অস্পষ্ট জার্নাল: ৬

ছত্রিশ। আমাদের মনে জ্ঞানের চাইতে ভয়ের কর্তৃত্ব বেশি। কীসের ভয়? প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাওয়ার ভয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ না হওয়ার ভয়, লোভ কিংবা প্রাপ্তির অহংকারপ্রসূত সমীকরণে পিছিয়ে পড়ার ভয়। সমাজ ও সভ্যতার অসম বিকাশ আমাদের মনকে দাসত্বের শেকলে বাঁধা পড়তে শেখায়। আমরা যতো বেশি বাহ্যিক ঐশ্বর্যের পেছনে ছুটতে থাকব, ততো বেশি আমরা নিজেদের ঐশ্বর্যের দাস করে ফেলব। এইভাবে চলতে থাকলে একসময় আমাদের অধিকারে আর কোনো ঐশ্বর্য থাকবে না, বরং আমরা নিজেরাই ঐশ্বর্যের অধিকারে চলে যাবো। ঘরের আসবাবপত্র, গায়ের পোশাকসহ জীবনের বাহ্যিকতাগুলি আমাদের ভাবনাকে যতো বেশি গ্রাস করবে, আমরা ততো বেশি নিজেদের মূল্যায়ন করতে শিখবো জীবনের অনুষঙ্গের দামে, হৃদয়কে সমৃদ্ধ করার দিকে আমাদের আগ্রহ ও মনোযোগ দুইই ক্রমশ কমতে থাকবে। যার বিত্তের ঐশ্বর্য চিত্তের ঐশ্বর্যের চাইতে প্রকট, তার মতন দরিদ্র আর হয় না। আগে শুনতাম, আয় অনুসারে ব্যয় কর; এখন শুনি, ব্যয় অনুসারে আয় কর; আমি বলি, ততোটুকুই আয় এবং ব্যয় কর, যতোটুকুতে তোমার শান্তি ও স্বস্তি নষ্ট না হয়। ভবিষ্যতের সুখের মোহে বর্তমানের শান্তি ধ্বংস করে দেয়ার কী মানে? ৮০০ টাকার শার্ট যে পরে, তার চাইতে ৮০০০ টাকার শার্টের মালিকের মাথায় কি বেশি বুদ্ধি ধরে? দামি শার্ট পরার বাড়তি ৭২০০ টাকা আয় করতে গিয়ে বাড়তি যে শ্রম আর সময়টা দিতে হল, তা একটা ভাল বই পড়ে, একজন ভাল মানুষের সাথে মিশে, একটা ভাল মুভি দেখার, কোনো ভাল স্থানে ভ্রমণ করার, একটা ভাল সুর শোনার পেছনে দিলে কি হৃদয়ের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা দুইই আরো বাড়ত না? জ্ঞানী মানুষ পোশাক কিনে, আর নির্বোধ মানুষকে পোশাক কিনে। দামি পোশাক পরিহিত গর্দভ শেষ পর্যন্ত সস্তা গর্দভই থেকে যায়। আমাদের আশেপাশে মানুষের পোশাকে কত অমানুষ ঘুরে বেড়ায়! এমন সমাজ আমাদের চিন্তাভাবনায় শেকল পরিয়ে দেয়। আমাদের নিরাপত্তা লাগবে, আমাদের সফল হতেই হবে, আমাদের সমাজসিদ্ধ সঠিক পথটাতেই হাঁটতে হবে, পরিবার আর ধর্মের তোষণ অবশ্যকর্তব্য—ওতে হৃদয়ের সবকটা দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় তো যাক, হাড়জিরজিরে ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার নামই নাকি জীবন, গুরুর ইশারায় দিনযাপনের দীক্ষা নেই তো জীবন উচ্ছন্নে গেল, এরকম আরো কতসব বেড়াজালে আমরা অনন্তকাল ধরে আটকে আছি! যতক্ষণ পর্যন্ত এমন সংস্কার আর বিশ্বাস থেকে আমরা নিজেদের মুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের স্বস্তি ক্রীতদাসের স্বস্তি হয়েই থাকবে। ভাবনার দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত না করলে আত্মজ্ঞানলাভ করা সম্ভব নয়। যে নিজেকে চিনতে পারে না, সে কখনোই দুঃখ আর অজ্ঞতার বাঁধন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনতে পারে না। সংস্কারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য নয়, বরং পরিমিত সংশয়ের মধ্য দিয়েই জীবনবোধের যথার্থ সূচনা হয়। আত্ম-সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি বেশ কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার, তাই আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই সহজ, মায়াময় পথটি বেছে নেয়। আমাদের জীবনকে একটা নির্দিষ্ট নিরাপদ নিরুদ্বেগ ছকে ফেলে দেয়, এমন সিস্টেম, গুরু, সম্প্রদায়, কর্তৃত্ব বা ধাঁচকে আমরা হাসিমুখে মেনে নিই। এরূপ আনুগত্য আমাদের অক্ষম, পরমুখাপেক্ষী ও অরক্ষিত করে দেয়। কোনো একটা প্রথার উপর আমাদের অতি নির্ভরশীলতা সেটিকে ক্রমশ দূষিত করে তোলে, আমাদের মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কর্তাব্যক্তিরা নিজেরাও নীতিভ্রষ্ট হতে থাকেন, আর আমরাও তাদের পথের অনুগমন করি। বই, শিক্ষক, গুরু, উপাসনালয়, বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা এসবের উপর ভর করে আমরা নির্বিঘ্নে বাঁচি। আমরা অনুভব করি, এই বেশ ভাল আছি, এইভাবে চললে তো ভালোই, দিন এমনি করেই কেটে যাবে। সত্যিই কি অভিজ্ঞতার প্রভুত্বকে অস্বীকার করে বাঁচা সম্ভব নয়? মনকে যদি অতীতের সকল অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, জ্ঞান আর বিশ্বাস থেকে মুক্ত করতে না পারি, তবে আমরা জীবনে চলার পথে যাকিছু দেখবো, পাবো, তাকিছু গ্রহণ করার সময়ই আমাদের মনের ভেতরের অদৃশ্য এক প্রকট সত্তা আমাদের বারবারই চোখ রাঙাতে থাকবে আর আমরা নতুন কিছু থেকে নিজেদের অবচেতনভাবেই সরিয়ে আনতে থাকব। আত্মজ্ঞান অর্জনের উপায় কী?—আত্ম-সচেতনতা? আত্ম-সংযম? আত্ম-পরিশুদ্ধি? আত্ম-অন্বেষণ? হ্যাঁ, এর সবকটিই আত্মজ্ঞান লাভে ব্যক্তিকে সাহায্য করে। তবে এর জন্য সংসারবৈরাগ্যের কোনো আবশ্যকতা নেই। সমাজের সাথে, নিজের পরিবারের সাথে, নিজের সম্প্রদায়ের সাথে, পৃথিবীর মানুষের সাথে সম্পর্ক রহিত করে আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। আমাদের সাথে আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের যে সম্পর্ক, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সে সম্পর্কের নানাবিধ মাত্রাকে খুব সজাগ মনে, সূক্ষ্ম বিবেচনাবোধে নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে আত্মপ্রকৃতি নির্ণয় করা সহজ হয়। আমাদের যাত্রাপথ কোনদিকে? এটা জানতে হলে আমাদের দুটো জিনিস জানতে হবে: এক। আমরা কোথায় আছি। দুই। আমরা কোথায় যাবো। যদি আমরা বুঝতেই না পারলাম আমরা আসলে কেমন আছি, তবে আমরা নিজেদের জীবনকে বদলানোর জন্য যা-ই করি না কেন, তার সবকিছুই ভিত্তিহীন। আমরা কেন আমাদের স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছতে পারি না? কারণ, আমরা জানিই না আমরা কী অবস্থায় আছি। এতে যে সমস্যাটা হয়, তা হল, আমরা নিজেদের কিংবা নিজেদের বর্তমান অবস্থাটিকে অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন করে ফেলি। যদি আমি নিজে না জানি, আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, তবে সামনে চলার সময় সঠিক পথটা চিনব কীকরে? আমরা কী হতে চাই, তা জানার আগে আমাদের জানতে হবে আমি এখন কী হয়ে আছি। জীবন কেমন, এ নিয়ে আমাদের মনে কিছু আদর্শ আর বিশ্বাস গেঁথে আছে। যদি এ নিয়েই আমরা নিজেদের চিনতে চাই, তবে যে রঙটা আমাদের চোখে ক্রমেই সয়ে গেছে, সে রঙের পুরু পর্দা জীবনে অন্য কোনো রঙকেই আমাদের চোখের সামনে আসতে দেবে না। আমি লোভী, আমি কপট, আমি ঈর্ষাকাতর, আমি ক্ষতিকর, আমি হিংস্র, আমি ইন্দ্রিয়পরায়ণ। নিজেকে চেনার প্রাথমিক স্তর হচ্ছে, প্রথমেই মেনে নিতে হবে আমি ওই সকল অন্ধকার সত্তাকে ধারণ করে আছি। আমি যদি না-ই মানি আমি খারাপ, তবে আমি ভাল হবো কীভাবে? আমি সুন্দর হই, অসুন্দর হই, ভাল হই, মন্দ হই, দক্ষ হই, অদক্ষ হই, সুস্থ মানসিকতার হই, অসুস্থ মানসিকতার হই, জ্ঞানী হই, মূর্খ হই, সৎ হই, অসৎ হই—আমি যেমনই হই না কেন, সেটা কোনো রকম সুখবিকৃতি ছাড়াই মেনে নিতে হবে, মন থেকে তা গ্রহণ করতে হবে, তবেই আমি অন্ধকারের শেকল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবো, এরপরই শুরু হবে আত্মশুদ্ধির পথে যাত্রা। কোনো একটা ঘটনা যেরকম করে ঘটেছে, সেটা আমার কাছে একরকম, আরেকজনের কাছে আরেকরকম। পরিবেশ-পরিস্থিতি ভেদে একই ঘটনা একেকজনের কাছে একেকরকম হতে পারে। তবে একটা জিনিস সব মানুষের ক্ষেত্রেই অভিন্ন, তা হল কোনো একটা বিষয়ের ব্যাখ্যায় আত্মজ্ঞানের প্রয়োগ। আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে একটা বিষয়কে দেখলে, সেটা একাধিক চোখেও একইরকম হয়েই ধরা দেয়, ফলে অভিন্ন অভিজ্ঞতায় একাধিক মানুষ সে বিষয়টিকে দেখে। অজ্ঞতা বা সঠিক জ্ঞানের অভাব অভিজ্ঞতার বিভাজন বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সেদিন একটা বই দেখলাম: How to read a book। কথা হচ্ছে, এই বইটা না পড়লে যদি এটা জানা না যায়, কীভাবে একটা বই পড়তে হয়, তবে আদৌ কি সে বইটা ঠিকভাবে পড়া সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তবে এই বইটা নিশ্চয়ই এমন একটা বই যা লেখারই কোনো মানে নেই। বই পড়ার বা জ্ঞানলাভ করার কোনো নির্দিষ্ট পন্থা নেই, তেমনি আত্মজ্ঞান লাভেরও নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। একেকজনের পথের ধরন একেকরকম। কোনো বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করার মানেই হল, কোনো শিক্ষক, কোনো গুরু, কোনো পথপ্রদর্শক, কোনো সিদ্ধপুরুষের দেখানো পথে চলা। এখন প্রশ্ন আসে, সে পথে যে জ্ঞানলাভ হবে, তা কি আত্মজ্ঞান, নাকি ধারকরা জ্ঞান? অন্যের জ্ঞানলাভের পথ অনুসরণ করলে নিজের মানসিক স্বাধীনতা নষ্ট হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো সৃষ্টিশীল কাজ বা কলা নেই যা কাউকে কেউ শিখিয়ে দিতে পারে। যদি তা-ই হতো, তবে সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত, নাট্যকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যাঁদের নাম শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হয়, তাঁদের সকলেরই একজন করে উত্তরাধিকারীকে আমরা পেয়ে যেতাম। যামিনী রায়ের সন্তান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সন্তান, উত্তম কুমারের সন্তান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সন্তান হতেন বাবার মতোই প্রাতঃস্মরণীয়। আজকাল দেখি, কবিতা লেখার পদ্ধতি নিয়ে দিনব্যাপী ওয়ার্কশপ হয়। আহা, জীবনানন্দ মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন! এসব সার্কাস তাঁকে দেখতে হচ্ছে না। বিবিধ কলার উৎপত্তি কখনোই গুরুমুখী নয়, সবসময়ই অন্তর্মুখী।

সাইত্রিশ। আমরা আসলে কেমন, এটা কীসে প্রকাশ পায়? আমাদের কিছু কাজ আমাদের সম্পর্কে অন্যদের জানায়। যেমন, আমরা কীভাবে কথা বলি, আমরা আমাদের ভাবনাকে কোন উপায়ে সবার সামনে নিয়ে আসি, আমরা কোনকিছুকে কীভাবে গ্রহণ করি বা বর্জন করি, আমরা অন্যদের বা নিজেদের উপর কীভাবে দোষ চাপাই, সুখ বা দুঃখের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়াটা কেমন, এরকম আরোকিছু বিষয় আমাদের সম্পর্কে অন্যদের মনে একটা ধারণা দেয়। শাশ্বত কোনোকিছুকে আমরা কখন অনুভব করতে পারি? যখন আমরা আমাদের মনটাকে স্তব্ধ, সহজ, নিরুত্তাপ, হালকা করে ফেলতে পারি, তখন আমরা আর কোনো শব্দের মায়াজালে ধরা দিই না, তথ্যের বাহুল্য সত্যকে আর আড়াল করে না, আমরা কোনো সত্তা বা ঘটনার বাহ্যিকতায় প্রভাবিত হয়ে কোনোকিছুকে বিচার-বিশ্লেষণ করি না। নিজেকে চেনার রাস্তায় কোনো দ্বিধা অনুশাসন বিশ্বাস অনুমিতি ভ্রান্তি কিংবা ইশারা থাকে না, সে রাস্তায় চলার নকশা আঁকতে হয় হৃদয়ের সাথে আত্মার নিরাবেগ বোঝাপড়ার মাধ্যমে। আমাদের চিন্তা আসলে কী? আমাদের চিন্তা হল আমাদের অভিজ্ঞতা বা স্মৃতির প্রতি আমাদের প্রতিবেদ বা সাড়া। এই ব্যাপারটি যখন ঘটে তখন একঝাঁক স্মৃতির পায়রা উড়ে আসে, এসে আমাদের মস্তিষ্কে ক্রমাগত ঠোকরাতে থাকে, আর বলেই যায়, এটা কর, ওটা কোরো না, এটা তোমার লাগবে, ওটা তোমার লাগবে না, এটা নিয়ে ভাবলে তোমার লাভ হবে, ওটা নিয়ে ভেবো না—ওটা তোমার কোনো কাজেই আসবে না, এই জাতীয় কিছু ভাবনা আমাদের ভাবনাজগতকে গ্রাস করে ফেলে। এর ফলে আমাদের স্বাভাবিক চিন্তার প্রবাহ ব্যাহত হয়। আমরা সবসময়ই অবচেতনভাবে আমাদের মধ্যে সংস্কার, বিশ্বাস, নৈতিকতা, জীবনবোধ, অভিজ্ঞতা, যুক্তিতর্ক, আর নিয়মনীতির অভেদ্য বা দুর্ভেদ্য দেয়াল বানিয়ে রাখি, এর ফলে আমরা কোনোকিছুকেই সেটি যেমন, তেমনভাবে গ্রহণ করতে পারি না, বরং আমরা যেমন, তেমন করেই সেটিকে গ্রহণ করি। সেটি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের ভিত্তি প্রকৃত অবস্থার উপর রচিত হয় না, বরং আমাদের গোঁয়ার্তুমি, অহমিকা কিংবা অন্ধত্বের উপর রচিত হয়। যখন মাটিতে আমরা কোনো শস্যের বীজ রোপণ করি, তখন সে বীজকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করার সময় সে বীজ ভাল কী খারাপ, মাটি কি তা বিবেচনা করে গ্রহণ করে? যখন শস্য ফলে, তখন ভাল বীজ ভাল শস্য দেয়, খারাপ বীজ খারাপ শস্য দেয়—এইতো হয়, না? একইভাবে কোনোকিছুকে গ্রহণ করার সময় যদি আমরা আমাদের মনকে একেবারে শূন্য করে দিয়ে বিচারহীন উপায়ে তা গ্রহণ করতে পারি, তবে আমাদের মনের উপর তার প্রকৃত প্রভাবটা আমরা বুঝতে পারি। এমন অবস্থায় আমাদের মধ্যে আত্ম-উপলব্ধির জন্ম হয়। এই উপলব্ধি ছাড়া কোনোকিছু সম্পর্কে ঠিকভাবে ভাবা সম্ভব নয়। আমরা আর আমাদের পৃথিবী দুটো ভিন্ন সত্তা নয়। আমরা হাসলে পৃথিবী কাঁদে না, আমরা কাঁদলে পৃথিবী হাসে না। ভেতরে-ভেতরে আসলে সব মানুষই মূলত একই রকমের। আমাদের সবার মধ্যেই লোভ আছে, অসৎ চিন্তা আছে, ভয় আছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে; আমাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন এসবের মূল মোটামুটি একই জায়গায় প্রোথিত। আমাদের পৃথক করে দেখায় আমাদের সমাজ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, কিংবা ভৌগোলিক সীমারেখা। আমরা তা-ই, যেরকম আচরণ অন্যরা আমাদের কাছ থেকে পায়। অন্যকে হত্যা করা মানে মূলত নিজের মনুষ্যত্বকে হত্যা করা। অন্যের ক্ষতি করা মানে নিজহাতে নিজের ভবিষ্যৎ ক্ষতির রাস্তা তৈরি করে দেয়া। আমাদের সম্পর্কগুলি এবং সেগুলির প্রতি আমাদের আচরণ আমাদের হৃদয়ের আয়নার মতো কাজ করে। সে আয়নায় আমরা আমাদের সত্যিকারের চেহারা দেখতে পাই। আমরা আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণা পাই না, কারণ আমরা যা দেখি, তৎক্ষণাৎ তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা যুক্তি বা বিচার দাঁড় করিয়ে ফেলি, আমরা একটা ঘটনার সাথে মুহূর্তের উত্তেজনায় অপ্রাসঙ্গিক আরেকটা ঘটনার তুলনা করতে চাই, এবং এর ফলে যে তাড়নার সৃষ্টি হয়, তার মাধ্যমে কাউকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। যুক্তি, দোষারোপ, মূল্যায়ন, বিচার-বিশ্লেষণ, বদ্ধ সংস্কার বা বিশ্বাসের জোরে কখনোই সম্পর্ক টিকে না। আমরা আরো একটা কারণে বিভিন্ন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া দেখাই। উদাহরণ দিয়ে বলি। আমার মায়ের কোনো কথায় যখন আমি ভীষণ রেগে যাই, তখন ক্রোধে অন্ধ হয়ে মাকে উচ্চস্বরে বড়-বড় কথা শোনাতে থাকি, যা আমি স্বাভাবিক অবস্থায় সুস্থ মস্তিষ্কে কখনোই করতে পারতাম না। একটু ভেবে দেখলে বুঝবো, আমার মায়ের জায়গায় অন্য অনেকেই আমাকে এর চাইতে আরো গুরুতর জঘন্য কথা বললেও আমি হয়তো ক্রোধের পূর্বোক্ত বহিঃপ্রকাশের কিয়দংশও দেখাতাম না। তবে মায়ের কেন লঘুপাপে গুরুদণ্ড হল? দুটো কারণে হতে পারে। এক। হয়তো মাকে খুব ভালোবাসি বলেই অন্য কেউ যা বললে অতোটা ইগোতে লাগত না, মা তার দশভাগের একভাগ বলা সত্ত্বেও সেটা সহজভাবে নিতে পারিনি। দুই। আমি জানি, মা তো দুর্বল মানুষ, তার উপর আমাকে অনেক ভালোবাসেন। তাই আমি মাকে যাচ্ছেতাই শুনিয়ে দিলেও মা আমাকে কিছু করতে পারবে না, কিংবা করবে না। আমরা প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের সময় সম্পর্কের এবং নিজের আপেক্ষিক অবস্থানের ভিত্তিতে হিংস্র বা নমনীয় আচরণ করি। আমরা আসলে কেমন, তা প্রকাশ পায় আমরা যেখানে অনমনীয় আচরণ করতে পারি, সেখানে আমরা কতটা নমনীয় থাকতে পারি এবং আমরা যেখানে নমনীয় আচরণ করতে বাধ্য হই, সেখানে আমরা প্রয়োজনের তুলনায় কতটা অধিক নমনীয় হতে পারি—এই দুইয়ের উপর। সহিষ্ণুতা আর ধৈর্য প্রদর্শনের ধরনে মানুষ চেনা যায়।

আটত্রিশ। নিজেদের এবং চারপাশের জগত সম্পর্কে আমাদের মধ্যে অনেক ধারণা তৈরি হয়। এই ধারণা যদি অনেকদিন মনের মধ্যে থেকে যায়, তবে তা ক্রমশ বিশ্বাসে পরিণত হয়। সে বিশ্বাস কখনো-কখনো দীর্ঘসময় পর তত্ত্ব হয়ে যেতে পারে। কারো সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা বা বাহ্যিক বিচারে আমরা আমাদের মতো করে যেকোনো ধারণা করতেই পারি, তবে সে আসলে কেমন, তা যদি আমরা না জানি, তবে তার সম্পর্কে জানার কাজটা ঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। কোনো ঘটনা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ঘটনাটির প্রকৃত অবস্থা থেকে ঘটনাটিকে সরিয়ে আনে না। এভাবে করে ধারণা, বিশ্বাস, তত্ত্ব আমাদের প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্তে নিয়ে যায়। ধারণা আর সত্য এক জিনিস নয়। ধারণা জন্মে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান, অভিরুচি, জীবনদর্শন আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। তাই ধারণা থেকে কোনো বিষয়ের যাকিছু সত্য, তার সবটুকু জানা কখনোই সম্ভব নয়। আমরা যখন কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করি, তখন সেটা সম্পর্কে আমাদের ধারণা জন্মে। আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ায় আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, ভাববার পরিধি ও ক্ষমতা, জ্ঞান, সময়, পূর্বের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। আমাদের কাজ আর আমাদের ধারণা—এই দুইয়ের মধ্যে একটা দেয়াল আছে। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং বিশ্বাস মানুষকে পৃথক করে দেয়। আমরা আমাদের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে যখনই কোনো কাজ করতে যাই, তখনই আমরা পৃথক-পৃথক সম্প্রদায় কিংবা বিশ্বাসের অনুসারী হিসেবেই কাজটা করি। অর্থাৎ, যখন আমরা কোনো ধারণা থেকে একটা কাজ করি, তখন সে কাজটা করার সময় নির্দিষ্ট ছকেই আমাদের কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রে মুক্ত চিন্তাবুদ্ধির চর্চা আদৌ কি সম্ভব? এখন কথা হল, তবে আমরা কাজ করার সময় কোন ব্যাপারটাকে মাথায় রাখবো? ধারণা, বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা, তত্ত্ব এসব যদি মাথা থেকে বের করে দিই, তবে কাজটা করবোই বা কীভাবে? এ নিয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে, তবে আমার মনে হয়, ভালোবাসা দিয়ে যেকোনো কিছুই করা সম্ভব। নিজের মধ্যে ভালোবাসা জন্মানোর জন্য কোনো অভিজ্ঞতা, ধারণা, বিশ্বাস, স্মৃতি কোনোকিছুরই প্রয়োজন নেই। আমরা এমনকিছু করছি যা করতে আমরা ভালোবাসি, আমরা যেখানে পৌঁছাতে চাই যেখানে পৌঁছে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে আমরা ভালোবাসি, আমরা যা করছি তা দেখে অন্যদের যে প্রতিক্রিয়া তা দেখতে কিংবা ভাবতে আমরা ভালোবাসি, এই ধরনের নানাবিধ প্রণোদনা আমাদের যেকোনো কাজ খুব দারুণভাবে করতে সাহায্য করে। একেবারেই শূন্য ধারণা, অভিজ্ঞতা, তত্ত্ব, বিশ্বাসকে সম্বল করে স্রেফ কাজের প্রতি অসীম ভালোবাসা ও একাগ্রতা থেকেই পৃথিবীর সেরা কাজগুলি হয়েছে। আমরা যখন যা-ই করি না কেন, সে কাজটা ঐকান্তিক ভালোবাসা আর আগ্রহ নিয়ে করতে হবে। কিন্তু কেন সমসময় এমনটা করা যায় না? আমরা যখনই এটা ভাল, ওটা খারাপ, এই ধরনের একটা বিভেদ করি, তখন আমাদের চিন্তাভাবনায় একধরনের দ্বৈততার সৃষ্টি হয়। এরূপ দ্বৈততা আমাদের কাজের প্রতি যে ভালোবাসা, সেটাকে অপস্রিয়মাণ করে ফেলে। তখন আমাদের কাজের পরিধি সংকীর্ণ হতে থাকে, এবং আমরা আমাদের স্বপ্নযাত্রা থেকে ছিটকে পড়ি। এর জন্য দায়ী কে? আমরাই তো! ভাবনার অন্তর্হিত বিভাজনের ফলে সংশয় সৃষ্টি হয়, আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে সরে আসি। মানুষ সাধারণত ভাল কাজের চাইতে খারাপ কাজে বেশি সংঘবদ্ধ হতে চায়, লোকের সমষ্টিগত ভাবনার ক্ষেত্রে ভালোবাসার তুলনায় ঘৃণার কদর সবসময়ই বেশি থাকে। মানুষের চিন্তাপ্রবাহও মোটামুটি একইরকমের। যখন আমরা সংশয়কে প্রশ্রয় দিই, তখন এসে হাজির হয় সংশয়ের প্রিয় বন্ধু সংকট—বিবেকের সংকট, বোধের সংকট, উদ্যমের সংকট। আচ্ছা, ভাল কী, জানতে হলে কি খারাপ কী, তা জানাটা খুব জরুরি? সত্যকে ধারণ করতে হলে কি সংশয়কে প্রশ্রয় দিতেই হবে? সংযত হওয়ার প্রাথমিক ধাপই কি মাতাল হওয়া? কারো প্রতি সহানুভূতিশীল হতে চাইলে অন্যকারো প্রতি ঘৃণা জন্মাতেই হবে? শান্তির বারতা কি যুদ্ধেই? ছোট চারাগাছ ক্রমেই মহীরুহতে পরিণত হয়, মাটির চাকা ঘুরতে-ঘুরতে উড়োজাহাজের চাকা হয়, জলের ক্ষুদ্র কণাগুলি জমতে-জমতে সমুদ্র হয়। জীবনও এমনই। ছোট ভালোবাসা বড় ভালোবাসায় রূপ নিতে পারে, ছোট ঘৃণা বড় ঘৃণায় পরিণত হতে পারে, কিন্তু কখনোই সুন্দর জীবনের স্বপ্ন অসুন্দর জীবনের দুঃস্বপ্ন দিয়ে শুরু হয় না। আমরা কেউই অতীতের দিকে হাঁটি না। অথচ, আমরা অনেকেই অতীত মাথায় রেখে বর্তমানে বাঁচি। কেন আমরা এমন করি? পেছনে ফিরে তো আর সামনের দিকে হাঁটা যায় না, তাই না? কষ্টের স্মৃতির উপর ভর করে সুখের স্মৃতিকে আমন্ত্রণ জানানো না। দুর্বল স্মৃতিশক্তি অনেক বড় একটা আশীর্বাদ। যাদের স্মৃতি যতো প্রখর, তাদের স্মৃতিতে ততো বেশি কষ্ট জমে থাকে। এমন ভারি এবং ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পথচলা সত্যিই খুব কঠিন। তবে উপায়? আমরা কীভাবে খারাপ চিন্তা বা কষ্টের স্মৃতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে বাঁচব? যা করতে আমরা ভালোবাসি, কিংবা যা করলে অতীতের সুখস্মৃতির রোমন্থন হয়, কিংবা যা করার সময়ই নিজের শক্তি আর আত্মসম্মানের প্রতি অসীম ভালোবাসা জন্মে, সময়সুযোগ পেলেই তেমন কোনোকিছু করে বর্তমানকে দারুণভাবে উপভোগ করা যায়।

ঊনচল্লিশ। আমি অসুন্দর, আমি সুন্দর হতে চাই; আমি দরিদ্র, আমি ধনী হতে চাই; আমি নিচু, আমি উঁচু হতে চাই। সবাই একটা কিছু হতে দৌড়াচ্ছে, এমনি করেই বাঁচছে। আমাদের সমস্ত জীবন হচ্ছে কিছু একটা হয়ে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা। এ চেষ্টায় যন্ত্রণা আছে, আত্মত্যাগ আছে, হতাশা আছে। এমন সংগ্রামের নামই জীবন। আমার মনের মধ্যে আমি একটা ধারণা লালন করছি। আমি স্বপ্ন দেখছি, আমি এখন যেমন আছি, তেমন থাকব না, কেননা আমি আমার বর্তমানটাকে পছন্দ করি না। আমি যেমন হতে চাইছি, আমি তেমন থাকতে পছন্দ করি। আমি ভাবছি আমার স্বপ্নটা পূরণ হলে আমি অন্য কেউ হয়ে যাবো। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? আমি এখন যেমন আছি, যেভাবে আছি, তাকে টেনে নিয়ে আমি আমার স্বপ্নের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারি। আমি যা আছি, তা যেমন আমার অস্তিত্বের অংশ, তেমনি আমি যেমনটা হতে চাইছি, তা যদি হয়েও যাই, তাও আমার অস্তিত্বেরই আরেকটা অংশ। ফলে আমি শেষ অবধি আমিই থেকে যাবো, হয়তো আমার বাহ্যিক গ্রহণযোগ্যতা আর অবস্থান বদলাবে। আমি এখন যেমন করে খাই, তখন কি অন্যরকম করে খাবো? আমি এখন লোকজনের সাথে যে ব্যবহারটা করি, তখন কি সেটা বদলে যাবে? আমার অভ্যাস আর আচরণের ঔদ্ধত্য কি চলে যাবে? আমি এখন নির্বোধ আছি, আমি চেষ্টা করছি বুদ্ধিমান হতে। আচ্ছা, বুদ্ধিমান হওয়ার মানে কী? বিবেকের গায়ে কিছু জ্ঞানের প্রলেপ দেয়া, কিছু বইয়ের কথাকে মাথায় বোঝাই করে নেয়া, কিছু তথ্যকে মনে গেঁথে দেয়া যাতে প্রয়োজনের সময় তা ব্যবহার করা যায়। এসবই তো, না? এতে কি আমার নির্বুদ্ধিতা লোপ পাবে? আমি আমার বাড়ির চাকরটার সাথে আর দুর্ব্যবহার করবো না, প্রতিবেশীদের সাথে অন্যায় আচরণ করবো না, কী দরিদ্র কী ধনী—সবাইকেই তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেবো। বুদ্ধিমান হলেই রাতারাতি এসব হয়ে যাবে? কই, হয় নাতো! যদি এসব না হয়, তবে আমি বুদ্ধিমান হয়েই বা কী লাভটা হল? বুদ্ধিমানের নির্বুদ্ধিতা নির্বোধের নির্বুদ্ধিতার চাইতে অধিক নিন্দার্হ। বুদ্ধিমান হওয়ার চেয়ে বরং যদি বোঝার চেষ্টা করতাম, কেন আমি নির্বোধ, এবং নিজেকে সে নির্বুদ্ধিতা থেকে বের করে আনার জন্য কাজ করতাম, তবে সেটাই হতো সঠিক কাজ। আমাদের দুর্ভাগ্য এই নয় যে আমরা যা চাই তা পাই না, বরং আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা নিজেরাই জানি না আমরা আসলে কী চাই। আমাদের স্বপ্নগুলির মধ্যকার সংঘাত ওদের কাউকেই শেষ পর্যন্ত আর জিততে দেয় না। নিজেকে চিনতে হলে নিজেকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ অবস্থানে রেখে ক্রমাগত বিভিন্ন প্রশ্ন করে যেতে হয়। এর জন্য কোনো বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন নেই, কোনো অভিজ্ঞতাই এখানে কোনো কাজে লাগে না, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান বা স্বীকৃতি কখনোই মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। আপনসত্তা বলতে কী বোঝায়? এটা একটা ধারণা, স্মৃতি, সিদ্ধান্ত, অভিজ্ঞতা, নাম দেয়া যায় বা নাম দেয়া যায় না এমন কিছু অভিলাষের সমন্বিত রূপ। এটি কোনো কিছু হওয়া বা না হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা, জাতিগত ব্যক্তিগত দলগত কোনো বোধের আরেক নাম। বাস্তবতা কিংবা সত্যকে চেনা সত্যিই সহজ নয়। যে মানুষ জীবনকে বোঝে, তার জন্য বিশ্বাসে বাঁচার তেমন একটা দরকার নেই। বিশ্বাস আসলে আমাদের কী দেয়? উৎসাহ? কিংবা উদ্যম? আমরা আসলে কোন কাজগুলি করতে খুব উদ্যমী থাকি? কনসার্টে যেতে, শপিংএ যেতে, পিকনিকে যেতে, সিনেমায় যেতে, ঘুরতে যেতে। এসবই তো! আমরা বিশ্বাস করি, এসব করলে আমরা আনন্দ পাবো। আচ্ছা, আমরা কখন বিশ্বাস করি? আমরা কি পাহাড়ে বিশ্বাস করি? সূর্যালোকে? নদীতে? বাতাসে? কিংবা জ্যোৎস্নায়? করি না, কারণ আমরা জানি এসবের অস্তিত্ব আছে। আমরা সেসবকিছুতেই বিশ্বাস করি, যেসবকিছুর অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি, জীবনে কষ্ট আছে, দুঃখ আছে, অপ্রাপ্তি আছে, যন্ত্রণা আছে। জীবন যেখানে, সেখানে কষ্ট থাকবেই। যতক্ষণ জীবন, ততক্ষণই যন্ত্রণা। এটা বিশ্বাস করার কিছু নেই। কারণ, আমাদের বিশ্বাস করা না করায় কিছু এসে যায় না; যেখানে জীবন, সেখানে এসব থাকবেই। এর চাইতে ভাল হতো যদি আমরা এটাকে সত্য হিসেবে মেনে নিতাম। কোনোকিছুতে বিশ্বাস আমাদের মধ্যে সেটার অস্তিত্বের বিষয়ে একধরনের সংশয় সৃষ্টি করে। তাই বিশ্বাস করার ব্যাপারটি মূলত বাস্তবতা এড়িয়ে চলার একটা কৌশল মাত্র। আমরা স্রস্টায় বিশ্বাস করি, আমরা ধর্মে বিশ্বাস করি। এর মানে আসলে কী? ধর্মগ্রন্থ কিনে-কিনে বাড়ি সাজিয়ে ফেলা? এ কাজটা তো একজন বিশ্বাসী অসৎ ধূর্ত ধনী ব্যক্তিও করতে পারেন। নাকি, নিয়মিত উপাসনা করা? শারীরিকভাবে সক্ষম যে কেউই খুব সহজেই প্রার্থনা করতে পারেন। নাকি, ধর্মালয়ে যাওয়া? ধর্মালয় শান্তির জায়গা, একজন অবিশ্বাসীও যদি ওখানে যান, উনি যতক্ষণ ওখানে থাকবেন, শান্তিতেই থাকবেন ধরে নেয়া যায়। এসব কাজ ধর্মের অনুষঙ্গ, এটা ঠিক, কিন্তু ধর্ম পালন করা মানে এসব করা নয়। ধর্ম হচ্ছে জীবন থেকে না পালিয়ে অকপট হৃদয়ে জীবনের মুখোমুখি হওয়া; আমাদের সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে আমাদের যা দায়িত্ব তা ঠিকমতো পালন করা; কারো ক্ষতি না করে নিজে বাঁচা এবং অন্যকে বাঁচতে দেয়ার নামই ধর্ম; ধর্মের পুণ্য মেলে শাস্তিতে নয়, ক্ষমায়; আমাদের চাইতে যারা পদমর্যাদা বা সামাজিক অবস্থানে নিচে, তাদের সাথে আচরণের সৌন্দর্যই ধর্ম। যে ধার্মিক ব্যক্তি তাঁর নিজের আর পরিবার ও সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে স্রষ্টার খোঁজে সারাজীবন কাটিয়ে দেন, স্রষ্টা তাঁর কাছ থেকে সবসময়ই অনেক দূরে অবস্থান করেন। যার হৃদয়ে মানুষের জন্য ভালোবাসা নেই, তার পক্ষে কখনোই ধার্মিক হওয়া সম্ভব নয়। আমরা খুব ভাল করেই জানি, জীবন কুৎসিত, যন্ত্রণাময়, দুঃখেঘেরা। আমরা চাই আমাদের এই অসীম কষ্টের কিছু গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা, তত্ত্ব, নীতিকথা, যা আমাদের এই বেদনার কারণ ও উৎপত্তিকে সুন্দর সুশ্রাব্য শব্দের মায়াজালে আবদ্ধ করে ফেলবে। যা আমাদের কষ্টে রাখে, আমরা কী এক ভয়ে সেটার দিকে তাকাইই না, ভয়ের কারণ বা মূল উৎস থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াই। একসময় সে ভয়টা আমাদের অভ্যস্ততায় পরিণত হয়, এবং আমরা মেনেই নিই, এই ভয়েই আমাদের জীবন কাটাতে হবে। ভয়ের প্রতি এমন দাসত্ব আমাদের ভয়ের কার্যকারণ সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখে। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তাদের ভয়, ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলে তাদের জন্য বেঁচে থাকাটা কষ্টের। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তাদের ভয়, ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে তাদের জন্য বেঁচে থাকাটা কষ্টের। এই দুই পক্ষই বিশ্বাস নিয়ে বাঁচে, সত্য নিয়ে বাঁচে না। এই দুই দলের দুই রকমের সমাজ। এই দুই সমাজের অধিবাসীরা দুইটি ভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত। ওরা সত্যকে ভয় পায়, বিশ্বাসকে আলিঙ্গন করে বাঁচে। মানুষ জন্মগতভাবেই সংশয়ী প্রাণী। বোধশক্তি জন্মানোর পর থেকেই সে চায়, তার মধ্যে যে সংশয়, তা দূর হয়ে যাক। তখন সে তার সমাজ থেকে ওই সমাজের সদস্য হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে সংশয়ের সমাধান হিসেবে যা পায়, তা হল বিশ্বাস। এতে কি আসলে সংশয় কাটে? বিশ্বাস তাকে কী শেখায়? বিশ্বাস বলে, সংশয় থেকে দূরে পালিয়ে যাও, মনে কোনো সংশয় রাখা যাবে না, সংশয়কে দূরে সরিয়ে রাখ। তার মানে কী দাঁড়াল? বিশ্বাস সংশয়ের উত্তর দেয় না, বরং সংশয় থেকে পালিয়ে বাঁচতে শেখায়। এতটুকুতে ব্যাপারটা মিটে গেলে কোনো আপত্তি ছিল না। আসল বিপদটা শুরু হয় এরপর থেকে। একেকজনের সংশয়ের ধরন একেকরকমের। বিশ্বাস সংশয়কে দূরে ঠেলে দেয়, কিন্তু সত্যকে কখনো দূরে ঠেলতে পারে না। জীবনে চলার পথে যখন সত্য এসে সামনে দাঁড়ায়, তখন একেক মানুষ একেক ভাবে তার নিজস্ব বোধ, বিবেক ও ইচ্ছা দিয়ে নিজেকে সত্যের মুখোমুখি করে। সংশয়টাকে যেহেতু সে আগেই ব্যাখ্যাহীন রেখেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে, সেহেতু সে সত্যটাকে গ্রহণ করে তার বিশ্বাসের মাধ্যমে। সত্যকে যখনই বিশ্বাস দিয়ে গ্রহণ কিংবা বর্জন করা হয়, তখনই জন্ম হয় মানুষে-মানুষে দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের, কারণ প্রত্যেক মানুষই তার নিজস্ব বিশ্বাসে অটল থাকে। এমন সংঘাতপ্রিয়, নিষ্ঠুর, প্রতারণাপূর্ণ, অসৎ, কপট, মূর্খ মস্তিষ্ক আর হৃদয় যার, সে কখনো ঈশ্বরের খোঁজ পায় না। পাবেই বা কীভাবে? যে পথে সে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের আশায় হাঁটছে, সে পথটাই তো ভুল!

চল্লিশ। আমরা কীভাবে শুনি? মাথায় কোনোকিছুই না রেখে, কোনো পূর্ব অনুমান বা বিশ্বাসকে আঁকড়ে না ধরে, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নিজের ভাবনাকে নিবদ্ধ না করে, আমাদের চিন্তাজগতকে সম্পূর্ণরূপে ফাঁকা করে আমরা যখন শোনার কাজটা করি, তখন কী হয়? আমরা তখন দূর থেকে ভেসে আসা ঘণ্টাধ্বনি কিংবা খুব কাছের শুকনো পাতার মড়মড় শব্দে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া, কিংবা অন্যকিছু, যা নিতান্তই তুচ্ছ ভেবে এড়িয়ে যাওয়া যায়, সবই শুনতে পাই। আমাদের মনটা কোনো সংকীর্ণ বিষয়ে আটকে থাকে না। কোনো বাহ্যিক কারণ, প্রশ্ন বা তাগিদ থেকে হয়, স্রেফ শোনার জন্যই যখন আমরা শুনি, তখন আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্য স্পর্শ করে, ওতে আমাদের হৃদয়ের পরিচর্যা হয়। কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা, স্বার্থ, কামনা, ভয়, দুশ্চিন্তা যখন আমাদের কোনোকিছু শুনতে বাধ্য করে, বা উৎসাহিত করে, তখন আমরা এমনকিছু শুনতে চাই না, যা শুনে আমাদের কোনো জাগতিক লাভ নেই, যা আমাদের খুশি করে না, যা আমাদের দুঃখকষ্ট লাঘব করে না। আমরা শোনার মাধ্যমে প্রকৃতির ঐশ্বর্য গ্রহণ বা বর্জন করি। আমরা কী শুনবো, কী শুনবো না, সেটা যদি আগেই ঠিক করে রাখি, এবং সে অনুযায়ীই শুনি, তবে আমরা অনেককিছু থেকেই নিজেদের বঞ্চিত করে ফেলি। রাস্তার কোলাহলে কি সত্যিই কোনো সুর নেই? জীবিকার শব্দে কি প্রাণ থাকে না? পাখির একটানা কিচিরমিচিরের যাদুরেশ তো একমাত্র ওই কিচিরমিচিরেই মেলে। সমুদ্রের গর্জনের যে মাদকতা, তার কাছে সুন্দরতম কৃত্রিম সুরটাও মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। আপনার প্রিয় মানুষটির ডাক বা আপনার শিশুসন্তানের কান্না বরাবরই অনন্য, জীবনের সমস্ত সঞ্চিত অর্থের বিনিময়েও সে ডাক বা কান্না অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা প্রায়ই শুনি না, আমরা স্রেফ আমাদের প্রয়োজনটাকে গ্রহণ করি। প্রয়োজনের কয়টা জিনিসই বা সত্যিকার অর্থে সুন্দর হয়? মোজার্ট হয়তো অনেকেই শোনে, কিন্তু মোজার্টের সৌন্দর্যে নিজেকে ভাসিয়ে নিতে পারে কয়জন? শোনার কাজটা অনেক বড় একটা শিল্প। কোনো পূর্বচিন্তা, সংস্কার, কিংবা নিয়ম মেনে নয়, নিজের ভেতরটাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে, নিজের সকল জ্ঞানকে দূরে সরিয়ে রেখে, ভাবনার দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে, শব্দের বাহ্যিক মায়াজাল নয়, বরং শব্দের সুরকে হৃদয়ে ধারণ করে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে কথার ভেতরের কথাকে গ্রহণ করতে হয়। সেই ছোট্ট বয়সে যে ছড়াগুলি মায়ের মুখে শুনেছি, সেগুলি শত চেষ্টাতেও কখনোই স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। কেন যায় না? নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোটন বেঁধেছে…….এই ছড়া চাইলেও কি ভোলা যাবে কখনো? কীভাবেই যাবে? এটা যখন শুনতাম, তখন তো আর ছড়া মনে রেখে পরীক্ষায় মার্কস পাওয়ার কোনো উদ্দেশ্য মাথায় ছিল না। এখনো ছড়াটা শুনলে পায়রাগুলি চোখের সামনে সাদা পালকের মতো উড়ে বেড়ায় যেন! দিনের পর দিন কেটে যায় পাখির ডাক শুনি না। হয়তো কানে শুনি, কিন্তু সে ডাকের যে সৌন্দর্য, তা বুঝি কয়জন? যখন কোনো ফুলের দিকে তাকাই আর মুগ্ধ হই, তখন কি সে ফুলের নাম, গোত্র, প্রজাতি, ঠিকানা বিচার করতে বসি? সুন্দরের স্বাদ সুন্দরের বংশবিচার করে পাওয়া সম্ভব নয়। কবে কোথায় কখন কোন উদ্ভিদবিদ গোলাপের সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা লিখতে পেরেছেন? কারো কথা তখনই মনে রেখাপাত করে যখন মনের মধ্যে পৃথিবীর সব চিন্তা এসে গিজগিজ করে না। কারো কথা শোনার সময় কোনো ভাবনা, ধারণা, পূর্ব-অনুমিতি মাথায় না রেখে তার কথাটা হৃদয় দিয়ে বুঝতে হয়, তবেই বোঝা যাবে, সে যা বলছে তা সত্য, নাকি অসত্য। যখন কোনো সুর শুনে আনন্দ পাই, তখন আমরা কি সে সুরটা শোনার জন্য বাড়তি কোনো প্রয়াস দিই, নাকি সে সুর এমনিতেই হৃদয়ে প্রবেশ করে? যখন কেউ আমাদের বলে, অমুক গানটা মন দিয়ে শুনে দেখ, সত্যিই ভাল লাগবে, তখন প্রায়ই দেখা যায়, সে গান আমাদের ভাল লাগে না। অথচ, সেই একই গানটি যদি আমরা বাড়তি কোনো উদ্যম খরচ না করে শুনি কিংবা সজ্ঞানে গানটিকে ভাল লাগানোর চেষ্টা না করে শুনি, কিংবা গানটা কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে কোথাও থেকে ভেসে আসে কানে, গানটার আবেদন আমাদের হৃদয়ে ঠিকই সাড়া জাগায়। না চাইতে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সে আনন্দ আমাদের বেশি নাড়া দেয়। চলন্ত ট্রেনের হুইসেল শুনলে কি অবচেতন মনেই ভেসে ওঠে না ট্রেনে চড়ার অতীতের কিছু সুখস্মৃতি? অথচ, মন যদি বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে, তবে সে হুইসেল মনের মধ্যে আলাদা কোনো আবেদন জাগায় না। সামনের টেলিভিশনে মুভি চলছে। সে রুমে বসে এক বন্ধু টিভির শব্দে পড়াশোনা করতে পারছে না, আরেক বন্ধু ঠিকই কলেজের পড়াটা রেডি করে ফেলছে। কেন এমন হয়? প্রথম বন্ধুটি টিভির দিকে বাড়তি মনোযোগ দিচ্ছে, কিংবা তার মনোযোগের সিংহভাগই টিভির দিকে দিয়ে দিচ্ছে, আর দ্বিতীয় বন্ধুটি টিভির শব্দ এবং অন্যান্য শব্দ বাড়তি কোনো প্রয়াস না দিয়েই সমানভাবে গ্রহণ করছে, ফলে প্রত্যেকটা শব্দই তার মস্তিষ্কে একই রকমের প্রভাব সৃষ্টি করছে, এবং বিশেষ কোনো শব্দই তার কাছে আলাদা কিছু নয় বলে আলাদা করে কোনো শব্দই সে গ্রহণ বা বর্জন করছে না, এর ফলে সে ওই মুহূর্তে একটা নীরবতার মধ্যে বাস করছে এবং তার পড়ায় টিভির শব্দ কোনো বিঘ্ন ঘটাতে পারছে না। আমরা যাকিছু শুনি, তার সবকিছুই কিন্তু আমাদের ভাল লাগে না। আমাদের কোন কথাটা ভাল লাগে? আমরা সে কথাটাই গ্রহণ করি, মনে রাখি বা শুনি, যে কথাটি শুনলে আমরা ভাবি, সে কথাটিই আমরা বলতে চেয়ছি বহুবার, কিংবা যে কথাটি আমরা বক্তার বা লেখকের কাছ থেকে ওই মুহূর্তে শুনতে চাচ্ছি। এর বাইরে অন্য সব কথাই আমরা বর্জন করি, ভুলে যাই বা শোনার অভিনয় করি। বক্তা এমনকিছু এঁকে দিচ্ছেন আমাদের কল্পনায় আর মনের ক্যানভাসে, যে ছবি উনার ভাবনার ছবি নয়, যে ছবি আমাদেরই ভাবনার ছবি যা আমরা আঁকতে চেয়েছি অনেকবার, কিন্তু উনার মতো করে কখনো আঁকতে পারিনি। খারাপ বক্তা তিনিই যিনি তার কথাগুলি শ্রোতাদের উপর চাপিয়ে দেন। ভাল বক্তা এমন কথা বলেন, যা শ্রোতারা শুনতে চায়। শ্রোতা যে অবস্থায় আছেন, যদি সে অবস্থায়ই থেকে যেতে চান, তবে ভাল বক্তা এমনকিছু বলবেন, যাতে শ্রোতার মনে হয়, তার বর্তমান অবস্থাটি স্বপ্নের মতোই সুন্দর। যদি শ্রোতা অন্য কোনো অবস্থায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তবে ভাল বক্তা শ্রোতাকে বিশ্বাস করাবেন, চেষ্টা করলে শ্রোতার পক্ষে তার স্বপ্নের অবস্থায় যাওয়া সত্যিই সম্ভব। ভাল বক্তা শ্রোতার মনের মতো কথা বলেন বলেই ভাল বক্তা। শোনার কাজটি সহজ নয়; সাধারণত কেউই অন্য কারো কথা মানতে চায় না, এমনকি অমান্য করার সময়টুকুও তার হয় না। তাই যদি শ্রোতাকে এমনকিছু বলা যায় যাতে শ্রোতা নিজের ভেতরেই সে কথাটিকে ধারণ ও লালন করতে পারেন, তবে তার শোনার কাজ ও বক্তার বলার কাজ, দুইই পরিপূর্ণ ও সার্থক হয়। যখন আমরা কারো কথা শুনি, তখন আমাদের পূর্বের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমাদের চিন্তাভাবনাকে এতোটাই আচ্ছন্ন করে রাখে যে আমরা এমনকিছু গ্রহণ করতে চাই না যা আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে বেমানান, ফলে তেমন কোনো ধারণা বা কথা আমরা শুনিই না, বা শুনলেও অন্যমনস্কভাবে শুনি। আমরা যা পছন্দ করি না, বা জানতে চাই না, তা আমরা শুনি না। নতুন কিছু শোনা সত্যিই অনেক কঠিন। আমি গণিত ভালোবাসি না, কিন্তু গণিতের ক্লাসে বসে আমাকে শিক্ষকের লেকচার শুনতেই হচ্ছে, এমন অবস্থায় আমি আসলে গণিত শিখি না, বড়োজোর পরীক্ষায় পাস করার জন্য সাময়িকভাবে মাথায় গণিত জমিয়ে রাখি। হোক পাতা, ফুল, মেঘ, সূর্যাস্ত, মানুষ, কিংবা আকাশ, কোনোকিছু সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানতে হলে প্রথমেই দরকার সেটাকে মনে ধারণ করা, এরপরই আসে সেটা নিয়ে শোনার কাজটা। যা আমাদের পছন্দ নয়, তা নিয়ে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত অধ্যাপকও যদি খুব যত্ন নিয়ে লেকচার দেন, তবু সেটা আমার মাথায় ঢুকবে না। শোনার ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।

একচল্লিশ। আধুনিক মানুষের প্রধান সংকট হল মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা। এটা কী? আমরা প্রায় সবাইই ভীষণ একা। আমরা কী এক অগভীর শূন্য মন নিয়ে বেঁচে আছি। আমরা চাই, কেউ আমাদের ভালোবাসুক, আমরা কাউকে ভালোবাসি, অথচ আমরা জানিই না, ভালোবাসা আসলে কী। একাকিত্ব দূর করতে আমরা কিছু না কিছুর সাথে নিজেদের যুক্ত করে ফেলি। ওটার প্রতি আমাদের একধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়ে যায়। সেটা হতে পারে কারো প্রতি, কিংবা কোনোকিছুর প্রতি। মন যখন এমনিভাবে সংযুক্ত হয়ে থাকে, তখন সে মনে নতুন কিছু প্রবেশ করানোটা খুব কঠিন। মুক্ত মন খুব সহজেই কোনো অহংকার, পিছুটান, উৎকণ্ঠা, সংশয় ছাড়াই সুন্দর কিংবা কাঙ্ক্ষিত জিনিসকে গ্রহণ করতে পারে। আমরা কেন নির্ভরশীল হয়ে পড়ি? মানসিকভাবে আমরা কোনো বিশ্বাস, প্রথা, দর্শন, সিস্টেম, কিংবা আচরণ বিধিমালার উপর নির্ভর করে বাঁচতে পছন্দ করি। আমরা এমন কাউকে খুঁজি যিনি আমাদের একটু সুখ স্বস্তি শান্তির খোঁজ এনে দিতে পারেন। আমরা নিরাপত্তা চাই, আর নিরাপত্তা মানেই তো নির্ভরশীলতা। আমরা নির্ভরতা চাই, এটা ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। আমরা চাই কারো উপর নির্ভর হয়ে বাঁচতে, আমরা চাই, কেউ আমাদের উপর নির্ভর হয়ে বাঁচুক। আমরা নিরাপত্তা পেতে চাই, আমরা নিরাপত্তা দিতে চাই। কেন আমরা এরকম করে চাই? আমরা ইদানিং নিঃসংশয়কে ভয় করে চলি, আমরা আমাদের চারপাশের জগতটা সম্পর্কে সংশয়ে থাকতে পছন্দ করি। আমরা এও চাই, কেউ এসে আমাদের সমস্ত সংশয় দূর করুক। আমরা যেমন আছি, তেমন থাকতে চাই না। আবার আমরা যেমন থাকতে চাই, তেমন থাকা শুরু করলে, সেটাকে আমরা অপছন্দ করা শুরু করি। আসলে আমরা এক ধরনের পলায়নপর অস্থির মানসিক অবস্থার মধ্যে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমরা চাই, কোনো বিশ্বাস, ধারণা, তত্ত্ব, মতবাদের উপর নির্ভর করে সমস্যার গভীরে না গিয়ে সমস্যাটা আপাতভাবে দূরে সরিয়ে দিতে। সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ধরা যাক। যে সকল সম্পর্ক পারস্পরিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, সেগুলি ক্রমশ সংঘাতের দিকে অগ্রসর হয়। যখন দুইজন মানুষ একে অন্যের উপর নির্ভরশীল থাকে, তখন তারা প্রকৃতপক্ষে একে অপরকে কোনো একটা উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ব্যবহার করে। আমি তোমাকে আমার প্রয়োজনে ব্যবহার করবো, তুমিও আমাকে তোমার প্রয়োজনে ব্যবহার করবে—এমন চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক কখনোই টিকে না। এই সম্পর্ক থেকে আমি কী পাচ্ছি—সবসময়ই এটা মাথায় নিয়ে চললে যেকোনো সম্পর্কই ঠুনকো হয়ে পড়তে বাধ্য। আমি যা চাইছি, তা পাচ্ছি কিনা, কিংবা ও যা চাইছে, তা পাচ্ছে কিনা, এ ধরনের দ্বন্দ্ব জন্ম দেয় ভয়, ঈর্ষা, অসন্তোষ, সন্দেহ, আর সংঘাতের। এমন সম্পর্কে সুখ থাকে না। সমাজের ক্ষেত্রেও, যে সমাজ স্রেফ চাহিদা আর স্বার্থের উপর সৃষ্টি হয়, সে সমাজে কখনো কোনো সুস্থ মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। মানুষ যখন একে অপরকে আসবাবপত্রের মতো প্রয়োজনে আর নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যবহার করে, তখন তাদের মধ্যে কোনো ধরনের ভালোবাসা কিংবা আন্তরিকতার সম্পর্ক থাকে না। মানুষ কখনোই সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে পারে না। কেউ যদি কোনকিছুর সাথে তার সংযোগ ছিন্ন করে, একইসাথে একইসময়ে সে অন্যকিছুর সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়ে। সংসার থেকে যে বিযুক্ত হয়, সে বৈরাগ্যের সাথে যুক্ত হয়। এটাই নিয়ম। কোনোকিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করার অর্থই হল, অন্যকিছুর সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা। আমরা যাকিছুর সাথে নিজেদের যুক্ত করে রাখি, আমরা মূলত তা-ই। আমরা যেমন, আমরা তেমন কিছুই পছন্দ করি। আমরা যতোটা আমাদের সম্পদকে ব্যবহার করি, আমাদের সম্পদ ঠিক ততোটাই আমাদের ব্যবহার করে। ধরা যাক, আমাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়া হল। আমাদের সব জ্ঞান, বইপত্র, ধর্ম, বিশ্বাস, সম্পর্ক, এমনকি সকল বস্তুগত সম্পদ। তখন আমরা কেমন অনুভব করবো? অসীম নিঃসঙ্গতা, শূন্যতা আর অসহায়ত্ব এসে আমাদের গ্রাস করবে না? ইচ্ছে করবে না ওই মুহূর্তেই ছুটে পালিয়ে যেতে? আমরা কোথায় পালাবো? নিশ্চয়ই এমনকিছুর খোঁজে যা আমাদের একাকিত্বকে দূর করে আমাদের আশ্রয় দেবে। আমরা আত্ম-অন্তরণ সহ্য করতে পারি না, বেঁচে থাকতে আমাদের কাউকে লাগে, আমরা চাই, আমরা যা জানি তা অন্যকেউ শুনুক, ওরা যা জানে তা আমাদের শোনাক। কেউ ভাল চাকরি করে, অনেক মানুষ তাকে ঘিরে গিজগিজ করতে থাকে, সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছে সে সবার ঈর্ষার পাত্র হয়ে আছে সেই কবে থেকেই, তবু খোঁজ নিয়ে দেখুন, কী এক অসীম শূন্যতা একাকিত্ব নিঃসঙ্গতা তাকে ভেতরে-ভেতরে গ্রাস করে চলেছে প্রতি মুহূর্তেই। সে তখন কী করে? আনন্দফুর্তি করে, উপাসনালয়ে যায়, সমাজসেবা করে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। কী আর করবে সে? তাকেও তো বাঁচতে হবে! বিবেকের সংপ্রশ্ন এবং বিবেকের প্রতিবেদ—এই দুইয়ের মিলনই বিবেকের সংঘাত। একাকিত্ব আর সংযুক্তি—এই দুইয়ের সংযোগ অনুরূপ মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে, ফলে আমরা নিজের বর্তমানের একাকিত্ব আর শূন্যতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করি। এটা সহজেই অনুমেয় যে, একা থাকার দর্শন আর একাকিত্বের দর্শন এক নয়। একা থাকতে চাওয়া সমাজের সামগ্রিক বিন্যাসের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘোষণা করার মতো একটা ব্যাপার। সমাজের বাইরে চলে সমাজে বাঁচতে অনেক যোগ্যতা আর আত্মপ্রত্যয়ের দরকার হয়। এমন বাঁচা স্রোতের বিপরীতে বাঁচা। তবে এরও দরকার আছে। যতক্ষণ আমরা কোনো ব্যক্তি, সমাজ, বিশ্বাস, ধারণা, বস্তু বা মতকে আঁকড়ে ধরে বাঁচি, ততক্ষণ আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের আত্ম-উদ্বোধন ঘটে না। নিজেকে চেনার প্রথম ধাপই হচ্ছে, নিজেকে সকল বাহ্যিকতা ও আসক্তি থেকে বিযুক্ত করে ফেলা। সবাই তা পারে না। যারা আত্মজ্ঞানের পথে নিজেদের নিয়োজিত করে, একমাত্র তারাই অতোটা সৎসাহস দেখাতে পারে।

বিয়াল্লিশ। অশান্ত মন নিয়ে কোনোকিছু শেখা সম্ভব নয়। নতুন কিছু শেখার সবচাইতে কার্যকরী উপায় হচ্ছে, আগে যা শিখেছি, তা মাথা থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দিয়ে শূন্য জ্ঞানে পথচলা। পূর্বের জ্ঞানলব্ধ যে অভিজ্ঞতা, তা নতুন জ্ঞান গ্রহণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। অন্যের কাছ থেকে ধারকরা মহত্তম জ্ঞান দিয়েও নতুন জ্ঞানের সন্ধানলাভ করা সম্ভব নয়। কোনো বিশেষ আত্মপ্রসাদদায়ী জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেকে বেঁধে ফেলে কখনোই সত্যের অনুসন্ধান করা যায় না। সত্যের পথ নির্দিষ্ট নয়, একেকজনের সত্যের রূপ একেকরকমের। তবে শেখাটা আসলে কী? যা জানি, তাতে আরো নতুন কিছু যুক্ত করে অভিজ্ঞতার ঝুলিটাকে আরো ভারি করে নেয়া? নাকি, যা জানি না, যে অভিজ্ঞতা আমাদের এখনো হয়নি, নিজের জীবনকে সে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া? শেখার অর্থ স্মৃতির চাষাবাদ কিংবা মস্তিষ্কে জ্ঞান আর তথ্যের বোঝাইকরণ নয়, বরং কোনোরূপ ভ্রান্তি ছাড়াই পরিষ্কার ও সুস্থভাবে ভাববার ক্ষমতা; শেখার শুরুটা হয় বিশ্বাস বা ধারণা থেকে নয়, বরং প্রকৃত অবস্থা থেকে। প্রভাব, ভীতিসৃষ্টি বা বলপ্রদর্শন করে, চোখের সামনে পুরস্কার বা উৎসাহপ্রদানের মুলো ঝুলিয়ে আর যা-ই হোক, কখনোই কাউকে জ্ঞান দেয়া সম্ভব নয়। কারো সাথে তুলনা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে কিছু শেখা যায় না, এতে বরং শেখার প্রতি এক ধরনের ভয় তৈরি হয়। আমি যাকে মেনেই নিয়েছি আমার চাইতে উত্তম হিসেবে, তার তুলনায় বেশি কিছু শিখতে গেলেই স্বাভাবিকভাবে আমার অবচেতন মন আমাকে বারবার বাধা দেবে। জীবনকে সাজাতে চাইলে একমাত্র নিজের সাথেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হয়। এই যুদ্ধে জ্ঞানার্জন নয়, শেখাটা অধিক জরুরি। শেখা আর জ্ঞানার্জন একই জিনিস নয়। শেখা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমরা বেশিরভাগ মানুষ যা করি তা হল, স্মৃতি হিসেবে জ্ঞানকে সঞ্চয় করি, অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সেই স্মৃতিকে যত্ন করে রাখি, এবং প্রয়োজনে তা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করি। এটা হচ্ছে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বা বড়োজোর ঐতিহ্য; কিন্তু কোনোভাবেই শেখা নয়। একজন কৃতবিদ্য পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যের চাইতে একজন অশিক্ষিত ভিক্ষুকের জীবনশিক্ষণের মূল্য অনেকবেশি হতে পারে। জ্ঞান এবং আত্মজ্ঞান দুইটি ভিন্ন জিনিস। যে নিজেকে যতো বেশি জানতে পারে, তার মধ্যে ততো বেশি আত্মজ্ঞানের জন্ম হয়। আর কেউ তার চারপাশের পৃথিবীকে যতো বেশি জানতে পারে, তার মধ্যে ততো বেশি জ্ঞানের জন্ম হয়। জ্ঞানী হওয়ার চাইতে আত্মজ্ঞানী হওয়া অনেক কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সেরা গবেষক-অধ্যাপক তাঁর আত্মজ্ঞানকে শূন্যের কোঠায় রেখে দিয়েও অনেক জ্ঞানী হতে পারেন। বিভিন্ন তথ্য এবং জ্ঞান নিজের মধ্যে জড়ো করা বা সেসব সম্পর্কে জানা আর শেখা এক কথা নয়। অনেক প্রাজ্ঞ বিদগ্ধ সুধীজন আছেন, বাহ্যিক জগত সম্পর্কে যাঁদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান অনেক বেশি কিন্তু অন্তর্জগতের খোঁজ নেয়ার কথা হয়তো কখনো কখনো তাঁদের মাথায়ই আসেনি। এমন মানুষকে আমরা জ্ঞানী বলি, সম্মান করি; কিন্তু আত্মজ্ঞানীদের সম্মান ও জ্ঞানের স্তর জ্ঞানীদের চাইতে অনেক উপরে। শেখার কাজটি সবসময়ই বর্তমান প্রক্রিয়া, যখনই আমরা কোনোকিছু শিখে ফেলি, তখনই এটা অতীত হয়ে যায়, বর্তমানের শিক্ষা অতীতের জ্ঞানে পরিণত হয়। যাকিছুকে আমরা জ্ঞানে পরিণত করেছি, তাকিছু থেকে প্রাসঙ্গিক আরো বিষয় সম্পর্কে জানা যায়, সে জ্ঞানলব্ধ অভিজ্ঞতাকে বিবিধ সমরূপ জ্ঞানের শাখাপ্রশাখায় চমৎকারভাবে ব্যবহার করা যায়, কিন্তু তা থেকে কোনোভাবেই নতুন কোনোকিছু শেখা যায় না। জ্ঞান সবসময়ই পুরনো, আর শিক্ষণ সবসময়ই নতুন। প্রকৃতি আমাদের প্রতি মুহূর্তেই শেখায়। কেউ-কেউ সারাজীবনই শিখে যায়, আর কেউ-কেউ স্রেফ সেই শিক্ষণলব্ধ জ্ঞানটুকু আহরণ করেই জীবন কাটিয়ে দেয়। তাই প্রকৃতিজ্ঞানীর চাইতে প্রকৃতিশিক্ষার্থীর স্থান উঁচুতে। আমাদের নিজেদের জানতে হবে আমাদের হৃদয় ও আত্মা কী চায়, এই দুই সত্তা কী দিয়ে তৈরি তা বুঝতে হবে; আমাদের সামগ্রিক অস্তিত্বের তাৎপর্য নিয়ে ভাবতে হবে; আমরা কোথায় আছি আর কোথায় যেতে চাই, এ দুইয়ের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন রচনার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। এসবকিছু আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কিংবা সীমিত ভাবনার নিরাপদ নিরুদ্বিগ্ন নিশ্চিন্ত বলয়ে থেকে গিয়ে করা সম্ভব নয়। যে চোখ অতীত রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যের মেঘে ঢাকা, সে চোখ নতুন রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যের স্বাদ কীভাবে নেবে? আমরা সাধারণত বই পড়ে, অভিজ্ঞতার আলোকে, কিংবা কারো তত্ত্বাবধানে শিখি। কী করতে হবে, কী করা যাবে না, কী ভাবা যাবে, কী ভাবার প্রয়োজন নেই, কীভাবে অনুভব করবো, কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবো, এমন সব মনোদৈহিক প্রক্রিয়া আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় গেঁথে যায় বিভিন্ন কার্যকারণ বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান, অন্তর্মুখ পরীক্ষণ, এবং অধ্যয়নের মাধ্যমে। আমরা যাকিছু আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে নিই, সেগুলি পরবর্তীতে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও চাহিদা বুঝে সঠিকভাবে প্রয়োগ করি। একজন অসাধারণ পণ্ডিত মানুষ আসলে কিছু অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের শৃঙ্খলে নিজেকে বেঁধে রাখেন। উনার জীবনযাপনের প্রতিটি পর্যায়ে স্মৃতি এবং সঞ্চিত শিক্ষণের প্রভাব প্রকটভাবে ধরা পড়ে। এমন কারো পক্ষে প্রকৃতি ও হৃদয়ের সুবিস্তৃত মহাসমুদ্রে সাঁতরে বেড়ানো কঠিন। অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের চর্বিতচর্বণ থেকে আর যা-ই হোক, নতুন কিছু শেখার কাজটি কিছুতেই হয় না। আমরা যে ঘরটিতে বেঁচে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, সে নিরাপদ ঘরেই যদি নিজেদের আটকে রাখি, তবে নতুন ঘরের খোঁজ কীভাবে পাবো? আমরা নিজেদের বিভিন্ন কর্তৃত্বের অধীনে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। মানসিক দাসত্বে জীবন কাটানোটা আরামের হতে পারে, তবে তা কোনো সম্মান বয়ে আনে না। সচেতনভাবেই কিছু ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে আমরা শেষ পর্যন্ত থেকে যেতে চাই। কিংবা অন্ধভাবে অনুকরণ করে চলি কিছু গুরু, কিছু শিক্ষক, কিছু সিদ্ধপুরুষকে যাঁদের দর্শন এবং শিক্ষাকে আমাদের জন্য গ্রহণীয় বলেই আমরা মেনে নিই। আমি বলছি না কোনো স্বীকৃত আশ্রয়ে থাকাটা মন্দ কিছু, তবে সেসময় নিজের বিচারক্ষমতা, বিবেচনা, বিবেকবোধ, আর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে সজ্ঞানেই কাজে লাগাতে হবে। কোনো স্থানে আধুনিক দালানের নির্মাণ ওই স্থানের পূর্বস্থিত জরাজীর্ণ দালানটির ধ্বংস ছাড়া সম্ভব নয়। একইভাবে মানসিক পুনর্গঠন সনাতনী ভাবনার সম্পূর্ণ বিলোপ ছাড়া সম্ভব নয়।