হৃদয় আরও একটু খুঁড়ে

১। দুঃসময় নিজেকে ও অন্যকে চিনতে শেখায়। আপনি যখন অনেক বড়ো কোনও বিপদে পড়বেন, তখন আপনার যে আচরণ, প্রকৃতপক্ষে ওটাই আপনি। তখন আশেপাশের মানুষের যে চেহারাটি দেখবেন, সারাজীবনই মনে রাখুন, ওদের প্রকৃত চেহারা ওটাই। বিপদ কেটে যাবার পর আপনার নিজের এবং অন্যদের ওইসময়ের রূপটি (পারসোনা) ভুলেও ভুলে যাবেন না। নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনি যখন আবার বিপদে পড়বেন, তখন ওরা আবারও ওই চেহারায় ফিরে আসবে। সবার সাথে হ্যান্ডশেকটা করার কোনও দরকার নেই, কাউকে কাউকে দূর থেকেই হাই বলে বিদেয় করতে হয়।


২। বিপদে পড়লে ভয় পাওয়ার অভিনয় করুন, এতে কিছু মানুষ খুশি হবেন। তবে মনে সাহসটা ধরে রাখুন, এতে ওই মানুষগুলি যতটা ক্ষতি করার, ততটা ক্ষতি আর করতে পারবে না। মাথায় রাখুন, আপনি যত ভয় পাবেন, ততই আপনার আশেপাশের লোকজন আপনার মাথায় চড়ে বসবে। আপনার পায়ের জুতা হবার যোগ্যতাও নেই যার, সেও আপনাকে লাথি মারতে আসবে যদি আপনি দুর্বল হয়ে তার সামনে ধরা দেন। বেশিরভাগ মানুষই দুর্বলকে আঘাত করতে মজা পায়। বিপদের সময় আমরা পরিস্থিতিকে যতটা ভয়াবহ আকারে দেখি, প্রকৃত পরিস্থিতি আসলে ততটা ভয়াবহ নয়। বিপদের বাড়াবাড়িটা মাথায়ই ঘটে।


৩। জীবনে বাঁচতে হলে দুটো জিনিস সবচাইতে জরুরি: এক, কাউকে ভালোবাসতে পারা, তার কাছ থেকে ভালোবাসা না পেলেও। দুই, সেই ভালোবাসা যেন নিজের শান্তি নষ্ট করে না দেয়, সেটার দিকে খেয়াল রাখা। দিনের শেষে, ভালোবাসা অনুভব করার চাইতে শান্তি অনুভব করাটা বেশি জরুরি। আমার কাছে, কার‌ও দেওয়া ভালোবাসার দাম আমার হিসুর দামের চাইতেও কম, যদি সে ভালোবাসায় অশান্তি থাকে। আবার, কারও দেওয়া শান্তির দাম আমার জীবনের দামের চাইতেও বেশি, যদিও সেই শান্তিতে ভালোবাসা না-ও থাকে। তাই যদি কখনও মনে হয়, নিজের ভালোবাসার বিনিময়ে তারও ভালোবাসা পেলে নিজের কিছু শান্তি বিনষ্ট হবে, সেক্ষেত্রে নিজে নিজে ভালোবেসে যাওয়াই শ্রেয়। কাউকে ভালোবাসতে পারার মধ্যে অসীম শক্তি লুকিয়ে আছে।


৪। আপনি যখন আপনার ভালোবাসার কোনও একটা কাজে দিন-রাত মগ্ন হয়ে থাকেন, তখন সেটাকে দেখতে অনেকটা পাগলামির মতোই মনে হয়। সত্যিই এটা পাগলামি, কেননা অন্য দশজনের কাছে যা-কিছু অপরিচিত, তা-ই পাগলামি হিসেবে পরিচিত। একটু ভাবুন, যদি ওটা ওদের চোখে পাগলামি মনে না হতো, অর্থাৎ স্বাভাবিক কিছু বলেই মনে হতো, তবে তো সে কাজটা আপনাকে আলাদা করে পরিচিত করাতে পারত না। সহজ করে বলি। লোকে যত আপনাকে পাগল বলবে, আপনি তত বেশি আপনার কাজটাতে ডুবে যান। দেখবেন, ওরাই একদিন এই পাগলটার অটোগ্রাফ নেবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে!


৫। আপনার সামনে দুটো পথ খোলা: হয় আপনি বাজে লোকদের সাথে জয়েন করে বাজে কাজ করার আনন্দটা উপভোগ করবেন। নয় আপনি ওই পপুলার ট্রেন্ডের বাইরে থেকে নিজের বিবেককে জাগ্রত করার চেষ্টা করে যাবেন। দ্বিতীয় পথটি কঠিন ও একাকী। যদি আপনি পাঁচ মিনিটের জন্য রাজা হতে চান, তবে প্রথম রাস্তায় হাঁটুন। যদি আপনি পাঁচ যুগের জন্য রাজা হতে চান, তবে দ্বিতীয় রাস্তায় হাঁটুন। মাথায় রাখবেন, এই পৃথিবীর প্রায় মানুষই প্রথম পথের পথিক, ফলে দিনের শেষে, ওরা বাজে লোক হিসেবেই বেঁচে থাকে। দ্বিতীয় পথের পথিকরা নিজেদের এতটাই দূরে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে পৌঁছানোর স্বপ্নও প্রথম পথের পথিকরা দেখতে পর্যন্ত পারে না। যে যত কিছুই বলুক না কেন, একটা ফালতু লোক দিনের শেষে ফালতুই।


৬। হাতি কাদায় পড়লে মশাও লাথি মারে। হ্যাঁ, মশার সারাজীবনের সাফল্য বলতে ওই ওইটুকুই। লক্ষ মশা মিলেও একটা হাতির সমান হতে পারে না; দিনের শেষে, হাতি হাতিই আর মশা মশাই। এই ব্যাপারটা হাতি ও মশা দুজনেই জানে। বড়ো মানুষ যখন বিপদে পড়ে, তখন তার পেছনে লাগে যারা, একদম নিশ্চিত থাকতে পারেন, তারা এমন কিছু মানুষ, যারা সবাই মিলেও ওই বড়ো মানুষটির পায়ের নখের সমান যোগ্যতাও রাখে না। বিপদ থেকে বেরিয়ে যাবার পর সেই বড়ো মানুষটি আরও বড়ো হবেন, আর ওই ছোটোলোকগুলি অন্য কার পেছনে লাগা যায়, তা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। সেদিন একটা ভিডিও দেখছিলাম। কিছু বানর গাছ থেকে ঝুলে ঝুলে দুইটা বাঘের লেজ, কান ধরে টেনে টেনে, গালে চড় মেরে মেরে পালিয়ে যাচ্ছে। আহা, কত সুখেই না আছে ওই বানরগুলি! অথচ সামনে এসে বাঘের সাথে যুদ্ধ করার স্পর্ধাও ওদের কখনওই হবে না। কেন, জানেন? যত যা-ই কিছুই হোক না কেন, বাঘ বাঘই, আর বানর বানরই। বাঘের জন্মই হয়েছে বাঘ হয়ে মরার জন্য, আর বানরের জন্মই হয়েছে বানর হয়ে মরার জন্য। একে নিয়তি বলে। নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার পেছনে যারা লাগে, তাদের কেউই আপনার সমকক্ষ কিংবা আপনার উপরে নন, তাদের সবাই-ই আপনার চাইতে অনেক পিছিয়ে। মজার ব্যাপার, তারা কোনও দিনই আপনার চাইতে এগিয়ে যাওয়া দূরে থাক, আপনার সমকক্ষই হতে পারবে না। বিশ্বাস না হলে আশেপাশে তাকান, মিলিয়ে নিন।


৭। কেউ শিশুদের ভালোবাসে কি না, তা বুঝতে হলে সে তার নিজের সন্তানকে আদর করে কি করে না, তা দেখে লাভ নাই। দেখতে হবে, সে অন্যদের সন্তানকে কতটা বুকে টেনে নেয়। ঠিক একইভাবে, একজন মানুষ কতটা মানবিক, তা বুঝতে দেখুন তাদের প্রতি তার আচরণ কেমন, যাদের কাছ থেকে তার পাওয়ার কিছুই নেই। আরেকটি ব্যাপার। যে লোক পাপ পুণ্যের হিসেব করে মানবতা দেখায়, তার চাইতে, যে লোক কোনও কিছুরই হিসেব না করে মানবতা দেখায় স্রেফ অভ্যাস বা স্বভাবের কারণে, সে অনেক বেশিই মানবিক।


৮। যখন একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা রাজনীতি ও ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন সে দেশটি পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। শিক্ষা যদি রাজনীতি ও ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে, তবে সাধারণত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে দেশটি পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির দেশগুলির তালিকায় ঢুকে পড়ে খুব সহজেই। এর উলটোটা ঘটলেই শুরু হয় যাবতীয় বিপত্তি। আরেকটি কথা। যে দেশের নাগরিকরা নিজের পরিচয় দেবার সময় সে দেশের নয়, বরং ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পরিচয়টিই প্রথমে ব্যবহার করে, সে দেশের পক্ষে সভ্য হওয়া খুব কঠিন।


৯। পৃথিবীর সর্বজনীন ভাষা দুটো: হৃদয়ের ভাষা ও অর্থের ভাষা। হৃদয়ের ভাষা বোঝানো সময়- ও শ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার, তার চাইতে বরং অর্থের ভাষা বোঝানোটা অনেক সহজ। আপনি যখন এমন কোনও দেশে বেড়াতে যাবেন, যে দেশের লোকের ভাষা আপনি বোঝেন না, আপনার ভাষাও ওরা বোঝে না, তখন যদি আপনার পকেটটা ভারী থাকে, তবে দেখবেন, আপনি কিছু কিনতে গেলে ওরাই আফসোস করবে ও অপরাধবোধে ভুগবে যে কেন ওরা আপনার ভাষাটা জানে না! এ কারণেই আমাদের দেশে এসে ইংরেজরা একসময় বাংলা শিখেছিল। হ্যাঁ, নিজেদের প্রয়োজনেই, বাংলাকে ভালোবেসে নয়। আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলি। আমি দিল্লিতে টাইটান ঘড়ির শোরুমে গিয়েছিলাম। সেখানে ওইসময়ে এক ভদ্রলোক ঢুকেছিলেন যিনি ইংরেজি ও হিন্দি কোনওটাই জানেন না, কেবলই আঞ্চলিক (কোন অঞ্চলের, সেটা না বলি) বাংলায় কথা বলতে জানেন। তো উনি ঘড়ি নিয়েছিলেন মোট ৩৮টা। এবং, পুরোটা সময়ই বিশুদ্ধ আঞ্চলিক বাংলায় (ইংরেজি বা হিন্দি বিবর্জিত) কথা বলেছেন। টাইটান-এর বিক্রয়কর্মীদের সেই ভদ্রলোকের কথা বুঝতে তেমন সমস্যা হয়নি, কেননা ওঁর ক্রেডিট কার্ডের ভাষা ছিল যে-কোনও ভাষার চাইতে শক্তিশালী। তবে এখানে একটা কথা আছে। অর্থের ভাষা যেমন নগদ ও ফলপ্রসূ, তেমনি অর্থের ভাষার ভুল ব্যাখ্যাও নগদ ও ফলপ্রসূ। অর্থের সুগন্ধ নেবার সময় তাই অর্থের দুর্গন্ধটাও নেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।


১০। যখন আমরা অসীম আনন্দের মধ্য দিয়ে যাই ও যেতেই থাকি, তখন কখনও কখনও থেমে গিয়ে দেখতে হয়, যা নিয়ে আনন্দে মেতে আছি, তা আসলেই কতটা মঙ্গল বয়ে আনবে। হ্যাঁ, সুখের মধ্যে থাকার সময়ও থেমে থেমে ভাবতে হবে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে। যদি আমরা তা করি, তবে দেখা যাবে আজকের আনন্দ পরে একসময় আমাদের এমন একটা যন্ত্রণার মধ্যে নিয়ে ফেলে দিয়েছে, যেখান থেকে বের হয়ে আসাই অনেক কঠিন। যা-কিছু সুখের, তা-কিছু মঙ্গলজনক না-ও হতে পারে। যদি এমন হয়, অন্য কাউকে দুঃখে রাখার মাধ্যমেই আমার আজকের সুখ, তবে এ বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারি যে একদিন এমন এক দুঃখের সময় এসে উপস্থিত হবে, যা আমাকে তো বটেই, আমার পরবর্তী প্রজন্মকেও ভোগ করতে হবে। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয়।


১১। পৃথিবীর সবচাইতে কুৎসিত মানুষটিকেও কেউ-না-কেউ ভালোবাসে। তাই আপনাকে কে ভালোবাসল না, তা না দেখে খুঁজতে থাকুন, আপনাকে কে ভালোবাসে। যে ভালোবাসে, তার প্রতি ভীষণ দয়ালু হোন, এতটাই যে, যে ভালোবাসে না, সে যেন দেখে আফসোস করে এই ভেবে যে কেন সে আপনাকে ভালোবাসে না! আপনার অনেক জঘন্য দিক থাকতেই পারে, তবে খেয়াল রাখবেন যাতে সেগুলি আপনার এবং যে আপনাকে ভালোবাসে, তার উপর প্রত্যক্ষ কোনও প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে। মানুষের মধ্যে অন্ধকার দিক থাকবেই, এটা দোষের কিছু নয়। সমস্যাটা তখনই হয়, যখন সে অন্ধকার দিক মানুষকে পরিচালনা করতে থাকে।


১২। আমরা যাকে একবার ভালোবাসি, সে কখনওই আমাদের ছেড়ে যেতে পারে না। তার স্মৃতি, তার চোখ, তার কণ্ঠ, তার হাসি, তার অনুভূতি সবকিছুই আমরা আজীবন বয়ে বেড়াই। কাউকে ভালোবাসার অর্থই হচ্ছে, নিজের হৃদয়ে তাকে আজীবনের জন্য রেখে দেওয়া। সেখান থেকে তাকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। যদি মুছে ফেলা যায়, তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, তার সাথে পরিচয়টা সম্পর্ক ছিল মাত্র, ভালোবাসা নয়। মজার ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমরা কাউকে সত্যিই ভালোবাসি কি না, তা আমরা বুঝতে পারি সে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাবার পর। সে আমাদের সাথে থাকার সময় তাকে আমরা যে কতটা ভালোবাসি, তা অনুমান পর্যন্ত করতে পারি না। লালনের গান মনে পড়ছে: সময় গেলে সাধন হবে না…অবিশ্বাস্য রকমের সত্য একটি লাইন!!


১৩। যা-ই কিছুই ঘটুক না কেন, আপনি ভুল করেন বা ঠিক করেন, আপনি নিরপরাধ কিংবা অপরাধী, আপনি নিঃস্ব বা ধনী, আপনি নিরাপদ বা বিপন্ন---আপনাকে আপনার মতো করে মেনে নিয়ে নিঃশর্তে, নিঃস্বার্থে আপনার পাশে থেকে যায় যে কিংবা যারা, সে কিংবা তারাই আপনার পরিবার। এখানে রক্তের সম্পর্ক, দায়ের সম্পর্ক, অভ্যস্ততার সম্পর্ক এসবের কোনও মূল্য নেই। যে আপনাকে জাজ করার পর আপনার পাশে থাকার কিংবা না থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, সে আপনার আপনজন কোনওভাবেই নয়। আপনি যেমনই হোন না কেন, মানুষটা আপনি বলেই আপনার পাশে থাকবেই, এমন দৃঢ় মানসিক গঠন যার, একমাত্র সে-ই আপনার আপনজন।


১৪। আপনি উদ্ভট ও অদ্ভুত, কিন্তু ওরকম হয়ে থেকেই কারও কোনও ক্ষতি না করে আপনি ভালো আছেন, সুখে আছেন---এক্ষেত্রে আমি বলব, আপনি ঠিক পথেই আছেন। আপনি যার চোখে উদ্ভট, সে আপনাকে সুখে রাখতে পারবে না যেহেতু, তার কথায় নিজেকে পরিবর্তন করে নিজের সুখ নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না। আরে ভাই, অনন্য হোন! অন্য অনেক লোকের কপি-পেস্ট ভার্সন তো অনেকেই আছে, রীতিমতো রাস্তাঘাটে পাওয়া যায়,…ওদের কারও মতো না হয়ে বরং আপনার নিজের মতোই হোন। নিজের পাগলামিটাকে উদ্‌যাপন করুন। হোক কিছু সময় নষ্ট, হোক কিছু অর্থের অপচয়। কোনও ব্যাপার না! আপনি কালকেই যদি মারা যান, তবে আপনার সঙ্গী হবে সুখে থাকতে না পারার আফসোস---বেঁচেযাওয়া সময় কিংবা অর্থ নয়।


১৫। খাঁচার মধ্যে যে পাখিটিকে আটকে রেখেছেন, ওকে নিয়ে, মানে ওই খাঁচাটি নিয়ে আপনি বিশ্বভ্রমণ করে ফেললেও ও কিছুতেই সে আনন্দটি পাবে না, যে আনন্দটি সে পেত মুক্তভাবে স্রেফ এক গাছ থেকে কাছেরই আর-এক গাছে উড়ে গিয়ে বসলে। একইভাবে পৃথিবীর সবচাইতে দামি দামি জিনিসের মধ্যে ডুবে থাকলেও আপনি শান্তিতে থাকবেন না, যদি আপনার মন যা চায়, তা না পায়। আমি এক বেড়ালের কথা জানি, যাকে ওর মালিক তার বন্ধুর ঘরে রেখে দিয়ে এসেছিল যে বন্ধুটি ছিল অনেক ধনী ও বেড়ালপ্রেমিক। বেড়ালটি নতুন ঘরে কাঁদতে কাঁদতেই মারা গিয়েছিল। নতুন মালিক বেড়ালটিকে ভালোবাসলেও বেড়ালটি তো পুরনো মালিককেই খুঁজে বেড়াত। ফলে সে আর বাঁচতেই পারল না, পুরনো মানুষটির বিরহে মরেই গেল। আমাকে কেউ ভালোবাসছে, বেঁচে থাকার জন্য এর চাইতে জরুরি হলো, আমি তাকে ভালোবাসছি কি না, সেটা। বিত্ত কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না, মানুষ বাঁচে মূলত চিত্তের ঐশ্বর্যে।


১৬। হাজার বই পড়েও কোনও কাজ হবে না, যদি আমাদের ভেতরটা না জাগে। বই আমাদের উপর তার সমস্ত প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ, যদি আমরা নিজেরা নিজেদের হৃদয়ের সাথে যোগাযোগটা করতে না পারি। মানুষের জীবন থেকে যা শেখা যায়, তার কণামাত্রও বই পড়ে শেখা যায় না। বই আমাদের মনটাকে পরিশোধিত করতে পারে, জীবনের নানান শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করতে পারে। কিন্তু শিখতে হয় নিজেকেই। অনেক পড়াশোনা করেও যদি পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখে আসতে না পারি, তবে নম্বর কিন্তু শূন্যই আসবে। শুধু জানাই বড়ো কথা নয়, যা জানি তা কাজে লাগানোই বড়ো কথা।


১৭। কাউকে আমি সত্যিই ভালোবাসি!---এর মানে কী? এর মানে হলো, আমি তার জন্য মরে যেতেও প্রস্তুত! যদি এমন হয়, আমি কাউকে এতটাই ভালোবাসি যে ভালোবাসার জন্য আমি তাকে মেরে ফেলতেও প্রস্তুত, তবে সেটি কোনও অবস্থাতেই, কোনও যুক্তিতেই ভালোবাসা নয়। কাউকে ভালোবাসলে তাকে সামান্যতম আঘাত করতে গেলেও তো নিজের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতেই থাকে, সেখানে তাকে মেরে ফেলা কী করে সম্ভব? যাকে একবার ভালোবাসা যায়, তার বিন্দুমাত্রও কোনও ক্ষতি কখনওই করা সম্ভব নয়। যদি কেউ তা করতে পারে, তবে নিশ্চিত থাকুন, সেটি ভালোবাসা নয়, স্রেফ ফাজলামি।


১৮। মানুষ লড়াই করে দুই কারণে: ভালো কিছুর জন্য। কোনও বিশ্বাস থেকে। ভালো কিছুর জন্য যারা লড়াই করে, ওদের বিবেক যতটা জাগ্রত, বিশ্বাসের জন্য লড়াই করে যারা, ওদের বিবেক ততটা জাগ্রত নয়। তবে রহস্যময় ব্যাপার হলো, বিশ্বাসের জন্য যারা লড়াই করে, ওদের মনের শক্তি অনেক বেশি হয়, এবং ওরা প্রায়ই জয়লাভ করে। বিবেকের তাড়নায় লড়াই করে যারা, ওদের মধ্যে নানান সংশয় এসে ভর করে বিধায় প্রায়ই দেখা যায়, চূড়ান্ত জয়লাভটা ওদের আর হয় না। এই পৃথিবীতে লড়াকুদের দিকে তাকালে দেখবেন, দ্বিতীয়টি দলটিই ভারী, কেননা ওই দলে যোগ দেওয়া অনেক সহজ।


১৯। মুখ থেকে কিছু একবার বের করে ফেললে তখন সেটিই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। আমরা বিপদে পড়ে যাই আমাদের কথার জন্য, আমাদের ভাবনার জন্য নয়। অমুক কথাটা বলা আমার উচিত হয়নি,---বিশ্বাস করুন, এটা এক আপনি বাদে দুনিয়ার আর কেউ বুঝতেই চাইবে না। মনে রাখবেন, দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষই অপেক্ষা করে আছে কীভাবে আপনাকে একবার ফাঁদে ফেলা যায়! মানুষ অন্যকে বিপদে পড়তে দেখলে সুখ অনুভব করে এবং এমন আচরণ করতে থাকে, যেন সে নিজে ওই ভুলের ঊর্ধ্বে। যদিও দিনের শেষে, আমাদের মানুষের কাছেই ফিরে যেতে হয়, তবু আমরা যেন মাথায় রাখি,---মানুষের চাইতে বড়ো হারামজাদা আর কিছু হয় না।


২০। আপনি সাহসী হোন বা না হোন, চোখে মুখে বাক্যে সাহস ফুটিয়ে তুলুন। আপনি যত বেশি নিজের দুর্বল দিকটা লোকের সামনে নিয়ে আসবেন, লোকে আপনাকে তত বেশি আঘাত করতে থাকবে। অন্যকে দুর্বল দেখলে মানুষ নিজেকে সেই লোকটির চাইতে শক্তিশালী ভাবতে শুরু করে। এবং এই বিশ্বাসটাই তাকে সাহায্য করবে আপনাকে শেষ করে দিতে। ভদ্র ও বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করার মতো মানুষ খুবই কম এ সমাজে, যা হয়তো আপনি উন্নত কোনও সমাজে আশা করতে পারেন। ছোটোলোকদের সমাজে বিনয় ও ভদ্রতাকে দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হয়। প্রায়ই দেখবেন, যে আপনার পায়ের জুতার সমানও নয়, তাকে সালাম দিলে সে নিজেকে আপনার মাথার মুকুটের সমান ভেবে বসবে। কুকুরকে রাখতে হয় কুকুরের জায়গায়। ওকে বিছানায় জায়গা দিলে সে বিছানায় হিসু করে দেবে, এবং এটাই স্বাভাবিক।