অ্যা ম্যারিড ওমেন (১৯৬৪)

যেকোনো মুভি দেখার আগে আমি মুভিটা সম্পর্কে জেনে নিই। গদারের ‘অ্যা ম্যারিড ওমেন’ সম্পর্কে আইএমডিবি’তে লেখা আছে:

অগভীর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এক নারী তার না-পসন্দ স্বামী এবং অর্থহীন প্রেমিক, এই দুইয়ের মধ্যে কোনটাকে বেছে নেবে, তা নিয়ে দ্বিধায় ভোগে।

সাচ অ্যা প্লট দ্যাট ইজ মাই কাপ অব টি! পছন্দ হয়ে যায়। ভাবলাম, দেখি। দেখলাম।

যারা ভাবছেন, তুমি তো এরকম মুভি দেখবাই! তুমি তো বিশ্বখারাপ!…….তাদের সবিনয়ে বলছি, সবাই আপনার মতো ভাল হলে তো পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতে পারত। আফসোস, হল না! আমি তো ভাল না, ভাল নিয়েই থাকুন। এই রিভিউটা আর পড়বেন না। ধন্যবাদ, আবার আসবেন।

একেবারেই সাধারণ একটা মেয়ের ভালোবাসা পেতে কী লাগে? মুভিতে এর উত্তর আছে: তোমাকে জানতে হবে আমার চোখ কী বলে।

মেয়েদের ঠোঁট যা বলে না, তা বোঝে, এমন পুরুষই মেয়েদের পছন্দ।

একটা মেয়ে, স্বামী আছে, ছেলে আছে। স্বামী তার আবেগের জায়গাগুলি বোঝে না, তবে ভদ্রলোকের স্ত্রী হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তা ও সচ্ছলতা নিয়ে মেয়েটাকে ভাবতে হয় না। স্বামী মেয়েটিকে তার নিজের মতো করে পেতে চায়, মেয়েটি যেমন, তেমন করে চায় না। মেয়েটি যা পছন্দ করে, স্বামী তা পছন্দ করে না। স্বামীর কাছে স্মৃতি নিয়ে বাঁচা জরুরি, সে স্মৃতি যদি কষ্টেরও হয়, তাও। মেয়েটার কাছে স্মৃতিকাতরতার কোনো মূল্য নেই, বর্তমানের আনন্দই সব। স্বামীটি, পরে কী হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। মেয়েটি, এখন কী হচ্ছে, তা নিয়ে ব্যস্ত। মেয়েটি একটু ছেলেমানুষ টাইপের, চঞ্চল, নানান ঢঙে দুষ্টুমি করতে পছন্দ করে; স্বামীর কাছে ওসব আদিখ্যেতা মনে হয়। স্বামী বিছানার বাইরে মেয়েটিকে যতটা দূরে ঠেলে রাখে, বিছানায় ততটাই কাছে টানতে চায়। সবসময়ই মেয়েটাকে সন্দেহের চোখে দেখে। চোখেচোখে রাখে, এক ধরনের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে চায়, মেয়েটির মনকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে। সে যতটা না বন্ধু, ততধিক স্বামী। মেয়েটাকে ঠিকভাবে সময় দেয় না, নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এমন করে আসলে হয় না। মেয়েটা মানুষ তো, রোবট তো আর না!

অন্যদিকে মেয়েটার প্রেমিক যে, সে একেবারেই মেয়েটার মনের মতো। মেয়েটার ছেলেমানুষিকে গুরুত্ব দেয়, মেয়েটার মতো করে মেয়েটাকে সময় দেয়। মেয়েটা যা-ই বলে, যা-ই করে, প্রেমিকের কাছে তার সবই ঠিক। মেয়েটা যেসব ফ্যান্টাসিতে ডুবে থাকে, প্রেমিকের কাছে থাকলে সেসব যেন সে বাস্তবে পেয়ে যায়। মেয়েটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনে বুঁদ হয়ে থাকে, নিজের ফিগারের মাপ নিয়ে খুব ভাবে, একাএকা ঘুরতে পছন্দ করে। সিনেমায় যায়, শপিং করে। তার চোখে জীবনটা রঙিন, উপভোগের। অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না, বর্তমান নিয়েই মেতে থাকে। স্বপ্নের কথা ভাবতে ও শুনতে ভালোবাসে। প্রেমিকটি পেশায় অভিনেতা। মেয়েটিরও মনে আসে, এই যে এই মানুষটা আমি যেমন করে চাই, তেমন করেই নিজেকে আমার সামনে সবসময়ই উপস্থাপন করে, এটা তার অভিনয়েরই একটা অংশ নাতো? কথাটা সে জিজ্ঞেস করে বসেও। যথারীতি এমন উত্তর পায় যে উত্তরটাও তার মনের মতো। মেয়েরা, যেমন করে বুঝতে চায়, তেমন করে বুঝিয়ে দিলে সব বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকতে তারা ভালোবাসে। মুভির মেয়েটাও জানে, তার প্রেমিক তাকে বিয়ে করবে না, তবু সে বারবারই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি শুনতে চায়। মুহূর্তের উদযাপনের যে তৃপ্তি আর সুখ, তা পেতে সে হৃদয়কে নিজের নিয়মে ভালোবাসা ধারণ করিয়ে ফেলে।

আধুনিক মানুষের সম্পর্কের সংকট এবং তা থেকে আপাতমুক্তির যে স্বাদ, এই ফিল্ম তার কথা বলে। সামাজিক নৈতিকতার চাইতে জীবনের দাবি বড়ো, এমন থিমে গদার সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। দাম্পত্যযাপনের ক্লান্তি ও অস্বস্তি থেকে পালিয়ে মনের সকল অবসাদ থেকে নিজেকে ক্ষণিকের জন্য হলেও দূরেরাখা, এমন চর্চার পক্ষে কি বিপক্ষে, যেখানেই দাঁড়াই না কেন, সে চর্চা চলে আসছে, চলছে, চলবে। একে ব্যাহত করার চেষ্টা করলে পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোগুলি একএক করে ভেঙে পড়বে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এ দিকটি আপনাআপনিই সৃষ্টি হয়, আবার আপনাআপনিই ধ্বংস হয়ে যায়। জীবনের প্রয়োজনে এমন কিছু উদ্দেশ্যহীন, মহত্ত্ববর্জিত, অনৈতিক, ফ্যান্টাসিনির্ভর ইউটোপিয়া আধুনিক মানুষমাত্রই তৈরি করে রাখে, বেঁচেথাকার দায়ে সেসব ‘ভুল-নগরী’র অলিগলিতে অন্ধত্বের আনন্দ উপভোগ করে।