একজন ভুলে-ভরা মানুষ

 
আমি একজন ভুলে-ভরা মানুষ। আমি প্রায়ই খুব সহজ সহজ কাজে ভুল করে বসে থাকি। যে-কাজে অন্য কেউ ভুল করে না, সে-কাজেও আমার ভুল হবেই, এমন একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। আমার ইদানীং খুব শ্বাসকষ্ট হয়, আর আমি ক্রমাগত ডাক্তারের পকেটে পয়সা ঢুকাই। এই ভুলটা আমাকে সান্ত্বনা দেয়।


ক্লাসরুমে পৌঁছই দেরিতে, ওদিকে আবার রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই বাড়াবাড়ি রকমের আগেভাগে। আমি জানি, ক্লাস কয়টায় শুরু হবে। আমি এ-ও জানি, ট্রেন কয়টায় আসবে। এবং আমি আরও জানি, তবু ভুলটা আমার হবেই। ইচ্ছে করে ভুল করি, এমন নয়। ভুল হয়ে যায়।


আমি খুব আবেগ মিশিয়ে রাজ্যের যত সুন্দর ভাবনা জড়ো করে করে গুছিয়ে লেখা একটি মেসেজ ভুল মানুষকে পাঠিয়ে দিই। আবার সব সময়ই রং-নাম্বারটাই রিসিভ করি। এমন ভুল হয়ে আসছে। কিছুতেই বেরুতে পারছি না এখান থেকে। বেরুতে আমি চাইছি না, তা নয়। সত্যিই পারছি না।


আমি বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁতের শাড়ি পরি, আর গাদোয়ালটা পরি রিকশায় করে একা একা ঘুরে বেড়ানোর সময়। এর মানেটা কী, আসলে? আমি জানি না। ওই মুহূর্তে আমার ওটাই করতে ইচ্ছে করে। আমার ইচ্ছেটা ভুল হয়তো, কিন্তু এই ভুলটা নিয়ে বেঁচে থাকতে মন্দও লাগছে না।


সামনে এত এত কাজ বাকি পড়ে আছে দেখে ভয় পেয়ে রাতের বেলায় আমি একছুটে ঘুমুতে চলে যাই। আর সকালে উঠে মনেই করতে পারি না, আমার কী যেন সব কাজ করার কথা ছিল! অনেক কাজই আমার আর করা হয় না। পরে এর জন্য আমাকে ভুগতে হয়। সম্ভবত, আমি জন্মেইছি ভোগার জন্য। এমন চিন্তাভাবনা মনে আসে।


আমি ছোটোবেলায় না-বুঝেই ধারাপাত পড়েছি। বড়োবেলায় এসে সেই না-বুঝেই মানুষ পড়ছি। আমি নিজেকে বুঝি না, আমি আমার চারিদিকের মানুষ বুঝি না। আমার ভেতরের ও বাইরের পৃথিবী, দুই-ই ভুল পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি, আমি তা-ও বুঝি না।


আমি বহু দিন আগে একজন ঠিক মানুষকে ভুল ভেবে তাড়িয়ে দিয়েছি, তাই আজ ভুল মানুষকে ঠিক ধরে নিয়ে সংসারটা করে যেতে হচ্ছে। এটাই নিয়ম। প্রকৃতি গুনে গুনে ঠিকই সব ফেরত দিয়ে দেয়। প্রকৃতির হিসেবে ভুল হয় না, খুব বুঝতে পারছি।


আমি দিনের বেলায় ঘরের বাতি জ্বেলে দিই, রাতে ঘরটাকে করে রাখি অন্ধকার। আমার কাছে আলোর মানে আলো নয়, অন্ধকারের মানে অন্ধকার নয়। সব আলোই আলো হয় না, কিছু আলো অন্ধত্বও হয়। সব অন্ধকারই অন্ধকার হয় না, কিছু অন্ধকার আয়নাও হয়।


আমার প্রায়ই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। ব্যাগপত্র খুব গুছিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমি সর্বোচ্চ আমার বাসা থেকে আড়াইশো গজ দূরের সেলুন অবধি গিয়ে আবার ফিরে এসেছি বহু বহু বার। আমি জানি না, আমি কোথায় যাব। তবে আমি জানি, আমি কোথাও চলে যেতে চাই। সেলুনের কাকামশাই আমাকে দেখে হাসেন। কেন হাসেন? কাকার মেয়েটা গত বছর মারা গেছে। না না, আত্মহত্যা ছিল না ওটা, এটাই আমরা জানি। আচ্ছা, আমাকে দেখে কি কাকার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে?


যে পরীক্ষায় আমার একশো পাবার কথা ছিল, সেখানে আমি পেয়েছি শূন্য। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, খাতায় রোল-নম্বরটাই ভুল লিখে এসেছি। মনে পড়ে, সেইদিন নিজের জন্য খুব মায়া হয়েছিল। মানুষ এতটা দুর্ভাগ্য মেনে নিতে পারে না বোধহয়।


মাঝেমধ্যে এমন হয়েছে, ভিড়ের মধ্যে আমার ক্লান্ত লাগে তাই জলদি জলদি বাড়ি ফিরে এসেছি। আর এসে দেখি, বাড়ির সবাই একসমুদ্র ক্লান্তিভরা এক-একটা মুখ ঘাড়ের উপর লটকে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। অবশ্য, আমি কোনও বাড়তি চাপ অনুভব করিনি তখন। শুধু আরও এক বার বুঝেছি, সব সময় ফিরে আসতে নেই।


আমি সে-ই ছেলের জন্য জেনেবুঝেই ভাত মেখে বসে থেকেছি, যে-ই ছেলে বাড়িই ফিরবে না। আর যে ছেলেটা বাসায়ই আছে, সে খেয়েছে কি না জিজ্ঞেসও করে দেখিনি। কার জন্য ভাত মেখে কাকে খাইয়ে দিতে হয়, তা আমি এখনও শিখিনি।


আমি ভণিতা পছন্দ করিনি কখনও, কিন্তু প্রিয় মানুষদের কাছ থেকেই শুনেছি, ভণিতা না-জানলে প্রিয় হওয়া যায় না কারুর। যে আমার প্রিয়, যেন আমিও তার প্রিয় হই।---এমন আশাকে দুরাশা হিসেবেই এখন আমি মেনে নিয়েছি। মানুষ অন্য কাউকে, সে যেমন, তেমন করেই মেনে নিয়ে পছন্দ করতে পারে না।


আমি সব সময়ই বিশ্বাসঘাতককে বিশ্বাস করেছি, আর নির্দোষকে করেছি দোষী। জীবন এর উত্তর দিয়ে যাচ্ছে অবিরতই, তবু থামতে আর পারছি কই? আমি অবিশ্বাসের ঘরে খুব যত্ন করে কিছু বিশ্বাস রেখে দিই, আর বিশ্বাসের ঘরে কিছু অবিশ্বাস।


আমি সেই বধির মানুষটিকেই চিৎকার করে করে ডেকে চলেছি তাকে আমার কিছু বলার ছিল বলে; আর যে আমার মুখে একটু ‘ভালোবাসি’ শুনতে চেয়েছিল, তার দিকে একটা হাসি পর্যন্ত ছুড়ে দিইনি কখনও। এর ফলে যা হলো, আমি প্রথম মানুষটির চোখে বাচাল এবং দ্বিতীয়টি মানুষটির চোখে বধির হয়ে বেঁচে আছি। আর নিজের চোখে বেঁচে আছি এ-ই ভেবে ভেবে---আমাকে কেউ ভালোবাসে না।


আমি আঁকতে পারি না বলে কত কত রাত কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছি, অথচ নাচটা যে আমার রক্তেই ছিল, তা নিয়ে একটি বেলাও সুখ করে দেখিনি। আজ ওরা ভাবে, আমি নাচতে জানি না; আমি ভাবি, আমি আঁকতে জানি না।


আমি এ জীবনে কত মানুষকেই তো খুব অল্প কথায় সত্যি সত্যি চিনে ফেলেছি বলে ধরে নিয়েছি, অথচ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকেই কখনও চিনতে পারিনি! আমি মানুষকে আয়না ভাবি, আর আয়নাকে কিনা মানুষ ভাবি!


দামি সাবান মেখে, ঘষে ডলে শরীরের ময়লা তুলেছি; অথচ আমার
যে মনে এত ময়লা জমে আছে, সেই মনে একটা সস্তা সাবানও মাখা হলো না আজও। ঝকঝকে শরীরের ভেতরে লেপটে-থাকা কলুষিত একটা মন। এ-ই আমি!


হাতে ঘড়িটা পরেছি বরাবরই, কিন্তু সময়ের জ্ঞান আমার কখনওই ছিল না। যখন সে-জ্ঞানটা হলো, তখন দেখি, আমার হাতে ঘড়িই আর নেই। ঘড়ি-কেনার পয়সা পকেটে নিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরছি, অথচ পৃথিবীতে এখন ঘড়ির ব্যবসাই বন্ধ হয়ে গেছে!


আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকে কখনও ভালোবাসার কথা বলতেই পারিনি। আর যাকে ঘৃণা করতেও আমার রুচিতে বাধে, সে কিন্তু আমাকে দিয়ে দুবেলা ‘ভালোবাসি’টা বলিয়ে নিয়েছে ঠিকই! আমি বুঝেছি, ঠোঁটের ভালোবাসাটা চোখের ঘৃণার উলটো-পিঠ জেনেও ঠোঁট দুটোকে ব্যস্ত করে রাখতে হওয়ার নামই জীবন।


বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত আমার মনটা যখন প্রশ্ন করে, ‘এই বেঁচে-থাকার শেষ কোথায়?’, তখন হঠাৎ মনে পড়ে, ‘আরেহ, আমি তো বাঁচা এখনও শুরুই করিনি!’