অস্পষ্ট জার্নাল: ৮

 
পঞ্চাশ।

মানুষের ক্ষমতা যখন তার জ্ঞানের পরিধিকে ছাড়িয়ে যায়, ঠিক তখনই বিপর্যয়গুলো দেখা দেয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেও এটিই হয়ে আসছে। সে সময় মানুষ যখন ক্ষমতাশীল হতে লাগল, তখন তারা জানত না, তাদের এই বাড়তি শক্তিকে তারা কী কাজে ব্যবহার করবে। এতে করে নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে তাদের মধ্যে কিছু অহেতুক দম্ভ তৈরি হতে থাকে, যার ফলে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দুর্বল জাতির উপর সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে, বরং তাদের উপর রাজত্ব করতে থাকে এবং কখনও কখনও, সাহায্যের নামে তাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো চালাতে থাকে, তাদের উপর নানা অপকৌশলে বলপ্রয়োগ করতে থাকে। এই ক্ষমতার অহংকারে তারা সত্যের পথ থেকে দূরে সরে যায় এবং সত্যকে অস্বীকার করতে শুরু করে। নিজেদের চারপাশে দেয়াল তৈরি করতে থাকে এবং ইচ্ছেখুশি অনুযায়ী মুখোশের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। মানুষ কখন মুখ ফেলে মুখোশ নেয়? অনেক কারণেই নেয়। সেগুলির মধ্যে একটি হলো, যখন মানুষ তার নিজের সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণার অনুগামী হয়, নিজেকে এমনভাবে দেখাতে চায়, যেমনটা সে আসলে নয়। তখন মানুষ তার নিজের হৃদয় থেকে ক্রমেই অনেক দূরে সরে যায় এবং একটা কপটচক্রের আবর্তে ঘুরতেই থাকে।


সত্যের খোঁজ কেবলই বুদ্ধিগত কারণে হতে পারে না, একে অবশ্যই গভীরভাবে স্বজ্ঞামূলক হতে হয়। বুদ্ধির চেয়ে স্বজ্ঞার মূল্য অনেক বেশি। কেবলই কল্পনার রাজ্যে বিচরণ যার, সে কখনও সত্যের খোঁজ পায় না। একজন সত্যানুসন্ধানীকে অবশ্যই একই সাথে কৌতূহলী ও উৎসুক হতে হয়, একইসাথে বুঝেশুনে কিছু ঝুঁকি নিতে জানতেই হয়। সত্যের পথটা কখনও সরল এবং সোজা নয়। এতে প্রতিপদে বাধা আসতে পারে, পরাজয় গ্রাস করতে পারে, এমনকি মৃত্যুভয় থামিয়ে দিতে চাইতে পারে। সত্যের পথে হাঁটতে গেলে আমাদের মানসিকতা এমন হতে হবে, যেন যদি পথে মৃত্যুও আসে, তবুও আমরা পিছু ফিরে যাব না। এ মৃত্যু মূলত সমাজের কিংবা নিজের মধ্য থেকে সৃষ্ট নানান বিপত্তি ও সংশয়, যা আমাদের ওই মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে ফেলে পুরোপুরি অন্ধ করে দিতে চায়। আলোর পথে হাঁটতে চাইলে আমাদের আজীবন সত্যের খোঁজ করে যেতে হবে। কেননা আমাদের জন্মগত দৃষ্টি ক্ষীণ, এটি সব কিছু দেখতে পায় না। আমরা যতই খোঁজ করে যাই না কেন, অথবা আমরা যতই আলোকিত হই না কেন, জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও আমাদের অনেক কিছুই অদেখা থেকে যাবে। এটা নিয়ে বেঁচেথাকার সময় কিংবা সত্যকে জানার ও বোঝার সময় অতটা উদ্‌বিগ্ন হয়ে থাকাটা আবশ্যক নয়। এই পৃথিবীতে মানুষ মৃত্যুর আগে ঠিক ততটাই সত্য জেনে নিতে পারে, যতটা আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সামর্থ্য তার মধ্যে থাকে। সবার সব সামর্থ্য থাকে না, এটা মেনে নেওয়াটা জরুরি। অবশ্য, ক্রমাগত সাধনায় নিজের সামর্থ্যকে বাড়িয়ে নেওয়া যায় বহুগুণে!


সত্যকে জোর করে পাওয়া যায় না, কেবল নিরন্তর চেষ্টায় সত্য নিজে এসে আমাদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করে, কিন্তু তার প্রকাশিত হবার আগে আমরা আমাদের চারপাশে নিজেকে যেসকল ভণ্ডমুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছি, আমাদের ভাবনাবলয়ের পরিধির দিকে যে আবরণ তৈরি করেছি, আগে সেগুলো এক এক করে ঝেড়ে ফেলতে হবে। সত্য সামনে আসার অর্থ হচ্ছে, আমাদের হৃদয়ের অন্তস্তলে তার শক্ত অধিষ্ঠান হওয়া। সেটাকে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে জেনে নিতে হয়। আসলে আমাদের পক্ষে ঠিক যতটা জানা সম্ভব, অথবা যতটুকু সমন্বয় করা সম্ভব, তার সব কিছুই আমাদের ভেতরে রয়েছে। আমাদের এই সুপ্ত, ঘুমন্ত সত্তাটিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আর এই ঘুমন্ত সত্তাটিকে জাগিয়ে তুলতে চাইলে অনবরত সকল সংস্কার থেকে নিজেকে মুক্ত করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। সত্যের একাধিক রূপ রয়েছে এবং একে একাধিক মাত্রায় সংজ্ঞায়িত করা যায়। এক-একটা মানুষের জীবনের সত্য এক-এক রকমের। যে সত্য তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে---পৃথিবীর অন্য কোনও জীবের কণামাত্রও ক্ষতিসাধন না করেই, সে সত্যকে মিথ্যা বা অমূলক বলে নিজের মতামত দেওয়ার নামই মূর্খতা। নিজের সত্যই একমাত্র শ্রেষ্ঠ সত্য, বাকি সবই খেলো, এমন মানসিকতা মূর্খতারই নামান্তর। এমন মূর্খতা পৃথিবীতে যত বাড়বে, পৃথিবী ততই সংঘাতের দিকে চলে যাবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আমিই ঠিক, বাকিরা ভুল,---এই অহমিকাপূর্ণ বিশ্বাসই হলো অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতার প্রথমসোপান।


একজন প্রকৃত আলোকিত মানুষ একই সাথে একজন শিক্ষক এবং ছাত্র। একজন আলোকিত শিক্ষক প্রত্যেকের কাছ থেকেই শিক্ষা লাভ করে থাকেন এবং তাঁর জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত শিক্ষালাভ করতে থাকেন। পৃথিবীটা পূর্ব এবং পশ্চিম, এই দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের দ্বারা পরিচালিত। পৃথিবীর অর্থই হলো পৃথিবীর মানুষ। আমাদের ডানমস্তিষ্ক এবং বামমস্তিষ্কের মতোই এ পৃথিবীর চিন্তাচেতনা, কাজ করার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের ডানমস্তিষ্কের মতোই পশ্চিমগোলার্ধের মানুষ সব বিষয়ই বিজ্ঞানসম্মত, আক্রমণাত্নক ও যৌক্তিকভাবে গ্রহণ কিংবা বর্জন করে। আমাদের বামমস্তিষ্কের মতো পূর্বগোলার্ধের মানুষ কোমল, নরম, গভীর চিন্তাশক্তিসম্পন্ন, রহস্যপূর্ণ। ডানমস্তিষ্ক বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রকৃতিকে জয় করতে চায় এবং এর জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কাজ চালিয়ে যায়, কিন্তু আমাদের বামমস্তিষ্ক নিজেকে প্রকৃতির কাছে সমর্পিত করে এবং নিরন্তর চেষ্টার মাধ্যমে প্রকৃতির সাথে আত্মার সংযোগ ঘটাবার চেষ্টা করে। এজন্য আমাদের ডানমস্তিষ্কের সাথে আমাদের বামমস্তিষ্কের একধরনের চিরন্তন দ্বন্দ্ব সব সময় লেগেই থাকে। আমাদের ডানমস্তিষ্ক কেবল বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সব কিছুর উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে, কিন্তু আমাদের বামমস্তিষ্ক নিজের বুদ্ধিমত্তা, আবেগ, প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ক্রমাগত প্রশ্নকরার মাধ্যমে সমাধানে উপনীত হয়। আর প্রজ্ঞা ব্যতীত বৈজ্ঞানিক উন্নতি বরাবরই ধ্বংসাত্নক। এটি একটি শিশুর হাতে তরবারি ধরিয়ে দেবার মতো।


একান্ন।
বলা হয়ে থাকে, প্রত্যেক পঁচিশ শতাব্দী পর পর বিশ্ব একটি মারাত্নক বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে যায়। মানুষ নিজেকে অর্থহীন মনে করে, জীবনের অর্থ তার কাছে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে পড়ে। মানুষ তখন জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে পথভ্রষ্টের মতো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। একটা গভীর আঁধার মানুষকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতে থাকে। জীবনের সব কিছু যান্ত্রিক, ব্যর্থ এবং অর্থহীন মনে হতে থাকে। ঠিক এই সময় মানুষকে সত্যের কাছে ধরা দিতে হয়। জীবনের প্রকৃত সত্যের খোঁজ করতে হয়, আলোর খোঁজ করতে হয়। যখন কৃত্রিমতা মানুষকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে, তখনই প্রকৃত সময় আলোর পথে যাত্রার। তখনই মানুষ পুরোপুরি প্রস্তুত সত্যকে জানার জন্য। এ সময় একজন শিক্ষকের প্রয়োজন হয়, যিনি এই বিশৃঙ্খল মুহূর্তে মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যান। একজন নতুন মানুষের, একটি নতুন মানবতার জন্ম দেওয়ার চাইতে আনন্দের আর কী হতে পারে? একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাজ হচ্ছে, ছাত্রের মনে ক্রমাগত তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেওয়া এবং সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য তাকে প্রস্তুত করে তোলা। কেউ একবার পুরোপুরি আলোকিত হয়ে গেলে তখন আর তার কোনও শিক্ষকের প্রয়োজন পড়ে না। তার ভেতরের সব প্রশ্নের তখন সমাপ্তি ঘটে। নতুন কোনও প্রশ্ন মনে এলে, তার উত্তরটা কোথায় খুঁজলে পাওয়া যায় কিংবা উত্তর পাওয়ার জন্য নিজেকে কোন পথে নিয়ে যেতে হয় ধৈর্যের সাথে, তা সে নিজেই বুঝতে পারে।


একটি সম্পূর্ণ নতুন মানসিকতার মানুষ তৈরি করা সহজ কোনও কাজ নয়। এই কাজটি করতে গিয়ে একজন শিক্ষক যখন ভবিষ্যৎ ফল সম্পর্কে আগে থেকেই জানেন কিংবা অনুমান করতে পারেন, তখন তিনি যে কোনও কষ্ট বা উপেক্ষা মেনে নেন। বর্তমানের এই যন্ত্রণা সামনের দিনগুলির নির্মাতা, এটা তাঁর মাথায় খেলতে থাকে। ঠিক যেমনি একজন মা দশ মাস দশ দিন তাঁর পেটে সন্তানধারণ করেন সকল প্রকার কষ্ট সহ্য করেও, কেননা তিনি জানেন, এই সময়ের পর তিনি যখন তাঁর সন্তানের মুখ দেখবেন, একটি নতুন সৃষ্টির মুখ দেখবেন, তখন তাঁর সব কষ্টই সুখে পরিণত হবে। এমনকি মা এ-ও জানেন, এর মাধ্যমে তাঁর জীবনে মৃত্যুর আশঙ্কাও এসে উপস্থিত হতে পারে, তিনি মারা যেতে পারেন, তা সত্ত্বেও তিনি রাজি থাকেন সবকিছু মেনে নিতে। এই প্রক্রিয়ায় এক অনির্বচনীয় আনন্দ আছে। একইভাবে, যখন কেউ সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে, তখন তার মন আনন্দে নাচতে থাকে। এটা অনেক জরুরি, কেননা সৃষ্টির প্রধান উৎস হচ্ছে দুঃখ এবং সৃষ্টির বিকাশের প্রধান শর্ত হচ্ছে আনন্দ। যার মনে দুঃখ নেই, সে কখনও সৃষ্টি করতে পারে না। আবার শুধু দুঃখ থাকলেই হবে না, দুঃখের দহন থেকে শিখতে জানতেও হবে। এ ক্ষেত্রে দুঃখের চাইতে বড়ো ঐশ্বর্য আর নেই। দুঃখ থেকে যে সৃষ্টিটা হয়, সেই সৃষ্টি যদি স্রষ্টাকে আনন্দ না দেয়, তবে সৃষ্টির সকল বিকাশ অবধারিতভাবেই থেমে যাবে। অর্থাৎ, যার মনে কোনও দুঃখ নেই এবং যে তার দুঃখকে কাজে লাগাতে পারে না, এই দুই ধরনের মানুষই গতানুগতিক মানুষ। প্রকৃতপক্ষে, সে-ই সবচেয়ে দুঃখী, যার কোনও দুঃখ নেই।


সত্যের অস্তিত্বের সমস্ত প্রকটতা মানুষের ভাবনা ও ইচ্ছাকে ব্যবহার করে নতুন নতুন সৃষ্টির দিকে তার মস্তিষ্ককে পরিচালিত করতে থাকে। তখন মানুষ তার মনোভূমিকে ক্রমাগত কর্ষণ করে করে সেটিকে উর্বর করতে থাকে, এবং সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে। সেখানে সীমাহীন কষ্ট এবং ধৈর্য থাকে, কিন্তু সেই সীমাহীন কষ্ট আর ধৈর্যের পর যে আনন্দ, যে সুখ আসে, তা যাপিত সমস্ত কষ্টের চাইতে অনেক অনেক গভীর। সে আনন্দের কোনও বিবৃতি হয় না। আমরা যদি আমাদের ডান এবং বাম, উভয় মস্তিষ্ককে সমন্বয় করে চলতে পারি, তবে আমরা একটি সম্পূর্ণ নতুন ভবিষ্যতের মুখ দেখব, যা আমরা আগে কখনও দেখিনি। ব্যক্তিমানুষ নিজেকে বদলে ফেললে, তার পরিবার ও সমাজ বদলাবে, ফলে একসময় পুরো পৃথিবীই বদলাবে। তার পরিবর্তনের প্রথমধাপই হলো, নিজেকে বদলে ফেলা। এভাবে করে মানুষ চাইলে এই পৃথিবীটাকে স্বর্গের রূপ দিতে পারে, কিন্তু সেজন্য চাই যথাযথ প্রস্তুতি, শুদ্ধি এবং পরিপূর্ণতা। প্রস্তুতির অর্থ হচ্ছে, খোলামনে সব কিছুকে গ্রহণ করতে পারা। নিজের সমস্ত অতীত বিশ্বাস ও বদ্ধসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে নিজেকে কোনও কিছুর জন্য প্রস্তুত করা অসম্ভব। নিছকই কৌতূহলী না হয়ে ক্রমান্বয়ে জানার মাধ্যমে নিজের ভেতরে আরও অধিক জানার তৃষ্ণা সৃষ্টি করে যাওয়াই জীবনের উদ্দেশ্য।


কেবল বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে সত্যের অন্বেষণ করলে অথবা গুপ্তচরের বেশে মিথ্যার আড়ালে-থাকা সত্যটার খোঁজ করে গেলেই আমরা প্রকৃত সত্যের সন্ধান না-ও পেতে পারি, তা পেতে চাইলে আমাদের প্রথমত, কী ঘটছে কী ঘটছে না, সেই বিস্তৃতিতে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং নিজেদের সাথেই এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যে, আজ থেকে আমি সমস্ত ঔচিত্য ও অনৌচিত্যের শেকল থেকে নিজেকে মুক্ত করে দিলাম। উচিত বা অনুচিত নয়, বরং ঘটমান ও অঘটমান, এই দুইয়ের মধ্যেই আমি সত্যকে খুঁজব। মাথায় রাখতে হবে, পৃথিবীতে উচিত অনুচিত বলে কিছু নেই, যা আছে তা হলো---কী ঘটে, কী ঘটে না। ব্যস্‌! দুই ধরনের সত্য আছে। একটি মাথায় থাকে, আর-একটি থাকে মাথার বাইরে। আমাদের মাথার বাইরের সত্য, যা দ্বারা জগত নিয়ন্ত্রিত, তা নিয়েই বাঁচতে শিখতে হবে। এই শেখার প্রস্তুতির মাধ্যমেই কেবল আমাদের ভেতর জানার তীব্রতাটা বৃদ্ধি পায়।


এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষক আমাদের ভেতর সেই তৃষ্ণাবৃদ্ধির কাজটি করে যান। তিনি আমাদের জানার এই আকাঙ্ক্ষাকে এতটাই বাড়িয়ে তোলেন যে এরপর আমাদের জানার পরিধি যতই সংকীর্ণ থাকুক না কেন, সেটা ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। জানার জন্যে ভেতরে এক অগ্নিশিখা সব সময় জ্বলতেই থাকে। এই আগ্রহ আমাদের সবার মাঝেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কেবল একজন ভালো শিক্ষকই পারেন এই সুপ্ত অগ্নিশিখাকে জাগিয়ে তুলতে। আমরা যখন জানার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে প্রস্তুত হই, কেবল তখনই আমাদের জীবনে সেই শিক্ষকের আবির্ভাব ঘটে। সেই শিক্ষক আমাদের ভেতর তাঁর সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়ে আমাদের সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার কাজ করে যান। জীবনে বড়ো হওয়ার সবচাইতে সহজ উপায় হলো, কাউকে এমন একজন গুরু বা শিক্ষকের স্থানে বসিয়ে দেওয়া। তাঁর উপদেশ, নির্দেশনা, অনুসৃত মত ও পথ নিজের মধ্যে ধারণ করে, সে অনুযায়ী জীবনকে গঠন করা। তিনি কী বললেন তা বোঝার চাইতে জরুরি, তিনি কী বললেন না, কিন্তু বোঝাতে চাইলেন।


বায়ান্ন।
আমরা যখনই জানার উদ্দেশ্যে আরও ক্ষুধার্থ, ব্যতিব্যস্ত, ব্যগ্র হয়ে পড়ি, আর আমাদের ভেতরে অসন্তুষ্টির পরিমাণ বাড়তেই থাকে, তখনই কেবল আমরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত হয়ে যাই। অন্য আর কোনও লক্ষ্য আর কোনও উদ্দেশ্য আমাদের ভেতর কাজ করে না, কেবল জানার ইচ্ছা ব্যতীত। তখন রাতদিন কেবল সত্যের খোঁজ করতে থাকি, কেবল আমাদের স্রষ্টার খোঁজ করতে থাকি। প্রস্তুতির অর্থই হচ্ছে, সত্যের অনুগামী হওয়া। এটি আমাদের উপলদ্ধি করতে সাহায্য করে যে আমরা কতটা অন্ধভাবে বেঁচে আছি, এবং আমাদের সময়গুলোকে কেবল নষ্ট করেই চলেছি। এটি আমাদের উপলব্ধি করতে সাহায্য করে যে এটা বেঁচে থাকার সঠিক পথটি নয়। যদি আমরা পরমাত্মার পেছনে না ছুটি, তবে আমাদের জীবনটা শূন্যই থেকে যাবে, অব্যবহৃত আর অক্ষমই থেকে যাবে। আর একজন সত্যানুসন্ধানীকে অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, রাজনীতি সব কিছুকে ত্যাগ করে কেবলই সেই পরম এক সত্যের পেছনে ছুটতে হয়। এ এমন এক সত্য, যা আমাদের বুঝতে শেখায়, আমরা কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি এবং আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য কী। এভাবে ক্রমান্বয়ে প্রস্তুতির মাধ্যমেই আমরা সত্যের প্রথম স্তর পার করি।


এরপরই আসে শুদ্ধি। যখন আমাদের মধ্যে সত্যকে জানার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়, তখন আমাদের শুদ্ধির প্রয়োজন, কেননা পরমসত্যর কাছে পৌঁছুতে হলে আমরা আমাদের সাথে এতদিন যেসকল অপ্রয়োজনীয় বোঝা বয়ে নিয়ে বেরিয়েছি, সেগুলো সব ঝেড়ে ফেলতে হবে একমুহূর্তেই। যে বোঝাগুলোকে আমরা এতদিন মূল্যবান ভেবে এসেছি, যেসকল বিষাক্ত জিনিসে আমরা এতদিন মগ্ন ছিলাম, যে বিষ আমরা এতকাল পান করে এসেছি, এবং এই সবকিছুই ঘটে চলেছে যেসব পদ্ধতিতে, সেই পদ্ধতিগুলোকে শুদ্ধ করতে হবে। ধর্মের নামে যুগ যুগ ধরে আমরা যা অনুসরণ করে এসেছি, নিজেদের বিভক্ত করে এসেছি, তার সবগুলোই এক-একটা বিষ, এক-একটা কুসংস্কার। শুদ্ধির অর্থ হলো, সকল শর্ত, কুসংস্কার, দর্শন, সংজ্ঞা, আরোপিত-আদর্শকে ঝেড়ে ফেলা, যা এতদিন আমাদের অন্যের দ্বারা ভাবিত-চিন্তিত এবং প্রভাবিত করেছে। নিজেকে চূড়ান্তভাবে পরিষ্কার করার নামই শুদ্ধি। এটি তখনই আসবে, যখন কোনও চিন্তাধারা অথবা অন্য কোনও কিছুই আমাদের ভেতরে অবশিষ্ট থাকবে না; যখন আমদের হৃদয় পরিপূর্ণভাবে শূন্যতায় পর্যবসিত হবে, কেবল অস্তিত্বই আমাদের ভেতরে তার নিজস্ব সত্যকে উন্মোচিত করতে থাকবে; যখন আমরা চূড়ান্তরূপে নিশ্চুপ হয়ে যাব এবং আমাদের পারিপার্শ্বিক সমাজের দেওয়া সকল নীতি, দর্শন, চিন্তাধারা সম্পূর্ণভাবে আমাদের ভেতর থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। নতুনকে জায়গা দিতে নিজের পুরাতনকে সরিয়ে দিতেই হবে।


হ্যাঁ, কেবল তখনই আমাদের অস্তিত্ব আমাদের সাথে সহজ ও সরল রাস্তায় কথা বলবে। তখনই পরমসত্য নিজেই নিজের গুপ্তরহস্যের কথা আমাদের কানে মৃদুস্বরে বলতে থাকবে, যখন আমরা সম্পূর্ণভাবে শূন্যতাকে গ্রহণ করব, কেননা শূন্যতাই হচ্ছে আদিম-বিশুদ্ধতা। সত্যর পথে এমন শুদ্ধতা বিশোধকের মতোই কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে সত্য আমাদের থেকে খুব বেশি দূরে নয়। একে পেতে চাইলে কেবল আমাদের নিজেদের চারপাশের আবরণকে ভেঙে ফেলতে হবে। আমরা যদি আমাদের চারপাশটা অনেকগুলো দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখি, আমরা যদি একাধিক ব্যক্তিত্বের লেবাস পরে থাকি, অন্যের এবং নিজের সাথে প্রতারণা করে নিজেকে মুখোশের আড়ালে ঢেকে রাখি, যা আসলে আমরা নই তা-ই দেখাই, তাহলে আমরা কখনওই আমাদের প্রকৃতরূপ খুঁজে পাব না। আমাদের দেয়াল আমাদের কাছে নতুন কিছুকে আসতে দেবে না। আমাদের সব মুখোশ আমাদের নিজেদেরকেই একে একে ঝেড়ে ফেলতে হবে। আমরা ভেতর থেকে কতটা খাঁটি অথবা কতটা নোংরা, এ বিষয়ে সৎ হতে হবে, নিজের মনের আয়নার সামনে সততা নিয়ে দাঁড়াতে জানতে হবে। শুদ্ধতার অর্থই হচ্ছে, সকল প্রকার ভণ্ডামি, মিথ্যাচারিতা, অপ্রকৃত জিনিস বা ধারণাকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে চলার স্বভাব বাদ দেওয়া অথবা ঝেড়ে ফেলা। এই শুদ্ধতাই সত্যের পথে দ্বিতীয় স্তর।


এরপরই আসে সত্যের পথে তৃতীয় স্তরটি---পরিপূর্ণতা। যখন আমরা অপ্রকৃত, ভণ্ড হওয়ার আরামাদায়ক পথটি পরিত্যাগ করে আমাদের ভেতরের সকল বোঝা, সকল ময়লা ঝেড়ে ফেলে দেবো, তখন পরিপূর্ণতা নিজ নিয়মে আমাদের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে থাকবে। আমাদের আয়নায় এতদিন যে ময়লার স্তূপ জমে ছিল, সেগুলো ঝেড়ে ফেলতেই পরিপূর্ণতা আমাদের সামনে এসে দেখা দেবে। কিন্তু সত্যের পথে পরিশোধনের প্রক্রিয়ায় হাঁটার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রয়োজন, কেননা মৃদুআকাঙ্ক্ষায়, সত্যের পথে হাঁটতে যে প্রচণ্ড মানসিক শক্তির প্রয়োজন, তা তৈরি হতে পারে না। ভেতর থেকে পরিশোধিত হওয়াটা ক্ষতের পুঁজ বের করে আনার মত। যদি আমরা আমাদের ক্ষতের পুঁজটুকু সময়মতো বের করে আনতে সক্ষম না হই, তবে এই পুঁজ আমাদের ভেতরে থেকে ধীরে ধীরে পুরোটাই শেষ করে দেবে। এটিকে বের করতে যে কষ্ট, সে-ই সাময়িক কষ্টটুকু সহ্য করতে পারলেই আমরা জলদি সুস্থ হয়ে উঠব। একে শরীরের মধ্যে দাবিয়ে রাখার অর্থই হচ্ছে, একে ভেতরে ভেতরে বৃদ্ধি পেতে দেওয়া। এক পর্যায়ে এসে এটি সারাশরীরে ছড়িয়ে পড়বে। একবার যদি আমরা পরিশোধনের পথে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে পারি, এতটাই যে, যদি প্রয়োজন পড়ে, তবে আমরা এর জন্য মরতেও রাজি, তবে সত্য ধীরে ধীরে হৃদয়ে বাসা বাঁধতে থাকে।


মৃত্যুর অর্থই হচ্ছে, পুরনো আমি’র মৃত্যু। কেননা কেবল পুরনো আমি’র মৃত্যুতেই নতুন আমি’র সৃষ্টি সম্ভব। আমরা এতদিন নিজেকে যা ভেবে এসেছি, সেই আমি’র স্বেচ্ছামৃত্যু ঘটতে দিতে হবে। এতদিন আমরা আমাদের যে ইগোকে আঁকড়ে ছিলাম, সেটিকে এখন ছেড়ে দিতে হবে। নিজেকে নিজেদের সেই সব নবসৃষ্ট অভিযোগের আত্নসমর্পণ করতে দিতে হবে এবং যা-কিছু নিজেদের কাছে মূল্যবান মনে হয়েছিল এতকাল, সেগুলোকে আবর্জনা ভেবে ঝেড়ে ফেলতে হবে। এটি ঠিক নিজের রাজ্য হারিয়ে ভিখিরি হয়ে যাবার মত। রাজা হবার প্রথম ধাপই হচ্ছে, ভিখিরি হয়ে যাওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হবে, ততক্ষণ এটি করতে আমরা প্রস্তুত হতে পারব না। এই প্রচেষ্টায় আমাদের নিখুঁত হবার চেষ্টা করবার প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেদের পরিশোধনের মাধ্যমে একে জায়গা করে দিলে এটি আপনাআপনি নিজেকে নিখুঁত করে নেবে, পরিপূর্ণ হবে।


তিপান্ন।
সত্য একটাই, কিন্তু যুগে যুগে বিভিন্ন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি একে বিভিন্ন উপায়ে বর্ণনা করেছেন। একটি দার্শনিক মন কখনও অন্ধবিশ্বাসী অথবা উদ্ধত মানসিকতাসম্পন্ন হতে পারে না। দর্শনের পূর্বশর্তই হচ্ছে, খোলামেলা মন নিয়ে সব কিছু গ্রহণ করা। একজন দার্শনিক কোনও প্রশ্ন না করেই, তদন্ত অথবা অনুসন্ধান না করেই সব কিছু আগেভাগে মেনে নেন না। তিনি সন্দেহপ্রবণ, এমনকি সত্য যেখান থেকেই আসুক না কেন, তিনি তা খোলামনে গ্রহণ করে থাকেন। অজানাকে মেনে নিয়ে অস্তিত্বের খোঁজ করা যায় না। গোষ্ঠী বিচারে কেবল আমরাই স্রষ্টার মনোনীত মানুষ বা প্রতিনিধি, এমন ধারণা ধর্মান্ধতার সৃষ্টি করে। কোনও কিছুকে অন্ধভাবে বিশ্বাস-করা একপ্রকার স্বেচ্ছায় প্রতারিত হবার মতো। ঠিক যেমন আমরা কোনও কিছু না জেনে অথবা কোনও বিষয় অভিজ্ঞতা ছাড়াই মেনে নিই, ওরকমই। কেবল আমরাই সত্যটা জানি অথবা কেবল আমরা যা বলি, সেটাই সত্য---উভয়ই চরম ধ্বংসাত্নক। যখন আমরা বলি, কেবল ‘আমাদের স্রষ্টা’ই সত্যশাশ্বত, আমাদের অনুসৃত পথই সেরা ও সঠিক, বাকি সকলে ভণ্ড এবং ওরা কেবলই মিথ্যাচার করছে, তখন ব্যাপারটি আমাদের সত্যের কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নেয়, কেননা আমরা যদি বলি, এক আমাদের স্রষ্টাই সত্য, তবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্রষ্টার কী হবে? আমাদের যতটা যুক্তি আছে নিজেরদের পথে থেকে যাওয়ার, ওদেরও ঠিক ততটাই যুক্তি আছে ওদের পথ থেকে না সরার। এটা বোঝার নামই মানসিক ও আত্মিক পরিপক্বতা।


যখনই আমরা নিজেদেরকে ও নিজেদের পথটাই শ্রেষ্ঠ ভাবি, তখন আমরা আসলে ভুক্তভোগী হিসেবে নিজেদের তুলে ধরি, কেননা তখন আমাদের হয় প্ররোচক হতে হয়, নয়তো অন্যের ভুল মত ও পথ দ্বারা রূপান্তরিত হতে হয়। যদি আমরা এমন একটা স্বেচ্ছাপ্রতারণা মেনে নিই, তবে সব ঠিক থাকে; যদি আমরা স্বেচ্ছায় অন্যের দ্বারা চালিত হতে না চাই, তবে আমাদের অন্যের ধারণা মানতে বাধ্য করা হয়; নতুবা আমরা মানতে রাজি না হলে আমাদের নিগৃহীত করা হয়, যাতে করে আমরা আমাদের ওদের দাবিকৃত আমাদের ‘ভুল স্রষ্টা’কে ঝেড়ে ফেলি---এই ধরনের একটা পরিস্থিতি গোটা একটা সমাজকে, গোটা একটা জাতিকে ধ্বংস করে ফেলতে যথেষ্ট। আমরা যে-কোনও রাস্তায়ই সত্যের কাছে পৌঁছুতে পারি। পাহাড়ে ওঠার জন্য অনেক রাস্তা থাকে, কিন্তু আমরা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব কি পশ্চিম অথবা দুর্গম কি সরল, যে রাস্তা ধরেই যাই না কেন, তার সব রাস্তাই পাহাড়ের শীর্ষে যায়। এক্ষেত্রে পৌঁছানোই মূলকথা, পৌঁছানোর রাস্তা নয়। যে রাস্তায় পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানো যায়, সে রাস্তা কোনওমতেই ভুল রাস্তা হতে পারে না। হয়তো সেটা আমার রাস্তার সাথে না-ও মিলতে পারে, কিন্তু তা-ই বলে রাস্তাটি ভুল কিছুতেই নয়।


হয়ত প্রার্থনার জন্যে কেউ মসজিদে যায়, তো কেউ মন্দিরে। নয়তো কেউ যায় গির্জায়, প্যাগোডায় অথবা অন্য যে-কোনও প্রার্থনালয়ে, কিন্তু সব প্রার্থনা সেই একই স্রষ্টার কাছেই গিয়ে পৌঁছায়। মানুষ চাইলেই যে কোনও প্রার্থনালয়ে গিয়ে তার স্রষ্টাকে ডাকতে পারে। স্রষ্টা সব জায়গা থেকেই শুনতে পান। কেবল অন্যের ভক্তি, অন্যের প্রার্থনাকে শ্রদ্ধা করতে জানতে হয়। সকল প্রার্থনাকে পবিত্রভাবে গ্রহণ করতে হয়। এটা করতে না পারলে শুদ্ধপথে প্রার্থনা করা যায় না। আমরা যা বিশ্বাস করি, সেভাবেই, সেই বিশ্বাসে বাঁচার পথই সত্যের পথ। যে বিশ্বাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনও কাজে আসে না, সে বিশ্বাস মূল্যহীন। সে হিসেবে বাঁচার পথ, সত্যের পথ…এক নয়, একাধিক। যদি আমাদের কোনও কিছুকে সত্য বলে মনে হয়, যা পৃথিবীর কারও কোনও ক্ষতি করে না, কারও বাঁচার পথে বাধার সৃষ্টি করে না, সেই সত্যে জীবনযাপন করার নামই বিশ্বাস। আমাদের বিশ্বাস আমাদের জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই প্রস্ফুটিত হয়। তাই বলে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা বিশ্বাসকে জোর করে নিজেদের উপর চাপিয়ে দেব। এটা একপ্রকার কপটতা, একপ্রকার আত্নপ্রতারণা।


চুয়ান্ন।
যে বিশ্বাস হৃদয় থেকে আসে না, সে বিশ্বাস অর্থহীন। সত্যকে জেনেই সত্যের উপর আস্থা রাখতে হয়। ধরা যাক, যদি আমরা কাউকে ধ্যানের উপকারিতা জানিয়ে তাকে ধ্যান করতে বলি এবং সে যদি ধ্যানের কোনওরূপ চেষ্টা না করেই এর বিরূদ্ধে মন্তব্য করতে থাকে, তবে এটি তার বিশ্বাস নয়, বরং একটি ভ্রান্তধারণা, একগুঁয়েমি বা মুর্খামি। অভিজ্ঞতা ছাড়া যে-কোনও ধারণাকে গ্রহণ বা বর্জন করার নামই ভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া। যদি ধ্যানের নিয়ম না মেনে কেবল শিরদাঁড়া সোজা করে ধ্যান করতে বসে যাই, তবে এটি আমাদের কিছুই দেবে না। সত্যিই ধ্যানকরা আর ধ্যানের অভিনয় করার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। ধ্যান অর্থ নিজের হৃদয়ের সাথে আলাপ করা, নিজের মুখোশকে নয় বরং মুখকে চোখের সামনে নিয়ে এসে বাঁচা। হৃদয় বাজারে বিকিয়ে দেবার মতো কিছু নয়, আর এই ধ্যান মূলত হৃদয়ের কাজই করে। ধ্যান হচ্ছে নিজের ভেতরের মানুষটার সাথে আলাপ করা, সে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা।


সত্যের অন্বেষণ করতে গেলে অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে সেই খোঁজার কাজটি করে যেতে হয়। কেননা অন্যদের জানিয়ে জানিয়ে সত্যের খোঁজে বের হলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। এবং যে-কোনও বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলে সত্যান্বেষনের পথে সেটি একপ্রকার বাধা হয়ে দাঁড়ায়, মনোসংযোগ নষ্ট করে দেয়। এটি তখন অযথাই আমাদের শক্তির অপচয় করে। সত্য কেবল তাদের সাথেই আলোচনার যোগ্য, যারা এ বিষয়ে ধারণা রাখে এবং যাদের এ বিষয়ে বোধশক্তি রয়েছে কিংবা এ বিষয়টাকে বোঝার মতো মানসিক গঠন যাদের আছে। যাদের কাছে একমাত্র নিজের সত্য বাদে বাকি সবই মিথ্যা, তাদের সাথে সত্য নিয়ে আলোচনার মানেই নিজেকে বিপন্ন করে তোলা। সত্যকে নিজের মাঝে বীজের ন্যায় ছড়িয়ে দিতে হয়। সত্যের বীজ আমরা যদি নিজের ভেতরে না ছড়িয়ে আমাদের চারপাশে ছড়াতে থাকি, তবে এটি কখনওই বেড়ে উঠবে না। এটিকে নিজের মধ্যেই ক্রমান্বয়ে ছিটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই এটি একদিন গাছে পরিণত হবে। আমরা সত্যের বীজ আগে নিজের হৃদয়ে বপন না করে অন্যের হৃদয়ে বপন করার চেষ্টা করে যাই, ফলে সত্যের দেখা পাওয়া আর হয়ে ওঠে না।


আমাদের মধ্যে সত্যের যে শক্তিই উদিত হোক না কেন, এটিকে আমাদের হৃদয়ের মাঝে যত্ন করে রাখতে দিতে হবে, যেন গাছে পরিণত হতে পারে ও আমাদের ভেতরে সেটি যেন বেড়ে উঠতে সক্ষম হয়। তারপর একদিন এমন এক সময় আসে, যেদিন আমরা আর এটিকে আমাদের ভেতরে আটকে রাখতে পারি না। ঠিক সেই দিনই উপযুক্ত সময় এটি সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেবার, এর আগে কিছুতেই নয়। নিজে আগে সত্যকে ধারণ করতে হবে পরিপূর্ণভাবে, এরপর তা অন্যদের বিতরণের প্রশ্ন আসে। ঠিক যেমনি একজন মা তার সন্তানকে দশ মাস দশ দিন পেটে ধারণ করে, সত্যকে ঠিক তেমনি হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। মায়ের গর্ভের সন্তান যখন পরিপূর্ণ মানবশিশুতে পরিণত হয়, সেদিনই এটি বেরিয়ে আসার সঠিক সময়, সত্যের বেলায়ও তা-ই। ওই নির্দিষ্ট সময়ের আগে সন্তানকে সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায় না, একইভাবে সত্যের বেলায়ও নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হবার আগে সত্যকে তার নিজস্ব রূপে পাওয়া যায় না। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, অপরিপক্ব হাতে সত্য সব সময়ই বিকৃত রূপে প্রচারিত হয়।


সত্যান্বেষণের পথে যখনই আমরা সত্যের কিছুটা ঝলক দেখতে পাই, তখনই আমাদের মস্তিষ্ক এটিকে সাথে সাথে চারপাশে জানিয়ে দেবার জন্য আমাদের উদ্‌বুদ্ধ করতে থাকে, এবং বলতে থাকে, যেন আমরা এটি অন্যদের জানিয়ে দিই। কিন্তু আমরা যদি সেই মূহূর্তে সেটিকে জনসম্মুখে উন্মোচিত করি, তবে আমরা আর পরিপূর্ণ সত্যের দেখা পাব না, বাকিরাও তা দেখতে পারবে না। আমরা এটিকে মুহূর্তেই হারিয়ে ফেলব। সত্যকে পরিপূর্ণ উপায়ে পাওয়ার আগেই তা উন্মোচিত করতে নেই, ওতে সত্য সরে গিয়ে মিথ্যার আগমন ঘটে। সত্যান্বেষণের পথে আবার এমন অজস্র মুহূর্ত আসে, অনেক রাত অনেক দিন অপেক্ষার পরও যখন সত্য আমাদের কাছে ধরা দেয় না, তখন আমাদের মনে হয়, এই সত্যান্বেষণ ছেড়ে দেই। তখন আমাদের ভেতরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে, যখন আমরা হাল ছেড়ে দিই এবং সেই পেছনের একজন সাধারণ মানুষে ফিরে যাবার চিন্তা করি। এটি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন মুহূর্ত। সেই মুহূর্তে ধৈর্যের সাথে থাকতে হয়, সেই সকল মহান ব্যক্তিত্বের কথা স্মরণ করতে হয়, যাঁরা নিজেরা সত্যের পথে হেঁটেছেন এবং অন্যদের পথ দেখিয়েছেন।


পঞ্চান্ন।
অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, খ্যাতি এগুলো কোনওটাই গুরুত্ব বহন করে না, যদি সেখানে সত্যের উন্মেষ না থাকে। কেবল সত্যই চিরন্তন। সত্যের পথ, অস্তিত্বের পথই স্রষ্টার পথ, সৃষ্টির পথ। কিন্তু যে এই পথে হাঁটে, সে সম্পূর্ণই একা। কেবল যারা এ পথে বহু শতাব্দী ধরে হেঁটে এসেছে, তারাই এ পথের পথিকদের প্রকৃত বন্ধু। যখনই হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসে, তখন সকল প্রজ্ঞাবান মহৎব্যক্তির কথা স্মরণ করলেই এগোনো যায়। এই পৃথিবীর ইতিহাস বলে, সমস্ত মহামানবকে একসাথে ভাবলে প্রত্যেকেরই কিছু বৈশিষ্ট্য অভিন্ন, যেগুলির একটি হলো, তাঁরা সকলেই সংস্কারমুক্ত মনে আলোর পথে হাঁটেন। আমরা যারা সে পথে হাঁটি বা হাঁটার নিয়তে বাঁচি, তারা মূলত ওই সকল আলোর মানুষকেই অনুসরণ করি। এ পথে আমাদের কোনও ভয় নেই, কোনও নিরাশা নেই, আমাদের কেবল ধৈর্য ধরে না থেমে এগিয়ে যেতে হবে। যখন কেউ সত্যে পৌঁছয়, তখন সে নিজের মাঝে স্রষ্টাকে ধারণ করে। নিজের হৃদয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সংযোগস্থাপনের অর্থই হলো, সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ করা, আলাপ হওয়া। আমরা যখন মহৎ ব্যক্তিদের জীবনদর্শনকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি, তখন আমাদের তাঁদের সাথেই থাকতে হবে, তাঁদের নিয়েই চলতে হবে। কেননা তাঁদের পথই আমাদের পথ, আমরা তাঁদেরই অনুরূপ। জন্মগতভাবে আমরা যে গোত্রেই জন্মলাভ করি না কেন, আমাদের প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছতে হলে তাঁদের গোত্রভুক্ত হয়ে তাঁদের পথেই হাঁটতে হবে। সমস্ত মহত্ত্বের গোত্র, বাসস্থান, প্রকৃতি একটাই।


জন্মস্থান কখনও কারও পরিচয় বহন করে না। আলোর পথ হাঁটতে শিখেছে যারা, তারা সবাইই আলোর পথিক, সকল সীমানা ও সীমান্ত নির্বিশেষে। পৃথিবীজুড়ে অনেক প্রজাতির ফুল রয়েছে, কিন্তু সব ফুলের সুবাস অথবা সৌন্দর্য আমাদের কাছে টানে না, কেবল আমরা যেটিকে ভালোবাসি, সেটিকেই আমরা গ্রহণ করি, কাছে টানি, সেটিই আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। যা-কিছু আমাদের হৃদয়কে দোলা দেয়, সেটিই আমাদের প্রকৃত আবাস। সেটিই আমাদের শক্তির উৎস। এই শক্তিই আমাদেরকে আমাদের সত্যের কাছে নিয়ে যায়। প্রতিটি ধর্মের মূলদর্শনই হলো, সেই সত্যের পথে চলা। আচার নয়, ধর্মের দর্শনের দিকে ঝুঁকতে হবে। যার ক্ষমতা যত অল্প, সে তত বেশি অন্ধভাবে ধর্মীয় আচারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পৃথিবীর সকল ধর্ম, সকল ধর্মগ্রন্থ এবং সকল ধর্মাবলম্বীদের সম্মান করার অর্থ হচ্ছে, মানবতাকে সম্মান করা। যে মানবতাকে সম্মান করে না, সে কখনও সত্যের দ্বারে পৌঁছুতে পারে না। যখন আমাদের মাঝে এ সকল শক্তি ও স্থৈর্য সৃষ্টি হয়, তখনই সত্যের পথে শুদ্ধিলাভ করা যায়। আত্মার এ ধরনের শুদ্ধি আমাদেরকে আমাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শুদ্ধির জন্যে নিজের চারপাশে সেই পরিবেশ তৈরি করে নিতে হয়। কেবল তখনই শুদ্ধির জন্য যা যা আবশ্যক, তা তা করা যায়।


শুদ্ধির পথে প্রথমে একজন ভালো সন্তান, ভালো সঙ্গী, ভালো একজন ভাই কিংবা বোন এবং ভালো একজন বাবা কিংবা মা হওয়া প্রয়োজন। ভালো সন্তান হবার অর্থ এই নয় যে, অন্ধ আনুগত্য দেখিয়ে নিজের ইচ্ছার বিরূদ্ধে গিয়ে হলেও বাবা-মায়ের সকল মতামতকে মেনে নিতে হবে, বরং এর অর্থ এই যে, আমরা বাবা-মায়ের সব ইচ্ছের কথাই গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনব, এবং এরপর আমরা যা পছন্দ করি মেনে নিতে, তা মেনে নেব, যদি তাঁদের কোনও কিছু মেনে নিতে অসুবিধা হয়, সেটি তাঁদের নরম সুরে বুঝিয়ে বলব। আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে একমত না-ও হতে পারি, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমি তাঁদের কথা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে চলতে বাধ্য থাকব। কেননা এই ধরনের ক্রম-বাধ্যতা আমাকে অপ্রকৃতস্থ করে দেবে। তখন আমি নিজের সাথে এবং আমার চারপাশের মানুষের সাথে প্রতারণা করব। এটি মানুষকে ভেঙে নকল মানুষে পরিণত করে। একজন ভালো সন্তান সে-ই, যে সচেতন, সদ্‌বুদ্ধিসম্পন্ন, শ্রদ্ধাশীল, যে তার বাবা-মায়ের কথা গভীরভাবে উপলব্ধি করে, কেননা তাঁরা ইতোমধ্যেই জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ। একজন ভালো সন্তান সব সময় শোনে, বোঝে এবং তা থেকে শিক্ষা লাভ করে। সে তাড়াহুড়োয় কোনও সিদ্ধান্ত নেয় না।


বাবা এবং সন্তানের মধ্যে একটি ভালো যোগাযোগস্থাপন হওয়া প্রয়োজন, কেননা বাবা অতীতের প্রতিচ্ছবি এবং সন্তান ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। এটি অনেকটা একটা সেতুর মতো কাজ করে। এটি এমন নয় যে কেবল সন্তানকেই ভালো সন্তান হতে হবে। কেননা একতরফা কখনও কোনও কিছু টিকে থাকে না। বাবা এবং সন্তান উভয়কেই একে অপরের কাছে ভালো হতে হবে। বাবারা অতীতের সকল বাবার প্রতীক হিসেবে কাজ করেন। সুতরাং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সন্তানের কর্তব্য। আবার কিছু সন্তান এমন হয়, যারা ওদের বাবার অবাধ্য হয়, কারণ ওদের বাবা ওদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। সঠিক পথে হাঁটতে অনেকেই চায় না। সে পথে হাঁটতে পারার জন্য প্রজ্ঞা ও ধৈর্য প্রয়োজন, যা সবার থাকে না। সঠিক পথ সহজ কোনও পথ নয়। কিছু সন্তান কিছু কাজ এজন্যই করে না যে কাজটি করা ভালো, বরং এজন্য করে যে কাজটি তার বাবা তাকে করতে উপদেশ দিয়েছেন।---এই দুটি পথই ভুল, কেননা এই দুটিই তাদের অহম্‌সত্তার ফল। একজন ভালো সন্তানের কাজ তার বাবা তাকে যে উপদেশ দেন, তা নিবিড়ভাবে শোনা, উপলব্ধি করা, যাচাই করা, সব কথাকেই খোলামনে গ্রহণ করা এবং সবকিছু বিচারবিবেচনার পর তার সেগুলো থেকে যে পথ অনুসরণ করা সংগত, তা অনুসরণ করবে, বাকিগুলি বাদ দেবে, সাথে যেটি তার অপছন্দনীয়, সেটিও বর্জন করবে। এটি কোনও অবাধ্যতা নয়, বরং এটি একটি সুস্থবোধ।


ছাপান্ন।
একজন ভালো সহযোগী বা ভালো বন্ধু হওয়া সমাজে বেঁচেথাকার প্রথম শর্ত। সহযোগীদের মধ্যে সম্পর্ক বন্ধুত্বসুলভ হলে একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়, যা আমাদের স্বস্তিতে ও শান্তিতে কাজ করতে দেয়। যদি আমরা অন্যের ক্ষতি করি, তবে মূলত আমরা নিজেদের জন্যেই দুশ্চিন্তা কিনে আনি। এটি সত্যের পথে নানা রকম বাধার সৃষ্টি করতে পারে। তখন আমরা অযথাই নানারকম অহেতুক ঝামেলায় পড়তে পারি। এমনিভাবে নিজের সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীর সঙ্গেও নরম, কোমল এবং ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ বজায় রাখতে হবে। যেখানে ভালোবাসা থাকে না, সেখানে নানা রকম অপ্রাপ্তি থেকে অভিযোগ এবং অভিযোগ থেকে ঘৃণার আবির্ভাব হওয়া অমূলক নয়। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে ঘৃণা এমন একটি বিষ, যা মানুষকে ভালোবাসা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঘৃণাই ভালোবাসার সব সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। ঘৃণা করার কাজটা প্রতিমুহূর্তেই আমাদের সময় ও ক্ষমতা নষ্ট করতে থাকে।


ভালোবাসা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। যে ভালোবাসার মহিমা হারিয়ে ফেলে, সে প্রার্থনার অনুভূতিই বুঝতে পারে না। ভালোবাসা প্রার্থনারই আর-এক রূপ। যে ব্যক্তি অন্য মানুষকে কোনও কারণ ছাড়াই ভালোবাসতে পারে না, সে কখনও কারও ভালোবাসাও পায় না। কেবল এক ভালোবাসা দিয়েই মানুষের প্রার্থনায় স্থানলাভে করা যায়। নিজের সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীকে সমব্যথী হয়ে ভালোবাসতে হয়। কোমলতা, সদ্‌গুণ, ক্ষমা, সদ্‌আবেগ পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। এটি আমাদের নিজেদের জন্যেই ভয়ানক এক পৃথিবী তৈরি করবে, যদি না আমরা এখনই এই অবস্থা থেকে সরে আসি। দিন দিন আমাদের সম্পর্কগুলো ক্রমশই আবেগশূন্য এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। আমরা ক্রমেই কোমলতার ভাষা হারিয়ে ফেলছি। আমাদের সম্পর্কগুলো ক্রমেই ঘৃণা ও ক্রোধের কালোছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। আমরা একে অপরের প্রতি নিঃস্পৃহ হয়ে পড়ছি দিনদিন। এর মাঝ দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে আমাদের মনের স্রষ্টাটি আসলে মারা গেছেন। ফলে অবধারিতভাবেই আমাদের মন প্রার্থনাশূন্য হয়ে পড়েছে। ভালোবাসা একটি ফুলের মতো, আর প্রার্থনা সেই ফুলের সুবাস। আমরা যদি ভালোবাসাশূন্য হয়ে পড়ি, তবে আমরা কী করে প্রার্থনার সুবাস ছড়াব? আর প্রার্থনা ব্যতীত স্রষ্টাকে আর কোথায় পাব? স্রষ্টা আমাদের প্রার্থনায় মিশে আছেন। তাঁকে পেতে চাইলে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে নিজের বোধ ও অনুভূতিকে জাগাতে হবে। ভেতরের যে আমি, সেই আমি’র সাথে কথা বলতে হবে---সমস্ত সংস্কার, অহংকার, অভিমান ঝেড়ে ফেলে।


যখন আমরা বাবা হই, তখন আমরা যেন আমাদের সন্তানের জন্য একজন ভালো বাবা হয়ে উঠতে পারি। আমরা যেন আমাদের সন্তানদের উপর কোনও নিয়ম অথবা জীবনদর্শন জোর করে চাপিয়ে না দিই। আমরা যেন আমাদের ভালোবাসা, আমাদের ধারণা, আমাদের দর্শন তাদের সামনে তুলে ধরি। আমরা যেন পরিষ্কারভাবে আমাদের মতামত তাদের জানাই, তবে তাদের সেগুলো মানতে বাধ্য না করি। কেননা যদি আমরা তাদের বাধ্য করি, তবে হয়তো আমাদের সামনে তারা সেটি মেনে নেবে, আমাদের দেখানোর জন্য তারা সে পথে চলার ভান করবে, কিন্তু মূলত তারা লুকিয়ে হলেও সে কাজটিই করবে, যা তাদের পছন্দ অথবা যা তারা করতে চায়। এবং, তারা ধীরে ধীরে আমাদের চারপাশের সকলের সাথে মিশে প্রতারণার পথটিই বেছে নেবে, নিজেকে এমন একটা মুখোশের আড়ালে ঢেকে ফেলবে, যে মুখোশটি কেবল তার জন্যেই নয় বরং আমাদের সকলের জন্যেই ক্ষতিকর। সুতরাং আমরা যেন আমাদের সন্তানদের বড়ো শত্রু হয়ে না পড়ি, আমরা যেন তাকে তার বোধশক্তিকে কাজে লাগাতে দিই। তার নিজের জীবনে তাকে নিজে নিজে নিজের মতো করে হাঁটতে সাহায্য করি। আমরা আমাদের সন্তানদের ভালোবাসি, সেটা আমরা জানি, এবং তা যেন আমাদের মধ্যেই রেখে দিই, ভালোবাসার অজুহাতে আমরা যেন আমাদের সন্তানকে আমাদের ভালোবাসতে বাধ্য না করি। ভালোবাসা জোর করে আদায় করার কিছু নয়। ভালোবাসা যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে উৎসরিত না হয়, তবে তা কোনও অবস্থাতেই ভালোবাসা নয়। আমাদের যেন মাথায় রাখি, আমাদের সন্তানের নিজের কিছু পছন্দ থাকতে পারে, নিজের মধ্যেই কিছু দর্শন তৈরি হতে পারে। আমাদের কাজ কেবল…আমরা যা জানি, আমরা এই জীবনের পথে হাঁটতে গিয়ে যতটুকু অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, সেই সবকিছু ঠিক সেভাবেই পরিষ্কার করে তাদের সামনে তুলে ধরা।


একজন বাবা কেবল একজন সাহায্যকারী হতে পারেন, তিনি তাঁর আদেশ-নির্দেশ তাঁর সন্তানের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। তিনি সন্তানকে বিভিন্ন পথ দেখাতে পারেন, কিন্তু তাঁর নিজের পছন্দের পথে চলতে বাধ্য করতে পারেন না। কেননা আমরা প্রত্যেকেই জন্মগতভাবেই নিজের মতো চলার, নিজের আদর্শ নিজে অনুসরণ করার অধিকার নিয়েই জন্মেছি। অন্যের ওপরে নিজের দর্শন চাপিয়ে দেওয়াটা তার জন্মগত অধিকারকে খর্ব করার সমান। হোক সে নিজের সন্তান, তারপরও সে সন্তান সেই মহান অস্তিত্বেরই অংশ, যে অস্তিত্ব মানুষকে মানুষ করে ওঠার দিকে প্রাণিত ও ধাবিত করে। সত্যকে কখনও ভেঙে অনুসরণ করা যায় না। সত্য একটি পরিপূর্ণ অখণ্ড সত্তা। একে ভাঙলে এটি বিকৃত হয়ে যায়। আমরা আমাদের নিজেদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য পূরণ করতে আমাদের সন্তানদের ব্যবহার করতে পারি না। কেননা তাকেও একসময় তার নিজের সন্তানকে শিক্ষা দিতে হবে। যদি সে নিজেই ভণ্ড হয়, আরোপিত পথে চলে যায় সারাজীবন, তবে কী করে সে তার সন্তানকে সঠিকভাবে পথ দেখাবে? এটা একপ্রকার নিজেই নিজের সন্তানকে পঙ্গু করে দেওয়া এবং পরবর্তীতে সে আর তার নিজের বোঝাটুকুও বয়ে নিতে পারবে না।


একজন ভালো বাবার কাজ, সন্তানকে নিজের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হতে সাহায্য করা, তার এই নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি করা নয়। যখন একজন বাবা ভালো বাবা হয়ে ওঠেন, তখন একজন সন্তানও প্রাকৃতিক উপায়ে ভালো সন্তান হয়ে ওঠে, কেননা তখন তাকে কোনও কপটতার আশ্রয় নিতে হয় না। সে খোলামন নিয়ে তার বাবার সাথে মিশতে পারে, তার সকল মানসিক দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করতে পারে। তার ভেতর কোনও ভয় থাকে না। একজন ভালো সন্তানও এই উপায়েই কালক্রমে একজন ভালো বাবা হয়ে ওঠেন। এটিই একটি আদর্শ পারিবারিক পরিবেশ, যার মধ্যে দিয়ে আমরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারি। এমন একটি সুষম পরিবেশ, যেখানে ভালোবাসা, অন্তরঙ্গতা, কোমলতা, দায়িত্ববোধ, মানবিকতা সব কিছুই থাকে। কেবল এমন পরিবেশেই সত্যের পথে আলোর খোঁজে হাঁটা সম্ভব।