আরেক জন্ম

অন্যদিনের মতোই, আকাশ থেকে ঝুপ করে শীতের সন্ধেটা নামল। ঝিঁঝিঁপোকার ক্লান্তিহীন ঝিঁঝিঁ। গাছের পাতায়-পাতায় সন্ধের ঘ্রাণটা আটকে-আটকে অন্ধকার বাড়াচ্ছে। সহস্র জোনাকির মিটিমিটি আলোকবিন্দুর মায়াজাল ফুঁড়ে মেঘের ফলার মতো হিম-হিম কুয়াশা গায়ে এসে-এসে বিঁধে। হঠাৎ, সে অস্ফুট আঁধারের বুক চিরে কানে এল দত্তবাবুদের বাড়ি থেকে উলুধ্বনির তীক্ষ্ণ শব্দ। মঙ্গলার্থে এ ধ্বনি শোনা যায়।—ছেলে হয়েছে রে, ছেলে! বাব্বাহ্‌! কী তেজ! সাতমাসেই বেরিয়ে গেলো! মানিকের অমন পীড়াপীড়িতে ওকে আর ভেতরে রাখতে পারল না বাবা লোকনাথ! কী দস্যি ছেলে বাবা, মায়ের পেট ফুঁড়ে বেরিয়েই পা ছুঁড়ছে কেমন করে দ্যাখ্‌ দ্যাখ্‌! পঞ্জিকাটা হাতে নে না বাপু, দ্যাখ্‌ না কোন তিথিতে এলো! ……. এমনি আরও অনেক কথায়, আশীর্বাদে, প্রভাময়ীর কোলে পরপর চার মেয়ের পর ঘর আলো করে এলো এক পুত্রসন্তান। দেখতে একেবারেই ছোটোখাটো গড়নের, ছোট্টো পুতুলের মতো হাত-পা ছুঁড়ছে শূন্যে। হাসিতে, গানে আর মিষ্টিতে সে সন্ধে মেতে উঠল, বাতি জ্বলে উঠল একে একে—বিজলি আর হৃদয়ের আলোয় সে বাড়ি ঝলমল করতে লাগল। ছেলের মাসি ছেলের নাম রাখলেন সায়ং। মানিক দত্তের মানিক সায়ং দত্ত। প্রভাময়ী দত্তের প্রভা সায়ং দত্ত। সকলের নয়নের মণি সায়ং। চার মেয়ের পর প্রথম পুত্রসন্তান হওয়ায় সায়ং সবার কাছ থেকে আদরটা একটু বেশিই পেত। সায়ং-সন্ধ্যায় সায়ংয়ের আশীর্বচন ধ্বনিত হতে লাগল—ঘরময়, উঠোনময়, সমস্ত উপকণ্ঠজুড়ে।

সায়ং চোখের রেটিনায় কিছু সমস্যা নিয়ে জন্মেছিল। রেটিনার লেন্স জন্মগতভাবেই অস্বাভাবিক ছিল। এই ব্যাপারটি ওদের বাড়িতে কেউই ধরতে পারেনি। ও যখন ক্লাস থ্রিতে, তখন এ সমস্যাটি প্রথম ধরা পড়ে। সবাই খেয়াল করলো, সায়ং বইপড়ার সময় বইটা একেবারে চোখের সামনে নিয়ে ধরে, লেখার সময় খাতার কাছে চোখ নিতে-নিতে একেবারে ঝুঁকে পড়ে। ডান চোখে কিছুই দেখে না, বাম চোখে একটু দেখতে পায়, ওইটুকু দেখতেও অনেক কষ্ট হয় ওর। কিছুক্ষণ পড়লেই চোখ থেকে অবিরাম জল পড়তে থাকে। ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার চশমা দিলেন। চশমা পরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও বই কাছে এনেই পড়তে হতো সায়ংকে, লিখতে হতো ওই ঝুঁকেই। এরকম করতে করতে, একসময় ওর পিঠের হাড়গুলি কেমন যেন বেঁকে যেতে লাগল, কুঁজো হয়ে হাঁটত, সোজা হয়ে বসলে পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা হত। অনেকেই আন্ধা, কানা, প্রতিবন্ধী সহ নানান কটূক্তি করে-করে ওকে খেপাত, ওসব বলে-বলে ওরা মনে শান্তি পেত। ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ স্বভাবের ছিল সায়ং। কাউকেই কোনো প্রত্যুত্তর দিত না, ওর মতো করেই পড়াশোনা করতে থাকে, ওর জীবনটাকে ওর নিজের নিয়মেই কাটাতে থাকে। বই চোখের কাছে নিয়ে পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল ও। ওভাবে পড়তে তেমন কোনো সমস্যা হতো না ওর। কিন্তু, ওকে ওভাবে পড়তে দেখে সবাই বলতো, “তুই তো একসময় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবি। জীবনে কিছুই করতে পারবি না। তোর পড়ে কী লাভ?” মনে-মনে অনেক কষ্ট পেলেও মুখে কিছুই বলতো না সায়ং, পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতা নীরবে সহ্য করতো—এর মধ্যে এক ধরনের শক্তি টের পেতো সে। অসীম দুঃখ আর তাচ্ছিল্য নেয়ার ক্ষমতা যার যত বেশি, জীবনকে অনুভব করার শক্তি তার তত বেশি। আঘাতেই মঙ্গল! মাথায় মুকুট পরার আগে নিজেকে ধুলোয় মিশতে দিতে জানতে হয়। কাঁটায় যার ভয় নেই, গোলাপ তো তার‌ই হাতে মানায়! কেউ কেউ বলতো, “আসলে প্রতিবন্ধীদের পৃথিবীতে বেঁচে না থাকাই ভাল। ওরা দুনিয়াতে আসেই সবাইকে কষ্ট দেয়ার জন্য। তুই মরে গেলে তোর বাবা-মা বেঁচে যেত।” সায়ং যার খায়ও না, পরেও না, এমন কারো মুখে এ ধরনের কথা শুনলে ওই নোংরা নর্দমার কীটের নাকে ঘুষি বসিয়ে দিতে পারতো খুব যৌক্তিকভাবেই, কিন্তু ও শুধুই হাসতো, মুখে কিছুই বলতো না। মনে-মনে নিজের কাছে এ শপথ করতো সবসময়ই: “আমাকে যে করেই হোক, অন্যদের চাইতে বেশি পরিশ্রম করতে হবে। যদি ওদের সাথে মেধায় না পারি, তবে ওদের চাইতে এগিয়ে যেতে হলে যতটা বেশি সময় পড়াশোনা করতে হয়, আমি তার চাইতেও বেশি সময় পড়াশোনা করবো। ওদের চাইতে এগোনোর আগ পর্যন্ত জীবনের সমস্ত সুখ আর আরামকে দূরে সরিয়ে রাখবো। একদিন না একদিন আমি কিছু একটা করে দেখাবোই দেখাবো। তাহলেই তো আর আমাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না।”

ওর বন্ধুরা যখন দুপুরে ঘুমিয়ে থাকত, ও তখন না ঘুমিয়ে পড়াশোনা করত। অন্যদের চাইতে অনেক বেশি সময় দিত পড়ার পেছনে। আসলে, ওকে দিতেও হতো, কারণ ও যতোই ভাবুক না কেন, ওর চোখে তেমন কোনো সমস্যা নেই, প্রকৃতপক্ষে ওর রেটিনা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। বই চোখের সামনে ধরে, কিংবা মাথা-ঘাড় নিচু করে প্রচুর পড়াশোনা করার কারণে, ক্রমেই ওর পিঠের-কাঁধের হাড়ে আর চোখে নানান সমস্যার উপসর্গ দেখা দিচ্ছিলো। কিন্তু, যতই শারীরিক কষ্ট হোক না কেন, ও কিছুতেই পড়াশোনা কমাতো না, বরং প্রতিদিনই একটু-একটু করে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো, প্রতিদিনই আগের দিনের চাইতে একটু হলেও বেশি পরিশ্রম করতো। ক্লাসের রেজাল্ট সবসময়ই ভাল হতো। প্রথম তিন জনের মধ্যে থেকে টার্ম পরীক্ষাগুলিতে পাস করতো। সুন্দর হস্তাক্ষর প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে পরপর তিনবার প্রথম হয়েছিলো। ক্লাস ফাইভে ওদের থানায় প্রথম হয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলো; ক্লাস এইটেও তা-ই। সায়ং তখনো ওর সমস্যার কথা ঠিকভাবে বুঝতে পারেনি। ও ভাবতো, ও যেভাবে চোখে দেখে, সেটাই ওর জন্য, এর বেশি দেখার দরকার হবে না ওর, ওটাই স্বাভাবিক। রেজাল্ট ভাল করতো আর ব্যবহারটাও ভাল ছিল বলে স্কুলের সবাই সায়ংকে ভালোবাসতো। ক্লাস নাইনে সবার পরামর্শে সায়েন্সে ভর্তি হলো। অনেক গ্রামের স্কুলের মতো ওদের স্কুলেও সায়েন্সের প্র্যাক্টিক্যাল করতে হতো না, এমনকি ফাইনাল একজামেও প্র্যাক্টিক্যাল করতে হয়নি, ল্যাব-অ্যাটেন্ডেন্টরাই সবকিছু করে দিয়েছিলো। তাই, তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই এসএসসি’তে গোল্ডেন এপ্লাস পেয়ে পাস করলো। ওদের এলাকা থেকে সায়ংই প্রথম গোল্ডেন এপ্লাস পায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ সায়ংকে, ওর বাবা-মা’কে সংবর্ধনা দিল। ফলে, এলাকায় ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। স্কুলে পড়ার সময় ফুটবল, ভলিবল, এবং অন্যান্য ইনডোর গেমস্‌ খেলতো। ক্রিকেট খেলায়, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির কারণে একটু সমস্যা হলেও, অন্য খেলাগুলিতে ভাল খেলার জন্য পুরস্কার পেতো। প্রাইভেটে একটু পেছনের বেঞ্চে বসলে স্যার বোর্ডে কী লিখছেন, সায়ং খেয়াল করতে পারতো না। সায়ংয়ের প্রতি বাড়তি কেয়ার নিতে চাইলে, বা ওর খাতায় স্যার নিজে লিখে দিতে গেলেই অন্যরাও আবদার করতো, ওদের খাতায়ও লিখে দিতে হবে। সায়ং কোনো ব্যাপারে একটু বেশি সুবিধা পাচ্ছে—এটা সায়ংয়ের ক্লাসমেটরা কেউ মেনে নিতে পারতো না। ফলে, স্যাররা ইচ্ছে থাকলেও সায়ংকে বাড়তি কোনো সাহায্য করতে পারতেন না।

এ পৃথিবীতে কেউই কাউকে একচুল পরিমাণও ছাড় দেয় না। যদি কারো শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকে, তবে সেটার জন্য সে বড়োজোর করুণা পায়, বাড়তি কোনো সুবিধা নয়। যার এক পা নেই, এভারেস্ট-জয়ের যাত্রায় তার জন্য দুটো অপশন: হয় সে পর্বতজয়ের মৃত্যুখেলায় নামবেই না, নতুবা ক্রাচে বা স্টিলের পায়ে ভর দিয়েই যে করে হোক, তাকে মৃত্যুফাঁদকে জয় করতে হবে—অবশ্যই, অন্যদের চাইতে কোনোদিক দিয়েই বেশি সুবিধা না নিয়ে। খেলায় নামার আগে ক্রাচে বা স্টিলের পায়ে ভর করে কীভাবে অন্যদের মতোই সে পথটা পাড়ি দিতে হয়, তা শিখে নিতে হবে—শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে বুড়োআঙুল দেখাতে অন্যদের চাইতে বেশি পরিশ্রম আর সাধনা করতেই হবে। জীবনকে কণামাত্রও ছাড় দেয়া যাবে না। তুমি জীবনকে ছাড় দিতে পার, কিন্তু জীবন তোমাকে একটুও ছাড় দেবে না—এটাই বাস্তবতা। সায়ং জানতো, শারীরিক ক্ষমতায় সে অন্যদের চাইতে পিছিয়ে। এও জানতো, অন্য দশজনের মানসিক ক্ষমতা এক করলেও, সেটা ওর মানসিক ক্ষমতার ধারেকাছেও যেতে পারবে না। অন্যদের আপত্তির কারণে, ওর খাতায় স্যার আর আলাদা করে লিখে দিতেন না। এতে প্রথম-প্রথম মনে কষ্ট পেলেও পরে-পরে সায়ংয়ের মধ্যে জেদ চেপে যায়। বাসায় ফিরে অন্যরা উচ্চতর গণিতের যে অংকটি একবার করতো, সায়ং সেটা তিনবার করতো। এসএসসি’তে ভাল রেজাল্ট করার পর সবাই ওকে সমীহ করতে শুরু করে। রেজাল্ট ভাল করায় সবাই বলছিলো, যে করেই হোক, ওকে ডাক্তার হতে হবে। যারা সায়েন্স থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ভাল করে, ওদেরকে নাকি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এসব হতে হয়। এটাই নাকি নিয়ম! সায়ং জানে, ওর চোখের এ অবস্থা নিয়ে সায়েন্সে পড়াটা ওর জন্য সহজ নয়। ওই বয়সে নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করার সামর্থ্য একটা ছেলের সাধারণত থাকে না। সবাই মিলে অনেকটা জোর করেই ওকে জেলার সরকারি কলেজে সায়েন্সে ভর্তি করিয়ে দিলো। সেই মফস্বল শহরটির একটা মেসে ও থাকত, টিউশনি করে চলতো। শুধু কলেজের খরচটা বাবার কাছ থেকে নিতো, প্রাইভেটও পড়তো নিজের টাকায়। টিউশনি চলে গেলে, কখনো-কখনো খাবার কেনার টাকাটাও থাকতো না, মাঝারি সাইজের এক প্যাকেট পাউরুটিতেই দুইদিন অনায়াসেই পার করে দিতো সায়ং। তবু, কোনোদিনই কোনো স্যারকে সে তার অবস্থার কথা জানিয়ে বেতন কম নিতে অনুরোধ করেনি। প্রবল আত্মসম্মানবোধের কারণে তাকে অনেক কষ্টভোগ করতে হয়েছে। এসবকিছু সায়ংকে স্পর্শ করতো না কখনোই। ও শুধু এইটুকুই জানতো, ওকে বড় হতে হবে। সবাইকে দেখাতে হবে, ও কিছুতেই বাবা-মা’র অক্ষম সন্তান নয়। এটা করার জন্য ওকে সব কষ্ট সহ্য করতে হবে।

ও যে এক চোখে কিছুই দেখতে পায় না, এটা ও বুঝেছিল এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর। এর আগে, ডাক্তার বললেও ও নিজে তা খুব একটা আমলে নিতো না। ওটা বোঝার পর টেনশনে ও খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফার্স্ট ইয়ারের পড়াশোনায়ও ব্যাঘাত ঘটছিলো। একদিন সায়ং জেলার একজন ভাল ডাক্তারের কাছে গেল। ওকে দেখেশুনে ডাক্তার বললেন, তোমার চোখের অবস্থা ভাল না। ঢাকায় একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞ দেখাও, দেরি করলে ভাল চোখটাও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। সেদিন থেকেই ওর জীবনটা অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করলো। ও জানলো, ও সত্যি-সত্যিই অন্ধ হতে চলেছে। এটা জানার পর, মানসিকভাবে সুস্থ থাকাটা বড় শক্ত। বাবার সাথে ঢাকায় এসে সায়ং এক কাজিনের বাসায় উঠলো। ঢাকায় নামকরা ডাক্তার একজনকে বাদ দিলেন না সায়ংয়ের বাবা। স্রোতের মতো পয়সা খরচ হতে লাগলো। একেকজন একেক কথা বলেন। কেউ কেউ বললেন, “বাবা, তুমি তো অন্ধ হয়ে যাবে। এর কোনো চিকিৎসা নেই। পড়াশোনা করে তেমনকিছু হবে না। তার চাইতে বরং অন্যকাজ কর, বিশ্রাম নাও। চোখের উপর কোনো ধরনের চাপ দিয়ো না।” যারা এমন কথা বলেছিলেন, তাদের জ্ঞানের ভার যেমনই হোক না কেন, ডিগ্রির ভার তাদের কথাকে ফেলতে দেয় না। ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে রীতিমতো অপারেশন থিয়েটার রেডি করা হল সায়ংয়ের চোখের অপারেশন করতে। ওরা বলছিলো, কোনো গ্যারান্টি দেয়া যাবে না। অপারেশন সাকসেসফুল হলে চোখটা ভাল হয়ে যেতে পারে, সাকসেসফুল না হলে চোখটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ভয়ে সায়ং কিছুতেই রাজি হলো না অপারেশনে। বাবাও বললেন, থাক্‌, কপালে যা আছে, তা-ই হবে। এরপর ওরা আবার বাড়িতে ফিরে এলো।

অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে থাকলে বাসায় সবাই মিলে ঠিক করলো, ওকে ভারতের শংকর নেত্রালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ওর ফার্স্ট ইয়ারের পড়া বন্ধ রেখে ওকে নিয়ে ওর মেজোদিদির বর ইন্ডিয়াতে গেলেন, উনি আগেও চেন্নাই গেছেন, কাজ চালানোর মতো ইংরেজি জানেন। ৪০ দিনের ভিসা। ওখানে রেটিনা স্পেশালিস্ট ডাক্তার প্রতীক রঞ্জন সেনকে দেখানো হলো। কিছু টেস্টের পর উনি বললেন, “এটা তোমার জন্মগত সমস্যা। তোমার জন্য ডাক্তারদের করার তেমন কিছু নেই। তোমার যা দৃষ্টিশক্তি এখন আছে, সেটা আর বাড়ানো সম্ভব নয়, তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে, এ দৃষ্টিশক্তি দিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে, বাড়তি কোনো সমস্যা হবে না।” সায়ং বলল, “কিন্তু, আমাকে যে ডাক্তার হতেই হবে, আমি মানুষের সেবা করতে চাই। স্যার, আপনি আমাকে দয়া করে সারিয়ে দিন।” “বাবা শোনো, মানুষের সেবা করা ইদানিং কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন অমানুষের সেবাই বেশি করি। অসুস্থ হয়ে আমাদের কাছে মানুষও আসে, অমানুষও আসে। ডাক্তার যেহেতু, করতে হয়ই। এখন সময়টা মানুষের সময় নয়। বাদ দাও সেসব কথা। তোমার কথায় আসি। যদি তুমি মানুষের সেবা করতেই চাও, সেটা অনেকভাবেই করতে পারো। শুধু ডাক্তাররাই মানুষের সেবা করেন না। অন্যান্য অনেক পেশায়ই এ মহৎ কাজটি করার সুযোগ আছে।” ডাক্তার সেনের সেদিনের একটা কথা সায়ংয়ের কিশোরমনে গভীরভাবে গেঁথে গেলো: Try not to become a man of success, but rather try to become a man of value. পরে সে জেনেছিল, কথাটা আলবার্ট আইনস্টাইনের। ডাক্তার সায়ংকে আবারও পড়াশোনা শুরু করতে বললেন। বললেন, “একমাত্র পড়াশোনাই পারে তোমাকে বেঁচে থাকার সময়টাতে সবার চোখে বাঁচিয়ে রাখতে। যত বেশি পড়াশোনা করবে, তত বেশি মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। পড়াশোনা আনন্দের জিনিস নয়। যত আনন্দ, পড়াশোনা শেষ করার পরেই। এর আগ পর্যন্ত কষ্ট পাবে, পেতেই থাকবে—সেটা মেনে নিয়ো। জীবনে কখনোই পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ করবে না।” সায়ংয়ের মনে হতে লাগলো, কোনো এক প্রাণের দেবতা ওকে আদর করে-করে জীবনের অর্থ বোঝাচ্ছেন। কেন কেউ কখনো ওকে দুটো ভাল কথা বলেনি? লোকে কী মজা পায় ওকে তাচ্ছিল্য করে? ডাক্তারের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় ওর চোখ ঝরলো।

ওরা দেশে ফিরে এলো। সায়ংয়ের বাবার জমানো সামান্য টাকার প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে গেলো। চোখ নিয়ে এসব ঝামেলায় পড়ে ততদিনে সায়ংয়ের ফার্স্ট ইয়ার শেষ। পড়াশোনা কিছুই হয়নি বললেই চলে। সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই একসাথে দুই বছরের পড়াশোনা শুরু করলো সায়ং। কী করবে, কীভাবে করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না সে। চোখে যতোই যন্ত্রণা হোক, শরীর যতোই খারাপ করুক, নিজের শরীরের সাথে যুদ্ধ করে মনের জোরে ধৈর্য ধরে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলো। ক্লাস করা, টিউশনিতে যাওয়া, রুমে পড়াশোনা করা—এ তিনেই দিন কাটছিলো ওর। প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে কিছু পারতো না বলে স্যাররা ক্লাস থেকে বের করে দিতেন, অনেকদিন সায়ংয়ের খাতা নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে মারতেন। ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করতো। কানা-কানা বলে খেপাতো। কলেজের মাঠে সায়ংয়ের গায়ে ঢিল ছুঁড়ে মারতো। সায়ং কখনোই কাউকে কিছু বলতো না, কোনো অভিযোগও করতো না কারো বিরুদ্ধে। সারারাত নীরবে কাঁদতো। ভেতরে-ভেতরে আরো বেশি করে জেদ চেপে যেতো। প্রাইভেটে ঠিকমতো পড়া বুঝতে পারতো না, বোর্ডে স্যাররা কী লিখলেন, দেখতে পেতো না, এর-ওর কাছ থেকে দেখে-দেখে খাতায় ক্লাসের পড়া তুলে নিতো। সবাই তাচ্ছিল্য করে বলতো, “সায়ং সাহেব বড় হয়ে প্রতিবন্ধী ডাক্তার হবেন। হাহ্‌-হাহ্‌-হাহ্‌-হাহ্‌-……” স্যাররাও কেউ কেউ বিরক্ত হতেন ওর জন্য বাড়তি সময় দিতে হতো বলে। বলতেন, “এসব পড়াশোনা-টড়াশোনা তোমার জন্য আসে নাই। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। তার চাইতে বরং কোনো দোকান-টোকানে বসে পড়লে কাজটা শিখে নিতে পারবে। জীবনে কিছু করে খেতে হবে তো! পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করলে তো না খেয়ে মারা যাবে।” সেই একটা বছর সায়ং শুধু কেঁদে কাটিয়েছে। রুমে এসে কাঁদতো আর দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনা করতো। যাকে নিয়ে কেউই কোনো স্বপ্ন দেখে না, সেও নিজের জন্য একটুখানি হলেও স্বপ্ন দেখে। হয়তো সেই খুব-সামান্য স্বপ্নেই বেঁচে ছিল সায়ং। ও জানেই, ও জীবনে কিছু করতে পারবে না। তবু, ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় বেঁচে আছেই যখন, তখন নিশ্চয়ই এ বেঁচেথাকাটা নিরর্থক নয়। ঈশ্বর তো আর কাউকে এমনি-এমনিই বাঁচিয়ে রাখেন না! ও বেঁচে আছে মানেই হলো, ওকেও এ পৃথিবীর প্রয়োজন—ও কিছুতেই মূল্যহীন নয়। শরীরে যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণই নিজের সাথে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে যাবে। প্রয়োজনে মরবে, তবু কিছুতেই হারবে না।

যা-ই হোক, এভাবে দিন কেটে গেলো। সায়ং এইচএসসি পরীক্ষা দিলো, ৪.৭০ পেলো। এসএসসি’র তুলনায় রেজাল্ট খারাপ করায় সবাই খুব তিরস্কার করেছিলো। ও যে চিকিৎসা করাতে গিয়ে এক বছর ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারেনি, সেটা কেউ মাথায় আনলো না, সবাই শুধু রেজাল্ট নিয়েই কথা তুললো। বলছিলো, ও নাকি শহরে গিয়ে মেসে থেকেছে, প্রেম করেছে, সিনেমা দেখেছে, সিগ্রেট ফুঁকেছে আর তাস খেলেছে। পড়াশোনা কিচ্ছু করেনি। শুধু শুধু বাপের টাকার শ্রাদ্ধ করেছে। কানা প্রতিবন্ধী ছেলে, বাপকে পথে বসাবে। অথচ, এদের মধ্যেই কেউ কেউ ওর এসএসসি’র রেজাল্টের পর ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। তখন বলেছিলেন, সায়ংয়ের মতো এমন সোনার টুকরা ছেলে আর হয় না, ও এ গ্রামের গর্ব, এরকম আরো কত কী! ওই নিন্দুকের দলে কেউ কেউ ছিলেন, যারা সায়ং এসএসসি’তে ভাল করার পর অভিনন্দন না জানালেও এইচএসসি’তে আশানুরূপ রেজাল্ট না করায় তেড়ে এসেছিলেন কটু কথার শাণিত বর্শা হাতে। থাকে কিছু ফালতু লোক—ভাল কাজের প্রশংসা করতে জানে না, মন্দ কাজের নিন্দা করতে ঠিকই ছুটে আসে। সায়ং কোনো অজুহাত দেখালো না, কোনো প্রতিবাদ করলো না, কোনো নিন্দুককেই থামিয়ে দিয়ে নিন্দা করার অপার্থিব সুখ থেকে বঞ্চিত করলো না—শুধুই নীরবে মাথা নিচু করে শুনে গেলো, আর আড়ালে চোখের জল ফেললো।

সায়ংকে সবচাইতে বেশি উৎসাহ দিতেন ওর সেজোদিদি। উনি একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। সবসময়ই বলতেন, “সায়ং, দেখিস, তুই পারবি। এতো অসুস্থ শরীর নিয়ে যা করেছিস, তোর জায়গায় অন্যকেউ হলে, কখনোই তা করতে পারতো না। কারো কথায় কান দিস না, ভাই। তুই তোর কাজ করে যা। শুধু কাজে ফাঁকি দিবি না, নিজেকে ফাঁকি দিলে সে ফাঁকির শাস্তি থেকে রেহাই পাবি না। তোর কাজ কী, তা বুঝে নে, সেটা মনপ্রাণ দিয়ে করতে থাক্‌, বাকিটা ঈশ্বর দেখবেন।” আত্মীয়স্বজনের নানান ধরনের আজেবাজে কথায় সায়ংয়ের বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। আর্থিকভাবে আগেই ভেঙে পড়েছিলেন, এবার মানসিকভাবেও ভেঙে পড়লেন। সায়ং মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো, অনার্সে আর যা-ই হোক, সায়েন্সের কোনো সাবজেক্ট নিয়ে সে পড়বে না। সায়েন্সে পড়তে বড় কষ্ট হয়, এ শরীর নিয়ে সায়েন্সে আর না। ঢাকায় ভাল কোনো পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং করতে চাইলো। বাসায় কিছুতেই রাজি হলো না। বললো, আর পড়াশোনা করতে হবে না, এবার কিছু একটাতে ঢুকে যা। ওর কাকা ওর জন্য একটা পিয়নের চাকরিও যোগাড় করে ফেললেন। অনেকটা গোঁয়ার্তুমি করেই, ওর জন্মদিনে বড় মামার কাছ থেকে উপহার-পাওয়া দামি রিস্টওয়াচ আর টিউশনির টাকায় কেনা সস্তা মেইড-ইন-চায়না হ্যান্ডসেটটা বিক্রি করে, সে টাকায় কোচিং-এ ভর্তি হলো। অল্প বেতনে একটা টিউশনিও জুটিয়ে ফেললো যাতে বিভিন্ন ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার ফরমগুলি কিনতে পারে, যাওয়া-আসার খরচ মেটাতে পারে। ও ততদিনে বুঝে গেছে, ওকে কেউ ভার্সিটির ফরম কেনার টাকাও দেবে না।

সায়ং দৈনিক ১৭-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খাজুরাহো বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলো। সবকটাতেই ভাল মেরিট-পজিশনে চান্স পেলো সায়ং। খাজুরাহো বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাতালিকায় ৩৪তম হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২তম। কিন্তু কেউই ওকে খাজুরাহো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দিতে রাজি হচ্ছিলো না, ওখানকার পরিবেশ নাকি ভাল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ওদের বাড়ি থেকে কাছে বলে ওকে ওখানেই ভর্তি হয়ে যেতে বলছিলো সবাই। সায়ংয়ের অনেক স্বপ্ন, ও খাজুরাহো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, দেশের অনেক বড়োবড়ো মানুষ ওখানে পড়েছেন, ওদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে খাজুরাহোর পুণ্যধুলো মাথায় নিয়ে জীবনকে ধন্য করবে। পরে ওর সেজোদিদি আর দাদাবাবুকে অনেক বলেটলে রাজি করাল যাতে ওরা বাবাকে বোঝায়। বাড়িতে অনেক ঝামেলা সহ্য করে কষ্টেসৃষ্টে খাজুরাহো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল সায়ং। ভর্তি হওয়ার পুরো টাকাটা দিয়েছিল ওর সেজোদিদি। ও চাইলেই কলা অনুষদে আইন বা ইংরেজি নিয়ে পড়তে পারতো। কিন্তু সবাই ওকে বুদ্ধি দিলো, “আইনে পড়ে কী লাভ? তুই তো চোখে দেখিস না। প্র্যাকটিস্‌ করবি কীভাবে? আর ইংরেজি সাহিত্য তো অনেক কঠিন, বেশি পড়াশোনা করতে হয়, তোর রেজাল্ট খারাপ হবে, পড়তে-পড়তে অন্ধ হয়ে যাবি। তার চাইতে বরং সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়্‌। সাবজেক্ট ভাল, পাস করাও সহজ। আর পাস করে বের হলে, বিসিএস শিক্ষা-য় হলেও কলেজে কোনোরকমে একটা চাকরি জোটাতে পারবি।” বাড়ি থেকে ওকে আরো বলে দেয়া হলো, ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময় কারো নিষেধ শোনেনি, সাবজেক্ট সিলেকশনেও ওদের কথা না শুনলে কখনো ওর কোনো কাজেই ওরা আর মাথা ঘামাবে না।

ওদের কথামতো, সায়ং তা-ই করলো। এরপর শুরু হলো আরেক মহাযুদ্ধ। হল, ডিপার্টমেন্ট, ক্যাম্পাস কোথাও তেমন কোনো বাড়তি সহানুভূতি পেলো না। সায়ংয়ের খুব কষ্ট হত সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে। একেকসময় মনে হতো, আত্মহত্যা করে। পরক্ষণেই, ও নিজেকে বোঝাতো, আর কিছু হোক না হোক, অন্তত, যারা ওর সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে, তাদেরকে, উচিত জবাব দেয়ার জন্য হলেও জীবনে কিছু একটা করতেই হবে। যদি ও মরেই যায়, তবে তো ওসব অমানুষদের কাছে হার মেনে নেয়া হল। কিছুকিছু ছেলেমেয়েকে দেখে ওর মনে হতে থাকে, খাজুরাহো বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মানুষ নয়, অমানুষ বানানোরও কারিগর। অসুস্থ মানসিকতার, বিকৃত রুচির কিছু-কিছু অমানুষ এখান থেকে উচ্চমর্যাদার সার্টিফিকেট নিয়ে ‘উচ্চশিক্ষিত’ হয়ে সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়। ওর মনে পড়ে যায়, খাজুরাহো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান থেকে অনার্স-মাস্টার্স করা রাজন নামের এক বহুজাতিক কোম্পানির চাকুরে-পশু ওদের পাশের গ্রামের দীপা দিদিকে বিয়ের ৬ মাসের মধ্যেই, যৌতুকের জন্য কেমন নৃশংসভাবে পিটিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিলো। ভাবতে-ভাবতে, সায়ংয়ের মুখে একদলা থুতু জমে ওঠে, ও সেটা ফেলে না দিয়ে গিলে ফেললো। ঘৃণার আগুন ভেতরে ধারণ করতে হয়, তবেই তা তীব্রভাবে নিজেকে দহন করে। সে উন্মত্ত জেদের বারুদ বুকের ভেতর থেকে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে-মেরে মানুষকে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারতে চায় যেন! একটাসময়, সে তাপে সবকিছু জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়—ভেতর থেকে নিখাদ মানুষটাই বেরিয়ে আসে।

এভাবেই দিন কাটছিলো সায়ংয়ের। প্রতিদিন ক্লাস করতো, ক্লাসনোট তুলতো, টিউশনিতে যেতো, রুমে এসেই একটুও সময় নষ্ট না করে পড়াশোনায় ডুব মারতো। ভার্সিটি-লাইফে দুজন ভাল বন্ধু পেয়েছিল সায়ং, যারা নিঃস্বার্থভাবে ওকে ভালোবাসতো, ওকে নানানভাবে সাহায্য করতো, ওর প্রতি সত্যিই আন্তরিক ছিলো—প্রদ্যুম্ন আর বায়েজিদ। মেয়েদেরকে মোটামুটি এড়িয়েই চলতো সায়ং, কিংবা, ওরাই ওকে অতো পাত্তাটাত্তা দিতো না—সেটাই ছিলো ওর চোখে সহজ আর স্বাভাবিক। ভার্সিটিতে উঠে সে যেন হয়ে গিয়েছিল মা বসুমতীর একনিষ্ঠ ভক্ত; মাথা নিচু করে চোখজোড়া মাটিতে রেখেই ক্যাম্পাসে হাঁটত সায়ং। তবে, ওদের ক্লাসের নীলাক্ষির সাথে কখনো-কখনো কথা হতো ওর, তাও খুব অল্প সময়ের জন্য—হয়তো দুটো ক্লাসের মাঝের ফাঁকা সময়টিতে। সায়ং ওর সাথে কথা বলে আনন্দ পেতো, কারণ সে মেয়েটি সায়ংয়ের দিকে তাকিয়ে ভীষণ মিষ্টি করে হেসে কথা বলতো। একদিন মেয়েটি সায়ংকে ইনবক্সে লিখে পাঠালো:

আকাশের ওই গায়ে ফালি-ফালি করে কাটা মেঘের ছোটো-ছোটো রথ কী অপার সৌন্দর্য নিয়ে ঠাঁই বসে আছে, আছে তো আছেই…….ছড়ানো নীলটা যেন মুঠোমুঠো সাদার খেলার সঙ্গী, লুকোচুরি খেলছেই তো খেলছে—দেখলেই ভারি আনন্দ হয়। তাই, আকাশটাকে আমার কী যে আপন লাগে! যতটা সময় ধরে দেখা যায়, ততটা সময়ই আমি দুচোখ ভরে ওই স্বচ্ছ নীলে ঘুরে আসি, তুলো-মেঘের মৃদুনাচন দেখে-দেখে ভাসি। আমার এ নীল আকাশের নাম দিলাম—ভালোবাসা। এ আশ্চর্য যাদুর ক্যানভাস কীভাবে যেন মুহূর্তেই রং বদলায়! শুধু আমিই থেকে যাই পুরনো, বিবর্ণ। তবে, মাঝে-মাঝে ওই নীল আকাশের রংতুলিতে আমি আমার এই মনটাকে ইচ্ছেমত রাঙাই। একদিন এক বুড়োথুবড়ো দুপুরে আকাশটাকে বললাম, “অ্যাই শোনো! আমায় একটু বৃষ্টি দাও না গো!” অমনিই সে বললো আমায়, “বালিকা, আমার যে এখন রোদ্দুর ছড়ানোর প্রহর গো! তুমি বরং এই মিঠেরৌদ্রের নিবিড় ছায়ায় আমার ভালোবাসা খুঁজে নাও। আমার এই ঐশ্বর্য আমি তোমায় উজাড় করে দিলাম।” আমি ওতেও মহাখুশি! আকাশের সাথে যে আমার জন্মজন্মান্তরের মিতালি, এ নরোম আবদার না মেনে কি পারি গো! এই যে, শুনছ? যেদিন ওই লাল-লাল দালান টপকে-টপকে রুপোলী চাঁদটা আকাশের গায়ে লেপটে থাকবে, তোমায় নিয়ে আমি জোছনায় ভিজবো ভেবে রেখেছি, গেয়ে উঠবো দুধের ফেনার মতো ধবধবে শুভ্র পবিত্র আলোয়…….ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো…….আচ্ছা আকাশ, বলো তো দেখি, ‘ও’ কি আমায় এমন করে ভালোবাসবে গো, যেমন করে আমি তোমার রুপোলী জোছনাকে ভালোবাসি? বলো না গো, ‘ও’ ভালোবাসবে তো? ও আকাশ, শোনো না! সেদিন নাহয় তুমি একটু বৃষ্টি দিও গো, যেদিন আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটবো। বৃষ্টিতে ভিজবো আর একটু পরপরই গেয়ে উঠবো দুজনে। ভীষণ মজা হবে, তাই না, বলো? এই এই এই! তুমি কিন্ত সেদিন বৃষ্টি দিও মনে করে, কেমন? তোমার-আমার এই মিতালির গল্প শুনাবো আমার ‘ও’কে। শুনে কী যে হিংসেয় ওর মুখটা কুচকুচে কালো হবে! তখন আমি তোমার দিকে তাকিয়ে প্রাণভরে খিলখিল করে হাসবো, এতো এতো এতো হাসি হাসবো, বিশ্বাস কর! যখন ‘ও’ আমার থেকে লুকিয়ে ছিলো সেই অচিন মেঘেদের রাজ্যে অনেক অনেকদিন ধরেই, আমায় কষ্ট দিয়েছিলো, সব, সবকিছুর শোধ আমি এ হাসি দিয়েই তুলবো, ও আকাশ, তুমি দেখো! ওর হিংসেয় জ্বলেযাওয়া মুখটা ভেবে আমার কী যে ভীষণ ভাল লাগে! শুনো গো আকাশ, ও বেলায় আমি আবার আসবো, আর তোমায় গান শুনাবো বলে বুকের ভেতর অনেক যত্নে গানের কথাগুলোকে থরে-থরে সাজিয়ে রেখেছি। তুমি থাকোওওও…….! আমি আবার আসবো। ফিরে আসবো, ‘ও’কে বুকের মধ্যে লুকিয়ে!

সায়ং, এই সায়ং, এই! তুমি আমার ‘ও’ হবে? হও না, প্লিজ! হয়ে যাও না! একটু করে হলে কী হয়?

এই মেসেজ পড়ে সায়ং ভয়ে কেঁপে-কেঁপে ঘামতে শুরু করল। এর আগে কেউ এমন করে বলেনি তো! ওর মতো ছেলেকে কোনো মেয়ে ভালোবাসতে পারে, সেটা ওর কষ্টকল্পনাতেও কখনো আসেনি। যাকে কেউ কোনোদিনই ভালোবাসেনি, সে নীলাক্ষির ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখবে কীকরে? ও নাহয় চোখে দেখে না, কিন্তু নীলাক্ষি তো চোখে দেখে। এমন ভুল কীভাবে মেয়েটি করে বসলো? নিশ্চয়ই এ চিঠি ও মেয়ের কোনো এক ঠাট্টা! নিরীহ ছেলেদের নিয়ে মজা করতে অনেক মেয়েই তো পছন্দ করে। সায়ংকে অসহায় করে দিয়ে পরে ঠিকই নীলাক্ষি পালিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই এটা একটা ফাঁদ……ফাঁদ…….ফাঁদ! কিছুতেই নীলাক্ষি সায়ংকে ভালোবাসতে পারে না। মিথ্যে, সব মিথ্যে! মেয়েদের সাথে শুধু বন্ধুত্বই করা যায়, প্রেম নয়। ওকে যে অনেক বড় হতে হবে, অনেক!—এই তুচ্ছ ভালোবাসার চাইতে অনেক বড়। সায়ং বিশ্বাস করে নিলো, ইনবক্সের ওই মেসেজটা পড়ার মুহূর্ত পুরোটাই একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন! দুঃস্বপ্ন দ্রুত ভুলে যেতে হয়! সেদিনের পর থেকে ভয়ে আর কোনোদিনই সায়ং কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেনি।

একসময় অনার্স শেষ হলো, মাস্টার্স শেষ হলো। অনার্সে রেজাল্ট এলো ৩.৭২, মাস্টার্সে ৩.৮৪। অনার্সের পরপরই অন্য সবার মতো অ্যাপিয়ার-সার্টিফিকেট দিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় অ্যাপ্লাই করল সায়ং। সেসময় মানসিক চাপ আর ভীষণ ধন্দে পড়ে গেলো, কোটায় আবেদন করবে, কী করবে না, এ নিয়ে। পরে সবার পরামর্শে কোটাতেই অ্যাপ্লাই করল ও। সবাই বলছিল, “তুমি তো আসলেই প্রতিবন্ধী, একেবারে জেনুইন! বানানো সার্টিফিকেট দিয়ে তো আর অ্যাপ্লাই করছো না। আজব! এতে লজ্জার কী আছে? তাছাড়া, প্রতিবন্ধী কোটায় চাকরি পাওয়া একেবারেই সহজ। দিবে আর চাকরি হয়ে যাবে। শুধু প্রিলিটা পাস করলেই হবে।” সবার এসব কথা বলার ধরনে অনেক কষ্ট পেলেও, চাকরি পাওয়ার আশায়, নিজের অনিচ্ছার সাথে অনেক যুদ্ধ করে কোটাতেই আবেদন করল সায়ং। লোকে, কখনো-কখনো, নিজের দুর্বলতার সুযোগও নিয়ে বসে! ও পুরনো চোখে দেখলো, কাউকে ছোট করতে পারলে মানুষ যে কত বড় মনে করে নিজেকে! কারো দুর্বল জায়গাতে বারবার আঘাত করায় কী যে সুখ! অবশ্য, সায়ং ওতে অভ্যস্ত। আঘাত না করে থাকতে পারার শক্তি যে কত বেশি, সে খোঁজ সায়ং ভাল করেই জানে। হাসিমুখে স্বভাবসুলভ মৌনতাতেই রয়ে গেল সে। অমানুষিক পরিশ্রম করে মাস্টার্সের পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল সায়ং। প্রায়ই মনে-মনে ভাবতো, ওর এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। কত মানুষ অন্ধ হয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ঘোরে, ও তো তাও এক চোখে দেখে। এটা মনে এলেই, ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে সায়ংয়ের হৃদয়। নিজের সবটুকু ঢেলে নিজেকে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে লাগলো সে। চোখের উপর ভীষণ, ভীষণ চাপ পড়ত। চোখ থেকে অনবরত জল ঝরতো, পাশে রুমাল নিতে পড়তে বসতে হতো ওকে। ও নিজেকে বোঝাতো, “হয় চোখ, নয় চাকরি। থার্ড কোনো অপশন নেই। জীবনে কিছু করতে না পারলে এ চোখ দিয়েই বা কী হবে? আমি এখনো দেখতে পাই, এ যে আমার পরম ভাগ্য! চোখটা নষ্ট হয়ে গেলেই বা পৃথিবীর এমন কী ক্ষতি হতো? এ সৌভাগ্যকে অবহেলা করা যে বড় পাপ!”

বিসিএস পরীক্ষা হলো, রেজাল্ট হলো। সায়ং বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে মেধাতালিকায় ৭ম হলো। রেজাল্টের পরও অনেকে বলতো, সায়ং আসলে কোটায় চাকরি পেয়েছে, মানুষকে মিথ্যা কথা বলে সে, অহেতুক ভাব নেয়। কিছু-কিছু মানুষ আছে, যারা মানসিকভাবে এতোটাই বিকৃত আর অসুস্থ যে, মানুষহত্যা মানুষের আইনে অপরাধ না হলে, ওদেরকে রাস্তাঘাটে কুকুর-শেয়ালের মতো পিটিয়ে মেরে ফেললে পৃথিবী কিছুটা হলেও কলংকের ভারমুক্ত হতো। আবার, রেজাল্টের পর আরেক শ্রেণীর ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’র নবজন্ম হল, যারা সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলো, ওরা নাকি জানতোই সায়ং জীবনে ভালকিছু করতে পারবে। ওরা তাই সবসময়ই ওর পাশে থেকেছে, ওকে সাহস যুগিয়েছে, আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে। অথচ, সায়ং ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে কখনো এক পয়সাও কারো কাছ থেকে নেয়নি, টিউশনি করে নিজের সকল খরচ চালিয়েছে। সেজোদিদির কাছ থেকে পাওয়া ভার্সিটিতে ভর্তির টাকাটাই ওর পরিবার থেকে নেয়া শেষ টাকা। ওর যে মেজোকাকা প্রায়ই ওকে বলতেন, “তোর জন্মই হয়েছে তোর বাবার মৃত্যুর পর বাবাকে মুখাগ্নি করতে। নইলে, চারবোনের পর ভগবান আমাদের পরিবারে এরকম একটা প্রতিবন্ধী পাঠাবেন কেন? মুখাগ্নি করার প্রথম অধিকারী তো পুত্র, তাই তুই পৃথিবীতে এসেছিস। ওটাই তোর একমাত্র কাজ। যে কাজের জন্য এসেছিস, সে কাজের জন্য অপেক্ষা কর। তুই জীবনে আর কিছুই করতে পারবি না।” সেই কাকাই সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন, উনি নাকি সবসময়ই সায়ংয়ের খোঁজখবর রাখতেন, ওকে নানানভাবে সাহায্য করতেন, ঢাকায় গেলেই সায়ংয়ের সাথে দেখা করতেন, সায়ং উনার গর্ব, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব মানুষের কথা ভাবলেও, ওদেরকে চেপে ধরে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে, রাগে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। সায়ং এসবের কিছুই করে না, ওর যা করা প্রয়োজন ছিল, ও তা করে ফেলেছে।

সায়ং কখনো কারো কাছ থেকে শোনেনি যে, ও জীবনে কিছু করতে পারবে। তবে হ্যাঁ, একজনই শুধু বলেছিল, “তুমি পারবে।” সে মানুষটির সাথে ওর কোনোদিনই দেখা হয়নি। শুধু ফোনে কথা হতো। মাঝেমাঝে যখন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতায় নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেলতো, আর পারতো না স্থির থাকতে, তখন একটু শান্তি আর সাহসের আশ্রয় খুঁজে পেতে অসিত দাদাকে ফোন করে কথা বলতো সায়ং। এই একটি মানুষের সান্নিধ্যে এলে সায়ং বেঁচে থাকার, জীবনে কিছু করতে পারার স্বপ্ন দেখতো। উনার আন্তরিক কণ্ঠস্বরও অসীম শান্তি ছড়িয়ে দিতো সায়ংয়ের মনে, সমস্ত শরীরে। অসিত দাদা সায়ংকে বলতেন, “আরে বোকা, কাঁদিস না। তোর নাম্বারটা আমার মোবাইলে কী নামে সেভ করা জানিস? ‘হিরো সায়ং’ নামে। তুই নিজের চেষ্টায় এতদূর এসেছিস, ভাবা যায়? তোর জায়গায় অন্যকেউ হলে পারতো নাকি এতো? প্রশ্নই আসে না! তুই তো নায়ক হয়েই আছিস রে পাগল! মনে রাখিস, নায়করা কক্ষনো কাঁদে না। ওরা হাসে—একেবারে শেষে। ওরা হাসে, যখন হাসিটা জীবনে বড় প্রয়োজন। ওদের সে হাসি আর থামেই না। তখন বড় ভাল লাগে দেখতে। চোখের জল নয়, ঘাম ঝরা, ঘাম! এ পৃথিবী…….অশ্রুর নয়, ঘামের দাম দেয়।” অসিত দাদার কথা তন্ময় হয়ে শুনতে-শুনতে সায়ংয়ের মনে হতো, চোখের জল মুছে দেয়ার জন্য হলেও জীবনে কাউকে লাগে।

বিসিএস ভাইভাতে সায়ংকে যেরকম প্রশ্ন করা হয়েছিলো, সেরকম কঠিন প্রশ্ন সাধারণত ভাইভাতে ধরে না। পুরো ভাইভা হয়েছিলো ইংরেজিতে, বিভিন্ন কূটনৈতিক বিষয়ের উপর বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নই ছিল বেশি। অথচ, সায়ংয়ের ফার্স্ট চয়েজ ছিল বিসিএস প্রশাসন। ইকোনমিক্স আর লিটারেচার থেকে অনেক প্রশ্ন করা হয়। সমাজবিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক নানান প্রেক্ষাপট থেকে ঘোরানো প্রশ্ন করে ওকে আটকে দেয়ার চেষ্টা করেন প্রশ্নকর্তারা। ওর ইকিউ আর আইকিউ টেস্ট করতেও বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়। দুটো প্রশ্নের উত্তর একদমই পারেনি, তিনটার উত্তর দিয়েছিলো আংশিক, বাকি সবকটারই সঠিক উত্তর করতে পেরেছিল সায়ং। ওকে ৩৪ মিনিট রাখা হয় ভাইভা-বোর্ডে।

পুরনো দিনগুলির কথা সায়ংয়ের খুব মনে পড়ে। যারা ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে, নানান কটু কথা শুনিয়েছে, প্রতিনিয়তই কষ্ট দিয়েছে, ওর রেজাল্ট জানার পর ওদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছে, ওর বড় জানতে ইচ্ছে করে। সায়ং এতো প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও অনার্সের অ্যাপিয়ার-সার্টিফিকেট দিয়ে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় জীবনে যতদূর এসেছে, ওরা সারাজীবন চেষ্টা করলেও কিছুতেই এর অর্ধেকও আসতে পারবে না; ও যে অফিসের অফিসার হবে, সে অফিসের পিওন হওয়ার যোগ্যতাও ওদের নেই—এসব ভাবনা ওকে এক ধরনের শক্তি দেয়, স্বস্তি দেয়। এ শক্তি এমন শক্তি, যা কাউকে দৃশ্যত আঘাত করে না, অথচ সে শক্তির অদৃশ্য আঘাতে সবকিছুই ভেঙে চুরমাচুর হয়ে যায়, সে শক্তির সামনে দাঁড়াতে পারে না কিছুই। সাফল্যের চাইতে মধুর প্রতিশোধ আর হয় না। নিজের চেষ্টা আর আত্মত্যাগে যে স্বস্তিটা সে অর্জন করেছে, তার বিশালত্বের খোঁজ ওসব রাস্তার কুকুরগুলো কখনোই পাবে না। সায়ং কারো উপরেই প্রতিশোধ নেয়নি, অথচ সবাই আজ ওর কাছে পরাজিত। কথা বা পেশীশক্তি ছাড়াই জিতে যাওয়ার আনন্দটা রক্তের ভেতরে শিরায়-শিরায় টগবগিয়ে খেলে। শুধু একটা কথাকেই হৃদয়ে ধারণ করে সায়ং জীবনের পথে হেঁটেছে: যে করেই হোক, আমাকে অন্যদের চাইতে বেশি পরিশ্রম করতে হবে, একটু হলেও এগিয়ে থাকতে হবে অন্যদের চেয়ে।

পুনশ্চ। আমার একটা নোট আছে। নাম, ‘লাইফ, নট গ্রেডস্‌’, বছর চারেক আগে লেখা। সে নোটের শেষ অনুচ্ছেদটা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। করি…….

“গতকাল এক ছেলে ফোন করল। ওর এবং ওর আশেপাশের সবার বিশ্বাস, ও জীবনে কিছু করতে পারবে না। কেন? জন্মগতভাবে ওর দুই পা-ই বাঁকানো, ক্রাচে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে হাঁটে। এরকম যারা, ওদের কেউ ভালোবাসে না, শুধু করুণা করে। ওর ক্ষেত্রেও সবসময়ই এ-ই হয়ে আসছে। মানুষের অবহেলা ওকে পথের কাঙাল করে ছেড়ে দেয় প্রতি মুহূর্তেই। তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন করে একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করতে থাকে, তেমনি করে একটুখানি ভালবাসার জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে! ওকে কেউ কখনো ভালোবাসেনি। এর ফলে ও সবসময়ই এসব নিয়েই ভাবতে অভ্যস্ত—ওর কী কী নেই, কোন কোন চাকরি ওর জন্য নয়, ওর কাউকেই কোনোকিছুই দেয়ার নেই। ওর সমস্ত ভাবনার শতকরা আশিভাগই কী কী ওর জন্য নয়, তা নিয়ে। প্রচণ্ড হতাশা, কষ্ট, অভিমান আর বিষণ্নতায় ওর প্রায়ই মনে হয়, চলে যাই সবকিছু ছেড়ে। যাকে এ পৃথিবীতে কেউই চায় না, সে থাকেই বা কীভাবে? . . . . . . ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম। ওকে শেখালাম, কীভাবে করে সেই আশিভাগকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়, বাকি বিশভাগকে নিপুণ হাতে একশোভাগে নিয়ে যেতে হয়। এ পৃথিবীতে শুধু কান্নাই ব্যক্তিগত। এটা নিয়ে বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর সমান। কান্না সবার সাথে ভাগাভাগি করতে হয় না। সবাই আপনার কষ্টের দাম বুঝবে না। থাকুক না কিছু কান্না ব্যক্তিগত! কষ্টের শক্তি অনেক বড়। এর খোঁজ করতে জানতে হয়। . . . . . এমন আরো অনেককিছু বললাম। ওকে এটা বিশ্বাস করিয়ে দিলাম, পৃথিবীতে ওর মূল্য অনেক। যাদের কাছে ওর দাম নেই, তাদেরকে ইউজড টিস্যুপেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। সাহসী হতে শেখালাম, শক্তির জায়গাগুলি চিনতে শেখালাম। দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠের একটা ছেলে হেরে যাবে কেন? আমি চাই, ও হারিয়ে না যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট পোলিও আক্রান্ত ছিলেন। হুইলচেয়ারে বসেই উনি ১২ বছর আমেরিকা শাসন করেছেন বিশ্বের সবচাইতে সংকটপূর্ণ সময়ে। উনার মতো সফল রাষ্ট্রনায়ক কয়জন আছে? এমন উদাহরণ আরো ভূরি ভূরি দেয়া যাবে। উনারা পারলে ও কেন পারবে না? যখন ওকে বললাম, ভাই, তুমি চাকরি পাওয়ার পর প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে কিন্তু! তখন সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। আমি জানি, চোখের জল কখনো মিথ্যে বলে না। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, ও পারবেই!”

……………এই ছেলেটির নাম দিলাম, সংশপ্তক। সায়ং আর সংশপ্তক—একই মানুষ? ওরকম কেউ, বা ওরা, আদৌ কি আছে? এতক্ষণ যা লিখেছি, তা কি সত্যি? নাকি, এতো এতো কথার ফুলঝুরি স্রেফ গল্পের খাতিরে গল্পের জন্ম দিতে?…….এসব প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। বস্তুত, অমন লড়াই করে যারা বাঁচে, তারা সবাইই—একই মানুষ।