উপাসনা, ঘরোয়া ও যতিচিহ্নময়

 
এ পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যাদের জন্য কেউ কখনও অপেক্ষা করে থাকে না। যদি তোমার জীবনে এমন কেউ থাকে যে তোমার জন্য অপেক্ষা করে, তবে তুমি ওদের চাইতে অনেক ভাগ্যবান। ওদের শুধুই ঘর আছে, ঘরের মানুষ নেই। তোমার ঘরও আছে, ঘরের মানুষও আছে।


কিছু কঠিন কঠিন কথা বলব। কিছু মনে কোরো না।


ধরো, তুমি এই পৃথিবীতে বাবা-মায়ের পরে একজন মানুষকেই শুধু ভালোবাস। যাকে ভালোবাস, সে তোমার ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু, ঠিক ঠিক বুঝতে পারে। অন্যদের সে খুব আনন্দের সাথে জানায় তুমি তাকে কতটা ভালোবাসো, তোমার কিছু কিছু অতি পাগলামোর কথা অথবা তার জন্য করা কাজগুলোর গল্প সে সবার সাথে শেয়ার করে এবং সে এটিও সবাইকে জানায় যে তোমার ভালোবাসাটা একতরফা, সে সবাইকে এটাও বোঝায় যে--কেউ এতটা ভালোবাসলে তাকে একেবারে ইগনোর করা যায় না, আর এজন্যই সেও কখনও কখনও কিছুটা সময় পেলে রেসপন্স করে, কিন্তু আসলে এখানে তার কোনও প্রকার আবেগ অথবা ভালোবাসা কাজ করে না। অবশ্য এতে তার কোনও অসুবিধা নেই যে তুমি তাকে এভাবে ভালোবাসছ, সে জেনেবুঝেই সব মেনে নেয়। এসব জানার এবং বোঝার পর তার প্রতি...
১. তোমার অনুভূতি কেমন হবে?
২. এই সম্পর্কটিতে তুমি নিজেকে কোন অবস্থানে দেখ?
৩. তার প্রতি তোমার আগামী সিদ্ধান্ত কেমন হওয়া উচিত বলে তুমি মনে কর?


যেখানে একটা সম্পর্কে কম বেশি যা-ই হোক, দুজনেরই কিছুটা ভূমিকা প্রয়োজন, সেখানে একজনের নিয়মিত ভূমিকায় সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়া যায় না, আর সেটা উচিতও না। কেননা সেক্ষেত্রে একপক্ষ একটা পর্যায়ে এসে সম্পর্কটাকে ‘ফর গ্রান্টেড’ ধরে নেয়। যেকোন‌ও সম্পর্কের বেলায়‌ই 'ফর গ্রান্টেড' ব্যাপারটা অনেক রকমের অনর্থ ঘটায়। এমন একটা সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত আসলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যেকোনও সম্পর্ক…তা ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা যা-কিছুরই হোক না কেন, সব সম্পর্কেই কিছুটা ভালোবাসা, সাথে আন্তরিকতার প্রয়োজন। শুধুই প্রয়োজনের তাগিদে যে সম্পর্ক, তা প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার সাথে সাথেই কেমন যেন বিশ্রী রকমের হিসেবি হয়ে যায়। তখন কখনও কখনও পুরনো ক্ষোভ, না পাওয়া, অবহেলা…এগুলো একের পর এক মনে জঞ্জাল তৈরি করতে থাকে। সম্পর্ক যখন এরকম শুধুই প্রয়োজননির্ভর হতে থাকে, তখন একে আর এগিয়ে না নেওয়াই বরং ভালো, তাতে অন্তত ভবিষ্যতে কোনও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয় না। সব সম্পর্কেই আসলে কিছুটা চাহিদা, প্রয়োজন থাকেই। মূলত কোনও সম্পর্কই প্রয়োজন ছাড়া গড়ে না, টেকেও না, কিন্তু সম্পর্কটাতে প্রয়োজনগুলো অবশ্যই দুদিক থেকেই থাকতে হয়। দুদিকেরই কিছু না কিছু দিতে হয়। ভালোবাসা না দিলে যেমন ভালোবাসা পাওয়া যায় না, তেমনি ভালোবাসা পেতে হলেও কিছুটা ভালোবাসা দিতে হয়। আবার ভালোবাসা পেতে চাইলে সবার আগে ভালোবাসাকে গ্রহণ ও ধারণ করার ক্ষমতা থাকা চাই।


যার অধীনে আমরা থাকি, যার অধীনে কাজ করি অথবা যাদের জন্য আমাদের পেট চলে বা চালিয়ে নিই, তাদেরকেও কিন্তু আমাদের...যা-ই হোক, একটা সেবা দিতে হয়। যদি তা না দিতাম, তা হলে আমরাও বাঁচতে পারতাম না। আমরা যখন ভিক্ষুককে কিছু দিই এবং অনেক সময় অন্যদের না জানিয়েই দিয়ে থাকি, তখনও কিন্তু আমরা মনে মনে স্রষ্টার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই দিই। আমাদের হয়তো সেই মানুষটার কাছে কোনও চাহিদা থাকে না, কিন্তু স্রষ্টার কাছে ঠিক ঠিক একটা কিছু তার প্রতিদানে আশা করে বসে থাকি। সেটা হয়তো শুধুই স্রষ্টার অনুগ্রহ অথবা নিতান্ত কিছুই না হলেও নিজের মানসিক স্বস্তির উদ্দেশ্য থাকেই। আবার অনেক সময় অবিমিশ্র মানসিক তৃপ্তির জন্যও আমরা সাহায্য করে থাকি, সেখানেও কিন্তু একটা কিছু প্রাপ্তির আশা থাকে বলেই দিই। সে প্রাপ্তি হতে পারে কেবলই মনের প্রশান্তি। যদি সেটুকুও না থাকত, আমরা তা হলে কারও জন্যেই কিছু করতাম না। আর যদি কখনও এমন কোনও মুহূর্ত আসে, যখন একজন মানুষকে ভালোবাসার কেউই নেই, তখন সে মানুষটার কী করা উচিত? অন্যের দ্বারে দ্বারে ভালোবাসা খোঁজা উচিত, না কি নিজেরই নিজেকে এতটা ভালোবাসা উচিত যেন অন্য কারও ভালোবাসার প্রয়োজনই না পড়ে?


আত্মকথন। আমার মাঝে এত শক্তি কই! কোথায় পাব অত ধৈর্য, অত সাহস! অতটা উদার হতে যে বিশাল একটা মন চাই--একটা শুদ্ধতম মন, সে যে বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার অমন একটা মন ধারণ করা! খুব যে বলি ভালোবাসি, তাহলে ভালোবাসাটা কি আসলেই এতটা সহজ কিছু? মানুষ কতটা পারে অমন প্রতিদানশূন্য একটা মন নিয়ে আজীবন ভালোবেসে যেতে? সে ভালোবাসায় থাকে কি আর সেই প্রথম দিনের প্রথম ছোঁয়ার মতো নিবিড় আবেগ, বিশ্বাস অতটা কিংবা শ্রদ্ধা আদৌ? ভালোবাসা কি জ্ঞাতসারেই মানুষকে কাঁদায় তবে? যে ভালোবাসা সবচাইতে তীব্র, তার কি আদৌ কোনও ভাষা হয়? ভালোবাসার সব অনুভূতি ওভাবে শব্দ কিংবা বর্ণমালার ফ্রেমে যায় বন্দি করা? চুপটি করে প্রতিদিন যে মায়া বাড়াই, সে জেগে-ওঠা মায়া ক্রমশই ভালোবাসা নামের এক ঋণ-বোঝা সাথে করে নিয়ে বুকের কোমল জায়গায় খুঁড়ে খুঁড়ে গভীর সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে থাকে। সে মায়া শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে আর একটা বৃত্তের চারিদিকে শুধু নির্বাক এক আর্তনাদে ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে…তবুও প্রকাশিত হয়ে যাবার যুতসই যোগ্য কোনও ভাষা খুঁজে পায় না কোথাও! সে ভালোবাসার আসলে কী যে হবে…সেগুলো কি ওভাবেই বন্ধ-দুয়ারে চিরকাল দম আটকে থাকতে থাকতে দুম্‌ করে মরে যাবে একদিন? কে বলে পৃথিবীটা ভালোবাসাশূন্য হয়ে পড়ে আছে? ওরা কি জানে এই পৃথিবী কত লক্ষ-কোটি বছরের অগুনতি ভালোবাসা নিজের বুকের গভীরে ধারণ করে আছে? পৃথিবী ফুরিয়ে যাবার দিনও সেসব ভালোবাসা ফুরোবে না। আমরা আমাদের মনের কতটা অংশ জানি? আমাদের স্মৃতিতে হয়তো ধুলো জমে যায় আর নতুন নতুন ভালোবাসার স্তূপ জমতে থাকে, তাই বলে কি পুরনো স্মৃতি সব ঝেড়ে ফেলে দিতে পারি? ভালোবাসার ধূলিকণা সাথে করে নিয়েই মানুষ কবরে যায়। ভালো হতো খুব, যদি সে জমানো ভালোবাসাগুলো একদিনে ধুয়েমুছে সরিয়ে দেওয়া যেত অনেক দূরে...যারা সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপহার দেয়--যারা প্রতিনিয়ত‌ই সামান্য অজুহাতের রেশ ধরে অমন হাজারো ভালোবাসার হিরণ্ময় মুহূর্তগুলো দিয়ে যায়, তারা জানে কি আদৌ যে তারা কতটা ধনী? এই জীবনটাকে পুড়িয়েও যদি অমন একটা শুভ্র মন বানাতে পারতাম...


তুমি আমাকে লক্ষ্মী বল, কিন্তু আমি তো লক্ষ্মী না, একেবারেই লক্ষ্মী না আমি, বরং আমি সম্পূর্ণ এর বিপরীত। আমি তোমাকে জ্বালাই, আমাকে ফোন করতে বাধ্য করি, আমার সাথে কথা বলতে বাধ্য করি, অন্য কারও সাথে তোমাকে দেখলে আমি হিংসা করি, আমি যখন তোমার উপর কষ্ট পাই তখন তোমাকে আঘাত করে কথা বলি, আমি তোমার সাথে তখন অস্বাভাবিক আচরণ করি…আদর করে কথা তো বলিই না…বরং তোমাকে কষ্ট দিই! আমি তো মোটেও লক্ষ্মী না, তা হলে তুমি আমাকে লক্ষ্মী কেন বল, পাখি? আমি যত দিন লক্ষ্মীর মতো কিছু না করব, তুমি আমাকে কখনও তত দিন লক্ষ্মী বলবে না। এটা আমার শাস্তি। আমি যা করেছি, সেজন্য এটাই প্রাপ্য আমার। আমি এখন ঘুমিয়ে পড়ব। আর শোনো, আমি তোমাকে জ্বালাবই জ্বালাব। আমাকে মেসেজ পাঠাও না কেন? কেন খোঁজ নাও না আমার? আমার ভাগের সময় আমাকে দিতে হবে…হবেই। আমার সময় আমাকে দাও। দেখো, আজকে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাব। সারারাত তোমাকে জড়িয়ে ধরে রাখব। তার পর তুমি যেয়ো যেখানে যেতে চাও। আমার মনটা একটু খারাপ। আগামী মাসে আব্বু-আম্মু হজ্ব করতে যাবে। আমি কখনও এভাবে আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে সম্পূর্ণ একা থাকিনি। তুমিও নেই পাশে…অনেক দূরে আছ তো, তা ছাড়া তুমি ব্যস্ত থাক...অবশ্য ঠিক আছে, যেভাবেই আছ…আছই তো! তোমার জন্য অপেক্ষা করি, আমার ভালো লাগে। এর বাইরে আর কিছু করার আছে আমাদের? তুমিই বলো! আর একটা কথা। তুমি আমাকে ইংরেজিতে কিছু লিখে পাঠাবে না। তুমি আমাকে ইংরেজিতে কিছু লিখে পাঠালে আমার মনে হয়, তুমি আমার উপর রেগে আছ, আর আমাকে বকছ।


আচ্ছা, আমি কি ঝামেলা করি বেশি? কিন্তু আমি তো ঝামেলা করবই। তুমি বলেছিলে না প্রতিদিন তুমি আমাকে ফোন করবে? আর আজকে মাসের কত তারিখ? তুমি এই মাসে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলোনি?...আমি ইদানীং কিছু করছি না। গত দুদিন আমি একটুও পড়িনি এবং কিছু লিখিওনি। সারাদিনই কী সব ছবি নিয়ে থিসিস করেছি। আমাকে একটা বকা দিয়ে দাও তো খুব দ্রুত! সরি, একটু ভুল বলেছি…আমি সারাদিন তোমার ছবি নিয়ে পড়ে ছিলাম। আর শোনো বাবুই, তুমি গতকালও আমার সঙ্গে চালাকি করেছ, আমি কালকে বুঝতে পারিনি, একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, আজকে বুঝতে পারছি। সেটা হচ্ছে, তুমি গতকাল আমাকে ফোন দিয়েছ ঠিকই, কিন্তু তুমি আমার কথা বলোনি, অন্যান্য কাজের কথাই বলেছ শুধু। এমন করা উচিত না। তুমি আমাকে একটু বকা দাও না কেন, আমি পড়াশোনা না করলে তুমি আমাকে বকা দাও না কেন? ভালোবাসলে বকা দিতে হয়, তাও জানো না? তুমি এত বোকা কেন? আচ্ছা, তুমি কী জানো আসলে? আমি তোমাকে ভীষণ মিস করি, এজন্য আমার পড়াশোনার কথা মনে থাকে না। আমি কী করব, তুমিই বলো? আমি কোথায় যাব? আর হচ্ছে, আমি ঠিক করেছি, আমি তোমাকে মেসেজ করে জ্বালাব, এবং জ্বালাবই! আমি জানি, আমি তোমাকে কখনও কখনও ভুল বুঝি। কিন্তু আমি তাও বলব, বলেই যাব যা বলতে ইচ্ছে করে।


মণি, আমার আজকাল কী যেন হয়েছে, জানো? তবে হয়েছে আজকাল না, ঠিক কবে থেকে তাও বলতে পারব না। সব কিছু কেমন যেন হয়ে গেছে আমার মাঝে। আমি একেবারে বদলে গেছি, আমি লন্ডভন্ড হয়ে গেছি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি শূন্যে ভাসছি, আমার মনে হয় আমার শরীর বলতে কিছুই নেই। আমি বাতাসের সাথে ভেসে বেড়াচ্ছি। আমি এখানে নেই, আমি সেখানে নেই, আমি যেন কোথাও নেই! এমন কেন হচ্ছে, বলো তো? তুমি কি আমাকে এভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অনন্তকাল…আমি কি শুধু ভেসে বেড়াব বাতাসের সাথে? একদিন আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে না আমি দূর থেকে ভালোবাসা অনুভব করতে পারি কি না, আমি তোমাকে অনুভব করি কি না? আমার কাছে ভালোবাসা মানে শুধু তুমিই। আমার পৃথিবীর একেবারে ছোট্ট একটা গণ্ডির মাঝে আমি আজ পর্যন্ত শুধু তোমাকেই অনুভব করেছি, কখনও কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারেনি। না, আমি এসব কখনও তোমার কাছে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। আমি আজও তোমাকে বোঝাতে পারি না আমার জীবনে তুমি যে কী, আমার জীবনে তোমার ভালোবাসা কী...পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা যেসকল অনুভূতি, সেগুলো কখনও কোনও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি আমার অনুভূতির কিছুই বলতে পারিনি, আমি পারিই না ওগুলো লিখতে, আমার যে অত ঐশ্বর্য নেই। তুমি জানো না, এমনকি তুমি ধারণাও করতে পার না কতটা এলোমেলো করে দিয়ে যাও আমাকে…প্রতি মুহূর্তেই।


আমার কতটা জুড়ে তুমি আছ, সে আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু বুঝি না…শুধু জানি, আমার মাঝে আমিই আর নেই, আমি সত্যিই আর আমি নেই। আমি যে সবটাই বদলে গিয়ে কেবলই তুমি হয়ে গেলাম। আমাকে স্থির হতে যে বল, আমি কী করে নিজেকে স্থির করব? আমি কী করে নিজেকে বশ করব? আমাকে নিয়ন্ত্রণের যে চাবি, সে যে তোমারই হাতে! তুমি চাইলেই আমি সব পারি, তুমি বললেই সব হয় আমার মাঝে, তোমার ইচ্ছে আমার ভেতরে প্রস্ফুটিত হয়, আমি অনুভব করতে পারি। এছাড়া আমি যে আর কিছুই জানি না। তুমি ধ্যানমগ্ন হও, তার পর আমাকে বলো--এটা করো, ওটা করো…আমি সব করি, আমি সব কিছু হই, আমি সব পারি তোমার জন্য, যেন এক জাদুর কাঠি পেয়ে গেছ তুমি আর আমি হলাম কাঠের পুতুল…আমি নাচি, আমাকে নাচানো হয়, আমি না নেচে থাকতে পারি না! আমি কেন এমন হয়ে যাই? হয়তো আমি এমনই হতে চাই। আমি ভেসে কতটা আর যাব দূরে? সেই তোমারই তীরেই তো আছড়ে পড়ব অবশেষে! আমি আসলে জানতে চাই না ভালোবাসা কী, কী করে তা ধরে রাখে, কেমন সে অমূল্য অনুভূতি! আমি শুধুই জানি, আমি ভালোবাসি, আমি নিজেই জ্যান্ত একটুকরো ভালোবাসা! তুমি চাইলে আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি না চাইলেও আমি তোমায় ভালোবাসি। তুমি দেখলে ভালোবাসি, তুমি না দেখলেও ভালোবাসাটা ঠিক তেমনই থাকে। আমার ভালোথাকার উপকরণ তুমি, আমার মন্দথাকার উপকরণও শুধুই তুমি। আমি যে কথাগুলো কখনও বলতে পারিনি, অথবা এখনও যে কথাগুলোর কোনও ভাষা আমার কাছে নেই, ওগুলো আমাকে সারাক্ষণই ভেতর থেকে জ্বালিয়ে মারে। আমি ছটফট করতে থাকি। এসব কী আসলে?


আমি ভাবি, আমি বোধহয় মরে যাব, না হলে এমন কেন হয়? এত সুখ, এত এত মায়া, এত জ্বালা শরীর মন সবটা জুড়ে…আমি কী করব এগুলো নিয়ে যদি তোমার কাছে পৌঁছুতে না পারি? ভালোবাসা--সে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি! সে অনুভূতি শুধু ভাগ্য নিয়ে জন্মালেই পাওয়া যায়, ধারণ করা যায়। সে অনুভূতিটুকু একটু একটু করে শিরায় প্রবেশ করে সারাশরীর আন্দোলিত করে। তুমি জানো, আজকাল তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি একদৃষ্টিতে তো তাকিয়েই থাকি, আর কিছুই মনে থাকে না, সময় গড়িয়ে যায়…যেতেই থাকে যেতেই থাকে, মনে হয় যেন সারাটা জীবন আমি শুধু তোমাকে দেখেই কাটিয়ে দিতে এসেছি, আমার কোনও কিছুর তাড়া নেই, আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই। তোমার যদি কখনও আমাকে অনুভব করার শক্তি হয়, তা হলে আমার বুকে মাথা রেখে দেখো আমি তোমার কতটা আর কতটা আমার নিজের...ওভাবে কিছু বলাও যায় না--সে অনুভূতি, সে উত্তাপ শুধু যে ধারণ করে, সে-ই জানে…যেমন তার জ্বালা তেমনই তার শক্তি! তার প্রখরতা, তার মলিনতা শুধু যে কেড়ে নেয় তা-ই নয়, এ যে মুঠোয় পুরে আস্ত একটা জীবনই এনে দেয় আমায়! মাঝে মাঝেই ভীষণ ইচ্ছে হয় তোমার সারাশরীর জুড়ে আমার স্পর্শ এঁকে দিতে। একটু একটু করে তোমার সবটা শুষে নিতে ইচ্ছে হয় তখন। নিজেকে তোমার কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে শুদ্ধ হতে ইচ্ছে হয়। আমার মন তোমাকে চায়, আমার শরীর তোমাকে চায়, আমার আত্মা তোমার জন্য ছটফট করে মুক্তির আশায়...আমি কি মুক্তি পাব কখনও, আমি কি কখনও আর নিজের করে পাব নিজেকে, আমি যে নিজেকে ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি...এই ভালোবাসা বাদেও আর কোন সে ভালোবাসা, যার কিছুই আমি জানি না? ভালোবাসার আরও আছে কি কোনও রকমফের? ভালোবাসা এর ঊর্ধ্বে আর কী হতে পারে?


আমাকে ছেড়ো না, কক্ষনো ওই খোলা পথে একা ছেড়ে দিয়ো না আর, আমি যে দিকশূন্য হয়ে কোথাও মরে পড়ে থাকব! আমার শুরু যেখানে হয়েছে, আমার শেষটা ওখানেই হতে দাও। আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে দাও, আমাকে ক্ষয়ে যেতে দাও, আমাকে এই আবেশে আস্তে আস্তে নিভে যেতে দাও। ভালোবাসা কখনও কমে না, জানো তো? ভালোবাসা একটুও কমে যায় না কখনওই। হয়তো প্রকাশের ভাষাগুলো বদলে যায়, কিন্তু নিঃসন্দেহে ভালোবাসা বাড়তেই থাকে…প্রতিদিন হাজারো রকমের ভালোবাসা জন্ম নেয়। যাকে মানুষ একবার ভালোবাসে…সত্যিই ভালোবাসে, তার স্মৃতি কখনও ভোলা যায় না। তার কথা হৃদয়ে উঁকি দেয়, উন্মাতাল করে দেয়…কারণে বা অকারণে…সময়ে আর অসময়ে।…আমার কী যেন হয়েছে, কিছুই ভালো লাগে না, কিছুই খারাপ লাগে না, কোনও কিছুতেই কিচ্ছু হয় না আমার। আমার কী হয়েছে...? আচ্ছা, তুমি অনেক দিন একটাও ভালোবাসার কবিতা লিখ না। প্লিজ, একটা ভালোবাসার কবিতা লিখো…আমার জন্য হলেও!


ও আমার জানপাখি গো, হ্যাঁ, আমি জানি আমি তোমাকে কথায় কথায় ভুল বুঝি, তোমাকে টেনে অভিযোগ তুলি নানানভাবে, কিন্তু তুমি কি জানো, আমি তোমার সাথে অমন করি যেন তোমার কাছে থেকে আরও একটু বেশি আদর আদায় করে নিতে পারি, সেজন্য। আমি যদি তোমার কাছ থেকে আদর আদায় করে নিতে পারি, তা হলে তুমি কেন তা দিবে না? বলো! ওটা তো আমার অধিকার, কেননা রাগ করে হোক, অভিমান করে হোক, তোমাকে জ্বালিয়ে হোক…যে করেই হোক, আমি তো ওটা আদায় করে নিয়েছি! তা হলে তুমি কেন দিবে না? এত কিপ্টেমি কীসের তোমার? আমি জানি, তুমি আমার কাছ থেকে শারীরিকভাবে অনেক অনেক দূরে, কিন্তু মানসিকভাবে আমি তোমাকে আমার কাছে রাখবই…হ্যাঁ, রাখবই। আর আমি যদি সেটা করতে পারি, তা হলে তুমি কেন আমার কাছে থাকবে না? আচ্ছা, যদি চাও তো যাও, থেকো না সেটুকুও। তোমায় পেতে আমার তোমাকে লাগেই না আর! আচ্ছা, তোমার এই কয়েক দিনের লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, আমার যা বলার ছিল, তার সবই তো তুমি বলে ফেলছ, তা হলে আমি আর কী বলব? আমার জন্য কিছুই যে বাকি নেই। আমি তো এগুলোই লিখতাম, কিন্তু তোমার মতো এত গুছিয়ে লিখতে পারতাম না। আমি আর লিখবই না কিছু, আমার সব কথাই তোমার চোখে পড়তেই বরং ভালো লাগছে...


জোর করে ঘর করতে হচ্ছে, এমন একজন মানুষের সাথে থেকে থেকে নিজেদের জীবন বিষিয়ে তুলে সন্তানের অজুহাত দেখানোর কী অর্থ? ওর জন্য তোমরা আলাদা হতে পারছ না, তাই না? এটা বলে কী বোঝাতে চাও তোমরা? সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তোমাদের এই সংসার? এত ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমৃত্যু দুজন একসাথে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছ? দুজন দুদিকে, একসাথে থাকতে গেলেই যেখানে অশান্তি ছাড়া আর কিছুই করতে পার না, সেখানে আদৌ কি তোমরা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আলাদা হচ্ছ না, না কি হচ্ছ না তোমাদের চারপাশের সমাজের ভয়ে? না কি নিরাপত্তার ভয়? মেয়েরা বোধহয় অধিকাংশই নিরাপত্তার ভয় পায়। এরপর কই যাব, কীভাবে কাটবে বাকিটা জীবন!....আর তোমরা কিনা সেই সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর দায় সন্তানের উপরেই চাপাও! যখন তোমাদের বিশ্রী ঝগড়াগুলো শুধুই তোমাদের দুজনের মধ্যে থাকে না অথবা ওই চারদেয়ালের মাঝে থাকে না, তখন? তখন তোমাদের লজ্জা করে না? তখনও তোমরা সন্তানের অজুহাত দাও? কই, দাও না তো! সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ইগো বিসর্জন দিয়ে ঝগড়া বাদ দিয়ে চুপচাপ সহ্য করতে পার না তখন? তোমরা কি মনে কর না সংসারের প্রতিদিনের অশান্তি সন্তানের উপর, তার জীবনের নানান সম্পর্কের উপর বিশ্রী প্রভাব ফেলে না? ওর সামনে ঝগড়া করতে থাক আর ওদিকে ওর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশটা হয় ভীষণ বাজেভাবে। ওকে জন্ম দাও প্রতিদিন এভাবে একটু একটু করে মেরে ফেলার জন্যই? ওহ্‌, ওটা তো তোমাদের অধিকার, তাই না? তোমাদের নিজেদের সন্তান, সুতরাং তোমরা ওর সাথে যা খুশি তা-ই করতে পার! জেনে রেখো, এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ‌ই মুক্তির দাবি রাখে।


একটা বাচ্চা ছোট থেকেই নিজের ঘরেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কেন? ওর সামনেও তোমাদের মুখের ভাষায় কোনও কিছুই বাঁধ সাধে না...কেন? না কি ওগুলো সব সামাজিকতা দেখাবার সময় ব্যবহারের জন্য তুলে রেখেছ? না কি তোমরা নিজেদের ফেরেশতা মনে কর, আর এভাবেই সংসার টিকিয়ে রাখাকে মহৎ কাজ বলে ধরে নাও? সন্তান কি তোমার একার, না কি তার একার? তার পর সন্তানের সামনে একে অপরকে বাজেভাবে প্রেজেন্ট কর…কাকে কর? যাকে কর, সে আসলে তোমার কে হয়? তুমি যদি তোমার সন্তানের সামনে তারই মাকে খারাপ বল, তবে যখন ওর বুদ্ধি হবে, তখন কি সে তোমাকে সম্মানটা করবে আদৌ? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধুই ভালোবাসার আর একসাথে থাকার সম্পর্ক--কে বলল? কারা বলেছিল এমন কথা? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মানে একে অপরের দোষ ঢেকে রাখার একটা সম্পর্ক। এটা তোমার বাড়ির গুরুজনেরা শিখিয়ে দেননি? তোমার স্ত্রীর বাড়ির গুরুজনেরা তাকে শেখাননি? কেন শেখাননি? না কি তাঁরাও এভাবেই চালিয়ে এসেছেন? তুমি নিজ দায়িত্বে কেন শিখে নাওনি? সে কেন নেয়নি? বিয়ের আগে কেন এগুলো পরিষ্কার করে নাওনি? তুমি কি বিয়ের সময় প্রাপ্তবয়ষ্ক ছিলে না? সে ছিল না? তার পরও তোমাদের একসাথে থাকার দায় সব গিয়ে পড়ে ওই ছোট্ট বাচ্চাটির উপরই…কেন? ওর কী দোষ? ও বড় হচ্ছে, ওর সামনে ঝগড়া কেন করবে তোমরা? ওর সামনে এমনভাবে কেন থাকবে যাতে করে ওর মনে হয় আমার বাবা-মায়ের মাঝে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস কিছুই নেই, এমনকি ওরা একে অপরকে ন্যূনতম সম্মানটুকু পর্যন্ত করে না? তোমরা ওকে এভাবে এমন একটা পরিবেশে বড় করবে, আবার ওর কাছ থেকেই ভালো কিছু আশা করবে…ফাজলামো পেয়েছ নাকি?


নিজেদের প্রয়োজন, নিজেদের দায়িত্ব কেন নিজেরাই বসে ভাগ করে নাও না? আসলে তোমরা যার যার জায়গায় নিজেকে কী মনে কর? সে তোমার যোগ্য না, তুমি তার যোগ্য না…এইসবই তো, না? জানতে না বিয়ের আগে যে বিয়েটা শুধুই নিজের জন্য নয়? কী কী আশা করেছিলে? কী কী ব্যাপারে নিরাশ হয়েছ? একটা কাগজে লিখে ফেলো তো! দেখবে, নৈরাশ্যের জায়গাটা যত বড়, তার চাইতে অনেক বড় তোমাদের মনে স্রেফ অনিচ্ছা বা বিতৃষ্ণার জায়গাটা। সত্যি সত্যি ওরকমই দেখবে! লোকে সঙ্গীর সাথে থাকতে চায় না, ঠিক আছে…কেন যে চায় না, তা সে নিজেই জানে না! কিংবা যে অজুহাতগুলো দাঁড় করায়, সেগুলো বেশিরভাগই খুব ঠুনকো! আচ্ছা, বাদ দিই এসব! তোমাদের কথায় আসি। তোমার সুখ খুঁজতে তুমি তোমাকে নিয়ে থাকবে, তার সুখ খুঁজতে সে অন্য কিছু নিয়ে থাকবে, এর মাঝে আবার কোন আহ্লাদে নতুন মানুষটাকে টেনে আনলে? ও কি নিজের ইচ্ছেয় এখানে এসেছে, মানে তোমাদের দুজনের মাঝে? আনলে কেন তাকে? তোমাদের বুড়ো বয়সে দেখার জন্য? না কি তোমাদের এই প্রাত্যাহিক ভজনগীত শোনাবার জন্য? বাবা-মা হয়েছ বলে কি সন্তানের সব কিছু অধিকার করে বসে আছ? প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ঘরে থাকলেই অশান্তি কর, এসবের অর্থ কী? আবার বল বাবা-মা হওয়া নাকি সহজ না…সহজ কী তা হলে? তোমাদের রোজরোজ ঝগড়া, একটা পর্যায়ে হাতাহাতি নয়তো ভাঙচুর…এই তো তোমরা করবে! সন্তানের মানসিক অবস্থা বলে কিছু একটা আছে, সেটা জানা আছে তোমাদের? ও ছোট থেকেই এমন পরিবেশ পেলে হাওয়ায় হাওয়ার ভালো মানুষ হবে না, ভালো কিছু দিবে না কখনওই…আর সেক্ষেত্রে তোমরা ওর কাছ থেকে বেশি কিছু আশা কোরোও না।


সন্তান সন্তান করে আর কত? নরকে যাবার জন্য মরতে হয়…কে বলল? নিজের ঘরকেই নরক বানিয়ে রাখলে...মৃত্যু--সে আবার নতুন কী! আদর্শ বাবা আদর্শ মা হবার আগে আদর্শ সঙ্গী হওয়াটা বেশি জরুরি নয়? আমরা যতটা স্বামী হয়ে উঠি, যতটা স্ত্রী হয়ে উঠি, ততটা বন্ধু হয়ে উঠতে পারি না কখনওই! সুখী দাম্পত্যের মূল রহস্যই হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক বন্ধুত্ব। মনে রাখবে, সন্তানের তোমাদের দুজনেরই প্রয়োজন, একছাদের নিচে থেকেও যদি দুজন মিলে একজন মানুষ হতে না পার, তা হলে প্লিজ, সন্তানের উপর সে ব্যর্থতার অজুহাত চাপিয়ে দিয়ো না। আর শোনো, তোমাদের সন্তানেরও একটা মন আছে, তোমরা এক হয়ে থাকতে না পার, ওকে অন্তত এটা বুঝতে বাধ্য করে দিয়ো না যে পৃথিবীতে কেউই তেমন সুখে নেই। একটা শিশু যদি ছোটবেলা থেকেই ভাবতে শিখে যায় যে এ পৃথিবীতে সে এসেছে কেবলই দুঃখ পেতে, তবে তার পক্ষে কখনও বুদ্ধির ও ভাবনার উন্মেষ ঘটানো সম্ভব নয়। তাই অন্তত ওর জন্য হলেও একসাথে বসে আলোচনা করে যা করার থাকে, যতটা ছাড় দিয়ে করার থাকে…তা-ই কোরো, প্লিজ কোরো। আর হ্যাঁ, আমি পারিনি, ওরাও পারেনি, তাই বলে তোমরাও কি পারবে না? যার যার জীবন তার তার। একজনেরটা আরেকজনেরটার সাথে মিলে না কখনওই। আমি আসলেই একটা ফাজিল আর ড্যামকেয়ার টাইপের মেয়ে ছিলাম, তাই পারিনি। আমি সম্পর্ককে মূল্য দিইনি, তাই পারিনি। আমার হাজার হাজার ভুল ছিল, দোষ ছিল, তাই পারিনি। আমাকে ঘৃণা করো, আমার অপারগতাকেও ঘৃণা করো---তবু নিজেরা ঘৃণ্য হয়ে যেয়ো না।


আর শোনো, আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমি পারব না, আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি আমার সন্তানকে সুস্থ একটা পারিবারিক পরিবেশ উপহার দিতে পারব না, এজন্যই সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছিলাম। ভাবছ, আমি টিকে যাবার আগেই ছেড়ে দিয়েছি? বেশ, তোমরা দিয়ো না, তোমারা টিকিয়ে দেখাও, তোমরা ভালো থেকে দেখাও। তা না হলে কখনও আমাকে বলতে এসো না, আমি তো চেষ্টাই করিনি। যে জীবনে নিজে বাঁচোনি, সে জীবন নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। বললে বলো! আমি চেষ্টা করিনি ভালো করেছি। তোমরা চেষ্টা করে যদি টিকে যাও, ভালো থাক, সুখে থেকে আমাকে দেখাতে পার, তবে আমি সারাজীবন স্যালুট করে যাব তোমাদের এবং সারাজীবন তোমাদের কাছে আমার অপারগতা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে যাব। আর তা না হলে কখনও…কখনওই বলতে এসো না যে তোমরা তোমাদের সন্তানের জন্য একসাথে থেকেছ। এটাকে আত্মত্যাগ বলে না। তোমরা কিছু মানুষের কটুকথা ও তির্যক দৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে এসব করছ, শুধুই নিজেদের জন্য করছ তোমরা, অবশ্যই সন্তানের জন্য নয়। সন্তানের জন্য করা কখন বলে? যখন দুজন আলাদা থেকেও সারাজীবন সেই সন্তানের দিকে চেয়ে আর অন্য কোনও সম্পর্কেই না জড়িয়ে শুধুই ওই সন্তানকে আঁকড়ে বেঁচে থাকে, প্রয়োজনে সব কিছুতেই ছাড় দিয়ে দেয়…কিংবা আর যা-ই করুক না কেন, সন্তানের জীবনে তার আঁচড়ও লাগতে না দেয়, সন্তানের সব ধরনের যত্ন ও দেখাশোনা করে যায়…তিলে তিলে নিজেকে শেষ করা মানে কী, বোঝ তোমরা? নিজের ছোট বড় সব সুখ শেষ করে দেওয়া, সারাজীবনটাই পরিবারের জন্য সমর্পণ করে দেওয়া…বোঝ সেগুলো? যখন বল, সন্তানের জন্য এই, সন্তানের জন্য সেই--তখন একটু বুঝে বোলো--সন্তানেরই জন্য, শুধুই সন্তানের জন্য…এমনটা না হলে ‘সন্তানের জন্য’ কথাটা বোলো না। কিছুটা আমার, কিছুটা ওর, কিছুটা পরিবারের, কিছুটা সমাজের--কিছুটা সন্তানের, তা কখনও হয়, বলো? যা-কিছু সবারই জন্য, তা-কিছু আসলে কারও জন্যই নয়। পারবে সন্তানের দিকে তাকিয়ে তার কাছে বা পরস্পরের সামনে নিজেদের সব কিছু উন্মুক্ত করে দিতে? তোমাদের লুকিয়ে রাখার অনেক অনেক কিছু আছে--সবারই যেমন থাকে, এমনকি অনেকগুলো তোমরা নিজেরাই জানো না বা চোখের সামনে নিয়ে আসতে এবং তা নিয়ে ভাবতে ভয় পাও। এতটা স্বচ্ছ হওয়া যায় না, কেউই পারে না তা, হতে পার না তোমরাও…পার কি? আজকাল তেমন স্বচ্ছতা আর কোথাও নেই-ই হয়তো। তোমরা যখন প্রথমত তোমাদেরই সুখের খোঁজে ব্যস্ত, তখন সন্তানের অজুহাত কেন দাও? কথায় ও ভাবনায় সততা রাখতে শেখো। আমি জানি, এসব পড়ে তুমি আমাকে খারাপ ভাবছ। আমার কথা তোমার ভালো লাগছে না। কিন্তু আমার বলতে হবে, আমি বলবই!


তিল তিল করে কোনও কিছু গড়তে যে জানে, ভেঙে-ফেলাও শুধু তাকেই মানায়। যে গড়তে জানে, সে আবারও গড়ে নিতে পারে। হ্যাঁ, আমিই গড়েছিলাম, বুঝে ফেলেছিলাম যে পারব না আর এগুতে, তখন নিজেই তা ভেঙে এসেছি। যে শুধুই ভাঙতে জানে, সে কোনও কিছু একবার ভেঙে ফেললে আর তা ফিরে পায় না। আমি ভেঙেছি কেন, জানো? যাতে অন্য কেউ তার ইচ্ছেমতো গড়ে নিতে পারে। যে সম্পর্ক ভেঙে যায়নি এখনও, কিন্তু ভেঙে গেলে যা হতো, তার চেয়েও বাজে অবস্থায় আছে, সে সম্পর্ক ভেঙে ফেলাই ভালো। ভেঙে ফেললে আবার নতুন করে গড়া যায়, এতে দুজনেরই মঙ্গল--জীবন তো আর কারও জন্য থেমে থাকে না। আমি আমার জায়গা ছেড়ে দিয়ে এসেছি অন্য কারও জন্য। আমি চাইনি, সেজন্যই সম্পর্কটা আর কন্টিনিউ করিনি। আমি নিজের সাথে অন্তত প্রতারণা করিনি, আমি অন্যের সাথেও প্রতারণা করিনি। বহন করতে পারব না যা, তা ছেড়ে দিয়ে এসেছি। আমি নিজেকে ঠকাইনি, অন্যকেও ঠকতে দিইনি। আমি জানতাম, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটা পবিত্র সম্পর্ক, দুজনের দিক থেকেই ছাড় দিয়ে একসাথে চলার সম্পর্ক। কিন্তু তার অর্থ এই না যে, সংসার মানেই নিজের ব্যক্তিগত জীবনের পরিসমাপ্তি। প্রতিটি মানুষই আগে মানুষ, পরে স্বামী বা স্ত্রী, বাবা বা মা। যার কোনও ব্যক্তিসত্তা নেই, সে আবার কীসের মানুষ? আমি বুঝেছিলাম, ওখানে এ যুক্তি খাটছে না।


তোমরা যখন বিয়েকে একটা নতুন সম্পর্ক না ভেবে একটা বন্ধন ভাব, তখনই তো এসব ঝামেলা তৈরি হয়, তাই না? বিয়ে কি কোনও বন্ধন না কি প্রয়োজন? সে প্রয়োজন কি একজনের না কি দুজনেরই? তোমরা নিজে ছাড় দিবে না কিন্তু ছাড় পাবার জন্য যুদ্ধ করে যাবে! কী থেকে মুক্তি চাও তোমরা? আসলে বিয়ে থেকে তোমরা কী চাও? বিয়ে কোনও নতুন অধ্যায় না, একে নতুন করে শুরু করারও কিছু নেই। বিয়ে হচ্ছে নতুন কিছুকে চলার পরিচিত পথটিতে যুক্ত করে নেওয়া। কখনও কখনও তাকে সাথে নিয়েই পথের সমাপ্তি, নয়তো মাঝপথে হঠাৎই আবার একা হয়ে যাওয়া। তখনও পথটা কিন্তু একই থাকে, কিছুই হারায় না, শুধু কিছু সময় আর স্মৃতি ছাড়া। সে একই পথের নতুন বাঁকে সন্তান থাকা না থাকায় ওই দুজনের একসাথে বা আলাদা চলতে কোনও অসুবিধার সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। আর তোমরা যারা সন্তানকেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মাধ্যম বানাও, আমার সত্যিই ভীষণ করুণা হয় তোমাদের জন্য। দুজন মানুষের ভালোবাসার সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির আবশ্যকতা মানেই কিন্তু ‘সমাপ্তি’, সে ব্যক্তি সন্তান, বাবা-মা, পরিজন, আত্মীয়, বন্ধু--যে-ই হোক না কেন...কেননা তখন সেই দুজন মানুষ একসাথে থেকে যায় নিজেদের জন্য নয়, সেই তৃতীয় ব্যক্তিটির জন্য--সে সম্পর্কে দুটো দেহের একসাথে থাকা হয় ঠিকই, কিন্তু ওদের মন দুটো আলাদা হয়ে যায়। সন্তানকেন্দ্রিক পরিবারের ছাদ বাবা-মা দুজনেই, কিন্তু সে ছাদ জোর করে ধরেবেঁধে আর কতক্ষণই-বা টিকিয়ে রাখা যায়? ভালোবাসা ছাড়া কোনও কিছুতে মিশে যাওয়া যায়…পুরোপুরি থেকে যাওয়া যায়?


আমাকে মাফ করে দিয়ো। আমি হয়তো বাড়াবাড়িই করে ফেলছি, তবু আমি বলবই। আমাকে এগুলো কষ্ট দেয়। আমি এগুলো মানতে পারি না। এজন্যই বলব। আমি পড়তে বসি, পড়তে পারি না, লিখতে বসি মাথায় কিছুই আসে না, খেতে বসি খেতে পারি না...আমি বলি, মনের যত ঝামেলা, তা ঘরের অংশ কেন হবে? দিনের শেষে মানুষের পরম শান্তির আশ্রয় তো ঘরই, সে ঘরই যদি পর হয়, তা হলে আর কই যাবে মানুষ? মানুষের মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য পারিবারিক পরিবেশ অন্তত কিছুটা সুস্থ থাকা দরকার। যার ঘরে শান্তি নেই, তার আসলে পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নেই। আবার বলে বোসো না যেন মনের শান্তি নিজের কাছেই। আসলে আমি ওসব জানি, সব বাইরের কারণ তো আর নিজের ঘরেই টেনে আনতে হয় না, দুইয়ে দুইয়ে চার--এমন তো আর সব সময় ঘটে না, তাই না…সবাইকেই তো দেখি, ওরা মানিয়ে নিয়েটিয়ে চলে! একটা পরিবার সবারই কিছু না কিছু ছাড় দেওয়ার মধ্য দিয়ে চলে, একা একা এসব হয় না।


আমি ইদানীং কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি। আমি সত্যিই অনেক বেশি রিজার্ভ হয়ে গেছি। আমার সারাটা দিন রুমেই কাটে, মানুষ বলতে একমাত্র সংগীতা আর স্রেফ তোমার সাথেই কথা হয়। খুব দরকার ছাড়া বের হই না, শপিং-এও যাই না। আগের মতো একফোঁটাও নেই আমি আর। আমার কেমন জানি তেমন কিছুর দরকারও পড়ে না। এসব বন্ধুবান্ধব, রংঢংগুলো আমার কাছে অসহ্য আর মেকি লাগে। একা থাকার মধ্যে সত্যিই সুখ আছে, অনেক শান্তি আছে। ক্যারিয়ার হোক না হোক, সুখে যে আছি, এটাই বড় প্রাপ্তি। ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে মাথা খারাপ করার অর্থই হলো বর্তমানটাকে নষ্ট করে দেওয়া! ক্যারিয়ার হয়ে গেলে বাড়তি কী হবে? বেশি সংগতিতে বাঁচতে পারব, এই তো? তার চেয়ে কি অল্প সংগতিতে শান্তি নিয়ে বাঁচা অনেক ভালো নয়? ক্যারিয়ার হবে, ভালোভাবেই হবে, তবে খুব দেরিতে--সবার পরে, আমার যা যা হতে পারত, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোটাই হবে। আসলে দেরিতেই ভালো। কর্মজীবনে ঢুকে যাবার পর আমার জীবন রুচি অভ্যাস সবটাই বদলে যাবে…না চাইলেও। এমনকি আমরা দুজন এখনকার মতো নাও থাকতে পারি। এখন তুমি কবে আসবে, তার জন্য চাতকপাখির মতো প্রতীক্ষা করি, তখন তো এই অপেক্ষা আর করা হবে না। তোমার জন্য নিজের হাতে নাস্তা বানানো হবে না, রেডিমেড দামি দামি খাবারই হয়তো এনে রাখব, তা-ই সঙ্গে নিয়ে যাব দেখা করতে যাবার সময়।


অপেক্ষাই হলো শুদ্ধতম ভালোবাসা ও ভালোথাকা। আমি এই সময়টা উপভোগ করে যেতে চাই। সামনের দিনগুলো অনিশ্চিত। আমার কাছে বর্তমানটাই জ্যান্ত, সুন্দর। এমনও হয়ে যেতে পারে, তুমিও ক্লান্ত, আমিও ক্লান্ত। যেকোনও সম্পর্কে ক্লান্তি এসে যাওয়াটা ভয়ংকর একটা ব্যপার, ওতে সম্পর্কের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। পাশাপাশি থেকেও কেউ কারও কাছাকাছি থাকব না আর--এমনটাই হয়, আমি অনেক দেখেছি। সম্পর্কের সুস্থতার জন্য ভালো ক্যারিয়ার ভালো কিছু নয়। এমনটাই হয়তো হবে সামনে, আমাদের কিছুই করার থাকবে না আর…সত্যি বলছি। এই সময়টা, এই মুহূর্তগুলো আমাদের দুজনের জীবনে সবচেয়ে মধুময় সময় মনে হবে তখন। আমি যতদিন কর্মহীন থাকব, ধরেই নিতে পার, ততদিনই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। একদিন এক বিকেলে আবিষ্কার করবে, তোমার চেয়েও ঢের বেশি ব্যস্ততা আমার। নতুন অফিস, নতুন কলিগ, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন, নতুন দায়িত্ব…দেখা যাবে, এত এত নতুনের ভিড়ে তুমি একজন পুরান মানুষের জন্য সময় বের করে উঠতে পারছি না যেন! প্রায় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমনই হয়। আমার ভয় হয় সামনের দিনগুলির কথা ভেবে। যত দেরিতে দিনগুলি আসে, ততই ভালো।


এখন আমার হয়তো কিছুই নেই, তবু একজন মানুষ তো আছে, যার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকি। একদিন আমার নিজেরই হয়তো গাড়ি বাড়ি ব্যাংকব্যালেন্স থাকবে, থাকবে না কেবল কারও জন্য অপেক্ষা করার সময় এবং সেই মানুষটি। এমনও হতে পারে দুজনেই জীবনের ও সময়ের প্রয়োজনে দুইটি বিপরীতমুখো রাস্তায় হেঁটে চলেছি, চলতে চলতে গভীর কোনও এক নিঃসঙ্গ রাতে অনুভব করব…‘সত্যিই আজ মেরুর শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, মনে পড়বে, আমাদের একদিন অপেক্ষা করার মতো কিছু বিকেল ছিল, খুনসুটি-মাখানো অনেকগুলো আদুরে সন্ধ্যা ছিল, কেউ একজন ক্লান্তি ও প্রত্যাশা সারাগায়ে লেপটে ঢুলুঢুলু চোখে ঘরে ফিরবে, তাই আরেক জন রাঁধতে না জেনেও খুব চেষ্টায় কিছু অখাদ্য রেঁধে মানুষটার মুখ থেকে রান্নার প্রশংসা শোনার জন্য জানলার গ্রিল ধরে তীব্র অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনত আর ভাবত…মানুষটার ফিরতে আর কত সেকেন্ড লাগবে?


ধন্যবাদ, আমাকে সুযোগটা দেবার জন্য। যার একজন অপেক্ষা করার মতো মানুষ থাকে, তার হাতে গোটা একটা স্বর্গের একক আধিপত্য থাকে। আমাদের এ সময়টা বদলে যায় তো যাক না, অন্য একটা সময় এসে ব্যস্ত করে দেয় তো দিক না…সব কিছুর পরও, সব কিছু মেনে নিয়েও…যখন-তখনই…যদি ধরো জীবন বাজি, আমি তোমার সাথেই রাজি!