অলক্ষিত শৈশবদাগ

আধুনিক শহুরে ফ্যামিলিগুলো সাধারণত নিউক্লিয়ার। হাজব্যান্ড আর ওয়াইফ। দুজনই জব করে, কাজের প্রয়োজনে ওদের বাইরে থাকতে হয়। বাসায় কে থাকে? কাজের বুয়া; কখনও-কখনও মালি, ড্রাইভার। পাশের বাসার লোকজন মাঝে-মাঝে আসে। এই তো! ছেলেটাও ব্যস্ত, মেয়েটাও। খুউব ব্যস্ত। সন্ধ্যায় দেখা হয় দুজনার। খুনসুটি, কখনও-কখনও ঘুরতে যাওয়া, একসাথে খাওয়া, ঘুমিয়ে পড়া। এমনই তো হয়, না? ছেলেটার বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে থাকে, কিংবা অন্য জায়গায়। এমনি করেই আধুনিক মানুষের ফুড়ুৎফারুৎ চড়ুইয়ের জীবন চলে।

একটাসময়ে ছেলেটা আর ছেলে থাকে না, বাবা হয়। মেয়েটা আর মেয়ে থাকে না, মা হয়। তখন কী হয়? মেয়েটা কয়েক মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করে। এরপর আবার অফিস। ছোট্ট বাবুটির সাথে সময় কাটানোর সময়টা কমে যায় ব্যস্ততায়। ওদের সন্তান বড় হয় কাজের বুয়ার হাতে, মালির হাতে, ড্রাইভারের হাতে। পাশের বাসার লোকজনও ওকে আদর করে। দিনের সিংহভাগ সময়টাতে বাবা-মা বাদে বাকি সবার আদরে ও বড় হয়। ওরা ব্যস্ত যে! আদর নেই, তবে আর সব অনুষঙ্গ আছে। কিন্তু ছোট্টো মানুষ আদর ছাড়া কীভাবে বাঁচে? ধরে নিলাম, ওদের একটা মেয়ে হয়েছে। ছোট্টো পুতুলের মত মেয়ে। অবাক দৃষ্টিতে পৃথিবীটাকে নিজের মতো করে প্রতিদিনই একটু-একটু করে আবিষ্কার করে। আয়নার সাথে খেলতে-খেলতে প্রতিদিনই একটু-একটু করে বড় হয়। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়ায়, পাখির পালকের মতো নরোম হাতে ওর চারপাশের পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে দেখতে-দেখতে বেড়ে ওঠে। কিছুই বোঝে না সে। সকালে বাবা-মা ছোট্ট পরীটার চোখে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যায়, আরও পরে ও জেগে ওঠে আর একটুখানি আদরের জন্য বসে থাকে সন্ধ্যা অবধি। ওরা অফিস থেকে ফেরার সময় ওদের খুকুমণির জন্য কত কী কিনে আনে! সামর্থ্যের মধ্যে থাকা পৃথিবীর সবচাইতে দামি-দামি পার্থিব সব আদর—কেনা যায়, ছোঁয়া যায়, ছুঁড়ে ফেলে দেয়াও যায়। এভাবেই কর্পোরেট বাবা-মা’র কর্পোরেট শিশু কর্পোরেট কালচারে বেড়ে ওঠে।

এসব হয়। আর কী হয়? ও ছোট্টো অসহায় মানুষ। সারাটা দিন বাসায়ই থাকে। প্রতিদিন একটু-একটু করে বড় হয়। স্কুলে যাওয়ার বয়স হলে স্কুলে যায়, স্কুল থেকে বাসায় ফেরে। বাসায় ফিরে ওর কী কাজ? কার্টুন দেখা, খেলনা ভাঙা, বুয়ার সাথে এটাওটা বায়না করা। কখনও-কখনও বুয়া বকাটকা দিলে মনটা ছোট করে ফেলে, ঠোঁটদুটো উল্টে-উল্টে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, মনখারাপের কিছু মুহূর্তের পর সবকিছু ভুলে গিয়ে আবারও আপনমনে খেলতে থাকে। এই তো! ও ছেলেমেয়ের বিভেদ কী বোঝে? একা-একা থাকে। ও তো একজন খেলার সাথী পেলেই খুশি, না? ও চায়, ওকে কেউই বকবে না, চকোলেট কিনে দেবে, খেলনা ভেঙে ফেললেও কিছু বলবে না। ও নিজেই জানে না, কখনও জানার বয়স কিংবা প্রয়োজন হয়নি যে, ও একটা মেয়ে। মেয়েরা সবকিছু করতে পারে না। কিন্তু এসব ও বুঝবে কীভাবে? ওর আশেপাশের বড়রা কিন্তু সব বোঝে। ওরা বোঝে, ওর কর্পোরেট মা-বাবা পাশে নেই, কাজের বুয়াকে ‘ম্যানেজ করা’ কঠিন নয়। ওরা জানে, একটা চকোলেটের দাম খুব সামান্য। ওইটুকুতেও ‘অনেককিছু’ পাওয়া হয়ে যায় খুব সহজেই! ওরা ওকে আদর করে, অনেক বেশিই করে। মেয়েশিশুদের কদর বেশি, আদরটাদরও অসহ্য রকমের বেশি। ওরা কারা? পাশের বাসার কিশোর ছেলেটা, ওর বন্ধু, ওর ভাইয়া, বাসার মালি, ড্রাইভার, কদর্য টিচার, কাছের কিংবা দূরের সম্পর্কের আত্মীয় কিংবা অনাত্মীয়ও, ফ্যামিলিফ্রেন্ড এবং সব পরিচিত একই রকমের পুরনো রক্তের পুরুষমানুষ। মেয়েটা জানবে কীভাবে যে, ও ওদের কাছে কেন, কত দামি! মেয়েটার যে ছোট্টো কোনো বন্ধুও নেই, তাই খেলার সাথীও নেই। বড়রাই ওর খেলার সাথী। বড়রা খেলে, খেলায়। এসব চলতে থাকে। এর চাইতে কম পয়সায় ইন্দ্রিয়সুখ কেনা যায় নাকি? কখনও হঠাৎই বেশি সুখ পেয়ে গেলে, সে খুশিতে পরেরবার খুব বেশি পয়সা খরচ করতে ইচ্ছে হলে একটা বারবিডল কিনে দিতে হতে পারে। এইটুকুই তো! এর চাইতে সহজলভ্য ভোগ জগতে আর কী-ই বা আছে? সহজই তো, তাই না? মেয়েটা বুঝতেও পারবে না। এমনকি কখনও বোঝার মতো কিছু করে ফেললেও সমস্যা নেই। ওইটুকুন বাচ্চা ভয়েই তো কাউকে কিছু বলতে পারবে না; কিংবা, ওটা যে বলার মতো কিছু, এটাই বোঝার বুদ্ধিই তো ওর এখনও হয়নি। কেউই কোনোদিনও জানতে পারবে না; এমনকি বিয়ের পর স্বামীও না। এসব কথা যে বলা যায় না। চাপা কষ্টে বুকের ভেতরে চেপে রাখতে হয়। তাই ওর সাথে যখন ইচ্ছে তখন, যা ইচ্ছে তা-ই করা যাবে। বিনে পয়সায় ইন্দ্রিয়সুখের সহজ পসরা, তৃপ্তির অফুরান বেসাতি। সবার চোখে পড়ছে, অথচ কেউই দেখছে না।

মা খেয়ালই করবেন না। বাবা খেয়াল না করাটাকেই দায়িত্ব ভাববেন। ওরা ভীষণ ব্যস্ত তো! ওর খবর নেয়ার সময় কই? ও তো বড় হচ্ছেই! চোখের সামনে পুতুলটা বেড়ে উঠছে। কীভাবে উঠছে? সারাদিনের ক্লান্তি; পরেরদিন অফিসের কাজগুলোও তো গুছিয়ে নিতে হবে। আরো কিছু চাহিদাও তো থাকে; জৈবিক, কিংবা অজৈবিক। মেয়েটা দিব্যি সুস্থ আছে, সারাদিন কী কী করেছে, স্কুলে ম্যামরা কীভাবে হাসে, কীভাবে কথা বলে, কীভাবে বকে, তাও খুব গুছিয়ে বলছে, শরীরের কোথাও কিছু হয়েছে কিনা, সেটার খোঁজ কে রাখে! আমি এক মায়ের কথা জানি, যিনি উনার মেয়ের পিরিয়ড শুরু হওয়ার ২দিন পর সেটা জানতে পারেন। পাশের ফ্ল্যাটের এক কিশোরী প্রেগন্যান্ট হয়ে যাওয়ার খবর শুনে নিজের ৮ বছরের মেয়েকে রাগী-রাগী গলায় জিজ্ঞেস করেন, “এই! কেউ তোর সাথে ‘কিছু’ করে নাতো!” মেয়ে বলে, “না মা।” কী বলবে ও? সত্যি বললে মারও তো খেতে পারে। মা যে মিথ্যে শুনলেই খুশি। কত ব্যস্ত মা! ঝামেলাকে কে সেধে বুঝতে চায়? কাজ করতে হবে, কাজ! অনেক-অনেক উপরে উঠতে হবে। ইঁদুরদৌড়ে কে হারতে চায়? হাজব্যান্ডের কাছ থেকে পয়সা চাওয়া যাবে না। পয়সা চাইতে গেলে হাজব্যান্ড দুনিয়ার আজেবাজে জেরা করা শুরু করে। ও কি ফকিরনী নাকি? এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে আরেকজনের উপর ডিপেনডেন্ট হয়ে থাকার জন্য? ওরও তো একটা নিজস্ব সোসাইটি আছে। ওকেও অনেককিছু মেইনটেইন করেটরে চলতে হয়। ওর হাজব্যান্ডের মত ওরও কিছু সিক্রেট আছে। অল্পবয়সি মায়েদের হৃদয় সিক্রেটের মহাসমুদ্র। হাজব্যান্ডের কাছ থেকে পয়সা না চাইলে হাজব্যান্ড ওর সিক্রেটগুলো নিয়ে অতো ঘাঁটায় না। মেয়েদের চাকরি করার সুবিধে আছে। হাজব্যান্ডের সিক্রেট তো আরও বেশি! থাকুক কিছু সিক্রেট! ওরকম একটুআধটু থাকে! দুটো মানুষ নিজেদের মত করে সুখের নিপুণ অভিনয় করে চলে। ওরা যেন একই নদীর দুটো পাড়। সেতুও আছে। সেতু আছে, শুধু এইটুকুই সান্ত্বনা। ওরা সেতুটা বাঁধতে পারেনি, সেতু নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে নিজেই বাঁধা পড়েছে। সে সেতু ভাল নেই। ও দিনেদিনে ভাল-নেই’দের পৃথিবীতে বেড়ে উঠছে। শুধু ভাল আছে সেতুর খেলনাগুলো। হায়! আরও ভাল আছে সেতু যাদের খেলনা, সেই নোংরা বড়রা। ক্যারিয়ারিস্ট দম্পতির এটা ভাববার সময় নেই। অনেক কাজ। ব্যাংক ব্যালেন্স শক্ত করতে হবে। সেতুকে অসুস্থ করে রেখে ওর জন্যই সুস্থতার নানান আয়োজন। সেতু আছে, আলাদা পাড়দুটোকে আলাদা করে কেউ কিচ্ছুটি বুঝছে না, সব কিছু এইভাবেই বেশ ভাল আছে! সবাই দেখে ভাবে, আহা, বড় সুখে আছে। সোসাইটিতে চলতে গেলে এই গ্রহণযোগ্যতাটাই দরকার। সেতুতে ঘুণ ধরছে। হাজার বছরের পুরনো সে ঘুণপোকা! সেটা খেয়াল করার সময় নেই। সেতুটা ঘুণে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। অসময় এসে যাওয়ার আগে কারও হাতেই কোনও সময় নেই। নিয়ন আলোর স্বপ্নে বোনা কর্পোরেট সংসার। নিয়ন বাতির নিচে মৃত জোনাকিদের এলিজি রচিত হচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। জোনাকিদের মন ভাল নেই; ওরা আজ বড্ডো মৃত।

এভাবে করেই অনেক মেয়েশিশু বড় হচ্ছে। চাকরিজীবী দম্পতিরা, ব্যাপারটা ভেবে দেখেছেন কখনও? ওকে ঘিরেই তো আপনাদের ছোট্টো টোনাটুনির ঘর, তাই না? বড়ো যত্নেগড়া পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর পুতুলটি ঈশ্বর আপনাদের ছোট্টো ঘরে পাঠিয়েছেন। এই শ্রেষ্ঠ উপহারটি এতটা অবহেলায় পড়ে থাকবে কেন? শিশুরা বড় হয়। ওরা কী শুধু শরীরেই বেড়ে ওঠে? দামি-দামি ফল, দুধের কৌটা, পুতুল, জামা, খেলনা কিনে দিলেই বুঝি আপনার সোনামণিটা খুব ভাল থাকে? ওকে যে ছবির বইটা কিনে দিয়েছেন, সেটাতে ছোট্টো পুতুলটার ক’ফোঁটা চোখের জল শুকিয়ে মরে পড়ে আছে, সে খবর রাখবার সময় হয়েছে কখনও? ওর চারপাশের বড়দের এত ভাল ভাবছেন কেন? আপনি কি ছোটো ছিলেন না কখনও? আপনি কখনওই নীরব যৌন নিগ্রহের শিকার হননি? সেসব কথা ভুলে গেছেন? নাকি, ভুলে আছেন? নাকি, ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে? নাকি, ভুলে থাকার অভিনয়টাও করা শিখে গেছেন? নাকি, আজকের স্বস্তিতে কালকের অস্বস্তি নিয়ে ভাববার সময়টুকু হচ্ছে না? নাকি অল্প নিয়ে অল্প ভাবাই হালের ফ্যাশন? এ অল্প আর কতদিন অল্পতেই থেমে থাকবে, ভেবে দেখেছেন কখনও? অল্প একদিন হঠাৎ বেশি হয়ে উঠলে সেদিন আর বেশি ভাবলেও কোনও লাভ হবে না।

জীবনকে সাজানোর পসরা যতটা না ঘরের বাইরের, তার চাইতে ঢের বেশি ঘরের ভেতরের। আপনার সন্তানের সাথে বসে সন্ধ্যার নাস্তা আর রাতের ডিনারটা অন্তত করুন। এতে ভালোবাসা বাড়ে। ওকে ভালোবাসায় বাড়তে দিন। এটার সুফল পাবেন, ও যখন আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করার মতো বড় হবে, তখন। যখন ওর শরীর খারাপ করে, তখন ও সারাটা দিন দরোজার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে কাঁদে আর ভাবে, মা কখন ফিরবে মা কখন ফিরবে! প্রকৃতিগতভাবেই সন্তানরা মাকে বেশি খুঁজে ফেরে। ওর চোখের জলের দাম পৃথিবীর যেকোনো চাকরির বেতনের চাইতে লক্ষগুণ বেশি। যার জন্য নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দম বন্ধ করে ছুটছেন, সে যেদিন দম-বন্ধ-করে-বাঁচা’র অনভ্যস্ততায় হুট করে দম ফুরিয়ে নেই’দের খাতায় নাম লেখাবে, সেইদিন সেই অসীম আফসোসের মূল্য দিতে পারবেন তো?

সমাজের পুরুষমানুষদেরকে বলছি। চাকরি না করলে যদি ঘরের বউটাকে অকেজো মনে হয়, তবে দেখি নিজের সন্তানটিকে মানুষ করার দায়িত্বটা একটুখানি হলেও ভাগ করে নিন না! বুঝবেন, কত ধানে কত খৈ! নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, নিজের ফুলটাইম চাকরিটার তুলনায় এই পার্টটাইম চাকরির বেতন অন্তত ৫ গুণ হওয়া উচিত, এটাই মনে হবে! সন্তান মানুষ করা পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলির একটি। সংসারে স্ত্রীরা যে ভূমিকাটা রাখেন, সে ব্যাপারে স্বামীরা যদি দায়িত্বশীল আর সংবেদনশীল না হন, তবে সে ঘরে সুখ থাকলেও শান্তি থাকে না। প্রাচুর্য হয়তো কখনও-কখনও সুখ এনে দিতে পারে, কিন্তু শান্তি সম্পূর্ণই মনের ব্যাপার। যদি পারিবারিক নানান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে স্ত্রীকে চাকরি করতেই হয়, তবে ঘরের কাজের স্ত্রীর ভাগটা স্বামীকে নিতেই হবে। ঘরের ভেতরের কাজের জন্য যদি বেতন ধরা হত, তবে সে বেতন ঘরের বাইরের কাজের বেতনের অন্তত ৩ গুণ হত, এটা হিসেব কষে বলে দেয়া যায়। সন্তান মানুষ করার সিংহভাগ কৃতিত্ব যদি মায়ের হয়, তবে বাবার আয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্যের সিংহভাগের দাবিদার নিঃসন্দেহে মা-ই হবেন, এবং সে আয় আর সংসারের অন্যান্য কাজ সম্পাদনের জন্য ধর্তব্য বেতনের যোগফল বাবার আয়ের তুলনায় অনেক গুণ বেশি! এর মানে দাঁড়াল এই, সংসারে মা-ই বেশি আয় করেন, সে বাবা চাকরিই করুন, আর যত বড় ব্যবসাই করুন না কেন! সন্তান ভাল কিছু করলে যদি ‘আমার সন্তান’ বলে গর্ব করতে ইচ্ছে করে, তবে তার আগে সন্তানকে ভাল কিছু করার জন্য যোগ্য করে তোলার দায়িত্বের অন্তত কিছু ভাগও নেয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। আপনার সন্তান যতটুকু অনিরাপদ, আপনার ভবিষ্যৎ ঠিক ততটুকুই অনিরাপদ, আজকের দিনে এটা শুধু মায়েদের বুঝলেই চলে না। সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার পর থেকে ওকে নিরাপদ রাখার জন্য মাকে যতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়, সন্তান বেড়ে ওঠার সময় থেকে শুরু করে সম্পূর্ণরূপে আত্মনির্ভরশীল হওয়া পর্যন্ত ওর নিরাপত্তার সমস্ত ভাগটুকুও যদি বাবাকে নিতে হয়, তবুও সে কষ্ট মায়ের সন্তান জন্মদানের কষ্টের সিকিভাগও নয়।

আমি দেখেছি, বাংলাদেশে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান বিধায়, এখানে কর্মক্ষেত্রে স্বামীর চাইতে স্ত্রীর সাফল্য বেশি হলে কিছু-কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর প্রভাব অনেকটা নেতিবাচকভাবেই সন্তানদের উপর এসে পড়ে। সাধারণত এটাই দেখা যায়। আর্থসামাজিক নিরিখে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিংবা সমাধানের দায়িত্ব সমাজবিজ্ঞানীদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। মেয়েরা পড়াশোনা করবে, বড় হয়ে চাকরিবাকরি করবে, স্বাবলম্বী হবে। একইসাথে যে নিষ্পাপ শিশুটিকে ওর ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছার অপ্রেক্ষিতে পৃথিবীতে আনা হয়েছে, সে নিষ্পাপ শিশুটার শৈশব যেন সুস্থ ও নিরাপদ থাকে, সে কথাটা সবার আগে ভাবতে হবে। যে বয়সে তার রূপকথার রাজ্যে থাকার কথা, খেলনার স্পোর্টসকার কিংবা টেডিবিয়ার নিয়ে খেলার কথা, চারপাশের পৃথিবীটাকে স্বপ্নের রাজ্য ভাববার কথা, সে বয়সে ও যেনো পৃথিবীর কুৎসিত নষ্ট রূপটি দেখে না ফেলে। আর সন্তানটি যদি মেয়ে হয়, তবে এটা বলা যায়, একটা মেয়ের মেয়েলি সমস্যাগুলো মায়ের চাইতে বেশি বাবা কখনওই বুঝবে না! বাবাদেরকে সে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। বলতে পারেন, সন্তানের জন্য স্বামীই নাহয় ক্যারিয়ারটা বিসর্জন দিক! স্ত্রীর বর্তমানে সুষ্ঠুভাবে ছেলেমেয়ে মানুষ করেছে কোন বাঙালি পিতা কোথায়, কবে? উদাহরণ দিতে পারবেন? সাধারণত ছেলেরা এই ব্যাপারে প্রকৃতিগতভাবেই উদাসীন আর আনাড়ি।

এরপরেও কিছু কথা থেকে যায়। যে কয়েকটা এই মুহূর্তে মাথায় আসছে, সেগুলি বলছি:

# এ লেখায় আমি নারীস্বাধীনতা খর্ব করে কিছু বলিনি। বলবই বা কেন? মাথায় অতোটা বিদ্যেবুদ্ধি না থাকলেও ছোটোবেলা থেকে মা’কে দেখে এইটুকু তো অন্তত শিখেছি, পরিবারের স্ত্রীর পারিবারিক, সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার উপর নির্ভর করছে অনেককিছু। তবে সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশে ততদিন পর্যন্ত নারীস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে না যতদিন পর্যন্ত স্ত্রীরা বাইরে চাকরি করবেন আর স্বামীরা গেরস্থালি সামলাবেন—এটা স্বাভাবিক মানসিকতায় গ্রহণ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হবে। বাংলাদেশে পুরুষের কাঁধে চড়ে নারীরা স্বাধীন হতে চান। কীভাবে সম্ভব?

# আমি সমাজের একটা কুৎসিত পীড়াদায়ক সমস্যার কথা বলেছি। এটাকে নিয়ে ভাববার দরকার আছে। চোখ বন্ধ করে থাকলেই তো আর প্রলয় থেমে যায় না। একটা অস্বস্তিকর সত্য হল, এই সমস্যাটা শুধু মেয়েশিশুদেরই না, ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রেও ঘটে। এটা মেনে নিয়েই বলছি, মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে সমস্যাটার চিত্র খুব অহরহ এবং ভয়াবহ। দুই ক্ষেত্রেই একটা শিশুর সুষ্ঠু মনোদৈহিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এটা দেখেশুনে সয়ে যাওয়ার অভ্যস্ততায় নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে থাকলেই কিন্তু সমস্যাটা ভ্যানিশ হয়ে যাবে না।

# একটা বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আমি বলিনি, মেয়েদের চাকরি করাটা ঠিক নয়। আমি বলেছি, ওদের সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখতে। আবার বলে বসবেন না যেন, আমি মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি ফলাতে এসেছি। আমি বলতে চেয়েছি, ওই কুৎসিত সমস্যাটা এমনই এক সমস্যা যেটা আপনি দেখেও হয়তো বুঝবেন না, যেটা আপনার অগোচরেই ঘটে, ভিকটিম নিজেই যে সমস্যার কথা চেপে যায়। আরেকটা ব্যাপার। অনেকসময়ই মা বাসায় থাকার পরেও এ সমস্যাটা ঘটে। আমি একটা মেয়ের ঘটনা জানি। সে মেয়ে অল্পবয়সে এক গানের টিচারের হাতে অনেকদিন ধরেই ‘আদর’-এর নামে ‘নোংরামি’ সহ্য করেছে। তার মা এক স্বল্পশিক্ষিতা সহজসরল ভদ্রমহিলা যিনি উনার সংসারের রান্নাবান্না, আচারঅনুষ্ঠান, সামাজিকতা নিয়েই সারাদিন মগ্ন থাকতেন। আর মেয়েটি ওই বিকৃত মস্তিষ্কের টিচারের বাসায় একাই যেত গান শিখতে। সেখানে গান শেখানোর নামে কদর্য ইন্দ্রিয়রতি চলত। আমার এক বন্ধুর কাছে কথাপ্রসঙ্গে শুনেছিলাম তার এক নিকট আত্মীয়ার করুণ কাহিনী। কোনও এক সন্ধ্যায় মেয়েটির (সেই সময় ওর বয়স ১০ কি ১১ বছর।) বাসায় গ্রাম থেকে অনেক মেহমান এসে হাজির হন কোনও একটা ব্যাপারে সালিশি বৈঠক করতে। তখন মেয়েটির মা (তিনি একজন গৃহবধূ ও পর্দানশীন ভদ্রমহিলা) তাকে পাশের বাড়িতে পাঠা্ন এই ভেবে যে, “ওইখানে তো আমার মেয়ে প্রায়ই থাকে। ও ওই আপার ছেলেমেয়েদের সাথে খেলুক, এই সব বড়দের ব্যাপারের মাঝে ওর থাকার দরকার নাই।” ঘটনাচক্রে ওই বাসায় সেইদিন বেড়াতে এসেছিল কোন এক সদ্য বিদেশফেরত পারভার্ট পেডোফাইল। ফলে যা ঘটার, তা-ই ঘটল। সেই বিশাল বড় বাড়ির কোনও একটি রুমে যখন এত বড় ভয়ংকর অপরাধটি ঘটছে, তখন ওই প্রতিবেশিনী ব্যস্ত ছিলেন তাঁর নিজের রুমে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মুভি দেখায়। কোনও পুলিশি ব্যাপার কিংবা, কোর্টকাচারিতে মেয়েটির পরিবার যায়নি। তবে মেয়েটি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভুগছিল। এই দুটো ক্ষেত্রে মায়েরা কেউ অফিস তো দূরে থাক, স্বামী বা নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সাথে বাসার বাইরে নিজের পা-টিও ফেলেন না। কিন্তু নিজের মেয়েকে তাঁরা কোনও ধরনের নিরাপত্তা দিতে পারেননি। অসংখ্য শিশুই তো আপন মামা-চাচার হাতে নিভৃত যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। সেইসব ক্ষেত্রে মায়ের চাকরি করা না করার কোনও ভূমিকাই নেই।

# আমার মা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াতেন, কিছু স্টুডেন্টকে বাসায় প্রাইভেট পড়াতেন। কেন পড়াতেন? পয়সার জন্য? হ্যাঁ, সে তো কিছুটা বটেই। তবে প্রয়োজনটা পুরোপুরি পয়সার ছিল না, প্রয়োজনটা ছিল আত্মসম্মানের। বাবার কাছ থেকে সবসময় পয়সা চাইতে আমার মায়ের সংকোচ হত। আবার ভেবে বসবেন না যেন, বাবা মাকে পয়সা দিতেন না। আমরা ছোটোবেলায় নানান সময়ে মায়ের কাছ থেকেই পয়সা চাইতাম। শুধু ছোটোবেলায় কেন? একটু বড় হওয়ার পর আমার বইকেনার নেশা চেপে বসে। প্রায়প্রায়ই কারণে-অকারণে প্রচুর বই কিনতাম। বাবার কাছ থেকে পয়সা চাইতে কেন জানি লজ্জা-লজ্জা করত। পয়সা চাইলে মা সেটা নিজের উপার্জন থেকে কিংবা বাবার কাছ থেকে চেয়ে এনে দিতেন। মেয়েদের ব্যাগের পয়সা আর টুথপেস্টের টিউবের পেস্ট, দুটোই একই রকমের। কখনওই যেন পুরোপুরি ফুরিয়ে যায় না, চেপেচুপে একটুখানি বের করা যায়ই। মা কিন্তু এখনও স্টুডেন্ট পড়ান। এখন কেন পড়ান? মা তখন কেন স্টুডেন্ট পড়াতেন? মা ফ্রিতেও অনেককে পড়িয়েছেন। স্টুডেন্ট পড়ানোর সুখ কখনও পয়সায় কেনা যায় না। ওরা কত বড় হয়ে গেছে! ভাল-ভাল জায়গায় আছে। ওরা এখনও মা’র কথা মনে রেখেছে। মা পড়াতে খুব ভালোবাসেন। মা একা মানুষ। আমার তো বোন নেই, আমরা দুই ভাই। মা গল্প করবেন কার সাথে? মা তাই পড়াতে পছন্দ করেন। মা’র সময় কাটে না, আগেও কাটত না। সময়টা সুন্দরভাবে কাটানোর জন্য মা স্টুডেন্ট পড়াতেন এবং পড়ান। এতে মায়ের মনও ভাল থাকে। অন্যের নিন্দে করার সময় জোটে কম। আমি স্বাবলম্বী—এই অনুভূতিটা প্রত্যেক মানুষকেই ভীষণ আনন্দ দেয়। এখন কথা হচ্ছে, মা স্টুডেন্ট পড়ানোর পাশাপাশি সংসারের সবকিছু কীভাবে মেইনটেইন করতেন? অনেকবেশি মানসিক আর শারীরিক পরিশ্রম করে। মায়ের দুনিয়াটা ছোটো ছিল তো! চাওয়াপাওয়া কম ছিল। স্বামী, সন্তান, পরিবার আর কিছু বইটই-গান-মুভি—এই নিয়েই আমার মা’র ছোট্টো দুনিয়া, ছেলেদের সুখই উনার সুখ। আমাদের পরীক্ষার আগে-আগে মাঝেমাঝে পড়ানো ছেড়ে দিতেন, নিজে পড়াতেন আমাদের। আমাদের সবসময় টিচারদের বাসায় নিয়ে যেতেন। বাবা খুবই লাজুক স্বভাবের মানুষ। মা-ই সব স্যারের সাথে কথা বলতেন। প্রতিদিন ভাল করে ৫ ঘণ্টাও ঘুমাতেন কিনা সন্দেহ! বাসার দিকে এতটা খেয়াল রাখতে পারলে চাকরি করতে মেয়েদের সমস্যা কোথায়? মা এই ব্যাপারে বাবার কাছ থেকে সব ধরনের সাপোর্ট পেয়েছেন। আমরা যেমন মা’কে মা ডাকি, তেমনি বাবা’কেও তো বাবা ডাকি। সন্তান তো মায়ের একার না।

# জীবনের প্রয়োজনে জীবিকা। এইটুকু হলে ঠিক আছে। কিন্তু যেন জীবিকার প্রয়োজনে জীবন না হয়ে ওঠে। এতে কতকিছুই তো হারিয়ে যায়, তাই না? ভালোবাসা হারায়, সুখ হারায়, আদর হারায়। পরিবারটা আরও সুন্দর হতে পারত, হয় না। না-বলা এবং বলা-যায়-না, এমন সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে। সংসারের তাগিদে মেয়েরা চাকরিতে যায়। এই ক্ষেত্রে ছেলেটাকেও অনেকটুকু ছাড় দিতে হবে। সংসারের কাজকর্ম ভাগ করে নিতে হবে। ওর কিংবা ওর পরিবারের জন্যই তো মেয়েটা সন্তানদের দিকে ঠিকমতো নজর দিতে পারছে না, তাই না? বাবা-মা দুজনেরই ভূমিকা আছে এই ক্ষেত্রে।

জীবনটা কেমন?………… যেখানে যেমন! এই তো! মানে, আমার এই লেখার বাইরেও জীবনের অনেক অনেক অনেক রঙ আছে। সে রঙের ব্যাপ্তিই বেশি। যে ফ্যামিলিতে বাবা নেই, কিংবা বাবা থেকেও নেই, সে ফ্যামিলির হাল ধরতে মাকে বাইরে বের হতেই হয়। যে ফ্যামিলিতে স্ত্রীকে চাকরি করতেই হয়, সে ফ্যামিলির সন্তান অনিরাপদ হয়ে যাবেই, এমনও কিন্তু নয়। কর্মজীবী কেয়ারিং মায়েদের সংখ্যা কিছুতেই কম নয়। ঈশ্বর মেয়েদের সৃষ্টি করেছেন অদ্ভুত মানসিক আদলে। সময় আর পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মেয়েরা যতটা চমৎকারভাবে মানিয়ে চলতে পারে, সে আর্ট রপ্ত করাটা ছেলেদের সাধ্যেরও বাইরে। সন্তানের নিরাপত্তা আর সুস্থ-স্বাভাবিক শৈশব-কৈশোর দিতে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা আর কিছু-কিছু ক্ষেত্রে পরিমিত সন্দেহপ্রবণতা। নিরাপদ শৈশব-কৈশোরের স্বার্থে সন্তানের সাথে বাবা-মা’র দূরত্ব যত কমে আসবে, ততই মঙ্গল। বাড়তি অর্থের মোহে বাড়তি সময়ের বিনিয়োগ অনেকসময়ই জীবনে বাড়তি কিছু অনর্থের সূচনা করে।