অনুষঙ্গে অনুরক্তি: এক

 তুমি আমার আমি’টাকে জাগিয়েছ, প্রিয়,
আমার সত্তার পুরোটা জুড়ে তোমারই বিহান!
যেমনি করে হৃদয় দোলায় বন্ধু আমার,
তেমনি করে তোমায় আমি করেছি গ্রহণ সঁপে মনপ্রাণ।
আমি যা বলি, তা কেবলই তোমার কথা,
যখনই আমি বলি না কিছুই, মনকথায় বাড়াই মায়া তোমারই জন্য।
 
ভালোবাসায়, দুই হৃদয়ের মাঝখানেতে থাকে না কিছুই,
কামনা থেকেই কথা ওঠে ফুটে ফুলের মতন,
প্রেমে পড়ে যে, সে-ই তো জানে, পড়তে প্রেমে কেমন লাগে!
প্রেম এমন কিছু যার হয় না ভাষ্য, যাতে কোনো যুক্তি চলে না।
যে হৃদয় খুলে বলতে পারে প্রেমটা তাকে কেমন বাঁধে, সে কেবলই মিথ্যে বলে।
যা হৃদয়ে থাকলে পরে মাথায় আর থাকে না কিছুই,
তবু তারই মধ্যে বাঁচছ তুমি,
তুমিই বলো, তার আবার ভাষ্য কীসের?
 
আমি তোমাকে দুই রকমের ভালোবাসা দিয়ে বেঁধে রেখেছি মনের ভেতর।
এক। ভালোবাসা, যা কামনায় কাঁপে।
দুই। ভালোবাসা, যা তোমাকে ভাবলে আপনিই আসে।
প্রথমটিতে, আমার পুরোটা অস্তিত্ব তুমি হয়ে যায়,
আর কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও স্বস্তি পায় না।
তোমার রঙ আমার চোখের দেয়ালে সেঁটে থাকে---বেয়াড়া পোস্টারের মতন।
পরেরটায়, আমার চোখের পর্দা নামুক কি উঠুক, তোমাকেই দেখি!
চোখের সীমানা পেরিয়ে দেখতে পাই বলেই দেখি না তোমায় যদি কাছে আসো।
তুমি এমন মানুষ, যে অমন করে মনের চোখে কিংবা চোখের মনে আসেই আসে!
 
হে প্রভু, যদি আমি তোমায় ডাকি
দোজখের ভয়ে, তবে আমায় পুড়িয়ে মেরো!
যদি আমি তোমায় ডাকি
বেহেস্তের লোভে, তবে আমার জন্য ওই দরোজা বন্ধ রেখো।
তবে, যদি আমি তোমায় ডাকি
ভালোবেসে, তবে আমায় তোমার আলোর কণাটুকু দিয়ো।
 
আমার সবচে’ দামি যে ধন, সে হলো তোমারই আশা,
কণ্ঠে আমার তোমার নামই সবচাইতে মধুর বাজে।
যতটা সময় পাশে থাকো তুমি, ততটা সময় প্রাণও যেন থাকে!
তোমার ওই মুখ না দেখে তো এক মুহূর্তও বাঁচতে পারি না,
তুমিই বলো, মৃত্যুর পর আরেক জগতে তোমায় ছেড়ে বাঁচবো কী করে?
এই জন্মে আছো বিদেশি; মিনতি আমার, আরেক জন্মে আপন থেকো।
 
আরো একটা রাত যাচ্ছে ফুরিয়ে আরো একটা নতুন দিনের ডাকে,
দিনশুরুর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমায় বলো, রাতটা আমার কেটেছে তো ভাল?
কাটলে ভাল, শান্তি পাবো।
নাকি এ রাত কেবলই নষ্ট করেছি বিগত সেই রাতের মতোই?
হারিয়েছি যা, তার জন্য আফসোসে ডুবে নষ্ট নিজেকে একটু হলেও শাস্তি দেবো।
শপথ করছি, তোমার সকল আশ্বাসে, দিনগুলি আমার কেটেছে তোমার বিশ্বাসে,
তোমারই ছায়ায় বেঁচেছি নিবিড় নিঃশ্বাসে।
বন্ধু আমার, থেকে যেয়ো পাশে, যা হয় হোক, সামলে নেবো।
তাড়িয়েও যদি দাও আমাকে, ভীষণ রেগে সরবো দূরে ক্ষণিক সময়,
আবারো ফিরে আসবো কাছে!
নিজেই নিজের হৃদয় হতে বিদায় নেবো কেমন করে?
 
যারাই তোমার রূপ দেখেছে অনুভবে,
বলেছে সবাই, এ কী আলো! আলোর ধারায় চোখটা গেলো! আগেই কত ছিলাম ভাল!
আমি ভাসছি এক অন্তহীন সমুদ্রের মায়াবী স্রোতে,
আমার ভেতরেও ভেসে যাচ্ছে এক অন্তহীন সমুদ্র!
এ কী যাদু! এ কী হচ্ছে আমার সাথে!
দেখছি আমি, তুমি আমি এক! গুনছি আমি, তুমি আমি এক! শুনছি আমি, তুমি আমি এক!
কী এক ভয়ে দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসছে যেন!
তবু আরো বড়ো ভয়ে চোখ দুটোকে রাখছি খোলা---যদি তোমায় হারিয়ে ফেলি!
 
যদিও আমি অপবিত্র এবং পাপী,
তবু আমি জানি, আমি ক্ষমা পাবো।
আমি রাস্তার নিকৃষ্ট পাংশুধুলো,
এ জীবনে পেয়েছে যে শুধু উপহাস আর অপমানমধু।
আমি নিরাশ এবং প্রত্যাখ্যাত এক মুসাফির,
আমি মানবতার চোখে বিষাদের খোঁচা,
ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে মাতাল আমি,
আমার যা কাজ, ফালতু সবই!
তবু ক্ষমা পাবো আগের মতোই!
 
জীবন বড়ো আশ্চর্য জানোয়ার---
যা কিছু যায় না শোনা, তা-ই শুনে নেয়!
যা কিছু যায় না করা, তা-ই করে নেয়!
যা কিছু যায় না বলা, তা-ই বলে নেয়!
 
যে রাতে প্রার্থনা হয়, সে রাত বড়ো সুখের রাত।
আমি চোখ বুজলেই কাছে পেয়ে যাই, আমার আমি’কে প্রার্থনাতে।
রাত নামলে সবারই যখন আলো ফুরোয়, আমার তখনই আলো আসে।
আর বিচ্ছেদে নয়, মিলনে এসো,
যে আলো কেবল আঁধার নামায়, সে আলোয় নয়,
হৃদয়ের অসীম আলোর ভেলায় ভাসো!
আমি প্রার্থনায় বাঁচি, তুমি বাঁচো আলোর ঘরে।
তোমার যত বেদনা বিষাদ কখনো কাছে ঘেঁষতে দিয়ো না,
আমার প্রার্থনা যখন চলতে থাকে তোমার মানতে।
 
যতদিন আমার দুনিয়া আছে, আমি ভালোবাসায় চাই না বিষাদ।
ভালোবাসাকে খুব ভালোবাসি! তাই ভালোবাসার শপথ ভাঙি না।
যতদিন পৃথিবী বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে, ততদিন বাঁচবে ভালোবাসা আর
ভালোবাসা নিয়ে যত লেখা হবে আমার নামটা খুঁজো ওখানে।
ভালোবাসা কারো চুলের বেণীতে, কারো-বা চোখে, কারো-বা ঠোঁটে।
আমি ঠকেছি যত, জেনেছি ততই, ভালোবাসাটা থাকে কেবলই হৃদয়ে-হৃদয়ে।
আমি অনন্তকাল ভালোবাসা নিয়ে বাঁচবো, হৃদয়ে জড়াবো ভালোবাসা-সুতো,
আমার ভালথাকা কিংবা না-থাকা, ভালোবাসার মন্দবাসার এক নিয়মেই বাঁধা।
 
তোমার ভালোবাসার আগুন রেখো কেবলই ওই হৃদয়মাঝে।
যে হৃদয় ভালোবাসার আগুনে পোড়ে, সে হৃদয় তো শুদ্ধতম!
তোমার প্রেমের সুরা নিলো যে মাতাল হয়ে,
তাকে মাতালই থাকতে দিয়ো।
প্রিয় যদি আসে, কথা বোলো নাকো,
তার সমস্তটা জুড়ে খুঁজে নিয়ো নিজেকে তোমার,
দুই মিলে আজ এক করে নাও নুইয়ে অহং, সরিয়ে কথা,
যদি না পারো সত্তা নিজের ওই তফাতে রাখতে ঠেলে,
শান্তি কি সুখ, পাবে না কিছুই প্রিয়কে পেলে!
 
আমায় নাহয় বেদনাই দিয়ো, সারিয়ো নাগো,
যে ব্যথা দাও, সে তো জানি, সুখের মতোই!
জানি, তোমায় শত খুঁজলেও কেউ পাবে না,
পাওয়ার মাঝে যে সুখ আছে, তারচে’ বেশি
সুখ যে আছে পাওয়ার আশা বাঁচিয়ে রেখে।
সব পেয়ে গেলে সবই ফাঁকি, থাকবে শুধুই মৃত্যু বাকি।
 
তোমায় না পেলে বসন্ত শুকিয়ে যায় বিবর্ণ ফুলে,
আগুন কিনি জলের দামে, এই দু’চোখে বৃষ্টি নামে।
নেই বসন্ত, তো বৃষ্টিই ভাল!
আলো নেই যার, অশ্রুই আলো!
আমার কাল গতকাল এক হলো আজ তোমায় না পেয়ে,
মাস কি বছর ঘুরলো দিনে, শতাব্দী যেন মুহূর্তের মেয়ে!
 
বন্ধু যে খোঁজে, সে-ই কি তবে যন্ত্রণা পায়?
থাকে প্রতীক্ষায় বিষাদচোখে? পুড়তে থাকে লুপ্ত বোধে?
যে পোড়ে, সে জানে কেবল পুড়তে সত্যি কেমন লাগে।
বাকিরা কেবল দেখে হাসিটা, কান্না যে দেখে, বন্ধু তো সে-ই!
কষ্টের দান আশীর্বাদে, থাকার মতো কষ্টে যে থাকে, সে-ই শুধু বাঁচে!
 
তোমায় পেলে চাই না পৃথিবী।
পৃথিবীর যত রূপ, ম্লান হয়ে আসে তোমার রূপে।
তোমায় ভাবলে পুরো এক পৃথিবীর সবটুকু সুখ ছাড়তে পারি হাসিমুখেই!
একটা সময় ছিল, যখন আমি দেখিনি তোমায়,
দেখেছি কেবলই আমার মেধা, সক্ষমতা, মনমননের সুধীরতা।
আর এখন দেখো!
আর কিছু নয়, তোমার স্রেফ চাহনি চূর্ণ করে দম্ভ আর দর্প-পাহাড়!
 
তোমার চাঁদের মতন মুখটা থেকে কিরণ বেরোয়, সূর্যে পড়ে,
অমনি দেখি, কী এক লাজে সূর্য সরে, যেমনি করে রূপের ঘায়ে বুদ্ধি মরে!
তোমার জন্যই দুঃখ আমার দেখেছে পৃথিবী।
বলো, কেনো এ হৃদয়ে সে সুবাসই দিলে যা কেড়ে নিতে হবে?
কেনো অমন করে সরলে দূরে? আমি ব্যাধিগ্রস্ত বলে?
ব্যাধি তো আমার ছিল না প্রিয়, তুমি যখন ছিলে না মনে!
 
এ বিচ্ছেদ-উপত্যকা আমি চিনি না! আমাকে এখান থেকে মুক্ত করো!
তোমার ঘনঘোর চুলের ভাঁজে যে বেচারা মাতাল হলো,
তার কী হায় উপায়, বলো! তার ক্লান্ত আত্মা শান্ত হবে কোন সে পথে?
তোমার জন্য এ কেমন মত্ততা আমার!
তুমি আমার হৃদয়ে এ কী গোল বাধালে!
তোমার জন্য বিশৃঙ্খল হয়ে আছি কত কতকাল ধরে!
আমি আমার আমি’কে তোমায় দিয়েছি যেদিন থেকে,
সেদিন থেকেই নিজের ফাঁদেই পড়েছি বাঁধা তোমার নিখুঁত ছদ্মবেশে।