উমবার্তো ডি. (১৯৫২)

দ্য বাইসাইকেল থিফ। ভিত্তোরিও ডি সিকার। এ মুভির অনুপ্রেরণায় সত্যজিৎ রায় সিদ্ধান্ত নিলেন, আমিও সিনেমা বানাবো। সৃষ্টি হল ‘পথের পাঁচালী’। নিও-রিয়্যালিস্ট ঘরানার সবচাইতে বিখ্যাত মুভির তালিকায় প্রথম যে মুভির নাম আসে, সেটি ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’। চলচ্চিত্রের এ নতুন পাঠশালার সূচনা ইতালিতে। মুভির ক্যামেরাকে স্টুডিয়ো থেকে পথের ধুলোয় নামানোর কাজ। যাঁরা অভিনয় করবেন, তাঁরাও হবেন সাধারণ লোকজন, তারকা লেভেলের কাউকে লাগবেই, এমন নয়। কোনো সিনেমাটিক গ্ল্যামার নেই, কুশীলবরা পেশাদার নন, ফিল্মের আবহ শতভাগ বাস্তবানুগ। কাহিনি হবে সরল, সৎ, বাস্তব। মুভি দেখার সময় কখনোই মনে হবে না ধারকরা কিছু দেখছি, মনে হবে, এই কাহিনি আর কাহিনির মানুষগুলি আমার পরিচিত। আমি এ বিষণ্ণতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, এ উল্লাসও আমার অতিচেনা। কম বাজেটে জীবনের এমন অকপট চিত্রায়ন-পাঠশালার মাস্টারমশাইদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভিত্তোরিও ডি সিকা। তাঁর আরেকটি মাস্টারপিস উমবার্তো ডি. (১৯৫২)। নিও-রিয়্যালিস্ট ঘরানারই।

মুভির প্লট একেবারেই সাদামাটা। উমবার্তো ডি. ফেরারি একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা। পেনশনের অল্প টাকায় টিকে থাকার লড়াইয়ে তাঁর অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। মায়ামমতাহীন বাড়িওয়ালীর সাথে বকেয়া বাড়িভাড়া নিয়ে বচসায় সবসময়ই অস্থির সময় কাটে তাঁর। প্রাক্তন সহকর্মীরা এবং সামাজিক নানান সংগঠন তাঁর এ দুরবস্থায় মুখ ফিরিয়ে রাখে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এ মানুষটির পাশে সে সময় ছিল তাঁর আদরের পোষা কুকুরটি আর বাড়িওয়ালীর কাজের মেয়েটি। মেয়েটি অবিবাহিতা, গর্ভবতী। অসহায় মানুষটির পাশে যারা ছিল, তারাও ছিল অসহায়। এরকমই হয়। বাঁচার কোনো অবলম্বন না পেয়ে উমবার্তো ডি. সিদ্ধান্ত নিলেন, আত্মহত্যা করবেন। তাও পারলেন না। এ সিনেমায় আমরা দেখি, বেঁচেথাকার কোনো অর্থ কিংবা আশা না নিয়েও মানুষ শেষ পর্যন্ত স্রেফ বেঁচেথাকার জন্যই বেঁচে থাকতে পারে।

ডি সিকার চিত্রনাট্যকার সেসারে জাভাত্তিনি ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ এবং ‘উমবার্তো ডি.’, এ দুই মাস্টারপিসেরই স্ক্রিপ্ট লেখেন। তাঁর দ্বিতীয় কাজে জীবন নিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি নিরীক্ষার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। দেড় ঘণ্টার সিনেমাটি দেখার সময় আমাদের এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় না, এমন কিছু দেখছি, যা অভিনব, আনকোরা, অবাস্তব। প্রতিদিনকার আটপৌরে জীবনের সূক্ষ্ম ও নিখুঁত পুঙ্খানুপুঙ্খ দলিল এ চলচ্চিত্র। একটা দৃশ্যের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বাড়িওয়ালীর কাজের মেয়ে রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছে। নীরবে। সে তখন তিনমাসের গর্ভবতী, অবিবাহিতা। অনাগত সন্তানের বাবা তাকে বিয়ে করতে রাজি নয়। মেয়েটি আলতোভাবে তার নিজের পেটে আঘাত করছে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মাত্র পাঁচ মিনিটের দৃশ্যায়ন। সাইলেন্ট, স্টিল পাওয়ারফুল। এ দৃশ্য কিছু না বলেও অনেক্কিছু বলে দেয়। এ ভাষা সবকালের, সব মানুষের বেলায়ই প্রাসঙ্গিক, দরকারি।

সিনেমা শুরু হয় পেনশনভোগীদের বিক্ষোভ প্রদর্শনদৃশ্যের মধ্য দিয়ে। ওরা পেশন বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। প্রোটাগনিস্ট উমবার্তো ডি. পেনশন-বৃদ্ধির দাবিতে সোচ্চার, তবু আমাদের নিরাশ করে এ মুভি সরকারি পলিসি কিংবা রাজনীতি-র সংস্কারের পথে হাঁটেনি। আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, যখন আমরা দেখি, ভাড়া বকেয়া আছে বলে উমবার্তো ডি.-র কক্ষটি বাড়িওয়ালী ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া দিচ্ছেন অবৈধ প্রণয়ী-প্রণয়িনীকে; একজন দরিদ্র বৃদ্ধ মানুষের অসহায়ত্ব ও একাকীত্ব আমাদের বিষণ্ণ করে রাখে সিনেমার পুরোটা সময়। এ মুভির বেশিরভাগ অংশই ততটা বক্তব্যনির্ভর নয়, নীরবই বলা চলে, কোনো জাঁকালো ডায়লগ কিংবা আরোপিত অভিনয় নেই, তবু সেগুলি জীবনদর্শনের যে পাঠ দেয়, তা চিরন্তন, বিশ্বস্ত।

আমরা যারা চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা দেখতে ভালোবাসি, তারা এ মুভির একটা দৃশ্যে চ্যাপলিনসুলভ ডেলিভারি খুঁজে পাই। দারিদ্র্যপীড়িত বৃদ্ধ মানুষটি, যিনি একসময় আমলা ছিলেন, নিরুপায় হয়ে রাস্তায় দাঁড়ান ভিক্ষা করতে। ঠিক ‘দাঁড়ান’ বললে ভুল হবে, হাত পাতবেন কি পাতবেন না, এ প্রবল সংশয়বিদ্ধ অবস্থায় মনের অবচেতনেই হাতের তালু বাড়িয়ে রাখেন কিছু সময়ের জন্য, এক পথচারী তাঁকে অর্থসাহায্য দেয়ার মুহূর্তে তাঁর শিক্ষা, আত্মসম্মানবোধ, অতীত মধ্যবিত্ত অবস্থান হাতের তালুটি নিমিষেই উপুড় করে দেয়। সে সময় উনি বেঁচেথাকার বিশ্বস্ত সঙ্গী কুকুরটির মুখে তাঁর হ্যাটটি উল্টো করে ধরিয়ে দিয়ে একটু দূরে লুকিয়ে থাকেন। ভিক্ষার আশায় কুকুরটি দুই পায়ে দাঁড়িয়ে হ্যাট কামড়ে ধরে আছে, সে সময় সে পথ দিয়ে উমবার্তো ডি.-র এক প্রাক্তন সহকর্মী হেঁটে যাওয়ার সময় কুকুরটিকে দেখেন আর অমনিই উমবার্তো ডি. আড়াল থেকে সামনে এসে সহকর্মীকে বোঝান যে এটা কুকুরটির একটি খেলা। চরম দরিদ্র আর অসহায় অবস্থায়ও সবেমাত্র গতহওয়া মধ্যবিত্ত ইগো আর মর্যাদাবোধ মানুষকে কিছুতেই পরিচিত বলয়ে ছোট হতে দেয় না।

মার্টিন স্কোরসেজি তাঁর ইতালির সিনেমাদেখা নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারি ‘মাই ভয়েজ টু ইতালি’তে পছন্দের তালিকায় ‘উমবার্তো ডি.’কে ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’-এর আগে রেখেছেন। তিনি বলেছেন, “এ মুভিতে দেখানো আবেগগুলি স্বতঃস্ফূর্ত, অভিব্যক্তি আর উচ্ছ্বাস পুরোপুরিই বিশুদ্ধ।” দ্য বাইসাইকেল থিফ-এ প্রধান চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, বাস্তবজীবনে তিনি ছিলেন কারখানার কর্মচারী। উমবার্তো ডি.-র উমবার্তো সাহেবের সাথে ডি সিকার দেখা হয়েছিল একদিন রাস্তায় হাঁটার সময়। ভিত্তোরিও ডি সিকার বাবার নাম ছিল উমবার্তো ডি সিকা। তিনি ছিলেন ব্যাংকের ছাপোষা কেরানি এবং বীমা কোম্পানির কর্মচারী। বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিভূ উমবার্তো ডি সিকা সারাজীবনই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে। উমবার্তো ডি. দেখার সময় মনে হতে থাকে, ভিত্তোরিও ডি সিকা প্রকৃতপক্ষে তাঁর নিজের বাবার ছবিই এঁকেছেন সিনেমাতুলির নিপুণ আঁচড়ে।