অন্দরঘরের বাতিঘর

শুনেছি, আমার বড় দাদা (গ্রান্ড গ্রান্ডফাদার) ছিলেন জমিদার। সিরাজগঞ্জে মিঞাবাড়ির নামে লোক এখনও সমীহ করে চলে। রাজত্ব চলে গেলেও রাজার নাম থেকে যায়। সে সময়ের গল্প শুনলেই আমার ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের মিঞাবাড়ির আবহ চোখের সামনে ভেসে ওঠে শুধু। ছোটবেলায় নাটকটা দেখতাম আর ‘মিঞার ব্যাটা মিঞা’ মনে হত বাবাকেই। সব মেয়েরই একজন ছোটবেলার নায়ক থাকে, সে নায়কটি তার বাবা। আমার বাবা-চাচারা একসাথে একাত্ম হয়ে থাকবার শিক্ষাটা বংশগতভাবেই পেয়েছিলেন। আরও শুনেছি, মিঞা বাড়ির সামনে দিয়ে নাকি কেউ জুতা পায়ে ছাতা মাথায় দিয়ে যেত না। আমাদের বৈঠকখানা আর অন্দরমহল আলাদা তো ছিলই! আমার বাবার ডাকনাম সাখু, অবশ্য, বাড়ির ছোটরা আর একটু দূরের যারা, তাদের দেখেছি, বাবাকে সাখাওয়াত বা সাখাওয়াত ভাই বলেই ডাকতেন। বাবারা ছিলেন আট ভাই আর তিন বোন। আমার তিন চাচা বেঁচে নেই। আমি ছোট ফুপুমাকে দেখিনি, আমার জন্মের আগেই তিনি মারা যান। উনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন, অনেক বেশিই অসুস্থ, কখনও-কখনও হয়তো ঘরে আটকেও রাখতে হত। বেঁচে থাকার পুরো সময়টাতেই ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। মৃত্যুর সময়ও অনেক যন্ত্রণা পেয়েছিলেন, শুনেছি, রক্তবমি করতে-করতে উনি মারা যান। উনাকে দেখে সবাই খুব আফসোস করতো, আর বলত, এত কষ্টের যার জীবন, তার মৃত্যুটা যেন একটু আরামের হয়। সৃষ্টিকর্তা তা শোনেননি। সবই অবশ্য শোনা-কথা। ছোট ফুপুমা দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন, সাথে ছিলেন দারুণ সপ্রতিভ। আমার ছোটাপুর (মানে, আমার ইমিডিয়েট বড় বোনের) সাথে নাকি তার চেহারার অনেক মিল ছিল। তবে আমি বড় ফুপুকে দেখেছি। উনার মতন উঁচু, লম্বা, ফর্সা মহিয়সী নারী কমই চোখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের এক বউদির সাথে উনার অনেক মিল পাই। বড় ফুপুমা অনেক অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। আমি দাদীকে দেখিনি। সবাই বলত, দাদীর চারিত্রিক দিকগুলি উনি পেয়েছিলেন। বড় ফুপুমার বংশীয়, গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ বেশ ভাল লাগত। উনি বেশ বিদুষী মহিলা ছিলেন, উনার সংগ্রহে প্রচুর বই ছিল। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, হিন্দি আর উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারতেন। বাসায় এলে আমাদের বকাঝকাও করতেন, দেখতাম। শুনেছি, চাকরির কারণে দাদা নাকি কলকাতাতেই বেশি থাকতেন, তাই সংসার এর সবদিক দাদীকেই সামলাতে হত, আর সাথে থাকতেন বড় ফুপু। বাবা বড় ফুপুকে বড়বু বলে ডাকতেন। আমার মেজো ফুপুর কথা কেউ বলে না। উনি দেখতে অন্য দুই বোনের মতন খুব সুন্দরী ছিলেন না। খুব ভাল গাইতে পারতেন, গানের উপর বেশ দখল ছিল। বাড়ির সকলের পছন্দের বিরুদ্ধে গিয়ে উনি শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছিলেন। পরবর্তীতে ফুপু একজন অমুসলিম সুরকারকে পালিয়ে বিয়ে করেন। এ কারণেই উনাকে পারিবারিকভাবে ত্যাজ্য করা হয়। শুনেছি, উনি এখন মুর্শিদাবাদে থাকেন, উনার গানের স্কুল আর ফুপাকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন।
আমার বাবা ছিলেন পড়ালেখার প্রতি বেশ অমনোযোগী। সারা কাচিহারা, জামতৈল, কৈজুরী, রূপনাই গ্রাম চষে বেড়াতেন শিমুলদাইড়ের মিঞা বাড়ির এই কনিষ্ঠ পুত্রটি, আর গ্রামের সিনিয়র বন্ধুরাও তার কথাকে বেশ গুরুত্বের সাথেই নিতেন। বাবার সিনিয়র বন্ধুদের একজন ছিলেন প্রাক্তন আর্মি চিফ পি আর মজুমদার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পদে আবেদনের পর আমি উনার সাথে সশরীরে দেখাও করেছিলাম। সে চাকরিটা আমার হয়নি, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল, কাদের অধ্যাপনার সুযোগ দেয়া হবে। তবে, উনার আন্তরিকতার কোনও কমতি ছিল না। উনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আর ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছিলাম আমাদের ক্যাম্পাসে মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সম্মিলন পরিষদ আর আমার হাতেগড়া সাংস্কৃতিক সংগঠন উদ্ধরণ-এর যৌথ আয়োজনের এক অনুষ্ঠানে। যা-ই হোক, সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমার বাবা, অর্থাৎ বাল্যবন্ধু সাখুকে চিনতে তাঁর দেরি হয়নি, অনেক বড় মানুষের মত উনি এমন ভাণ করেননি যে উনি উনার বাল্যবন্ধুকে ঠিক মনে করতে পারছেন না। রাজনীতি নিয়ে আমার বাবা-চাচাদের উচ্ছ্বাস দেখেছি ওই ড্রইংরুমে চায়ের আড্ডাতেই। উনারা কেউই রাজনীতির নোংরামি আর ছ্যাঁচড়ামি সহ্য করতে পারতেন না। তাই সবসময়ই খুব যত্নে এই ব্যাপারটা নিয়ে নিঃস্পৃহ থেকেছেন, নিজেদের দূরে রেখেছেন সচেতনভাবেই। আমরা পারিবারিকভাবেই তাই সুবিধাবাদীদের দলে ছিলাম না কোনওদিনই। স্রেফ রাজনৈতিক পরিচয়ে যা হয়ে যেতে পারতো অনায়াসেই, তা-ই আমাদের অর্জন করতে হয়েছে নিজের যোগ্যতাতে। এটা নিয়ে বাবা-চাচাদের কখনওই আফসোস করতে দেখিনি, বরং নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে বেঁচে থাকার অহংকার তাঁদের মধ্যে সবসময়ই ছিল, আছে, আমি বিশ্বাস করি, থাকবেও। বাবা প্রায়ই বলেন, “যতদিন এ দেশে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক লোকজনকে সমীহ করে চলবে তাদের মেধার জোরের কারণে শ্রদ্ধা থেকে নয়, পেশির জোরের কারণে বাধ্য হয়ে, ততদিন এ দেশে রাজনৈতিক পরিচয়ে বেঁচে থাকার ব্যাপারটা সম্মানজনক কিছু হবে না।” ভাবি, কী আশ্চর্য রকমের একটা সত্য কথা! তো যেখানে ছিলাম। বাবা যাত্রা পালা থিয়েটার মেলা এসব দেখে বেড়াতেন। খুব ডানপিটে টাইপের ছিলেন। ক্লাস এইটে থাকতেই পড়ালেখা সম্পূর্ণ ছেড়ে এমনকি বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। চাচাত ভাই আরাফাতের কাছে এসে ওঠেন জুরাইনে। এরপর আর কখনও সিরাজগঞ্জে ফিরে যাবার আকুতি আজ পর্যন্ত বাবার মধ্যে আমি কোনওদিনই দেখিনি। বাবার পড়াশোনার অধ্যায় ক্লাস এইটেই সমাপ্ত। তবে হ্যাঁ, মায়ের উৎসাহেই হোক, আর জোরাজুরিতেই হোক, বাবা অনেক উপন্যাস পড়েছেন।
অন্যদিকে, আমার মা ছিলেন নওগাঁর নির্মইল গ্রামের মেয়ে। নানা মুন্সি রেজভী আহমেদ ভূঁইয়া মারা যান ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর গুলিতে। নানার মতন আলীম মানুষ আর বিনয়ী নাকি হয় না। শুনেছি, বাবাকে সবসময় ‘আপনি’ বলে কথা বলতেন। কারও উপর কোনওদিন স্বর উঁচু করে কথা বলেননি। মাও নানাভাইয়ের মতই হয়েছেন, শুনেছি। নানীকে আমরা বুবু বলে ডাকতাম। আমার যখন তেরো মাস বয়স, তখন হাসানের জন্ম। ফলে বাধ্য হয়ে আমাকে মায়ের দুধ ছেড়ে দিতে হয়েছিল, সেই সময় বুবু আমাদের ঢাকার বাসায় থেকে আমাকে দেখাশোনা করতেন, খাওয়াতেন। উনি আমার এতটাই যত্ন করেছিলেন যে আমি বেশ স্বাস্থ্যবান একটা শিশু হয়ে উঠেছিলাম। আমি ঘুমালে নাকি সবাই বলতো, দেখো, দেখো, ফাখেরার একটা মেয়ে হয়েছে একদম পদ্মফুলের মতন। আমার নাকি চোখদুটো এত দীঘল ছিল যে চোখ ফিরতো না কারও। অমন টকটকে গায়ের রঙ কারও নাকি হয় না। আরও কত কী শুনেছি নিজের সম্পর্কে! ছোটবেলায় সবাইই বোধহয় শুধু প্রশংসা পায়। ছোটবেলায় তাই প্রশংসার জন্য কোনও টেনশন করতে হয় না। বড় হয়ে গেলেই ঝামেলা, সব প্রশংসা নিজেকেই বুদ্ধি করে ম্যানেজ করতে হয়! নানীকে আমরা দেখেছি, এত নিরিবিলি বোকাসোকা আর অবুঝ মানুষ আর হয় না। উনি টিভির মধ্যে মানুষ দেখেও ঘোমটা টেনে আড়ালে লুকাতেন। সফেদ কাপড়ে ছোটখাটো গোলগাল মাথাভর্তি ঘন কালো লম্বা চুলের বুবু একটা সময় দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে থেকে মারা যান। মৃত্যুর আগেও উনার একটা চুলও পাকেনি, মাথায় তেমন চুল কমেনি। আমি তাঁর মৃত্যুর সময়ও দেখতে যাইনি, আর অসুস্থ অবস্থায় সেবা করার কথা মাথায় আসেনি। মা গিয়েছিলেন তখন, আমি আর আমরা বোনেরা বাসায় থেকে সংসার সামলেছি। আমার কাছে মাকে বুবুর মতই বোকা মনে হয়। আমার নানী ছিলেন বাবামায়ের একমাত্র মেয়ে, অনেক আদরের। একবার নাকি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ায় নানাকে জোর করে বিয়ে করিয়েছিলেন ছোট নানীর সাথে। (ছোট নানী বুবুর ছোটো চাচার মেয়ে।) এও যে হয়, তার চাক্ষুষ প্রমাণ আমার নানী, নানার যত্ন ঠিকমত্ন হচ্ছে না তাই স্বামীকে বিয়ে করালেন নিজের ছোটবোনের সাথে! ছোট নানীর চেয়ে আমার বুবু অনেক বেশি মায়াবতী আর সুন্দরী ছিলেন। শুনেছি নানাবাড়ি থেকে কেউ নাকি না খেয়ে ফিরতে পারতেন না কোনওদিন। গ্রামের বাড়ির স্মৃতি বলতে আমার যা আছে, তা হাতড়ে নানাবাড়ির স্মৃতিই মনে পড়ে। সেজো মামা এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। আমরা দেখেছি, মামার বৈঠকখানা রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকতে। সেজো মামী রাঁধছেন হাড়ির পর হাড়ি, ঢালছেন আর একটু পরপরই ফুরাচ্ছে। বাড়িতে বাড়তি লোক সবসময়ই থাকত।
বাবা মাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারতেন না। মা যদি বাপের বাড়িতে নায়র যেতেন, তবে আমাদের নানাবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার উছিলায় বাবা (আসলে) মাকে দেখতে যেতেন। বাবা কখনওই মাকে রেখে আসতেন না, যে করেই হোক, কোনও না কোনও বুদ্ধিতে মাকে সাথে নিয়েই ফিরতেন। বাবা যখন আমাদের নিয়ে নানাবাড়ি যেতেন, সবাই বাবার খাতিরে অতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। বাবাকে সবাই খুব সমীহ করতেন। কেন এতটা, আমি বুঝতাম না। বাবার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান খুব খাতির পাওয়ার মত তেমন কিছু ছিল না। বাবা সবাইকে অনেক সুপরামর্শও দিতেন। অথচ বাবার যে তখন খুব ভাল সময় যাচ্ছে, তাও নয়। আমি যখন বিভিন্ন সেমিনারে বক্তাদের নানান উপদেশ দিতে দেখি, ভালভাল পরামর্শ দিতে দেখি, তখন আমার প্রায়ই জানতে ইচ্ছে হয়, উনারা নিজেরা এসব কথা কতটুকু মেনে চলেন! মোটিভেশনাল বক্তাদের দেখলে আমার প্রায়ই মনে হতে থাকে, উনারা স্ববিরোধী বক্তব্য রাখছেন। উনাদের নিজেদের জীবনটা খুব মসৃণ নয়, অথচ উনারা সবাইকে শেখাচ্ছেন, জীবনকে কীকরে মসৃণ করতে হয়! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একবার উনার বৌদি ঠাট্টা করে ফোড়ন কেটেছিলেন---নিজের বিয়ের খোঁজ নেই, পরের বিয়ের পদ্য লেখে! উনাদের দেখেও আমার বলতে ইচ্ছে করে---নিজের সুখের ঠিক নেই, পরের সুখের সওদা করে! উনারা যা কিছু শ্রোতাদের মানতে বলেন, তার বেশিরভাগই আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। উনারা, আপনি না আচরি ধর্ম শেখান অপরে! উনাদের কথা শুনলে আমি একটুও অনুপ্রাণিত হই না, বরং চরম মেজাজ খারাপ হয়, আর ব্যাটাদের ধরে থাবড়াতে মন চায়! মোটিভেশনাল বক্তাদের দেখলেই আমার বেকুববেকুব লাগে, ধরে কাতুকুতু দিতে ইচ্ছা করে, আর হাসি পায়। হিহিহি......... বাবার অমন চারিত্রিক দ্বৈততা দেখলে সেই ছোট্ট আমারও বিস্ময় বাড়ত। খুব রাগ হত এটা ভাবলে যে বাবা মাকে দেখতে চলে যেতে চায়, যাক না, আমাদের কেন টানতে-টানতে নিয়ে যাচ্ছে সাথে! বাবার কি সাহস নেই মাকে আনার জন্যই নানাবাড়িতে যাওয়ার? নাকি, নিজে এখনও অতটা শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারেননি বলেই শ্বশুরবাড়িতে যেতেও বাবাকে কোনও একটা অজুহাত দাঁড় করাতেই হত? এমনও হয়েছে, স্কুল কামাই করে আমরা নানাবাড়িতে গিয়ে দিনের পর দিন মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি! রাগ হত এসব ভেবে আর ভাবতাম, মাকে ছাড়া কি বাবার একদিনও চলে না?
একই বিভাগের ভিন্ন দুটি জেলার দুটি ভিন্ন গ্রাম। দুটি ভিন্ন পরিবার। একদিকে মিঞা বাড়ির রাশভারি অহংকার আর আভিজাত্য, অন্যদিকে ভূঁইয়া বাড়ির বিনয় আর নম্রতা। দুটি ভিন্ন আদর্শের পরিবারের, দুটি সম্পূর্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষের বিয়ে হয়েছিল। আর হয়েছিল বলেই হয়তো আমাদের সংসার এমন করে, এত প্রতিকূলতায়ও কখনও পথ হারায়নি। নৌকা যখন একদিকে ডুবতে বসেছে, অন্যদিকে শক্ত হাতে বৈঠা চালিয়ে তা ঠিকই ভাসিয়ে ওঠানো হয়েছে। এটাই বুঝি সংসারের ধর্ম। সমানে-সমানে সংসার টেকে কম। সংসার মানেই টানাপড়েন। সংসার মানেই বোঝাপড়া। সংসার মানেই বৈপরীত্য।
আমি কতকটা আনসোশাল। মনে আছে, ক্লাস সিক্সে স্কুলে আমার খুব পছন্দের শিক্ষক ছিলেন রুমানা জামান চৌধুরী আপা। উনি খুব লম্বা, শুকনা, ফর্সা, মিশুক আর প্রাণবন্ত মহিলা ছিলেন। ইংরেজি পড়াতেন। অসম্ভব সুন্দর উচ্চারণে আবৃত্তির ঢঙে ক্লাস নিতেন। উনার আদর্শ ছিলেন ডিরোজিও, আমাদের ক্লাসে ডিরোজিওকে নিয়ে কথা বলতেন। আপা খুবই আন্তরিক মানুষ ছিলেন। নিজের পেশার প্রতি অতোটা নিবেদিত আর সৎ শিক্ষক আমি আর কখনও পাইনি। সব ছাত্রীই উনাকে পছন্দ করতো। তো আমিও করতাম। অন্যদের সাথে আমার পার্থক্য ছিল এটাই যে, আমি খুব বাধ্য আর মনোযোগী ছাত্রী ছিলাম। উনি কোনও ক্লাসে কী পড়াবেন, সেটা আগের রাতেই বাসায় পড়ে ক্লাসে আসতাম। আমাদের আশাবরী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতি ক্লাসে দুটো করে সেকশন ছিল। বেজোড় স্থান অধিকারিণীরা ‘ক’ শাখায় আর জোড় স্থান অধিকারিণীরা ‘খ’ শাখায় পড়ত। আমি ছিলাম ‘ক’ সেকশনের রোল নাম্বার এক। এর মানে কিন্তু এটা না যে, আমি সত্যিসত্যি ফার্স্ট গার্ল ছিলাম। যে মেয়েটা ফার্স্ট হয়েছিল ও স্কুল চেঞ্জ করে অন্য একটা ভাল স্কুলে চলে যাওয়ায় তৃতীয় হয়েও আমার রোল হয়েছিল এক।
তো যে কথায় ছিলাম। কেন আমি আনসোশাল? সব তো মনেও পড়ে না, অনেক কিছুই আসলে দিনকে দিন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বয়স বাড়ছে তো! তবু যতটা মনে আছে তা হল, ভাল ছাত্রী ছিলাম বলেই রুমানা আপা আমাকে অনেক আদর করতেন। আপার বাড়ি ছিল সিলেট। আপা আমাকে ডাকতেন কৌলমি বলে, আপা কলমি উচ্চারণটা ওভাবেই করতেন। খুব সম্ভবত আপার ভাইয়ের মেয়ের নামও ছিল কলমি। তখন আপা আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন। অনেক আগে থেকেই, মানে যখন থেকে উনি এই স্কুলে বদলি হয়ে আসেন, তখন থেকেই আপা আমাকে খেয়াল করতেন। অর্থাৎ ক্লাস ফোর থেকে। শান্ত, ভদ্র, ভাল ছাত্রী মেয়েটা আবার ক্লাস ক্যাপ্টেনও। কিন্তু সমস্যা দুইটা। এক। মেয়ের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ, অপুষ্টির ছাপ সুস্পষ্ট। দুই। মেয়েটার স্কুল ড্রেসটা ছেঁড়া আর সেলাইকরা---রিফু তালি কিছুই বাদ নেই। কাপড়ও ভীষণ পাতলা হয়ে গেছে একনাগাড়ে ব্যবহার করার কারণে। আসলে তখন স্কুলে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল কেবল দুটো কারণে---এক। বই ও বেতন ফ্রি। দুই। আমাকে অন্যের বাসায় কাজ করতে যেতে হত না বলে। খেতে পাই আর না পাই, ভাল কাপড় পরি আর না পরি, আমার মা আমাদেরকে শিক্ষিত দেখতে চেয়েছিলেন, আর আমার বাবা সবসময়ই, যত দারিদ্র্যেই থাকি না কেন, কাজের লোকদের শ্রেণী যে আলাদা, সেটা মেনেই চলতেন, যদিও বাবা-মাসহ আমাদের সবারই তখন ছিন্ন বসনে দিনাতিপাত করার সময় চলছিল। আধা কেজি চাল সংসারের ১২ জনের মাঝে ভাগ করে এক সালুনে খাওয়ার দিন চলে, তবু সেসময়ও শ্রেণী বিভেদ মেনেই চলতেন বাবা। বাবার একটা কথা ছিল, গরীব যত টাকাপয়সার মালিকই হোক না কেন, সে গরীবই থেকে যায়। ১০০ টাকার লুঙ্গিতে ৫০ টাকা গিঁট মারলেই তা ১৫০ টাকার লুঙ্গি হয়ে যায় না। বংশ কথা বলে। বড় বংশ বড়ই, আর ছোট বংশ ছোটই। বাবা প্রয়োজনে না খেয়ে মারা যাবেন, তবুও নিজের বংশকে কারও কাছে ছোটো হতে দেবেন না। বাবাকে কোনওদিনই কারও কাছে হাত পাততে দেখিনি। বরং চরম অভাবের সময়েও সাংঘাতিক ঠাট বজায় রেখে চলতেন। বাবার কাছ থেকে শেখা যে শিক্ষাটি আমার সবচাইতে বেশি কাজে লেগেছে, তা হচ্ছে আকাশছোঁয়া আত্মসম্মানবোধ।
সেই সময় ছেঁড়া পোশাক, মলিন চেহারা, বিনীত আচরণ আর ভাল রেজাল্ট ছিল আমার ট্রেডমার্ক। কেন জানি এটা নিয়ে আমি দুঃখিত হলেও বিব্রত ছিলাম না একটুও। আমার মনে হতো, আমার এই অবস্থার জন্য আমি নিজে তো কোনওভাবে দায়ী নই। আর এই অবস্থাও নিশ্চয় চিরস্থায়ী নয়। দিন এমন হয়েই থাকবে না। কষ্টের দিন শেষ হবেই। আমি আমার দায়িত্ব যেটা, সেই লেখাপড়াতে তো কোন ফাঁকি দিচ্ছি না। ছেঁড়া পোশাকেই ক্লাসে ফার্স্ট হতাম। অসুবিধে কী? তাই আমার মন ছোট করারও কিছুই নেই। দামি পোশাকে ঠোঁটে রঙ মেখে ফেল করার কী মানে? নিজেকে এভাবেই বোঝাতাম। কিন্তু প্রতিবছর দরিদ্র তহবিলের সাহায্য আর ফুল ফ্রি স্টুডেন্টশিপ নেয়ার জন্য আবেদন করতে এক ধরনের গ্লানিবোধ হত। স্পষ্ট বুঝতাম, ক্লাসের বাকি ছাত্রীদের চেয়ে আমি আলাদা। আমি আসলেই বেশ গরিব। ওদের মা টিফিনে নুডল্স দেয়, আমার মা প্রায় দিনই কিছু দিতে পারেন না। তবু আমি খালি টিফিন বক্সটাই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতাম, টিফিন ছুটিতে ব্যাগের ভেতরে আমার ছোট্ট মাথাটি লুকিয়ে মুখ নাড়াতাম, যেন খুব দামি সুস্বাদু কোনও খাবার আমার টিফিন বক্সে আছে, যা আমি কারও সাথে ভাগ করতে চাইছি না। আমাকে অনেক বেশি সীমাবদ্ধতার মধ্যেই যুদ্ধ করতে হবে। জানি, এ এক অসম যুদ্ধ। এও জানি, সেই যুদ্ধে জিততেও হবে আমাকেই। যুদ্ধে হেরে গেলে কাউকে তো আর আমার দারিদ্র্যের অজুহাতটা দেখাতে পারবো না। আর দেখিয়েও বা আমার লাভটা কোথায়? যুদ্ধে নেমেছি মরে হলেও জেতার জন্য, হেরে বাঁচার জন্য নয়। আমি ছোটবেলা থেকেই অজুহাত না দেখিয়ে নিজের মাথার জোরে চলতে শিখেছি। এবং, তা-ই করে যাচ্ছিলাম। এভাবেই কাটছিল দিনগুলো।
মা শিখিয়েছিলেন, বাহ্যিক চাকচিক্য নয়, ভেতরের চাকচিক্যই বড় কথা। এটাকে আপ্তবাক্য হিসেবেই মানতাম। নিজের ড্রেসআপ আর গেটাপের প্রতি সেই থেকে আমার উদাসীনতার শুরু। আজও সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া অহেতুক বলেই মনে হয় আমার কাছে। ক্লাস সিক্সের সেই দিনটা ছিল সবচেয়ে বেশি অপমানের দিন আমার জন্য, যেদিন নওশীনের (আমাদের ক্লাসে রোল ১ ছিল যে মেয়েটার, যে ভিকারুননিসা স্কুলে চলে যায় সিক্সে উঠে, আর রোল ২ হয়েও আমার রোল হয়ে যায় ১) আম্মু আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, “কলমি, নওশীন তো অন্য স্কুলে চলে যাচ্ছে, ওর তো আর এই স্কুল ড্রেস দরকার নেই। ওর পুরনো ড্রেসটা তোমাকে দিতে চাই, যদি তোমার আপত্তি না থাকে।” কথাটা শুনে আমার এত বেশি অপমানিত বোধ হয়েছিল! আমি জানি, আমার নতুন পোশাক নেই। আমার ড্রেসটা হয়তো আর পরার যোগ্যই নয়। আমি নাহয় ছেঁড়া ফাটা শত সেলাইয়ের মলিন পোশাকই পরছি, তবুও তো সেটা আমার নিজের পোশাক। আমার তো অন্য কারও পোশাক ভাল লাগে না। আমার নিজের ছেঁড়া পোশাকই আমার জন্য ভাল। যা আমার ভাগ্যে আছে, আমি তা নিয়েই চলতে শিখেছি। উনি কোন সাহসে আমারই ক্লাসমেটের পুরনো জামা আমাকে দিতে চাইলেন? দুই চোখের কান্না চেপে কঠিন স্বরে শুধু বলেছিলাম, না আন্টি, আমার লাগবে না।
কয়দিন পর রুমানা জামান চৌধুরী আপা একদিন ক্লাস শেষে সব মেয়েকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বললেন, শুধু আমাকে থাকতে বললেন। আমি আর আপা রুমে একা। আমার খুব পছন্দের ব্যক্তিত্বটি তাঁর সান্নিধ্যে একা আমাকে ডেকে নিয়েছেন। আর সবাইকে চলে যেতে বলেছেন। আমার খুব গর্ব হচ্ছিল সেই মুহূর্তে। আপা আমাকে খুব কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে বললেন, কৌলমি, তোমার নাম তো আমার ভাইয়ের মেয়ের নামেই, আমি তোমাকে ওর মতনই দেখি। আমি তোমাকে স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিতে চাই, আজকে তুমি চল আমার সাথে টেইলর্সে। আপাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আর ভালোবাসার উপহারে না করা যায় না। আমার দুই চোখ বেয়ে কেবল অঝোরে কান্না গড়িয়ে গেল। আমার মুখে তখন কোনও ভাষা নেই। আমি বোবার মতন আপাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছি।
সেদিন মার্কেটের সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় দর্জির দোকান বন্ধ ছিল। আপা বললেন, চলো, তোমার বাসায় যাই। নিবে তো আমাকে? আমি মনেমনে অ্যাত্তো খুশি! বললাম, চলেন আপা। হেঁটে যাওয়াআসা করা আমার অভ্যাস। চন্দ্রিকাচক মার্কেট থেকে আপাকে নিয়ে হেঁটে আমাদের পূর্ব মাহীসন্তোষের বাসায় ফিরলাম। আপা কিছুটা হাঁপিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, বেশ দূর তো! বাসায় আসার সময় আমার জন্য আপেল নিয়ে এসেছিলেন, আর আমার স্কুল ড্রেসের জন্য জোর করে কিছু টাকা মার হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের সব ভাইবোনের খবর নিলেন। ততদিনে আমার বড় ভাই, মানে ভাইয়া নালিন্দা কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। আর আমার সবচেয়ে বড় যে আপু, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাশ করে বের হয়ে চাকরি করছে। এর মাঝে আপুর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক ঝড়। যে ঝড়ের ঝাপটায় বলতে গেলে প্রতি বছরই পুরো পরিবার উলটেপালটে গিয়েও একসাথে তা সামলে উঠেছি সবাই মিলে বারবার। হ্যাঁ, ১৯৯৬-২০০১, এই টানা পাঁচ বছর প্রতি শীতে আপু অসুস্থ হত মানসিকভাবে। টানা সাত বছর পিজি হাসপাতালে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে ড্রাগস নিতে হয়েছিল আপুর। হাই পাওয়ারের সব ওষুধ, লারগেট্রিল, পার্কেনিল, আরও কী কী যেন। অনেক দাম! তার একটা ডোস একজন সুস্থ মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। সে কথা তো আর জনেজনে বলবার মত কিছু নয়। কাউকে বলিওনি। আমাদের পরিবার থেকে শেখানো হয়েছে, নিজের কষ্টের কথা কখনওই কাউকে বলতে নেই। সুখ মার্কেটিং করার জিনিস হতে পারে, তবে কষ্ট কিছুতেই মার্কেটিং করার মত কিছু নয়। কষ্ট লুকিয়ে রাখতে হয়। অন্যের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলার মানেই হল, নিজের কষ্টকে অন্যের কাছে হাল্কা করে দেয়া। পৃথিবীর কেউই আসলে অন্যের কষ্টের তেমন একটা দাম দেয় না। মুখে সহানুভূতি দেখায় হয়তো, তবু সে সহানুভূতির সাথে আন্তরিকতার সংযোগ থাকে খুব কমই। তাছাড়া, সান্ত্বনা আর সহানুভূতি কুড়িয়ে কষ্ট কি কমে আদৌ? বরং, এমনই বেশি হয়, কাউকে নিজের কষ্টের কথা বললাম, উনি তা এমন কাউকে বিকৃত করে বলে দিলেন যিনি পরবর্তীতে সেটাকে পুঁজি করে আমার দুর্বলতার সুযোগ নেবেন। বড়ই রহস্যময় কোনও কারণে মানুষ নিষ্ঠুরতা পছন্দ করে। তাই বরং, কান্না গিলে হাসার নামই জীবন! যা-ই হোক, এই অসুস্থতার মাঝেও ১৯৯৮ সালে আপু এমএ পাশ করে বেশ ভাল মার্কস নিয়েই। তারপর থেকে সংসারের হাল ধরতে স্কুলে চাকরি করেছে, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়েছে। বিদ্যাপীঠ কোচিং হোম, সূর্যাবর্ত একাডেমী, ডিআরসি---এইসব। সেদিন আপুর সাথে তাই আপার দেখা হয়নি। ভাইয়া বাসায় ছিল, তাই ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছিল। মনে আছে, যাবার সময় আপা বলেছিলেন, “খুব ভাল, বড়বোন যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, তুমিও পড়বে। আগেরটা যেদিকে যায় পিছেরটাও সেদিক যাবে।”
সেদিনের সে কথার অর্থ হয়তো তেমন কিছু গুরুত্ব বহন করে না, তবু আমার মনে হয়, মানুষের কিছু-কিছু কথা দোয়ার মতই কাজ করে। সেদিনের ছোট্ট আমিও কোনওকিছু না বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী, ওখানে পড়লে কী হয়, এসবের কিছুই আমি জানতাম না, শুধু জানতাম, আমার সবচাইতে প্রিয় ম্যাডাম আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বলেছেন, তাই যে করেই হোক, আমাকে তা-ই করতে হবে। পরে মিলিয়ে দেখলাম, সেই কথাটি আসলেই সত্য হয়েছিল। আমরা, মানে আমার শানু চাচা, যিনি ছিলেন আমার একমাত্র চাচা যিনি বাংলাদেশে থাকতেন, তাঁর ছেলেমেয়ে, মানে চাচাত বোন-ভাইরাও ঢাবি থেকে পাস করেছিল। আমাদের পরিবারের সবার বড় সন্তান রনি ভাইয়া অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স আর সবচাইতে অমনোযোগী মেয়েটি, মানে রুকু আপু ফাইন আর্টস থেকে মাস্টার্স করেছেন। দুই জনই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে চাকরি করছেন। আগে একটা সময় (আমার জন্মের আগের কথা বলছি) আমাদের পূর্ব মাহীসন্তোষের বাসাতেই চাচারাও একসাথে থাকতেন। শানু চাচা ফুড ইন্সপেক্টর ছিলেন বলে সরকারি কোয়াটার্স পেয়েছিলেন শেষের দিকে। তখন উনি আগারগাঁও কোয়াটার্সে চলে যান। আর বাবা ছোটভাই হয়েও যে বড়ভাইকে পড়ালেখার আর সংসার চালানোর খরচ পর্যন্ত দিতেন একসময়, সেই বড়ভাইয়ের তেমন কোনও সহযোগিতা পাননি নিজের বিপদের দিনে। আসলে চাচাও তো সরকারি চাকরি করতেন। সেখানে খুব সীমিত আয়, তাঁদের নিজেদেরও তো চলতে হয়। পৃথিবীটা এমনই। নিজের স্বার্থ নিজে না দেখলে তা আর কেউ দেখে না। অন্যের সাহায্যে আর কত দিনই বা চলা যায়! আর অন্য কেউ আমাকে সাহায্য করবেই বা কেন? কার এমন কী দায় পড়েছে? আমি উনার প্রয়োজনের সময় হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, এটা যেমনি আমার ব্যাপার, ঠিক তেমনি আমার প্রয়োজনের সময়ে উনি হাত বাড়িয়ে দেবেন কি দেবেন না, সেটাও সম্পূর্ণই উনার নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার। বরং বিপদের দিনে এমন মানুষকেই বেশি পাশে পাওয়া যায়, যাদের নিয়ে ভাববার মত সময়ই হয়তো কখনও আমি দিইনি। আমি যার বিপদের সময় পাশে ছিলাম, আমার বিপদের সময় উনার কাছ থেকে সবচাইতে ভাল যে প্রত্যাশাটি আমি করতে পারি, তা হল, উনি যেন উনার কোনও কাজের মাধ্যমে আমার বিপদটি আর বাড়িয়ে না দেন। এক ছোটভাই, যার পাশে আমি সবসময়ই আর্থিক ও মানসিকভাবে থেকেছি, এমনকি ওর বিয়ের সময় পর্যন্ত প্রায় পুরো টাকাটাই আমিই দিয়েছি, সে-ই কিনা আমার বিপদের সময় কিছু কাজের মাধ্যমে আমার বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে। আরেক বন্ধু, যার মানসিক কষ্টের দিনগুলিতে আমি তাকে সময় দিয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সে-ই আমার বিপদের দিনে আমার সম্পর্কে আজেবাজে কথা ছড়িয়েছে। জীবনের এমন সব কঠিন পাঠ আমার আরও ছোট্টবেলাতেই নেয়া হয়ে গেছে। আমি জেনেছি, মানুষ অকৃতজ্ঞ ও কৃতঘ্ন, সুযোগ পেলেই সবার আগে মানুষ উপকারীর ক্ষতি করে ফেলে, এবং এসব জেনেই আমি মানুষকে সবসময়ই সাহায্য করে গেছি। কারণ, কাউকে সাহায্য করতে পারলে আমার খুব আনন্দ হয়।
চাচা সেভাবে পাশে দাঁড়াতে না পারলেও আমার মামারা পাশে ছিলেন সর্বতোভাবে। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের আসল কাজগুলিতে ততটা সার্থক হতে পারেননি। আজ আমরা সত্যিই প্রায় সব ভাইবোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পাস করে বের হয়েছি, যে যে যার যার নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমার সবচেয়ে ছোট যে ভাইটা, তার জন্ম হয় আমি যখন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই, তখন। ওর খাবার জন্য দুধ দিতে পারিনি কেউই, কারণ মায়ের বুকে দুধ আসছিল না তখন, মার হাতেপায়ে পানি এসে গিয়েছিল অপুষ্টির কারণে, সেই ভাইটাকে আমি নিজে হাতে তখন কেবল চিনিমেশানো পানি মুখে তুলে কান্না থামাতাম। শুধু দুধ কেনার পয়সা ছিল না বলে ওকে পানি খাইয়ে শান্ত রাখতাম। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে, যখন প্রতিটি দিন শুরু হত আমার বাবা-মা’র ঝগড়া আর কলহে, এরই মাঝে দেখতে হত, বাবার পেশির জোরের কাছে লাঞ্ছিত, বিপর্যস্ত, অপমানিত, পরাজিত আমার মা’কে। বাবার সকল অক্ষমতা আর অভিমানের বলি হতে হত মাকেই। এই অপমান নীরবে বাবার প্রতি আমাকে ক্রমেই বিদ্বেষপরায়ণ করে তোলে। যা-ই হোক, আমার ভাইয়ের কথায় ছিলাম। সে আমাদের পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসকরা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, সেও আজ চাকরি করছে, ভাল মাইনে পাচ্ছে, পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমরা কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছি। আজ সত্যি তাই পেছন ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না। তবুও কখনও-কখনও কষ্ট ফিরে আসতে চায়। অবশ্য, সে কষ্ট অন্য রকমের কষ্ট। সব পেয়ে গেলেও অনেক রকমের কষ্ট থাকে। কিছু মানুষকে দেখলে বড় সুখী মনে হয়, কারণ ওরা হাসি দিয়ে কৌশলে কষ্ট লুকিয়ে রাখে। কী আছে, কী নেই, তার উপর কষ্ট পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে না। কষ্টের একমাত্র ধর্মই হচ্ছে, যতক্ষণ নিঃশ্বাস আছে, ততক্ষণ কষ্ট থাকবেই। কষ্ট দূর করা অসম্ভব, তবে হ্যাঁ, কষ্টকে কমানো কিংবা কষ্টকে মানিয়ে চলার অভ্যাস করা সম্ভব।
সেদিন রুমানা আপা চলে যাওয়ার সময় মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, “কী, আপাকে একটু এগিয়েও দিয়ে আসবে না, তুমি এত অসামাজিক, কলমি?” আর বলেই জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমি লজ্জায় লাল হয়ে আপাকে রিক্সা পর্যন্ত ভাইয়ার সাথে গিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসি। সেই সময় আমি এতই বোকা ছিলাম যে বাসা পর্যন্ত যে রিক্সায়ও আসা যায়, সেটাই মাথায় আসেনি। আমি হেঁটে যাই, আসি, তাই আপাকেও কষ্ট দিয়ে একইভাবে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। যাবার সময় আপা আরেকবার আমাকে জড়িয়ে নিয়ে চুমু খেলেন। আর আপার এই আদরটাই আমাকে উনার কাছে অতো বেশি টানতো। সত্যি কথা এই যে, এত বড় হয়েছি, মা কোনওদিনও আমাদের ভাইবোনদের কাউকে জড়িয়ে ধরেননি, আদর করে চুমু খাননি। এটার জন্য দারিদ্র্য দায়ী, নাকি আমার মায়ের লাজুক স্বভাব, তার উত্তর আমি আজও পাইনি। আমাদের খুব ইচ্ছে করতো, যাতে মা আমাদের একটু হলেও আদর করেন, কিন্তু উনি কখনওই তা করেননি। এমনকি আমার ছোটভাইটি ঘুমিয়ে পড়ার পরও মাকে কখনওই ওকে কপালে, চোখে, গালে চুমু খেতে দেখিনি। মায়ের মধ্যে এই আদর করার ব্যাপারটাই হয়তো ছিল না অমন করে। আমি খুব করে চাইতাম, যাতে রুমানা আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন। উনার সে আদরে আমি মায়ের আদর খুঁজে পেতাম যেন! মানুষ বড় আদরের কাঙাল হয়। একটুও আদর না পেলে সে পাগল হয়ে ওঠে।
মনে পড়ে সেই সব দিনগুলো.........সেসময় ছিল ছিল যুদ্ধের সময়। আমাদের সবার একটাই কাজ ছিল---দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকা আর সামনে এগুনোর চেষ্টা করা। আমাদের কখনও রিপুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়নি। যাদের চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন থাকে, তারা খুব দরিদ্র হলেও কোনও রিপুই তাদের গ্রাস করতে পারে না। আমাদের একমাত্র কাজই ছিল, যে করেই হোক, টিকে থাকা, হারিয়ে না যাওয়া, আর যত কষ্টই হোক প্রয়োজনে না খেয়ে হলেও পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা। আমরাও তা-ই করছিলাম, আমার মায়ের চোখের জল মুছে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মা আজও যখন কাঁদেন, কেবল আমার বিয়ে হচ্ছে না দেখে, রাতের পর রাত জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন, তখন নিজের সকল অর্জনই খুব তুচ্ছ লাগে। যে টিনের ভাঙা বাড়িটাতে রুমানা আপাকে নিয়ে এসেছিলাম, যে বাড়িটায় একটু বৃষ্টিতেই পানি টিনের চালের ফুটো কিংবা পুরনো টিন গড়িয়ে পড়ে ভিজত বিছানা-বালিশ, ভাসত কাঁচা মেঝে, তা আজ পাকা দালান হয়েছে। খুব ইচ্ছে করে, ইসস্ রুমানা আপাকে আরেকবার আমারদের বাড়িতে নিয়ে আসতে পারতাম! মায়ের স্বপ্নের বাড়ির নাম রাখা হয়েছে ‘নীড়’। এই সব কিছুর পরও লুকানো কষ্টরা যেন শ্বাস চেপে ধরতে চায় বারেবারে। কিছুকিছু কষ্ট আছে এমন, সেগুলি যে কীসের কষ্ট, নিজেই বুঝি না।
রুমানা আপা ছিলেন আমার জীবনের ধ্রুবতারা। ক্লাস সেভেনে ওঠার সাথেসাথেই আপা বদলি হয়ে চলে গেলেন নোয়াখালীর সেনবাগ উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুলে আপার মেয়ে ততদিনে আমার কাছে আঁকার ক্লাস শুরু করেছে। ড্রইং-এ আমি হায়েস্ট মার্ক পেয়েছিলাম বলে আপা উনার মেয়ে সিমন্তিকে আঁকা দেখিয়ে দিতে বলেছিলেন আমাকে, আমি ক্লাস শেষে একটা রুমে সিমন্তিকে ড্রইং খাতায় আঁকতে শিখাই। আমি নিজে কিছু টেকনিক শিখেছিলাম বিটিভি’র মুস্তাফা মনোয়ারের ‘এসো আঁকি’ অনুষ্ঠান থেকে। সেসময় যে কত যত্ন করে সিমন্তিকে আঁকা শেখাতাম! মনে হত, এর চাইতে জরুরি কাজ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। কেউ আমার ক্ষমতার উপর আস্থা রেখে আমাকে কোনও একটা কাজ করতে বলেছেন, এটা অনেক সম্মানের একটা ব্যাপার। আমি মনপ্রাণ ঢেলে সিমন্তিকে আঁকাআঁকি শেখাতাম। আপা চলে যাবেন, আমার সে কী কষ্ট! বিদায়ের দিনে আপার জন্য নিজের হাতে তৈরি একটা কার্ড, আর পাট-কাঠ-মাটি দিয়ে নিজের ডিজাইন করে বানানো একসেট গহনা উপহার দিয়েছিলাম। সে উপহার ছিল গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মতন। আমি যা পারতাম, তা আপার জন্যই পারতাম। এই যেমন, খুব বাজে কিছু আঁকলাম, আপা খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতেন, “বাহ্! কী সুন্দর এঁকেছ! তুমি চেষ্টা করলে তো এর চাইতে দারুণ আঁকতে পারবে!” একটা মাটির পুতুল বানিয়ে স্কুলে নিয়ে রুমানা আপাকে দেখালাম, আর অমনিই উনি বলে উঠবেনই, “দেখি, দেখি! কত সুন্দর বানিয়েছ! এত সুন্দর পুতুল তো দোকানেও পাওয়া যায় না! সামনের দিন আরেকটা নিয়ে এসো তো, লক্ষ্মীসোনা!” উনি এই ম্যাজিকটা খুব ভাল করে জানতেন---বাচ্চাদের উৎসাহ দেয়া। শুধু উনার জন্যই আমি প্রতিবার যেকোনও কাজ করার সময় আগেরবারের চাইতে ভাল করে করার প্রাণপণ চেষ্টা করতাম। সবসময়ই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, যাতে রুমানা আপা আগেরবারের চাইতে বেশি খুশি হয়ে ওঠেন, আমাকে আরও বেশি আদর করেন।
পরবর্তীতে অসংখ্য চিঠির মাধ্যমে আপার সাথে যোগাযোগ রেখেছি। অনেক বছর ধরেই সে যোগাযোগ ছিল। মজার ব্যাপার হল, আমরা কখনও নিজেদের ফোন নম্বর চাইনি, তাই জানতামও না। যা যোগাযোগ হত, সব চিঠিতেই। ২০১৬ সালের শেষের দিকে আপা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে এলেন। আমার ছোটাপুও সেখানে চাকরি করে। একদিন গিয়ে দেখা করে এলাম, সাথে ফোন নম্বর নিয়ে এলাম। মাঝেমধ্যে আপার সাথে ফোনে কথা হত, তবে চিঠি দেয়ানেয়ার কাজটি কখনও বন্ধ হয়নি। সিমন্তির খুব ভাল বিয়ে হয়েছে। সে এখন সম্ভবত কানাডায় থাকছে বরের সাথে। কদিন ধরেই আপাকে মনে পড়ছে। আপাকে এবার ঈদের উপহার দিব ঠিক করলাম। আপার এই অসামাজিক স্নেহের ছাত্রীটি সাহস করে আজ আপাকে ফোন দিয়ে বারিধারার ফ্লাটের ঠিকানাও নিয়েছে। বেঁচে থাকলে কাল সে ঠিকই পছন্দের শাড়ি নিয়ে আপার পায়ের ধুলা আরেকবার নিয়ে আসবে।
একজন রুমানা জামান চৌধুরী, কলমি নামের বোকা মেয়েটা একটা সময় চোখ বুজলে যাকে নিজের মায়ের আগে উজ্জ্বল রূপে দেখতে পেত!
রুমানা আপা বাতিঘর হয়ে আমার জীবনে ছিলেন সবসময়ই। যখনই কোনও সংশয়ে কিংবা বিপদে পড়েছি, আপার কাছ থেকে পরামর্শ আর সাহস পেয়েছি। জীবনে আঁধার এলে আপা আলো হয়ে পাশে থেকেছেন নিরন্তর।
আচ্ছা, একটা সম্পর্কে হয়তো দুজন মানুষের অবস্থান আর যোগ্যতাই সবকিছু নির্ধারণ করে দেয়, তাই না? সবকিছু বলতে, এই যেমন, ওই দুজনের কারও থাকা কিংবা চলে যাওয়া। ভার্সিটিতে পড়ার একেবারে শেষের দিকে এক মানুষের প্রেমে পড়েছিলাম, তাকে ভালোবাসতাম। সেই মানুষটিই আমাকে এতটা দুঃখ দিয়েছিল, কষ্ট দিয়েছিল, যা হয়তো পৃথিবীর কাউকেই বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কেউ তা বুঝবেও না কখনও, সেটা আমি জানি। আজ যখন এতদিন পর আমি সে মানুষটার কথা লিখছি, তখন আমি কেমন শান্ত, স্থির, ধীর। সময় সবকিছু ঠিক করে দেয়। সময় দারুণ ব্যথা সারাতে পারে---শরীরের, মনের। আমি এখন আর আগের কলমি নেই। জীবনে, ভাবনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। সময় কতকিছু বদলে দেয়---অগ্রাধিকার, পছন্দ, দর্শন। একটা সময়ে সে মানুষটার কারণেই নিজেকে ভীষণ অযোগ্য আর ফেলনা ভাবতে শুরু করেছিলাম। ভালোবাসা দুর্বলকে শক্তিশালী করে, আর সবলকে অসহায় করে দেয়। আমি তাকে আমার পুরোটা দিয়েই ভালোবেসেছিলাম। সে আমার পৃথিবী ছিল, অথচ আমি তার পৃথিবীর কোথাও ছিলাম না। এখন এটা মনে এলে হাহাহাহা করে হাসি। সে বুয়েটে পড়ত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। তার ধারণা ছিল, নিজেকে অন্য কারও চাইতে যোগ্যতর ধরে নিয়ে তাকে হেয় করতে পারলেই বুঝি সে অনেক বড় একজন মানুষ হয়ে যায়। আমি তো ডাক্তার নই, ইঞ্জিনিয়ারও নই, সে কোন দুঃখে আমায় ভালোবাসবে? অথচ আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম, তার কাছে গিয়েছিলাম---অযাচিতভাবে কিংবা অনাহূত হয়ে নয়, তার ভালোবাসাটুকু দেখেই। আমি ভেবেছিলাম, সে আমাকে ভালোবাসতো। সে আমার জীবনের প্রথম প্রেম ছিল। এর আগে আমি কখনও কোনও ছেলেকে নিয়ে ভাবিও পর্যন্ত নি। নিজের জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে প্রেম ভালোবাসার চাইতে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার দাবি আমার কাছে অনেক বড় ছিল। আর সেই আমার কিনা ওকে ভুলে বাঁচতে কত কষ্ট হয়েছিল! ওকে ভুলতে থাকতে একটা মৃত্যুর সমান কষ্ট হত যেন! নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবি, কত দারিদ্র্য, তবু কত ভালোবাসা, তাও আবার ভুল মানুষের প্রতি!
ওর সাথে যখন পরিচয় হয়, তখন এমনিতেই কথা হতো। এরপর বন্ধুত্ব। একটা সময় সে চাইল যে, আমি তার প্রেমিকা হয়ে যাই। ওর সাথে যখন বন্ধুত্ব ছিল, তখনই ওর সম্পর্কে আমার বেশ কিছু বান্ধবীদের থেকে শুনেছিলাম যে, ও অনেক মেয়ের সাথেই খুব কাছাকাছি ধরনের কথাবার্তা বলতো। আমি আলাদা কিছু ছিলাম না ওর জীবনে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম শুনে। এটা জানার পর ভেবেছিলাম, ওর সাথে বন্ধুত্বটাও আর রাখবো না। কিন্তু তখন ও আমাকে এমন সব কথা বলতে শুরু করে যে শুনে মনে হল, ওর চাইতে বেশি ভালো বোধহয় আমাকে আর কেউ কখনও বাসবে না। হঠাৎ করেই আমাকে অনেক সময় দিতো তখন। কখনও টিউশনিতে না গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সাথে ঘুরে বেড়াত। আমার মন তবুও বাধা দিতো আমাকে। ভেতর থেকে কে যেন চিৎকার করে বলে যেত, “কলমি, তুই ভুল করছিস! সুখী মানুষ যেমনি একটা পোশাক নিয়েই সুখী, তেমনি ভাল মানুষ একটা চেহারা নিয়েই ভাল। যার মুখ ও মুখোশ দুইই লাগে, সে কখনও ভাল হতে পারে না। সময় থাকতে তুই সরে যা, নিজেকে বাঁচা!” কিন্তু আবেগের কাছে বিবেক হেরে গিয়েছিল সেদিন। ও ওর বন্ধুর মাধ্যমেও আমাকে খুব করে বলাতো। ওর বন্ধু এমনভাবে আমাকে বলত যেন আমাকে না পেলে ওর জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর একদিন ওর কাছ থেকে ওর মাকে নিয়ে কিছু কথা শুনি, যেগুলো শোনার পর ওর প্রতি আমার ভীষণ মায়া হতো। আর সেই মায়াটাই কাল হয়েছিল আমার জীবনে। ভুল কারও প্রতি মায়া বড় বাজে জিনিস! কষ্টের ব্যাপার এই, মাকে নিয়ে বলা ওর সেদিনের কথাগুলি বানানো ছিল। আজ বুঝি, সেদিন মন কেন বারবার বাধা দিচ্ছিল। এমনকি, আমি ওর সাথে বন্ধুত্বটুকুও তখন রাখবো না ভেবে ওকে সব জায়গায় ব্লকও করে দিয়েছিলাম। কি ফেসবুক, কি ভাইবার, কি হোয়াট্সঅ্যাপ, কি ইমো---সব জায়গাতেই। সেদিনই সে আমাকে ফোন করে যখন তার জীবনের কিছু ঘটনার কথা জানালো, তখন আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো, ভাবলাম, আচ্ছা, বন্ধুত্বটুকুই থাক না! কিন্তু সে শুধুমাত্র বন্ধুত্বই চাইতো না। আজ বুঝি, সে আসলে আমার কাছ থেকে সহানুভূতি পেতে চাইছিল। পরে জেনেছি, সেদিন সে আমাকে ৩-৪ ঘণ্টা যা যা বলেছিল, সেসব কথা সে আরও অনেককেই বলেছে, এবং ওদেরকে কাছেও পেয়েছে।
এরপর সম্পর্কের ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় সে তার এক বান্ধবীর প্রেমে পড়ে যায়। আমাকে ওর কথা বলত, ওর রূপের বর্ণনা দিত। সে আমাকে বলতো, আমার সাথে নাকি কথা বলে তার আর ভাল লাগে না, আমার সাথে শেয়ার করার মতো নাকি কিছুই নেই তার। তার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনার কোনও কিছুই নাকি সে আমার সাথে শেয়ার করতে পারবে না। আমার সাথে সম্পর্ক রেখেই বা কী লাভ তার? আমার ভীষণ কষ্ট হতো এসব শুনতে। সে তো জানতোই, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ি না। তাহলে আগে তার এসব মনে হয়নি কেন? আমি তবুও তার সব কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। ও যা-ই বলতো, আমার ভাল লাগতো। ওর পড়াশোনা নিয়ে কোনওকিছু বললেও আমি শুনতাম। যা-ই হোক, সে আবারও প্রেমে পড়লো ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়া তার আরেক বান্ধবীর। সে মেয়ে পড়ত কোনও এক প্রাইভেট ভার্সিটিতে। আমার বাবার টাকা থাকলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে, আর সেখানে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে হলে আমিও সেখানে নিশ্চয়ই পড়তে পারতাম। সেই মেয়ের আবার অন্য কাউকে পছন্দ ছিল। তা জেনেও সেই মেয়ের প্রতি তার নাকি চরম লেভেলের আবেগের ছিল। হয়তো সেই আবেগ তৈরি হয়েছিল আমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর এক-দুইমাস পর থেকেই। কেউকেউ আমাকে তা বলেওছিল, আমি ততটা আমলে নিইনি। এখন বুঝি, সেজন্যই আমাকে অতো অপমান আর অবহেলা করেছিল সে। লোকে প্রাসাদ পেয়ে গেলে কি আর কুটিরের দিকে ফিরেও দেখে? হয়তো সে কুটিরই একদিন তার শান্তির আশ্রয়স্থল ছিল, তবু যার মাথায় প্রাসাদ ঢুকে গেছে, তাকে কুটিরের মোহে আটকে রাখা সহজ নয়। সে আমায় দূরে সরিয়ে দিত, আবার সে-ই ক্ষমা চেয়ে সব ঠিকঠাক করে ফেলত। কিছু মানুষ আছে, ক্ষমা চাইতে যাদের একটুও খারাপ লাগে না। অথচ আমিও প্রতিবারই বোকার মত সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে তাকে ক্ষমা করে দিতাম।
সেসময় একএকটা দিন কাটানো আমার কাছে ছিল মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করার মতন। আমার মনে হতো, এর চাইতে মৃত্যুও বুঝি সহজ হবে। তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল মাত্র পাঁচ মাসের। সময়টা যা-ই হোক, সে সেই মানুষটা ছিল যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। সে আমার কাছে আমার কষ্টের চাইতেও আপন ছিল। তবে আজ আমি সৃষ্টিকর্তাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। তিনি অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তাইতো এখনও নিজেকে শক্তভাবে ধৈর্যের সাথে ধরে রাখতে পারছি। তার সাথে আমার কোনও যোগাযোগ নেই। যাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারতাম না, যাকে ঘিরেই জীবনের সব সমীকরণ মিলিয়ে নিতাম, সে নেই বলেই এখন দিব্যি ভাল আছি। আসলে পৃথিবীতে কারও জন্যই কেউ তেমন অপরিহার্য নয়। তার সাথে যোগাযোগ করবোও না আর কোনওদিনই। খুব অদ্ভুত লাগে ভাবতে। একসময় যে মানুষটার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে হবে ভেবে আমার পুরো পৃথিবীটাই ওলটপালট হয়ে যেতো, মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ত, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেত, আজ সেই মানুষটার সাথেই কোনও যোগাযোগ না করেই খুব ভাল আছি। বেঁচে থাকার জন্য তাকে আর প্রয়োজন হবে না আমার। বেঁচে থাকার জন্য যাকে লাগেই না, তার কাছে বারবার ছোটো হওয়ার কী মানে? আমি জানি, সে আমার স্বপ্নের মানুষটা নয়। সে এক ভুল মানুষ। আমার ভালোবাসায় কোনও ভুল ছিল না, তবে ভালোবাসার মানুষ চেনায় ভুল ছিল। শেষ যেদিন শুনেছিলাম ওর একটা নতুন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে, সেদিনের পর থেকেই আমি সরে গেছি ওর জীবন থেকে। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আর এই অপেক্ষায় কিছু হবে না, যাবার সময় হয়ে গেছে। যাকে আমি আমার জীবন ভাবি, তারই জীবনে অপশন হয়ে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়। মজার ব্যাপার, সম্প্রতি তার নতুন আরেকটা গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। মেয়েটা রাজশাহী মেডিক্যালে পড়ে। পাস করবে, ডাক্তার হবে। সে অবশ্যই আমার চাইতে অনেক যোগ্য। অন্তত একজন ইঞ্জিনিয়ারের পাশে একজন ডাক্তারকেই মানায়! আমি একটা সাধারণ মেয়ে হয়ে ‘ভালোবাসা’র মতন এতো অসাধারণ কিছু কারও কাছ থেকে কীকরে চাইতে পারি? যদিও ওর ভালোবাসাটুকু চাইওনি, শুধু ওর পাশে থাকতেই চেয়েছিলাম। কাকে কার পাশে মানায়, কে কার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য, এসব নিয়ে সমাজের বড় বেমানান হাস্যকর কিছু নিয়ম আছে। যাদের পেছনে মেরুদণ্ডটা নেই, যাদের মনে ভালোবাসার দাবির চাইতে হিসেবের খেলার স্থান উপরে, তাদের এসব নিয়ম মেনে চলে জীবন কাটাতে হয়। সেসবের নিয়মের কাছে আমি হেরে গিয়েছিলাম! যা-ই হোক, ওর গার্লফ্রেন্ডের কথা যেদিন শুনলাম, সেদিন আর চিৎকার করে কাঁদার মত কিছু হয়নি। আমি তেমন অবাকও হইনি। আমি তো আমার বিবেকের রায়টা আগে পাত্তা দিইনি, তাই যা হয়েছে, তা-ই আমার প্রাপ্য ছিল। তবে মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছিল ঠিকই। আর মনে হচ্ছিল, কেউ যেন কানেকানে এসে বলছে, “এবার তোমার বাঁচার সময় এসে গেছে। এবার একটু শান্তি নিয়ে বাঁচো। আর ভুল পথের দিকে চেয়ে ভুল অপেক্ষা নয়! ঘুম ভেঙে ওঠো, বাঁচো!” আমি শুধু স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রেখে সেদিন সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছিলাম।
স্রষ্টা কখনওই চান না, তাঁর প্রিয় সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাক। কোনও না কোনও উছিলায় সৃষ্টিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। আমার জীবনে নানান সময়ে আমি নানান মানুষ কিংবা ঘটনার কাছ থেকে সাহস কিংবা কষ্ট পেয়ে শিখেছি। আমার কষ্টের ওই সময়টাতে আমার সব কথা আমি পৃথিবীর একজন মানুষের সাথেই শেয়ার করতাম। তিনি রুমানা আপা। উনি আমাকে শিখিয়েছেন, নিজেকে আর বাঁচার সুযোগ করে দেয়া যাবে না, কখনওই এতটা দেরি কারও জীবনে হয়ে যায় না। আমি তো সেসময় অন্ধ ছিলাম, তাই আমার চলার পথে হাতটা ধরে পথ চেনার জন্য একজনকে প্রয়োজন ছিল। রুমানা আপা ছিলেন সেই মানুষটি। “কলমি, কারও জন্য কষ্ট পেয়ে নিজের জীবনটাকে শেষ করে দেয়ার জন্য আমরা এ পৃথিবীতে আসিনি। মানবজন্ম বড় দুর্লভ, বড় দামি। তোমার যত আবেগ, যত অনুভূতি, যত কষ্ট, সেগুলিকে কখনওই কারও খেলনা হতে দিয়ো না। কিছু মানুষের প্রিয় খেলনাই হচ্ছে অন্যের জীবন। তাদের কাছ থেকে সবসময়ই দূরে থাকতে হয়। ওরা মানুষকে শোপিস ভাবে। কেউ যদি ওদের ফাঁদে একবার ধরা দেয়, তবে সে নিজের অজান্তেই ওদের শোকেসে নিজেকে আবিষ্কার করে। সে ওখানে অন্য পুতুলদের সাথে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, সে কান্না কেউ শুনতে পায় না। সে কান্না গলা দিয়ে বের হওয়ার আগেই কী একটা যেন ওকে কান্নাটা গিলে ফেলতে বাধ্য করে! তখন সে নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চায় খোলস থেকে, সে খোলস ভাঙে না কিছুতেই, শুধু নিজেরই ধাক্কায় বারবার নিচে পড়ে গিয়ে রক্তাক্ত হয়, আহত হয়। সে রক্তক্ষরণটুকুও কারও চোখে পড়ে না। কখনও বড় দেরি হয়ে যায়। তখন যে পালানোর পথটাও আর থাকে না! সরে এসো কলমি, নিজেকে মুক্ত করো। নইলে তুমি কখন যে ওই শোকেসের শোপিস হয়ে যাবে, বুঝতেই পারবে না।” আপার কোনও এক চিঠিতে লেখা এই কথাগুলি খুব দামি ছিল আমার জন্য। আমি হয়তো ওই কথাগুলি নিজেও বুঝতাম, তবু ওইসময়ে কারও কাছ থেকে কথাগুলি শোনা আমার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। প্রেমে পড়লে মানুষ শিশু হয়ে যায়, আর একটা শিশু চায়ই যে কেউ ওকে সত্যসহজ কথাটাই বুঝিয়ে বলুক!
এখন আমি বেশ ভাল আছি। সেও অনেক সুখে আছে, নতুন মানুষ নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে। আমি কখনও ভাবি, আজ আমি ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলে আমার জীবনের গল্পটাও অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু তাতে কী হতো? একটা ভুল মানুষের সাথে থাকা হতো। আহা, আমি ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হলে হয়তোবা নিজের হাতেই নিজের জীবনটাকে শেষ করে দিতাম! যা হয়েছে, তা-ই আমার জন্য ভাল। অনেকবার আত্মহত্যার কথা মাথায় এসেছিল, কিন্তু আমি বেঁচে থেকেছি নিজের পরিবারের জন্য, আর স্রষ্টার উপর এ বিশ্বাস রেখে যে একদিন একটা সুন্দর দিন আসবেই। এবং, একজন রুমানা জামান চৌধুরী’র জন্য, যিনি নিজেই জানেন না, তাঁর আচরণ আর কথার ক্ষমতা কতখানি! উনি আমাকে শিখিয়েছেন, আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্যে। আর ভালোবাসা? সেটা নাহয় না-ই বা পেলাম আর। মানুষ তো এক জীবনে সবকিছু পায় না। বাস্তবটা এখন বেশ ভালই বুঝি। এই পৃথিবীতে ভালোবাসার দাম হয়তো নেই খুব একটা, তবে বেঁচে থাকার দাম আছে---সময় হলেই জীবন দামটা ঠিকই দিয়ে দেয়।
জানি সবই, বুঝিও হয়তো সবই। তবু কোথায় যেন কী একটা অন্যরকমের খারাপলাগা কাজ করে। মনে হয়, ইসস্ যদি অতীতে ফিরে গিয়ে ওই মানুষটাকেই মুছে ফেলতে পারতাম। জীবন থেকে মানুষ চলে যায়, তবু জীবন তো ঠিকই রয়ে যায়, সাথে রয়ে যায় ওই চলেযাওয়া মানুষটাও। কিছু একটা বদলে ফেলতে পারতাম! এও জানি, তা সম্ভব নয়। অতীত অতীতেই থেকে যাবে---সুন্দরভাবে, কিংবা অসুন্দরভাবে। যারা খুব নিঃশব্দে একটা আত্মাকে খুন করে রেখে যেতে পারে, দেখছি, তারা খুব ভালও থাকে। ফেলেআসা কোনওকিছুই আর তাদের মনে থাকে না। একেবারেই কিচ্ছু না! এখন আমি নীরবে ওর সুখ দেখি, দেখি, ওরা দুজন দুজনকে খুব ভালোওবাসে হয়তো। আমি চাই, ওরা ভাল থাকুক। আমার ভাগ্যে যা-ই থাকুক, অন্তত ওরা তো সুখী হোক! এই পৃথিবীতে সবারই ভাগ্য হয় না নিজের ভালোবাসার মানুষটার সাথে সুখী হবার। ওদের সেই ভাগ্যটা হোক। এখন তার বন্ধুবান্ধব সকলেই জানে তাদের প্রেমের কথা। ওরা নাকি পারফেক্ট কাপল! আর আমি ভাবি, আমার হাসিটা, যাকে আমি চেয়েছি সারাজীবন ধরেই, সে হাসি পুরনো আমি’র সাথেই মরে গেছে হয়তো। এই মানুষটা সেই মানুষটা নয়, যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। সময় কতো সুন্দরভাবে সব বদলে দেয়। আমার সময়গুলো এখন সুন্দর। আর কিছু থাক না থাক, নিজের মানসিক শান্তিটুকু তো আছে। রুমানা আপার একটা কথা আমাকে খুব শান্তি দেয়---তিনি যা করেন, আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। আমরা তো শুধু বর্তমানটা দেখতে পাই, সামনের দিনে কী আছে, কোনটা আমাদের জন্য ভাল, কোনটা খারাপ, সেটা তো আমরা জানি না। একমাত্র তিনিই জানেন, কী হলে আমাদের জন্য ভাল হয়। যদি তোমার নিয়ত ঠিক থাকে, তবে তুমি নিশ্চিত থেকো, তোমার সাথে যা হয়েছে, তা তোমার ভালর জন্যই হয়েছে।
ও প্রায়ই বলত, “যেখানে-সেখানে ঢিল ছোঁড়া উচিত। যদি লেগে যায়! অসুবিধা কোথায়?” এমন কথাও একটা উচ্চশিক্ষিত ছেলে ভাবতে পারে! অবশ্য, ওর কাছে ভালোবাসাটাসা তেমন কিছু নয়, একজন উচ্চ ডিগ্রিধারী সঙ্গী পেলেই তাকে সাথে নিয়ে ও জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে!
মাঝেমধ্যে তবু ওকে মনে করে অনেককিছু লিখতে বসি, পুরনো অভ্যেস তো, তাই। ফিরে আসি, লিখি না। ভাবি, কেন লিখব? আমি সব ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ দুম্ করে একদিন ওর সাথে দেখা হয়ে গেলে ওকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞেস করে বসব, যা দিয়েছিলাম পরম ভালোবাসায়, তা অক্ষত রেখেছ তো?
“আমি জানি, ভুলে যাওয়া, ভুলে থাকা, দুটোই খুব কঠিন কাজ। জীবনে বাঁচতে হলে আমাদের যা করতে হয়, হোক ইচ্ছেয় কিংবা অনিচ্ছেয়---যা কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা আমাদের মনের মত হবে না, এটাই স্বাভাবিক। আমি জানি, তুমি যে কষ্টটা পাচ্ছ, এবং পাবেও হয়তো, তা তুমি সত্যিই ডিজার্ভ কর না। কষ্ট যদি মানুষ চিনত, তাহলে তো হতই। কষ্টের চোখ নেই, কষ্ট অন্ধ। তুমি কী ডিজার্ভ কর, কী ডিজার্ভ কর না, সেটা সম্পূর্ণই তোমার নিজস্ব বিচারবিবেচনা। ওটা দিয়ে জীবন চলে না। তুমি যা পাচ্ছ, তা-ই সত্য। আর সত্যকে যত সহজে গ্রহণ করতে পারবে, জীবনকাটানো ততই সহজ হবে। অতীতকে চাইলেই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না, জীবন থাকলে তার সাথে অতীত থেকেই যাবে। থাকুক না সে, তবে যেন সে আবারও নিষ্ঠুর খুনি হয়ে না ওঠে! এ খুনের হাত থেকে একমাত্র তুমিই নিজেকে বাঁচাতে পারো। একই আঘাতে বারবার মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার নামই পরিপক্বতা। স্মরণ করো, প্রয়োজনে আপ্লুতও হও, তবু ধ্বংস হয়ো না। বড় হও, শুধুই বেড়ে ওঠো না।”
মুগ্ধ হয়ে ভাবি, একজন রুমানা জামান চৌধুরী কতটা ঠিক বলেন!