হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে

এক।
যাকে ভালো লাগে, যার সাথে থেকে যেতে মন চায়, সে কোনওমতেই ভুল মানুষ-টানুষ কিছু না। ওসব সমাজের বানানো কথাবার্তা। আমাদের একমাত্র ভুল হচ্ছে, সমাজকেই ঈশ্বর বলে মনে করা। এটাকে আমরা একধরনের অসহায়ত্বও বলতে পারি, কেননা আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই এর বাইরে করার তেমন কিছুই থাকে না। পরিবার থেকেও আমরা ওরকম ধারণা ও শিক্ষাই পেতে থাকি। সমাজ যা ভাবে, বাবা-মা তা-ই মনে ভাবেন, আর আমাদেরকেও তা-ই ভাবতে বাধ্য করেন, সেজন্য সত্যিকারের ঈশ্বরের দেখা পাই-ই না বলতে গেলে...আমরা কেউই।
যারা যারাই সমাজের নিয়মের বাইরে গেছে, তাদেরকেই আমরা বয়কট করে এসেছি। আমাদের চোখের সামনে এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণটি হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে আমাদের তো এখনও আগ্রহের শেষ নেই। অথচ, আমার ব্যক্তিগত ভাবনা হচ্ছে, (ভুল হতেই পারে) তিনি শেষের দিকে কিছু ‘হাবিজাবি’ লিখেছেন হয়তো; (মানে তাঁর লেখার ক্ষমতা তো আরও অনেক অনেক অনেক ভালো ছিল) হ্যাঁ, ঠিক আছে, যার কারণে তাঁকে ‘বাজারি লেখক’ বলা হয়েছে অনেকসময়ই।
কিন্তু একটু ভাবুন তো, শাওনকে বিয়ে না করলে, হুমায়ূন আহমেদ হয়তো আরও আগেই একাকিত্বের কাছে হার মেনে নিতেন, ফলে ২০০৩-এর পরে তিনি যা যা লিখেছেন, তার অনেক কিছুই আমরা পেতামই না। মানুষটাই ঠিকভাবে বেঁচে থাকতেন কি না আদৌ, তা-ও কিন্তু ভেবে দেখবার বিষয়! আমরা তো সমালোচনা করেই খালাস, একজন ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের হৃদয়মনের সুস্থতার খোঁজখবর আমরা কে-ইবা কখন রেখেছি বা জেনেছি? আমরা কারও মনকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিতে পারি না, অথচ কেউ তার মনটাকে ভালো রাখার জন্য যা-ই করুক, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করার দায়িত্বটা ঠিকই নিতে পারি!
শাওন নিজেও বোধহয় ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিলেন, নয়তো তাঁর নিজেরই তো অর্জনের শেষ নেই, নামি দামি কারুর স্ত্রী হবার তো দরকারও নেই তাঁর! হ্যাঁ, বলতে চাইছি, শাওন হুমায়ূন আহমেদকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলেন, তাই একাকিত্বের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তাঁকে। এ নিয়ে ভিন্ন মতও আছে অবশ্য। বলে রাখা ভালো, বিবাহিত মানুষ মানেই একাকিত্বের হাত থেকে মুক্ত মানুষ---এরকম অদ্ভুত রকমের ভুল ধারণা আপনার মধ্যে থাকলে তা থেকে সরে আসুন, যদি আপনি মানসিকভাবে পরিপক্ব হয়ে থাকেন।
এমনও হতে পারে, লেখার ক্ষমতাকে বাঁচাতে, মানে নিজেকেই বাঁচাতে হুমায়ূন আহমেদ শাওনের হাত ধরেন। হুমায়ূন আহমেদ চাইলে শাওনের সাথে গোপনে লিভইন কিংবা পরকীয়া, যে-কোনও কিছুই করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। প্রকাশ্যেই দ্বিতীয় বিয়েটা করেছেন। এর কারণটা হচ্ছে, তিনি হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর লেভেলে উঠতে গেলে সমাজকে ঈশ্বর মানা যাবে না যাবে না যাবেই না! এই পৃথিবীতে কখনওই কোনও জিনিয়াসকে তাঁর সময়কার সমাজ চিনতে পারেনি। সমাজ গোপন ব্যভিচারও মেনে নেয়, কিন্তু প্রকাশ্য ভালোবাসা মানতেই পারে না! আহা, দ্য হাইট অব হিপোক্রিসি অব দ্য সোসাইটি!
যারা সমাজকে ঈশ্বর বলে মুখে মুখে মানে, তাদের অনেকেই মনে মনে হুমায়ূন আহমেদের লেখা আর শাওনকে বিয়ে করার সাহসের জন্য তাঁকে অনেক বড়ো মাপের একজন মানুষ বলেই মানে, কিন্তু এটা মুখে স্বীকার করে না ‘সমাজের ভয়ে’। তাঁর মতন একজন অসামান্য লেখক এত বড়ো একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে গেছেন, তবুও আমরা বরাবরই উলটোটাই বুঝি!
জিনিয়াসদের তাঁদের নিজস্ব ব্যাকরণে ভালো থাকতে দিতে হবে। এর অন্যথায় ঘটলে পৃথিবীর ইতিহাস কয়েকটি উজ্জ্বল অনুচ্ছেদ থেকে নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত হয়। আমাদের চিন্তাভাবনা ওঁদের সাথে মিলবে না, এবং এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। সমাজের ব্যাকরণ মানেই কিন্তু সাধারণত্বের ব্যাকরণ, একজন জিনিয়াসের ব্যাকরণ নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়---ব্যাকরণহীনতাই জিনিয়াসদের একমাত্র ব্যাকরণ!


দুই।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর শাওনকে নিয়ে প্রচুর টানাহ্যাঁচড়া হয়েছে। প্রচুর মানে প্রচুর! বিশ্রীভাবেই! অনেকেই অনেক ধরনের মন্তব্য করেছে, তবে গুলতেকিনকে প্রকাশ্যে শাওনকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনায় যেতে বা খারাপ মন্তব্য করতে শুনিনি। তবে অতিকৌতূহলী মানুষেরা অনেক আজেবাজে কথা বলে গেছে বরাবরই, যেগুলির বেশিরভাগই অনুমাননির্ভর।
হুমায়ূন আহমেদ যখন শাওনকে অ্যাপ্রোচ করেন, তখন শাওন এসএসসিও পাস করেনি। তিনি যেভাবে অ্যাপ্রোচ করেছিলেন, ওরকম স্টাইলে ওই বয়সে একজন হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেলে যে-কোনও মেয়েই ভালোবাসতে বাধ্য। আর সেখানে শাওন তো তখন বাচ্চা মেয়ে!
তবে গুলতেকিনকেও হুমায়ূন আহমেদ ভালোবাসতেন। একজন মানুষ একইসাথে একাধিক মানুষকে ভালোবাসতে পারে---মানবমনস্তত্ত্বের একজন নিবিড় পাঠক ও পর্যবেক্ষক হিসেবে এটাই আমার রায়। গুলতেকিন তাঁর লেখার অন্যতম ভালো পাঠক ছিলেন। মূলত লেখার কারণেই ওঁদের যোগাযোগটা। হুমায়ূন আহমেদের লেখার পেছনে গুলতেকিনের অনেক বড়ো ভূমিকা ছিল। শাওনের সাথে যেটা হয়েছে, সেটাও খুবই অন্যরকম একটা ব্যাপার। শাওনকে হুমায়ূন আহমেদ কতটা ভালো রকমের বুঝেছেন, সেটা তাঁর অনেক লেখা পড়লে বোঝা যায়। শাওনও বোধহয় নিজেকে এভাবে বোঝেননি, যেভাবে হুমায়ূন আহমেদ বুঝেছিলেন।
শাওন অসম্ভব গুণী একজন মানুষ। হুমায়ূন আহমেদকে তাঁর মতো করে থাকতে দিয়েছিলেন। লেখক-স্বামীকে বোঝার চেষ্টা করতেন। একজন লেখককে তাঁর মতো করে থাকতে দিতে হয়, যা লেখকের স্ত্রীরা তেমন একটা বোঝেনই না। এর অন্যথায় করার মানেই হচ্ছে একজন প্রতিভাবান মানুষের প্রতিভাকে খুন করে ফেলা। এটা অনেক বড়ো একটা পাপ। হুমায়ূন আহমদের ভেতরের জগতটার পরিচর্যা করতে গিয়ে শাওন সব রকমের আত্মত্যাগ স্বীকার করে গেছেন হাসিমুখেই। এ ছাড়াও অদ্ভুত কিছু ব্যাপার আছে শাওনের মধ্যে, যা আমাদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে চমৎকার কিছু ভাবনার জন্ম দেয়।
ওদিকে গুলতেকিন ছিলেন প্রচণ্ড অভিমানী একজন মানুষ। হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পরেও তিনি তাঁকে দেখতে আসতে পারেননি। এতটা অভিমান, প্রচণ্ড আঘাত না পেলে কারও মধ্যে জন্ম নেয় না। তবে শাওন যখন হুমায়ূন আহমেদের জীবনে আসেন, তখন তিনি একাই ছিলেন, গুলতেকিনের সাথে ছিলেন না। অফিশিয়ালি সেপারেটেড না হলেও তাঁরা আলাদা থাকতেন। হ্যাঁ, হুমায়ূন আহমেদ চার বছর একা একা জীবন কাটিয়েছেন সেইসময়, শাওনকে বিয়ে করার আগে।
হুমায়ূন আহমেদ দারুণ ভালো একজন বাবা। তাঁর সব ছেলেমেয়েই তাঁকে ভীষণ ভালোবাসে। মানে পুরো ব্যাপারটাই একটা জটিল অঙ্কের মতো। না জেনে এটা নিয়ে মন্তব্য করাটা নির্বুদ্ধিতা হবে। অথচ মানুষ কত সহজেই কিছু না জেনে অনেক সরলীকৃত কথা বলে ফেলে! জিনিয়াসদের পেছনে লেগে পার পেয়ে যাওয়াটা সোজা, কেননা ওঁদের তো সময় বা মানসিকতাই নেই কারও পেছনে লাগার!
মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত একটা অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ শাওনের হাতটা ধরতে চেয়েছিলেন। সে ঘটনাটা বড়ো অদ্ভুত। এত অদ্ভুত রকমের সুন্দর করেও একজন মানুষকে পাশে চাইতে পারে কেউ---এটা হুমায়ূন আহমেদই জানতেন। তাঁকে ভালো না বেসে থাকাটা অসম্ভব।
আমার এক কাজিনের হাজব্যান্ড হুমায়ূন আহমেদকে পছন্দ করেন না কোনও একটা বিচিত্র কারণে। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর যখন আমার কাজিন পাগলের মতো কাঁদছিল, তখন দুলাভাই আমার আপুকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই দেখো, তোমার নির্বোধ অপদার্থ বোনের কাণ্ড! হুমায়ূন আহমেদের মতো একটা লোকের জন্যও নাকি মানুষ এভাবে কাঁদে! শাওনের মতো আরেক পিস বেকুবকে দেখো!’ তখন আমার আপু ভীষণ রকমের রেগে গিয়ে চিৎকার করে করে বলেছিল, ‘তোমার চাকরি দেখে বাসা থেকে আমাকে জোর করে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছে, নাহলে তোমার মতন একটা অরডিনারি লোককে আমি কখনওই বিয়ে করতাম না। এক চাকরি বাদে বলার মতো আর কোনও গুণ বা অর্জন আছে তোমার? এ জীবনে যদি হুমায়ূন আহমেদের অষ্টম স্ত্রী হবারও সুযোগ আসত কখনও, তবে তোমার মতো একটা লোকের ঘর ছেড়ে দিতে আমি দ্বিতীয় বার ভাবতাম না।’ দুলাভাই রাগে দুঃখে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন আপুর কথা শুনে। আমি আপুকে সেদিন বলেছিলাম, ‘দুলাভাই ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, সাহিত্য পড়েনও না, বোঝেনও না। তিনি কী করে হুমায়ূন আহমেদকে বুঝবেন, বল? দুলাভাই মেধাবী হতে পারেন, কিন্তু জিনিয়াস কিসিমের কেউ তো না। তুই কেন আশা করছিস যে একজন সাধারণ মানুষ, যিনি হুমায়ূন আহমেদের লেখাই পড়েননি কখনও, তিনিও তাঁকে বুঝবেন? আর এমনিতেও সুপ্রতিষ্ঠিত পুরুষমানুষ মাত্রই জিনিয়াস গোছের কাউকে সহ্য করতে পারে না সাধারণত। মন খারাপ করিস না, বাদ দে।’
গুলতেকিন পরে সেটল করেছেন অন্য একজন মানুষের সাথে, যতদূর জানি। তিনি ভালো আছেন। তাঁর এই ভালোথাকা দেখে আমাদের বড়ো ভালো লাগে। আমরা চাই, সবাই নিজের মতো করে ভালো থাকুক, ভালো থাকার সাহসটা দেখাক। সমাজ কাউকে ভালো রাখবে না, ওই ক্ষমতাই সমাজের নেই। কার মনে কী যে চলছে, এক সে নিজে বাদে আর কেউ তা জানে না, এমনকি প্রায় সময়ই, অনুমান পর্যন্ত করতে পারে না। অথচ প্রায় সবাই-ই অন্যকে জাজ করতে মহাওস্তাদ!
আমার কাছে ব্যাপারটি প্রচণ্ড জটিল লাগে…হুমায়ূন আহমেদ আর গুলতেকিন, কিংবা হুমায়ূন আহমেদ আর শাওন। আলাদা আলাদাভাবে ভীষণ ভালো দুটো সম্পর্ক। কিন্তু যখনই ব্যাপারটি ত্রিকোণ হয়েছে বা মানুষগুলোকে একটি সুতোয় নিয়ে আসতে হয়েছে, তখনই জটিলতা এসে উপস্থিত হয়েছে। কাজটি তাঁদের চাইতে বেশি করেছি আমরা। এর কোনও দরকার আদৌ কি আছে?
আমি গুলতেকিনকে কখনও শাওনকে নিয়ে কারও সামনে অসম্মান করে কথা বলতে শুনিনি। খুব স্মার্টলি এড়িয়ে গেছেন সবসময়ই। এড়াতে পারি না আমরা সাধারণ মানুষেরা, কাউকে জাজ করার লোভটা সামলাতে পারি না বলে। অন্যের পারসোনাল ব্যাপার নিয়ে মাথা না ঘামানোর মতো স্মার্টনেসটা অরডিনারি লোকজনের মধ্যে থাকে না। কাউকে ভালো থাকতে দেখলেও আমাদের অস্বস্তি লাগে, কাউকে খারাপ থাকতে দেখলেও আমাদের অস্বস্তি লাগে। আসলে কে যে ভালো আছে, আর কে যে ভালো নেই---আমরা তা ঠিক করে আদৌ জানিই না! ব্যাপারগুলি কিউট না?