অস্তিত্বের একটি টুকরো

(ডাক্তার এহসানুল করিম স্মরণে)


মাত্র দু-একজন মানুষকে ভালো হিসেবে জানি।
ওদেরই কাউকে কাউকে মরে যেতে দেখি।
আর নিজেকে বেঁচে থাকতে দেখি, আরও অসংখ্য খারাপ মানুষের সাথে।
বেঁচে থাকলে এসব দেখে দেখে বাঁচতে হয়। এর নাম ঐশ্বরিক শাস্তি।


যাঁকে দেখলেও সত্যিই অর্ধেক অসুখ সেরে যেত,
তাঁকেই অসুস্থ হয়ে অকালে মরতে দেখি,
পেছনে কাঁদতে থাকে তাঁর ব্যথাহত স্ত্রীর কোলে দু-বছরের শিশুটি!
আর এরপর নিজের দিকে তাকালে মনে হতে থাকে,
এখন আমি কার কাছে যাব?
যাবার জায়গা সব সময়ই থাকে যদিও, তবু সবার কাছে কি আর যাওয়া যায়...চোখ বন্ধ করেই?
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, আমি যা জানছি, মিথ্যে জানছি!
কাল সন্ধের পর গোলপাহাড়ের মোড়ে তাঁর চেম্বারে গেলে তাঁকে ঠিকই আবার দেখতে পাবো!


যাকে এবং যাদেরকে আমি ভালোবাসি,
তাদেরকে সুস্থ মনে ও শরীরে
রেখে দিয়েছিলেন যে মানুষটি, দিনের পর দিন,
সে মানুষটি যখন ফাঁকি দিয়ে চলে যান,
তখন আরও একবার অসহায় দৃষ্টিতে
আমার ভালোবাসার মানুষগুলির দিকে আমি তাকাই।
দীর্ঘশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে টুকরো কিছু অভিমান বাড়ে।


সবচাইতে শান্ত, সবচাইতে স্নিগ্ধ চাহনির যে মানুষটি,
তাঁর চোখ কেন বন্ধ হয়ে যায় বড়ো অসময়ে?
মাত্র দুদিন আগেও যাঁর সাথে কথা বলেছি বলেই
সুস্থ হয়ে উঠেছি আজ---ভবিষ্যতেও সুস্থ থাকবার নির্ভার স্বপ্নে,
তাঁকে চোখের সামনে চলে যেতে দেখলে সত্যি সত্যি
একদৌড়ে গিয়ে বুকের সাথে জোর করে আটকে রাখতে ইচ্ছে করে!


ভালো চিকিৎসক হতে অনেককেই তো দেখলাম,
ওঁদের মধ্যে ভালো মানুষ হতে কয়জনকেই-বা দেখেছি এ জীবনে?
---এমন অগুনতি প্রশ্ন যখন মায়ের অশ্রুতে, বাবার দীর্ঘশ্বাসে,
ভাইয়ের অক্ষম সুতীব্র অভিমানে, কিংবা নিজেরই দলা দলা চাপাকান্নায় জমা হতে থাকে,
তখন মানুষটার ভালোবাসাপূর্ণ দুটো কথা, দুটো আশ্বাস, দুটো হাসি,
…আর কখনওই পাবো না, যতদিন বাঁচব---
এসবও হায় চুপচাপ মেনে নিতে হয় বেঁচে থাকতে চাইলে---
বুঝি সবই যদিও, তবু বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হয়!


যে মানুষটাকে গত বারোটা বছর ধরে চিনি,
যে মানুষটার সাথে একটিও দুঃসহ কিংবা অভিযোগপূর্ণ স্মৃতি নেই,
যে মানুষটাকে কখনও একটু রাগতে পর্যন্ত দেখিনি,
যে মানুষটাকে বরাবরই নিরীহ, আত্মসংবৃত, কর্মমগ্ন হিসেবে জেনেছি,
যে মানুষটার আশ্রয়ে চোখ বুজে চলে যাওয়া যেত নিঃশঙ্ক চিত্তেই,
যে মানুষটাকে দেখলে ভাবতাম, ‘আমার একজন বড়ো ভাই থাকলে তিনিও বুঝি ঠিক এমনই হতেন!’,
যে মানুষটা ছিলেন বলেই আমার অসুস্থ মা, বাবা, এবং আরও অনেক প্রিয়জন বেঁচে গেছেন বহু বহুবার,
যে মানুষটাকে তাঁর কাজে অবিচল থাকতে দেখেছি নির্ভুল হাতে, হাসিমুখে, বরফশীতল মেজাজে,
---সেই মানুষটাই যখন স্মৃতি হয়ে যান, চোখের অশ্রুতে ঠায় লেপটে থাকেন,
তখন সত্যিই অনুভব করি, স্মৃতি কতটা দায় হয়ে পড়ে রয়, হৃদয় কেমন শ্মশান হয়ে পুড়তে থাকে,
কিছু মানুষের প্রস্থান বুকে-রক্তে-মস্তিষ্কে কতটা দহন-ক্ষরণ ঘটায়!


ভালো মানুষের আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে যায়,
টিকে থাকে দীর্ঘআয়ুর কিছু অপ্রয়োজনীয় মানুষ।
এইসব মৃত্যু দেখি, আর ভাবি, এই পৃথিবীতে ন্যায্যতা বলে সত্যিই কিছু নেই।
কিছু মৃত্যু থাকে, যেগুলির নেপথ্যে একটিও ঐশীন্যায্যতা মানতে আমার কিছুতেই ইচ্ছে করে না,
এমনকি, যদিও সেইসব স্রষ্টা-নির্ধারিত…ঠিক যেমনি করে নির্ধারিত খারাপ মানুষের আয়ুরেখাও!


মৃত্যুর মিছিলে, কখনও কখনও, কেবলই আর-একটি সংখ্যা যুক্ত হয় না,
নিজের অস্তিত্বের একটি টুকরো যুক্ত হয়।


.........................................
৩ জুন ২০২০