঠার ঠিক আগে। “হুম, এমনই হয়!” এইটুকু বলেই আইসক্রিমটা হাতে নিয়ে পূরবী খুব দ্রুত সেখান থেকে চলে এসেছিল। অতটা হিমশীতল আইসক্রিম পূরবী জীবনেও খায়নি।

দিনে-দিনে ওরা পরস্পরের প্রতি খুব বেশি নির্ভরশীল ও আসক্ত হয়ে পড়ল। নিয়মিত কথা হত চ্যাটে। ঘুমানোর সময়টা বাদে, দিনরাত, সবসময়ই। পূরবী আগে দুপুরে ঘুমাত, রাতে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টের কাজটাজ করত। কিন্তু অবনির সাথে পরিচয়ের পর থেকেই ওর সবকিছুই বদলে যেতে লাগল। জীবনের ভাবনা, জীবনের রুটিন, জীবনের ছন্দ। ওরা মেসেঞ্জারে কথা বলত, কিন্তু ওদের মধ্যে কখনোই ফোনে কথা হয়নি। প্রায় ৬ মাস কাটল এভাবেই। একদিন। অবনি পূরবীর কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা চাইল। পূরবী একটু কনজারভেটিভ ছিল বলে কিছুতেই ওটা দিতে রাজি হচ্ছিল না। “তুমি নিয়মিত ক্লাস কর, আমি তো ক্লাসে যাই না। আমাকে ক্লাসের পড়ার খোঁজখবর দেয়াটা তোমার দায়িত্ব।” “সেটা তো আমি এখানেই দিতে পারি।” “না, এভাবে করে হয় না। এখানে সবকিছু শেয়ার করা সম্ভব না।” অবনি অনেক জেদ করাও সত্ত্বেও যখন পূরবী নাম্বারটা দিল না, তখন ও হঠাৎ করে বলে বসল, “পূরবী, আমি আমার মোবাইলটা পাচ্ছি না। একটা মিসড কল দাও না প্লিজ! …………এটা আমার নাম্বার।” পূরবী মজা করে বলল, “আচ্ছা, দিলাম মিসড কল। পেয়েছ তো?” “হ্যাঁ, পেলাম। থ্যাংকস অ্যা লট!” পূরবী ভেবেছিল, অবনিও পূরবীর মতো মজা করেছে। আসল ঘটনা ছিল ভিন্ন।

এর কয়েক দিন পর কথায়-কথায় পূরবী জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোমার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?” “আমরা আগে ভালো বন্ধু হয়ে নিই, তারপর বলব।” এটা বলেই অবনি প্রশ্নটি এড়িয়ে গেল। বারবার জোরাজুরি করা সত্ত্বেও যখন অবনি কিছুতেই ওটা বলতে রাজি হচ্ছিল না, তখন পূরবী রাগ দেখিয়ে রিপ্লাই করা বন্ধ করে দিল। একটুপরেই আইডিটা ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিয়ে বের হয়ে পড়ে ফেসবুক থেকে। প্রায় দেড় সপ্তাহের মত আইডি বন্ধ রেখেছিল। এই সময়টাতে পূরবীর সাথে যোগাযোগের কোনও উপায় না পেয়ে অবনি ভীষণ রকমের অস্থির হয়ে ওঠে। তখন ওই নাম্বারে ফোন করে বুঝতে পারল, ওটা পূরবীর নাম্বার না। আসলে সেদিন ওদের মধ্যে যে সময়টাতে কথা হচ্ছিল, ঠিক ওইসময়েই কাকতালীয়ভাবে একটা আননোন নাম্বার থেকে অবনির মোবাইলে ফোন আসে। আর সেটাকেই স্বাভাবিকভাবে পূরবীর নাম্বার ভেবে অবনি সেভ করেছিল। পূরবী আইডিটা আবার খুলে দেয়ার পর সে ঘটনাটি বলার সাথে সাথে ও নিজেই অবনিকে ফোন দেয়। পূরবীর ফোনটা পেয়ে অবনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। পূরবীকে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সরি’ই বলেছিল। পূরবী অবনিকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলে। এরপর থেকে ওদের প্রায় সারাক্ষণই ফোনে কথা হত। দিনে-দিনে ওদের ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে যেতে লাগল। ক্লাসে এলে পূরবীকে দেখতে পারবে, শুধু এটার জন্যই অবনি নিয়মিত ক্লাসে আসতে শুরু করল। একদিনও ক্লাস মিস করত না। শুধু পূরবীর জন্য প্রতিটি ক্লাস করত, প্রতিটি ক্লাসটেস্ট দিত। পূরবী ওকে নানানভাবে হেল্প করত। ওকে নোট করে দেয়া, স্যারদের লেকচার তুলে দেয়া, সাজেশনস রেডি করে দেয়া থেকে শুরু করে অবনির পড়াশোনার ব্যাপারে প্রায় সব দায়িত্ব পূরবী নিয়ে নিল। ওদের সম্পর্কটা দিনদিন গাঢ় হল। অবনির রেজাল্ট আগের চাইতে ভালো হওয়া শুরু করল, পড়ায় মন বাড়ল। ওর মধ্যে এই পরিবর্তনটা ওর বাবা-মা বুঝতে পারেন। অবনিও ওর বাবা-মা’কে প্রায়ই বলত, “শুধু পূরবীর জন্যই আমার মধ্যে এত চেঞ্জ। শুধু ওর জন্যই আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে।” অবনিদের বাড়ি ছিল নওগাঁতে। একদিন পূরবীর সাথে দেখা করতে অবনির বাবা-মা ভার্সিটি ক্যাম্পাসে এলেন। এসেই পূরবীকে ফোন করে ডেকে নিয়ে অনেক গল্প করেছিলেন। পূরবীর জন্য অবনির মা অনেক খাবার রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে বাসায় গিয়ে অবনিকে বলেছিলেন, “পূরবী অসাধারণ একটা মেয়ে। ওকে আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে।” এরপর থেকেই প্রায়ই উনারা পূরবীকে ফোন করে খবরাখবর নিতেন। পূরবীকে ‘মা’ সম্বোধন করেই সবসময়ই কথা বলতেন। প্রতি সপ্তাহেই অবনির মা পূরবীর জন্য বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না করে পাঠাতেন। অবনি নিজ হাতে তুলে সে খাবার পূরবীকে খাইয়ে দিত। এভাবেই কাটছিল সুন্দর সুখের দিনগুলি।

একদিন পূরবীর হাত ধরে বসে-বসে বিভিন্ন গল্প করতে-করতে অবনি বলে, “তোমাকে আমি অনেকদিন থেকেই অনেক পছন্দ করি। তুমি তো ছেলেদের দিকে অত তাকাওটাকাও না, তাই খেয়াল করনি, আমি তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম চুপিচুপি। তোমার নাকটা এত সুন্দর লম্বা, দেখলেই মনে হয় যেন ইরানি কোনও মেয়ে। এমন সুন্দর মেয়ে আমি কোনওদিনই দেখিনি। তোমার চোখের মতন অমন অদ্ভুত চোখ আর কারওই নেই। কেউই বলতে পারবে না, তোমার চোখ আসলে কী রঙের। কখনও বাদামি, কখনও ধূসর, কখনও ছাইরঙের; এরই মাঝে কেমন একটা নীল আভা খেলে যায় হঠাৎ-হঠাৎ।” একরাশ অসীম মুগ্ধতা নিয়ে পূরবীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত অবনি। পূরবীর সরলতা, সততা আর চারিত্রিক দৃঢ়তার কথা প্রায়ই বলত অবনি। “তোমার মা নেই, এতটা দুঃখ নিয়ে বেঁচে আছ তুমি, অথচ তোমার ছেলেমানুষি আর উচ্ছলতা দেখে সেটা বোঝার কোনও উপায়ই নেই। তুমি এভাবেই সবসময়ই হেসেখেলে বেড়িয়ো।” ওদের মধ্যে এই আকর্ষণ ক্রমেই আরও দুর্নিবার হতে লাগল। ওরা সবসময়ই একসাথে বসত, একসাথে ঘুরে বেড়াত, একসাথেই খেত। অবনি কখনোই পূরবীকে ফেলে কিছু খেত না, খুবই কেয়ার করত পূরবীর। পূরবীর যেভাবে করে ভালো লাগে, সেভাবে করেই চলার আপ্রাণ চেষ্টা করত। পূরবীর ভালোলাগা খারাপলাগা এসব নিয়ে সারাক্ষণই ভাবত। পূরবীর খুব ছোটছোট ব্যাপারগুলিও খুব সহজেই বুঝতে পারত বলে নিজেকে পূরবীর সামনে পূরবীর মনের মতো করেই উপস্থাপন করত অবনি। অবনির আচরণ, কথাবার্তা, ভদ্রতা, বিনয় সবকিছুতেই মুগ্ধ মোহগ্রস্ত হয়ে থাকত পূরবী। পূরবীর সব মতামতই খুব গুরুত্ব দিয়ে শুনত, পূরবীর ভাবনাগুলিকে সম্মান করত, পূরবীকে বোঝার চেষ্টা করত পূরবীর মতো করেই। পূরবীর চোখে অবনি ছিল পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর, ভদ্র, স্মার্ট, মার্জিত একটা ছেলে। অবনিকেই পূরবী পারফেক্ট মনে করত সবদিক থেকেই।

ওরা একসাথে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াত বলে সবার কাছেই খুব পরিচিত জুটি ছিল। সবাইই চিনত ওদের। ঝালমুড়িওয়ালা থেকে শুরু করে ক্যান্টিনের মামারা পর্যন্ত। স্যার-ম্যাডামরাও জানতেন, ওরা সবসময় একসাথেই থাকে। একদিন এক ম্যাডাম মজা করে পূরবীকে জিজ্ঞেস করে বসেছিলেন, “অবনি কি তোমার শুধু বন্ধুই?” ক্লাসের সবাই ওদেরকে নিয়ে নানান জল্পনাকল্পনা করত। “ওরা কি আসলে বন্ধু? নাকি কাপল?” ওরা বন্ধুর মতো চলত বলে ওদেরকে নিয়ে সবাই কনফিউসড ছিল। অবনি পূরবীকে বলত বন্ধু, আর পূরবীর নাম্বারটা সেভ করে রেখেছিল ‘বাবুই’ নামটা দিয়ে। পূরবীকে আদর করে ‘বাবুই পাখি’ বলে ডাকত। ওরা সবসময়ই বাসে পাশাপাশি বসে যাওয়াআসা করত। সারাপথই হাতে হাত রেখে খুব গল্প করত দুজন। কখন যে সময়টা এক দৌড়ে ফুরিয়ে যেত ওরা টেরই পেত না।

ওদের থার্ড ইয়ার একজামের কিছুদিন আগে একদিন সকালে পূরবী অবনির ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে ওর আগের পোস্টগুলি দেখছিল এক-এক করে। ২০১০ সালের মার্চের ৬ তারিখের একটা পোস্টের কমেন্টে পূরবী দেখল, অবনি কেয়া নামের কাউকে ‘আই লাভ ইউ, বাবুসোনা।’ লিখেছে। পরে আরও কয়েক মাসের পোস্ট ঘাঁটাঘাঁটি করে পূরবী বুঝতে পারল, ওই মেয়েটা অবনির গার্লফ্রেন্ড এবং এখনও মেয়েটা ওর ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। এরপর পূরবী মেয়েটাকে অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠায়। মেয়েটা অ্যাক্সেপ্ট করলে ওর সাথে ইনবক্সে খুবই সাধারণ সৌজন্যমূলক কিছু মেসেজের বিনিময় হয়। সেদিন বিকেলেই অবনি পূরবীকে ফোন করল। “আমি তোমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। মন দিয়ে শোনো। আসলে আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। এটা তোমার জানা উচিত বলে আমি মনে করি।” পূরবী ফোনে হেসে হেসেই কথা বলছিল, ওর রিলেশনটা নিয়ে অনেক মজা করছিল, ওর জন্য শুভকামনাও জানাল, কিন্তু ফোনটা রাখতেই অঝোরে হুহু করে কান্না করা শুরু করল। সে কান্নার ব্যাপ্তি লেখা ছিল পূরবীর বাকি জীবনটা জুড়েই। সে কান্না আর কোনওদিনই থামেনি। অভিমানী পূরবী তার কষ্টের কথা অবনিকে কোনওদিনই জানতে দেবে না, এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সেদিনই পূরবী প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে, অবনিকে ও কতটা ভালোবাসে। কিন্তু সেটা ওকে পূরবী একটুও বুঝতে দেয়নি। বরং থার্ড ইয়ার ফাইনালের সময় ঠিক আগের মতই নিজের ক্ষতি করে সবসময়ই অবনির পাশে থেকেছে। ওকে পড়াশোনায় সব ধরনের উৎসাহ দিয়েছে। কারণ, ও খুব ভালো করেই জানত, ও পাশে না থাকলে অবনির রেজাল্ট আগের মতই খারাপ হবে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর একদিন সন্ধ্যায় গল্প করার সময় অবনিকে পূরবী তার মায়ের কথা বলে কাঁদতে লাগল। এর পরদিনই ছিল পূরবীর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। ভীষণ কাঁদতে-কাঁদতে একসময় অসহায়ভাবে অবনিকে পূরবী বলে ফেলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি কী করব, আমাকে বলে দাও।” পূরবীর মাথাটা টেনে বুকের মধ্যে শক্ত করে গুঁজে অবনি বলেছিল, “আমি আগেই জানতাম, তুমি আমাকে ভালোবাস। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, তুমি তো অনেক শক্ত মেয়ে, নিজেকে সামলে নিতে পারবে। আমি নিজেও তোমার প্রতি অনেক দুর্বল। তোমাকে ছেড়ে বাঁচতে আমারও ভীষণ কষ্ট হবে। আমি কোনওদিনই তোমার হব না, এটা আমি ভাবতেও পারি না, বিশ্বাস কর। কিন্তু তা-ই বলে আমি যে আমার গার্লফ্রেন্ডকে ঠকাতে পারব না। ওর কী দোষ, বলো? আমাদের ৬ বছরের রিলেশন। ও যে আমার জন্যই এতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে। তুমি কিছু ভেবো না। আমি তোমার সবকিছুই ঠিকঠাক করে দেবো যদি তুমি আমার পাশে থাক। তুমি কখনোই আমাকে ছেড়ে যেও না, বাবুইসোনা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। তুমি সারাজীবনই আমার পাশে থাকবে; প্রয়োজনে, বন্ধু হয়ে।” “কিন্তু এভাবে তো সম্ভব নয়। তোমার পাশে থাকলে, তোমাকে দেখলে, আমি কখনোই ভুলতে পারব না তোমাকে। তুমিও কষ্ট পাবে, আমিও কষ্ট পাবো। আবার ওদিকে তোমার গার্লফ্রেন্ডও ঠকে যাচ্ছে। এভাবে হয় না। একটু বুঝতে চেষ্টা কর প্লিজ!” সেদিনের সন্ধ্যাটি রাতের কোলে হারিয়ে গিয়েছিল দুইজন অসহায় মানুষের অর্থহীন চোখের জলের স্রোতে।

পূরবী অবনিকে অনেক কষ্টে রাজি করায় যাতে অন্তত এক মাস পূরবীর সাথে ও কোনও ধরনের যোগাযোগ না রাখে। সে রাতে বাসায় ফিরেই অবনি অনেক যন্ত্রণামাখা স্ট্যাটাস দেয়। এভাবে তিন-চারদিন নিজের সমস্ত বিষণ্ণতা আর বেদনাবোধে আচ্ছন্ন অবনির নীল ভাবনাদেয়াল কাঁদতে থাকে। পূরবী অবনির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজেই ওকে ফোন করে। অনেকক্ষণ কথা বলে ওকে শান্ত করে। এরপর থেকে কিছুদিন পরপরই ওরা নিজেদের মধ্যে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখত। কিন্তু কেউই বেশিদিন চুপ করে থাকতে পারত না। দুজনের যে কেউ ফোন করে বসতই। অবনি ক্লাসে আসাও কমিয়ে দেয় আগের মতই। পূরবী জিজ্ঞেস করলে বলত, “যদি তুমি আমাকে দেখে কষ্ট পাও, তাই ক্লাসে আসি না।” এভাবেই চলতে থাকে।

এর কিছুদিন পর হঠাৎ পূরবীর বাবা স্ট্রোক করে মারা যান। সে সময় ওদের যোগাযোগ বন্ধ ছিল। পূরবীর এক বান্ধবীর কাছ থেকে পূরবীর বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অবনি বাচ্চাদের মতো করে ভীষণ কেঁদেছিল। বারবারই দিনাজপুরে পূরবীদের বাসায় আসতে চেয়েছিল। পূরবীর বান্ধবীকে অনুরোধ করেছিল, যাতে ও পূরবীকে বলে একটিবারের জন্য হলেও অবনির সাথে কথা বলতে। বাবার মৃত্যুর ৫ দিন পর পূরবী অবনিকে ফোন করে। অবনির সাথে কথা বলতে গিয়ে বারবারই পূরবীর দম আটকে যাচ্ছিল। পূরবী অবনিকে বলে, ও যেন পরদিন ক্যাম্পাসে আসে। সেদিন ওরা আগের মতোই একসাথে ঘোরাঘুরি করে, আড্ডা দেয়, সময় কাটায়। পরে একটা সময় পূরবী অবনিকে জানায়, এভাবে করে আসলে সম্ভব না। ও কিছুতেই বাঁচতে পারছে না অবনিকে ছাড়া। এরকম করে চলতে থাকলে ও অসুস্থ হয়ে মারা যাবে। অবনি বোঝায়, ও পূরবীকে অনেক পছন্দ করে। ওর কাছে জীবন মানেই পূরবী, কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের সাথে বিট্রে করতে পারবে না বলে পূরবীকে গ্রহণ করতে পারছে না। পূরবীকে ও আজীবন ওর পাশে চায়, খুব ভালো বন্ধু হিসেবে। ওর নিজের মায়ের পরে দেখা সবচাইতে নিঃস্বার্থ মেয়ে হল পূরবী। কোনওমতেই পূরবীকে ও হারাতে চায় না। এ ধরনের বিভিন্ন কথা বলে পূরবীকে বোঝানোর চেষ্টা করে অবনি। এক পর্যায়ে পূরবী কাঁদতে থাকলে পূরবীকে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে পূরবীর কপালে, চোখে, মাথায়, গালে চুমু খেতে খেতে বারবার বিভিন্ন ধরনের উপদেশ ও সান্ত্বনা দেয় অবনি। সেদিনের পর থেকে ওরা দুজনই একটু সতর্ক হয়ে চলার চেষ্টা করতে থাকে। ওরা নিজেদের মধ্যে শপথ করেছিল, ওরা যে করেই হোক, স্রেফ বন্ধু হয়েই থাকবে।

এই ধরনের ক্ষেত্রে মানুষ শপথ গড়ে যতটা প্রত্যয়ে, শপথ ভাঙে তার দ্বিগুণ প্রত্যয়ে। ওরা আস্তে-আস্তে আরও গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে থাকে। রাতের পর রাত জেগে চ্যাটিং করত, ফোনে গল্প করত। প্রায় রাতেই কথা বলতে বলতে আজানের সময় হয়ে যেত। ওরা ঘুমাতে যেত সকাল ৭টায়। অবনি ভীষণ সুন্দর গাইতে পারত। পূরবী যখনই আবদার করত, অবনি ওকে গান শোনাত। হোক সেটা রাত, কিংবা দিন। প্রায়ই পূরবীর জন্য গান রেকর্ড করে পাঠাত। পূরবী অবনিকে যা-ই করতে বলত, শত কষ্ট হলেও অবনি সেটা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করত। পূরবীকে খুশি করার জন্য সবসময়ই নানান প্ল্যান করত। পূরবীর এটাওটা কিনে দেয়া, ডাক্তার দেখানো, যেকোনও প্রয়োজনে সঙ্গ দেয়া, সব কাজই করে দিত অবনি।

এদিকে পূরবীকে না জানিয়েই বাসায় ওর আপুরা ওর বিয়ের জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই পাত্র খুঁজছিল। একটা ছেলে ফেসবুকে পূরবীকে পছন্দ করে, ওর সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিয়ে ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্সে বিবিএ এমবিএ করা, একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। ঢাকায় বাড়ি গাড়ি সবই আছে। ভদ্র বিনয়ী সুদর্শন ছেলে। ফ্যামিলিও বেশ ভালো। বিয়ে যেদিন, তার ঠিক আগের দিন পূরবীকে বিয়ের কথা বাসা থেকে জানানো হয়। অবনিকে ফোনে এটা জানালে ও পাগলের মতো পূরবীর হলের সামনে ছুটে আসে। পূরবীকে বারবার নিষেধ করে বিয়েটা করতে। বলে, বিয়ে করলে তোমার ক্যারিয়ারের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি বেঁচে থাকতে সেটা কিছুতেই হতে দেবো না। তুমি যেকোনও মূল্যে এই বিয়েটা বন্ধ কর। “অবনি, আমি তোমার জন্য সবকিছুই করতে পারি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর কোনওদিনই হয়তো এটা আর বলব না, কিন্তু এটা সবসময়ই বিশ্বাস কোরো।” পূরবীকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে-খেতে অবনি বলতে থাকে, “আমিও তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি, কিন্তু আমি একটা রিলেশনে আছি বলে কোনওদিনই সাহসের অভাবে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে কথা দিয়েছি। তাই কিছুতেই ওকে ঠকাতে পারব না। আবার তোমাকেও ভালো না বেসে থাকতে পারব না। তোমাকে ছাড়া আমি আমার জীবনটাকে কল্পনাও করতে পারি না। আমি ছাড়া তুমি আর কারও হবে, এটা আমি ভাবতেও পারি না। তুমি এই বিয়েটা ভেঙে দাও, সোনা।”

যে মেয়ের বাবা নেই, মা নেই, সে মেয়ের পক্ষে পরিবারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যাওয়াটা পৃথিবীর সবচাইতে দুরূহ কাজগুলির একটি। পরিবারের শতশত গঞ্জনা, কথার খোঁটা, সন্দেহের তীক্ষ্ণ তীর, বক্রোক্তি মুখ বুজে সহ্য করে অনেক কষ্টে পূরবী বিয়েটা ভেঙে দিল। দিনটা ছিল রোববার। সোমবারেই পূরবীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ে ভেঙে দেয়ার ব্যাপারটা পূরবী অবনিকে জানায়নি। ওর সাথে পরের দুইদিন কথাও বলেনি। এরপর মঙ্গলবার ঠিক রাত ১২:০১টায় কেক কাটার মুহূর্তে অবনিকে ফোন করে বলে, “হ্যাপি বার্থডে টু য়্যু!” এরপর ওই ব্যাপারটা জানায় অবনিকে। পূরবীর প্ল্যান ছিল, জন্মদিনে অবনিকে একটা দারুণ সারপ্রাইজ দেবে খবরটা জানিয়ে। পূরবীর বিয়ে ভেঙে যাওয়ার খবরটা শুনে খুশিতে অবনি চিৎকার করতে থাকে। বলতে থাকে, বাবুই সোনা, আমার এ জীবনে এত বড় বার্থডে গিফট আমি কোনওদিনই পাইনি। তোমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসি, সোনা। তুমি আমার, শুধু আমারই থাকবে সারাজীবন।

পূরবীর চোখে অবনি অনেক চমৎকার একজন ভালো মানুষ। ও যা-ই করত, পূরবীর মনে হত, এর চাইতে ভালো আর কিছুই হয় না। তবে একটা ব্যাপারে পূরবী খুব কষ্ট পেত। সেটা হল, অবনি যখনই ওর নওগাঁর বাসায় যেত, তখন পূরবীকে তেমন একটা সময় দিত না। জিজ্ঞেস করলে বলত, ওখানে গেলে অনেক বন্ধুকে আর বাবা-মা’কে সময় দিতে হয় বলে ওকে ফোন করতে পারে না। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝলেও পূরবী কিছুতেই ওর সাথে একটুখানিও বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারত না বলে অনেক অভিমান করে থাকত। কান্নাকাটি করত, কথাবলা বন্ধ করে দিত। তারপর অবনি অনেক আদর করে-করে ওর অভিমান ভাঙাত। না ভাঙালে পূরবী নিজ থেকেই আবার কথা বলা শুরু করত। আসলে অবনির চাইতে ভালো ছেলে পূরবী আর কখনোই দেখেনি। নিজের জীবনটাকে অবনি ছাড়া কল্পনাতেও আনতে পারত না পূরবী। অবনি পূরবীকে খুবই ভালোবাসত, পূরবীর সব ধরনের যত্ন নিত, পূরবীর সকল সুখদুঃখের খোঁজ রাখত। একটা ছেলে এতটা ভালোবাসতে পারে, এটা পূরবী ভাবতেও পারত না। অবনির সবকিছুতেই পূরবী মুগ্ধ হয়ে থাকত। পূরবীকে এই পৃথিবীতে একমাত্র অবনিই বুঝতে পারত। পূরবীও অবনিকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে। অবনি ছিল পূরবীর কাছে একটা অপ্রতিরোধ্য নেশার মতো। অবনি কী করছে, কী করবে, কী ভাবছে, কী ভাববে, সবকিছুই বলে দিতে পারত পূরবী। ওদের মাঝে ভীষণ রকমের মিল। ভাবনার এরকম অবিশ্বাস্য টেলেপ্যাথি কেউ কোনওদিন দেখেনি। পূরবী খুব অবাক হয়ে ভাবত, এতটা কোইনসিডেন্স কীকরে সম্ভব? ও বিশ্বাস করত, এ পৃথিবীতে একমাত্র অবনিই ওর সত্যিকারের সৌলমেট। তাই যখনই ওর মনে হয়, ও অবনিকে পাবে না, ও অন্য কারও, তখনই ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। বুক ভেঙে কান্না আসে। সমস্ত শরীরমন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। ভাবতে ভাবতে যখন পাগলের হওয়ার উপক্রম হয়, তখন অবনির আর ওর নিজের ভালোর কথা চিন্তা করে আবারও কথাবলা বন্ধ করে দেয়। অবনি পূরবীকে বোঝানোর চেষ্টা করে; বলে, পূরবীর সাথে কথা বলতে না পারলে সে দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে। কখনও-কখনও পূরবী খুব অনড় অবস্থানে চলে যায়। তখন পূরবীকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে অবনিও পূরবীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বুকে কষ্ট চেপে পূরবীর পথেই চলে।

একবার বেশ কিছুদিন কথাবলা একেবারেই বন্ধ ছিল। এরপর পূরবী যখন দেখল, সেমিস্টার ফাইনালের আর মাত্র ৫ দিন বাকি, অথচ অবনি তখনও মেসে ফেরেনি, নওগাঁতে গিয়ে বসে আছে, তখন ওকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চেয়ে মেসে নিয়ে এসেছিল। দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতে অবনির কোনও ক্ষতি পূরবী কোনওদিনই হতে দেবে না। পূরবী না বললে অবনি সেমিস্টার ড্রপ দেয়ার প্ল্যান করেছিল। বাসায় কারও কথাই শুনছিল না ও। পূরবী নিজেই সব নোট আর সাজেশনস যোগাড় করে দিয়ে, নিজে না পড়ে অবনিকে ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়া বুঝিয়ে দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ায়। অবনির বাবা-মা পূরবীকে অসম্ভব বিশ্বাস করতেন। প্রায়ই ফোন করে বলতেন, “মা, তোমার হাতে আমরা আমাদের ছেলেটাকে তুলে দিয়েছি। তুমি ওকে দেখে রাখবে, সবসময়ই খেয়াল রাখবে। তুমিই আমাদের শেষ ভরসা, মা। কারণ, অবনি এই দুনিয়ায় একমাত্র তোমার সব কথা শোনে।” অবনির বাবা-মা পূরবীকে অবনির খুব ভালো একজন বন্ধু হিসেবেই জানেন, আবার ওদিকে অবনির ওই রিলেশনটার কথাও জানেন। উনারা অবনির রিলেশনটা মেনে নিয়েছেন এর মধ্যেই। যা-ই হোক, অবনিকে পরীক্ষাটা ভালোমতো শেষ করিয়ে দিয়ে পূরবী আবারও অবনির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

কয়েকদিন পর অবনির পীড়াপীড়িতে পূরবী অবনির সাথে রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত স্কাইপে ভিডিওকলে কথা বলে। পরদিন পূরবীই অবনিকে প্রথম কল দেয়, ওর কাছ থেকে সেলফি চায়, ওর নিজের সেলফিও দেয়। এর দুইদিন পর অবনি ক্যাম্পাসে এসেছিল ডিপার্টমেন্টের একটা কাজে। সেদিন ক্যাম্পাসে আসার আগে পূরবীকে ফোন করে আসেনি। পূরবী হঠাৎ পেছন থেকে অবনির হাত দেখেই অবনিকে চিনে ফেলে। এরপর ওর সামনে গিয়ে একটু উঁচু গলায় বলতে থাকে, “তুমি তো নিজেই বল, তুমি ডিপার্টমেন্টে আসই আমার জন্য। তবে আসার আগে ফোন করনি কেন? আর কক্ষনো আমার সাথে কথা বলবে না তুমি। আজকের পর থেকে আমার ছায়াটাও মাড়াবে না।” অবনিকে পাবে না জেনে, নিজের ভেতরে জমেওঠা সবটুকু রাগ আর অভিমান ঢেলে দিল অবনির ওপর। অবনি কিছুই বলেনি। ও পূরবীকে বুঝত। ও জানে, পূরবী ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে; নিঃস্বার্থভাবে। তাই, সব কথা হজম করে চুপ থেকেছে। একটা অভিযোগও করেনি, মাথা নিচু করে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এরপর কিছুদিন পূরবী লক্ষ্য করে, অবনি আর আগের মতো পূরবীকে ফোন করে না, মিশে না। নিজ থেকে উপযাচক হয়ে কথাও বলে না। এটা নিয়ে পূরবী আবারও কান্নাকাটি করে, অভিমান করে। তখন অবনি ওকে জানায়, পূরবীর কথামতোই তো ও পূরবীর কাছ থেকে দূরে-দূরে থাকছে। তবে এটা নিয়ে প্রশ্ন করার কী আছে? ওই মুহূর্তে পূরবী সত্যিই বুঝতে পারে না, ও এখন কী বলবে!

কিছু-কিছু মানুষ জন্মায় মৃত্যুর আগেই মরে যাওয়ার জন্য। পূরবী হয়তো তাদেরই একজন। সেই ৪ বছর আগে যখন পূরবী জানতে পেরেছিল, ও অবনিকে কোনওদিনই পাবে না, সেদিনই সে মরে গেছে। এরপর সে অসংখ্যবার মরেছে। এতদিন ধরে সে নিজের মৃত দেহটাকে টেনে নিয়ে-নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। পালিয়ে যাচ্ছে নিজের অস্তিত্বের কাছ থেকে প্রতিটি সেকেন্ডেই। মৃত্যুযন্ত্রণার কথা ভাবলে সে এখন আর আঁতকে ওঠে না, ওটা পেয়ে-পেয়ে সে অভ্যস্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। অবনিকে ছাড়া একটা মুহূর্তের জন্যও পূরবী অন্যকিছু ভাবতে পারে না। ও অন্যকিছু ভাবতে ভুলে গেছে অনেক অনেকদিন আগেই। অবনির কথা ও এতটাই ভাবে যে, সৃষ্টিকর্তাকে এর অর্ধেক পরিমাণও স্মরণ করলে হয়তো উনি পূরবীকে জান্নাত দিয়ে দিতেন। ওর নিজের কোনও পৃথক সত্তা কিংবা অস্তিত্ব নেই। স্রেফ নিঃশ্বাসের প্রবাহের জোরেই যদি মানুষ না বাঁচত, তবে ওর মরে যাওয়ার কথা ছিল অনেকদিন আগেই। প্রতি রাতেই পূরবী সারারাত কাঁদতে থাকে। কাঁদতে-কাঁদতে কখনও কখনও অজ্ঞান হয়ে যায়, কিংবা বমি করে দেয়। পূরবীর প্রতিটি মুহূর্তের সবচাইতে বিশ্বস্ত নিশ্চল সঙ্গী অসহ্য যন্ত্রণা। ও বিশ্বাস করে, অবনিও অনেক অনেক কষ্টে আছে। পূরবীকে ছাড়া ও কিছুতেই ভালো থাকতে পারে না। এক মুহূর্তের জন্যও না। কিন্তু শুধু পূরবীর ভালোর কথা চিন্তা করেই নিজে যন্ত্রণা সহ্য করে পূরবীর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। শুধুই পূরবীর মঙ্গলের জন্য, আর কিছুই নয়।

আবার ঠিক পরমুহূর্তেই পূরবীর মনে প্রশ্ন জাগে, “এটা কীভাবে সম্ভব? যে ছেলেটা সবসময়ই আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখত সুযোগ পেলেই, লুকিয়ে-লুকিয়ে হলেও, যে আমার চোখে এক ফোঁটাও জল আসতে দেয়নি কোনওদিনই, পরম বিশ্বস্ততায় আমার ভালোলাগা খারাপলাগার খেয়াল রেখেছে দিনের পর দিন, যেখানে নিজের বাবা-মা’র কথা শোনেনি, সেখানে আমার সব কথাই ক্রমাগত শুনে গেছে চোখকানমুখ বুজে, শত কষ্ট হলেও, যে ছেলেটাকে অন্যরা সবাই গম্ভীর, ব্যক্তিত্বপূর্ণ, কঠিন মানুষ হিসেবে জানে, সমীহ করে চলে, অথচ সেই মানুষটিই আমার দুঃখকষ্ট দেখলে বাচ্চাদের মত করে কাঁদে, আমাকে ছেড়ে থাকতে যার পুরো পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে যায়, যাকে আমি আমার অস্তিত্ব ভুলে পাগলের মতো ভালোবাসি—-সে কীভাবে আমার হবে না? কীভাবে তার আর আমার মিলন হবে না? দুইজন মানুষের কাছে থাকার জন্য এর থেকে আর কত বেশি ভালোবাসা, ত্যাগ প্রয়োজন? ভালোবাসা কি আজ তবে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি? ……………. পূরবী আর কিছুই ভাববার শক্তি পায় না।

পূরবী এখন ইচ্ছে করেই অবনির সাথে যোগাযোগ করে না। হয়তো ও কেয়াকে নিয়ে বেশ সুখে দিন কাটাচ্ছে। পূরবী জানে, ও যত বেশি অবনির জীবন থেকে দূরে থাকবে, অবনি তত বেশি ভালো থাকার পথে এগোবে। ও অবনির পাশে থাকলে অবনি কখনোই ভালো থাকতে পারবে না। তাই, যত কষ্টই হোক, প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে হলেও ও অবনির জন্য সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করবে, করেই যাবে আজীবন। পূরবী চায়, অবনি ভালো থাকুক। সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক। ও যে অবনিকে ভালোবেসেছে, শেষ নিঃশ্বাসের বাজি ধরে!