অস্পষ্ট জার্নাল: ৫

উনত্রিশ। আমাদের এই জীবন দারুণ একটা উপহার। আমরা বেঁচে না থাকলেই বা কী এমন এসে যেতো? যদি ধরে নিই, আমরা স্রষ্টার অনুগ্রহে বেঁচে আছি, তবে সাথে এই ভাবনাটিও সাথে এসে যায়: আমরা কেউই পৃথিবীর জন্য এমন কোনো অপরিহার্য প্রাণী নই যে আমাদের অনুপস্থিতিতে প্রলয় ঘটে যাবে, ফলে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হচ্ছে। এতো-এতো মানুষ প্রতিদিন কারণে বিনাকারণে মারা যাচ্ছে, অথচ মৃতদের সে তালিকায় আমরা নেই। তাই, এই যে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি, এই ব্যাপারটিই দারুণ আনন্দের ও বিস্ময়ের। পুরো জীবনটাই তো একটা বোনাস! যা-ই পাই, যতটুকুই পাই, তা-ই তো বাড়তি পাওয়া! কত মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে, আর আমরা দুমুঠো বাসি ভাত হলেও তো খেয়ে বেঁচে আছি; কত লোক খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়, আমাদের ভাগ্যে একটা কুঁড়েঘর হলেও তো জুটেছে; কত দুঃখী মানুষের গায়ে পোশাক নেই, আমাদের গায়ে একটা পুরনো ফিকে রঙের পোশাক হলেও তো আছে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সিঙ্গারা খাওয়ার সময় সিঙ্গারার উচ্ছিষ্টটা কুড়িয়ে খাওয়ার আশায় ছেঁড়ানোংরা পোশাকপরা কত ছেলে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে থাকে, তা কি কখনো আমাদের চোখে পড়েছে? ডাস্টবিনের দেয়ালের আড়ালে খিদের জ্বালায় কত মানুষ কুকুরবেড়ালের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে বেঁচে আছে, সে খোঁজ কি কখনো নিয়েছি? কত কষ্ট করে প্রাণটাকে শরীরে আটকে রেখেছে, তবুও ওদের মুখে হাসি ফোটে। আমাদের কী এমন অসীম কষ্ট যে আমরা হাসতেই ভুলে গেছি? বেঁচে আছি, পেটে খিদে নেই, শরীরে তেমন কোনো রোগ বাসা বাঁধেনি যা সারানোর সামর্থ্য আমার নেই, আমার রাতগুলি ফুরোয় না মৃত্যুর আতংকে—সত্যিই বেশ ভাল আছি কিন্তু! যেখানে, আর কিছু নয়, স্রেফ বেঁচে থাকাটাও পরম সৌভাগ্যের একটা ঘটনা, সেখানে স্রষ্টা আমাদের কত ভাল রেখেছেন! কতকিছু দিয়েছেন! ভাবা যায়! আমরা পঙ্গু হয়ে যাইনি, আমাদের চোখ অন্ধ হয়ে যায়নি, আমাদের চেহারা কোনো দুর্ঘটনায় বিকৃত হয়নি, এরপরেও বলবো, প্রেম নেই তাই জীবনটা শূন্য? এতোটা বিলাসিতা দেখানোর আস্পর্ধাটা আসে কোত্থেকে? মৃত্যু বড় সহজ একটা ব্যাপার। ভাবুনতো, গতকাল সন্ধ্যায় যে পিতাটি অফিস শেষে তার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকা সাড়ে ৪ বছরের ছোট্ট খুকুমণির জন্য তার যৎসামান্য সামর্থ্যে ৫টা আপেল কিনে বাড়ি ফেরার পথে অতর্কিত বোমা হামলায় প্রাণ হারালেন, তিনি আপনার আমার চাইতে কোন পাপটি বেশি করার সুযোগের যথার্থ সদ্ব্যবহার করে ফেলেছিলেন? যে আপেলটি তার সন্তানের খুশিতে মাখামাখি হয়ে থাকার কথা ছিল, কেন সে আপেলটিই তার বুকের তাজা রক্তে পথে গড়াগড়ি খায়? আমরা কেউ ভাল নেই, তাই না? বাহ্‌ বাহ্‌!! শালার খারাপ থাকা! যদি আমাদের শরীরে এখনো রক্ত প্রবাহিত হয়, তবে সেই রক্তের প্রতি সুবিচার করতে আমরা যেন স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিই, শুকরিয়া আদায় করি! বেঁচে থাকার চাইতে মহৎ উপহার আর হয় না। এই বেঁচে থাকার সময়টিতে আমরা যাকিছু অর্জন করি, তাকিছু আমাদের সুখী করতে পারে না, যদি আমরা কিছু মানুষের জীবনকে স্পর্শ করতে না পারি, তাদের আনন্দের সন্ধান দিতে না পারি, তাদের ভালোবাসায় সিক্ত হতে না পারি। কোনোভাবে নিজের আত্মার প্রদীপটা জ্বালাতে পারলে যে সকল প্রবৃত্তি আমাদের অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দেয়, সেগুলি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হয়। নিদ্রার গহীন গহ্বর থেকে নিজেকে সরিয়ে আনাটা অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সে গহ্বরে অনন্তকাল থেকে যেতে ইচ্ছে করে সবারই। জাগার কাজটি সহজ নয়। ঘুমিয়ে থাকার দুর্নিবার আকর্ষণ থেকে নিজেকে দূরে রাখার আর বদভ্যাসের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার সাধনা, দুইই অনেক বড় ইবাদত। আমার জীবনে এখন কী ঘটছে আমার সাথে? কেন ঘটছে? এমন ঘটার কি কথা ছিল? এসব ভাবনা আমাদের বর্তমানকে আচ্ছন্ন করে দেয়, অতীতে বসবাস করায়। তার চাইতে ভাল, যদি এমন করে ভাবতে পারি: আমি অতীতে যা করেছি কিংবা যা ভেবেছি, তার ফলাফলই আমার বর্তমান। যদি আমি সেসময় তা না করতাম, তবে নিশ্চয়ই বর্তমানের এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হতো না। যদি আমি আমার এই বর্তমানকে পছন্দ না করি, তবে আমি দুটো কাজ করতে পারি: এক। বর্তমানে এমনকিছু করবো না, যা আমার ভবিষ্যতকে আফসোসে পরিপূর্ণ করে দিতে পারে। দুই। বর্তমানে এমনকিছু করবো, যা আমার বর্তমানতাকে আমার পছন্দমতো বদলাতে সাহায্য করে। অজ্ঞতা এবং সংস্কারের প্রতি অনুরক্তি ও আনুগত্য আমাদের চৈতন্যকে জাগতে দেয় না। জাগতে হলে, প্রথমে স্বপ্ন দেখতে হবে, আমি কোথায় পৌঁছতে চাই। এরপর সেখানে পৌঁছতে হলে, প্রথমত আমি যা শিখেছি, তা ভুলে যেতে হবে, এবং দ্বিতীয়ত আমার যা শেখা প্রয়োজন, তা শিখতে হবে। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে এতদিন ধরে এতো কষ্ট করে এই যে এতকিছু শিখলাম, এর কি কোনো মূল্যই নেই? উত্তর সহজ। যদি এইসব না শিখতাম, তবে কীকরে আমার মধ্যে এই বোধটা জন্মাত: আমি যে জীবনে বাঁচতে চাই, সে জীবনে আমি বাঁচছি না? জীবনদর্শনের উৎপত্তি ও বিকাশ হয় জীবনযাপনের সার্থকতা থেকে নয়, অসার্থকতা থেকে। সকল মহান সৃষ্টির মূলে রয়েছে আনন্দ নয়, বেদনা। অট্টালিকায় বাস না করলে অরণ্যের শান্ত সামাহিত তপোবনের জীর্ণ পর্ণ দীর্ণ কুটিরের স্বস্তির উপলব্ধি কীভাবে আসবে? আমাদের পুরো জীবনটাই একটা বিশাল স্বপ্ন। স্বপ্ন যেমনি করে মিলিয়ে যায়, তেমনি আমাদের জীবনের প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তিগুলিও মিলিয়ে যায়। আমরা যখন যে মুহূর্তে যে পৃথিবীটাতে বাস করছি, সে পৃথিবীই শেষ পৃথিবী নয়। আরো পৃথিবীর সাথে আমাদের দেখা হবে, এবং যতদিন বাঁচবো, দেখা হতেই থাকবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আমার পৃথিবীটাই একমাত্র বাসযোগ্য পৃথিবী নয়। বর্তমান পৃথিবীর সাথে আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ার অর্থই হলো, অন্য সকল পৃথিবীর ঐশ্বর্য উপভোগ করা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া। তবে হ্যাঁ, সবাই কিন্তু একই পৃথিবীতে বাঁচার জন্য জন্ম নেয়নি। একেকজনের পৃথিবী একেকটা। যদি আরো স্পষ্ট করে বলি, তবে বলতে হয়, প্রত্যেকটা পৃথিবী আবার কয়েকটা পৃথিবী নিয়ে তৈরি। মানে, আমি যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি, সে পৃথিবীর অনুরূপ ধরনে সৃষ্ট আরো কয়েকটি পৃথিবীতে বাঁচার জন্য আমি জন্মেছি। পরের পৃথিবীগুলিতে যাওয়ার জন্য যে ক্ষমতা প্রয়োজন, তা কিন্তু আমার মধ্যে আছে; তবে তা সুপ্ত অবস্থায় আছে। আমার যা কাজ, তা হলো, জীবনের পরবর্তী ধাপগুলি অতিক্রম করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। এই ধাপগুলিই মূলত আমার জন্য যে পৃথিবীগুলি রাখা আছে, সেগুলি। একেক মানুষের ধাপ একেক রকমের। ফলে, আমার জন্য রাখা পৃথিবীগুলি অন্য একজনের জন্য রাখা পৃথিবীগুলির মতন নয়। পৃথিবীর কোনো সজ্জাই শ্রেষ্ঠ নয়, কোনো সজ্জাই নিকৃষ্ট নয়। যার যেমন সজ্জা, সে তেমনভাবে জীবন কাটায়। জীবনকে আমরা যতদূর নিয়ে যাবো, আমাদের সজ্জায় আমাদের অবস্থান ও অর্জন ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। যদি আমি নিজেকে না জাগাই, বর্তমান অবস্থা, তথা বর্তমানের পৃথিবী নিয়েই আত্মতৃপ্তিতে অন্ধ হয়ে থাকি, তবে সামনের সকল পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য থেকে আমি নিজেকে বঞ্চিত করবো। এটা এক ধরনের পাপ; স্রষ্টা আমাকে সৃষ্টি করার সময় যে দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, সেটা পালন করার প্রতি আমার অনাগ্রহ ও নিরাসক্তিই হলো অমন আত্মতৃপ্তি। আমরা যে পথে হাঁটছি, স্রষ্টা আমাদের যে পথের হাঁটার সুযোগ করে দিয়েছেন, সে পথে হাঁটার কাজটি আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব, ততটুকু সুন্দর করে শেষ করতে হবে। এক পথের সমাপ্তিতে অন্য পথের সূচনা ঘটে আমাদের চোখের সামনে। এভাবে করে একের পর এক পথ আমাদের সামনে খুলে যেতে থাকে। কোন পথে কীভাবে হাঁটতে হবে, তার কোনো ব্যাকরণ নেই, কোনো সহজ সংক্ষিপ্ত পথ নেই। নিজেকেই নিজের সাধ্য, সুযোগ, পছন্দ ও সুবিধামত পথের ছক তৈরি করে-করে এগোতে হয়। যে যতো বেশি পথে হাঁটতে পারে, সে তার জীবনকে ততো বেশি সুন্দর ও সার্থক করতে পারে।

ত্রিশ। আমাদের হৃদয়ের ধারণক্ষমতা কতটুকু? কতটা কষ্ট হৃদয়ে রেখে দেয়া যায় অনায়াসেই? কেন ছোট্ট হৃদয়ে অসীম দুঃখের সাগর বারেবারে ঢেউ তোলে? সত্যিটা হলো এই, আমাদের কল্পনায় আমরা সমস্ত পৃথিবীর যতোটা দেখতে পাই, আমাদের হৃদয়ে আমরা ঠিক ততোটা কষ্ট ধারণ করতে পারি। আমাদের ভাবনার ব্যাপ্তি যতদূর, আমাদের কষ্টের সীমাও ততদূর বিস্তৃত। আমরা যতোটা ভালোবাসতে পারি, ততোটা কষ্টও ধারণ করতে পারি। আমরা যখন কাউকে বা কোনোকিছুকে ভালোবাসি, তখন আমরা সে ব্যক্তির, বস্তুর বা ধারণার অস্তিত্ব নিজের হৃদয়ে ধারণ করি পরম মমতায়, আন্তরিকতায়, ভালোবাসায়। ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ে আলো জ্বালায়, আমরা সে আলোয় নিজেদের দেখি। যদি কখনো এমন হয়, সে আলোতে আর আমরা নিজেদের দেখতে পাচ্ছি না, সবকিছুকে কী এক আঁধার এসে ছেয়ে ফেলেছে, তখন সে আঁধারকে আমরা ডাকি দুঃখ বলে। আমাদের হৃদয় এমনভাবে তৈরি যে, সেখানে যতোটা আলো রাখা যায়, ঠিক ততোটাই আঁধার রাখা যায়। হৃদয় যখন আঁধারে ছেয়ে যায়, তখন অবচেতনভাবেই হৃদয় অন্য আলোর খোঁজ করতে থাকে। যে হৃদয়ে ভালোবাসা নেই, সে হৃদয়ে কখনো আলো আসে না। তাই, আলোয় বাঁচতে হলে প্রথমেই হৃদয়কে ভালোবাসার উপযুক্ত করে তৈরি করতে হয়। আমাদের কাজ, আমাদের ভাবনা, আমাদের অর্জন, আমাদের জ্ঞান, এই সবকিছু মিলে আমাদের হৃদয়কে ভালোবাসার আধার করে গড়ে তোলে। হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে আকাশ ছোঁয়া যায়। সে আকাশটা ছুঁয়ে ফেলতে পারলে মনের মধ্যে যে আনন্দের প্রস্রবণ বয়ে যায়, সে আনন্দের উৎপত্তি হয় অসীম বেদনা থেকে। হৃদয়ে সুখের শস্যের চাষ হয় দুঃখ দিয়ে। নিরন্তর সুখপ্রাপ্তি কিংবা নিরন্তর দুঃখপ্রাপ্তি, এর কোনোটাই এ পৃথিবীতে হয় না। সুখভোগের সীমা বৃদ্ধি করার একমাত্র নিয়মই হচ্ছে, নিজের সাধ্যের মধ্যে সুখকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। দুঃখভোগের সীমা হ্রাস করার একমাত্র নিয়মই হচ্ছে, দুঃখকে আপন করে নিয়ে নিজেকে ক্রমাগত আঘাত আর দহন করার মাধ্যমে দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় সন্ধান করা, এবং সে উপায় অনুযায়ী কাজ করা। পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে নিজেকে সুন্দর করতে হয়। সুন্দর মানে কী? সবচাইতে সুন্দর মানুষ কাদেরকে বলি? যাদের দেখলে যাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যে আমাদের দৃষ্টি আটকে যায়? না। সবচাইতে সুন্দর তারাই, যাদের সাথে কথা বললে, যাদের সংস্পর্শে থাকলে তাদের হৃদয়ের ঐশ্বর্য আমাদের তীব্রভাবে স্পর্শ করে। যাদের সাহচর্য আমাদের স্বস্তি দেয়, নির্ভরতা দেয়, আনন্দ দেয়, তারাই সুন্দর। সুন্দর তারাই, যাদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার পরও কথা ফুরিয়ে যায় না, মনে হতে থাকে, আরো কয়েক জন্ম তাদের সাথে গল্প করা যাবে, তাদের কাছাকাছি থাকা যাবে। কেউ একজন ইমাম জাফর আল সাদিককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্রষ্টা কি চাইলে পৃথিবীর আকৃতি না কমিয়ে এবং ডিমের আকৃতি না বাড়িয়ে পুরো পৃথিবীকে একটা ডিমের ভেতরে রেখে দিতে পারবেন?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আপনি আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন তো! কী দেখছেন?” উত্তর এলো, “আকাশ, পাহাড়পর্বত, গাছপালা, অরণ্য।” “আপনার যেমনি করে আপনার ওই ছোট্ট চোখের মণিতে এতো বিশাল-বিশাল জিনিস রাখতে পারছেন, তেমনি করেই স্রষ্টা এই বিশাল পৃথিবীর পুরোটাকেই একটা ছোট্ট ডিমের ভেতরে রেখে দিতে পারবেন।” হৃদয়ের বিশালত্ব ও ক্ষুদ্রত্ব, দুইই আমাদের কল্পনাতীত। হৃদয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করার জন্য দুটো জিনিস প্রয়োজন: ধৈর্য আর ত্যাগ। আসুক কষ্ট, আসুক দৈন্য, আসুক নৈরাশ্য, আসুক বর্বরতা, আসুক অবিচার, আসুক আঘাত। এর সবকিছুকেই ধারণ করার সামর্থ্য আমাদের হৃদয়ের রয়েছে। আমরা যেমন হতে চাই, আমরা যেমন হয়ে থাকতে চাই, সেটার প্রতি ভালোবাসাকে জাগিয়ে তুলতে হবে ধৈর্য আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে। তবেই পরিস্থিতির প্রচণ্ডতা আমাদের আর বিহ্বল করে দেবে না। বাইরের পৃথিবীর দিকে চোখ রাখলে নিজেকে মনে হয় এক অসীম মহাসমুদ্রের একটা ফোঁটার চাইতেও নগণ্য। আর দুচোখ বন্ধ করে নিজের ভেতরের পৃথিবীটাকে দেখলে এই বোধ জেগে ওঠে—যেন পুরো পৃথিবীই আমার হৃদয়ের মহাসমুদ্র হতে ছোট্ট একটা সুন্দর বুদ্বুদের মতো করে ধীরে-ধীরে জন্ম নিচ্ছে, যে পৃথিবীর বিকাশের সকল নিয়ন্ত্রণই পুরোপুরি আমার হাতে। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই স্রষ্টার অধিষ্ঠান। বাহ্যিক পৃথিবীর মায়া, মোহ, ভ্রান্তি যখন আমাদের অন্ধ করে রাখে, তখন আমরা আর হৃদয়ের মহাসমুদ্রে ভাসতে পারি না। ভালোবাসা, শান্তি, আশীর্বাদ, সুখ, স্বস্তি আর ক্ষমতার সেই অফুরন্ত উৎস থেকে অন্ধত্ব আর অজ্ঞতা আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে। আমাদের আত্মা যখন আমাদের চৈতন্যের সাথে যুক্ত হয়, তখন আমাদের ভেতরে ও বাইরে মিরাকল্‌ ঘটতে থাকে, অন্তরের সাথে বাহিরের সংযোগ আমাদের আনন্দ আর প্রশান্তিতে উদ্বেল করে দেয়।

একত্রিশ। আমাদের ইগো আমাদের ভয়ের এক ধরনের প্রকাশ মাত্র। কীসের ভয়? নিজের দুর্বলতা সামনে এসে যাওয়ার ভয়, অন্যের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার কাছে হেরে যাওয়ার ভয়। যখন ভালোবাসার জায়গাটা সংশয় দখল করে নেয়, তখনই ইগোর আধিপত্য শুরু হয়। ইগোর খেলায় ভালোবাসা দূরে সরে যায়, আন্তরিকতা কমে যায়, আত্মতুষ্টি ও অহমিকাকে জিতিয়ে দেয়ার প্রবল জেদ সকল বাস্তব-সংগতি ও হিতাহিতকে তুচ্ছ করে মস্তিষ্কের মধ্যে রাজত্ব করতে থাকে। নিঃশ্বাসের দূরত্বের মানুষের সাথেও আলোকবর্ষের দূরত্ব তৈরি হয়। মানুষ যখন ধরেই নেয়, সে যা ভাবছে, শুধু তা-ই ঠিক, অন্যরা সবাই ভুল জানে, ভুল ভাবে, তখন জ্ঞানের ক্ষুদ্রতা তার মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ সৃষ্টি করে। এক শিশু সাগরের সব জল জমিয়ে রাখার জন্য সাগরতীরে বসে-বসে বালিতে একটা ছোট্ট গর্ত খুঁড়ছিল। এক জ্ঞান-উদ্ধত ব্যক্তি শিশুটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই বোকা! তুমি সাগরের সব জল এই ছোট্ট গর্তে কীভাবে রাখবে?” শিশুটি উত্তর দিল, “ওহে বুদ্ধিমান! তবে আপনি কীকরে বিশ্বাস করেন যে, আপনার ওই ক্ষুদ্র মাথায় আপনি পৃথিবীর সব জ্ঞান ধারণ করে ফেলেছেন?” বাবা ছেলের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, “যা, ইলেকট্রিক বিলটা দিয়ে আয়।” ছেলের গাড়ির অনেক সখ। সেই টাকা দিয়ে ইলেকট্রিক বিল পরিশোধ না করে একটা নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ির র‍্যাফেল ড্র’র লটারির টিকেট কিনে ছেলে বাড়ি ফিরল। তার বিশ্বাস, সে নতুন গাড়ি জিতবেই জিতবে। বাসায় ফিরে বাবাকে তা বলতেই বাবা ছেলেকে সেইরকম একটা উত্তমমধ্যম দিলেন। পরেরদিন। বাবা ঘুম থেকে উঠে বাড়ির দরোজা খুলেই দেখলেন, বাড়ির সামনে একটা ব্র্যান্ড নিউ কার! অসীম বিস্ময় এসে বাবাকে ঘিরে ফেলল! তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! অতি উত্তেজনায় বাবা চিৎকার করে ছেলেকে ডাকলেন! বিস্মিত হবার তখনো বাকি ছিল। নতুন গাড়িটা বিদ্যুৎ বিভাগের কেনা, এবং সেদিনই গাড়িটা প্রথম রাস্তায় নামানো হয়েছিলো যাদের বিদ্যুৎ বিল বাকি, তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজে। বলাই বাহুল্য, বেচারা স্বপ্নচারী বালক পুত্র আরেক দফা উত্তমমধ্যম লটারির পুরস্কার হিসেবে পেলো। আমরা যখন ইগোকে পরিচর্যা করি, ইগো নিয়ে বসে থাকি, তখন এটা ধরেই নিই, কোনো এক জাদুমন্ত্রবলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, পরিস্থিতি আমার অনুকূলে চলে আসবে। ছেলে বিশ্বাস করেছিলো, অলৌকিকভাবেই লটারির টিকেটের প্রথম পুরস্কারটা সে পেয়ে যাবে। বাবা যদিও সেটা বিশ্বাস করেননি, তবুও বাসার সামনে গাড়ি দেখে উনার মন বলছিল, এ ধন আমার! এ ধন আমার! অথচ, ছেলে বেচারা আরো একবার মার খেলো। প্রথম মারটা লটারি কেনার অপরাধে, দ্বিতীয় মারটা লটারি না জেতার অপরাধে। বাবা যেটা ঘটবে না বলেই ধরে নিয়েছিলেন, সেটা না ঘটা নিয়ে তার ক্রোধের উৎপত্তি কি ছেলের বোকামিকে ছাড়িয়ে যায় না? কাকতালীয় ঘটনা তো ক্বচিৎ ঘটে। ইগোর জিতও তেমনিই একটা কাকতালীয় ঘটনা। জিতটা হয় ইগোর, ইগোর মালিকের হয় হার, অথচ, মালিক ভাবেন, তিনি জিতে গেছেন। বাহ্যিক দৃষ্টি থেকে ইগোর সৃষ্টি। খোলা চোখে যা দেখা যায়, মোটা দাগে ভাবলে যতটুকু বোঝা যায়, তার উপর ভিত্তি করে মনকে পরিচালিত করার নাম ইগোতে বাঁচা। চোখ যা দেখে, মুখ তা বলে। চোখের কাজই হচ্ছে, বাহ্যিক দৃষ্টির উপর ভর করে একের পর এক গল্প বানানো। আমাদের চোখ যেমনি জ্ঞানের জানালা, তেমনি আমাদের আত্মা বোধের জানালা। চোখের দেখার সীমা যেখানে শেষ আত্মার দেখার সীমা সেখান থেকে শুরু। চোখ বাইরের পৃথিবীর সৌন্দর্যটুকু দেখে, সে সৌন্দর্য সুখ দিয়ে ঘেরা আর আত্মা দেখতে পায় ভেতরের পৃথিবীর সৌন্দর্য, সে সৌন্দর্য কষ্ট দিয়ে গড়া। রাতের আকাশে চোখ দেখতে পায় শুধু তারার আলোটুকু। আর আত্মা খুঁজতে থাকে সূর্যের তীব্র আলো, যে আলোর খোঁজ তারার আলোয় নয়, বরং সে আলো যে আঁধারকে আড়াল করে রেখেছে, সে আঁধারে ডুব দেয়ার পথটায়। মানুষের চোখ কখনো মিথ্যে বলে না, তবে মানুষ কায়দা করে চোখের ছলনায় মিথ্যে বলে। যখন চোখের ভাষা আড়াল হয়ে যায়, তখন মুখের ভাষা সামনে চলে আসে। তখন বিভ্রান্ত হওয়া সহজ। তার চাইতে ভাল হচ্ছে, নিজের হৃদয়ের চোখ দিয়ে অন্যের হৃদয়ের দিকে তাকানো। চোখ যা স্বপ্নে কল্পনা করে, হৃদয় তা স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। অজানাকে আর অচেনাকে নিজের ভেতরে এনে জায়গা করে দিতে হৃদয় ক্রমাগত নিজেকে ভেঙে ফেলে। সকল জ্ঞান, সকল সংস্কার, সকল অহংবোধ, সকল অর্জন, সকল শিক্ষা—যাকিছু হৃদয়ের দ্বারকে রুদ্ধ করে রাখে, তাকিছু দূরে সরে গিয়ে হৃদয়ের দরোজা খুলে যায়। সেই খোলা দরোজা দিয়ে এক রহস্যময় আলো এসে হৃদয়ে প্রবেশ করে, যার ফলে আত্মার শৃঙ্খলমুক্তি ঘটে। গ্লাসে সরবত রাখতে মদটা ফেলে গ্লাসকে পরিষ্কার করে ফেলতে হয়। নাহলে, গ্লাসে সরবতটা রাখার জায়গা হবে না, যদি হয়ও, সরবত মদের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করবে। মদের স্বাদে যে বিভোর, সে সরবতের স্বাদের খোঁজ আর পায় না। একইভাবে, নতুন দর্শন ধারণ করার জন্য জায়গা করে দিতে পুরনো দর্শনকে হৃদয় থেকে বের করে দিতে হয়। হৃদয়ের ভাঙাগড়ার খেলা তাই আঁধারকে সরিয়ে আলোর আবাহনের নামান্তর।

বত্রিশ। যাদের চেহারা সুন্দর, যাদের গায়ের রঙ সুন্দর, আমরা তাদের কাছে টানতে চাই, আবার তাদের কাছেও নিজেদের রাখতে চাই। সুন্দর চেহারার মানুষ কাছে থাকা মানেই কি নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত, নিঃশঙ্ক হয়ে কাটানোর আয়োজন? দুর্দশা কি কখনো মানুষের অবয়ব বুঝে আসে? যারা দেখতে সুন্দর, তারা কি কোনো না কোনোভাবে কষ্ট থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারে? বাহ্যিকভাবে সুন্দর মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার বন্ধু হলাম তার স্থূল মস্তিষ্কের খোঁজ কিংবা দুষ্কৃতকর্মের প্রবৃত্তি না জেনেই, আর কোনো একসময় তার পাপ কিংবা নির্বুদ্ধিতার শাস্তি আমাকেও পেতে হলো। এমনও তো হতে পারে, তাই না? বন্ধুর পুণ্যের ভাগ না পেলেও বন্ধুর পাপের পরিণতি প্রায়ই ভোগ করতে হয়। বিপদ এবং দুর্ভাগ্য সবচাইতে সুন্দর মানুষটিকেও এক ইঞ্চিও ছাড় দেয় না। বরং অবয়বের সৌন্দর্য মানুষকে প্রায়ই বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। চর্যাপদ শেখায়, আপনা মাংসে হরিণা বৈরি। হরিণ যেমন তার সুস্বাদু মাংসের জন্যই শিকারিদের প্রিয়, তেমনি সুন্দর চেহারা আর গড়নের মানুষও সহজেই সবার শত্রু হয়ে ওঠে। যে দেখতে ভাল না, সে সুন্দর মানুষদের সহ্য করতে পারে কম। এটাই হয়ে আসছে। সুন্দর মানুষ যার শত্রু, সুন্দর মানুষের বন্ধুও তার শত্রু। বাইরের সৌন্দর্যের দাস না হয়ে ভেতরের সৌন্দর্যের পূজারি হয়ে জীবন কাটালে কারো শারীরিক সান্নিধ্য থাকুক না থাকুক, তার হৃদয়ের কাছাকাছি বসবাস করেও শান্তিতে জীবন কাটানো যায়। দাসত্বের শেকল মানুষকে অন্ধ করে দেয়, আর নিবেদনের স্পর্শ মানুষের দেবত্বকে জাগ্রত করে। যে দুঃখ আমাদের কাঁদায়, সে দুঃখের দিকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাকালে আমরা দেখতে পাবো, প্রকৃতপক্ষে সে দুঃখের মধ্যে অনির্বচনীয় সুখের ফোয়ারা লুকানো রয়েছে। গান যে আমাদের মুগ্ধ করে, সে মুগ্ধতার কৃতিত্ব যতোটা না গানের কথার, তার চাইতে বেশি গানের সুরের। সুরই অজানা ভাষার গানের প্রতিও প্রেমের জন্ম দেয়। একইভাবে, হৃদয় যদি সুরে ভেসে যায়, তবে সুখ কিংবা দুঃখ, যা-ই হৃদয়ে আসুক না কেন, হৃদয় ঠিকই সুন্দর সুরে বাজতে থাকে। ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ, দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য, আনন্দ কিংবা বেদনা, প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা—এরূপ বৈপরীত্যের কোনটাই অগ্রাহ্য করার মতো তুচ্ছ নয়। কখনো দেখা যায়, বেদনাও সুরের উপর ভর করে হৃদয়কে আনন্দে মাতায়। আমাদের হৃদয়ে আনন্দের যে বিস্তৃত প্রস্রবণ চির প্রবহমান, যদি আমরা তার বিন্দুমাত্রেরও খোঁজ কখনো পেতাম, তবে পৃথিবীর কোনো দুঃখই আমাদের আর বিহ্বল করে দিতে পারত না। দুঃখকে খুব সহজেই গ্রহণ করে সে আনন্দের ধারায় হাসিমুখে মিশিয়ে দিতাম। হৃদয়ের ভেতরের পৃথিবীর খোঁজ যে একবার পেয়েছে, সে আর বাইরের পৃথিবীর রঙের নেশায় তৃষ্ণার্ত হয়ে ছুটে বেড়ায় না। সুন্দরের আবেদন যথার্থভাবে গ্রহণ করতে হলে শিশুর হৃদয় দিয়ে সুন্দরের দিকে তাকাতে হয়। শিশুরা নিষ্পাপ বলে যতো সহজে সৌন্দর্যতে মুগ্ধ হয়ে থাকে, অন্যরা ততো সহজে সৌন্দর্যের সাগরে অবগাহন করতে পারে না। সুন্দর যতো বেশি ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণে ভারাক্রান্ত হয়, সুন্দর ততো বেশি তার আবেদন হারায়। হৃদয়ের অপার সৌন্দর্যের মধ্যে ডুব দিতে নির্বোধ, সরল, সহজ হতে হয়। যার মধ্যে পার্থিব বুদ্ধি যতো বেশি, সে সুন্দর হতে ততো দূরে। জাগতিক অর্জনের সাথে-সাথে হৃদয়ের ঐশ্বর্য কমতে থাকে। যখন হৃদয় পার্থিব হিসেবের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, তখন ঐশ্বরিক আলোর ধারা হৃদয়কে আর ধুয়ে দেয় না, অনন্ত আঁধার হৃদয়ে তার রাজত্বের সূচনা করে।

তেত্রিশ। নতুন-নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টির সাথে-সাথে আমাদের ভেতরে নতুন একেকটা পৃথিবীর জন্ম হয়। আমাদের জীবনে যখন কোনো বন্ধু আসে, তখন আমাদের হৃদয়ে তার জন্য নতুন একটা জায়গার সৃষ্টি হয়, সে জায়গার নিয়মকানুন, রীতিনীতি আর ধরন হৃদয়ের অন্য জায়গা থেকে ভিন্ন। যখন দুই আত্মা মিলে এক হয়ে যায়, যখন দুইটি ভিন্ন পৃথিবী মিলে এক হয়ে যায়, যখন ভালোবাসা আর সুখের ভিন্ন দুইটি সমীকরণ একীভূত হয়ে যায়, যখন দুইটি হৃদয়ের সুখ ও দুঃখের অনুভূতি আশ্চর্যভাবে একই রকমের হয়ে যায়, তখন বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয়। এ বিচারে পৃথিবীর সবচাইতে ঠুনকো বন্ধুত্ব হচ্ছে, ফেসবুক বন্ধুত্ব। লাইক কমেন্ট শেয়ার চ্যাটিং এর বেড়াজালে হৃদয়ের আবেগ আর অনুভূতি মিথ্যে অনুরণনে চারিদিকে কাঁপতে থাকে। সেই প্রকৃত বন্ধু, যার উপস্থিতি সবসময়ই দারুণ সব স্মৃতির জন্ম দেয়। কোনো প্রতিদানের আশা না করে বন্ধু সবসময়ই বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ায়। সুখের সাথী হোক না হোক, দুঃখের আঁধারে দীপ জ্বেলে যায়। আমরা প্রায়ই পরিচিতকে বন্ধু ভেবে ভুল করি, বন্ধুকে পরিচিত বানিয়ে ফেলে ভুল করি। পরিচিত অনেকেই হতে পারে, কিন্তু বন্ধু হয় হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র। যখন কেউ বিশ্বাস করে, তার প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা তার হাতের আঙুলের সংখ্যার চাইতে বেশি, তখন নিশ্চয়ই তার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। বন্ধু অতো বেশি হয় না, খুব দামি জিনিস পরিমাণে সবসময় কমই হয়। বন্ধুত্বের ভাষা কোনো শব্দে নয়, বরং অর্থে প্রোথিত। গাছ যেমনি ছায়া দেয়, প্রাণ জুড়ায়, বন্ধুত্বও তেমনি নির্ভার নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয় দেয়। স্কুল-কলেজে বন্ধুত্বের পাঠ দেয়া হয় না, এটা এমন এক পাঠ যা জীবনের পাঠশালায় নিতে হয়, এ পাঠ না নিলে অন্য সকল পাঠই নিরর্থক হয়ে যায়। কারো সাথে তখনই বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়, যখন আমরা তাকে সে যেমন, হোক ভাল কিংবা মন্দ, ঠিক তেমনভাবেই গ্রহণ করতে পারি। বন্ধু যখন বিপদে পড়ে, তখন সবার আগে বন্ধুই এগিয়ে আসে। বিপদের সময় মানুষ ঈশ্বরকে আর বন্ধুকে ডাকে। নৈরাশ্যের সময়ে বন্ধু পাশে এসে আশার আলো জ্বালে। ভাল বন্ধু আর ভাল মানুষ, একই কথা নয়। কেউ ভাল মানুষ হতে পারে, কিন্তু ভাল বন্ধু নাও হতে পারে। এর উল্টোটাও সত্য। বন্ধুর ভুল থাকবে, দোষ থাকবে, অসম্পূর্ণতা থাকবে, তবুও সবকিছুর পরও বন্ধু বন্ধুই। নিখুঁত বন্ধু যারা খুঁজে বেড়ায়, তাদের জীবনেও কোনো বন্ধু হয় না। কোনো সামাজিক অবস্থান, যোগ্যতা, অর্থ-প্রতিপত্তি বন্ধুত্বের নির্দেশক হতে পারে না। তাই ছোটবেলার বন্ধুত্ব সাধারণত কখনোই নষ্ট হয় না। কারণ, ছোটবেলায় কোনো স্বার্থ বা হিসেবনিকেশ করে বন্ধুত্ব হয় না। আত্মার সাথে আত্মার মিলনে বাল্যবন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এমন বন্ধুত্বই আসল বন্ধুত্ব, যা সারাজীবনই টিকে থাকে। জাগতিক জীবনে একজন ব্যর্থ মানুষ বন্ধু হিসেবে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যেতে পারে। যখন আকাশ মুক্তো ছড়ায়, রাস্তা ঢাকে, অলিতে গলিতে মুক্তোর স্তূপ পড়ে থাকে; যখন স্বপ্ন এসে দরোজায় কড়া নাড়ে, আত্মার মধ্যে মাদকতা জাগায়; যখন পথের ধুলোয় নৈঃশব্দ্য খেলে; যখন বিপুল অরণ্যের স্তব্ধতায়, ধূধূ মরুর প্রান্তরে সন্ধে নামে, রাত্রি উঁকি দেয়—তখন তারার মেলায় ভেসে-ভেসে অপার বিস্ময়ে প্রেমিক প্রশ্ন করে, এমন সুখে কে থাকে একা? এমন ঐশ্বর্য একাকী গ্রহণ করায় কীসের আনন্দ? এ কোন দ্বীপে পড়লাম বাঁধা? নিরন্তর সুখে বিচ্ছিন্ন মৃত্যুর মিছিলে অমরত্বের এই মিথ্যে ইশারা থেকে কীসে মুক্তি? জীবনের এ কোন ধাঁধায় প্রকট সুখের স্রোতে শান্তি মিলায়? এমন দ্বিধায় সৌন্দর্য-পিপাসু পথিকের অসহায়ত্ব বন্ধুর হৃদয়কে স্পর্শ করে তীব্রভাবে। একটা তারা নেমে আসে আকাশ থেকে, আত্মার সকল বাঁধন একে-একে খুলে যায়, ওই তারাটি কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, ভাবছ কেন অতো? তোমার বন্ধু তো আছেই পাশে! তোমার সুখে সঙ্গ দিতে, তোমার দুঃখের ভাগটা নিতে আর কেউ নেই যদিও সে তো আছে! চোখদুটো বন্ধ হোক, হৃদয়ের আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখো, সে আয়নায় যখন আত্মার ছায়া পড়ে, তখন সকল রহস্যের জট এক-এক করে যায় খুলে। যে মুহূর্তে বন্ধুত্বের আহ্বান হৃদয়ে বাজে, সে মুহূর্তে দুটো আত্মা এক হয়ে যায়, আনন্দ আর বেদনার উৎস অভিন্ন হয়ে ধরা দেয়। অমন মুহূর্তে বন্ধুত্বের শক্তি সকল প্রেমের দায় আর ভালোবাসার দাবিকে হারিয়ে দিয়ে হৃদয়ের একত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সেই তো বন্ধু, যে যুক্তি দিয়ে বিচার করে বন্ধুকে গ্রহণ করে না কিংবা বর্জন করে না, যে শুধু এইটুকু জানে, বন্ধুকে গ্রহণ করতে হয় হৃদয় দিয়ে, বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে হয় সকল যুক্তিতর্কের ঊর্দ্ধে উঠে, বন্ধুর ভাল মানেই নিজের ভাল, বন্ধুর খারাপ মানেই নিজের খারাপ, বন্ধুর সুখই নিজের সুখ, বন্ধুর দুঃখই নিজের দুঃখ। তবে হ্যাঁ, আমি যার জন্য নিবেদিত প্রাণ বন্ধু, সে আমার জন্য ততোটা বন্ধু নাও হতে পারে। সেই বন্ধুত্বই সবচাইতে সুখের শান্তির স্বস্তির, যে বন্ধুত্বে দুইজনই বন্ধুত্বের দাবিতে প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে। বন্ধুত্ব কোনো বোঝা নয়, যা বয়ে বেড়াতে হয়। বন্ধুত্ব সেই শক্তি যা সকল বোঝাকে হাল্কা করে দেয়। আমার যা প্রয়োজন, তার প্রয়োজন অনুভূত হবার সাথে-সাথেই বন্ধু তার খোঁজ দিয়ে দেয়—বন্ধুত্ব এমনই এক অমূল্য উপহার। বন্ধুত্ব প্রত্যাশা করতে জানে না, বন্ধুত্ব কেবলই নিঃস্বার্থভাবে দিতে জানে। বন্ধুত্বের একমাত্র প্রতিদানই হলো ভালোবাসা, আনন্দ, শান্তি। বন্ধুত্ব হতে হলে বিশেষ কেউ হতে হয় না, বন্ধুত্বই ব্যক্তিকে বিশেষ কেউ করে তোলে। আমরা একেবারে সাদামাটা হয়ে পৃথিবীতে আসি, বন্ধুত্বই আমাদের সমৃদ্ধ করে, ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে, বাঁচিয়ে রাখে।

চৌত্রিশ। আপন সত্তার আলো যখন ভেতর থেকে বাইরে এসে সকল আঁধারকে আলোয় ভরিয়ে দেয়, আর সকল আলোকে ছাপিয়ে যায়, তখন নিজের অস্তিত্বের প্রবলতা এক ধরনের আকস্মিক ভয়ের জন্ম দেয়। যখন সবকিছু হারিয়ে যায়, যখন নিজের ভেতরটা একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, যখন সকল শক্তি কোথায় যেন মিলিয়ে যায়, যখন সকল বাহ্যিকতা ধ্বংস হয়ে নিজের আত্মাটাই কেবল নিজের সাথে থেকে যায়, ঠিক তখনই সেই ধ্রুব সত্তা জ্বলে ওঠে, আলো ছড়ায়, পথ দেখায়। এই আলোর উৎস যেখান হতে, সেখান হতে সাহস আসে, সেই অক্ষয় উৎস আঁধারপথের সকল অস্পষ্টতা দূর করে সঠিক পথের সন্ধান দেখায়। আমাদের হৃদয় এই পৃথিবীর আলো। এই আলোর তীব্রতা অগ্নির উত্তাপে আমাদের পোড়ায়, শুদ্ধ করে। আমাদের কী করতে হবে, কীভাবে বাঁচতে হবে, আমাদের জন্য কী ঠিক বা কী ভুল, কীকরে অন্যের অধিকারকে খর্ব না করে এবং অনুভূতিকে আহত না করে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়, নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে হয়—এসবকিছুর শিক্ষা ও দীক্ষা এই আলো থেকেই আসে। এমন আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করার জন্য যে মাত্রায় পাগল হতে হয়, যদি আমাদের মধ্যে তার বিন্দুমাত্রও ঘাটতি থাকে, তবে আমাদের পুনর্বাসন প্রয়োজন। নিজের মধ্যে পাগলামি না থাকাটাই সবচাইতে বড় মানসিক অসুস্থতা। জীবন যখন আমাদের একশ জুয়ায় হারিয়ে দেয়, তখন একশএকতম জুয়ায় হেরে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি নিয়ে জীবনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার নামই হৃদয়-আলোয় অবগাহন। যখন শেষ তীরটাও এসে বুক বিদ্ধ করে দেয়, তখনো আরো তীরের আঘাত গ্রহণ করতে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার নামই জীবন। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহ যখন বিশ্রাম খোঁজে, তখন বিপন্ন মানবতার সেবায় নতুন উদ্যমে নিজেকে সমর্পণ করার শক্তিই তেজ। যে শিসটা কাঠের ঘোড়াও শুনতে পায়, শুনে পেছন-পেছন ছুটতে চায়, সেই শিসটা প্রয়োজনের সময় দেয়াটাই বাহাদুরি। স্রষ্টা আমাদের যা বলেন, যা বোঝাতে চান, তা ধীর-স্থির হয়ে শোনার ধৈর্য এবং সময় আমাদের কখনোই হয় না, ফলে আমাদের সকল প্রার্থনা আমাদের ঠোঁটেই বসতি গড়ে, স্রষ্টার কাছ পর্যন্ত তা আর পৌঁছয় না। যাকে ভালোবাসি, যা ভালোবাসি, তার চোখ ধাঁধানো রঙটা দেখতে গিয়ে নিজেকেই রাঙিয়ে ফিরে আসি। আমাদের চোখের সামনে যে শত স্তরের পর্দা আমাদের দৃষ্টিকে ঢেকে দেয়, তা আমাদের সেই প্রিয়র রঙটাই আর দেখতে দেয় না। ক্রোধ, বিদ্বেষ, লোভ, অসূয়া, দম্ভ ইত্যাদি প্রবৃত্তি আমাদের আত্মায় ধুলো আর কাদার পুরু স্তর ফেলে দেয়। আমাদের শঙ্কা এই নয় যে, আমরা দুর্বল। আমাদের শঙ্কা এই যে, আমরা আমাদের মধ্যে এতোটাই শক্তি ধারণ করে বেঁচে আছি, যা পরিমাপেরও অতীত। শক্তির এই বিশালত্ব আমাদের যেকোনো সময়ে শেষ করে দিতে পারে, আমাদের যতো ভয় এই আশংকাকে ঘিরেই। হৃদয়ের অন্ধকার আমাদের যতোটা না বিহ্বল করে, তার চাইতে সহস্র গুণে বিহ্বল করে আত্মার আলো। অনধিকারীর জন্য আলো বরাবরই অসহ্য। আমরা যখনই আমাদের আত্মার আলোকে প্রজ্বলিত করি, তখনই আমরা আমাদের আশেপাশের সবাইকে একই চেতনায় জাগিয়ে তুলি, তারাও সকল প্রতিকূলতা, সমস্যা, কণ্টককে তুচ্ছ করে একই মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠে। জীবনের সকল দীর্ঘশ্বাস আর আফসোসের মুখোমুখি হওয়ার যাদুটা শিখতে হয়, প্রয়োজন হলে লড়াইয়ের পথ বেছে নেয়ার দৃঢ়তা থাকাটা জরুরি, অকপট চিত্তে সত্যের সামনে দাঁড়ানোর সাহস জীবনের পাথেয়, যেকোনো কিছু করার আগেই কর্মফল ভোগ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে হয়, স্বর্গসুখ বা নরকযন্ত্রণা দুইয়ের প্রাপ্তি মৃত্যুর আগেই—এই সকল বোধে নিজেকে অভ্যস্ত করার নাম সততা কিংবা অকপটতা। আমাদের পাপের শাস্তি কিংবা ভালকাজের পুরস্কার—আমাদের জীবনে দুইই ধ্রুব, ব্যর্থ হিংস্র নির্বোধের নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, অবিচার, স্বার্থপরতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা—এ সবই আমাদের মানসিক শক্তি পরীক্ষা করার একেকটা উপায় মাত্র। এই সত্যকে নির্মোহ হৃদয়ে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই জীবন সার্থক হয়ে ওঠে। আমরা প্রত্যেকেই ভালোবাসার একেকটা প্রতিমূর্তি ছাড়া আর কিছুই নই। আমাদের মধ্যে তখনই দেবত্বের প্রকাশ ঘটবে, যখন আমাদের আত্মা ভালোবাসা, শান্তি, নির্মলতা এবং সমবেদনায় পূর্ণ হবে। হৃদয় ভালোবাসায় পূর্ণ হলে ঘৃণা, ক্রোধ, অসূয়া, ইগো আর ভয় আমাদের কখনোই গ্রাস করতে পারে না। ভালোবাসা ছড়িয়ে দিলে স্রষ্টার অনুগ্রহ চারিদিকে ছড়িয়ে যায়, এতে আমাদের ঘিরেথাকা সকল সত্তা ভালোবাসার করুণাধারায় সিক্ত হয়, পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণ আসে। অসীম একাকীত্ব কিংবা গহীন অন্ধকার যখন আমাদের অস্তিত্বকে গ্রাস করতে চায়, তখন যদি আমাদের অভ্যন্তরস্থ সত্তার আলো আমাদের পথ দেখাতো, তবে আমরা কিছুতেই পথ হারানোর ভয়ে অনুপায় হয়ে থাকতাম না। যে মুহূর্তে দুঃখ আমাদের ছেয়ে ফেলে, সে মুহূর্তে এই প্রতীতি নিজের মধ্যে গভীরভাবে জন্মাতে হবে: যখন গোলাপের কাঁটার খোঁজ পেয়েই গেছি, তবে খুব শীঘ্রই গোলাপ অবধি পৌঁছে যাবো। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়? আমরা তখনই শুধু আঁধারটাকেই চোখের সামনে দেখি, যখন স্বীয় সত্তার তীব্র আলো আমাদের অন্ধ করে রাখে। যদি আঁধারে থাকাই হয় আমাদের নিয়তি, তবে যতোই আলো আসুক না কেন, আঁধারের রাজ্যই হবে আমাদের শেষ ঠিকানা। আর যদি আলোই হয় আমাদের বাঁচার একমাত্র অনুষঙ্গ, তবে এই আঁধার, এই মায়া, এই দুঃখের ছদ্মবেশ—সবই তো সাময়িক, এক সময় না এক সময় কেটে যাবে। ভয় কীসের? কীসের দ্বন্দ্ব? কীসের দ্বিধা? আমাদের যেখানে থাকার কথা, আমরা সেখানেই আছি। আমরা গতকাল যা করেছি, আজ তার ফলটা ভোগ করছি; আমরা আজ যা করবো, আগামীকাল তার ফলভোগ করবো। আমরা যা ভোগ করছি, কিংবা করছি না, এর নিয়ন্ত্রণ তো আমাদেরই হাতে। এতো ভাবনা কীসের? এর বাইরে যা ঘটে, তা তো নিয়তি, নিয়তির উপর কারই বা হাত আছে? তবে যাপিত উদ্বেগটা কীসের?

পঁয়ত্রিশ। তোমার ঘুমটা তোমাকেই ঘুমাতে হবে, তোমার জাগাটা তোমাকেই জাগতে হবে। তুমি জাগতে না চাইলে কারো সাধ্য নেই যে তোমাকে জাগায়, তুমি ঘুমাতে না চাইলে কারো সাধ্য নেই যে তোমাকে ঘুমাতে বাধ্য করে। হাঁটার সময় কাউকে সাথে পেলে হাঁটার কষ্টটা বেশ কমে যায়। কিন্তু যদি এমন কাউকে হাঁটার সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায়, যে তোমাকে হাঁটতেই দেয় না, তবে একলা হাঁটাই উত্তম পন্থা। আমাদের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী বা পূর্বসূরি, তারা বড়োজোর আমাদের পথ দেখাবেন, কিন্তু সে পথে হাঁটার কাজটা আমাদেরকেই করতে হবে। আমাদের হাঁটাটা কেউ হেঁটে দেবে না, আমাদের ভাগ্য কেউ গড়ে দেবে না, আমাদের কষ্টটা কেউ ভোগ করে দেবে না। সুখটা যদি একাই ভোগ করতে চাই, তবে কোন আক্কেলে দুঃখের ভাগীদার খুঁজে মরি? জীবনে কোনো কাজ ঠিকভাবে করতে হলে সঠিক পরিকল্পনা করতে হয়। তবু, আমাদের জীবনটা আমাদের পরিকল্পনা মাফিক কতটুকুই বা চলে? যে লোকটি এতিম শিশুদের নিয়ে কাজ করার সকল পরিকল্পনা গুছিয়ে রেখেছিলো, সে হঠাৎ করেই ক্যানসারে মারা গেল। এর কী মানে? জীবন চলে স্রষ্টার পরিকল্পনায়, সেখানে আমাদের তেমন কিছুই করার থাকে না। হ্যাঁ, আমরা যা করতে পারি তা হলো, যদি বেঁচে থাকি, তবে যে পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যদি কখনো সে পথটাই হারিয়ে যায়, তবে নিজেই নিজের সুবিধামত নতুন পথ সৃষ্টি করে নিতে পারি। কাজটা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং, কঠিন, শ্রমসাপেক্ষ; তবে অসাধ্য নিশ্চয়ই নয়। সোজা রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে এই নয় যে, আর রাস্তা নেই; এর মানে হলো, ঘোরানো রাস্তা ধরতে হবে। প্রায়ই এমন হয়, আমরা বিশ্বাস করে নিই—রাস্তা নেই, কিংবা আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, কিংবা রাস্তা ওই দূরে যেখানে ঠিক সময়ের মধ্যে পৌঁছানো অসম্ভব, কিংবা রাস্তার খোঁজ আমরা আর কোনোদিনই পাবো না; অথচ, আমরা যেখানে আছি, সেটাই সঠিক রাস্তা যা আমরা কখনোই জানতে পারিনি। ঠিক জিনিসের খোঁজ পেতে দেখতে জানতে হয়। জীবনের জুয়া খেলায় জেতার দুটো পথ আছে: হয় রাস্তা খুঁজে নাও, নতুবা নিজেই নিজের রাস্তা বানাও। যে করেই হোক, সামনের দিকে চলতে হবে, কিছুতেই থামা যাবে না। ধুলো কুয়াশা ঝড়—মরীচিকার মতো আমাদের রাস্তা আড়াল করে রাখে। দেখার দৃষ্টি আর বোঝার ধরনটা বদলাতে পারলে সকল বাধা আর প্রহেলিকা দূর হয়ে সহজ রাস্তার খোঁজটা আমরা পেয়ে যাবো। আমাদের যে স্বপ্নটি সবচাইতে সুন্দর, সে স্বপ্নে পৌঁছানোর কোনো রাস্তা নেই, কারণ সে স্বপ্নে হয়তো এখনো কেউই পৌছয়নি; এক্ষেত্রে আমরা যে পথে পা রাখবো, সেটাই আমাদের রাস্তা। যে পথ ধরে আমরা হেঁটে ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যাবো, লোকে সে পথকেই নাম দেবে—রাস্তা। যেদিন আমরা এই পৃথিবীতে এলাম, সেদিন থেকেই আমাদের একলা হাঁটতে হয়। হয়তো আমরা না বুঝে বা না জেনে ছদ্মবেশী আনন্দেই অন্ধকারকে আলো ভেবে জীবন কাটিয়ে দিই, কিংবা এতোটাই বাস্তবতা নিয়ে জীবন কাটাই, যা আমাদের প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে রাখে। ক্ষণিকের দুঃখ বা সুখকে আমরা চিরস্থায়ী বলে ভুল করি, আশংকা আর সম্ভাবনাকে ধ্রুব ধরে নিরাসক্ত নির্লিপ্ত নিরাবেগ হয়ে বসে থাকি। জীবনযাপনের আটপৌরে যাত্রায় আমরা কাকে সঙ্গী করবো, এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভীষণ কঠিন ও দুঃসাহসের একটা কাজ। এই পৃথিবীতে বাঁচার সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডি হলো এই, এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচার জন্য আমাদের কেবল একটামাত্র জীবন দেয়া হয়েছে। নিজের জীবনটা নিজেকেই বাঁচতে হয়। জীবনটা কাটানোর কোনো ম্যানুয়েল নেই, কোনো নেতা বা মহাত্মাকে আইডল বানিয়ে উনার মতো করে নিজের জীবনটা কাটানোর কোনো মানেই হয় না। নিজের ভূমি কর্ষণ করতে হয় নিজেকেই, একেক ভূমির কাঠিন্য ও গঠন একেকরকমের, কোন উপায়ে ভূমিকে চাষাবাদের উপযোগী করা যাবে, এর কোনো সর্বজনসিদ্ধ নিয়ম নেই। তখন নিজের হৃদয়ের কথা শুনতে হয়। হৃদয়ের দ্বার খোলা রাখলে প্রয়োজনীয় কোনোকিছুকে গ্রহণ কিংবা অপ্রয়োজনীয় কোনোকিছুকে বর্জন, দুইই সহজ হয়। একমাত্র নিজের হৃদয়ই জানে, কোন পথে চললে জীবনে আফসোস কম থাকবে। নিজের হৃদয়ের কথামতো চলে যদি ভুল গন্তব্যেও কেউ পৌঁছয়, তবুও অতোটা আফসোস থাকে না। অন্যের বুদ্ধিতে ঠিক করার চাইতে নিজের বুদ্ধিতে ভুল করাটা বেশি শেখায়। অন্যের পথে চলে প্রাসাদে পৌঁছানোর চাইতে বরং নিজের পথে চলে কুটিরে পৌঁছানোর আনন্দ ও গৌরব দুইই অনেকবেশি। জীবনপথে হাঁটার জন্য সাথে কাউকে পেলে হাঁটার ক্লান্তি অনেকটাই কমে যায়। এজন্য কমে না যে, হাঁটার কাজের খানিকটা পথের সঙ্গী করে দেয়। পাশে কেউ থাকলে মনে সাহস থাকে, পথের দূরত্বকে কম মনে হয়, মানসিক শক্তি বাড়ে। তবে যাকে পাশে রেখে পথ চললে পথটাই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তার সাথে চলার চাইতে একলা চলা অনেক ভাল। হোক হিন্দু, মুসলিম, খৃস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, কিংবা শিখ—সত্যের পথে যারা চলে, তাদের সবারই ধর্মই মূলত এক। তাদের চলার পথ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য ও গন্তব্য একই। সত্য সকল মানুষকে একই সুতোয় গাঁথে, মানুষ বিভক্ত হয় মিথ্যার মোহনীয় ফাঁদে। মন যখন সকল আবর্জনা দূর করে পরিচ্ছন্ন হয়, মনে তখন আনন্দ আসে, স্বস্তি ও শান্তির সুবাতাস মনকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। আমার লক্ষ্য একমাত্র আমারই, আমি যেমন করে সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই, ঠিক তেমন করে অন্য কেউ পৌঁছাতে চাইবে না। আমি যখন সে লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি, হয়তো আশেপাশে অনেককেই পাবো, যারাও আমার মতোই একই লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার চেষ্টা যেমন ওদের কোনো কাজে আসবে না, তেমনি ওদের চেষ্টাও আমার কোনো কাজেই আসবে না। আমার যা কষ্ট, তা হয়তো অনেকেরই কষ্ট। ওরা আমার সাথেই একই কষ্টটা ভোগ করবে হয়তো, কিন্তু আমার কষ্টটা আমাকেই ভোগ করতে হবে, ওরা ভোগ করবে ওদের কষ্ট। কারো কষ্টভোগ আমার কষ্টকে কোনোভাবেই কমিয়ে দেবে না। যে স্বর্গ হাতে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি, সে স্বর্গ হয়তো অনেকেই পাবে, তবে আমার স্বর্গটা আমাকেই অর্জন করতে হবে। আমার কবরটা অন্য কেউ হয়তো খুঁড়ে দিতে পারবে, তবে সে কবরের শান্তি বা অশান্তি গ্রহণ করতে হবে আমাকেই। যাদের সাথে মিশে আমার পৃথিবীটাকে আমি নরক বানিয়ে ফেলছি, যখন নরকের আগুন জ্বলে উঠবে, তখন হয়তো ওরাও আমার মতোই অগ্নিকুণ্ডে পুড়বে, কিন্তু আমার দহনের যন্ত্রণাটা একা আমাকেই ভোগ করতে হবে। আমার জীবনে অনেকেই আমার সাথে বাঁচবে, হোক সে বাঁচার ধরনটা ভাল কিংবা মন্দ, তবে আমার বাঁচার কাজটা আমাকেই করতে হবে। যখন আমি কষ্ট পাই, অসুস্থ হই, বিপদে পড়ি, বিমর্ষ থাকি, যখন আমার মন খারাপ হয়, ক্লান্ত লাগে, অসহায় লাগে, তখন আমার চারপাশের যাদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, ওরাও আমার ব্যথায় সমব্যথী, সমভাগী; তারা প্রকৃতপক্ষে আমার ব্যথাটা স্রেফ চোখে দেখছে আর নিজের হৃদয়ে সে ব্যথার তীব্রতা কল্পনা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্যথার যে বাস্তব অনুভূতি, কারো পক্ষেই তা অনুভব করা সম্ভব নয়, হোক সে নিজের বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী কিংবা স্ত্রী, সে যতোই দাবি করুক না কেন সে আমার ব্যথাটা অনুভব করতে পারছে, সে প্রকৃতপক্ষে আমি যে ব্যথা পাচ্ছি, তা দেখে ব্যথা পাচ্ছে। আপনি যে ব্যথার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন না, আপনার পক্ষে সে ব্যথার প্রকৃত রূপ বড়োজোর অনুমান করা সম্ভব, কখনোই অনুভব করা সম্ভব নয়। ব্যথার যাবতীয় ধরনই সবসময়ই একেকটা স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত অনুভূতি। তাই, ‘সমব্যথী’ শব্দটা আক্ষরিক অর্থে নিলে তা নিরর্থক ও বাহুল্য হয়ে যায়।