অ-সৃষ্টিশীল মেধাবীদের প্রসঙ্গে

বিনয়ের সাথে ভয়ে ভয়ে কিছু কথা বলি।


যাঁদের প্রতিভা ও মেধা দুই-ই আছে, তাঁদের কিছু-না-কিছু সৃষ্টি করা খুব প্রয়োজন। এতে দুটো লাভ আছে:


এক। আমরা সাধারণ মানুষেরা তাঁদের কাছ থেকে চমৎকার কিছু উপহার পাবো। নিজেকে সমৃদ্ধ করাই তো জীবনযাপনের মুখ্য উদ্দেশ্য!
দুই। তাঁদের মধ্যে মনের গহিনে কোণে কোনও অবচেতনেও এই আফসোসের উদয় হবে না যে---চাইলেই আমি অনেক চমৎকার কিছু সৃষ্টি করতে পারতাম!


এক ব্যক্তিকে চেনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি যাঁদের চিনি, তাঁদের মধ্যে তাঁর কাছাকাছিও বাংলা জানেন ও বোঝেন, এমন কেউ নেই। বলা বাহুল্য, বাংলা জানা-বোঝার মানে বাংলাভাষার ব্যুৎপত্তি-প্রয়োগ ও সাহিত্য নিয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের কথা বলছি। তিনি আমার কাছে অতিনমস্য। পাণ্ডিত্যের বিচারে অনেক পক্বকেশ বাংলার অধ্যাপকও তাঁর ধারে কাছেও আসার যোগ্যতা রাখেন না। তিনি এমনই এক মানুষ, যাঁর পায়ের কাছে মাথা নত করে বসে বাংলা শেখা যায়।


সত্যি বলছি, এ জীবনে যাঁদের দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে, তাঁদের পায়ের কাছে ধুলোয় বসে শেখা যায়, তিনি তাঁদের অন্যতম।


তবে তাঁর চরিত্রের একটি দিক আমাকে প্রায়ই ব্যথিত করে। তাঁকে দেখেছি, তিনি তাঁর সমসাময়িক লেখকদের, মানে সাহিত্যের অঙ্গনে সৃষ্টিশীল মানুষদের তেমন একটা শ্রদ্ধা দিয়ে, এমনকি পাত্তা দিয়েও কথা বলেন না। সমরেশ, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব (গুহ), প্রয়াত সুনীল প্রমুখ, এমনকি শঙ্খ ঘোষের মতো শ্রদ্ধেয়জনেরাও তাঁর কাছে ঠিক 'পাত্তা'ই পান না!


আমাদের দুর্ভাগ্য, তিনি কিছু লেখেননি, মানে ছাপার অক্ষরে তাঁর কোনও সৃষ্টি নেই। লিখলে কী হতো বা হতো না, সে বিচারে না গিয়ে এইটুকু বলব, তিনি লেখকদের প্রতি এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে, তা দেখে মনে হয়, হয়তো তিনি একধরনের হীনম্মন্যতা কিংবা আত্মঅভিমানে ভোগেন।


একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বই পড়ে অনেক অনেক জানা কিংবা পাণ্ডিত্যলাভ করা ও লিখতে পারা---এই দুই কিন্তু এক কথা নয়। অনেক পড়ুয়া পণ্ডিতকেই দেখেছি, অনেক জানেন ও বোঝেন, তবে লেখার ক্ষমতা ওঁদের নেই। লিখতে পারাটা অনেকটা জাদুর মতন একটা ব্যাপার। যাঁর মধ্যে এই জাদুটা নেই, তিনি যতই বিদগ্ধ পণ্ডিত হন না কেন, লিখতে পারবেনই না। হ্যাঁ, তিনি বড়োজোর কারও লেখার সমালোচক হতে পারবেন, তবে তাঁর সমালোচনা করার মানুষ তিনি পাবেন না।


প্রিয় মানুষটি সম্পর্কে আমার এমন বিচার-বিশ্লেষণ ভুলও হতে পারে। তবে আমি তাঁকে এরকমই করতে দেখেছি ও দেখি। একদম সবসময়ই! তিনি ভীষণ অহংকারী এবং এটা নিয়ে আমার বলার কিছুই নেই, কেননা তাঁকে অহংকার সত্যিই মানায়। অহংকার কেবল তাকেই ধ্বংস করে দেয়, যে অহংকারটা ঠিক 'ক্যারি' করতে পারে না। তাঁর অবিশ্বাস্য জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের কারণে আমি তাঁকে ভালোবাসি, অন্ধের মতো শ্রদ্ধা করি। তাঁর সাথে নতমস্তকে কথা বলতে পারলেও আমি একধরনের শ্লাঘা অনুভব করি। একইসাথে লেখকদের প্রতি তাঁর এমন তাচ্ছিল্যমাখা মনোভাব আমাকে সত্যিই ভীষণ ব্যথিত করে।


যাঁরা সৃষ্টি করতে পারেন, সে-ক্ষমতা ঈশ্বর যাঁদের দিয়েছেন, তাঁদের নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে বা তাঁদের অশ্রদ্ধা করে কেউ কিছু বললে আমি তা কোনওভাবেই হজম করতে পারি না। চেষ্টা করে দেখেছি, পারি না, বুকের ভেতরে দুঃখ ও ক্রোধ টগবগ করে ফুটতে থাকে। জীবনের এই যে যাপন, সেখানে নানান সময়ে ও অসময়ে যাঁদের কাজ আমাকে বিমল আনন্দ দিয়েছে, সঙ্গ দিয়েছে বন্ধুর মতন, তাঁদের কিছু অক্ষমতা বা সীমাবদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করে বাঁচতে আমার ভালো লাগে। আমার কাছে মনে হয়, মানুষ হিসেবে কিছু ভুল তো তাঁদের থাকবেই। তবু তাঁরা যে আলোটা ছড়িয়েছেন এবং ছড়াচ্ছেন, সেটির দিকে তাকিয়ে বাকি সব কিছুই বিনা তর্কে ও কুণ্ঠায় মেনে নেওয়া চলে। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত দর্শন।


আমার ভালোলাগার ও শ্রদ্ধার মানুষটি যখন আমাকে বলেন, শীর্ষেন্দু তো একেবারেই সাদামাটা লোক, ওঁর প্রতিভা বলে কিছু আছে নাকি আদৌ? ওই যে তোমাদের পাড়ায় বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে যে লোকটা হেঁটে যায় বেলা এগারোটার দিকে, তাঁর সাথে শীর্ষেন্দুর কোনও তফাত নেই, বুঝলে? ওঁকে লোকে অহেতুকই ওরকম আকাশে তুলেছে! ও আচ্ছা, তোমরা তো আবার বাজারি লেখক হুমায়ূন আহমেদের গায়েও সাহিত্যিক তকমা সেঁটে দিয়ে বসে আছ! তোমাদের আর কী বলব!


...তখন আমার সত্যিই কষ্ট হয়। তাঁর পায়ের কাছে বসে অনেক কিছু শিখেছি, তাঁকে ভালোবাসি ও গুরু মানি, তাই তাঁকে ওরকম করে বলতে দেখলে মনে হতে থাকে, আহা, এই মানুষটি যদি কিছু সৃষ্টি ছড়িয়ে দিতেন আমাদের মাঝে, তবে হয়তো তাঁর এই ক্রোধটা একটু হলেও কমত।


এক জন সৃষ্টিশীল মানুষ আরেকজন সৃষ্টিশীল মানুষকে যতটা সহজে সহ্য করতে পারেন, এক জন পণ্ডিত তবে অসৃষ্টিশীল মানুষ এক জন অপেক্ষাকৃত অপণ্ডিত তবে সৃষ্টিশীল মানুষকে ততটা সহ্য করতে পারেন না। অনেক পণ্ডিতও, সমালোচনা করতে গিয়ে নিন্দা করে ফেলেন। কাজের সমালোচনা সুস্বাদু, কর্মীর নিন্দা নয়।


সবাই তো আর প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মতো অসামান্য জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য নিয়েও (অল্প কিছু প্রবন্ধের কথা বাদ দিলে) 'অসৃষ্টিশীল' থেকেই তাঁর চাইতে অনেক অল্প প্রজ্ঞাসম্পন্ন তবে সৃষ্টিশীলদের কণামাত্রও নিন্দামন্দ না করে স্রেফ দাবার বোর্ডে নাক গুঁজেই অমন নিঃস্পৃহতায় গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন না! আহা, যাঁর বুকপকেট থেকে অত লেখক বেরিয়ে এলেন, তাঁরই কিনা পকেটে কোনও লেখা নেই!