অ্যা লেটার ফ্রম অ্যান আনবর্ন চাইল্ড





প্রিয় বাবা-মা,

 আমি জানি, আমি কেন পৃথিবীতে এলাম না, এর উত্তর তোমরা কাউকেই কোনওদিনই দেবে না। পৃথিবীর প্রান্তে-প্রান্তে এসব নীরব সম্মানরক্ষার হত্যার হিসেব এক বিধাতা বাদে আর কেউই কোনওদিনই চায়নি, চাইবেও না। যে অপরাধের কৈফিয়ত কেউ কোনওদিনই চায় না, সে অপরাধ করার হাতছানি কে উপেক্ষা করতে পারে, বলো! বলতে পারো, তোমাদের বাবা-মা ডাকছিই-বা কেন! আমি তো জন্মের আগেই মৃত হয়ে গেছি সবার অগোচরে। পৃথিবীর আর কেউ না জানুক, তোমরা তো জানো, আমি এসেছিলাম তোমাদেরই ইচ্ছেয় এবং আমাকে সুকৌশলে হত্যা করা হয়েছে। খুব ইচ্ছে করে, তোমাদের ‘খুনি’ বলি! পারি না। কারণ আমি জানি, তোমাদের জন্যই আমার আজকের এই স্ব-আরোপিত অস্তিত্ব; হোক নিরর্থক অদৃশ্য, তবুও…! তোমাদের একটি মৃত সন্তান আছে, এটা যতটা সত্য, আমারও বাবা-মা আছে, এটাও ঠিক ততটাই সত্য! তোমরা না থাকলে যে আমিও থাকতাম না। অনেক কষ্ট, তবু কাঁদতে পারি না। যে কখনও জন্মায়ইনি, যাকে জন্মাতে দেওয়া হয়নি, সে কাঁদতে শিখবেই-বা কোত্থেকে? এই পৃথিবীর বুকে আসা মানেই, কাঁদতে শিখে যাওয়া। হায়! আমার কাঁদতে পারার যোগ্যতাটুকুও নেই! আমার কোনও অস্তিত্ব নেই, আমার কোনও কান্না নেই, তাই আমার কোনও হাসিও নেই। বিশ্বাস করো, তোমরা যা আমাকে মানতে বাধ্য করেছ, আমি আজও তা মেনে নিতে পারি না।

 আচ্ছা, তোমাদের তো মনে নেই, আজ আমার জন্মদিন,…তাই না? আমিই নাহয় অযাচিত হয়ে মনে করিয়ে দিলাম! তোমাদের জন্য যা ছিল নিছকই ভুল মাত্র, আমার জন্য তা-ই ছিল জন্মের প্রতিশ্রুত প্রতীক্ষা-বার্তা। অবশ্য, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে! না জন্মানোর অনেক সুবিধা, না জন্মালে কোনও কিছুকেই আর ভয়টয় করে না। যার কোনও অস্তিত্বই নেই, তার আবার অনস্তিত্বের ভয় কীসের? একটু ভুল হলো, আমার মা’র হয়তো আজকের দিনটা ঠিকই মনে আছে। মনে থাকে না কীভাবে? মা’র শরীরে ক্যানসারের মতো আটকে ছিলাম যে অনেক দিন! বাবা, মা তোমাকে ভয়ে আজকের দিনের কথা বলেনি। যদি মায়ের সাথে তোমার এখনও যোগাযোগ থাকে, তবে মাকে একটা ফোন করে জিজ্ঞেস করেই দেখো না! আচ্ছা, আমি এসেছিলাম বললে তুমি নাকি ভীষণ রাগ করো? আর রাগ কোরো না, বাবা। আমার জন্য একটা বার্থডে ক্যান্ডেলও কেনার বাজে খরচ করতে হবে না তোমাকে। আমার জন্য কারও কাছে মাথা হেঁট করে রাখতে হবে না। আমার খুব আদর পেতে ইচ্ছে করে, বাবা! তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে, মা’র গালটা ছুঁতে ইচ্ছে করে। একটা আলতো করে পাপ্পি দেবে, প্লিজ? কেউ দেখবে না তো! মিথ্যে করে হলেও বলো না, “ভালোবাসি!” একটু করে বলবে, “হ্যাপি বার্থডে!”? আমি আমার জন্মের না হোক, মৃত্যুর হলেও একটা নিভৃত স্বীকৃতি চাই। একটা মিথ্যে-মিথ্যে পুতুল কিনে দেবে আমায়? সস্তা মাটির হলেও? দাও না, বাবা! প্রয়োজনে কল্পনাতেও বেশি খরচ কোরো না---হোক না সস্তা একটা পুতুল, যে পুতুলটি সারামেলায় বিক্রি হয়নি বলে মেলাভাঙার ঠিক আগে পুতুলওয়ালা শুধু ১০ টাকায় হাঁকাচ্ছে! তোমার ভালোবাসার উপহার আমার কাছে অনেক দামি। আমি নাহয় তোমার সন্তান নই, কিন্তু তুমি যে আমার বাবা!

 মা, আমার চোখে একটা চুমু খাবে? জানো মা, যদি আমাকে তোমরা আসতে দিতে, তবে দেখতে পেতে, আমার চোখদুটো তোমার চোখের মতোই সুন্দর। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলতেন, “ব্যাটা, মায়ের চোখ পেয়েছিস!” মা, আজকে আমাকে কপালে একটা কাজলের টিপ দিয়ে দেবে বড়ো করে? তুমি কি কখনও কখনও বুঝতে পারতে যে, যখন তুমি আমাকে অনেক যত্ন করে গর্ভে রেখেছিলে, তখন আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসতাম! হাসলে তোমার গালে টোল পড়ে, তাই না, মা? আমি চাইতাম, আমি যখন তোমার মতন বড়ো হব, তখন আমার গালেও ওরকম পড়ুক! সত্যি বলছি মা, তোমার মুখের মতন অমন সুন্দর মুখ কারও হয় না। এ কথা বাবাও বলে তো, না? না কি বলেই না আর? অমন গালেও কেউ চড় বসিয়ে দিতে পারে! নিজের উপরই খুব রাগ হয়েছিল সেদিন। আমি আসছি বলেই তো বাবা তোমাকে অমন করে মারছে! মনে হচ্ছিল, মরে যাই। আমি মরে গেলেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে---বাবা তোমাকে আবারও ভালোবাসবে! বাবা তো ও-ই চাইছিল! বাবা তোমার ভালো চায় বলেই আমাকে হত্যা করেছে, মা। তুমি বাবাকে কখনও ভুল বুঝো না। জন্মাতে ভাগ্য লাগে, আমার যে তা নেই! 

 মা, বড়ো ইচ্ছে ছিল, যখন তুমি ঘুমিয়ে পড়বে, তখন আমি আমার গুটিগুটি গোলগোল হাতের উলটো পিঠে তোমার গাল, নাক, মুখ, চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখব। এত যত্নে আমায় রাখলে, অথচ আমায় অকৃতজ্ঞ রেখেই বিদায় দিলে। মা, আমাকে এভাবে করে মেরে ফেললে? এটা কেমন নিয়তি, মা? নিয়তি তো বিধাতা লিখে দেন। তবে কি কখনও কখনও মানুষের মর্জিতেও নিয়তির নিভৃত লিখন চলতে থাকে ডাক্তারের হাতের মুঠোয়? মানুষের খামখেয়াল নিয়তির চাইতেও বড়ো? আমি কী অপরাধ করেছিলাম? সে ‘সুযোগ’টাই তো পাইনি, মা! অপরাধ করাটাও যে একটা সুযোগ, তা আমি তোমাদের দেখে শিখেছি। তোমরা সুযোগ কাজে লাগিয়েছ, আমি সুযোগ পাইইনি! মা, আজ আমি মৃত। আজকে তোমাদের আদরের ফুটফুটে মৃত সন্তানটির প্রথম জন্মদিন। জানো মা, যারা জন্মের আগেই মারা যায়, তারা কক্ষনো বড়ো হয় না, ছোট্টটি থাকে। যারা আমারই সমবয়সি, তারা সবাই বড়ো হয়ে যাবে, কিন্তু আমি কখনও বড়ো হব না। ছোট্টটি থেকে যাওয়ার অনেক সুবিধে। সবাই শুধু আদর করে। আমাকে তোমরা আসতে দাওনি নিজেদের সম্মানের জন্য। সম্মানের কত-কত রকমফের আছে, কত-কত রঙ আছে! হায়, কিছু সম্মান জন্মোৎসবে, কিছু সম্মান মৃত্যুর আয়োজনে!

 বড্ড আবোলতাবোল বকছি, না? হঠাৎই খুউব ইচ্ছে করছে, একটু আদর পেতে! অন্তত আজকের জন্য হলেও আমাকে একটু আদর করো, মা। আমি কোনওদিনই জন্মের দাবি নিয়ে তোমাদের সামনে এসে দাঁড়াব না। শুধু একটাই চাওয়া, আমাকে ঘৃণা কোরো না। ভালো না বাসলে কষ্ট করে সহ্য করা যায়, কিন্তু ঘৃণা সহ্য যায় না। ভালোবাসাহীনতায়ও বাঁচা যায়, কিন্তু ঘৃণায় মরাও কঠিন! মা, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমাকে যেভাবে করে ‘আমার লক্ষ্মীসোনা’ বলে ডাকতে, আমি ঠিক ওরকম লক্ষ্মীটিই আছি। বিশ্বাস করো, মা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি,…অনেক! আমাকে ওটা বলতে দাওনি বলে বলতে পারিনি, কিন্তু চোখ বন্ধ করে একটি বারের জন্য হলেও অনুভব করে দেখো---আর কিছু না, শুধু আমার ভালোবাসা দিয়েই সব কষ্ট বেদনা গ্লানি ধুয়েমুছে ফেলা যায়। তুমি কেঁদো না, মা, শুধু আমায় ভালোবেসো। ভালোবাসলে অনেক শক্তি পাওয়া যায়। সে শক্তিই তোমায় বাঁচিয়ে রাখবে। মা, আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে সারাজীবন শান্তিতে রাখব।

 বাবাকে বলতে শুনেছি, “ওকে যদি পৃথিবীতে আনো, তবে আমি ‘ওটা’ ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসব।” কী আশ্চর্য! একা মা-ই বুঝি আমায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছিল এ পৃথিবীর আলোবাতাসে? বাবা, তোমার সন্তানকে তুমি কুকুর-বেড়ালের মুখে দেওয়ার কথাও ভেবে ফেলেছিলে? তোমার সন্তান ডাস্টবিনের ময়লা হয়ে পড়ে থাকলে তোমার সম্মান খুব বাড়ত? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অমন কাপুরুষ পিতার সন্তান করে উনি আমাকে পৃথিবীতে পাঠাননি। অবাক হই এ ভেবে যে, পুরো পৃথিবীর মতো করে তুমি আজও ভাবো, তোমার সন্তান হয়নি। আমি জানি, তুমি আমার বাবা, তুমি এক মৃত সন্তানের বাবা। চিৎকার করে বলছি, তুমি সেই বাবা, যে তার সন্তানকে জন্মের আগেই খুন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বাবা, আমার কথায় কষ্ট পেয়ো না, প্লিজ। নিজেকে নিজের বিবেকের সামনে দাঁড় করিয়ে ভেবে দেখো, এটাই সত্য, এটাই ঘটেছিল। যা-কিছু কখনওই ইতিহাসে লেখা থাকে না, যুগে-যুগে তা-কিছুই ইতিহাস রচনা করে যায়। বিধাতার খাতায় লেখা আছে: আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই খুন করা হয়েছে। আমাকে আমার বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে দেওয়া হয়নি, আমার মাকে ‘মা’ বলে ডাকতে দেওয়া হয়নি। আমার সাথে ভীষণ অন্যায় করা হয়েছে।

 বাবা, আমার মা অ্যাবরশনে রাজি না হওয়ায় তুমি মা’কে চড় মেরেছিলে না? সেদিন মা মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। এমনকি অ্যাবরশনের দিন মা’কে ম্যাটারনিটিতে যেতে হয়েছিল মায়ের বান্ধবীর সাথে। মৃত্যুর ঠিক আগে আমি আশেপাশের মানুষের গুঞ্জন শুনেছি, আমার মা নাকি নষ্টা মেয়ে! হায়, আমাদের এ সমাজ আর কবে পুরুষদের ‘নষ্ট’ বলতে শিখবে? ওরা মা’কে বার বার জিজ্ঞেস করছিল, “তোমার হাজব্যান্ডকে সাথে নিয়ে আসোনি কেন?” মা ওদের কিছুই বলতে পারেনি, মাথা নিচু করে কাঁদছিল, শুধুই কাঁদছিল। ইসস্‌…! তোমার এই জানোয়ারের রূপটি সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারতাম! আমার সব কিছুই মনে আছে, বাবা। আমার সাথে গল্প করার সময়ে মা প্রায়ই বলত, “তোর বাবা অনেক জানে রে! তুই তোর বাবার মতো হোস।” বাবা, একটা কথা বলি, রেগে যেয়ো না। আমি থুতু মারি ওরকম জ্ঞানীর মুখে! আমার মা’কে ওরকমভাবে গালাগালি করার স্পর্ধা তুমি কোথায় পেয়েছিলে, বলো তো? সেই ‘পাপ’টি করার সময় কোথায় ছিল তোমার ঠুনকো আভিজাত্য, অহংকার? আমি হওয়ার আগেও কি তুমি মাকে ওরকম গালাগালি করতে? আগেও কখনও কখনও গলা টিপে ধরেছিলে? হায়! আমারই তো দোষ! আমার মাকে আমার জন্যই তো কত কিছু সহ্য করতে হলো! শরীরের যন্ত্রণা, মনের যন্ত্রণা। আমি তো পুরো তিন মাস মায়ের শরীরের ভেতরে ছিলাম। মা অনেক আদর করত আমাকে। সারাক্ষণই প্রার্থনা করত, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করত, গরিবদুঃখীদের সাহায্য করত। একটু বেশি বেশি ভালো খাবার খেত। ভাবত, আমার সোনাটাও তো খাবে! আমার সাথে সারাক্ষণ কথা বলতে থাকত, “আমার বাবুটাকে নিয়ে দূউউরেএএএ পালিয়ে যাব। একটা স্কুলে বাচ্চাদেরকে পড়াব, ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে থাকব। কারও কাছেই কোনও দাবি রাখব না কোনওদিনই। কেউই খুঁজে পাবে না আমাদেরকে। তাই না, সোনা?” আমি বুঝতাম না, আমাকে নিয়ে আমার মাকে পালাতে হবে কেন? পালিয়েই যদি যাব, তবে এলাম কেন? আমি তো নিজের ইচ্ছেতে আসিনি, আমাকে আনা হয়েছে। আমি অবৈধ সন্তানও নই, জারজও নই। তবে, কেন আমাকে তোমরা পৃথিবীর আলো দেখতে দিলে না?

 বাবা, তুমি কি জানো, মা আমাকে প্রতিদিনই দেখে? যখনই মন খারাপ হয়, আমার কথা ভাবে? আমি স্বপ্নে এসে মা’কে আদর করে দিয়ে যাই? যেদিন আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্টটা হাতে পেল, সেদিন তুমি মা’কে খুব করে বকছিলে। মা সেদিন একটুও কাঁদছিল না, উলটো আমার বোকা মা’টা কিডস্ শপ থেকে সবচাইতে সুন্দর প্রজাপতি-বসানো গোলাপি রঙের জুতোজোড়াটি কিনে বাসায় ফিরেছিল। সেগুলি কেউ কোনওদিনই পরবে না। বাবা, তুমি কি জানো, সে জুতোজোড়া বুকে জড়িয়ে মা এখনও কাঁদে, আমার জুতো মুছে দেয় নিজের শরীরের কাপড় দিয়ে নয়, ঠোঁট দিয়ে, গাল দিয়ে, চোখ দিয়ে, সমস্ত শরীর দিয়ে। ইসসস্‌! জানো, বাবা, মা না আমার জন্য অনেকগুলি পুতুল কিনেছে! মা প্রতি মাসে টিউশনি করে যা পায়, তার প্রায় পুরোটাই আমার জন্য খরচ করে ফেলে। মিথ্যে সুখের পসরা দিয়ে জীবন সাজায়। ওইটুকুই আমার মা’র জীবনে সবচাইতে ধ্রুব, তীব্র! মা ভাবে, আমি জানি না, পুতুলগুলি কার কেনা। রুমের দরোজা বন্ধ করে ওগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে, নিজের সাথেই হাসতে থাকে আর বলে, “এই বোকা, এই পুতুলগুলি তোর বাবা তোর জন্য কিনে দিয়েছে। তুই এখনও রাগ করে আছিস? বাবার উপর রাগ করে থাকতে হয় না রে! তোর বাবা সত্যিই অনেক ভালো একজন মানুষ!” মা তোমায় অনেক বেশিই ভালোবাসে, বাবা। মাকে কখনও কষ্ট দিয়ো না।

 মা আমাকে অনেক বোঝে! শুধুই ভালোবাসে আর চুমু খায়। আমি যে এখনও হারিয়ে যাইনি, আমি এতেই অনেক খুশি! মা মন থেকে বিশ্বাস করে, আমি আছি, আমি দূরে অন্য কোথাও বড়ো হচ্ছি। একদিন হুট করেই পেছন থেকে এসে মা’র গলা জড়িয়ে ধরে চমকে দেবো। বলব, মা, এই তো আমি! আমাকে অমন করে খুঁজছিলে কেন বলো তো? আমি তো আছিই! আচ্ছা, দেখো তো মা, আমি কি সত্যিই বাবার মতো হয়ে যাচ্ছি? আমার চুলগুলি কি বাবার মতোই হয়েছে? চোখদুটো তোমার মতো? হাসলে গালে টোল পড়ে তো, না? মা, আমি বাবার সাথে একটু থাকি? বাবা কি খুব রেগে যাবে আমাকে দেখলে? মা, তুমি বলতে না, “আমার বাবুনিটা কী সুন্দর করে হাসে! দেখলে মনে হয়, চাঁদের একটা কণা ঈশ্বর আমার কোলে পাঠিয়ে দিয়েছেন!” দেখো মা, আমিও একদিন চাঁদের আলো দেখতে শিখে যাব। সেদিন কারও হাত ধরে চাঁদের আলো দেখাতে সমুদ্রে নিয়ে যাব! তখন কী ভীষণ ভাবনায় পড়ে যাবে তোমরা, তাই না? হা হা হা হা… বাবা, মা নাকি আমাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখে। যখন মা’র পাশে কেউই থাকে না, তখন আমি মা’কে ঘিরে ঘুরতে থাকি, নাচতে থাকি, মা’র চোখের জল মুছে দিয়ে বলি, দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে! এত কাঁদছ কেন, মা? আমি আছি তো! 

 মা, জানো, আমারও না বাবার কোলে উঠতে ইচ্ছে করে, কাঁধে চড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে। বাবার কাঁধ নাকি পৃথিবীর সবচাইতে নিরাপদ আশ্রয়। সবাই বলে এটা! আমি ভাবি, ইসসস্‌! সবাই কী বোকা! আচ্ছা বাবা, মা কি তোমাকে বলেছে, মা আমার জন্য এই জন্মদিনে দুটো ফ্রক কিনেছে? নরোম-নরোম পুতুল কিনেছে চারটা, অনেক চকোলেটও আছে। মা’টা না ভীষণ বোকা! জানল কীভাবে, আমি ফ্রক পরি? বাবা, আজকে তোমাকে একটা কেক কিনতে বলায় মা’কে ওরকম করে বকলে কেন? কী হয় আমাকে একটু ভালোবাসলে? আমি তো মরেই আছি! তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছি তো! মা একটা কেকই শুধু চেয়েছে! তবুও…বাবা, তুমি ভেবো না, মা তোমাকে দিয়ে বাজে খরচ করাতে চাইছিল। আমার জন্য একটা বার্থডে কেক আমার মা’ও কিনতে পারে! মা শুধু আমার অনস্তিত্বের স্বীকৃতিটুকু চেয়েছে! আর কিছু না! 

 ইসসস্‌! ছোটোদের কত সুন্দর সুন্দর কবর থাকে, আমার যে তা-ও নেই! আমার কবরেও জায়গা হয়নি। আমি মায়ের গর্ভ থেকে সোজা ড্রেইনে নিক্ষিপ্ত হয়েছি! আমার থাকার কোনও জায়গা নেই, শুধু এক মা’র স্মৃতিতে ছাড়া! অবশ্য আমার ওতে কোনও দুঃখও নেই। মা আমাকে অনেক ভালোবাসে, অনেক যত্ন করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে লুকিয়ে রাখে! বাবা, আজকে চুপি-চুপি একটা কথা বলে দিই। অ্যাবরশনের দিন মা’র ব্যাগে সায়ানাইড ছিল। ডাক্তারের হাতে ধরা পড়ে গেছে। ভাগ্যিস, ধরা পড়েছিল! আমাকে খুন করেছ, এতে আমার কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু আমার মা’কে খুন করলে তোমাকে আমি কিছুতেই ছাড়তাম না। যখন আমার মাকে মারো, তখন আমার খুব ইচ্ছে করে, দৌড়ে এসে তোমার গলা টিপে ধরি! রাগ হলো, না? রাগ কোরো না বাবা। মৃতের উপরে রাগ করতে হয় না।

 আচ্ছা, ঠিক আছে, যাও, ওসব কিছু বাদ! বাবা, ও বাবা! তোমার হাতদুটো একটু দেবে? মা প্রায়ই বলত, তোমার হাতের আঙুলগুলি নাকি অনেক সুন্দর! তোমার হাতটা একটু এদিকে বাড়িয়ে দাও না, বাবা! একটুখানি আদর করি? আমার গালে তোমার আঙুলগুলি একটু ছড়িয়ে দেবে? আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু খাবে, বাবা? মা খায় তো, লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায়ই খায়! একটা সিক্রেট বলে দিই? মা’র মোবাইলের স্ক্রিনসেভারের বাবুটা কিন্তু আমি। ল্যাপটপের ব্যাকগ্রাউন্ডে, দেয়ালের কোনায় টাঙানো ছবির ফ্রেমের ভেতরে বসে বসে আমি চুপিচুপি মা’কে দেখি, মা’র সাথে খেলি, মা’র খেয়াল রাখি। মা বলেছে, এসব কক্ষনো কাউকে না বলতে। একটুও দুষ্টুমি না করতে, কাউকে কষ্ট না দিতে। আরও বলেছে, খেলনা ভাঙা যাবে না, বড়ো হয়ে বাবার মতো বড়ো হতে হবে। ইসসস্‌! মা’টা কী বোকা! বাবা, তুমিই বলো, আমি কি তোমার মতো হব?…এমনই ভয়ংকর খুনি, যে খুনের কোনও নিশানা রাখেনি বলে তার কক্ষনো কিচ্ছুটি হবে না? আর সেই পরম নির্ভরতায় খুনিটি তার অতীত অপরাধের কথা মনেও করে না কখনওই! বাবা, তুমিই বলো, আমি কি তোমার মতো হব? মা’কে বলে দিয়েছি, “মা, আমি হব তোমার মতো, বড়ো মানুষ হতে পারি আর না পারি, ভালো মানুষ হব। অত বড়ো মানুষ হয়ে কিছু হয় না মা, একজন সাদামাটা ভালো মানুষ হয়ে বাঁচতে পারলেই আমি খুব খুশি! তুমি আমাকে শুধু সে আশীর্বাদটুকুই কোরো।” শুধু বলিইনি, একেবারে পাক্কা কথাও দিয়েছি। মা আমার মুখ চেপে ধরে বলেছে, “ছিঃ বাবা! বাবাকে নিয়ে এভাবে বলতে হয় না। তোর বাবা তো!” আমি আর কিছু বলিনি। শুধু মনে মনে ভেবেছি, এত সহজেই যদি বাবা হয়ে যাওয়া যেত, তবে তো বাবাদের নিষ্ঠুরতায় পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নেওয়াই দায় হতো! 

 যে শিশুটি কখনওই জন্মায়ইনি, তার কোনও জন্মদিন থাকে না। আমার কোনও জন্মদিন নেই। তবু আমি জানি, আমি এসেছিলাম। যারা জন্মের আগেই মৃতদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে, তারা কিছুতেই মৃত নয়। আমার ভ্রূণটি আমার মায়ের গর্ভে যেদিনটাতে উঁকি দিয়েছিল অসীম সাহসিকতায়, আজকে সেই দিন। তোমরা যদি সত্য হও, তবে আমিও সত্য। আজ আমার সত্যিই কোনও অভিযোগ নেই, তোমাদের আমি আমার অভিযোগেরও অযোগ্য মনে করি। আজ আমার লোভী, অহংকারী আর স্বার্থপর হয়ে যেতে বড়ো ইচ্ছে করছে! পুরো পৃথিবীকে অসম দুঃসাহসে চিৎকার করে জানিয়ে দিতে চাইছি: Happy Birthday to An Unborn Child!!

 ইতি-
 তোমাদেরই অনর্থিত সন্তান