অনুষঙ্গে অনুরক্তি: তিন

 আমার এই ভেজা চোখ দুটো তুলনা কোরো না মেঘের সাথে,
মেঘ তো কেবল হাওয়া থেকেই বৃষ্টি ঝরায়,
আর অশ্রু আমার রক্তনদীয় ঝড় তুলে দেয় প্রিয়র আশায়।
বন্ধুর খোঁজে একটা জীবন খর্চা হলেও হতে পারে,
ক্লান্তি কি শ্রান্তি সরাতে বন্ধুর মতো কে-ইবা কাঁদে?
বন্ধু পেতে পুরো পৃথিবীও শত্রু যদি হয়, কী এসে যায়?
 
বন্ধুর হাতে হাত রাখলে দুই হৃদয়ে পৃথিবী হাসে!
প্রিয়র চোখের তারায় যেন উঠোন নামে দেবমন্দিরের!
হে মায়াবী হাওয়া, প্রিয়র সুবাস এনে দাও,
তোমায় এই মুহূর্তের জীবন দেবো কিংবা যা চাও!
যার যেখানে খুশি সরে চলে যাক,
আমি কেবল থেকে যাবো আমার প্রিয়র পথে!
 
ওগো সুন্দরের রাজা! একটু দয়া করো,
আমার দিকে একটু তাকাও করুণা দিয়ে,
এই একাকীত্ব দুঃসহ বড়ো, আর কত, বলো?
জীবন যখন ফেরায় আমাকে, আশা করে আসি
তোমার কাছে। ফিরিয়ো না আর, এর চাইতে মৃত্যু ভাল!
 
যখন আত্মা আমার হৃদয় জাগায়, চোখ মেলে দেয় অলক্ষ্যতেই,
কী ঘটে যায়? হৃদয় আর শরীর মিলে ভালোবাসার যাত্রাটা নেয়,
যে যাত্রায় হাসি আছে, আছে কান্নাও, অনিশ্চিতের ভাবটাও আছে,
নৈঃশব্দ্যের প্রলাপ আছে, প্রতিশ্রুতির বিলাপ আছে;
সে যাত্রায় বিরাম নিলে আরাম পালায়, থামলে পরে পথটা বাড়ে।
তবু যাত্রা ওটাই সবার বড়ো, সে যাত্রায় যে মুসাফির, সে-ই তো আমীর!
 
হে তীর্থপথিক, দম্ভ কোরো না।
তুমি বিধাতার ঘর দেখেছ, স্বর শোনোনি, পাওনি তো তাঁকে।
আমি তীর্থে যাইনি, হৃদয়ে ঘুরেছি। পেয়েছি তাঁকে দেখেছি যখন,
আমিই তো তিনি! আমি কেঁদেছি যত তাঁকে ছোঁবো বলে,
বুঝেছি ততই, এ তো ভ্রম কেবলই। আমারই মনে তাঁর অধিবাস,
এ হৃদয়ে, এ অনুভবে তিনি যে আছেন; বোঝা দেখা যায়
তখনই কেবল, যখনই সরাই পর্দা মনের।
 
তিনি ভুলে গেছেন! একদিন কতো সময় কেটেছে আন্তরিক, তাঁর নিবিড় পরশে,
তাঁকে পেয়ে আর চাইনি কখনো দুনিয়ার যত ধনদৌলত, মুক্তোমণি,
আমি আমীরের আমীর, তবু তাঁকে না পেলে ধরি ফকিরের বেশ!
 
তুমি নেচেছ সেদিন, মুগ্ধ নয়নে অভিভূত আমি দেখেছি কেবলই,
সে নাচের ছন্দটুকু বুঝেছি যত, অবাক হয়েছি, কখনো অতীতে
সে নাচ দেখেছি অন্য পায়ে, অন্য ঘরে, অন্য আবহে।
আমি সে গান শুনিনি, যে গানে মুর্শিদ দেখায় পথ,
যে গানে স্বর্গের পথ সহজ সরল, তাই সে পথ এখনো দেখতে বাকি।
 
এসো কণ্ঠ মিলাই, পায়ে রেখে যাদু, চোখে রেখে সুর,
এই মাতাল সময়ে বেতাল ভজনে ভরিয়ে তুলি যে দেবতা আছেন মনের মাঝে।
সুন্দরের যে মুখ, প্রতিভূ তাঁরই,
বাগানের রঙ কি বাগানের ঘ্রাণ, তাঁরই তো জানি,
প্রতিটি জিভে, প্রতিটি মনে, যে আরতি,
তা চলে যায় তাঁরই পথে। তাঁর যে পথ,
তীর্থ সেতোই! সে তীর্থ দূরে নয়কো, হৃদয়মাঝেই!
 
আমি ধুলোয় লুটাই, তবু যে মজি প্রিয়র প্রেমে,
ভালোবাসাটা চলে গেলেও ক্ষত রেখে যায়,
সে ক্ষত তো ভালোবাসাই, আর কিছু নয়।
ভালোবাসা-শিখা আগুন ধরায়,
সে আগুনে ছাই হয়ে যাই তোমার নেশায়,
আমি তো জানি, আমি এইখানে নেই সেই কবে থেকে,
হারিয়েই আছি তোমার মাঝে, অস্তিত্ব কি সত্তাই বল,
সেও তুমিই!
 
ভালোবাসা যাকে বন্ধু বানায়, বেছে নেয় খুব আপন করে,
সে স্বস্তি খোঁজে ভালোবাসা-ঘায়ে শেষ অবধিই!
অমন প্রেমিক আঘাতেই বাঁচে, গোলাপ না পেলে কাঁটাহাতে হাসে।
ভালোবাসার যন্ত্রণাসুরা পান করে নেয় কী হাসিমুখে!
কাল কী আছে, ভাবে না ওরা, আজকের দুঃখে কেবলই হাসে!
 
যে প্রিয়র মোহে শেকল পরেছে, সে শেকল খোলে না,
খোলা খাঁচাতেও নাচে যে পাখি, তাকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাও? অতো কি সোজা?
তাদের কষ্টে জ্বলে আলোর শিখা, গরলপাত্রে অমৃতের সুধা,
তৃষ্ণায় কাঁপে ঠোঁট দুটো তাদের, জীবনে তবু বসন্তসভা!
তারা চোখে দেখে না, কানে শোনে না, কথা বলে না,
তবু দেখে, শোনে আর বলে সবই---অনেকটা বেশি, আমাদের চেয়ে!
 
দুনিয়া দেখে, ভেতর দেখে না, এমন মানুষ ওদের দেখে অচেনা ভাবে।
যে ভালোবেসেছে, সে চেনে না বিশ্রাম, স্বস্তি বোঝে না, জিরেন খোঁজে না।
ভালোবাসায় যার বিশ্বাসটুকু অধীর অগাধ, সে বাজার চেনে না, বাগান মানে না।
কি ভয়ে কি লজ্জায়, পেছোয় না কখনো, ভালোবাসার কথা বলে চলে সে সবার কাছেই!
যে ভালোবাসার ঘায়ে আহত নিহত, সে পরোয়া করে না নাম কি খ্যাতির!
জীবন যায় তো, জীবনই খোয়ায়, হৃদয় পেতে হৃদয় হারায়---বেপরোয়া এত!
 
পুরো দুনিয়া হেসে ভুলে যায় ভালোবাসা নিতে, প্রিয়কে হৃদয়ে রাখে, শহর ঘোরে,
দেখে মনে হয়, ভেঙেযাওয়া এক জীর্ণ শাখা, আসলে ভেতরে তার আগুন জ্বলে!
তারা টলে না নিজে, পাহাড় টলায়, চুপ থেকে তারা খুশবু ছড়ায় পথেপ্রান্তরে।
যে বলে, আমি তো কাছেই আছি, যদি অনুভবে না থাকে সে,
তবে রেখো জেনে, নেই সে কোথাও! সে হৃদয়ে ভালোবাসা নেই,
যা আছে, তা কেবলই ঠোঁটে, সে হৃদয় কুকুরেরও অধম,
কুকুর তবু ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত হলেও সারাজীবনই থাকে অনুগত!
 
ভালোবাসা না থাকলে সকল প্রার্থনা আর শুদ্ধতা বেকার হয়ে থাকে,
ভালোবাসায় না পুড়লে বন্ধু কখনো যায় না চেনা,
ভালোবাসাও যাকে হেলায় না কখনো, চেয়ো না তার কাছে দূরের চাহনি।
প্রেমের অনুগ্রহ যে পেয়েছে, সে কখনো নয় সাধারণ,
পোশাক কি বাণী, ভোলায় না জেনো যদি ভেতরের আলো না ছোঁয় সাথে।
যার ভালোবাসা নেই, তার পোশাক কি আশাক ফতুর দুইই!
 
ভালোবাসা ও বাধা কখনো বন্ধু হয় না। ভালোবাসা তাই অবাধ অবোধ!
তীর তরবারি কোনো কিছুতেই ভয় পায় না ভালোবাসে যে!
না মরলে কেউ কখনো স্বর্গে যায় না,
যদি প্রিয়কে পাওয়াই স্বর্গ ভাবো, তবে নরক মৃত্যু, হাসিমুখেই নিয়ো!
প্রেমিক কখনো হারায় না আশা, প্রতিদিনই বাঁচে তীব্র বোধের আলোর আঁচে!
যে ভালোবাসা চায়, তার কখনো ভয় থাকে না, শংকা থাকে না।
 
একদিন এক আশ্চর্য উপত্যকায় পূজক পূজিত, দুইই এলেন।
তাঁরা এক হয়ে গেলেন, শত চেষ্টায়ও তাঁদের আলাদা করা গেলো না আর।
পূজক দেখতে মানুষের মতন, তবু মানুষ তিনি নন।
পূজিত দেখতে ঈশ্বরের মতন, তবু ঈশ্বর তিনি নন।
দুইই তো এক! ভিন্ন ভাবনায়, ভিন্ন দেহে, ভিন্ন বোধে।
 
ভাল কি মন্দ, সে তো কেবলই দেখার প্রভেদ,
সুখ কি দুখ, সে তো কেবলই ভাবার প্রভেদ,
হাসি কি কান্না, সে তো কেবলই নেয়ার প্রভেদ,
স্বর্গ কি নরক, সে তো কেবলই বোঝার প্রভেদ।
সবার মনেই সংকটের ভয়, ঝড়ের ভীতি,
যদি একবার এই হৃদয়ে স্বর্গ নরক, দুইই নিয়ে
হাঁটা যায় সুর কি-বা অ-সুরের পথে,
ভয় থাকে না কোনো কিছুতেই!
 
যে বিষ খেয়ে বাঁচে, সে অমৃতের ভয় করবেই-বা কেন?
পথের শেষপ্রান্তে পৌঁছেছে যে, সে মরে একবার, আবারো বাঁচে,
অন্ধ, বধির, মুঢ় হয়ে হয় একবার উধাও, আবারো ফেরে!
 
পুরো শহরে খালিপায়ে যুক্তিরা ঘুরে বেড়ায়, প্রেমিকের কাছে কেউ ঘেঁষে না।
বিশ্বাসের রহস্য যে একবার বুঝেছে, সে পরোয়া করে না আর কিছুকেই!
সকল যুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখায়, নেচেগেয়ে চলে বিশ্বাসের পথে।
চিৎকার করে আর শুধু বলে, আমি জানি না, আমি কে!
শুধু জানে, সে যাচ্ছে! কোথায় যাচ্ছে, তা জানে না!
অহং আর আমিত্বকে ফেললে পিছে, পথের বাধায় ভয় কী মিছে?