উলটোরথে, আয়ু-পরাঙ্মুখ

  
 আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।
 কেন করে না?
 জানি না। তবে এটা জানি, করে না।
  
 আমি একা থাকি। ভালো লাগে।
 ঘরটা অন্ধকার করে রাখি। খাটে শুয়ে পড়ি। হুটহাট।
 ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে রাখি। সেই দিনগুলির কথা ভাবতে থাকি,
 যেই দিনগুলি চলে গেছে, এবং যেই দিনগুলির কথা ভেবে কোনও লাভ নেই।
 তবু, ওরকম করতে আমার ভালো লাগে।
 কখনও, জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। বাইরে দৃষ্টি ছুড়ে দিই।
 কেন, জানি না। শুধু জানি, ওরকম করতে ভালো লাগে।
 এ-ও জানি, আমার বাঁচতে ভালো লাগে না।
  
 জানালা দিয়ে কিছু পোকামাকড় ঘরে ঢুকে পড়ে।
 আমি ওদের বাধা দিই না। ঘরে এলে তাড়িয়ে দিই না।
 ওদের মধ্যে কোনও দূরত্ব নেই। ওরা একসাথে থাকে।
 আমার দূরত্বহীনতা দেখতে ভালো লাগে।
 ওদের ঘরে থাকতে দিতে ভালো লাগে।
 আমার শুধু বাঁচতেই ভালো লাগে না।
  
 কিছুদিন আগে, একটা মাঝবয়েসি তেলাপোকা
 খাটের তলটা দখলে নিয়েছে, সাথে ওর পরিবার।
 আজকে দেখলাম, দুটো বাচ্চা-তেলাপোকা খাটের তল থেকে বেরিয়ে
 কার্পেটের উপর খেলছে। ওরা ভাই-বোন, বোধ হয়।
 আমি ওদের ঠেলে ঠেলে ঘরের দিকে এগিয়ে দিয়েছি।
 মা-তেলাপোকা ঘুমাচ্ছে, এই সুযোগে বাচ্চাদুটো বেরিয়ে গেছে।
 আমার চোখের সামনে আসা ওদের নিষেধ। ওরা তা জানে না।
 ঘরে তেলাপোকা মারার ওষুধ আছে।
 থাকুক। ঘরে তো আরও অনেক কিছুই আছে।
 ওদের দেখতে ভালো লাগছে, আমার শুধু বাঁচতে ভালো লাগছে না।
  
 একটু আগে রুমে একটা ফড়িং ঢুকে পড়েছে।
 সারারুমে ছুটেছে, ভয়ে। আমি শোয়া থেকে উঠলাম,
 ফ্যানটা দ্রুত বন্ধ করে দিলাম। তবে শেষরক্ষাটা হলো না।
 ফড়িংটা পাখার ধাক্কায় টেবিলে পড়ে ছটফট করছে।
 আমি দৌড়ে গেলাম। কেন গেলাম, জানি না।
 আমি যাবার আগেই সে চলে গেল।
 ওর পরিবারের কথা ভাবতে ভাবতে আমি কাঁদছি।
 আমি কেন কাঁদছি? কাঁদতে আমার ভালো লাগছে।
 আমার কেবল বেঁচে থাকতেই ভালো লাগছে না।
  
 পড়ার টেবিলে বইয়ের স্তূপের উপর একটা মাকড়শা বসে আছে। গর্ভবতী।
 ওর পেটে একটা বড়ো ডিম আটকে আছে। ওরা জীবনে একবারই মা হয়।
 ওর পেটের সন্তানরা ক্ষুধানিবৃত্তির প্রথমকামড়টা ওর পেটেই বসাবে।
 এভাবে ওরা খেতেই থাকবে ততক্ষণ,
 যতক্ষণ পর্যন্ত ওর শরীরের সমস্ত হাড়মাংস খাওয়া শেষ না হচ্ছে।
 সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে মা নিজেকেই দান করে যাবে।
 এমন একটা মহৎমাকড়কে বাঁচানো যায় না?
 আচ্ছা, আমি যদি ওদের জন্য রান্না করি, তখন?
 মাকড়ছানারা আমার রান্না খাবে? মা-টাকে ছেড়ে দেবে ওরা?
 এইসব ভাবতে ভাবতে চোখে জল এসে গেছে।
 এই জলটাও আমার ভালো লাগছে, কিন্তু
 আমি বেঁচে আছি ভাবতেই আমার অসহ্য লাগছে।
  
 এখন আমার অনেক কাজ।
 বর্ডার ক্রস করে আসা বাচ্চাদুটো ঘরে পৌঁছেছে কি না ভাবছি।
 ফড়িংটার মৃত্যুসংবাদ তার ঘরে পৌঁছে দেবার কথা ভাবছি।
 মাকড়শার অনাগত সন্তানদের জন্য রান্না করার কথা ভাবছি।
 আমার কর্তব্য বেড়ে গেছে। মুহূর্তেই! আমি না চাইতেও!
 এইসব দায়িত্ব অন্য কারও কাঁধে ঝেড়ে ফেলা যাবে না বলেই
 আমার হঠাৎ বাঁচতে ইচ্ছে করছে!
  
 আমি বেঁচে থাকছি। আমি আরও কিছুদিন বাঁচব।
 বেঁচে থাকলে বাঁচানো যায়, বাঁচানো গেলে আরও কিছুদিন বাঁচা যায়।
 এই অচ্ছেদ্য চক্রকে আমার মধ্যে ধারণ করতে ভালো লাগছে।
 কী আশ্চর্য, এই আনন্দটা আমি আগে কখনও টের পেলাম না কেন!