অস্পষ্ট জার্নাল: ১

এক। আমরা যে পৃথিবীটাকে দেখি, সে দেখাটা কতটুকু স্বপ্ন আর কতটুকু বাস্তব, তা বোঝার সুযোগ আমাদের খুব কমই হয়। আমরা আমাদের নিজেদের আর আমাদের চারপাশের জগতটার সম্পর্কে যে ধারণা পাই বা পাই বলে বিশ্বাস করি, সে ধারণা প্রায়ই ভ্রান্ত এবং প্রকৃত অবস্থার বিপরীত। হয়তোবা আমরা সারাজীবনই একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিই, যেটাকে বাস্তব ভেবে নিয়ে আমরা বেশ ভাল থাকি, বা ভাল থাকার অভিনয় করে যাই। পৃথিবীতে আসলে কিছুই বদলায় না, আমরা নিজেরাই বদলে যাই, কখনো-কখনো আমাদের মনমানসিকতা বা চাহিদা বদলে যায়। সামনে এগোনোর জন্য কিংবা পিছিয়ে যাওয়ার জন্য যাকিছু দরকার, তার সবই আমাদের চোখের সামনেই থাকে, শুধু একটা ভারি ধূসর চাদর সেসবকিছুকে আড়াল করে রাখে। নিজেদের মধ্যে যা আছে, তার তোয়াক্কা না করে আমরা কী একটা যেন খুঁজতে থাকি, খুঁজতেই থাকি। আমাদের জাগতে হবে আমাদের জাগতে হবে—এর মানে কী আসলে? আমরা এখন কোনো একটা অবস্থায় আছি, যা আমাদের পছন্দ নয়, যা থেকে আমরা সত্যিই বেরিয়ে আসতে চাই। আমাদের সামনে যা আছে, যাকে নিয়ে আমরা জেগে আছি, তা যদি আমরা না চাই, তবে তাকেই ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে, কিংবা আমাদের চোখের সামনে থেকে আড়াল করে ফেলতে হবে। আমাদের জেগে উঠতেই হবে, এমন নয়; বরং আমরা যা নিয়ে বাঁচতে চাই না, স্রেফ তা যদি আমরা আমাদের চোখের সামনে থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি, তবে আমাদের ভেতরের সেসব শক্তি আপনাআপনিই জেগে উঠবে, যেগুলি আমাদের ওই মুহূর্তে ভীষণ প্রয়োজন। ধরুন, কালকে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে। আপনি চাইছেন, আপনার সবচাইতে দামি শার্টটা সে অনুষ্ঠানে পরে যেতে। আপনার দুটি দামি শার্ট আর পাঁচটি সস্তা শার্ট আছে। যদি সেই পাঁচটি সস্তা শার্টকে আপনার চোখের সামনে থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে না পারেন, তবে কে জানে, হয়তো আপনি সে অনুষ্ঠানে যাবার আগ মুহূর্তে নিজের অবচেতন মনেই সস্তা শার্টটা গায়ে দিয়ে বের হয়ে যাবেন! আবর্জনা যেমনি করে রাস্তা আড়াল করে, তেমনি অপ্রয়োজনীয় ভাবনা বা মানসিকতা সঠিক ভাবনার পথটাকে আড়াল করে রাখে। আবর্জনা না সরালে মনে হতে চাইবে, ওই আবর্জনাই বুঝি রাস্তা। ঠিক তেমনি বর্তমানের পুরনো জঞ্জাল মাথা থেকে না সরালে মন বিশ্বাস করবে, ওই জঞ্জালে বাঁচার নামই জীবন। একদিন যখন আত্মার মৃত্যু এসে বিবেকের দরোজায় কড়া নাড়তে থাকে, সেদিন নিজের এতদিনের বোকামিতে নিজেই হাসতে থাকি আর ভাবি, কী এক কষ্টের আঁতুড়ঘরকে সুখের প্রাসাদ ভেবে নিয়ে এতদিন কাটিয়ে দিলাম! প্রায়ই এরকম হয়, আমার নিজের জীবনটা যেমন, আমার সেটা ভাল লাগে না; যাকে নিয়ে আমি আছি, তার কিছুই আমার ভাল লাগে না; যে কাজটা আমি করছি, সে কাজটা আমার ভাল লাগে না; যে শহরে আমি থাকছি, সে শহর আমার ভাল লাগে না; যা খেয়ে আমি বেঁচে আছি, সে খাবার খেতে আমার ভাল লাগে না। তখন আমি কী করি? জীবনটা অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে—সেই কল্পরাজ্যের স্বপ্নে বেঁচে আধ-বেঁচে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই। আর যদি এমন করতে-করতে একদিন মরেই যাই, এরপর তো আর কিছুই বাকি থাকল না। তখন, এই যে বেঁচে ছিলাম এতদিন, তার পুরোটাই অর্থহীন হয়ে যায়। এই পৃথিবীতে আসার পর থেকে অন্য স্বপ্নের মোহে দিন গুনে-গুনে একদিন আমরা টুক্ করে মরে যাই। এভাবেই বাঁচার অভিনয় করে যাই অন্য জীবনের খোঁজে। বাস্তবতা কিংবা স্বপ্ন, এর কোনোটাই আমাদের ভাগ্যে জোটে না। আসলে, কোমল স্বপ্নে কষ্টে বেঁচে মরার চাইতে কখনো-কখনো কঠিন বাস্তবতায় কোনোরকমে বাঁচাও ভাল। পোলাওকোর্মার স্বপ্নে শাকান্নকে তুচ্ছ ভেবে বাঁচতে-বাঁচতে যদি কখনোই সে পোলাওকোর্মা ভাগ্যে আর না জোটে, তবে অমন মিথ্যেস্বপ্নে বাঁচার কী মানে? আমরা যে মুহূর্তটাতে জেগে আছি, তখন আমাদের দেখলে মনে হয়, ঘুমিয়ে পড়েছি। যখন ঘুমিয়ে পড়ি, তখন আমাদের চেহারায় স্পষ্ট ভাসতে থাকে জেগে থাকার ভাব। এমন ছদ্মবেশী জীবনের পথেচলা আর কত? চোখ আর ঠোঁট মিলে যে ফুর্তিতে মেতে থাকে, সে ফুর্তির খোঁজ মন কোনোদিনই জানলো না। মেনে নিতে হবে, এও বাঁচা? আমাদের ভেতরকার চৈতন্যবোধ যতক্ষণ না জাগছে, ততক্ষণ আমাদের সকল বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তবজ্ঞান মিলেও আমাদের সত্যিকার অর্থে জাগাতে পারে না।

দুই। অনেক কাজ, দুশ্চিন্তা আর ভয়ের মধ্যে আমাদের দিনগুলি কাটে। হাতে যখন সময় অল্প, কাজ সীমাহীন, তখন কিছুটা হলেও ঘুম কমিয়ে কাজ করে যেতে হয়। ঘুমিয়ে পড়লে তো কাজের পাহাড় আরো বেড়ে যাবে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে এই আশায় ঘুমিয়ে পড়ি—ঘুম ভাঙতেই দেখবো, কোনো এক যাদুবলে সব কাজ উধাও! কিন্তু তা কি আর হয়! এসবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপনি নাহয় একদিন ঘুমিয়েই পড়লেন। এরপর স্বপ্নে চলে গেলেন স্বর্গে ঘুরতে। সে স্বর্গের অমরাবতী থেকে অপূর্ব এক ফুল হাতে নিয়ে ভাবলেন, “হ্যাঁ, এমন একটা সুন্দর ফুলই তো আমি চেয়েছিলাম।” ঘুম ভাঙল। বুঝলেন, এতক্ষণ যা দেখছিলেন, সবই ফাঁকি। আপনি স্বর্গ থেকে মুহূর্তেই ফিরে এলেন পৃথিবীতে। তবে কি সবই ফাঁকি? না না, স্বর্গের সে ফুলটি আপনার হাতে ঠিকই রয়ে গেছে। এরপর আপনি দেখতে শুরু করলেন আরেক স্বপ্ন। স্বপ্নের ফুল যদি হারিয়ে যায়? আবার যদি আপনি রিক্ত শূন্য হয়ে যান? কীকরে এই ফুলটা সারাজীবনের জন্য আপনার কাছে রেখে দেয়া যায়, সে স্বপ্নের যাত্রা হলো শুরু। আপনার একঘুমের স্বপ্নেপাওয়া ফুলকে বাঁচাতে আরেক জাগ্রত স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে নতুন করে গড়ার যুদ্ধ। ফুলটি আপনাকে সবসময়ই মনে করিয়ে দিচ্ছে, “ঘুমের মধ্যে যে অমরাবতীতে আপনি চলে গিয়েছিলেন, সেটা হয়তো মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু এই আশ্চর্য স্বপ্নের ফুল তো আর মিথ্যে নয়। সে ফুলের বাগানে আনন্দে ঘুরে বেড়াতে হলে জীবনের রাস্তাটাকে বদলে সে অমরাবতীর রাস্তায় নিয়ে যেতে হবে। ঘুমের মধ্যে দেখা স্বর্গে সত্যিই যেতে চাইলে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘুমের সুন্দরকে নির্ঘুমেই খুঁজতে হয়।” জীবনে শুধু অবিরাম চললেই হয় না, কখনো-কখনো থামতে হয়। আমার ভাগ্যে যা আছে, যা হবার, তা-ই হবে, একটু বিশ্রাম নিয়েই দেখি না কী হয়!—এরকম ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার কিছু নেই। কখনো-কখনো, সবচাইতে সুন্দর ভাবনাটা তখনই আসে, যখন আমরা মাথায় কিছুই রাখি না। ভারাক্রান্ত মাথা স্বপ্নের ভার নিতে পারে না। মাথাটাকে একেবারে নিরুদ্বিগ্ন নিঃশঙ্ক নিরুত্তাপ করে দিয়ে নির্ভার হয়ে যেতে পারলে সুন্দরতম স্বপ্নটি রহস্যময় মস্তিষ্কের গোপনতম প্রকোষ্ঠে কীভাবে যেন গেঁথে যায়। পরবর্তীতে সে স্বপ্নের দায় শোধ করতে ক্রমাগত কাজ করে যাওয়ার মধ্য দিয়েই একসময় স্বপ্নের সাথে দেখা হয়ে যায়। শুধু পথ চললেই, চলতেই থাকলে, কখনোই না থামলে, অভিমানী জীবন ভুলগুলিকে ক্লান্তির আড়ালে ঢেকে দেয়। ভুলগুলিকে চিনে নিতে, শুধরে নিতে জীবনে চলার পথে থামতে হয়, স্বপ্নবাগিচার সুশীতল ছায়ায় খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিতে হয়। নিজের উপর বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে আর নিজের সামর্থ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার জন্যই জানতে হয়, কখন থামতে হবে। আমরা শুরু করতে জানি, ঠিক জায়গায় থামতে জানি না, তাই হেরে যাই। পুরো পৃথিবীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চাই, অথচ নিজেই থেকে যাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যদি স্বপ্নছোঁয়ার রাস্তাটা ঠিক না করেই ক্রমাগত চলতে থাকি, তবে হয়তো সে স্বপ্নযাত্রা উপভোগ করা যাবে ঠিকই, কিন্তু স্বপ্নটা আর ছোঁয়া যাবে না। হৃদয়ে যে পবিত্র গোলাপের গাছটা রোপণ করেছি, জীবনের অফুরান নদীর জলে যদি সে গোলাপের যত্ন না নিতে পারি, তবে তার সুবাস চারিদিক মাতাল করবেই বা কেন?

তিন। আমরা কখন নিজেরা নিজেদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠি? কখন থেকে নিজের বুদ্ধি আর ক্ষমতার উপর ভর করে আমরা চলতে শিখি? কখন নিজের প্রতি সম্মানবোধটা তীব্র হয়ে ওঠে আর কঠোরতম দায়িত্বটাও হাসিমুখে নিতে আর কোনো কষ্টই হয় না? জীবনে এমন সুদিন সেদিনই আসে, যেদিন পৃথিবীর কারো কোনো কথায়ই আমার কিছু এসে যাবে না। যেদিন আমরা যথেষ্ট যুক্তি, যোগ্যতা আর সাহস নিয়ে অন্যের মতকে পরোয়া না করেই চলতে পারবো, সেদিন আমাদের স্বেচ্ছা-স্বাধীনতার দিন, গৌরবের দিন। যেদিন আমরা আমাদের স্বপ্নের মতো করে বাঁচতে পারবো কারো উপর বিন্দুমাত্রও নির্ভর না করে, সেদিন আমাদের মাথা উঁচু করে চলার দিন। সেই দিনটাতে পৌঁছানো যায় কোন পথে? কারো পথ চোখে দেখা যায়, কারো পথ শুধু অনুভব করতে হয়। পথটা বাহ্যিকই হোক, আর আভ্যন্তরই হোক, গন্তব্য কিন্তু একই। সুখ, শান্তি আর স্বস্তি—এই তিন এর চাইতে বড় কিছু পৃথিবীতে আর নেই। কখনো-কখনো, এই তিনটি, এমনকি, ভালোবাসার চাইতেও বড়। ধনের ঐশ্বর্যই হোক, আর মনের ঐশ্বর্যই হোক, যেকোনোটির প্রাপ্তিতে এই তিন মহাসম্পদের অধীশ্বর হওয়াই জীবনের মুখ্য সাধনা। এই পৃথিবী পাগলের কারখানা, এখানে আমরা যা দেখি, তার সবটুকুকেই সত্য বলে ধরে নেয়ার চাইতে বড় মিথ্যা আর কিছু নেই। যে ডাকপিয়নের কাছ থেকে দরোজা খুলে আমার চিঠিটা বুঝে নিই, সেও কি কখনো জানতে পারবে, আমার ঠিকানা আসলে কোথায়? যে ঠিকানায় আমার চিঠি পৌঁছয়, সে ঠিকানা আসলে অন্য কারো। আমি নিজেই এই গোলমেলে ব্যাপারটার কতটুকুই বা জানি? আমাদের মৃত্যুর পর যখন সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে কাঁদে, তখন কারো মাথায় কি ঘুণাক্ষরেও আসে যে যার জন্য ওরা সবাই কাঁদছে, সে আসলে মরেনি? যেটার দিকে তাকিয়ে আছে, সেটা তো এক মাংসের দলা ছাড়া আর কিছুই নয়। মৃত্যুর পর মেডিক্যাল সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছাড়া অন্যদের কাছে দেহের কীসের দাম? মৃত্যুর পর কেউই আর আমাদের নাম ধরে ডাকে না, মৃতদের সর্বজনগৃহীত একটাই নাম: লাশ। প্রত্যেক মানুষ মূলত এক অজর অবিনশ্বর আত্মা ভিন্ন আর কিছু নয়। মৃত্যুর পর ধুলোর চাদর ঘর হয়ে পুরো শরীর ঢেকে দেয়। মৃত শরীর ঝিনুকের খোলসের মতো, আর আত্মা হল মুক্তো, যা খোলস ছেড়ে একসময় না একসময় বেরিয়ে পড়ে। যতক্ষণ ভেতরে মুক্তো থাকে, ততক্ষণই তো ঝিনুকের দাম। যে ঝিনুকে মুক্তো নেই, কার‌ও গলায় সে ঝিনুকের জায়গা হয় না, অতি অবহেলায় আর বিস্মৃতিতে পায়ের তলায় তা পড়ে থাকে। শরীরটা এক কারাগারের মতো, যেখানে আমরা থাকি, বেঁচে থাকার সময়টাতে দিন ফুরোই। যে খাঁচাটি ছেড়ে পাখি পালিয়ে যায়, সে খাঁচার আর কী-ই বা দাম? পাখির পাখিজন্মের সার্থকতা বন্দিত্বে নয়, মুক্তিতে। পাখি যতো বেশি মায়া ছড়ায়, পাখি উড়ে যাওয়ার পর লোকে পাখির শূন্য খাঁচা দেখে ততো বেশি কাঁদে। এই মায়ার গভীরতা বাড়ে বা কমে নিয়ত আর কাজের মধ্য দিয়ে। আমার যে ঘর, সে ঘর ভেঙে যাবে। আমার যে খাঁচা, সে খাঁচা ধুলোয় মিশে যাবে। আমার এ দেহ এক অভিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই নয়। বড় নশ্বর এ দেহ, ধরে রাখা যায় না। স্মৃতিটুকু কেবল কাঁদিয়ে যায়। এ পৃথিবীতে যা হওয়ার তা-ই হয় শেষ অবধি। এরই মাঝে আমাদের বেঁচে থাকার নিপুণ অভিনয়। আমাদের সকল অহংকার, সকল গরিমা, সকল বাহ্যিক সম্পদ, এ সবকিছুই মাটিতে মিলিয়ে যাবে। আমাদের সৃষ্টি, আমাদের ভাল কাজগুলি থেকে যাবে। আমাদের চেতনা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকবে যুগের পর যুগ। আমরা চলে যাবো এমনি করে, যারা থেকে যাবে, আমরা তাদের প্রতীক্ষায় থাকব ওই পারে—এটাই পৃথিবীর রীতি। মৃত্যু শুধুই মৃত্যু নয়, মৃত্যু আরেক জীবনের আহ্বান। যে মৃত্যু কোনো চেতনা ছড়িয়ে দেয় না, সে মৃত্যু অর্থহীন। মৃত্যু কী? এক দীর্ঘ ঘুম? যে ঘুম সকল চৈতন্যকে অবশ অসাড় করে রাখে অনন্তকাল ধরে? ঘুম আর জাগরণের মধ্যে যে দেয়াল, তা কতটা পুরু? যারা বেঁচে আছে, তাদের সাথে মৃতদের দূরত্ব কি সেই দেয়ালের পুরুত্বের চাইতেও বেশি? এ পৃথিবীতে যাকিছুর অস্তিত্ব আছে বলে আমরা দাবি করি, তার পুরোটাই কি একটা বিশাল অনস্তিত্বের অংশ নয়? এই যে সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসার এমন প্রকট অস্তিত্ব, তার শেষ কি মায়ের মৃত্যুতে? সন্তানের জীবনে যদি অন্য কোনো ভালোবাসার অস্তিত্ব মায়ের ভালোবাসার চাইতেও আরো বড় হয়ে ওঠে জীবনযাপনের কোনো এক পর্যায়ে, তখনো কি মায়ের ভালোবাসার অস্তিত্ব টিকে থাকে আগের মতোই? যখন সে সন্তানের একটি সন্তান জন্ম নেয়, সেসময় কি মায়ের সেই ভালোবাসাটা একটু হলেও ফিকে হয়ে ওঠে না? আমার মায়ের মা মারা যান আমার ছোটভাইয়ের কোনো এক জন্মদিনে। নিজের মায়ের স্মৃতি আমার মাকে হয়তো তাড়া করে বেড়াবে আজীবন, কিন্তু মা আমার ছোটভাইয়ের জন্মদিনে নিজের মায়ের মৃত্যুদিবস পালন করেন না, বরং নিজের সন্তানের মঙ্গলকামনায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, অন্যদের সাথে জন্মদিনের কেক কাটেন হাসিমুখেই। কোন আবেদনটা আমার মায়ের জীবনে বড় হয়ে ওঠে সেদিন? মায়ের মৃত্যুদিবসের ব্যথা? নাকি, সন্তানের জন্মদিনের আনন্দ? স্রষ্টার এই খেলার কাছে সৃষ্টি বড় অসহায়।

চার। আমরা যেকোনো স্থানে সে স্থানের বস্তুগুলির মধ্যে, কিংবা সে সময়ে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে যে সম্পর্ক বা মিথস্ক্রিয়া চলছে বলে দাবি করি, তা মূলত আমাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা দ্বারাই প্রভাবিত, এমনকি কখনো-কখনো সৃষ্টও। এই দাবির সাথে ওই বস্তুগুলি বা ঘটনাগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের মিল থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। মেঘ জমে আকাশ কালো হয়ে উঠলে কেউ-কেউ অমঙ্গল দেখেন, কেউ-কেউ দেখেন ফসলের সম্ভাবনা। আমরা যখন কোনোকিছু নিয়ে ভাবি বা কোনো একটা কাজ করি, তখন আমরা সচেতনভাবেই সে বস্তু বা কাজ সম্পর্কে একটা ধারণা নিজের মধ্যে তৈরি করে ফেলি। যখন দেখি, আমরা এতোটা সময় ধরে যা নিয়ে ভেবেছি, তার প্রায় পুরোটাই ভুল, তখন আমরা সম্বিৎ ফিরে পাই এবং সবকিছু নিয়ে অন্যরকম ধাঁচে ভাবতে শুরু করি। আমরা যতদিন বেঁচে থাকি, ততদিন আমরা বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে সময় পার করি। যখন যে স্বপ্নের মধ্যে বাঁচি, তখন সেটাকেই বাস্তব হিসেবে ধরে বাঁচি। কোনোভাবেই এটা মাথায় আসে না যে, এখনকার স্বপ্নটা পরের স্বপ্নের পথ দেখাচ্ছে মাত্র, আর কিছু নয়। স্বপ্নকে ক্রমাগত প্রশ্ন করার মাধ্যমে বাস্তবকে চোখের সামনে দেখা যায়। যা নিয়ে ভাল আছি বা মন্দ আছি ধরে বাঁচছি, সেটা আসলেই কতটা ভাল বা কতটা মন্দ, এ প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মাথায় সাধারণত আসে না। যাদের মাথায় আসে, তারা একটা স্বপ্নে থাকার সময়ই পরের স্বপ্নের ধারণা পেয়ে যায়, এবং সেসময়ই চেষ্টা করে, পরবর্তী স্বপ্নটা কেমন, সেটা নিয়ে ভাবতে, বুঝতে। আমরা শান্তির স্বপ্নে বাঁচি, নিজের সুখ আর স্বার্থপরতার ছকে জীবন সাজাই, অন্যরা কে কী ভাবছে, বা বর্তমানের স্বপ্ন ভবিষ্যতে দুঃস্বপ্ন ডেকে আনবে কিনা, সেটা নিয়ে ভাববার মতো দূরদর্শিতা বা স্রেফ ইচ্ছে কয়জনেরই বা থাকে? এই পৃথিবীটাই একটা স্বপ্ন, যারা ঠিকভাবে চেষ্টা করে, তারা এ স্বপ্নটা ছুঁতে পারে। পৃথিবীটা একটা স্বর্গ, যে নিজেকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারে, সে-ই এই স্বর্গের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। এ পৃথিবী এক দীর্ঘ যাত্রা, যারা নিজেদের এ যাত্রার জন্য প্রস্তুত করতে পারে, তারাই পথচলার আনন্দ উপভোগ করতে পারে। পৃথিবীটা একটা কঠিন পরীক্ষা, এ পরীক্ষায় জয়ী হওয়াটা কেবল সেরাদের জন্য বরাদ্দ। পৃথিবীটা দুদিনের, একমাত্র জ্ঞানীরাই এটা বুঝে বাঁচেন। পৃথিবীতে বাঁচার সবচাইতে বড় শর্ত হল, এখানে ত্যাগ করে চলা শিখতে হয়। শরীরে আর মনে অতো ভার নিয়ে চলা যায় নাকি? প্রকৃত যোদ্ধারাই অমন বিসর্জনের দীক্ষায় চলতে পারে। এ পৃথিবী একটা ভয়ংকর মায়া, নির্লোভরাই এখানে বাঁচার মতো বাঁচতে পারে। পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার সবচাইতে বড় অবলম্বন হচ্ছে মানবতা। যাদের হৃদয়ে দয়া নেই, তারা এই অবলম্বনের নিশ্চিন্ত ছায়াতলে কখনোই বাঁচতে পারে না। পৃথিবীর সবচাইতে সুমিষ্ট মিথ্যেটা হল পৃথিবী নিজেই, যারা নিজেদের ভেতরের সৌন্দর্যের খোঁজ পায়, তারাই শুধু মিথ্যের ভিড়ে সত্যটাকে পৃথকভাবে গ্রহণ করে চলতে শেখে।

পাঁচ। নিজকে যে ভালোবাসে না, সে কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারে না। যার নিজের প্রতি আত্মসম্মানবোধ নেই, সে কখনো কাউকে সম্মান করতে পারে না। সব ধুলোছাইই ফেলনা হয় না, একইভাবে, যারা আলাদা করে আমাদের চোখে পড়ে না, একেবারেই পথে মিশে যাওয়া মানুষের ভিড়ে যারা অগণ্য আর সাধারণ, তাদের সবাই যে অকেজো আর বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে, এমন নয়। এ পৃথিবীতে ভালোবাসার সত্য সঠিক পথটাতে হাঁটতে হলে প্রথমেই যা প্রয়োজন, তা হল, ধুলো আর ছাই যেমনি করে নিজের সমস্তটুকু বিকিয়ে পথে পড়ে থাকে, তেমনি করে নিজের সকল অহংবোধকে বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসা গ্রহণ আর ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। এরপর যে অল্প সময়ের জন্য আমরা পৃথিবীতে আছি, সে সময়টাতে আমাদের ভেতরটাকে পরিশুদ্ধ করে যদি এমন স্বপ্নের মায়াজালে নিজেকে বেঁধে ফেলতে পারি, যে স্বপ্নের আনন্দ ক্ষণিকের মাত্র নয়, তবে আমরা ঠিক পথটার খোঁজ পাবো। একটা শিশু ঘুমের মধ্যে যে দুঃস্বপ্নগুলি দেখে, সেগুলিকে সে সত্য ভেবেই দেখে। আমাদের কারো পক্ষে কি সম্ভব তার দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকে ওতে সুন্দর কিছু উপাদান মিশিয়ে দিয়ে দুঃস্বপ্নকে সুখস্বপ্ন বানিয়ে দেয়া? আমরা বড়োজোর যা করতে পারি, তা হল এই, শিশুটিকে খুব সাবধানে আস্তে-আস্তে জাগিয়ে দিয়ে ওকে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি দিতে। আমাদের সাথেও স্রষ্টা এই কাজটাই করে যাচ্ছেন। আমাদের ভেতরে যে বিবেক আছে, যা আমাদের ভাল কাজের অনুপ্রেরণা যোগায়, খারাপ কাজ করলে অনুশোচনা জাগায়, তা-ই আমাদের ঈশ্বর। আমাদের প্রকৃত সুপথে জাগিয়ে তুলতে বিবেক কাজ করে যায় প্রতিনিয়তই। বিবেকের রায় মেনে চলে যারা, তাদেরকে পৃথিবীর কোনোকিছুই ততোটা পথভ্রষ্ট করতে পারে না। অনেক সময় নিয়ে কোনোকিছু নিয়ে খুব করে ভাবতে থাকুন। এরপর দেখবেন, সেই জিনিসটাই বা ভাবনাটাই কেমন করে জানি আপনার স্বপ্নে ফিরে এসেছে! বিবেক যা করতে বলে, তা যদি গ্রহণ করেন আর সেটা মাথায় রেখে সময় কাটান, তবে দেখবেন, আপনার পক্ষে আপনার নিজের বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর কোনোকিছু করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। জীবন নামের যে স্বপ্নে আমরা বেঁচে আছি, সে স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠা মানেই তো মৃত্যু। এই জেগে ওঠার পর বোঝা যায়, আমরা এতদিন যাকিছুকে স্বপ্ন ভেবে আঁকড়ে ধরে মেতে ছিলাম, তাকিছুর মূল্য ছিল অতি সামান্য। যদি মৃত্যুর পরের পৃথিবীটাতে আমরা ঘুরে আসতে পারতাম, তবে অবাক হয়ে দেখতাম, যারা আমাদের মৃত্যুর পর বেঁচে আছে, তাদের কাছে আমাদের অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব দুইই একই আবহ বা আবেদন তৈরি করে। আমাদের সম্পদ, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, সম্মান—যাকিছুর স্বপ্ন নিয়ে আমরা বাঁচি, সেসবকিছুর প্রকৃত মূল্য কতটুকু, যা আমাদের মৃত্যুর পরও সবার কাছে বাঁচিয়ে রাখে? আমাদের এমন কী অর্জন বা কাজ আছে, যার কারণে আমাদের অনুপস্থিতি মানুষকে কষ্ট দেবে, কিংবা শুন্যতা অনুভব করাবে? যে স্বপ্নের বুননে আমাদের ভালোবাসার ধরন, আমাদের সকল বাহ্যিকতা মূলত কপটতা আর ভণ্ডামির আলেখ্য, সে স্বপ্নে বাঁচার চাইতে শান্তির ঘুম উত্তম। কখনো-কখনো সবচাইতে বেশি কিছু আর সুন্দর কিছু করা যায় কোনোকিছু না করে। ঘুম ক্ষণিকের মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নয়, আর মৃত্যু এমন এক ঘুম যে ঘুম আর কখনো ভাঙে না। যেদিন আমরা চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ব, সেই ঘুমের আগে আমাদের এমন এক ঘুম প্রয়োজন যে ঘুম আমাদের বর্তমানের সকল সকল অস্তিত্বকে নিরর্থক করে দেবে, আমাদের সে শূন্যে ফিরিয়ে নেবে যে শূন্য থেকে আমাদের আজকের এই শূন্য পেরিয়েআসা দূরত্বে অবস্থান, আমাদের সেই নতুন স্বপ্নে মোহাবিষ্ট করে রাখবে যে স্বপ্নে বেঁচে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা যায়। সাধারণ মানুষের কাছে দিনগুলি জীবনের মতো, আর রাতগুলি মৃত্যুর মতো। অসাধারণ মানুষের কাছে দিনগুলি জীবনের মতো, আর রাতগুলি?…….মহাজীবনের মতো! সবার জন্যই তো পৃথিবীটা একই রকম করেই ঘোরে, একই দৈর্ঘ্যে দিবারাত্রির পালাবদল ঘটে। সে একই পৃথিবীতে বাঁচার এবং জীবনকে দেখার ভিন্ন-ভিন্ন ধরনই একেকটা মানুষকে একেক রকম জীবনে বাঁচিয়ে রাখে।

ছয়। যাকিছু সুন্দর, তাকিছু সবসময় ভাল নাও হতে পারে, কিন্তু যাকিছু ভাল, তাকিছু সবসময়ই সুন্দর। কিছু সুন্দর আছে, যাদের আকর্ষণ এড়িয়ে চলাটা ভীষণ শক্ত, আবার কাছেই গেলেই মৃত্যু নিশ্চিত। তাই যাদেরকে আমরা সুন্দর বলি, তারা কতটা সুন্দর সেটা নির্ভর করে, তারা আসলে কতটা ভাল, তার উপর। দেখতে অনেক সুন্দর, কিন্তু মানুষ হিসেবে ভাল নয়, সুযোগ পেলেই ক্ষতি করে, কপটতায় পরিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে বাঁচে, এমন মানুষ খুব বেশি সময় ধরে আমাদের চোখে আর হৃদয়ে সুন্দর হয়ে থাকে না। সবচাইতে সুন্দর কিন্তু বিষাক্ত ফুলটি আমরা না দিই প্রাণের দেবতাকে, না রাখি নিজের ফুলদানিতে সাজিয়ে। সুন্দর কিছুকে দেখবো, ছোঁবো, সুন্দর কিছুতে বুঁদ হয়ে থাকবো অনন্ত মুহূর্ত ধরে, সেটাকে হৃদয়ে ধারণ করবো, তবে সে সুন্দর কিছু যেন আমাদের ধারণ করে না ফেলে। সুন্দর কিছু আমাদের ঐশ্বর্য হয়ে থাক, আমরা ঐশ্বর্য হয়ে থাকি ভাল কিছুর। যাকিছু ভাল, তাকিছু আমাদের ধরে রাখুক ভালোবাসার নিখাদ বন্ধনে। যখন সুন্দর কিছু ভালোবাসার বাঁধনে আমাদের একবার বেঁধে ফেলে, তখন সে সুন্দররের অসুন্দর রূপটাও আমাদের আর দূরে ঠেলে দেয় না। যে একবার আমাদের ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধে ফেলে, সে যেমনই হোক না কেন, সুন্দর হয়েই আমাদের চোখে ধরা দেয়, তার অসুন্দরগুলিকেও আর অসুন্দর মনে হয় না, ওই অসুন্দর চোখের সামনে প্রকট হয়ে উঠলেও নিজেকে প্রবোধ দিতে শিখে নিই, “ও আমার দেখার ভুল!” এখানেই মানুষের সবচাইতে বড় পরাজয়। এ পৃথিবীর সবচাইতে বড় শক্তি দুটো: যৌবনের তেজ আর নারীর সৌন্দর্য। এ দুই ক্ষমতা ঠিক পথে ঠিক সময়ে ঠিক হাতে কাজে না লাগলে পৃথিবীর অনেক বড় বিপর্যয় পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে। পৃথিবীতে সুন্দর হৃদয়ের যতো অভাব, সুন্দর অবয়বের অভাব ততো নেই। সুন্দর মুখগুলি কপটতা আর অসততা নিয়ে চলে, নোংরা আত্মায় স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে জীবন কাটায়। অথচ, আঁস্তাকুড়ের পাতা কখনো স্বর্গে যায় না। হায়, কে কবে মন রেখেছে এই কথা? সত্যিকারের ভালোবাসা পৃথিবীতে খুব একটা পাবেন না, আর কোনো স্বার্থ বা উদ্দেশ্যের সাগরে ডুবে যাওয়া ভালোবাসাকে নিখাদ বলে বিশ্বাস করে ঠকে যাবেন। বাহ্যিক সৌন্দর্যের দ্বন্দ্ব বা সুন্দর অসুন্দরের মধ্যকার বৈপরীত্য পৃথিবীকে দুঃসহ করে তোলে। আমরা যখন কাউকে বা কোনোকিছুকে ভালোবাসি, তখন কখনো-কখনো সেই ভালোবাসায় থাকার সময়ই আমরা অন্যকারো বা অন্যকিছুর প্রতি ভালোবাসা অনুভব করি। খুবই আন্তরিক এবং একাগ্র ভালোবাসায়ও এই ব্যাপারটা দেখা যায়। এরকম কেন হয়? কেন দুটো সত্তা একইভাবে আমাদের নাড়া দেয়? ভালোবাসার বিভিন্ন প্রকাশ কেন আমাদের একই আবেগে আলোড়িত করে? ভালোবাসার কী আদৌ কোনো রঙ আছে? না থাকলে কেন ভালোবাসা হাজারো রঙে আমাদের সামনে নিজেকে মেলে ধরে? এ চিরায়ত অসহায়ত্ব থেকে মুক্তির উপায় কী? মুক্তি কি আদৌ আছে? আচ্ছা, মুক্তিরই বা দরকার কীসের? দুটো সত্তা যখন শুদ্ধ আবেগে নিষ্পাপ ভালোবাসায় হৃদয় জাগায়, তখন পৃথিবীর কোন ক্ষতিটা হয়? বরং, প্রকৃত ভালোবাসার উদ্বোধনে মানুষের হৃদয় হতে ক্ষুদ্রতা সরে যায়। বৃহতের আবাহন মাত্রই তো মঙ্গল নিয়ে আসে। ভালোবাসার রাস্তায় অনেক পথের মধ্য থেকে সবচাইতে দীর্ঘ পথটি চলার জন্য বেছে নিলে ভালোবাসার আগেই মৃত্যু এসে হৃদয়ের দরোজায় কড়া নাড়ে। হৃদয়কে রুদ্ধ করে রাখার চাইতে এমন মৃত্যুও কি কল্যাণের নয়? ভালোবাসার বিশাল সমুদ্রে একটু-একটু করে সাঁতরানোই ভাল। ভালোবাসার অমৃতের পেয়ালা চুমুকেই নিঃশেষ করে ফেললে ভালোবাসার সকল আবেদন চুমুকেই হারিয়ে যেতে বাধ্য। যে জিনিস একেবারে অনেক পাওয়া হয়ে যায়, তার গুরুত্ব কমে যায়। অল্প-অল্প করে পেলে প্রতিটি কণা পরিমাণেরও গুরুত্ব বোঝা যায়। ভালোবাসার কণা পরিমাণও অনুভূতির সমুদ্রদর্শন যে করতে পারে, সেই প্রকৃত প্রেমিক।

সাত। আমাদের আশেপাশে কত মেধাবী মানুষের আনাগোনা, কত-কত অর্জনে তাদের থলে পরিপূর্ণ, তাদের দেখে অন্তরে সমীহ জাগে, অথচ তাদের কেউই আমাদের হৃদয়ে কোনো জায়গা করে নিতে পারেন না। কত সুন্দর চেহারার মানুষ দেখি যাদের স্থান আমাদের চোখের মাঝেই, হৃদয়ে গিয়ে ওদের যাত্রাটা আর শেষ হয় না। কত বিত্তশালী মানুষ আছেন, যারা তাদের উপচেপড়া সব সম্পদের বিনিময়েও আমাদের হৃদয়ের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেন না। অথচ, সহায় সম্বলহীন একেবারেই সাধারণ গোছের কিছু-কিছু মানুষ তাদের হৃদয়ের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের হৃদয়ের মাঝে থেকে যান চিরকাল। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে চাতুর্য, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তির চাইতে বেশি প্রয়োজন দয়া, সহানুভূতি, মানবিকতা, সহমর্মিতা। ক্ষমতার সীমাহীন প্রদর্শনে নয়, ভালোবাসার স্পর্শে মানুষ ভালভাবে বেঁচে থাকে। জীবনের মঞ্চে জয়ের চাইতে ক্ষমার শক্তি অনেক বেশি। ক্ষমা করতে পারার অক্ষমতা শাস্তিপ্রাপ্তকে যতোটা শাস্তি দেয়, শাস্তিদাতাকে তার চাইতে অনেকবেশি কষ্ট আর অস্বস্তিতে রাখে। যখন এমন কাউকে ক্ষমা করে দিতে হয়, যে ক্ষমা চায় না, যার নিজের শক্তি আমার ক্ষমা করে দেয়ার শক্তির চাইতে বহুগুণে বেশি, অথচ যাকে ক্ষমা করে না দিলে আমি নিজেই হয়তো এমন অপরাধে অপরাধী হয়ে যাবো, যার কোনো ক্ষমা নেই, তখন আসলে বোঝা যায়, ক্ষমার দীপ্তি কত প্রখর! যার ভেতরটা সুন্দর, যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে হাজারো গল্প মাথায় খেলে যায়, যার চোখ থেকে ঝরে পড়ে দরদের অশ্রু, যার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আলো ছড়ায়, যার কাজে অন্যরা ভাল থাকে, তিনিই ভালমানুষ। এমন ভালমানুষই প্রকৃতপক্ষে একজন সুন্দর মানুষ। পৃথিবীর সকল নির্দয়তা সহ্য করেও এমন মানুষ নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখেন। যখন কেউ দেখে, পুরো পৃথিবী তার বিরুদ্ধে কাজ করছে, অসুন্দরের জয়গান মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করে দিচ্ছে বারবার, অবিরাম আঘাতে সে ক্লান্ত জর্জরিত, বেঁচে থাকার মানে যখন মৃত্যুর আলিঙ্গন হয়ে দাঁড়ায়, তখনো যদি সে সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে সরে না আসে, তবেই সে যথার্থ সুন্দর মানুষ। সৌন্দর্য এক কঠিন পরীক্ষা, সবাই এ পরীক্ষায় পাস করতে পারে না। সূর্য যেমনি চাঁদকে কখনো বলে না, তোমার ওই আলো তো আমার, তেমনি প্রকৃত সুন্দর মানুষও কখনো নিজের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে সেটা নিয়ে দম্ভ করেন না। প্রচণ্ড ন্যায্য অহংকার এসে কাউকে ছেয়ে ফেলছে, অথচ তার কোনো প্রকাশ ঘটছে না, বরং নিজের বিভিন্ন ক্ষুদ্রতাকে কীভাবে জয় করে আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়, সে ভাবনায় মাথা নত হয়ে আসছে, এমন বিনতির পরীক্ষা বড় কঠিন পরীক্ষা। আমরা খালি চোখে যা দেখতে পাই, যতটুকু দেখতে পাই, যতদূর দেখতে পাই, সে দেখায় এমনকিছু থাকে না, যা আমাদের সত্যিই প্রয়োজন। যা আমাদের এবং আমাদের আশেপাশের সবাইকে ভালভাবে বাঁচিয়ে রাখে, তা দেখতে হৃদয় লাগে, চোখ নয়। যা সত্যিই দরকার, চোখ তা দেখতে পায় না, বরং কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস চোখের সামনে এসে চোখ আর মনকে ভুলিয়ে রাখে, ফলে ঠিক পথে চলা দূরে থাক, সে পথের খোঁজটাই আমরা কখনো পাই না। যাকিছুকে আমাদের হৃদয় জায়গা করে দেয়, তাকিছুই আমাদের জন্য অমূল্য। গোলাপের কী দাম, যদি আমরা গোলাপের পেছনে আমাদের ভাবনা আর সময় ব্যয় না করি? ভাবনা আর সময়ের চাইতে বড় বিনিয়োগ আর হয় না। তাই, আমাদের সেই ভাবনা-গোলাপের সৌন্দর্যের সকল দায় আমাদেরকেই নিতে হবে। আমাদের যে স্বপ্নকে আমরা আমাদের হৃদয়ে জাগিয়ে রাখি, সে স্বপ্নের মৃত্যুর আগেই আমাদের আত্মিক মৃত্যু ঘটে যায়। এমন মৃত্যুর আগেই যেন সত্য আর সুন্দরের নির্মল ধারায় নির্ভার অবগাহন আমাদের ভাগ্যে জোটে।