হৃদয় খুঁড়ে দশ

১। সবচেয়ে কঠিন সত্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, নিজের পরিবারের এবং আত্মীয়স্বজনের কাছেই আপনার নিজেকে সবার আগে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি। কোনও একটা সুন্দরী মেয়ে, যে আসলেই সুন্দরী, সেটা সে সবার আগে জানতে পারে তার কোনও ঠোঁটকাটা গোছের বান্ধবীর মুখে, অথবা কোনও ছেলেবন্ধুর মায়ের মুখে। সে যে সুন্দরী, তাকে রোজ রোজ দেখতে দেখতে তার নিজের বাড়ির মানুষের চোখে সেটা কখনও ধরাই পড়ে না। এমনকি বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রথম-হওয়া মেয়েটিও যে সব মিলিয়ে সুন্দরী, সেটা প্রতিযোগিতায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে কখনও জানতেই পারে না!


আরও একটা উদাহরণ দিই। যেই ছেলেটা ভালো ফুটবল খেলে, খোঁজ নিয়ে দেখলে জানতে পারবেন, ওর বাসায় ওকে গোনায়ই ধরা হয় না। ওই ফুটবলের কারণে কিংবা তিনবেলা এই ফুটবল-খেলা নিয়েই তাকে নানান খোঁটা শুনতে হয়। ওর বাবা-মায়ের কাছে ওর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, তাঁরা বলবেন, ‘ওর সবই ভালো, শুধু ওই ফুটবলটাই ওর সর্বনাশের কারণ!’ এই ক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার ঘটে। এক, ছেলেটার মধ্যে যে আলাদা কিছু আছে, সেটা ধরা পড়ে একমাত্র তার ফুটবল-কোচ অথবা মেনটরের চোখে, আর সেই ছেলেই একদিন নামকরা ফুটবলার হয়ে দেখায়। দুই, কোনও কোচ কিংবা মেনটরের হাতে সে বেচারা কখনও পড়েই না!…বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যাপারটিই ঘটে। এভাবে হারিয়ে যায় একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইতিহাসের বেশিরভাগ সুপারস্টার তাঁরাই হয়েছেন, যাঁরা বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন কিংবা বাড়িতে থেকেই নিজের সাধনার প্রতি সারাজীবনই আন্তরিক হয়ে ছিলেন বাড়ির সবার সাথে যুদ্ধ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বাধ্যতা ভালো কিছু দিতে পারে না।


ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুবোধ ও সুবাধ্য কেউ কখনও, আর যা-ই হোক, গ্রেটম্যান হয়নি। এই পৃথিবীর ইতিহাস কিছু পাগলাটে মানুষের ইতিহাস।


২। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, শিল্প তাদের কাছে জীবনের কিছু অংশ মাত্র; কখনও কখনও, এমনকি সেটুকুও নয়। কিন্তু একজন শিল্পীর কাছে, শিল্পটাই জীবন, আর জীবন কাটানোর ব্যাপারটা শিল্পের কিছু অংশ মাত্র। সোজা কথায়, শিল্পীর কাছে জীবনের চেয়েও শিল্পটাই বড়। শিল্পের জন্য তিনি অনেক বড়ো বড়ো আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন। শিল্পের পেছনের নিজের সবটুকু দিতে গিয়ে অনেক আনন্দ, সুখ, আরাম থেকে নিজের বঞ্চিত করে রাখেন আজীবনই। এ কারণেই, প্রকৃত শিল্পী যাঁরা, তাঁরা সাধারণত কখনও সুখী হন না। সুখী মানুষ হচ্ছেন একজন শিল্পীসত্তাবর্জিত সাধারণ মানুষ। সুখী হতে চাইলে কখনওই একজন শিল্পীর সাথে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। যে শিল্পী নিজে সুখী এবং তাঁর সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে সুখী করতে পারেন, তিনি বেশিরভাগ সময়ই মহৎ কোনও শিল্পী নন।


৩। মানুষ মাতাল এবং আবেগপ্রবণ থাকা অবস্থায় সেই জিনিসগুলিই নির্দ্বিধায় বলে ফেলে, যেগুলি সে মন থেকে খুব করে পেতে চায়, অথচ বাস্তবে সেগুলি ছুঁয়ে দেখাও তার পক্ষে অসম্ভব। মানুষ খুব সহজেই স্বপ্নের কাছাকাছি চলে যেতে পারে বলেই ওরকম মাতাল হয় কিংবা আবেগকে প্রশ্রয় দেয়। যে মাতাল অবস্থাতেও নিজের জিভ ও হাতকে সংযত রাখতে পারে, সে আসলে মাতাল হওয়ার মজাটাই পায় না। যে মাতাল হলো, অথচ মাতলামিটাই করল না, তাকে মাতাল বলে না, হিসেবি বলে। সে হিসেব নিকেশ করে অন্যকে মাতাল করে রাখে কিছু-না-কিছু উদ্দেশ্য হাসিল করতে।


৪। আমার কোনও অহংকার নেই।---এটাও একধরনের অহংকার। যারা এমন করে বলে, ওদের সাথে মিশে দেখলে বুঝতে পারবেন, ওদের অভিমান ও ইগো অন্য অনেকের চাইতে অনেক বেশি। ওরা মনে মনে নিজেকে খুব বিনয়ী ও উন্নত মানুষ দাবি করে, যেটা বিরক্তির উদ্রেক করে। আবার আমি এ শ্রেণির মানুষের মধ্যে এমন মানুষও দেখেছি, যার মুখে ওরকম কিছু শুনলে হাসি পায়, কেননা তার অহংকার করারই কিছু নেই। যে ছেলেটা ক্লাসে পাসই করতে পারে না, এবং নতমস্তকে থাকে, সে যতটা নিরহংকার, ততোধিক অসহায়। সে যে নতমস্তকে থাকতেই বাধ্য! আবার যার কোনও অর্জনই নেই, শুধুই অহংকার আছে, সে আসলে মানুষের পর্যায়েই পড়ে না। তাকে আমরা অমানুষ কিংবা বড়োজোর উনমানুষ বলতে পারি।


৫। যারা টাকা ধার করে জামা-কাপড়, গয়না কেনে,…কাজের লোক, সুইপার কিংবা গৃহশিক্ষককে বেতন দেবার পরিবর্তে,…তারা ভিনগ্রহবাসী। এমন মানুষকেও আমি দেখেছি, অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে সেই টাকা ব্যাংকে রেখে দেয় ফিক্সড ডিপোজিট করে! আর যে ধার দেয়, সে বেচারা ঘুরতেই থাকে। কাউকে চিনতে হলে তাকে টাকা ধার দিতে হবে। বাইরে থেকে অনেককেই অনেক কিছু মনে হতে পারে, কিন্তু টাকা ধার দিলেই মানুষের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। ছোটোলোক চিনতে হয় টাকা ধার দিয়ে।


৬। বিবাহিত জীবন নষ্ট হবার অন্যতম প্রধান পরামর্শ হচ্ছে---বাচ্চা নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! এর ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, কিছু তো ঠিক হয়ই না, বরং বাচ্চাটাকে মাঝখানে রেখে দুজন মানুষ আরও দূরে সরে যায়, এবং অসুস্থ একটা সম্পর্ককে বাচ্চার মুখের দিকে চেয়ে জোর করে চালিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ওদিকে বাচ্চাটা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাকে চিনতে পারে না, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবাকে চিনতে পারে না। একসময় সে দুজনের কারও মুখের দিকেই আর তাকায় না, নিজের মতো করেই চলে। সেই চলার পথটা ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। প্রায় সময়ই, এমন সন্তান মনে মনে বাবা-মায়ের প্রতি একধরনের ঘৃণা কিংবা বিতৃষ্ণা নিয়ে বেড়ে ওঠে।


৭। কোনও মানুষ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হলে তার অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া নয়, বরং সে তার নিজের বাবা-মায়ের সাথে কীরূপ আচরণ করে, সেটা জেনে নিন। যে তার বাবা-মাকে প্রাপ্য সম্মান ও সেবা দেয় না, সে কিছুতেই ভালো মানুষ হতে পারে না। ভালো মানুষ সে-ই, যে তার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সাথে যুক্তিতে হেরে যায় এবং ভালোবাসায় জিতে যায়। বাবা-মায়ের বয়স যত বাড়ে, ততই তাঁদের কিছু ভুল আচরণের প্রতি মৌখিকভাবে চুপ করে থাকলে অনেক সমস্যার উদ্ভবই হয় না। পৃথিবীর কোনও বাবা-মা’ই নিজের সন্তানের মুখ থেকে তাচ্ছিল্য বা অবহেলা সহ্য করতে পারেন না---হোক তা যতই যৌক্তিক!


৮। যে মানুষ কোনওভাবেই কাঁদতে পারে না, সে একজন শক্ত মানুষ ঠিকই, এবং একইসাথে এটাও ঠিক যে সে একজন অসহায় মানুষ। তার বুকে কষ্ট জমতে জমতে একসময় তাকে একেবারেই ভেঙে চুরমার করে দেয়। তখন সে আর উঠে দাঁড়াতেই পারে না। কেঁদে ফেলতে পারাটা অনেক বড়ো একটা সৌভাগ্য। পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষগুলি নিজের মুখে হাসি ছড়িয়ে রাখতে ওস্তাদ! ওরা বরং অন্যদের দুঃখ দূর করতেই সারাজীবন চেষ্টা করে যায়। যারা নিজের দুঃখকে মার্কেটিং করে বেড়ায়, তারা বেশিরভাগ সময়ই অল্প দুঃখে দুঃখী মানুষ। যার দুঃখ যত গভীর, তার দুঃখের প্রকাশ তত কম।


৯। বাবা-মা বেঁচে থাকতে থাকতেই তাঁদের প্রতি ভালোবাসাটা প্রকাশ করুন। তাঁদের মৃত্যুর পর সমাধিস্থলের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করলে, আর ফেসবুকে ‘মিসিং ইউ’ জাতীয় কিছু লিখে ছবি পোস্ট করলে তখন আর হারিয়ে-যাওয়া মানুষটিকে ফিরে পাওয়া যাবে না। সে সময় যে পরিমাণ অনুশোচনা হবে, তা আপনি আজকের দিনে বসে কল্পনাও করতে পারবেন না! তখন বাকিরা আপনাকে খুব বাবা-মাভক্ত হিসেবে দেখলেও আপনার নিজের প্রতি নিজেরই অসীম ধিক্কার জন্মাবে। বাবা-মায়ের প্রতিটি কথার পালটা উত্তর যে দিচ্ছেন, যখন তাঁরা থাকবেন না, তাঁদের কণ্ঠস্বরটা শোনার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে থাকবে, কিন্তু কিছুই করার থাকবে না, সেদিন আজকের দিনের আচরণগুলির কথা মনে করে ভীষণ কান্না পাবে। নিজের কিছু ক্ষতি করে হলেও তাঁদের প্রায় সব কথাকেই মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন। ভালোবাসা কখনওই ফেইসবুকে থাকে না, সব সময়ই ফেইসবুকের বাইরে থাকে। সত্যি বলতে কী, ফেইসবুকে আসলে তেমন কিছুই থাকে না, যা-কিছু জীবনের জন্য সত্যি সত্যি দামি।


১০। একজন আবেগপ্রবণ মানুষ হয় আবেগে ভাসতে ভাসতে একসময় চিরতরে ভেসেই যায়, অথবা আবেগের মতন বিশাল শক্তিকে কাজে লাগিয়েই তড়তড় করে উপরে উঠে যায়। যার আবেগ যত কম, জীবন থেকে তার অর্জনের পরিমাণও তত কম। নিজের আবেগ যাকে হারিয়ে দিতে পারে না, তাকে হারিয়ে দেয়, পৃথিবীতে এমন কোনও শক্তি নেই। আবেগ যে মানুষকে ভাঙতে পারেনি, তাকে ভাঙতে পারে, এমন কিছু আর নেই। মানুষ তার আবেগ থেকে যে শক্তি অর্জন করে, সেই শক্তি দিয়ে সে এমন কিছু করে ফেলতে পারে, এমন দূরত্ব পাড়ি দিয়ে দিতে পারে, তাকে নিয়ে যতদূর স্বপ্ন হয়তো তার নিজের বাবা-মা’ও কখনও দেখেননি।