অস্পষ্ট জার্নাল: ৭

তেতাল্লিশ। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই খারাপ। মানুষের মধ্যে যা কিছু ভাল, তা কিছু মানুষ অর্জন করে সচেতন চেষ্টার মাধ্যমে। এ চেষ্টা যার মধ্যে যতো কম, সে ততো খারাপ। এর অর্থ হল, খারাপ প্রবৃত্তি মানুষের সহজাত, ভাল গুণ মানুষের অর্জন। মানুষ কখনওই এমন কিছু করে না, যেটাতে তার বস্তুগত বা অবস্তুগত লাভ নেই। যখন কেউ বাহ্যিকভাবে অলাভজনক কোনও কাজ করে, তখন কাজটি সে করে কারণ কাজটি তাকে শান্তি দেয় বা সন্তুষ্ট করে। এটাও এক ধরনের লাভ। খালি চোখে দেখা যায় না, এমন লাভের দাম সবচাইতে বেশি। লাভপ্রীতি মানুষকে অহংকারী ও লোভী করে তোলে, ফলে মানুষ বিনীত হতে ভুলে যায়। অহংকার ও লোভ, ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক হতে পারে। পৃথিবীতে এমন কোনও সৃষ্টিশীল মানুষ নেই যার মধ্যে অহংকার ও লোভ নেই। সৃষ্টিশীল মানুষ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি সে মানুষকে যে তার সহজাত গুণের বিকাশ ঘটাতে পারে। একজন সফল ব্যবসায়ী নিঃসন্দেহে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কারণ তিনি তার ব্যবসায়িক ঝোঁক ও মেধার প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন। যারা সৃষ্টিশীল নয়, তাদের অহংকার করার মতো কোনও পুঁজি থাকে না। তার মধ্যে লোভও নেই, কারণ তার নিজের কাছ থেকে পাওয়ার মতো তেমন কিছুই নেই। মজার ব্যাপার হল, অহংকার এমনকি ঔদ্ধত্যও সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে হ্রাস করে না। অহংকার পতনের মূল—এমন কথা পাঠ্য বইয়ে পড়তে বড় আরাম লাগলেও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। অতিঅহংকারও অতিযোগ্য মানুষের পতনের ঘটাতে পারে না। মানুষ জন্মগতভাবে ঈর্ষা ও ঘৃণা করতে ভালোবাসে। মানুষের ঝোঁকই সহিংসতা ও অপরাধের দিকে। সংঘবদ্ধ অপরাধ বা অন্যায় করার ক্ষেত্রে মানুষের উৎসাহ অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। দলবদ্ধ মানুষ সবসময়ই হিংস্র ও উন্মত্ত। উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ পেলে মানুষ নিষ্ঠুরতার চরম পর্যায়ে চলে যেতে পারে। সে অবস্থায় মানবিক প্রবৃত্তি পাশবিক প্রবৃত্তির তুলনায় কয়েকগুণ ভয়ংকর। প্রাণিজগতে এক মানুষ আরেক মানুষের ধ্বংস ও পতন দেখে পরম আনন্দ পায়, যা অন্য কোনও প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। এ বৈশিষ্ট্য মানুষের অনন্য যা তাকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। মানুষের ভাবনাজগত তৈরি হয় চোখে যা দেখা যায় আর কানে যা শোনা যায়, তা দিয়েই। যদি এইটুকু দিয়েই মানুষ সবকিছু বিচার করে, তবে মানুষের অধঃপতন অনিবার্য। জগতের বেশিরভাগ সত্য সেখানেই লুকায়িত যতদূর পর্যন্ত আমাদের চোখ ও কান পৌঁছাতে অক্ষম। বুদ্ধি, স্বজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়ে পৃথিবীকে দেখার ইচ্ছা বেশিরভাগ মানুষেরই থাকে না, ফলে তাদের মধ্যে সে দৃষ্টিশক্তির জন্ম হয় না। মানুষকে যদি তার ইচ্ছাপূরণ করার অবারিত সুযোগ দেয়া হয়, তবে দেখা যাবে, তার বেশিরভাগ ইচ্ছাই অনিষ্টকর ও পাপমূলক। পাপের মধ্য দিয়ে উত্থান সহজ বলে মানুষ নিজেকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পুণ্যের রাস্তা দূরে রেখে পাপের রাস্তাই বেছে নেয়, সে রাস্তায় হাঁটে, দৌড়ায়। পাপ করার ইচ্ছা এমনই এক ইচ্ছা যা প্রশ্রয় দিলে বিস্ময়করভাবে বেড়েই চলে। মানুষের স্বাধীনতা বলতে মূলত বোঝায় সেসব ইচ্ছার দাসত্ব থেকে মুক্তি যেসব ইচ্ছা মানুষকে পাপকাজে উদ্বুদ্ধ করে। যখন আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারব, কেবল তখনই আমরা নিজেদের মুক্ত বলে দাবি করতে পারব। হোক ভাল বা খারাপ, কোনওকিছুর অনুবর্তী হওয়া ঠিক কি ঠিক নয়, সেটা নির্ধারণ করতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ। কোনও বিষয়কে গ্রহণ বা বর্জন করার ধরন দেখে জ্ঞানী ও অজ্ঞ ব্যক্তির মূল পার্থক্যটা ধরা যায়। আমরা যা পেতে চাইছি, তার বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ কোনও বৈশিষ্ট্যের উপর আমাদের পাওয়ার ইচ্ছা নির্ভর করে না, বরং সে জিনিসটাকে আমরা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবছি, তার উপর আমাদের পাওয়ার ইচ্ছাটা নির্ভর করে। একই জিনিস একজনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আরেকজনের কাছে গুরুত্বহীন হতে পারে। ফলে, কোনও জিনিসের প্রতি আমাদের আগ্রহ বা অনাগ্রহই সেটাকে দামি বা মূল্যহীন করে। কোনওকিছুকে পাওয়ার জন্য কাতর না হয়ে বরং সে জিনিসটা পাওয়া আমার পক্ষে কতোটা সম্ভব, কিংবা আদৌ সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে ভাবা, কিংবা সেটা পাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করা বুদ্ধিমানের কাজ। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা যা করি তা হল, আমরা যা পেতে চাই, তা খুঁজতে-খুঁজতে একটা সময়ে আমাদের পক্ষে যা পাওয়া সম্ভব, যতটুকু পাওয়া সম্ভব, তার সাথে আমাদের চাওয়াটা মিলিয়ে নিই। প্রকৃতি আমাদের যা কিছু শেখায়, তা কিছু আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্বাস, চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। আমরা ততটুকুর মধ্যেই বাঁচি। মানুষ সবচাইতে ভালোবাসে জীবনকে, সবচাইতে অপছন্দ করে মৃত্যুকে। কখনও-কখনও এমন সময়ও আসে, যখন মানুষ আর বাঁচতে চায় না। এর কারণ এ নয় যে সে তার জীবনকে আর ভালোবাসে না। বরং কারণটা এই, তার জীবনে যা ঘটছে, সেগুলিকে সে আর মেনে নিতে পারছে না, ফলে সে চায় না তার বর্তমান দিনগুলিকে আর সামনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে। জীবনটাকে টানতে বা বয়ে বেড়াতে কষ্ট হয় বলেই মানুষ মরতে চায়, জীবনের প্রতি ঘৃণা থেকে কেউ মরতে চায় না। জীবন সত্যিই দারুণ জিনিস, বড় আদরের জিনিস, ঘৃণার জিনিস নয়। জীবনযাপনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকেই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়। মন যখন কোনও বিষয় নিয়ে বিক্ষিপ্ত থাকে, তখন মন কোনও যুক্তি শুনতে চায় না, মন যা বোঝে শুধু তা-ই বুঝতে চায়। আমাদের মনের যা চাওয়া, আমরা আমাদের সকল যুক্তিকে সে চাওয়ার মতো করেই সাজিয়ে নিই, বাস্তব বা প্রকৃত যুক্তি যা-ই হোক না কেন। তাই মনের ভেতরের সকল শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলা আসে মূলত মন আমাদের আশেপাশের ঘটনাগুলিকে কীভাবে গ্রহণ করছে, তার উপর। সে ক্ষেত্রে আমাদের ইচ্ছাই আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুন্দর ইচ্ছা মানুষকে সুন্দর মনের অধিকারী করে, কুৎসিত ইচ্ছা মানুষকে কুৎসিত মনের অধিকারী করে। কিছু মানুষ আছেন, যারা অনেকবেশি কষ্টভোগ করলেও কখনওই এমনকিছু করবেন না যা তাদের বিবেচনায় ঠিক নয়, এমনকি এতে যদি মৃত্যুও আসে তবুও। এ ধরনের ভদ্রলোক গোছের মানুষ সাফল্যের দেখা খুব একটা পান না, তবে তারা তাদের নিজস্ব নিয়মে ভীষণ সার্থক একটা জীবন কাটান। সফল জীবনের চাইতে সার্থক জীবনের দাম অনেক বেশি। তাদের সার্থকতার কাছে পৃথিবীর সেরা সাফল্যও তুচ্ছ। পরোপকারিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধার্মিকতা, বৈধতা ও সততার মানে কী, সেটা একেবারেই সাধারণ অশিক্ষিত গরীব মানুষটিও বোঝে। যদি কেউ এসবকে জীবনে ধরে রাখতে পারেন ও এর ফলে সুখ অনুভব করেন, তবে তিনি সার্থক। হয়তো তার জাগতিক সাফল্যের ঝুড়িটা শূন্য হতে পারে, তবে সাফল্যের চাইতে বড় রত্ন তার ঝুড়িতে শোভা পায়, আর তা হল সার্থকতা। জীবনে চলার সঠিক পথ কোনটি, তা বেছে নেয়ার জন্য শিক্ষা, পাণ্ডিত্য, বিদ্যা কিছুই দরকার নেই, শুধু মন আর বিবেক থাকলেই চলে যা সবারই থাকে। যে যে পথে জীবন কাটাতে ভালোবাসে, যদি সে পথে সকল ত্যাগ স্বীকার করে ধৈর্য ধরে সে চলতে পারে, তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনও দারিদ্র্য বা দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। জীবনের সকল কষ্টের সাথেই তারা নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখে যায়। আমাদের সুখ ও দুঃখ, দুইই আমাদের ইচ্ছাশক্তি ও সে শক্তিকে ধারণ করার মানসিক প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে।

চুয়াল্লিশ। নতুন কোনও বিষয়ে জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে মনকে অর্জিত সকল পূর্ব জ্ঞান ও ধারণা থেকে মুক্তি দেয়া। মন যতো বেশি অতীত জ্ঞানের দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকবে, নতুন জ্ঞানের প্রবেশ ততো বেশি বাধাপ্রাপ্ত হবে। যেকোনো আকাঙ্ক্ষা পূরণের ক্ষেত্রে নতুন জ্ঞানের প্রায়োগিক দিকগুলি কাজ করে। আমাদের মনে দুই ধরনের আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় এককভাবে, আরেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় অন্যান্য কিছু আকাঙ্ক্ষার সাথে সমষ্টিগতভাবে। আকাঙ্ক্ষা বস্তুগত কিংবা অবস্তুগত কিংবা উভয় প্রকারের হতে পারে। এমন প্রায়ই ঘটে, আমার পক্ষে যা যা পাওয়া সম্ভব, সেগুলি আমি আলাদা-আলাদাভাবে পেতে পারি, কিন্তু একসাথে পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ একসাথে পেতে গেলেই সেগুলির মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব বাধে কিংবা বাহ্যিক কোনও বিষয় এসে পুরো প্রাপ্তিটিকেই অর্থহীন করে দেয়। সহজ করে বলতে গেলে, হয়তো আমার X দরকার, আবার Y-ও দরকার। আমি এ দুটোর যেকোনোটি পাব, তবে দুটো একসাথে পাব না। এ ক্ষেত্রে আমি কোনটা ছেড়ে কোনটা গ্রহণ করব? এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা একভাবেই সম্ভব, তা হল, কী কী কারণে আমার X দরকার, তা একটি কাগজে লিখে নেবো, কী কী কারণে Y দরকার, তা একটি কাগজে লিখে নেবো। এরপর গুরুত্বের বিচারে তুলনা করে যার গুরুত্ব বেশি সেটিকেই বেছে নেবো। আমাদের মনের ভেতরে নিরন্তর চলমান এমন আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব যে কেবল আমাদের প্রার্থিত বস্তুগুলির মধ্যকার ভিন্নতার কারণেই হয় এমন নয়, বাহ্যিক কিছু কারণ দ্বারাও এটি প্রভাবিত, যেমন আমাদের আর্থিক বা অন্যবিধ অসঙ্গতি, সীমিত সামর্থ্য, কিংবা মানুষের অস্তিত্বের সময়গত ও অবস্থানগত সীমাবদ্ধতা। একেবারেই নিঃস্পৃহ মানুষটিরও কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকেই, সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিও তার সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেন না। আকাঙ্ক্ষা শূন্য হওয়া, সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা—এর কোনওটাই কখনও সম্ভব নয়। মানুষ কখনওই পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হয় না। তাই জীবনে তৃপ্তির অনুষঙ্গ যতোই কমিয়ে ফেলা যায়, জীবনধারণের সময় মানুষ ততোই পরিপূর্ণতার স্বাদ পায়। যার আকাঙ্ক্ষা যতো কম, সে ততো ধনী। মানুষের অতৃপ্তি অস্বস্তি অ-সুখ অসন্তোষ তখনই কাজ করে যখন মানুষ যা চায়, তার উপর সে প্রয়োজনের তুলনায় অল্প বা অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কীসের উপর কতটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিত, তা কীভাবে নির্ধারণ করা যায়? দেখা যাক। আমাদের মধ্যে যখনই কোনও আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়, তখনই আমরা যাচাই করে দেখব, এই আকাঙ্ক্ষাটি এই মুহূর্তেই পূরণ করার মতো কি না, এবং আকাঙ্ক্ষাটি পূরণ করলে বর্তমানে বা ভবিষ্যতে কোনও অনর্থ সৃষ্ট হওয়ার আশংকা আছে কি না। যদি প্রথমটির উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং দ্বিতীয়টির উত্তর ‘না’ হয়, তবে আকাঙ্ক্ষাটি এই মুহূর্তেই পূরণ করা ভাল। কারণ পরবর্তীতে সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য সঙ্গতি, ইচ্ছা, বা আয়ু নাও থাকতে পারে। যা কিছু আমাদের জীবনকে সহজ পথে নেবে না, জটিল করে দেবে, তা কিছু সঙ্গতি ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অপূর্ণ রেখে দেয়াই মঙ্গল। এতে জীবনে ভারসাম্য আনা যায়। জীবনে ভারসাম্য আনার অর্থ কী? যা আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ থেকে কঠিন করে দেয়, তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাই জীবনে ভারসাম্য আনা। এই ভারসাম্য আনার কাজটা বড় শক্ত। এমন অনেককিছুই আছে, যা আমাদের কিংবা আমাদের পরিপার্শ্বের জন্য গুরুত্ববাহী, কিন্তু একইসাথে আমাদের জীবনকে জটিল করে দেয়। সে ক্ষেত্রে আমরা কী করব? আমাদের যে আকাঙ্ক্ষাগুলি পূরণ করলে আমাদের জীবনে কিংবা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ, অবস্থা, বা ব্যক্তিবর্গের জীবনে শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ আসার সম্ভাবনা আছে, আমাদের সে আকাঙ্ক্ষাগুলি পূরণে মনোযোগী হতে হবে। সহজ পথে চলার সিদ্ধান্ত নিলে সবসময়ই যে জীবন সহজ হয়ে যায়, এমন নয়। সে ক্ষেত্রে হয় পথটা বদলাতে হবে, কিংবা পথের দাবি অনুযায়ী নিজেকে বদলাতে হবে। যার জীবনে কোনও শিক্ষক নেই, যার সামনে শেখার মতো কেউ নেই, তার মনের অবস্থা অনেকটা তার মুখ ও পাকস্থলীর মতো—যা পায়, তা-ই গ্রহণ করে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, মানুষ আবেগতাড়িত প্রাণী। আবেগ মানুষকে যা করতে বলে, মানুষ তার পেছনে কোনও না কোনও যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলে, এবং কাজটি করার সময় নিজেকে বোঝায়, আমি তো অযৌক্তিক কিছু করছি না। তাই বলা যায়, ব্যক্তি, কাল ও দেশ ভেদে প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজন মাফিক যুক্তির ব্যাকরণ একেক রকম হতে পারে। পরম যুক্তি বলে কিছু নেই, যুক্তি সবসময়ই আপেক্ষিক। ভালোবাসা ও ঘৃণা যেমনি যুক্তি মেনে চলে না, তেমনি আমাদের আকাঙ্ক্ষা ও বিতৃষ্ণাও যুক্তির হাত ধরে পথ চলে না। একেক ব্যক্তির কাছ থেকে আমাদের চাওয়া একেক রকমের। এ ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতি ও তীব্রতা পারস্পরিক ব্যক্তিসম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। আজকে যা ভাল, তা যদি কালকে খারাপ কিছু ডেকে আনে, তবে তা নিশ্চয়ই বর্জনীয়। আজকে যা খারাপ, তা যদি কালকে ভাল কিছু ডেকে আনে, তবে তা গ্রহণীয়। বর্তমান ও ভবিষ্যতের এ ভারসাম্য যে যতো ভাল বুঝতে পারে, সে ততো নির্ভুলভাবে তার ভুলগুলিকে অনেকটাই শুধরে নিতে পারে। কাজটা সহজ নয়। ধরা যাক, এই মুহূর্তেই আপনার খুব দামি একটা বাড়ি কিনতে ইচ্ছে করছে। বাড়ি কেনার টাকাও আপনার সঞ্চয়ে আছে। তবে আপনার সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়, বাড়িটা এখনই কিনলে খুব জরুরি প্রয়োজনে টাকার দরকার হলে লোকের কাছে হাতপাতা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। আবার গাড়িটা না কিনে টাকাটা জমিয়ে রাখলে এমনও তো হতে পারে, টাকাটা ভোগ করার আগেই আপনি মরে গেলেন। এ মনস্তাত্ত্বিক দ্বৈততার সমাধান কী? অনেক সমাধান আছে। আমার দৃষ্টিতে সবচাইতে সহজ সমাধানটি হচ্ছে, আপনার চাহিদা কমিয়ে ফেলা। সাধারণত, যে সকল জিনিসের বাহ্যিক মূল্য বেশি, সে সকল জিনিসের অভ্যন্তরীণ মূল্য কম হয়ে থাকে। যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু দিয়েই একবার বাঁচা শিখে গেলে আর ভয় নেই, অনেক ঐশ্বর্য নিয়ে বাঁচা যায়। আমরা অমূল্যকে মূল্যহীন করে রাখি, মূল্যহীনকে অমূল্য করে ভাবি। বিপত্তিটা সেখানেই। আমাদের কথা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, আমাদের কাজ আমাদের জীবনে গ্লানির সূচনা ঘটাতে পারে। তবু আমরা অমন কথা বলে ফেলি, অমন কাজ করে ফেলি। কেন? পরস্পরবিরোধী কিছু আকাঙ্ক্ষা আমাদের দিয়ে ওরকম করে বলিয়ে নেয়, ওরকম কাজ করিয়ে নেয়। আমাদের ইচ্ছা যখন সময়ের বিচারে সকল যুক্তির বিরুদ্ধে চলে, তখন হয় তীব্র আলো আমাদের ভাসিয়ে নেয়, কিংবা গাঢ় অন্ধকার আমাদের অসীম অন্ধত্বে ডুবিয়ে দেয়। মন যতো বেশি পরিস্থিতির উত্তেজনায় কাজ করে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ ততো কমতে থাকে। তখন মন তার পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারে না, এবং এর ক্রমাগত চর্চায় মানুষ নিকৃষ্ট শ্রেণীর প্রাণীতে পরিণত হয়। মানসিক সংকীর্ণতায় আনন্দ পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সুন্দর ভাবনা ও কাজের সমন্বয় সবসময়ই ব্যাহত হয়। সংকীর্ণ মন উচ্চ চিন্তা ও উচ্চ চিন্তার মানুষ সহ্য করতে পারে না, ভাবনার উচ্চস্তরের সাহচর্য সংকীর্ণ মনকে ঈর্ষাপরায়ণ ও হিংস্র করে দেয়।

পঁয়তাল্লিশ। আমাদের কিছু-কিছু অনুভূতি আমৃত্যু টিকে থাকে। এমন অনুভূতির একটি হল, আমরা আমাদের মন ও মস্তিষ্ককে কতটুকু ব্যবহার করছি বা করতে পারছি, তার উপর ভিত্তি করে আমাদের চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত অনুভূতি। ধর্মীয় বিভিন্ন বিধিবিধান আমাদের অনেক ভাবনাকে সংকীর্ণ ও সীমিত করে দেয়। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, ওই সকল বিধিবিধানের আবশ্যকতা কতটুকু? কিংবা, কোনও আবশ্যকতা আছে কি আদৌ? একটু ভাবলে দেখা যায়, আমরা যা পেতে চাই কিংবা যা পাওয়ার ক্ষমতা রাখি, তার সবটুকুই পাওয়া সম্ভব নয়, কিংবা সম্ভব হলেও পাওয়া উচিত নয়, কারণ সবটুকু পেয়ে গেলে সমাজে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। আমাদের ধর্মীয় বিভিন্ন বিধিবিধান যা করে তা হল, এমন অনেককিছু যা আমরা পেতে চাই কিংবা চাইলেই পেতে পারি, অথচ পেয়ে গেলে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, সেসবকিছু পাওয়া বা পাওয়ার ইচ্ছা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে। এতে সমাজ নিরাপদ থাকে। ধর্মীয় অনেক রীতিনীতি আছে যেগুলি মেনে চললে একটা দেশের সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে দেশের সম্পদ ঘাটতি মেটানো সম্ভব। মানবচরিত্রে দুটো দিক স্পষ্ট: বিচিত্রতা ও অধোগামিতা। ধর্মীয় অনুসাশনের মাধ্যমে মানুষের চরিত্রের এই দুটো দিককে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একটা পরিবারের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাও এর মাধ্যমে ঠিক থাকে। সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে মারামারি খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। সে ক্ষেত্রে যদি কোনও ধর্মগুরু বা ধর্মীয় রীতি তাদের এমন কোনও পথে চলতে বাধ্য করে, যেটা সমাজসিদ্ধ এবং তার অন্যথায় হলে সমাজের লোকেরা ওই ভাইদের একঘরে করে রাখবে কিংবা সে সমাজে বাস করতেই দেবে না, তবে তাদের মধ্যকার সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব গোড়াতেই এড়ানো যায়। কখনও-কখনও ধর্ম তার নিজস্ব বলয়ের মধ্যে আমাদের সমাজকে সুরক্ষিত রাখে। অনেক ধর্মীয় বিধিই আমাদের এমন অনেক কাজ থেকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিরত রাখে যা ঘটলে চরম অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হতে পারত। অতৃপ্তি ও অসন্তোষ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। যখন কেউ ধর্মীয় বিধান মেনে তার জীবনের চাহিদাকে কমিয়ে নিয়ে আসে, এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে উপায়েই জীবন কাটিয়ে যায়, তখন সে ওই দুই প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে অনেকটাই মুক্ত রাখতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, যখন লাভের প্রশ্ন এসে যায় তখন ভ্রাতৃত্ববোধের চাইতে লাভের দিকে মানুষের মন ঝুঁকে যায়। সচেতন কিংবা অবচেতন মনে মানুষ সম্পর্কের আগে স্বার্থকে প্রশ্রয় দেয়। মানুষ যখন সম্পর্ককে স্বার্থের আগে রাখে, তখন বেশিরভাগ সময়ই মানুষ তা করে পারিবারিক কিংবা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। প্রায়ই দেখা যায়, মানুষ যে যেকোনও খারাপ ইচ্ছা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লোভে পড়ে তা নয়, বরং তার আশেপাশের সবাই ওই জিনিস পাওয়ার জন্য লোভে পড়েছে বলে সেও লোভে পড়ে। সবাই যেটাকে ভাল বলে, সেও সেটাকে ভাল বলে। সবাই যা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে, সেও সেটা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে। এটা হয় বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের অভাবে। অযোগ্য ও অন্ধরা অনুকরণের লোভ সামলাতে পারে না। যার জ্ঞান ও নিয়ত সৎ, সে তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পৃথিবী জয় করতে পারে। কেউ যখন কোনও ঠিক কাজ করে, তখন কাজটা করা ঠিক বলে কাজটা করে না, বরং এ কারণে কাজটা ওভাবে করে কারণ কাজটা ওভাবে করাটা তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। একইভাবে কেউ যখন কোনও ভুল কাজ করে, তখন কাজটা করা ভুল বলে কাজটা করে না, বরং এ কারণে কাজটা ওভাবে করে কারণ কাজটা ওভাবে করাটা তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের মধ্যে যে অনুভূতি কাজ করে, সে অনুভূতির প্রভাব ও গুরুত্ব অনেক বেশি। পরিবেশ, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান মানুষের অনুভূতিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের কাজ ও আচরণের ধরন বাহ্যিক প্রণোদনা, পরিবেশ ও চাহিদার উপর নির্ভরশীল। তাই এই তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় এনে মানুষকে নির্দিষ্ট বিন্যাসে রেখে নির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়া সম্ভব। মানুষ ও পশুর মধ্যকার মূল পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ কোনও একটি কাজ বা আকাঙ্ক্ষার পক্ষে বা বিরুদ্ধে অন্য একটি বিকল্প আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিতে পারে, এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারে, যা পশু পারে না। যারা বিকল্প আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিতে পারে না, তারা সাধারণত পশুর বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। একজন মাদকসেবী যদি মাদক গ্রহণ না করে বাঁচতে না পারে, তবে সে মূলত পশুতুল্য, কারণ সে তার মনে মাদক গ্রহণ ব্যতীত অন্য কোনও বিকল্প আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিতে অক্ষম। ইচ্ছার স্বাধীনতা আর কাজের স্বাধীনতা এক কথা নয়। একজন মানুষ যেমন খুশি তেমন ইচ্ছা মনের মধ্যে আনতেই পারে, তবে সে কখনওই যেমন খুশি তেমন কাজ করতে পারে না। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুসাশন ও অভ্যস্ততা তাকে অনেক কাজ থেকেই বিরত রাখে।

ছেচল্লিশ। মানুষের জীবনে সুখ আছে, কষ্ট আছে। এর মধ্য থেকেই আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। কষ্টের মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ আছে, সে আনন্দ কষ্টের দিন শেষ হওয়ার পর অফুরান সুখের স্বপ্ন দেখার আনন্দ। সে আনন্দ যে যতো কম দেখতে পায়, তার জীবনে কষ্টের স্থায়িত্ব ততো বেশি হয়। আমরা কখন সুখী হই? সুখই বা কী? প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দেয়া সহজ। আমি যাদের ভালোবাসি, তারা আশেপাশে থাকলে সুখ পাই। বেথোভেন, মোজার্ট, বাখ, হ্যান্ডেল, তাইকোবস্কির সুর আমাকে এনে দেয় হাওয়ায় ওড়া পেঁজাতুলোর মতো নরম-নরম সুখ। ভাল মুভি দেখলে মনে হতে থাকে, জীবন তো এখানেই! একটা চমৎকার সন্ধ্যা অনায়াসেই কাটিয়ে দেয়া যায় জীবনানন্দের হাতে হাত রেখে। কিছু জাদুমাখা গানের রেশে বুঁদ হয়ে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কাজগুলি ঠিকঠাক চললে কতো ভাল লাগে! দুচোখ বুজে পোষা বেড়ালটার গায়ে হাত বোলাতে কি কম সুখ? কারও মন খারাপ, কারও সাহায্যের প্রয়োজন—এমন কারও পাশে দাঁড়াতে পারলে বড় শান্তি লাগে। সমুদ্রধারের রেস্টুরেন্টটায় বসে-বসে বন্ধুদের সাথে গরম-গরম সিফুড প্লেটার সাবাড় করা কিংবা কফির ধোঁয়ায় কোনও এক সন্ধ্যা নামিয়ে প্রিয় মানুষটির মুখোমুখি চুপচাপ বসেথাকা যখন দুচোখ ঠোঁটের দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে—কী এক অপূর্ব মুহূর্ত! ভাবা যায়! নীরব নিশ্চুপ নিস্তব্ধ ধ্যানে ডুব মেরে বসে থাকলে রাশি-রাশি শান্তি এসে মনটাকে কেমন করে ভিজিয়ে দেয়। কাঙ্ক্ষিত কারও সাথে নিপুণ রতিকলার তীব্রতায় সমস্ত শরীরমন যখন ফুটন্ত আগ্নেয়গিরির মতো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে, সে আনন্দের সাথে পৃথিবীর আর কিছুর তুলনা কি চলে? একমাত্র লেখার সময়ই আমার অমন মাতাল-মাতাল লাগে! সকালবেলার চায়ের কাপে প্রথম চুমুক—এর রেশ সারাদিনেও কি কাটে? প্রথম সন্তান জন্মের অনুভূতি—পৃথিবীর অতুলনীয় অপার্থিব সম্পদ! খিলখিল করে হাসতেথাকা শিশুর দিকে তাকালে মনের নদীতে আশ্চর্য রকমের একটা আনন্দের স্রোত বয়ে যায় না? পাহাড়ে ঘোরা—চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতেও কী দারুণ শিহরণ জাগে! প্রিয়জনের সাথে গহীন অরণ্যে খড়কুটো জ্বালিয়ে রাতের আকাশ দেখা—বড় আনন্দের সে দেখা—সে রাতে তারা নিভে যায় যাক, চাঁদ ডুবে যায় যাক! এসব আমাকে সুখী করে। সুখ কি তবে এমন সব মুহূর্তকে জড়ো করা? মনে তো হয় না! তা-ই যদি হবে, তবে সবার সুখ একই রকমের নয় কেন? যা কিছু আমায় হাসায়, কেন একই কিছু অন্য কারও-কারও চোখে জল ঝরায়? এমন অনেক লোককে চিনি মোজার্ট শুনলে যাদের মাথাব্যথা শুরু হয়, ওদের সামনে সিফুডের নাম উচ্চারণ করলে পর্যন্ত ওরা ঘেন্নায় কুঁকড়ে যায়, প্রকৃতির সান্নিধ্য যাদের কাছে খুব অসহ্য কিংবা আদিখ্যেতা, কুকুর দেখলে কোনও কারণ ছাড়াই ওর গায়ে ঢিল ছোঁড়ে, চা-কফিতে প্রবল বিতৃষ্ণা, মৌনতা যাদের একটুও সয় না। এরাও তো দিব্যি বাঁচে, না? এরা যে খুব বিরক্তিকর, তাও কিন্তু নয়, এমনকি এদের সাথে গল্প করতেও খারাপ লাগে না! আসলে সুখের সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম। যা আমার ভাল লাগে না, তা খুব ভাল কিছু হলেও আমাকে সুখী করতে পারবে না। আমি দিবাচর, তাই বলে আরেকজন নিশাচর হবে না কেন? আবার এমনও হয়, যা আমায় আগে সুখে রাখত, তা আমায় এখন আর সুখে রাখে না। একসময় যার চোখ নেশা ধরিয়ে দিত, এখন তার ভাবনা মাথায় এলেও রক্ত চড়ে যায়। সুখ কী তবে? এমন কিছু যা অন্যান্যদের সাথে আমার সম্পর্কের মাধুর্য দিয়ে মাপা যায়? নাকি, বস্তুগত ঐশ্বর্যই সুখের শেষ ঠিকানা? নাকি, সুখের ঘর আমাদের মনের মধ্যেই, বাহ্যিক কোনও কিছুই একে প্রভাবিত করতে পারে না? যে সুখের অভিজ্ঞতা কখনওই হয়নি, সে অভিজ্ঞতা লাভের স্মৃতির দাম লক্ষ টাকা। প্রথম চুমুর স্মৃতি যার ঝাপসা হয়ে গেছে, তার চাইতে দরিদ্র আর কে আছে? ব্যস্ত জীবনে ব্যস্ততার মধ্যেই সুখ খুঁজে নিতে জানতে হয়। সুখের খোঁজ ঘৃণার মুক্তিতে, ভালোবাসার শৃঙ্খলে। এমনকি যাকে ঘৃণা করি, তাকে ঘৃণা করার মধ্যেও এক ধরনের সুখ আছে। সুখ যুক্তিতে নয়, যুক্তির ভাঙনে। কিছু-কিছু সুখ ক্ষণিকের, সে সুখের মাশুল গুনতে হয় অনন্ত যন্ত্রণায়। মাদক সেবনের সুখ পরিণামে যে নিশ্চিত কষ্ট ডেকে আনে তার কথা ভাবলেও ভয়ে দুচোখ আপনিই বন্ধ হয়ে আসে। কখনও-কখনও তীব্র সুখের চেয়ে বিকল্প মৃদু সুখ অনেক ভাল। সে বিকল্পের খোঁজ যারা পায়, তাদের জীবন সুন্দর। হাতের কাছে থাকলেও সব সুখ নেয়া যায় না। ভয়, সংশয়, আকাঙ্ক্ষা, আবেগ, অহংকার, অজ্ঞতা, সংস্কার সহ অনেক অভ্যন্তরীণ অনুঘটক আমাদের সুখী হতে বাধা দেয়। আমাদের যা কিছু অসুখী করে রাখে, আমরা চাইলেই কি সেসব কিছু থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারি? প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের ব্যথাতুর করে, প্রেমের আকস্মিক অকাল সমাপ্তি আমাদের কাঁদায়, শরীর খারাপ করলে সাথে মনটাও খারাপ হয়ে থাকে, ক্যারিয়ারে বিপর্যয় নেমে এলে ভীষণ উদাসীন মানুষটিও সেটাকে শান্তমনে মেনে নিতে পারে না। সুখ খুব সূক্ষ্ম, জটিল ও বায়বীয় একটা ব্যাপার—চোখের সামনে, আবার হাত বাড়ালেই নেই; কতো দূরে, অথচ হাতড়ালেও ধাক্কা এসে লাগে। সুখ মূলত ব্যক্তিগত কল্যাণ, আর দুঃখ ব্যক্তিগত অকল্যাণ। খুব সুখী মানুষও হঠাৎ অসুখী হয়ে যেতে পারে। অসুস্থতা, পেশাগত বিপত্তি, পারিবারিক ঝামেলা, কিংবা অন্য যে কোনও কারণে জীবনে আকস্মিক অসন্তোষ আসতে পারে। কেউ যখন বলে সে তার জীবন নিয়ে সুখী বা তৃপ্ত, এর অর্থ হল, সে জীবনে কোনও না কোনওভাবে আনন্দের খোঁজ পেয়েছে, কিংবা সে যেভাবে চায় জীবন সেভাবেই ভারসাম্য নিয়ে চলছে, কিংবা তার পেশাগত, পারিবারিক, সামাজিক, আত্মিক, আবেগজাত বিষয়গুলি নিয়ে সে সন্তুষ্ট। জীবনে অ-সুখ আসে তখনই যখন আমাদের আনন্দের উৎসগুলি একে-একে হারিয়ে যায়, বিপরীতমুখী আকাঙ্ক্ষার চাপে আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে, অনুভূতির তীব্রতা বা অসাড়তা আমাদের যন্ত্রণায় ডুবিয়ে রাখে, বিরহ বা আর্থসামাজিক ব্যর্থতা আমাদের গ্রাস করে ফেলে। জীবনে অসুখী হওয়ার প্রধান কারণ হল এই, আমাদের জীবনের আলোকিত দিকগুলির চাইতে অন্ধকার দিকগুলির ভাবনা আমাদের বেশি আচ্ছন্ন করে রাখে। হ্যাঁ, টিকে থাকতে হলে প্রথমেই দরকার বিপদ চিনতে পারা এবং নিজেকে সে অনুযায়ী প্রস্তুত করা। তবে বিপদের আশংকা নিয়ে সদাউদ্বেগ যেন আমাদের জীবনে আলো আসতে কিছুতেই বাধা না দেয়। আমাদের অনুভূতি আর ভাবনা যখন আমাদের নিয়ে খেলে, তখন সে খেলায় শুধু ওদের নয়, আমাদেরও সমান প্রভাব থাকুক। শুধু অন্ধকারকেই নয়, আলোকেও আমরা কখনও-কখনও জিতিয়ে দেবো। এই জিতিয়ে দেয়ার নামই ভারসাম্য। আমরা যে জীবনে বেঁচে আছি, সে জীবনটা আমাদের ভাল লাগে? এ প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে আমরা সুখী। যদি ‘না’ হয়, তবে নিজেকে সুখী দেখতে চাইলে যা যা করা দরকার, তা তা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে, এবং সেগুলি করতে হবে। সময়ের সাথে-সাথে কিন্তু মানুষের ভালোলাগা মন্দলাগা, দুইই বদলায়। তাই যে জীবনে বাঁচতে পারলে আমাদের ভাল লাগত বলে আমরা এখন ধরে নিচ্ছি, এমনও হতে পারে, সে জীবনে পৌঁছে গেলে সময় বদলে যাবে, সাথে বদলে যাবে আমাদের ভালোলাগার ঠিকানা। নতুন ঠিকানায় থাকতে না পারার কষ্ট আবার আমাদের অসুখী করে রাখবে। যে জীবনে এখন বেঁচে আছি, এ জীবনও তো কারও না কারও স্বপ্নের জীবন। এ জীবনটা আমার—এও বা কম কীসে? তাই যতটুকু পারা যায়, এ জীবনের সকল সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করে মুঠোয়-মুঠোয় ছোট্ট সুখের ছোঁয়ায় বেঁচে নেয়াটা কি ভাল নয়?

সাতচল্লিশ। সুখী হওয়ার অর্থ হল বেছে নিতে শেখা। কোন আনন্দটা আমার জন্য শুধু সেটাই নয়, বরং আমার পথ কোনটা, আমি কোন পেশায় থাকতে চাই, আমি কীভাবে বাঁচব, আমার ভালোবাসার কাজ কী, অবসরটা কেমন করে কাটলে আমার ভাল লাগবে, বন্ধু নির্বাচন কিংবা জীবনের মূল্যবোধ ঠিক করা—এ সবই সুখী হওয়ার প্রাথমিক ধাপ। ভালোভাবে বাঁচার অর্থ হল, আমরা যা কিছু চাই তার সবকিছুই পাওয়া নয়, বরং যা কিছু পেলে আমাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে না আবার জীবনটাও আনন্দে কাটবে, তা কিছু পাওয়া। আমাদের মূল্যবোধ অনুযায়ী আমাদের লক্ষ্যের পথে হাঁটাই জীবন। যা আমাদের কিংবা আমাদের সমাজের সাথে যায় না, তা পাওয়াটা আমাদের স্বপ্ন হলেও সে পথে হাঁটা কল্যাণকর নয়। জীবনের লক্ষ্য স্থির করার সময়ই ঠিক করে নিতে হয় কোন কাজটা আমাদের মনের মতো, কোন কাজটা আমাদের মনের মতো নয়। যা আমাদের মনের মতো নয় সেটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলে পেশাগত জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আমরা যে পেশায় আছি সে পেশাটি আমাদের সারাক্ষণই অসন্তুষ্ট রাখলে সে পেশায় ঠিকভাবে মন বসানো সম্ভব নয়। আবার, একটা বিয়ে করবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে, ওদেরকে বড় করবে, সুন্দর গোছানো একটা পরিবার হবে—কারও-কারও অস্তিত্বের অর্থই হল এ-ই। এমন মানুষও আমরা দেখি, যারা জীবনের অর্থ খুঁজে পান তাদের চারপাশের লোকজনকে সাহায্য করার মধ্যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কিংবা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে। কেন? কোনও কারণ নেই। ওরকম করতে ওদের ভাল লাগে, শান্তি লাগে, তাই। জীবনকে আমরা কীভাবে কাটাতে চাই, তার উপর নির্ভর করে আমাদের জীবনের অর্থ কী। আচ্ছা, জীবনের অর্থ আর জীবনের আনন্দ—এই দুইয়ের মধ্যে কোনটা জরুরি? কোনটা আমাদের জীবনকে ইতিবাচক করে তুলে? উত্তরটা সহজ। যদি কেউ কোনও না কোনও উপায়ে আনন্দে বাঁচে, তবে তারা তাদের জীবনের ইতিবাচক অর্থ খুঁজে পায়। আনন্দ ও সুখের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বোঝা খুব জরুরি। ফ্রয়েড জানাচ্ছেন, মানুষ যা-ই করে, আনন্দের জন্যই করে, জীবনের অর্থ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ডেথ ক্যাম্প থেকে বেঁচেআসা ভিক্টর ফ্রাঙ্কল্‌ মৃত্যুপুরীতে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছেন, মানুষ মূলত জীবনের অর্থ খুঁজে ফেরে। দুই রকম কথা। কোনটা সত্য? আসলে দুটোই সত্য। মানুষ তখনই সুখী হয় যখন তার জীবনে আনন্দ থাকে এবং সে বাঁচার কোনও অর্থ খুঁজে পায়। আমাদের লক্ষ্যের চাইতে লক্ষ্যে পৌঁছানোর রাস্তাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্বপ্নযাত্রার সময়টাকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগানো জরুরি। আচ্ছা, সুখী কারা? নির্বোধরা খুব সুখে থাকে। তাই বলে কি আমরা কেউ নির্বোধ হতে চাই? যার জ্ঞান যতো বেশি, তার চাহিদা ততো বেশি, ফলে তার সুখ ততো কম। স্বচ্ছ উপায়ে বাঁচতে গেলে অনেককিছুর সাথে মানিয়ে নিতে হয়। তার মানে কি জীবনধারণের স্বচ্ছতা আমাদের অসুখী করে? অল্প চাহিদা, বেশি সুখ। এটাই কি নিয়ম? ভলতেয়ারের একটা গল্প মনে পড়ল—ভাল ব্রাহ্মণের গল্প। এক জ্ঞানী ব্রাহ্মণ ছিলেন যিনি সারাক্ষণই নিজেকে বিভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিক প্রশ্ন করতেন। এগুলির কোনটার উত্তর পেতেন, কোনটার পেতেন না। ফলে তাঁর মনে সুখ ছিল না। তার বাড়ির কাছেই এক অজ্ঞ, গোঁড়া মহিলা থাকতেন, খেয়েপরে বেঁচে থাকাই ছিল যার একমাত্র উদ্দেশ্য। তার মাথায় কখনও কোনও প্রশ্ন আসত না, ফলে তিনি বেশ সুখীই ছিলেন। তাকে দেখে মনে হত, তার চাইতে সুখী মহিলা এ পৃথিবীতে নেই। কেউ একজন সে জ্ঞানী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এমন সুখ চান না?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ, আমি নিজেকে অসংখ্যবার বলেছি আমি যদি ওই মহিলার মতো নির্বোধ হয়ে বাঁচতে পারতাম, তবে আমি নিঃসন্দেহে উনার মতোই সুখী হতাম। তবে আমি ওভাবে সুখী হতে চাই না।” সকল সমাজেই নির্বোধ সুখী মানুষের সংখ্যা বেশি। এমন হয়ে বাঁচতে অসুবিধাটা কোথায়? তারা ততক্ষণই সুখে থাকে যতক্ষণ তাদের জীবনে বড়সড় কোনও সমস্যা এসে হাজির না হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বুদ্ধিতা আমাদের কোনও ঝামেলায় না ফেলছে ততক্ষণ পর্যন্ত এটা বড় আনন্দের জিনিস। চিন্তাশক্তি ও জ্ঞানকে নির্বাসনে পাঠিয়ে কেবল নির্বোধদের দেশেই সুখী হওয়া যায়। ভ্রান্ত সুখের স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। মিথ্যে সুখও বেশিক্ষণ ভুলিয়ে রাখতে পারে না। নেশা কেটে গেলে সুখ আর টেকে না। এক লোক নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে কোনও মেয়েকে প্রেমে ফেলল। মেয়েটাও প্রেমের সাগরে বেশ সুখেই ভাসছিল। যখন মেয়েটা জানতে পারবে লোকটা বিবাহিত, তখন কি আর সেই সুখ থাকবে? সবসময়ই যুক্তিহীন উপায়ে সুখী হওয়া যায় না। নির্বোধ হয়ে অনন্তকাল সুখে থাকা অসম্ভব। এখন কথা হল, সবাইই কি সুখী হতে চায়? সুখী হতে চাইলে প্রথমেই যা দরকার তা হল, সুখী হতে চাইতে হবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও পক্ষেই সুখী হওয়া সম্ভব নয়। সুখ কি সার্বজনীন? সবাই যে সুখী হতে চায়, তা কিন্তু নয়। অনেকেই আছে যারা সুখী নয়, সন্তুষ্ট হতে চায়। সে সন্তুষ্টির পথে যাত্রাতেই তাদের যতো সুখ। আরেক দল আছে, যারা সুখ চায়, কিন্তু সে সুখ পাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার সেসব করতে চায় না। একেক জনের সুখ একেক জায়গায়। বর্তমানের আনন্দকে অস্বীকার না করলে গভীর সুখের দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। ধরা যাক, দুই বন্ধুর রক্তে সুরের নেশা খেলে। তাদের মধ্যে একজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সকল বিনোদন বাদ দিয়ে সুরের চর্চা করে যাচ্ছে। অনেক শ্রম, সাধনা, ধৈর্য ও একাগ্রতা দিয়ে একসময় সে ভাল একজন আর্টিস্ট হয়ে উঠল। অন্য বন্ধুটির একই স্বপ্ন ছিল কিন্তু এর জন্য যে তাগ, শ্রম আর নিষ্ঠার দরকার ছিল, সেসবের ধারেকাছেও সে কখনও যায়নি। সে তার জীবনকে উপভোগ করেছে এবং সুরকে শুধু হৃদয়েই ধারণ করে রেখে দিয়েছে, চর্চায় অতোটা আনেনি। সে হয়তো অনেক বছর পর দাবি করতে পারবে, তার আত্মায় সুর, প্রাণে সুর, ভাবনায় সুর। তবে যার গলায় সুর, তার কাছে তার এমন ‘সুরের সমঝদার’ ইমেজের কানাকড়িও মূল্য নেই। আমি যখন টিনএজার ছিলাম তখন প্রায়ই ভাবতাম, ইসস্‌ আমারও যদি ওদের মতো একটা প্রেম হত! খুব সুন্দর করে প্রেমের কথা লিখতে পারতাম, দীর্ঘ প্রেমের কবিতা চমৎকার করে আবৃত্তি করতে পারতাম, অসম্ভব রোমান্টিক-রোমান্টিক ভাবনা মাথায় মেঘের মতো চরে বেড়াত; শুধু যা পারতাম না তা হল, সাহস করে নিজের মনের বাধা না শুনে কাউকে ফস্‌ করে বলে ফেলা, ভালোবাসি! এ কাজ বড় কঠিন কাজ। নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়া অনায়াসেই, অথচ কাউকে বলা যায় না, ভালোবাসি! কারও-কারও সুখ চরম মুহূর্তের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে নেয়ার মধ্যে। ওদের সুখের ঠিকানা খেলাধুলা, হার্ড মিউজিক, ড্রাগস, অ্যালকোহল, কিংবা সেক্স। সংবেদনশীলতা চরম মাত্রায় পৌঁছে গেলে এদের কাউকে-কাউকে নিজের জীবনে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে বা নিজেকে শেষ করে দিতেও দেখা যায়। ধোঁয়া কিংবা অন্ধকার জীবনে আলো আনবেই বা কী করে? জীবনের শূন্যতা কি আর কৃত্রিম অনুসঙ্গে ভরে?

আটচল্লিশ। কীসে আমাদের সুখ আসে? আমরা কেন সুখী হতে চাই? আমরা অর্থ চাই আরামের জন্য, ক্ষমতা চাই লোকের কাছ থেকে স্বীকৃতি জয় করার জন্য, আর সুখী হতে চাই কেবল সুখী হওয়ার জন্য। যে জীবনে আনন্দ আছে সে জীবনই সুখী জীবন। আনন্দ কী? আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তিই আনন্দ। আমি জলপান করলে আনন্দ পাই কারণ আমি তৃষ্ণার্ত, আমি ঘুমালে আনন্দ পাই কারণ আমি ক্লান্ত, আমি কিছু শিখলে আনন্দ পাই কারণ আমি জানতে চাই, আমি যা চাই তা পেয়ে গেলে দারুণ আনন্দ পাই। এরকম আরও অনেক কিছুই আমাদের আনন্দ দেয়। যদি সব সুখ আমরা পেয়ে যেতাম তবে জীবন থেমে যেত। তাই সুখের অপূর্ণতা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। যে জীবনে কোনও দুঃখ নেই, সে জীবনের প্রতিচ্ছবি মৃত্যু আর কী? মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতেই সৃষ্টিকর্তা আমাদের কিছু দুঃখ দিয়ে রাখেন। জীবনে অনেক আনন্দ আছে, যেগুলি ভোগ করতে বাড়তি কোনও উদ্যম লাগে না, কিংবা যতটুকু উদ্যম প্রয়োজন হয় তা আমাদের বরং সুখ দেয়। যেমন, আইসক্রিম খাওয়া, যৌনসংগম করা, ভাল কোনও মুভি দেখা, গান শোনা, মজার কোনও বই পড়া, আকাশ দেখা, প্রিয়জনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা। কিছু-কিছু আনন্দ ভোগের সাথে-সাথে কমতে থাকে। যেমন ধরুন, ভীষণ খিদে পেল। তখন মনে হতে থাকে, এই মুহূর্তে কিছু খেতে পারলে পৃথিবীর সব আনন্দ যেন একসাথে হাতের মুঠোয় পেতাম। এরপর আমরা যতোই খাবার দিয়ে পাকস্থলী ভরাতে থাকি, আমাদের আনন্দ ততোই কমতে থাকে। দুএকটা আপেল খাওয়া আনন্দের, চারপাঁচটা আপেল খাওয়া নিরানন্দের, এর বেশি হয়ে গেলে তা রীতিমতো অত্যাচার।

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্মজীবনে ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। সেই ব্রিটিশ আমলের ম্যাজিস্ট্রেট কিন্তু চাট্টিখানি কথা ছিল না। অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে ম্যাজিস্ট্রেট হতে হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রকে।

সে পরীক্ষাতে অনান্য বিষয়ের সাথে বাংলা পরীক্ষাও দিতে হয়েছিল তাঁকে। মৌখিক বাংলা পরীক্ষায় সে বোর্ডের প্রধান ব্যক্তি ইংরেজ সাহেব বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রথম প্রশ্ন করলেন, “Well বাবু, you তো ভাল বাংলা জানে, Can you please tell me the difference between আপদ and বিপদ?”

বঙ্কিমচন্দ্র সবিনয়ে সাহেবকে বললেন, “Can I explain the difference by giving you examples?”

সাহেব সম্মতি দিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্র বলতে শুরু করলেন, “একবার ঢাকা থেকে লঞ্চে করে গোয়ালন্দ যাচ্ছিলাম, বিশাল পদ্মা নদীর মাঝখানে ঝড় উঠল। লঞ্চ ডোবে-ডোবে অবস্থা। সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিল। এটা হল বিপদ।”

আর আমি বাঙালি হয়ে তোমার মতো ইংরেজের কাছে বাংলা পরীক্ষা দিচ্ছি, এটা হল আপদ।”

সাহেব কী বুঝেছিলেন জানি না তবে বঙ্কিমচন্দ্রের চাকরি হয়েছিল।

অল্প ধনই আপদ হয়ে দাঁড়ায়, আর বেশি ধন তো রীতিমতো মহাবিপদ। লোকে বলে, “…….তবু রিকশায় বসে কাঁদার চাইতে ফেরারি গাড়িতে বসে কাঁদা অনেক ভাল।” শুনে বলতে ইচ্ছে করে, “ও আচ্ছা! তাই নাকি? Are you sure? মনে তো হয় না! আপনি কয়বার কেঁদেছেন ফেরারিতে বসে? ফেরারির কান্নায় জলের বদলে মুক্তো ঝরে নাকি ভায়া?” কান্না তো কান্নাই। পৃথিবীর সব কান্নাই একই রকমের। আমার তো মনে হয়, রিকশায় বরং অনেক নিরুদ্বিগ্নভাবে কাঁদা যায়। ফেরারির কান্না মাপা কান্না, চাপা কান্না, বোবা কান্না; রিকশার কান্না শুধুই কান্না। আসলে, সুখের অতোটা সরলীকৃত সমীকরণ হয় না। কিছু লোক আরেকজনকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। কিছু লোক অন্য প্রাণী হত্যা করে আনন্দ পায়। কিছু লোক অন্যকে যন্ত্রণা পেতে দেখলে আনন্দ পায়। কেন এমন হয়? এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। আনন্দের সাথে নৈতিকতার কোনও সম্পর্ক নেই। আনন্দের কোনও আগামাথা নেই, আনন্দ কোনও ব্যাকরণ মেনে চলে না, আনন্দের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ নয়—তাই আনন্দ কখনওই জীবনের একমাত্র তাড়না হতে পারে না। যে আনন্দ অন্যকে কষ্ট দেয়, অন্যের ক্ষতি ঘটায়, কিংবা ভবিষ্যত বিপদের আশংকার জন্ম দেয়, এমন আনন্দ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলে সুখের খোঁজে যেকোনও আনন্দের দরোজায় কড়া নাড়া যেতেই পারে। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, প্রতিপত্তি, খ্যাতি, ধ্যান, পরোপকার, দুর্গতের পাশে দাঁড়ানো—এমন অনেক আনন্দ মানুষকে সুখী করে। জাগতিক প্রাপ্তির আনন্দের চাইতে আত্মিক প্রাপ্তির আনন্দ মানুষের মনোজগতে অনেকবেশি প্রভাব বিস্তার করে। আনন্দ কিংবা সুখের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সুস্থ শরীর। শারীরিক সুস্থতার চাইতে বড় প্রাপ্তি আর নেই। সাহস, সংযম, উদারতা, নম্রতা, মহানুভবতা, রসবোধ আর ন্যায়বিচারের নিয়মিত চর্চা মানুষকে সুখী করে। এখন দেখা যাক, গ্রিক পণ্ডিত দার্শনিক এপিকিউরাস সুখ নিয়ে আমাদের কী জানাচ্ছেন। তিনি মনে করতেন, সুখী হতে চাইলে প্রথমেই আমাদের মন থেকে অবান্তর ও অমূলক সব ভয় দূর করে ফেলতে হবে। এমন দুটো ভয় হচ্ছে, মৃত্যুভয় ও ঈশ্বরভীতি। তিনি বলতেন না যে ঈশ্বর নেই, দেবতা নেই। তিনি বলতেন, ওরা আছে, থাকুক। ওরা ওদের জায়গাতেই থাকুক। ওদের বিরক্ত করার কিছু নেই। অভিজ্ঞতা বলে, মানুষের জীবনে ওদের কোনও প্রভাব নেই। প্রার্থনা ও নৈবেদ্য দিয়ে ওদের খুশি করার চেষ্টা নিরর্থক। আত্মা অমর—এই ধারণা মাথায় রেখে বাঁচার মানেই হল, মৃত্যুর পর কঠিন সব শাস্তির ভয় মাথায় রেখে বাঁচা। এই বাঁচা জীবনের আনন্দকে মাটি করে দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। মৃত্যুর আগেই মৃত্যুকে সাথে নিয়ে বাঁচার কী মানে? মানুষের দেহ হচ্ছে পরমাণুর সমষ্টি যা মৃত্যুতেই শেষ হয়ে যায়। মৃত্যুভয় ও এ সম্পর্কিত জীবনাচরণ মানুষের কল্পনা মাত্র। মৃত্যুতেই সব শেষ, এরপর আর কোনও জীবন নেই। জীবনের অনুপস্থিতি মানেই ভাবনা ও সৃষ্টির অনুপস্থিতি। এমন শূন্য নিয়ে ভাববার কী আছে? মানুষ কখন অসুখী হয়? এপিকিউরাসের কাছ থেকেই জেনে নিই। আমাদের অ-সুখ শুরুই হয় স্থায়ী অসন্তোষ থেকে। আকাঙ্ক্ষা তিন ধরনের। এক। স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় আকাঙ্ক্ষা, যেমন খাওয়া, পান করা, পোশাক পরা, ঘুমানো, ঘরে থাকার ইচ্ছা। দুই। স্বাভাবিক ও কম প্রয়োজনীয় আকাঙ্ক্ষা, যেমন ভাল রান্না, সুন্দর পোশাক, আরামদায়ক ঘর। তিন। কম স্বাভাবিক ও কম প্রয়োজনীয় আকাঙ্ক্ষা, যেমন ক্ষমতা, সম্মান, বিলাসিতা। তিনি বলতেন, সুখী হওয়ার জন্য আমাদের প্রথম ধরনের আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করলেই চলে, দ্বিতীয় ধরনের আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে যতো দূরে রাখা যাবে, ততো সুখী হওয়া যাবে। তৃতীয় ধরনের আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিতভাবেই আমাদের জীবনে ঝামেলা ও অ-সুখ নিয়ে আসে। এপিকিউরাসের সুখ সম্পর্কিত ভাবনাকে অনেকে ভুল বোঝেন। তারা ভাবেন, এপিকিউরাস যৌনতৃপ্তিকেই সুখের একমাত্র উপায় বলেছেন। এপিকিউরাস পরিমিত সাদামাটা খাবার গ্রহণের কথা বলতেন, সাধারণ পোশাক পরে অভ্যস্ত হতে পরামর্শ দিতেন। তিনি বলতেন, যে আনন্দে কৃত্রিমতা যতো বেশি থাকবে, সে আনন্দে সুখের উপাদান ততো কম থাকবে। বাহ্যিক নয়, অন্তরের প্রশান্তিই মানুষকে সুখী করে। আমরা যতো বেশি অহেতুক ভয় ও সংস্কার থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারব, আমাদের আনন্দের গুণগত মান ততো বেশি বৃদ্ধি পাবে। এপিকিউরাসের কথাগুলিকে এক কথায় এভাবে বলা যায়: নির্ভীক সরল জীবনযাপনই সুখের একমাত্র উৎস। শরীরকে সুস্থ রাখতে শরীরচর্চা, ধ্যান, ভাল খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার খুব চমৎকার বলেছেন: “আমাদের সুখের নব্বই শতাংশই নির্ভর করে স্বাস্থ্যের উপর। অসুস্থ রাজার চাইতে স্বাস্থ্যবান মুচি অধিক সুখী। দিনে অন্তত দুই ঘণ্টা মুক্ত বাতাসে শরীরচর্চা করা দরকার। আমাদের শরীর ভাল না থাকলে আমাদের কিছুই ভাল লাগে না।” আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, গাছ আমাদের হৃদয়ের চাহিদা বোঝে, পাহাড় আমাদের মনের খাবার সাজিয়ে রেখেছে, সাগর আমাদের এমন পৃথিবীতে পৌঁছে দেয় যে পৃথিবীতে বাঁচা স্বপ্ন আমরা প্রায়ই দেখি, অরণ্যের মাদকতা নারীশরীরের দুর্জ্ঞেয় সব ভাঁজের ঘ্রাণের চাইতে কম মাতাল করে না, নদীর ধার ধরে একা হেঁটে গেলে কতোটা শান্তি এসে শরীরমন ছেয়ে ফেলে। দুশ্চিন্তা দূর করতে, মনকে শান্ত রাখতে, চিন্তাভাবনাকে শাণিত করতে, জীবনযাপনের ক্লান্তি মুছে ফেলতে এগুলি পরম আশীর্বাদ। টিলা বেয়ে একটা পাথরের গড়িয়ে পড়াও আপনাকে অসীম শান্তি দিতে পারে, গাছের একটা ফুল থেকে অন্য ফুলে জলের ক্ষুদ্র ফোঁটাকে হাওয়ায় উড়ে দেখলে হৃদয় নেচে উঠতে পারে, এক টুকরো মেঘ কিংবা ছোট্ট চঞ্চল পাখির ফুড়ুৎফাড়ুৎ আপনাকে সারাটা দিন মুগ্ধ করে রাখতে পারে। ঘাসে শুয়ে থাকতে দারুণ লাগে না? বাগানের অসীম নৈঃশব্দ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজেকে হারানোর মধ্যে কী যে শান্তি! পার্কের এক কোনার বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে কে কী করছে, সেটা দেখতেও ভীষণ মজা! শিশুর সাথে ওর মতো করে খেলতে-খেলতে নিজের শৈশবকে ফিরে পাওয়ার সুখকল্পনা—এর তুলনা হয়? সুস্বাদু খাবারটির স্বাদ সবচাইতে বেশি পাওয়া যায় সেটি কারও সাথে ভাগ করে খেলে। প্রার্থনা, ধ্যান, হাসি, খেলাধুলা, পূর্বরাগ। এসব আমাদের হরমোনের নিঃসরণকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যা আমাদের মস্তিষ্কে সুখের অনুভূতি উৎপন্ন করে। তবে এত কথার পরও আমরা মাথায় রাখব: জগতের অন্য দশটা অনুভূতির মতো সুখের অনুভূতিও আপেক্ষিক—একেক জনের সুখ একেক জায়গায়।

ঊনপঞ্চাশ। ১। জীবনের প্রধান দুটো সমস্যা হল, ভ্রান্ত বোধ নিজের মধ্যে ধারণ করা এবং সে বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করা। ২। আমাদের জন্য কোনটা ঠিক, সেটা ঠিক সময়ে বুঝতে পারলে আমরা নিজেদের সঠিক পথে অনেকটাই এগিয়ে নিতে পারি। ৩। সাময়িক আত্মসুখ বিসর্জন ও একাগ্র কর্মনিষ্ঠাই ব্যক্তিগত ও বৈশ্বিক সমৃদ্ধির অব্যর্থ উপায়। ৪। আমাদের প্রত্যেকটা কাজই হোক প্রার্থনার মতো সুন্দর ও আন্তরিক। ৫। নিজের মধ্যে ইগোকে ধরে রেখে কখনোই সুখী হওয়া সম্ভব নয়। জিততে চাইলে সবার আগে হারতে শিখতে হবে। কখনও-কখনও লড়াই না করাই সবচাইতে বড় লড়াই। ৬। প্রতিদিনই একটু-একটু করে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নামই জীবনযাপন। একই মানুষ হয়ে প্রতিদিন বাঁচা আর মৃত্যুর মধ্যে তফাৎ অল্পই। ৭। যা শিখছি, তা যদি কাজে না লাগাই তবে শেখার সময়টা নিছকই অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। ৮। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, ততক্ষণ কিছুতেই নিজের কাছে হেরে যাওয়া যাবে না। নিজের কাছে হেরে যাওয়ার চাইতে মৃত্যুও সম্মানের। ৯। আমাদের যা আছে, সেটাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ও কাজের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব। জীবনে এখনও পর্যন্ত যতটুকু পেয়েছি, অনেক পেয়েছি—স্রষ্টাকে ধন্যবাদ। এমন বোধ মানুষকে ধনী ও সাহসী করে। ১০। চারপাশের পৃথিবী থেকে কেবল সুন্দর অনুভূতিগুলোই যেন আমরা আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে রাখি। সুখের চাষে সুখ বাড়ে, কষ্টের চাষে কষ্ট বাড়ে। ১১। সত্যকে উপলব্ধি করার একমাত্র পন্থা হল, মনের সকল পূর্ব অনুমান ও বদ্ধমূল ধারণাকে বিসর্জন দিয়ে প্রকৃত ঘটনা কী, অহং ও আবেগশূন্য হয়ে তা জানার চেষ্টা করা। আমাদের কোনও জানাই শেষ জানা নয়। আমি যা জানি, তা-ই একমাত্র সত্য—এরই নাম অজ্ঞতা। ১২। ক্রমাগত সুন্দর চিন্তার চর্চা আমাদের সুন্দর, অসুন্দর চিন্তার চর্চা আমাদের অসুন্দর করে তোলে। ১৩। মিথ্যা ও কুৎসিত কোনওকিছু সাময়িকভাবে আমাদের যতোই সুখী কিংবা তৃপ্ত করুক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তা থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে না পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অন্যদের চোখে ফালতু ও বাজেই থেকে যাবো। ১৪। অন্য কারও পথে পরিপূর্ণভাবে বাঁচার চাইতে নিজের স্বপ্নের পথে কুকুরের মতো পড়ে থাকাও স্বস্তির। ১৫। আমাদের সামনে অনেককিছুই করার থাকতে পারে। সেসবকিছুর মধ্য থেকে আমরা সবসময়ই সে কাজটিকেই প্রাধান্য দেবো, যা আমাদের ও আমাদের প্রিয় মানুষদের শান্তি ও সম্মান এনে দেয়। ১৬। ভাল হয়ে বাঁচা ও ভালভাবে বাঁচা—এই দুইয়ের চাইতে বড় পুরস্কার আর নেই। ভালথাকার প্র্যাকটিস করতে হয় নিজেকেই; কারণ বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, অন্যরা কেবল খারাপ থাকতেই জানে, ফলে ওরা ওটাই শেখায়। ১৭। নিজের দুর্বলতা অন্যের কাছে প্রকাশ করলে যা শান্তি পাওয়া যায়, পরিণামে তার চাইতে বহুগুণ অশান্তি সুদেআসলে ফেরত পাওয়া যায়। কাউকে নিজের দুর্বল দিকগুলি বলে দেয়ার মানেই হল, তাকে ভবিষ্যতে আপনার দুর্বলতার সুযোগ নেয়ার রাস্তা করে দেয়া। সুখকর নয়, সঠিক কাজই মানুষকে ক্ষমতাধর করে। ১৮। হোক সুখের, হোক দুঃখের, যা কিছু আমার এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই, সেসবকে দূরে সরিয়ে রাখা কিংবা সেসবের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনাই জীবন। যে যতো অল্পে বাঁচতে জানে, সে ততো ঐশ্বর্যে বাঁচতে পারে।