অস্পষ্ট জার্নাল: ১৪


বিরানব্বই।
ভালোবাসা এবং মৃত্যু একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। ভালোবাসা কী, তা জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে, মৃত্যু কী। ভালোবাসার অভিজ্ঞতা আমাদেরকে মৃত্যু ভুলিয়ে দেয়। কেননা মৃত্যুর গভীরতাতেই ভালোবাসা প্রোথিত। আমাদের ইগো আমাদের ভেতরের ভালোবাসার সুপ্ত কুঁড়িকে ফুটতে বাধা দেয়। প্রেমিকের অস্তিত্বের মাঝেই ভালোবাসার অস্তিত্ব বিদ্যমান, কেননা প্রেমিক মরে গেলে ভালোবাসারও মৃত্যু ঘটে। আমাদের আমিত্ব, আমাদের এবং আমাদের ভালোবাসার মাঝে দেয়াল তৈরি করে। আমরা মনে করি, যখন আমাদের ভালোবাসার মানুষ আমাদের কাছে আসবে, তখনই আমরা আমাদের ভালোবাসাকে খুঁজে পাবো। এটা ভাববার সময় আমরা ধরে দিই যেন ভালোবাসা হারিয়ে গেছে, অথবা ভালোবাসা হারিয়ে যাবার মতো কোনও একটা কিছু। এটা এক প্রকারের অসুস্থতা, কেননা আমরা নিজেরাই নিজের এবং নিজের ভালোবাসার মাঝে দেয়াল তৈরি করে রেখেছি। সে দেয়াল এক আমিত্বের দেয়াল, যে দেয়ালের আড়ালে ঢেকে গেছে আমাদের ‘ভালোবাসা’ নামের সম্পদটি, যা আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে খুঁজে ফিরছি প্রতিনিয়তই। আমাদের ইগো আমাদের ভালোবাসাকে খুঁজতে দেয় না, তাকে দেখতে বাধা দেয়, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা ভালোবাসা খুঁজে ফিরি, অথচ পাই না। আর এরই মাঝে ভালোবাসা আমাদের কাছে অনেক বার উঁকি দেয়, কিন্তু যখন আমরা ভাবি, এই বুঝি আমরা আমাদের ভালোবাসাকে পেয়েছি, তখনই বুঝতে পারি, আমরা এক ধোঁকার রাজ্যে আছি। আমরা যাকে ভালোবাসা ভেবে ধরতে গিয়েছি, তার কোনও অস্তিত্বই নেই, আমরা নতমস্তকে শূন্যহাতে আবার নিজের কাছে ফিরে আসি।


আমরা যখন প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসি, আমরা যখন বৃষ্টির ফোঁটাকে ছুঁয়ে দেখি, আমরা যখন সমুদ্রে গা ভেজাই, আমাদের ভোর যখন পাখির সুমধুর কলতানে আমাদেরকে পরম স্নেহে জাগিয়ে তোলে, ওই দূর আকাশ থেকে ভেসে-আসা চাঁদের আলো যখন আমাদের ভেতরটা এক অন্য রকম মাদকতায় জড়িয়ে নেয়, দুপুরের ভুবন-ভোলানো রোদ যখন আমাদেরকে তৃষ্ণার্ত করে তোলে, এগুলোতে আমরা কোথাও ভালোবাসা দেখি না। এর কারণ, আমাদের হৃদয় আর আমাদের মাঝে অনেক দূরের একটি সম্পর্ক, সেখানে অনুভূতিরা যেতে পারে না, আমাদের আমিত্ব খুব গোপনে আমাদের হৃদয় থেকে আমাদের সংযোগকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এখন আমরা প্রতি মুহূর্তে নিজের সাথে প্রতারণা করি, অথচ আমরাই নিজেকে বারে বারে মনে করিয়ে দিই যে আমরা মোটেও প্রতারিত নই। আমরা কেবল ভালোবাসা নিয়ে ভাবি, ভালোবাসাকে আমাদের কল্পনায়, আমাদের স্বপ্নে লালন করি, কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসার অভিজ্ঞতা যে কী, কেমন, আমরা সেটি জানি না। আমরা আমাদের প্রকৃত ভালোবাসাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কল্পনার রাজ্যে ভালোবাসাকে খুঁজে ফিরি। নিজের আমিত্বকে ঝেড়ে ফেলার নামই হচ্ছে মৃত্যু। নিজের আমিত্বের মৃত্যু ঘটালেই ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। আমাদের শরীরের মৃত্যুতে নয়, বরং আমাদের ইগোর মৃত্যুতেই ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব। কেবল এই একটি মাত্র উপায়েই আমরা প্রকৃত ভালোবাসাকে খুঁজে পেতে পারি। কেননা আমাদের ইগোই ভালোবাসার প্রধান প্রতিবন্ধক।


আমাদের শরীরের মৃত্যুর সাথে আমাদের আমিত্বের মৃত্যু ঘটে না, আমাদের শরীরের মৃত্যু হলেও আমাদের আমিত্ব এই বিশ্বঅস্তিত্বের মাঝেই থেকে যায়, আমাদের আমিত্বের গভীরে সেই অমর সত্তা সদা বর্তমান। যখন আমাদের শরীরের মৃত্যু ঘটে, তখন আমাদের আমিত্ব কেবল আমাদের শরীরের সেই খোলস থেকে বের হয়ে এসে অন্য আরেক খোলস বাসা বাঁধে, পুরনো খোলসটা কেবল ভেঙে যায়। ইগোকে নিজের শরীর নিজের মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলার অর্থ হচ্ছে আমাদের আমিত্বের মৃত্যু ঘটানো। আমার এবং আমার আমির মাঝে পার্থক্য কেবল এক খোলসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যে খোলস আমাদের ইগো এবং মস্তিষ্কের তৈরি, যার বাহ্যিক অস্তিত্ব নেই, যে শুধু একটি ফাঁপা ধারণার উপর বর্তমান। যখন পুরনো খোলসটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে, তখন এক নতুন খোলসের জন্ম হয়। যখন আমাদের আমিত্ব, তথা আমাদের ইগোর মৃত্যু ঘটে, তখন আমরা আসলে কিছুই হারাই না, বরং আমরা এক নতুন আমিকে খুঁজে পাই, আমাদের প্রকৃত সত্তাটি খুঁজে পাই। এমন সময় আমাদের আমিত্ব এক পরম অস্তিত্বের সাথে একাত্ম হয়, সৃষ্টির অস্তিত্বের সাথে একাত্ম হয়। এরপর যখন আমাদের এই শরীরের মৃত্যু ঘটে, তখন সেটি আমাদের কাছে একটি ঘটনা মাত্র, সেখানে নতুন কিছুই যেন নেই। আমাদের মস্তিষ্কের এই পরিবর্তন আমাদের জীবনকে এক ভিন্ন অর্থ এনে দেয়, আমাদের জীবনের অর্থ, লক্ষ্য, গন্তব্য, জীবনযাপনের ধরন, কাজের প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য সব কিছু পালটে দেয়। হয়তো এর আগে আমরা আমাদের জীবনকে যে চোখে দেখতাম, সব কিছুকে যেভাবে চাইতাম, সেইসব চাওয়া-পাওয়ার মাঝেও পরিবর্তন আসে।


আমরা যখন প্রকৃত ভালোবাসায় আসক্ত হই, তখন আমাদের সেই ইগো, আমিত্বের অহংকার, এই জাতীয় সব কিছু আমাদের ভেতর থেকেই শেষ হয়ে যায়। আমাদের ভেতর থেকে সেই আমিত্বের সত্তাটিই অদৃশ্য হয়ে ভেতরটা কেমন যেন বিশাল এক শূন্যতায় পর্যবসিত হয়। একটা গভীর নৈঃশব্দ্য আমাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে, তখন মনে হয় যেন আমার মাঝে ‘আমি’ বলে কিছু নেই, নিজেকে বড়ো শূন্য মনে হয়। তখন আমাদের ভালোবাসাকে আমরা দেখতে পাই, কিন্তু সেইসাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। যখন আমরা কাউকে এমনভাবে ভালোবাসি, নিজেকে ভেঙেচুরে, পুরোপুরিই এক আমিকে নিয়ে, তখন আমাদের পুরোটা জুড়ে আমাদের ভালোবাসার মানুষ ছেয়ে থাকে; এমনভাবেই, যেন সে ছাড়া আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, এমনকি আমি নিজেও না। এমন ভালোবাসায় যিনি ভালোবাসেন, তিনি নিজেই নিজের কাছে গৌণ হয়ে যান, তাঁর ভালোবাসার মানুষটিই তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। যখন আমরা নিজেকে হারাতে পারি, তখনই আমরা ভালোবাসতে পারি, আমাদের ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবাসা দিতে পারি। ঐশ্বরিক ভালোবাসা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আমাদের প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা, সেটি কাছের মানুষের জন্য ভালোবাসা, কিন্তু ঐশ্বরিক ভালোবাসা এইসব থেকে অনেক দূরের কিছু একটি। সকল প্রকার ভালোবাসার ক্ষেত্রেই ইগো একটি বিচ্যুতি হিসেবে কাজ করে, ইগো সত্যিই ভালোবাসার ব্যাঘাত ঘটায়।


তিরানব্বই।
যেখানে আমাদের হৃদয় শূন্য, সেই শূন্য হৃদয়কে ভালোবাসার কাছে অবনমিত না করে কী করে আমরা আমাদের হৃদয়ের পূর্ণতা পেতে পারি? আমরা হয়তো ভাবি, কেন আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে নত হব, হার স্বীকার করব, কেন আমরা আমাদের দুর্বলতাগুলো, যা তার প্রতি আমার সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোকে প্রকাশ করব? কেননা যদি আমরা সেগুলো তাকে জানিয়ে দিই, তবে আমরা তার কাছে আটকে যাব, নিজেকে ছোটো করে ফেলব, নিজেকে নত করতে আমাদের ইগো আমাদেরকে পেছন থেকে বেঁধে রাখে, অথচ আমরা বুঝিই না, নত না হলে আমরা কী করে আমাদের শূন্যতাকে পূরণ করব! যখন আমরা তৃষ্ণার্ত, তখন আমাদের জল প্রয়োজন, নদী নয়! যখন আমরা নদীর ধারে বসে বসে ভাবি, আমরা আমাদের পাত্রটি পূর্ণ করব না, স্বয়ং নদী এসে আমাদের পাত্রটি পূর্ণ করে দিয়ে যাবে, তখন আমরা কি বোকার রাজ্যে নেই? নদীর কি কোনও প্রয়োজন আছে স্বেচ্ছায় এসে আমাদের পাত্রে নিজেকে ঢেলে দেবার? তৃষ্ণা কি আমাদের নিজের, না কি নদীর? যেখানে নদী নিজেই নিজেকে উজাড় করে দিয়ে দিয়েছে, আমাদের কেবল নত হয়ে নিজেকেই নিজের পাত্র পূর্ণ করে নিতে হবে, সেখানে আমরা এই আশায় বসে আছি যে স্বয়ং নদী এসে আমাদের পাত্রে নিজেকে পূর্ণ করবে!


আমরা যদি এমনি করেই নিজেদের ইগোকে ধরে রাখি, তবে কি আমরা কখনও প্রকৃত ভালোবাসার দেখা পাবো? আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে, তৃষ্ণার্ত নদী নয়, আমরা। নদীর কাছে আমার তৃষ্ণা মেটাবার জল অঢেল রয়েছে, প্রয়োজনটা আমার, শূন্যতা আমাকে ঘিরে রেখেছে, তাই আমাকেই আমার তৃষ্ণা মেটাবার জন্য নদীর কাছে যেতে হবে। আমরা যদি নিজের পাত্রটি পূর্ণ করতে চাই, তবে আমাদেরই নত হয়ে নিজেকে পূর্ণ করে নিতে হবে। এতে নিজেকে হারাবার কিছু নেই, বরং প্রাপ্তির পুরোটাই সম্পূর্ণ নিজের। এমনকি আমরা যদি মাঝনদীতেও থাকি, তবুও নদীর জল উপচে এসে আমাদের তৃষ্ণা মেটাবে না, যদি না আমরা তা গ্রহণ করতে জানি। নদী নিজে এসে আমাদের ঠোঁটে নিজেকে বিলিয়ে দেবে না, অবশ্যই সেটি আমাদের চারপাশে বিরাজমান, কিন্ত আমাদেরকেই তাকে নিজের কাছে আনতে হবে, এখানেই নিজের ইগোর প্রশ্নটি আসে। যখন আমাদের মাঝে এমন অনুভূতিগুলো হতে থাকে, তখন আমরা নিশ্চিত হতে পারি, আমাদেরকে আমাদের ইগো দংশন করে চলেছে, যে কারণে আমরা এগুতে পারছি না। এর কারণ শুধুই আমাদের ইগো, আর কিছুই নয়। ভালোবাসা তেমনি আমাদের চারপাশে নিজেকে ছড়িয়ে রেখেছে, স্রষ্টা আমাদের চারপাশে বিরাজমান, এমনকি আমাদের ভেতরেও, কিন্তু আমাদেরই নিজেদের আমিত্ব থেকে বের হয়ে আসতে হবে, মস্তিষ্কের খেলা থেকে নিজের দিক পরিবর্তন করতে হবে, আমাদের অন্তরের শূন্যতাকে ভালোবাসার কাছে বিসর্জন দিতে হবে নিজেকেই।


ভালোবাসাকে পাবার এই একটিমাত্র পথ---যে পথে স্রষ্টা হেঁটে গেছেন, যে পথে আমাদের প্রিয়জনেরা হেঁটে গেছেন। আর যা আমাদের পেছন থেকে বেঁধে রাখে, সেটি আমাদের একটি ভ্রান্ত সত্তা, প্রকৃতপক্ষে সে সত্তার কোনও অস্তিত্বই নেই। ভালোবাসা প্রত্যেকটি হৃদয়ে এভাবেই আটকে আছে, নিজের এক ভ্রান্ত সত্তার কাছে। আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসছি না, আমরা নিজের কাছে একে আটকে রাখছি, আসলে আমাদের ইগো আমাদের ভালোবাসাকে ছড়িয়ে যেতে দিচ্ছে না। আমাদের ইগো আমাদের সামনে হাজারটি প্রশ্ন ছোড়ে যেন আমরা নিজের কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করতে না পারি। আমরা যে-কোনও সময় নিজেদের তৃষ্ণা মেটাতে পারি, যদি আমরা চাই। নিজেদেরকে নিজের ভালোবাসার কাছে নত করতে না-পারাই সবচাইতে বড়ো প্রতিবন্ধকতা। আমাদের জন্য সহস্র হৃদয় আমাদের চারপাশে ভালোবাসা ছড়িয়ে বসে আছে, কিন্তু আমরা সেগুলোকে গ্রহণ করতে পারছি না, কেননা আমরা নত হতে শিখিনি। আমরা নিজেরাই নিজের সমস্যা, আমরা নিজেরাই বোধশক্তিহীন। কেননা যখনই আমাদের মাঝে নিজেকে নত করবার প্রশ্ন আসে, তখনই আমরা হাজারো কাঠিন্যের সম্মুখীন হই। আমাদের ভেতরের আর-এক আমি আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আমাদেরকে হেয় করে বলতে থাকে, ‘আমি’ নত হব…আমি? এর চেয়ে বরং আমি মরে যাব, তবুও আমি নিজেকে নত করব না! আমাদের আমিত্ব তখন আমাদের বোঝাতে থাকে, নিজেকে নত করার চেয়ে বরং শেষ হয়ে যাওয়া ভালো।


আমরা আমাদের চারপাশে শুনে থাকি, দরকার হলে ভেঙে যাও, কিন্তু নত হয়ো না! আমরা একে অপরকে এই উপদেশ দিই এবং নিজেরাও অপরের সাথে এই আচরণ করি। এমনকি যখন আমরা আমাদের স্রষ্টাকে স্মরণ করি, তখনও আমাদের ভেতরে এই আমিত্ব প্রবল হয়ে ধরা দেয়, আমরা স্রষ্টার কাছে পুরোপুরি নত হতে জানি না। এই বিষটা আমাদের রক্তে ছড়িয়ে গেছে, ফলে একে আমাদের থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। অদ্ভুত শোনালেও সত্যি যে, আমাদের আমিত্ব এখন অনেকটা সাহসীদের মানদণ্ডে পরিণত হয়ে গেছ! এটিকে দেখতে বীরত্বের মতো মনে হয়, যেন এটি বীরত্বসূচক কিছু, যা আমরা সকলেই অর্জন করতে চাইছি। নিজেকে নত করবার ভয় আসলে এক প্রকারের কাপুরুষতা। একজন ভীরু স্বভাবের মানুষই নিজেকে হারাবার ভয়ে ন্যুব্জ হতে পরে না। সে কাপুরুষ এজন্যেই যে, একজন সাহসী কখনও নিজেকে হারাবার ভয় করে না, কেননা সাহসীরা সবসময় জানে, তার হারাবার কিছু নেই। এজন্যেই ছোটো গাছ কখনও ঝড়ে ভেঙে পড়ে না, ঝড়ে সবসময় বড়ো বড়ো গাছগুলোই ভেঙে পড়ে, যেগুলোর কাণ্ড শক্ত এবং মজবুত। এর কারণ হলো, বড়ো গাছগুলো কখনও নত হতে জানে না, সেগুলো তাদের সর্বশক্তি দিতে বীরদর্পে দাঁড়য়ে থাকতে চায়, বাতাসের বিরূদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, আর সে কারণেই তীব্র ঝড়ে ভেঙে পড়ে। অথচ ছোটো গাছগুলো প্রয়োজনে মাথা নোয়াতে জানে বলেই ঝড়ের সময় বাতাসের কাছে নত হয়, ফলে ঝড়ের শেষে তারা বেঁচে যায়।


যখনই আমাদের জীবনে তীব্র ঝড় আসে, তখন আমাদেরকে ছোটো গাছের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কী করে গাছগুলো নত হতে জানে, সে শিক্ষাটি নিতে হবে। যদি ঝড় আসে, আমরা যেন নত হই। কেননা আমরা আসলে যে ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করতে চাইছি, সে ঝড় আমাদেরকে পরিষ্কার করতে এসেছে। ঝড়শেষে আমরা ঠিকই দেখতে পাবো, চারপাশ কতটা সজীব, স্বচ্ছ, পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমরা যদি নত হতে না শিখি, তবে ঝড় চলে যাবে ঠিকই, তবে আমরা ভেঙে যাব, আমরা আর কখনও উঠে দাঁড়াতেই পারব না। নম্রতা আমাদেরকে সব কিছু এনে দেয়, আমাদেরকে ক্ষতিকর আমিত্বের হাত থেকে রক্ষা করে। অনমনীয়তা, ঋজুতা প্রকৃতপক্ষে বার্ধক্যের লক্ষণ, অন্যদিকে নম্রতা, ন্যুব্জতা, শিশুসুলভ মন আমাদেরকে সজীবতা, সত্যতা এনে দেয়, জীবনকে উজ্জ্বল করে। মনের বার্ধক্য মানুষকে নমনীয় হতে দেয় না, তাকে শক্ত করে রাখে। শিশু সর্বদা নম্র, সে নত হতে জানে। সে খুব সহজেই রাগ ভুলে আবারও মিশতে জানে, সে মনের মধ্যে তেমন কিছু পুষে রাখে না। একটি শিশু হাজারবার পড়ে যায়, কিন্তু প্রতিবার পড়ে গিয়েও খুব জলদি উঠে দাঁড়ায়। যখন একজন মানুষ কাউকে ভালোবাসে, প্রকৃত ভালোবাসায় সিক্ত হয়, তখন সে শিশুদের মতো হয়ে যায়। তখন সে শিশুদের মতো বারে বারে পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াতে শেখে, ভালোবাসার কাছে নত হতে শেখে, তার ভেতরটা নম্র হয়ে থাকে, তার মনের সকল ভয় ও সকল অসাড়তা, যা তাকে ভেঙে ফেলতে পারত, সেগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়।


চুরানব্বই।
আমরা কি জানি, কেন আমরা ভয় পাই? কেন আমরা ভালোবাসার কাছে সমর্পিত হতে ভয় পাই? কারণ যখন আমরা আমাদের ভালোবাসার কাছে নত হতে যাই, তখনই আমাদের ইগো আমাদেরকে ভেতর থেকে বলে ওঠে, যদি আমরা নত হই, নম্রতা দেখাই, তবে আমাদের সম্ভ্রমের কী হবে? আমরা তো হেরে যাব, আমরা অপরের কাছে ছোটো হয়ে যাব। যে মানুষ সবসময় নিজের প্রতিপত্তি রক্ষায় সচেতন থাকে, প্রকৃতপক্ষে তার নিজের বলতে, নিজের মর্যাদা বলতে কিছুই থাকে না। যে ব্যক্তি হেরে যাবার ভয় পায়, সেই তার সাফল্যের ব্যাপারে অনিশ্চিত থাকে। যে মানুষ নিজের কাছেই ভেতর থেকে পরাজিত, সে-ই কেবল সবসময় বাইরের পৃথিবীকে নিজের জয় দেখাতে চায়। আমাদেরকে সবসময় চারপাশ থেকে বলা হয়, মানুষকে ভেঙে পড়েতে নেই, নত হতে নেই, হেরে যেতে নেই; প্রকৃতপক্ষে এমন একজন মানুষ কেবল কাপুরুষের পক্ষেই হওয়া সম্ভব। একে সাহসিকতা বলে না, এটি বীরত্ব নয়। একজন কাপুরুষ সবসময় তার মর্যাদা, তার প্রতিপত্তি হারাবার ভয়ে থাকে। সে ভাবে, যদি সে নত হয়, তবে তার সব খ্যাতি শেষ হয়ে যাবে। সে-ই প্রকৃত মর্যাদাবান এবং সাহসী, যার কিনা মর্যাদা, খ্যাতি অথবা অন্য কোনও কিছুই হারাবার ভয় নেই। আপাতবিরোধী মনে হলেও, সত্যিই যা আমাদের আছে, তা কখনও হারাবার ভয় থাকে না, যা আমাদের আদতেই নেই, অথবা কখনওই ছিল না, আমরা সেটিই হারাবার ভয় করি, সেটি হারাবার ভয়ই আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। অর্থাৎ আমরা এমন কিছু হারাবার ভয় পাচ্ছি, যা আমাদের নয়, যা আমরা অর্জন করিনি অথবা জয় করিনি।


যে-কোনও সম্পর্কে হারাবার ভয় তখনই আসে, যখন আমরা ভুল উপায়ে সেটিকে নিজের বলে জাহির করতে চেষ্টা করি, অথবা যেটি আমাদের অর্জিত নয়। একজন নির্ভীক কখনও কোনও দ্বন্দ্বে জড়ায় না, সে নিজেকে নিজের অস্তিত্বের সাথে বয়ে নিয়ে চলে, সে সকল অস্তিত্বের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। ঝড়গুলো আসলে আমাদের নিজেদের, এটি আমাদের দিকে ধেয়ে আসে না, বরং এটি আমাদের দিক থেকেই আসে। একজন নির্ভীক মানুষ এ বিষয়ে নিশ্চিত যে সমগ্র অস্তিত্বই সে নিজে, সমগ্রের সাথে সেও মিলিত, অর্থাৎ সে আলাদা কিছু নয়। যদি আমরা নত হতে না শিখি, ইগোকে নিয়ে পড়ে থাকি, তবে আমাদের ভেতরে যে ভালোবাসা রয়েছে, সেটি আমাদের নিজেদেরকেই আক্রমণ করবে। যদি আমরা আমাদের কাছের, প্রিয়জনদের বা ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসার সেই স্রোতে জড়াতে না জানি, তবে কী করে আমরা স্রষ্টার ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করব? স্রষ্টার কাছেই-বা কী করে অবনমিত হব? আমাদের ভালোবাসার মানুষ আমাদের প্রতিবেশী, স্রষ্টা বরং তার চাইতে অনেক দূরে থাকেন। আমাদেরকে প্রতিটি স্তরের পথ হেঁটে অতিক্রম করেই স্রষ্টার সান্নিধ্যে যেতে হবে। একই পথে, যে পথে আমাদের ভালোবাসা গেছে, সে পথেই আমাদের স্রষ্টা ক্রমশ এগিয়ে গেছেন। এক এক করে সেইসব কিছু পাড়ি দিয়ে তবেই স্রষ্টার কাছে যাওয়া সম্ভব। স্রষ্টার কাছেই আমাদের সমর্পণের সমাপ্তি, এরপর আর কোনও পথ নেই, স্রষ্টার পথেই ভালোবাসার পথের সমাপ্তি, এবং আমরা যখন সেই সমাপ্তিতে নত হব, তখন আমরা যে পথ ধরে স্রষ্টার পথে হেঁটে গিয়েছি, সে পথে আর কখনও আমাদের ফিরে আসতে হবে না। এটি স্রষ্টার সাথে, স্রষ্টার মাঝে আমাদের মিলিয়ে যাবার সময়, এটি স্রষ্টার সত্তায় মিলিত হবার সময়, এটিই স্রষ্টার সাথে মিশে স্রষ্টার নানান গুণসমৃদ্ধ হওয়া, যেখান থেকেই সকল অস্তিত্বের শুরু, আমরা যে অস্তিত্বের একটি ক্ষুদ্র কণা মাত্র।


যদি আমরা জানি কী করে নিজেকে হারাতে হয়, কী করে নিজের সামনে নত হতে হয়,---যদি আমরা অন্তত একবার এতটা সাহস করে উঠতে পারি, তবেই আমরা প্রকৃত সাহসী, প্রকৃত বীর। তখন আমরা আমাদের আমিত্ব, ভ্রান্ত গরিমা এবং আমাদের ভয়কে জয় করতে পারব, এরপর আমরা এমন এক জীবন নিয়ে বাঁচতে শিখব, যে জীবন সকল বয়সের ঊর্ধ্বে, যেখানে বয়সের কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। স্রষ্টার অস্তিত্বের কোনও বয়স নেই। যখন আমরা স্রষ্টার অস্তিত্বে মিলিয়ে যাই, তখন থেকে আমরা চির যুবক, কেননা তারুণ্য কখনও জন্মায় না, এটি আমাদের অস্তিত্বের সাথেই মিশে আছে। যখন আমরা এমন মুহূর্তে এসে হাজির হই, তখন আমাদের মাঝে নিজের বলে কিছু থাকে না, আমাদের মাঝে কেবল স্রষ্টা থাকেন, আমাদের সবটাই সেই সর্বজ্ঞের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। যারা প্রকৃত ভালোবাসার মৃত্যু বরণ করে, তারা কখনও ফিরে আসে না, কিন্তু যারা সাধারণ মৃত্যু আলিঙ্গন করে, তারা বারে বারে ফিরে আসে। এর অর্থ কী? যারা জীবিতাবস্থায় মহত্ত্বের দিকে নিজেকে নিয়ে যায়, তাদের মৃত্যুর পর ঠিক ওরকম বা কাছাকাছি মানুষ তেমন একটা আসে না, কেননা তেমন হতে পারাটা অনেক সাধনার ব্যাপার। অপরদিকে, একেবারে সাদামাটা অন্য দশজনের মতো না চাইলেও হওয়া যায়। ওরকম মানুষ ইউনিক কিছু নয়, বরং আমাদের আশেপাশে যাদের দেখি, তারা প্রায় সকলেই এমন মানুষ, যাকে দেখলে আলাদা কিছু মনে হয় না, যাকে দেখে আলাদা কোনও সম্ভ্রম জাগে না। এসব মানুষের মৃত্যুর পর ওরকম মানুষ আরও আরও অনেক পাওয়া যায়, ভবিষ্যতেও যাবে। তবে মহৎ, অসাধারণ কিংবা জিনিয়াস মানুষের মৃত্যুর পর তেমন কেউ হয়তো শত বছরেও একজন আর আসে না, আমাদের জীবদ্দশায় তেমন কাউকে আমরা আর না-ও পেতে পারি।


পঁচানব্বই।
যে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পায়; সে তাকে স্বপ্নে নয়, বরং বাস্তবেই পায়। আমরা স্বপ্নে যেগুলো দেখি, তার সব কিছু আমরা পাই না, যেরকম দেখি, সেরকম পাই না, এমনকি প্রায়ই, আমাদের স্বপ্নের কিছুই আমরা পাই না। একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি সারা দিন খাবারের খোঁজ করে, যখন সে রাতে ঘুমাতে যায়, ঘুমিয়ে যাবার পরও সে স্বপ্নে দেখে, সে খাবার খাচ্ছে, স্বপ্নের খাবার তার পেট ভরায় না, তার শরীরকে সুস্থও করে না, কিন্তু তাকে ঘুমের শান্তি এনে দেয়, সে একটু নিশ্চিন্ত মনে ঘুমায় যে সে আর ক্ষুধার্ত নয়। আমরা কেবল সেই জিনিসগুলোর স্বপ্নই দেখি, যেগুলো আমরা অর্জন করিনি। একজন ভিক্ষুক প্রাসাদের স্বপ্ন দেখে, কেননা সে কখনও প্রাসাদ বানাতে পারেনি, একজন দরিদ্র ধনসম্পদ স্বপ্নে দেখে, কেননা তার ধনসম্পদের অভাব রয়েছে। এভাবেই আমরা আমাদের স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের অপ্রাপ্তির সান্ত্বনা খুঁজে ফিরি। স্বপ্ন অবাস্তব, বিভ্রান্তিকর, এবং কেবলই সান্ত্বনা আর অসুস্থ এক তৃপ্তি ছাড়া কিছুই নয়। স্বপ্নে দেখা খাবার আমাদের খালি পেট পূর্ণ করতে পারে না। হয়তো আমাদের অবদমিত বাসনা আমাদের স্বপ্নে পূর্ণতা পায়। তবে বাস্তবে এর কোনও স্থান নেই। স্বপ্ন কেবল আমাদের একটা ভালো ঘুম এনে দিতে পারে। যখন আমরা এমন কিছুর অভিলাষ করি, যা আমাদের নেই, এমন আকাঙ্ক্ষা আমাদেরকে ধীরে ধীরে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত করতেই থাকবে, যতদিন না এটি আমরা বাস্তবে লাভ করব।


যখন আমাদের সব আকাঙ্ক্ষাই মরে যায়, তখন আমরা মৃত্যুর পর আবার ফিরে এসে কী করব? কিন্তু আমরা আবার ফিরে আসি, কেননা আমাদের স্বপ্ন অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আমরা পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দ্যে এতটাই নিমজ্জিত যে আমাদের মৃত্যু ঘটলেও আমাদের আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটে না। আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো আমাদেরকে পেছন থেকে ডাকতে থাকে, ‘কোথায় যাচ্ছো? ফিরে এসো!’ কেউ আমাদেরকে এই পার্থিব জগতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে না, বরং আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষার তাগিদেই আবার ফিরে আসি, আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোই আমাদেরকে এখানে ফিরে আসতে বাধ্য করে। আমরা আবার আমাদের সেই পুরনো অভ্যাস, পুরনো চাহিদা নিয়ে ফিরে আসি, আমাদের নিজেদের আকাঙ্ক্ষার সেতুতে আবার আমরা ফিরে আসি, হয়তো এবার আমরা অন্য কোনও শরীরে ফিরে আসি, কিন্তু আবার ফিরে আসি। আমাদের পুরনো নিয়ম চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। আমাদের অস্তিত্ব যতক্ষণ না পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হয়, সুপক্ব হয়, ততক্ষণ এটি বারে বারে ফিরে আসে। যে মৃত্যুর মাঝে নতুন জন্মের সূচনা হয়, সেটি প্রকৃত মৃত্যু নয়, এমন মৃত্যু অসম্পূর্ণ। যথাযথ জ্ঞান অর্জিত না হলে পরিণত মৃত্যু অসম্ভব। প্রজ্ঞা এমন একটি বিষয়, যেটি এক হাত থেকে আরেক হাতে যেতে পারে না।


আমাদের চুলগুলো প্রাকৃতিক উপায়েই বয়সের সাথে পেকে যায়, কিন্তু শুধু বয়স বাড়লেই কেউ প্রজ্ঞাবান হয়ে যেতে পারে না। যখন কারও আর কোনও আকাঙ্ক্ষা থাকে না, সকল আকাঙ্ক্ষা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখনই কেবল প্রজ্ঞাবান হওয়া যায়। প্রকৃতির সব কিছু একসময় ক্ষয়ে যাবে, মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে, এসবের সাথে শুধুমাত্র সে ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষাগুলোর মৃত্যু হবে, যিনি জানেন প্রজ্ঞা কী, আকাঙ্ক্ষা কাকে বলে, এবং তিনিই প্রজ্ঞালাভ করবেন। সে মৃত্যুই প্রকৃত মৃত্যু, যে মৃত্যুতে পুনরায় জন্মাবার মতো কোনও আকাঙ্ক্ষা অবশিষ্ট থাকে না। আমরা যে কৌশলের মধ্যে দিয়ে মৃত্যুবরণ করি, সেটি মৃত্যুর আসল পথ নয়, কেননা প্রকৃত মৃত্যু হচ্ছে একটি শিল্প। যেখানে আমরা আমাদের জীবনকেই কখনও শিল্প হিসেবে দেখিনি, সেখানে মৃত্যুর মাঝে শিল্প খুঁজে পাওয়া একটা বড়ো প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমাদের কাছে জীবন একটি দুঃখজনক ঘটনা, সেজন্যে মৃত্যু কখনও আমাদের কাছে শিল্প হয়ে ধরা দেয়নি। সে কারণেই যখন আমরা কোনও নতুন কিছু করতে উদ্যত হই, তখন কিছু মুহূর্তের জন্যে থেমে এটুকু ভেবে দেখি না যে, কাজটি কীজন্য করতে যাচ্ছি, অথবা এর প্রয়োজনীয়তা কী, এবং যখন কেউ আমাদেরকে সে বিষয় জিজ্ঞেস করে, তখন আমরা নিজেরাই জানি না আমরা আসলে কী করতে যাচ্ছি। যদিও আমরা এর একটি যথাযোগ্য উত্তর তৈরি করে রাখি, যাতে করে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমরা তার একটা উত্তর দিয়ে দিতে পারি, কিন্তু মনে মনে আমরাও জানি যে এর কোনও উত্তর আমাদের নিজেদের কাছেও নেই।


আমরা আমাদের জীবনকে একটি সুনির্দিষ্ট আকৃতি দিয়েছি, আমরা একে পরিষ্কার করেছি, ঘষামাজা করেছি এবং এই উপায়ে এটিকে চকচকে করেছি, যেন এটি জ্বলজ্বল করে ওঠে। কিন্তু আমরা কি জানি, যদি আমরা এখনই আমাদের এই ঘষামাজা বন্ধ করে দিই, তবে এখন এই মুহূর্ত থেকেই আমরা খাঁটি সোনা হয়ে উঠব? আমরা আমাদের জীবনকে শৈল্পিক করে তুলতে অনেক কিছু করে যাচ্ছি, কিন্তু এগুলোর একটিও শৈল্পিকতার আশেপাশেও নেই। প্রকৃত অস্তিত্বপূর্ণ জীবন এসবের সম্পূর্ণ বিপরীত, সব কিছুর ঊর্ধ্বে। জীবন যতটা শৈল্পিক, মৃত্যুও ঠিক ততটাই শৈল্পিক। যদি আমরা শৈল্পিক উপায়ে বেঁচে থাকতে জানি, তবে আমরা শৈল্পিক উপায়েই মৃত্যুকে বরণ করব। যদি আমরা সঠিক পন্থায় বাঁচতে না জানি, তবে আমাদের পক্ষে সঠিক পন্থায় মৃত্যুলাভও সম্ভব হবে না। মৃত্যু হচ্ছে শীর্ষ, একটি সুন্দর সমাপ্তি, কিন্তু যদি আমরা জীবনেই সঠিক পথে সঠিকভাবে বেঁচে যেতে না পারলাম, তবে মৃত্যু কী করে সঠিক উপায়ে ঘটবে? যার সব কিছু এলোমেলো, তার শেষটা তাহলে কী করে গোছানো হতে পারে? মৃত্যু হচ্ছে আমাদের জীবনের মুকুটস্বরূপ, আমাদের কাজের শেষে, আমাদের কাজের সাফল্যে যেই মুকুট আমরা লাভ করি। মৃত্যু আমাদের জীবন শেষে জীবনের ফল, এটি ঠিক তেমনই হবে, যা আমরা এতদিন করে এসেছি। মৃত্যু আমাদের জীবনের পুষ্পশোভিত এক সারমর্ম, সুতরাং সারাজীবনের অর্জিত ফলই আমাদের হাতে জীবন শেষে তুলে দেওয়া হয়।


ছিয়ানব্বই।
যখন আমাদের পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছেতাই পথে কেটেছে, তখন এমন জীবনের মৃত্যু কী করে শৈল্পিক হতে পারে? যে গাছের কাণ্ডটিই পচে গেছে, সে গাছে কী করে সুস্বাদু ফল ধরতে পারে? আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, একটি শৈল্পিক জীবনের রহস্য কীসে? একটি শৈল্পিক জীবনের মূল হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ সচেতনতার সাথে বাঁচা। আঁধারের ভয়ে কিংবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নয়, বরং পূর্ণ সজাগ এবং সচেতন জীবনযাপনই হচ্ছে শৈল্পিক জীবন। আমরা যা-কিছুই করি না কেন, এমনকি এটি যদি এতটাই তুচ্ছ অথবা ক্ষুদ্র কিছু হয়, যা আমাদের চোখের পলকের সাথেই মিলিয়ে যেতে পারে, যা আমরা মুহূর্তের মধ্যে ভুলে যাতে পারি, সেগুলোকেও সচেতনভাবে গ্রহণ করতে হবে। কে জানে হয়তো সেই ক্ষুদ্র অথবা তুচ্ছ কাজটিই আমাদের জীবনের সব থেকে নির্ভরযোগ্য কোনও কাজ হয়ে যেতে পারে, আমাদের জীবনকে নতুন কোনও অর্থ এনে দিতে পারে! হয়তো সেই তুচ্ছ কাজটিই আমাদের সকল কাজের মূল! যদি আমরা কোনও পথে একাকী হাঁটতে থাকি এবং রাস্তায় হঠাৎ এমন কারও সাথে দেখা হয়ে যায়, যাকে নিয়ে বাকিটা জীবন চোখের পলকেই একসাথে কাটিয়ে দেওয়া যায়, কে জানে হয়তো সেই তুচ্ছ মানুষটিই আমাদের জীবন সঙ্গী হয়ে যেতে পারে! সেজন্যেই আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতি পলকের তুচ্ছতায়ও সচেতনভাবে হাঁটতে হবে। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কিংবা ঘুমন্ত অবস্থায় নয়। আমাদেরকে কেবল আমাদের আগামী পদক্ষেপ দেখে হাঁটতে হবে, তার পরেরটি নিয়ে চিন্তা করবার কিছু নেই। নিবিড়ভাবে ভাবতে হবে কেবল সামনের পদক্ষেপটি নিয়ে। প্রতি মুহূর্তের পদক্ষেপ গুনে গুনে পূর্ণাঙ্গ সচেতনভাবে হাঁটতে হবে।


এটি এমন কিছু নয় যে আমাদের চারপাশে কী হচ্ছে কী হচ্ছে না, তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সব কিছুই দেখার প্রয়োজন আছে, আমাদের কেবল আগামী পদক্ষেপটি ঠিকভাবে হাঁটাটা জরুরি। চতুর্দিকে তাকাবার কোনও প্রয়োজন নেই, আশাপাশে কী হচ্ছে, তা দিয়েও কোনও কাজ নেই, কেননা এরূপ সচেতনতা সারাজীবনব্যাপীও শেষ হবার নয়। আমরা যদি নিজের জীবনের দিকে খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখি, তবে আমরা জানতে পারব, আমাদের জীবনে সব কিছুই আকস্মিক, আমাদের জীবনের যা-কিছু পরিবর্তন এসেছে কোনও দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতেই এসেছে, হঠাৎ কোনও দুর্ঘটনায় আমাদের জীবন পুরোটাই পালটে গেছে। হয়তো আমরা কোথাও যাচ্ছিলাম, কিন্তু যাত্রাপথে আমাদের এমন কারও সাথে দেখা হয়ে গেল, এমন কোনও নারী অথবা এমন কোনও পুরুষ, যার সাথে ক্ষণিকের আলাপচারিতায় তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেল। আমরা সেই মানুষটির প্রতি এতটাই উদ্‌বিগ্ন ছিলাম যে আমরা আর দেরি করতে চাইনি, আমরা তাকে হারাতে চাইছিলাম না, তাই আমরা তাকে বিয়ে করে ফেললাম, আমাদের সংসার, সন্তান সব কিছু হলো, অথচ কেবল মুহূর্তের একটি সিদ্ধান্তে, মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের পুরোটা জীবন কেমন জানি পালটে গেল, আমরা যে পথে যাচ্ছিলাম, যে কাজে আর যে গন্তব্যে যাচ্ছিলাম, সে গন্তুব্য পালটে আমরা অন্য কোথাও চলে গেলাম, আমাদের জীবনের লক্ষ্যটাই সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল। এটা ইতিবাচক দিকেও হতে পারে, নেতিবাচক দিকেও হতে পারে। এমনটাই কি হয় না আমাদের জীবনে?


সব কিছুতেই আমাদের ভারসাম্যে চলতে হবে, এমন কিছুর প্রয়োজন কি আছে? যা-কিছু আমাদের জীবনে বড়ো পরিবর্তন এনে দেয়, তার সব কিছু কি আমাদের সংগতিপূর্ণ কাজের ফলে ঘটেছে? আমরা কতটা সে বিষয়ে সচেতন ছিলাম? আমাদেরকে সব কিছু যথাযথভাবে দেখতে হবে, যা-কিছু আমাদের সামনে আসে, সেগুলো প্রথমে বিবেচনা করে দেখতে হবে, যে-কোনও সিদ্ধান্ত নেবার আগে যে-কোনও কাজ শুরু করবার আগে আমাদেরকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বিচক্ষণতার সাথে ভেবে দেখতে হবে। যদি আমরা এমন করে চলি, তবে আমরা দেখতে পাবো, আমাদের জীবন একপ্রকার সৌন্দর্যে পরিণত হয়েছে, একটি পরিচ্ছন্নতা সেখানে ফুটে উঠেছে। আমরা একটি ভাস্কর্যের মতো হব, আমরা নিজের সমগ্র সত্তা নিয়ে, নিজের সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক অনন্য মানুষ হয়ে উঠব, আমরা নিজেরাই নিজের কারিগর হয়ে উঠব। যদি আমরা সচেতনভাবে বাঁচি, তবে আমরা দেখতে পাব, আমাদের অভ্যন্তরীণ কলকব্জা আমাদেরকে যেমনি করে বাঁধাই করা প্রয়োজন ছিল, ঠিক তেমনি করেই তৈরি করেছে। এটি আমাদের থেকে আমাদের অপ্রয়োজনীয় সব কিছুকে বাদ দিয়ে দিয়েছে, এটি আমাদের অপ্রয়োজনীয়, ব্যবহারের অযোগ্য কিছুই আমাদের মাঝে রাখেনি। আমাদের আত্মার ছেনি আমাদের ভেতরের অতিরিক্ত সব কিছুকে ছেঁটে ফেলেছে এবং আমাদের পুরো জীবনের একটি সঠিক সারমর্ম এনে দিয়েছে। একদিন আমরা দেখতে পাবো, আমরা আমাদের প্রকৃত ঘরে চলে এসেছি, এমন একটি ঘরে, যে ঘরে আমরা গভীর সচেতনতা নিয়ে বাঁচতে পারি।


যদি আমরা আমাদের শরীরের মৃত্যুর আগে এভাবে পূর্ণাঙ্গ সচেতনতা নিয়ে বাঁচতে পারি, তবেই আমাদের সঠিক উপায়ে বাঁচা হবে এবং সে কারণেই আমরা একটি সঠিক মৃত্যু পাবো, এক শৈল্পিক মৃত্যু। কেননা আমাদের চারপাশে মৃত্যু ছড়িয়ে আছে, মৃত্যু আমাদের আশেপাশে অসংখ্য থাবা বসাচ্ছে, যার সবই অসম্পূর্ণ মৃত্যু, যেগুলো সঠিক পথে ঘটেনি। আমরা কেউই সচেতন মৃত্যু নিচ্ছি না, আমরা কেউই সঠিক উপায়ে মরছি না। ফলে মৃত্যুর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয় না, ফলে আবার আমাদের আগের জায়গায় ফিরে আসতে হয়। যখন আমরা কোনও কিছু সঠিক উপায়ে করতে ব্যর্থ হই, তখন কাজটি বারে বারে আমাদের করে যেতে হয়, পুনরায় সে কাজ করে যেতে হয়। স্রষ্টা আমাদের সুযোগের পর সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন, প্রতি মুহূর্তে বাঁচার। কেননা স্রষ্টার কোনও তাড়া নেই, তিনি আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল। যার ফলে আমরা যতবারই ভুল করি, তিনি পুনরায় আমাদেরকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠান, আমাদেরকে সঠিকভাবে মৃত্যুর জন্যে সুযোগ করে দেন। আমরা তখনই স্রষ্টার সাথে মিলিয়ে যেতে পারব, যখন আমরা তাঁর সৃষ্টির, এই জীবনের সকল অভিজ্ঞতাকে পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ করতে পারব। আমরা এমন এক শিশুর মতো, যাকে সেই একই ক্লাসে বার বার ফেরত পাঠানো হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার সকল পড়া ঠিকমতো শেষ করতে পারছে।


সাতানব্বই।
ভালোবাসার ঘরটি আমাদের জন্য বন্ধই থাকবে, যতদিন না আমরা এই জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো কোনও ধরনের প্রত্যাশা বা প্রাপ্তির আশা বাদে পূর্ণাঙ্গভাবে লাভ করতে পারব। জীবনের শৈল্পিকতা হচ্ছে সফলভাবে জীবনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ায়। যে ব্যক্তি জীবনের পথে সফলভাবে অভিজ্ঞ হতে পারে, তার কাছে এই পৃথিবীতে জানার যোগ্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। কেননা এই পৃথিবী থেকে যা-কিছু জানার যোগ্য, ওসবের সব কিছুই তার জানা হয়ে যায়। সে তার আকাঙ্ক্ষিত সকল অগ্নিপরীক্ষায় সঠিকভাবে শিক্ষালাভ করেছে, আর এখন সেই শিক্ষার সর্বোচ্চ শীর্ষ তার জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এখন সে এসকল সাধারণ শিক্ষার জগতের ঊর্ধ্বে। এই পৃথিবীতে যা-কিছু তার জন্য শিক্ষণীয় ছিল, তার সব কিছু শেখার ফলে এই পৃথিবীতে আর তাকে ফিরে আসতে হবে না, এই পৃথিবীর পথ তার জন্য বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের এমনভাবে বাঁচতে হবে যেন এটাই আমাদের শেষ জন্ম হয় এবং আমাদেরকে এমনভাবে মরে যেতে হবে যেন এটাই আমাদের শেষ মৃত্যু, আর কোনও মৃত্যু নেই। যদি আমাদের আবার জন্ম হয়, তবে আমাদের আবারও এই পৃথিবীর একই অভিজ্ঞতাগুলোর সম্মুখীন হতে হবে, আবারও আমাদের মৃত্যু আলিঙ্গন করতে হবে। সুতরাং আমাদেরকে এমনভাবে বাঁচতে হবে যেন আমাদের পুনরায় জন্মাতে আর না হয়। তাহলেই আমাদের আরেক মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে না।


আমরা প্রত্যেকেই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে থাকতে চাই, মৃত্যু থেকে দূরে সরে থাকতে চাই। আমরা কি এমন কাউকে খুঁজে পেয়েছি যে কিনা মৃত্যুর ভয়ে ভীত নয়? মৃত্যু যদি এতটাই ভয়ানক, তবে কেন তারা তাদের পুনরায় জন্ম নেওয়াটাকে রোধ করতে পারে না? জন্মই তো আমাদের মৃত্যুর দ্বারে এনে দেলে দেয়! যখন আমরা বলি, আমরা আবারও এই পৃথিবীর সৌন্দর্যে বারে বারে ফিরে আসতে চাই, এটি কি আমাদের বোকামির পরিচয় নয়? এর অর্থ হচ্ছে, আমরা এই জীবনের নিয়মগুলো এখনও ঠিকমতো বুঝে উঠতেই পারিনি, জন্ম ও মৃত্যু হচ্ছে জীবনের দুটো তীর। এই জীবনের নিয়মানুযায়ী, যে জন্মাল, মৃত্যু তার জন্য অবধারিত। যে জিনিসের শুরু আছে, অবশ্যই তার সমাপ্তি থাকবে। যদি সমাপ্তি না থাকত, তবে শুরুর কোনও প্রশ্নই ছিল না। সুতরাং যদি আমরা মৃত্যুর এই প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে চাই, তবে আমাদের পুনরায় জন্মাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে আসতে হবে, আমাদের শুরুর পথটাই বন্ধ করে দিতে হবে। যদি আমরা অসীম হতে চাই, তবে আমাদের সীমানার পথ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। সেজন্য আমাদেরকে শুধু নিজের শুরুর পথ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করে যেতে হবে। এমনকি খুব ছোট্ট কোনও অভিজ্ঞতাও আমাদের জীবনের শুরুর পথকে বন্ধ করে দিতে সাহায্য করতে পারে।


আমরা অনেকসময়ই হঠাৎ করে রেগে যাই, অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে রেগে যাই। রাগের মাথায় অনেক কিছু করে বসি। যখন রাগ কেটে যায় তখন আমরা আমাদের রাগের জন্য আক্ষেপ করতে থাকি, আমরা আমাদের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই, আমরা নিজেকে বলি, আমরা আর কক্ষনো এভাবে রেগে যাব না, কিন্তু আবার যখন কোনও রাগের মুহূর্ত আসে, তখন আবারও ঠিক আগের মতই রেগে ফুঁসতে থাকি। আমাদের প্রথমেই জানতে হবে যে, রাগকে বেঁধে রাখার কিছু নেই, কেননা এটি একটি প্রকৃতি, রেগে গেলেও আমাদেরকে এর ভেতর দিয়েই যেতে হবে। তবে আমাদের রাগের শুরুতেই সচেতন হতে হবে, রেগে থাকার মুহূর্তগুলোয় আমাদেরকে সচেতনভাবে এর পুরো প্রক্রিয়াটার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আমাদের রাগের উৎস, যৌক্তিকতা বিচার করবার ক্ষমতা সাময়িকভাবে থেমে গেলেও আমাদের রাগের মুহূর্তের প্রতিটি কাজ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। মানসিক পরিপক্বতা থাকলে ওইটুকু করা যায়। রাগ এলে এটিকে আটকে রাখার কিছু নেই, আমাদের শুধু সচেতনতার সাথে এর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এটি প্র্যাকটিস করতে সময় লাগতে পারে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এটা অবশ্যই সত্যি যে এর শেষ আছে, যা-কিছুর শুরু আছে, তার সমাপ্তি ঘটবেই, আমরা চাই অথবা না চাই, এমনকি আমরা সচেতন না হলেও সেটির সমাপ্তি ঘটবেই। যদি আমরা রাগের প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাই, তবে যখনই আমাদের ভেতরে রাগের মুহূর্তে বড়ো বড়ো ঢেউ আমাদের মাঝে এসে জমা হবে সেগুলোর প্রতি সম্পূর্ণ সচেতন হতে হবে। রাগের সময় যা-ই করতে ইচ্ছে করুক না কেন, নিজেকে নীরব ও স্থির রেখে অপেক্ষা করতে হবে। মুখে কিছুই বলা যাবে না তখন, চোখ থাকবে নিচের দিকে। রাগের উৎস থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে জোর করে হলেও।


রাগ আমাদের মাঝে আসবেই, এটিকে কোনওভাবেই আটকে রাখা যাবে না। যখন আমরা কারও দ্বারা নির্যাতিত বা প্রতারিত হই, তখন সেই মুহূর্তে আমরা তার প্রতি রেগে না গেলেও রাগটি আমাদের ভেতরেই তৈরি হয়। হয়তো সাথে সাথে আমরা তার প্রতিক্রিয়া দেখাই না, কিন্তু সেটি আমাদের ভেতর থেকেই তৈরি। এজন্য আমাদেরকে সেই শুরুর মুহূর্তেই সচেতন হতে হবে, যেন এটি আমাদের মাঝে বাসা বাঁধতে না পারে। কেননা একবার যদি রাগ আমাদের মাঝে বাসা বেঁধে ফেলে, তবে আমাদেরকে এর মধ্যে দিয়ে যেতেই হবে, আমরা চাইলেও একে বাধা দিতে পারব না। যে মনে রাগ ঘর বাঁধতে পারে না, সে মনে রাগের কোনও বহিঃপ্রকাশও নেই। রাগ যে কী, তা সে জানেই না, রাগ বলতে কোনও কিছু তার ভেতরেই নেই। আমরা যা-কিছুর নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নিতে চাই, প্রথমে আমাদেরকে সেটির শুরুর পথটা বন্ধ করে দিতে হবে, তাহলেই তার পরের ধাপগুলো আর আমাদেরকে তাড়িত করবে না। আমরা মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাই, অথচ এর শুরুর পথ আমাদের কাছে অজানা। আমরা ভাবি, মৃত্যু কেবলই বার্ধক্যে বাসা বাঁধে, যখন এই শরীর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়, যখন কোনও ঔষধই আর কোনও কাজে দেয় না। কিন্তু এটি আমাদের সৃষ্ট একটি বিভ্রান্তি মাত্র, এভাবে জীবনকে জানা অসম্ভব। যখনই আমাদের জন্মের শুরু, আমাদের ভ্রূণের সূচনা, যেখান থেকে আমাদের জীবনের শুরু, তখনই যদি আমাদের জন্মের সূচনাকে বন্ধ করে দেওয়া যায়, তবে আমাদের মৃত্যুও বন্ধ হয়ে যাবে।


যেদিন আমরা জন্মাই, তার পরের প্রতিটি দিন থেকে আমরা আমাদের মৃত্যুর নিকটবর্তী করতে থাকি। আসলে আমরা প্রতিদিনই মরে যাচ্ছি, প্রতিদিন আমরা একটু একটু করে মৃত্যুর কাছে পৌঁছে যাচ্ছি। এটি আমাদের জীবনের শেষের কোনও ঘটনা নয়, এটি প্রতি মুহূর্তেই আমাদের সাথে একটু একটু করে ঘটে চলেছে। মৃত্যু কোনও আকস্মিকতা নয়, এটি আমাদের জীবনের একটি প্রক্রিয়া। মৃত্যু হচ্ছে সেই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত সমাপ্তি। আমাদের জন্মের সূচনাকে বন্ধ করতে হলে আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলিকে দমন করতে হবে, আমাদের আকাঙ্ক্ষাই আমাদের পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনে। আকাঙ্ক্ষা সবসময় আমাদেরকে ঘিরে ধরে। সবসময় আমরা আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই। আমরা মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করি, আমরা যদি আরও কিছুদিন বাঁচতে পারি, তবে আমাদের ঘরটা তৈরি-করা শেষ করে যেতে পারব, আমার অসম্পূর্ণ কাজগুলো শেষ করে যেতে পারব, কত কাজই তো এখনও আমার বাকি! তারপর যখন আমাদের সব ইচ্ছে একে একে পূরণ হয়ে যায়, তখন আমরা আমাদের স্রষ্টার কাছে যাবার জন্য আরও কিছু সময় চাই, কেননা আমাদের এখনও ধর্মালয়ে যাওয়া হয়নি, ধর্মালয়ে স্রষ্টার কাছে যাওয়া হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলির সমাপ্তি না ঘটে, ততক্ষণ আমাদের আত্মা তৃপ্ত হয় না, আমাদের আত্মার অতৃপ্তিই আমাদেরকে পুনরায় এই পৃথিবীতে নিয়ে আসে অন্য মায়ের গর্ভে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা যতক্ষণ আমাদের আত্মাকে তৃপ্ত না করবে, ততক্ষণ আমরা তুষ্ট হব না।


আটানব্বই।
আমরা যখন আমাদের আত্মাকে তুষ্ট করতে আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই, তখন আত্মাই আবার আমাদের ফিরিয়ে আনে। আমাদেরকে সকল আকাঙ্ক্ষা ঝেড়ে ফেলে আমরা যা, সেটিকে নিয়েই সুখী থাকতে হবে, নিজের সমগ্রতেই আত্মতুষ্টি অর্জন করতে হবে, তাহলেই আমাদের ফিরে-আসার রাস্তাটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের এমনভাবে পরিতৃপ্ত হতে হবে, যেন আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছি, আমাদের আর কোনও লক্ষ্য নেই, এরপর আমাদের আর কোনও গন্তব্য নেই, এখানেই আমাদের সব কিছুর সমাপ্তি। যখন আমাদের গন্তব্যের সমাপ্তি ঘটে, তখন যাবার আর কোনও জায়গা অবশিষ্ট থাকে না, তখন আমরা পূর্ণাঙ্গ আত্মতৃপ্তি নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিই। যে ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ আত্মতুষ্টি নিয়ে মৃত্যুবরণ করে, তার ফিরে আসবার আর কোনও কারণ থাকে না, এ ধরনের মানুষই শৈল্পিক মৃত্যুকে জানে, শৈল্পিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। একজন প্রজ্ঞাবান এবং একজন অজ্ঞ মানুষের মৃত্যু মাঝে পার্থক্য হচ্ছে, একজন আলোকিত মানুষ প্রজ্ঞাবান হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু একজন অজ্ঞ অনাশ্রিত ও সংশয়ী হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে। কিন্তু এরূপ পার্থক্য কোনও চিকিৎসকের চোখে ধরা পড়বে না, যদি একই হাসপাতালে একজন আলোকিত এবং একজন অজ্ঞ মানুষ মারা যান, তবে ডাক্তার কখনও এই দুইজনের মৃত্যুর পার্থক্য ধরতে পারবেন না।


একজন আলোকিত মানুষ পূর্ণতা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু একজন অজ্ঞ মানুষ অসম্পূর্ণতা নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। একজন অজ্ঞ মানুষ মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত ডাক্তার, কাছের মানুষ, সকলের কাছে বেঁচে থাকার জন্য সব রকমের সাহায্য প্রার্থনা করে, কিন্তু একজন প্রজ্ঞাবান মানুষ মৃত্যুকে শান্তির সাথে আলিঙ্গন করে নেয়। ১৯৫০ সালে আমেরিকায় এক ধনী মৃত্যুবরণ করেন যিনি কিনা ধারণা করতেন, যদি তার লাশটি আরও ত্রিশ বছর সংরক্ষণ করে রাখা যায়, তবে ত্রিশ বছর পর এমন কোনও ওষুধ আবিষ্কৃত হবে, যেটি দিয়ে তাঁকে পুনরায় জীবিত করে তোলা যাবে, তিনি আবারও জীবনযাপন করতে পারবেন। প্রতিদিন তাঁর পেছনে দশ হাজার ডলার খরচ করা হতো, যাতে তাঁর শরীরের কোনও অংশ পচে না যায়, তাঁর রক্তের শিরা-উপশিরাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এটি করার জন্য তাঁকে একটি সম্পূর্ণ এয়ারকন্ডিশনড বাড়িতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় হিমায়িত করে রাখা হয়। যদি এক মুহূর্তের জন্যও সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে যায়, তবে তার শরীরে পচন ধরে যাবে, এজন্য তাঁকে সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই সতর্কতার সাথে দেখা হত। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তাঁকে এভাবেই রাখা হয়েছিল! মানুষ কিছুতেই মৃত্যু চায় না, কিন্তু তাকে মৃত্যুকে বরণ করে নিতেই হয়। আমরা মরে না যাবার সব চেষ্টাই অব্যাহত রাখি। আমরা জ্যোতিষের কাছে ধরনা দিই, পিরদের কাছে যাই, এমনকি আমরা আমাদের শরীরে তাবিজও জড়াই, যেন মৃত্যু আমাদের ছুঁতে না পারে। হায়, এত কিছুর পরও আমাদের মৃত্যু কেউ আটকে রাখতে পারে না!


আমাদের বুদ্ধিমত্তা কতটা ভঙ্গুর হলে আমরা এমন কোনও চিন্তার দ্বারা তাড়িত হই যে, কোনও তাবিজের টুকরো অথবা কোনও ধর্মগ্রন্থের একটি বাক্য যা কিনা আমাদের নিজেদেরই হাতে লিখিত, সেই কয়টা বাক্যের মাধ্যমে আমরা শেষপর্যন্ত মৃত্যুর মতো একটি অকাট্য সত্যের হাত থেকে বেঁচে যাব? যদি স্রষ্টা এখনই চান যে আমাদের তিনি তুলে নেবেন, তাহলে তিনি কি তা পারেন না? শুধু বয়স বাড়া মানেই প্রজ্ঞাবান হওয়া নয়। প্রজ্ঞার অর্থ হচ্ছে, এই জ্ঞান অর্জন করা যে এই পৃথিবীতে অর্জনের ও সঞ্চয়ের যোগ্য কিছুই নেই এবং আমাদের জীবন একটি উইপোকার বাসার মতই ভঙ্গুর। প্রজ্ঞাবান হবার অর্থ হচ্ছে সকল আকাঙ্ক্ষা ঝেড়ে ফেলা এবং সেই আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বস্তুগত জিনিসের ঊর্ধ্বে দেখতে পাওয়া, ভালোবাসাকে খুঁজে পাওয়া। একই সাথে এই বোধটুকু অর্জন করা যে ভালোবাসাকে কখনও ছুঁয়ে দেখা যায় না, কিন্তু আমাদের নিঃশ্বাসের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তা অনুভবে থেকে যায়। প্রকৃতি আমাদেরকে কেবল তার সমগ্রের একটি ক্ষুদ্র শ্রেণি বা অংশ হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা অর্থের মানদণ্ডে যতই ধনী হই না কেন, দিনের শেষে অর্থ কেবল একটি কাগজের টুকরো ছাড়া কিছুই নয়। প্রকৃতির কাছে একটি ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ এবং আমাদের মধ্যকার পার্থক্য শূন্য, কেননা প্রকৃতির নিজের টিকে থাকার জন্য, প্রাণের চক্র, সৃষ্টির চক্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটি ছোট্ট কীটপতঙ্গের প্রয়োজনীয়তা যেরকম, আমাদের প্রয়োজনীয়তাও প্রকৃতির কাছে ওটার বিন্দুপরিমাণ কম অথবা বেশি নয়।


আমরা সমাজের যতই উঁচু আসনে বসে থাকি না কেন, দিনশেষে আমরা ঠিকই টের পাই, আমাদের সেই ক্ষমতার আসনটি আমাদের অপ্রাপ্তি, অক্ষমতা, অসন্তোষের চাপকে কিছুমাত্রও লাঘব করতে পারে না। আমাদেরকে বাড়তি কোনও তৃপ্তি এনে দেয় না, আমাদের অসন্তুষ্টিগুলিকে অদৃশ্য করে দেয় না। আমরা আমাদের ইগো ধরে বসে থাকি, অথচ আমরা দেখতে পাই এই ‘আমিত্ব’তে কোনও মানসিক শান্তি নেই। হয়তো আমরা উঁচু দালানে বাস করি, কিন্তু আমরা দেখি, আমাদের ভেতরের দারিদ্র্য কখনও আমাদের ভেতর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় না। হয়তো আমরা আমাদের পরিশ্রমের দ্বারা আমাদের ইচ্ছের সব কিছুই পেয়েছি, হয়তো আমাদের অর্জনের ঝুলিটি পূর্ণ, কিন্তু যখন আমরা জানব, আমাদের এসকল অর্জন আসলে জীবনের প্রকৃত সারমর্মের কাছে মূল্যহীন, কেননা এটি আমাদেরকে আলোর পথ থেকে, প্রজ্ঞার পথ থেকে অনেক অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে, তখন আমাদের জীবনের অর্জনের একমাত্র যোগ্য পথটি খুঁজে পাবো। এই পথটি আমাদের নিজেদেরকেই খুঁজে নিতে হবে, এটি এমন কিছু নয় যে আমরা কারও কথার মাধ্যমে শিখে নেবো, জীবনের যোগ্য খেলাটি আমাদের নিজের চলার পথে নিজেকেই শিখে নিতে হবে। একজন প্রজ্ঞাবান মানুষের কাছে এই পৃথিবী একটি শিশুর খেলনা মাত্র, এখানে প্রজ্ঞাবানদের কোনও জায়গা নেই, এখানে প্রজ্ঞাবানদের কিছুই শেখার বাকি নেই, কোনও কাজই অবশিষ্ট নেই।


যখন একজন আলোকিত মানুষ এই পৃথিবীর যাবতীয় অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তখন তিনি পূর্ণরূপে নির্ভার, নিরাসক্ত মানুষে পরিণত হন, তাঁর ভেতর থেকে আকাঙ্ক্ষা বিষয়টিই ভেঙে যায়। একজন আলোকিত মানুষের কাছে পার্থিব জগতটি একটি সমাধিক্ষেত্র। একজন আলোকিত মানুষ তিনিই, যাঁর চোখে তিনি নিজে মৃত, যিনি পার্থিব জগতের মৃত্যুর আগেই স্বেচ্ছামৃত্যুকে বরণ করে নেন, নিজেকে যিনি মৃত মনে করেন, আর যে ব্যক্তি বেঁচে থেকেই মৃত হয়ে যায়, তার কাছে মৃত্যু কোনও নতুন বিষয় নয়, তাঁর কাছে নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে, সাহায্য চেয়ে বেঁচে থাকার কিছু নেই। একজন আলোকিত মানুষ জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি জীবনের সব কিছুকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করে যান, তার ভেতরে কখনও অতৃপ্তি বাসা বাঁধতে পারে না। অতৃপ্তি কথাটি তাঁর অজানা, কেননা তিনি জানেন না কীভাবে অতৃপ্ত হতে হয়, কী করলে মানুষ অতৃপ্ত। তিনি তৃপ্ত এবং অতৃপ্তের ঊর্দ্ধে উঠে গেছেন, এবং যখন তাঁর তীরে মৃত্যুর নৌকো এসে তাঁকে তুলে নেবার জন্য অপেক্ষা করে, তিনি আনন্দের সাথে সেটিকে গ্রহণ করেন, যেখানে একজন সাধারণ মানুষের সামনে যখন মৃত্যু এসে হাজির হয়, তখন সে মৃত্যুকে থামিয়ে রাখতে চায়, সে মৃত্যুর কাছে আরও কিছু সময় চায় যেন সে কিছুটা হলেও আরও কিছু সুখ পেতে পারে, কেননা সে জীবনের কাছে অতৃপ্ত, তার ধারণা, হয়তো আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারলে জীবন তাকে কিছুটা সুখ এনে দেবে, অথচ যে জীবন তাকে এতকাল সুখ দিতে পারেনি, সে জীবন কী করে আর কিছুকাল বেঁচে থাকায় তাকে সুখী করতে পারে!