অস্তিত্বের চাইতেও ধ্রুব

 এক।
বহুদিন হয়ে গেল, একসাথে আছি।
কত মুহূর্ত দেখেছি অনুভবে--একসাথেই।
ছায়া-আবছায়ায় ভীষণ মায়ায় দুজনের হাত থাকে একসাথে, চলে একইমতে।
কতকত পথ হেঁটেছি দুজনে নিঃশ্বাসেরই দূরত্বে বেঁচে।
 
হয়তো তুমি তা জানতে পারোনি,
বোঝোনি কখনও, তোমার পাশেই আছি আমি।
আমি কখনও সামনে আসিনি, ও চোখ তোমার আমায় দেখেনি,
তবু আমি তোমায় দেখেছি, তোমায় শুনেছি--খুব কাছ থেকে--বুঝতে পারোনি।
 
আমি তোমার পাশেই থাকবো, জেনো।
পথের শুরুতে আমায় পাবে, পথের শেষেও থাকবো আমি।
বন্ধু, তুমি আমায় খুঁজো না, শুধু তোমায় খুঁজো।
যদি কখনও কান পেতে দাও ওই হৃদয়ে, সেখানেই কেবল আমায় পাবে।
 
এ মনে সাধ, তোমার সাথে হাঁটব নীরবে,
নীরবতার গানটা তো জানি, মিষ্টি ভীষণ!
সে গান নাহয় শুনব দুজন, ভাসব সুরে ওই অজানায়।
কোন যাদুতে ভালোবাসা যে হৃদয় বাঁধে, শিখব দুজন লুকোচুরিতে।
 
তোমার সাথে থাকব যখন, একটি কথাও বলব নাকো,
কতটা তোমার রয়েছি কাছে, জানবে না তুমি ভুলেও কখনও!
আঁধার রাতে, অচেনা প্রাতে পথ হারালেও ভয় পেয়ো না, হাত বাড়ালেই অদৃশ্য এই আমায় পাবে।
তোমায় আমি চলব বয়ে, নিজের সারাটি শরীর ক্ষয়ে, তবু থেমে যেয়ো না কখনও ভয়ে।
 
এসবকিছু করব নীরবে, একটি কথাও সরবে না মুখে,
তোমার হৃদয়ের কথা শুনব তখন, ও মন কিছু চাইবে যখন!
কখনও আমায় জানতে চেয়ো না, পারলে শুধু অনুভবে দেখো,
যত্নে আর আদরে খুঁজো আত্মা আমায়, যখন পাবে, তখন বুঝো।
 
এসো হাত রাখি হাতে, একসাথে হাঁটি, একসুরে গাই জীবনের গান।
সুন্দর সব মুহূর্ত যত, নিই মিশিয়ে হৃদয়ের ঘরে আর স্মৃতিতে।
ধ্বনিটা শুনব, প্রতিধ্বনিও--জেনে নেবো কী কানাকানি চলে আজি চারপাশে।
জীবনযাদুর রহস্যটা অনুভবে নেবো জেনে, লুকানো সকল সুখগুলিকে স্পর্শে আনব টেনে!
 
আজ যবনিকাপাতে,
আফসোস নেই, দুঃখও নেই।
কেবল এক অপরাধ তাড়িয়ে বেড়ায়--
কী এক বোধে অসাড় শোধে বকতে থাকি আপনমনেই...
তুমি এই ভালোবাসা জানলে না শুধু--
আমারই হেলায়। আমার না-বলা প্রিয় প্রেমকথা যত,
মৃত্যু কেন নেয় বলিয়ে? কেন বলতে পারিনি
কখনও তোমায়, বিধির খেলায় হারার আগেই?
যেখানে জ্যান্ত আবেগই দাম পায় না,
সেখানে মৃত আবেগের দাম কী, বলো?
 
দুই।
যতটা হেঁটেছি তোমার খোঁজে,
ততটা পথে তোমায় পেয়েছি আমার পাশেই।
যেমনি জোয়ারভাটায় ওই নদীতে স্রোত বোঝা যায়,
তেমনি তোমার অস্তিত্ব কি অনস্তিত্ব ‘তুমি আছই!’ এটাই জানায়!
 
গোধূলিবেলায় কিংবা ভোরে, প্রাসাদে কিংবা পর্ণকুটিরে,
অন্য ঘরে, বন্য হাওয়ায় তোমায় খুঁজেছি হন্যে হয়ে--কত-কতবার।
ভেতরে আমার যে প্রেমিক বাঁচে, তোমায় পেয়েছি তার চোখেতেই।
তারই ঠোঁটে হেসে উঁকি দেয় দেখি, তোমার ঠোঁটের লাজুক হাসি।
 
তোমায় দেখেছি নির্গৃহ ওই বালকের ভিড়ে,
পেয়েছি তোমায় দিয়েছি যখন শীতের কাপড় ওদের শরীরে।
কত বৃদ্ধ দেখি পান না খেতে দুবেলাও, নেই পরনে গরম কাপড়,
তোমায় পেতে, হে ভালোবাসা, দুঃখে ওদের কান পেতেছি সাধ্যমত।
 
মাসের খর্চা বাঁচিয়ে আধেক পথশিশুদের খেলনা দিয়েছি--সস্তা হলেও,
গরিবের ঘরে পৌঁছে শিক্ষা অবৈতনিক, কত আলো জ্বলে--তোমারই জন্য!
শীতের সূর্য রৌদ্র হয়ে ঝরেছে যত, উষ্ণতা তোমার ছড়িয়েছে তত--ফাঁকি নেই ওতে, তুমি তো জানো!
উৎসবে গালে আবির মেখেছি, রাঙিয়েছি হাত--তোমারই নামে!
 
প্রিয় স্টলে বসে চায়ের ধোঁয়ায় তোমায় ভাবি,
ফোটা-ফুলের মতন গরম ভাতেও তোমায় দেখি রয়েছ ফুটে,
ঘুরতে গিয়েছি যেখানে যখন, হয়তো জলের বোতলটা নিতে মনে নেই,
তবু তোমায় ছেড়ে যাইনি কখনও কোথাও আমি। তুমি যে আমার ভুলের চেয়েও অনেক বড়!
 
আমি নিঃসঙ্গ নই, তুমি আছ পাশে ধ্রুবতারা হয়ে,
পথ হারালে অচিন দেশে, পথ ঠিকই তুমি দেখাও হেসে।
দূরে চলে গেছ, ভালই করেছ,
তোমার আমি’কে বাঁচিয়ে রেখেছ।
স্বার্থপর হয়ে মরে গেছ তুমি--
নিজে বেঁচে গেছ, আমায় মেরেছ!
যতদিন তুমি পাশে ছিলে ওগো,
বেঁচে থাকতাম তোমারই জন্য।
আজ তুমি হায় এই পাশে নেই,
বুকের ভেতরে ব্যথা করে খুব,
কতদিন হল, আর কাঁদি না,
বেঁচে আছি তবু, থাকব বেঁচে--তোমার স্মৃতিতে--তোমারই জন্য!