আত্মাহুতি

আমার মনে আছে, তোমাকে সেই প্রথম 'আপনি আপনি' করে ডাকা, আর দেড় বছর ধরে বহু চেষ্টার পরে গিয়ে 'তুমি' বলতে পারার কথা। তোমার কি মনে আছে, কী করে তুমি আমায় রাজি করিয়েছিলে তোমায় 'তুমি' ডাকতে?


শুরুতে তুমি খুব ভালোবাসি ভালোবাসি করে চেঁচালে। আমি বিশ্বাস করেও নিলাম। বুদ্ধদেব গুহর কথাটা মাথায় খেলল: একজন মেয়ে যাকে মন দিতে পারে, তাকে শরীরটা দেওয়া কিছুই নয়। এই শরীরে আছেটা কী? অথচ আশ্চর্য! নিরানব্বই ভাগ পুরুষের কাছে এবং সমাজ যাঁরা গড়েছেন, তাঁদের কাছে এই শরীরটাই দামি। মনের দাম নেই কানাকড়িও।


এই শরীরটা দেবার সময় সেদিন প্রথম, সুখ নয়, বরং ভয়টাই পেলাম, ভীষণ অপ্রস্তুত ছিলাম যে!


দেখলাম, অত তাড়াতাড়ি আমি আসলেই শরীর দিয়ে দিই কি না, তুমি সেই পরীক্ষাটা নিতেই আমায় পরীক্ষায় বসালে। আমি দিয়েই দিলাম পরীক্ষা। প্রথম পরীক্ষা, প্রথম দিন, প্রথম বার, প্রথম প্রেম, প্রথম ভয়। তুমি খুব ভালো করে সব কিছু লক্ষ করলে।


সেদিনই প্রথম তুমি বুঝতে পারলে আমার ভালোবাসার ক্ষমতাটা। ভালো না বাসলে অমন এককথায় শরীরের ভাঁজ খুলে দেয় কোন মেয়ে?


পরীক্ষা তুমি নিলে, অথচ উত্তরটা পেলাম আমি। কী অদ্ভুত, তাই না? এই বোকা আমিটাও সেইদিন বুঝতে পারলাম যে তুমি শরীর ছোঁবার পর থেকে আমায় ভালোবাসতে শুরু করলে। মানে আমার ভালোবাসা দেখেই আমায় ভালোবাসার সিদ্ধান্তটা সেদিন নিলে তুমি। আমি শরীর দিয়ে মন পেলাম, আর তুমি দিয়েছিলে কী, আর পেয়েছিলেই-বা কী সেদিন, আমি জানি না। তবে তোমায় ধন্যবাদ, একঝুড়ি মিথ্যের মাঝ থেকে সত্যটা বেছে নেবার সুযোগ আমায় করে দেবার জন্য।


আচ্ছা, ভালো তো বাসলে ওই দিনই, তবে তার আগে তুমি আমায় যেসব কথা বলেছিলে, সেগুলো তবে কী ছিল? ভালোবাসা নিয়েও এমন মিথ্যে বলে মানুষ? এতটা নোংরামো পারলে করতে?


আমরা তবুও একসাথেই ছিলাম। আমি সব জেনেও সেসময় আলাদা হতে পারিনি। কেন পারিনি, আজও সেই উত্তরটা খুঁজে বেড়াই। এটা ভুলে যাই যে, কষ্ট করলে প্রশ্ন হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু কষ্ট কিংবা ইচ্ছে করলেই উত্তর সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।


তার কয়েক মাস পর থেকে তোমায় দেখতাম একটু অন্য রকম। আমার কাছে তোমাকে এলোমেলো লাগত, কেমন জানি বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগত। মনে হতো, বেখেয়ালি চলনে দিনগুলি কাটাচ্ছিলে তুমি।
আমি কয়েক জনের মুখে শুনতে পেলাম, তুমি নাকি ‘বেটার অপশন’ খুঁজছ! হা হা হা…। এই ‘বেটার অপশন’ খুঁজতে খুঁজতে কত মানুষকেই তো ভিখিরি হয়ে যেতে দেখলাম! ভালোবাসায় ওসব গুড, বেটার, বেস্টও আছে? তুমি কি জানো, ‘বেটার অপশন’-এর সমার্থক কথাটিকে আসলে ‘লোভ’ বলে, যার পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু? অবশ্য লোভ যাকে একবার ছোঁয়, মৃত্যু ঘনিয়ে এলেও কি সে টের পায় কখনও?


যাকগে সেসব কথা! তো অনেক ভেবে চিন্তে তুমি ‘বেটার অপশন’, মানে তোমার সেই পুরনো মানুষটার কাছেই আবার ফিরে গেলে। সত্যিই, কমফোর্ট-জোন ছাড়াটা বরাবরই কষ্টের। আমি তোমার সাথে একমত।


কিছুদিন পর আবারও হঠাৎ লোকমুখে শুনলাম, প্রকৃতির অমোঘ বিচার অনুযায়ী তোমার সেই ‘বেটার অপশন’ নাকি তার জন্য যা ‘বেটার অপশন’, তার কাছেই চলে গিয়েছে।


এর পরে অনেক দিন কেটে গেছে, আরও ব্যস্ত হয়েছে দুনিয়াটা। আমিও হয়েছি অমন ব্যস্ত; তুমিও হয়েছ হয়তো---জানি না আসলে, অনুমানে বললাম। শুনেছি, তুমি নাকি খুব চুপচাপ হয়ে গেছ, কোথাও যাও না, কারুর সাথে কথাবার্তাও বিশেষ একটা বলো না। অবশ্য আমারও কিন্তু তোমার সাথে কথাবলার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না!


তার কিছুদিন পর তোমার আত্মাহুতির কথা শুনলাম। বিশ্বাস করবে? কেন জানি না, একটুও অবাক হইনি আমি। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।---এটা আপ্তবাক্যটা আমি শুধু মুখেই বলতাম, কিন্তু এটাকেই চরমসত্য হিসেবে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েই যেতে হলো তোমাকে?