অভ্যর্থনা-কথন

(কলিগদের সম্পর্কে আমাদের প্রায় সকলেরই একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা হলো এই, তাঁদের মধ্যে তেমন কেউই আমাদের জন্য আন্তরিকভাবে ভাবেন না। তাঁদের বেলাতেও আমরা ওরকমই। ফলে কলিগদের মধ্যকার সম্পর্কটা মোটামুটি অফিসিয়ালই বলা চলে। চাকরি করে বাঁচতে হয় যাঁদের, এমন অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে।


এর মধ্যেও, আমাদের সবারই এমন কিছু কলিগ আছেন, যাঁরা তাঁদের ভাবনায় আমাদের রাখেন, আমরাও তাঁদের জন্য আন্তরিক থাকি। এটা এক ধরনের অভ্যস্ততা। এ-অভ্যস্ততার নাম বোধহয় ‘বন্ধুত্ব’। সৌভাগ্যক্রমে, এমন কিছু কলিগ-বন্ধু আমারও আছেন। আমি জানি, আমার বিপদের দিনে আমি তাঁদের পাশে পাব। তাঁরা জানেন, তাঁদের বিপদের দিনে তাঁরা আমাকে পাশে পাবেন।


তেমনই একজন তাঁর লেখা কিছু গল্প একসাথে ছাপবেন, সেই গল্প-সংকলনের বইটি আসছে একুশে বইমেলায় বের হবে। তিনি তাঁর প্রকাশিতব্য বইয়ের সম্মুখ-প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপে ছাপবার জন্য বই সম্পর্কে কিছু কথা লিখে দিতে বললেন। গল্পগুলি পড়ে অভ্যর্থনা-কথনটি লিখে দিলাম; কিছুটা গদ্যকবিতার আদলে। বইয়ের গল্পগুলির নাম কবিতায় অবিকৃত রেখেছি উদ্ধৃতিচিহ্নের ভেতরে।


অনুরোধ রইল, নিচের লেখাটি কবিতা হিসেবেই পড়ুন। কেমন লাগল জানালে ভালো লাগবে।)


কোনও জুলাইয়ের এক সন্ধে যশোররোডের ধারে চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে কারও সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছিলাম, মনে পড়ে। আজও স্মৃতির দেয়ালে সেই একটা মুহূর্ত আটকে আছে: ‘জুলাই অন যশোররোড’!
তখনও তোমায় খুঁজছিলাম, এখনও ‘খুঁজি তোমায়’। তুমিই বলো, আর কীই-বা করার থাকে একজন ব্যর্থ মানুষের!
দিন কেটে যায়, তবু ঠিক ফুরোয় না যেন! আজও ‘বর্ষার সেই দিন’টা কখনও কখনও ফিরে আসে।
বৃষ্টি তো হয়ই--ভেতরে, বাইরে! বিশ্বাস করো, শুধু ‘তোমার জন্য’ই বৃষ্টিটা নামে…আমার ব্যক্তিগত উঠোনের গায়ে!
কোনও এক ‘নীলার নীলপদ্ম’গুলি কোথাও যেন কাঁদে, সে ব্যর্থ-কান্নার অস্ফুট শব্দ আমি ঠিক শুনতে পাই।
বাঁচতে চাইলে কাঁদতে হয়, কান্না শুনতে হয়। অবশ্য, জীবনের চিরন্তন ‘কানামাছি’-খেলায় কখনওবা একেকটা ‘সারপ্রাইজ’ও জুটে যায়!
হ্যাঁ, জীবন নামের সত্তাটি তখন বাস্তবিকই হয়ে ওঠে ‘গল্পের মতোই সত্যি’! সৌভাগ্যের ডানায় ভর করে সময় ওড়ে, জীবন পোড়ে।
বয়ে-চলা কাল প্রায়ই স্থির থাকতে দেয় না, কিছু কিছু অস্তিত্ব না-বলেকয়েই ‘মার্ডার’ হয়ে-যাওয়াদের লিস্টে নাম লেখায়; তখন…এমনকী, ‘ভালোবাসার শ্বেতপ্রহর’ দেখতে দেখতেও ক্লান্তি ধরে যায়!
…এইসব মনে এলে অসহায় লাগে। সত্যিই লাগে!
কোনও এক ‘সিঙ্গাপুর-ফেরত আনোয়ার হোসেন’ বিরক্ত হয়ে ‘নাফিজের খোঁজে’ বেরিয়ে পড়ে। কীসের সে-বিরক্তি? কেন আনোয়াররা একটাসময় ধৈর্য কিংবা বিশ্বাস আর রাখতে পারে না? তবে কি সময় সামনের দিকে হাঁটে ‘ধোঁকা’ দেবে বলেই? দিনের শেষে প্রতারকের জীবনই আরামের হয়তো, কে জানে!
‘তুশির জন্য’ কেউ ‘অপেক্ষা’ করে থাকতে পারে, সে-কথা হয়তো তুশির মাথায়ই কখনও আসে না, তবুও থাকে তো! কোনও এক ‘প্রিয়জন’ জীবনের সব প্রয়োজনকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে তুশির সন্তানের ‘বাবা’ হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। হ্যাঁ, আছেই! পৃথিবীতে কোথাও-না-কোথাও কেউ-না-কেউ কারও জন্য প্রতীক্ষায় থাকে, তাই তো পৃথিবীটা আজও বাসযোগ্য!
এইসব ভাবি, ভাবতেই থাকি, একসময় কোথায় যেন চলে যাই…এমন কোথাও, যেখান থেকে কেউ বুঝি আর ফিরে আসতে চায় না, ঠিক তখুনিই ওপার থেকে বাবা যেন ডাক দিয়ে বলে, ‘খোকা’, আর দূরে যাসনে, মানিক! আমায় মানিক বলে আর কেউ ডাকে না, এক বাবাই ডাকত!
…সে কী যে ‘মায়া’, আহা, বলে বোঝানো যায় না! পৃথিবীর সব ‘হৃদিতা’কে দ্বিধা না-রেখেই গুডবাই বলে দেওয়া যায় তখন!
বয়েসযাপনের ছলে যা বুঝেছি, ভালোবাসতে হলে এক বেপরোয়া সুপারম্যান হতেই হয়, এমন নয়! আমার মতন ছাপোষা মানুষকেও…যার মধ্যে ভালোবাসতে পারার একটুখানিও ক্ষমতা আছে…‘সুপারম্যান ভার্সাস জেন্টলম্যান’--পৃথিবীর এই চিরায়ত দ্বন্দ্বটি গ্রাস করে দিতে পারে না, জেন্টলম্যান-সত্তা নিয়েও দ্বিধা ভেঙে সে টুপ্‌ করে প্রেমে পড়ে যায়!
সে-প্রশ্রয়ে আমি দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকি---কোনও ‘গুনিম’ কিংবা স্রষ্টার প্রেরিতপুরুষের অনুগ্রহে নয়, নিজের নিয়মে, নিজের ধরনে। আমি হেঁটে যাই, হোঁচট খাই, সামলে নিয়ে আবারও হাঁটি। দূরে সরে-যাওয়া এক পলাতকার ইশারা কোনও নিভৃত অবসরে অনুভবে এলে ভাবি, আফসোসে কাটছে যে-জীবন, সে-জীবনের আবার পিছুটান কীসের?