স্তব্ধতার সুবাস

 এক।
সরাইওয়ালার কাজ কতটুক, আমি তো জানিই, প্রভু!
তবু করজোড়ে এই মিনতি,
এ বছরখানা ঘুরলে এসো,
এ বছরের বর্ষামেঘে একাকীত্ব বাঁধছে আমার ভীষণ জোরে!
একাকীত্বে ব্যস্ততা খুব!
 
মেয়ে, শোনো বলি, যে মুহূর্তটা মেঘ হয়ে আছে,
ওকে দূরে রেখে দাও মুহূর্ততেই!
ওর ভেজা শরীর নাও জড়িয়ে তোমার গায়ে;
একটু ভিজো, একটা ফোঁটাও নষ্ট কোরো না!
জেনে রেখো, বৃষ্টি কখনো রাস্তা চেনে না,
কোনো নিশানার পরওয়া করে না রৌদ্র অবাধ!
 
তুমি কি তবে ওদের মতোই?
বিগত বিষাদে দাও তাড়িয়ে
নগদ আরাম?
তবে তাই হোক, থাকো মেয়ে হেঁয়ালিতেই!
শুধু মনে রেখো,
রাতের তারার মাঝে সূর্য ঘুমায়!
 
দুই।
শুনতে পাই,
প্রজাপতি সব নির্বাসনে যাবে,
গোলাপের দল পরাগ পাবে আপনা হতেই,
মৌমাছিরা মৃদু হাওয়ায় একটু দূরে উড়বে কেবল;
মলয় সমীরে ভেসে যাবে যত পরাগরেণু......
এসবই যদি নিয়ম হবে,
ফুলের দুঃখ ঘুচবে কবে?
 
হে রাজার বন্ধু দেবতা আমার,
রাজাকে বলো, পাপের ফসল গেছে পেকে সে কবেই!
আমাদের চাষা, আমাদের মুটে, আমাদের কুলি, আমাদেরই ছেলে
দাঁড়িয়ে কেবল কাঁদতে থাকে আর দেখে যায়
ওদের চোখ ওরা উপড়ে ফেলে,
ওদের জিভের সবটা জুড়ে দগদগে ঘা,
ওদের হাতে ওঠে না ফসল, কেবল রক্ত ওঠে!
ওরা ভাবে, ঈশ্বর তবে এমনি করেই বিচার করেন!
 
তিন।
আজ কোন নারীর দেহে পাথর শোবে?
কোন শিশুর আহার বন্ধ হবে কালকে থেকেই?
ওরা কেবল হন্তারকের বারুদ শোঁকে, দাপট দেখে।
আর দেখে যায়, দড়িতে ঝোলে অপাপীরাই!
নেই মাথা যার, মাথাব্যথা তার!
ভাল করলে স্বর্গ পাবে, খারাপ করলে এই পৃথিবী!
নাম তো এরই রাষ্ট্রসমাজ--ভগবানের দাস!
 
বাবার শিশু মায়ের নামে উঠলে বেড়ে,
পায় না জীবন, পায় অভিশাপ!
বাবাদের ঘরে বাড়তে গিয়ে
বহু দাম দিয়ে শ্বাসটা কিনে,
অপরিচয়ের পাহাড় ভেঙে উঠলে চুড়ায়, তবেই জানি,
মুক্তি মেলে। মায়ের নামে বাবার রাজ্যে এটাই নিয়ম!
তোমার চোখের রঙে, কপালের ভাঁজে বাবার ছায়া,
ঠোঁটের বাঁকে, গলার ফাঁকে, থুৎনিতেও বাবার কায়া,
তবু, বোধে রেখো, বাবারা যখন সমাজ হাঁটায়,
যাকে বল জন্মদাতা--মাড়িয়ে বিবেক আইনে বাঁচে, আইনে বাঁচায়!
বাদ দাও তো সব! ঘরের দরোজায় যে নাম রাখো, সে তো নকল!
পুরো পৃথিবী যে নামে কাল চিনবে তোমায় সেটাই আসল!
 
চার।
কথা চলছে। হঠাৎ নীরবতা!
কথা চলছে না। নীরবতা চলছে।
ভাইয়েরা, আসুন, নীরবতা শুনি।
 
কেউ কি কড়া নাড়ল.....এই মাঝরাতে?
নাকি এ ভ্রম কেবলই? কিংবা ভয়ের স্বপ্ন?
এ ভালোবাসার ঘর? নাকি প্রেমের?
তাকিয়ে দেখি, ছড়িয়ে মেঝেতে রক্তশিলা!
জানালার কাঁচে ঝনঝনানি!
এ কি মৃত্যু, নাকি হৃদয় কাঁপে?
ঝড় উঠে যায়--বাইরে নয়কো, মনের ঘরে।
কেউ আসছে! আলো জ্বলছে! আর আমি কিনা অন্ধ!
 
যে মুক্তি কিনেছি শতকে,
কেন পরিয়ে শেকল বাঁধবো তাকে
ফের ছটাকে?
বাঁধা আর পরবো না,
বাঁধামনে সরবো না,
ঘটে যা ঘটুক!
তার ইচ্ছেগুলি মানবো না আর,
যত সুর আছে, আর যত সুরা,
ভুলবো না মাখিয়ে নিষাদ!
আমি নাহয় হবো প্রজাপতি,
জীবনের দাবি ভোলাবে আমায়,
ভুলবো, তবু......ভাঙবো না ডানা ভুল করেও!
 
পাঁচ।
ঘড়ি কি তবে থেমেই গেল ঘোরের চোটে?
কত প্রহর কাটল, বলো, বলছি কথা
তোমার সাথে, এই জারুলতলায়।
দেখেছি, চাঁদ হামাগুড়িয়ে দিচ্ছে উঁকি গাছের ফাঁকে,
আমাদের চোখে মাতাল হাওয়ায় বইছে নেশা......
দেখেছি সবই, তোমার খোঁপার আলতো মায়ায়।
ভোর হয়ে যায়, তবু রাত কাটে না
তোমার ডোরে।
এসো, তবে লাগাই জোড়া ফুলদানিটা,
যা ভেঙেছে শুধুই বেখেয়ালের অহংকারে!
তোমাকে ভুলে ভুলেছি আমায়,
তুমিও কি ভুলনি তোমায় অমন করে?
আমাকে আমি চিনেছি যখন চিনেছি তোমায়,
তোমায় ছেড়ে আমায় নিয়ে থাকবো আমি,
অমন সাহস হল-বা আমার কেমন করে?
তুমি হন্যে খুঁজছ তোমায়--খবর পেতেই
এলাম ছুটে তোমার ঘরে!