একজন মুজতবা আঙ্কেলের সংসার

 
তখন গ্রামে থাকতাম পরিবারের সাথে। আমাদের দাদুবাড়িটা বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। আশেপাশে অনেকগুলো বাড়ি, মাঝখানে বড় একটা উঠোন। উঠোনের চারধারে এই বাড়ি, ওই বাড়ি…এরকম।


এক চাচা থাকতেন আমাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িটায়, নাম মুজতবা। ওঁরা দুই ভাই, তিন বোন। চাচা বাহারাইন চলে গিয়েছিলেন সংসারের হাল ধরার জন্য একদম ছোটবেলায়, তখন তাঁর বয়স এই আঠারো কি উনিশ, এর বেশি না। এই ছোট বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তাঁকে। সংসার চলত মূলত তাঁর মাধ্যমেই। ভাইবোনের মধ্যে তিনি পরিবারের দ্বিতীয় সদস্য, বড় একজন বোন ছিলেন তাঁর। বোনদের বিয়ে দেওয়া, ছোটভাইকে দেখা, এবং পুরো পরিবারের অর্থযোগানের গুরুদায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধেই।


এভাবেই চলছিল দিন।


গ্রামের একটা নিয়ম হলো, মেয়েদের যত কম বয়সে বিয়ে দেওয়া যায় ততই ভালো, অবিবাহিতা মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে তা একটা অসম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত সেই মেয়ের পরিবারের জন্য। তো, বড়বোনকে বিয়ে দিয়ে কয়েক বছর যেতে না যেতেই ছোট বোনরা বড় হয়ে যাচ্ছিল, এদিকে ছোট ভাইয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাস্বরূপ ওঁকেও বাহারাইন নিয়ে যাওয়া, পরিবারের সকলের নানান প্রয়োজন ও আবদার মেটানো, সব মিলিয়ে অনেক অনেক দায়িত্ব একাই বহন করতে হতো চাচাকে। চাচাদের মা বেঁচে থাকলেও বাবা একদম ছোটবেলাতেই মারা যান। নিয়মানুযায়ী পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুরুষসদস্যের উপর যাবতীয় দায়িত্ব চেপে যায়। যত মন্দ চরিত্রের পুরুষই হোক, ঘাড়ে চেপে-যাওয়া দায়িত্ব কেউ এড়াতে পারে না। যে একজন ছিঁচকেচোর, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সে তার একার জন্য চুরি করে না, অনেক সময়ই তার ঘাড়ে-থাকা দায়িত্বের চাপে নিরুপায় হয়েই চুরিতে হাত দেয়, তার হয়তো ক্ষুধার্ত একজন মা, বোন বা সন্তান আছে, তাদের মুখে ভাত তুলে দিতে ক্ষুধামুক্তির মিছিলে মূলধারার জীবন থেকে এভাবেই ছিটকে পরে ওরা। সখ করে কেউ চোর হয় না, সবারই সিংহাসনে বসে সুখে খাওয়ার ইচ্ছে জাগে, কেবল জীবনের দায়ে পারা হয়ে উঠে না।


তো, চাচা তাঁর ভাইকে বাহারাইনে নিয়ে গেলেন, বোনদের বিয়ে দিলেন, দুই ভাই মিলে একটা একতলা চাররুমের পাকাবাড়ি তুললেন। তত দিনে চাচার বয়স অনেক বেড়ে গেছে, তবু দায়িত্ব কিছুতেই কমছে না, বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু দায়িত্বের ভারে কাঁধ ক্রমেই ন্যুব্জ হচ্ছিল। সচরাচর পরিবারের বড়রা পরিবারের প্রতি দায়িত্বহেলা বা কর্তব্য এড়াতে পারেন না, বড়দের পিঠে পা রেখে ছোটরা গড়গড় করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়, কিন্তু সেই বড়রুপী কলুর বলদটি আজীবন দায়িত্বে-বাঁধা গোয়ালঘরের গরুর মতোই নির্জীব, নিষ্প্রাণ, অথচ দায়িত্ববান হয়েই কাটান। বুকে কষ্ট জমিয়ে হাসিমুখে পরিবারের জন্য খেটে যাওয়াই তাঁর নিয়তি। তাঁকে সবাই ভুল বোঝে, দুঃখ দেয়, ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাটুকুও স্বীকার করে না কখনও কখনও, তবু তাঁর কান্না করা বারণ, কাঁদতে গেলে যে দায়িত্বপালন করা যায় না, তাই।


এর মধ্যে ছোট ভাই বিয়ে করে ফেললেন দেশে এসে। এ জগতে কে কার জন্য বসে থাকে! ওদিকে চাচার আর বিয়ে-করা হচ্ছেই না। ধীরে ধীরে সবারই বিয়ে-করা শেষ, এবার তাঁর পালা, বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গেছে তত দিনে।


এক মেয়েকে পছন্দ করলেন, পছন্দের প্রথম বিষয় ছিল মেয়ের মাথায় কোমর ছাড়িয়ে লম্বা চুল। না, উনি আর কাউকেই নয়, বিয়ে যদি করতেই হয়, তবে এই চুলওয়ালিকেই করবেন, নয়তো আবার বিদেশেই ফেরত যাবেন। এটাই বলে দিলেন সাফ সাফ। এবার তবে কপালে সুখ লিখা হলো বোধহয়। মেয়েপক্ষ খোঁজ নিয়ে জানলেন, জগতের দশজন ভালোমানুষের তালিকা করলে মুজতবা আঙ্কেলের নাম থাকবে একদম শীর্ষেই। এমন ছেলের কাছে নির্দ্বিধায় মেয়েবিয়ে দেওয়া যায়।


ধুমধাম করে বিয়ের দিন এল, পাড়ার সবাই এল। বাড়ি সাজানো, মেহেদি লাগানো, বাড়ির ছাদে স্টেজ বাধানো, এদিক ওদিক মেহমানের আগমন, সবাই মিলে এটা ওটা রান্না, যার যা খুশি খাওয়া, যে যেভাবে খুশি নাচগান হইহুল্লোড়…আরও কত কী যে চলল! পাড়া হয়ে উঠল স্বর্গপুরী! যেন আকাশের দরজা ভেঙে স্বর্গের কোনা থেকে কিছু কিছু অমৃত সুখ ধপাস ধপাস করে ওঘরে আছড়ে পড়ল। আমি তখন বেশ ছোট। আমার মনে আছে, ছাদের স্টেজে বরবেশে মুজতবা আঙ্কেলের চোখে-মুখে সুখের রেশ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল।


আহা! পৃথিবীর কয়েকটা শিরোধার্য বিধানের শৃঙ্খলে বাঁধাপড়া একজন সত্যিকারের ভালোমানুষের যুগলবন্দী জীবনের শুভারম্ভ হতে চলেছে। একসাথে জীবনপার করার অঙ্গীকার, সুখ কিংবা দুঃখ, অথবা উত্থান-পতনে একসাথে পথচলার জাগতিক নিয়মের শুভসূচনা হতে চলেছে। ঘরে নতুন বউ আসবে। দায়িত্বের চাপে পিষ্ট হয়ে যাওয়া একজন নিষ্ঠাবান মানুষের জীবনে দায়িত্বের বাইরে এই প্রথম নতুন কোনও আনন্দের ছাপ দেখা যাচ্ছে।


এভাবেই সেই লম্বাচুলওয়ালি ঘরে ঢুকল বউ হয়ে। ছোটরা সবাই বউ দেখবে বলে দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করছে, এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। ওদের সাথে পাল্লা দিচ্ছে বড়রাও। বউ কালো না কি সাদা, লম্বা না কি খাটো, এসব নিয়ে তেমন কোনও গুঞ্জন হচ্ছে না, গুঞ্জন হচ্ছে কেবল এমন---দেখো দেখো, পরীর মতন লম্বাচুল বউয়ের! আহা আহা!


ওদিকে উঠোনে দাঁড়িয়ে মুজতবা আঙ্কেল লজ্জায় কখনও হাসছেন, কখনও মুখ লুকাচ্ছেন, কখনও-বা নিজেকে একটু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন। তবুও আঙ্কেলের চোখেমুখে আলোর একটা রেশ ঝিলিক মেরে যাচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণেই, যেন মনে মনে বলছিলেন--- 'আমি পাইলাম,'আমি ইহাকে পাইলাম।'


এভাবেই হাসিতে আনন্দে গানে ফুর্তিতে কেটে গেল কয়েকটা মাস। বিয়ের তিন মাস পরেই, ছয় মাসের ছুটি নিয়ে আসা মুজতবা আঙ্কেলের ছয় মাসের ছুটির মেয়াদ শেষ। কর্মস্থলে ফিরতে হবে, এখন তো দায়িত্ব আরও বেড়েছে। চলে গেলেন তিনি, পেছনে রেখে গেলেন পরিবার, নতুন বউ, সম্ভাব্য অনাগত সন্তান।


বছর দুয়েক পর তিনি আবার দেশে এলেন। উপহারস্বরূপ পেলেন পরীর মতো ফুটফুটে এক শিশুকন্যা, নাম রাখলেন ফাইজা। ছয় মাস বেশ সুখেই কাটল। অঢেল সুখ, রাশিরাশি হাসি, ভূরি ভূরি ভালোবাসা। যেন গোটা পৃথিবীটাই একটা স্বর্গরাজ্য!


ছয় মাস বাদে তিনি বাহারাইন চলে গেলেন। এর মধ্যে জন্ম নিল আর এক সন্তান। এবার ছেলে। তিনি ছেলের নাম দিলেন দুর্জয়।


পুত্র এখন হাঁটছে। কিন্তু এখনও পিতার সাথে পুত্রের দেখা হয়নি।


হঠাৎ চাচার শরীর দুর্বল হয়ে উঠল। কী জানি একটা অসুখ। বাহারাইনে তাঁর কফিল তাঁকে আবার ছয় মাসের ছুটি দিয়ে বললেন, দেশে যান, বউ-বাচ্চাকে দেখে আসুন, এর সাথে ডাক্তার দেখিয়ে রোগনির্ণয় করে চিকিৎসা নিন। সকল আর্থিক সহায়তা আমিই দিব। চাচা দেশে ফিরলেন। এটা কন্যার সাথে তাঁর দ্বিতীয়বার দেখা, পুত্রের সাথে প্রথম দেখা। আহা! কী সুখের পৃথিবী, যেন স্বর্গ থেকে দুটো দেবশিশু টুপ্‌ করে পড়ে এ ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঘরভর্তি আনন্দ, কিন্তু সাথে বাড়ছে কাঁধভর্তি দায়িত্ব, ওদিকে আছে সেই কেমন-জানি অসুখ। সে অসুখ বেড়েই চলেছে…সারাঘরে সুখ, আর চাচার শরীরে ক্রমেই দানা বাঁধছে অসুখ।


তিন মাস ধরে এই ডাক্তার, ওই ডাক্তার। এদিকে ছোটা, ওদিকে ছোটা। কিন্তু কোনও ডাক্তারই যেন রোগ ধরতে পারছেন না। এদিকে ছয় মাস প্রায় শেষ। স্ত্রী আবারও চার-পাঁচ মাসের গর্ভবতী।


অনেকগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে। এবার রিপোর্টের রেজাল্ট জানানোর সময়। ছুটির মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছরে নেওয়া হলো। অবশেষে রিপোর্ট এল। মুজতবা আঙ্কেলের রোগ ধরা পড়েছে। জানা গেল, আঙ্কেলের জীবনক্ষয়ী ব্রেইন-টিউমার হয়েছে। এবং, সেটা পৌঁছে গেছে একেবারে লাস্ট-স্টেজে। ডাক্তার জানালেন, ব্রেইন-টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে অপারেশনে সারানো যায়, কিন্তু লাস্ট-স্টেজে অপারেশন আর করানো যায় না, করলে জীবনঝুঁকি প্রায় নব্বই ভাগ। এখন মৃত্যুর প্রহর গোনা বাদে আর তেমন কিছু করার নেই। আঙ্কেল জেনে গেলেন, তাঁর মৃত্যু সন্নিকটে। এটা মাথায় রেখে তাঁকে আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতে হবে।


সারাবাড়িতে কান্নার রোল। ফুলেভরা বাগানে যেন হঠাৎই ঘূর্নিঝড়! উঠোনে দাঁড়িয়ে নিজের রোগের কথা অন্যদের জানাতে গিয়ে আঙ্কেল হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আজ তাঁর খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আজ জীবনে প্রথমবারের মতো তাঁর সুখী হতে ইচ্ছে করছে। আলগোছে উঠোনে বসে তিনি তাঁর সন্তানদের জড়িয়ে ধরে অবোধ শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।


পাশের ঘর থেকে আঙ্কেলের মায়ের কান্নায় যেন আকাশ হেলে পড়ছে পৃথিবীতে। যেন, যদি আকাশ ছিঁড়ে খোদার দরবার থেকে ছেলের জন্য আর একটু হায়াত বাড়ানো যেত! বারবার কাঁদছেন আর মূর্ছা যাচ্ছেন। বউয়ের হাসিহাসি মুখ সেদিনের পর থেকে ঘোর অমাবস্যার মতো অন্ধকার হয়ে গেল। বিয়ের বয়স বোধহয় মাত্র পাঁচ-ছয় বছর। এত কম সময় জীবনকে উপভোগ করা…যেন ভরদুপুরেই, সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই, সূর্য ডুবে যাওয়া। এও মেনে নেওয়া যায়! কোন পাপের ফল এই শাস্তি? মুজতবা আঙ্কেলের মতন ভালোমানুষ আমাদের গ্রামে আর একজনও নেই। তাঁর সাথেই এমনটা হতে হলো!


এর কয়েক মাস পরে তৃতীয় সন্তানের জন্ম। এবারও বাবাই নাম রাখলেন। বিজয়। মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে, মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে সন্তানের নাম রাখলেন বিজয়। একটা মৃত্যুর দামে আর একটা বিজয়।


সময় গড়াচ্ছে, ডাক্তার মুজতবা আঙ্কেলকে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন---যাতে প্রতিদিন হাঁটেন, নিয়মিত খাবার খান, ওষুধ চালান। চাচাও তা-ই করছিলেন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।


কিন্তু হায়, বিধিলিপির প্রতিটা অক্ষরই যেন অখণ্ডনীয়!


ধীরে ধীরে আঙ্কেলের হাঁটার গতি কমছিল। একসময় লাঠি ধরলেন। তাঁকে লাঠিতে ভর করে হাঁটতে হচ্ছে, কানে আগের মতো শুনতে পান না, কথাও ঠিক স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না, কেমন যেন আধোআধো শব্দ, এক গ্লাস পানি চাইতে গেলেও সে কথাটা জড়িয়ে যায়। দৃষ্টিশক্তিও কমে আসছে, ঝাপসা দেখেন সব কিছু। সবার চোখের সামনে একজন জীবনযোদ্ধা ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছেন।


কয়েক মাস পর আঙ্কেল আর লাঠি ধরেও হাঁটতে পারেন না, অনেক জোরে কথা বললে তবেই কানে শুনতে পান। আগের মতো অস্পষ্ট কথাগুলোও এখন আর বলতে পারেন না। চোখে দেখেন না কিছুই, কেউ একদম চোখের সামনে এসে দাঁড়ালে তবেই বুঝতে পারেন যে এটা একটা মানুষ---এর বেশি আর কিছুই নয়।


সবাই দেখল, আঙ্কেলের শরীরের একপাশের হাত-পা পুরোপুরি অবশ হয়ে গেল একসময়। এবার আঙ্কেল আর বসেও থাকতে পারেন না। আগে তাও বাথরুমে কেউ ধরে নিয়ে গেলে যেতে পারলেও এখন আর তাও পারেন না। তাঁকে এখন শুয়েই থাকতে হয়। শুয়ে শুয়েই পায়খানা-প্রস্রাব সব করেন।


আঙ্কেলের বাড়ির মুখোমুখি আমাদের বাড়ি।


একেক সময় মধ্যরাতে ঘুম ভাঙলে শুনতাম, হু হু করে কাঁদছেন তিনি। আঙ্কেল সারারাতই জেগে থাকতেন, কিছুতেই ঘুমাতে পারতেন না, কিন্তু অন্যদের তো ঘুম পেত, ওরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ত। কেবল ওঁরই কখনও ঘুম আসত না। যেন জাগতিক যত ঘুম, ওরা সবাই মিলে বিরোধিতা করে চলেছে তাঁর সাথে।


ঘুমাতে না পারা, আর ঘুম না আসা, এই দুইটা ব্যাপার মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়ে কোনও অংশেই কম না। লোকে সাধ করে দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধ খায় না। যারা ঘুমের ওষুধ খেতে বারণ করে, তারা আসলে জানেই না কতটা কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পেতে কেউ ঘুমের ওষুধে আসক্ত হয়ে পড়ে!


দিনের বেলায় সবাই উনাকে দেখতে যেত। একটাসময় আঙ্কেল ইশারা দিয়ে কিছু বলতে চাইতেন, কিন্তু পরে পরে ইশারাও আর করতে পারতেন না। পুরো শরীরই প্যারালাইজড হয়ে গেল। কেউ কিছু বললে, অথবা কোনও পরিচিত মুখের স্পর্শ বুঝতে পারলে আঙ্কেলের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ত। কেউ কেউ জল মুছে দিত। আহা, যে মানুষটি ছোটবেলা থেকেই পুরো পৃথিবী একপাশ করে অনেকগুলো মানুষের সামর্থ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, একার কাঁধে বয়ে চলেছেন পুরো পরিবারের সমস্ত ভার, আজ সেই মানুষটিরই কিনা নিজের হাতে নিজের চোখের জলটুকুও মুছার সামর্থ্য নেই! জীবনের এ কী কঠিন পরিহাস, বিধাতার এ কী অবধারিত লিপি!


সদ্য বসতে-শেখা বাচ্চাটি হামাগুড়ি দিয়ে বাবার গা-ঘেঁষে বসে থাকত, বাবাকে বারবার ছুঁত আর কী বুঝে জানি খিলবিল করে হাসত। সন্তানের স্পর্শ বুঝে আঙ্কেলের চোখ বেয়ে আরও জল গড়াত, সে জল যেন…একবার, শুধু একবার সন্তানকে কোলে নিতে না পারার লক্ষকোটি বছরের অকৃত অপরাধনামার জানান দিত!


একদিন। সন্ধ্যা ফুরোচ্ছে। মুজতবা আঙ্কেল কেমন জানি ছটফট করছেন। তাঁর চোখ দিয়ে বারবার জল গড়াচ্ছে। আমি পাশেই ছিলাম। দৌড়ে গিয়ে মাকে বললাম, মা, মুজতবা আঙ্কেল কেমন জানি করছেন, মনে হচ্ছে ওঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। মা কী বুঝে জানি দৌড়ে আঙ্কেলের মাথার কাছে গেলেন, আঙ্কেলের বৃদ্ধ মা, বউ আর আঙ্কেলের এক বোনকে ডাকালেন। মা বললেন উনার "চকরাত" (অর্থ: মরার সময় যে যন্ত্রণাবোধ) চলছে। অনেক মানুষকে মা নিজের চোখে মরতে দেখেছেন, তাই মা এটা চিনতে পারেন। আমি মায়ের পাশে বসেই আছি, আঙ্কেলের ঠিক চোখ বরাবর তাকিয়ে আছি। উনি হঠাৎ আধোআধো স্বরে বললেন, “আমার মেয়ে ফাইজা বড় হলে ওকে বাঁধনের ছেলে বিলুর সাথে বিয়ে দিস।” বাঁধন মুজতবা আঙ্কেলের ছোট বোন।


কথাটা বলার সময় কেবল আমি আর মা-ই সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অন্যরা কী সব কাজে জানি পাশের রুমে ছিল। আঙ্কেলের শেষকথা ছিল ওটাই। ধীরে ধীরে আঙ্কেল নিস্তেজ হতে লাগলেন। দেখলাম, চোখ দিয়ে এখন আর জল বেরোচ্ছে না, কেমন একটা সুনসান নীরবতা। ততক্ষণে অনেকে চলে এসেছে।


চারিদিকে কান্নার রোল পড়ে গেল।


আঙ্কেল হঠাৎ জোরে একটা শ্বাস নিতে গিয়ে মুখটা হালকা হাঁ করতে চাইলেন, উপরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তিনি কিছু সময় খিঁচুনি মারলেন। ওই খিঁচুনিতে, ওই নিতে-না-পারা নিঃশ্বাসের সাথে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো অপ্রাপ্তি, না-বলা কথা, ভেঙে-যাওয়া স্বপ্ন, অপূর্ণ কিছু ইচ্ছা।


আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ করেই আঙ্কেল থেমে গেলেন। তিনি আর নিঃশ্বাস নিচ্ছেন না, চোখও নাড়াচ্ছেন না, তাঁর ঠোঁটও আর কাঁপছে না। আঙ্কেলের সারাশরীর জুড়ে জগতের সকল নীরবতা ভর করল আর তিনি দেহত্যাগ করলেন। তাঁর নীরবতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল অন্যদের হইচই আর কান্নার শব্দ। নীরব মৃত্যুও অনেক কোলাহলের জন্ম দেয়।


হঠাৎ আমার ধ্যান ভাঙল। মৃত্যু ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হলেও সেদিন প্রথম বুঝেছি কত যে কঠিন মৃত্যুযন্ত্রণা! আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আমার একের পর এক মনে পড়তে লাগল সেদিন---আঙ্কেলের বিয়ের স্টেজ, আমার কেক-খাওয়ার দৃশ্য, বর সেজে আঙ্কেলের লাজুক চাহনি, সন্তানদের কোলে তুলে তুমুল আদর, আমাকে বাবরি, লাকড়ি ইত্যাদি নামে ডেকে ডেকে ক্ষ্যাপানো, সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া। অদ্ভুত সব দৃশ্য! জীবিত আঙ্কেলের জীবন্ত দৃশ্যগুলি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মৃত আঙ্কেলের সামনে বসে। হঠাৎ অনুভব করলাম, এবার আমার বুকটা খালি খালি লাগছে। বারবারই মনে হচ্ছে, কী যেন নেই কী যেন নেই!


আমি মানুষের সামনে কাঁদতে পারি না।


এদিকে চোখে জলের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে, বাধ্য হয়ে একদৌড়ে আমাদের ঘরে ঢুকে রুম বন্ধ করে আরও অনেকক্ষণ কাঁদলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম, চিৎকার করে করে কাঁদলাম। কেন কাঁদলাম? কে হন উনি আমার? কেন আমি এই মৃত্যুটা সহ্য করতে পারছি না? কেন বুকের ভেতরে এত কষ্ট হচ্ছে?


না, তিনি আমার তেমন কেউই হন না, কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে উনি আমার অনেক কিছু হন। মনে হচ্ছে, আঙ্কেল একবার উঠে দাঁড়াক, কথা বলুক, হাসুক, হাঁটুক, আমাকে ক্ষ্যাপাক। একবার, শুধু একবার মিথ্যে হয়ে যাক এই মৃত্যু নামের ধ্রুবসত্যটা। মিথ্যে হয়ে যাক---মুজতবা আঙ্কেল মারা গেছেন।


আমি আবারও কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে না জানলে বেঁচে থাকাটা অসম্ভব হয়ে যেত!


সারাপাড়া জুড়ে কান্না। মুজতবা আঙ্কেল মারা গেছেন। একজন নিষ্ঠাবান, মাটির মানুষ, সত্যিকারের ভালোমানুষ মুজতবা আঙ্কেল মারা গেছেন।


বউমা (আঙ্কেলের স্ত্রীকে আমরা ‘বউমা’ ডাকতাম) কেমন জানি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন আঙ্কেলের নিষ্পলক চেহারার দিকে। কোনও কথা বলছেন না, একটুও কাঁদছেন না। ভরা রূপযৌবন গায়ে মেখে উনি জীবনের কঠিন নির্মমতার শিকার হয়ে নিথর হয়ে গেছেন। কে বলবে বউমার জামাই মারা গেছেন? কে বলবে বউমার জীবনের সমস্ত সুখ অনায়াসেই ফিকে হয়ে গেছে? দেখে মনে হচ্ছে, এত রূপযৌবনা সুন্দরীর তো ঠিকমতো বিয়েরই বয়স হয়নি, যেন হাতে বিয়ের মেহেদির রং শুকানোর আগেই শুকিয়ে গেছে জীবনের যত রং, লালরংয়ের শাড়ির বদলে সাদারংয়ের শাড়ির আঁচলে গোটা জীবনটাই আজ আঁচল বদলাল। বউমার লম্বাচুলে বিভোর হয়ে-থাকা মানুষটা আজ আর নেই।


মৃতদেহের গোসল সারিয়ে সাদা কাফনে মুড়িয়ে আঙ্কেলকে রাখা হলো সামনের খোলা রুমটায়। সবাই শেষবার দেখতে আসছেন, চোখ মুছে মুছে এক এক করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মা, বোনেরা খানিক বাদে বাদে মূর্ছা থেকে উঠে আবার মূর্ছা যাচ্ছেন।


সন্তানের মৃতমুখ সহ্য করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনও মায়েরই নাই। পৃথিবীর কোনও মাকেই এই ক্ষমতা দিয়ে পাঠানো হয়নি।


কিন্তু হায়, একজন মা, যিনি তাঁর সন্তানকে পেটে দশমাস দশদিন রেখে দুনিয়ার আলো দেখিয়েছেন, সেই মায়ের সন্তানই কিনা তাঁর আগেই দুনিয়ার আলো থেকে মুখ সরিয়ে নিল? স্রষ্টার এ কেমন পরিহাস? যে মা সন্তানের গায়ে মশার কামড় সহ্য করতে পারতেন না, সেই মাকেই সহ্য করতে হচ্ছে সন্তানের মৃত্যু! মৃত্যুযন্ত্রণা কি এর চেয়েও ভয়াবহ কিছু!


সারাজীবনই দায়িত্বের চাপে পিষ্ট মানুষটি আজ মৃত্যুর পর কী নিষ্পলক শুয়ে আছেন। আজ তাঁর বিশ্রামের সময়। পৃথিবীর কোনও কিছুর ভার আর তাঁর কাঁধে নেই। শুয়ে-থাকা আঙ্কেলের চেহারায় কষ্টের ছাপ নেই, দায়িত্ব নেই, কর্তব্য নেই, নেই কোনও শরীরযন্ত্রণার চিহ্নমাত্রও। তিনি আজ সমস্ত চিন্তা ও ভাবনা থেকে মুক্ত! মুক্তি, সব কিছু থেকেই মুক্তি! কিছু মুক্তির কখনও আনন্দমিছিল হয় না।…হয় কেবলই যন্ত্রণামিছিল।


মৃতদেহকে ঘিরে চারপাশে গোল হয়ে কোরান নিয়ে পড়তে বসেছে সবাই। আগরবাতি জ্বলছে, আগরবাতির ধোঁয়া সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যেন---একদিন সব পথেরই শেষ আছে, একদিন জীবনরেল শেষস্টেশনে গিয়ে ঠিকই থেমে যাবে। অর্থহীন জীবনচাকায় একদিন জং লেগে যাবে। এত আয়োজনের কিছুই সাথে যাবে না, সব কিছুই পেছনে ফেলে রেখে চলে যেতে হবে।


ফাইজা বাবার পাশে বসে বাবার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছে। সদ্যই জীবন বুঝে-ওঠা ফাইজা সেদিন খোদার কাছে কী প্রশ্নের উত্তর চাইছিল, তা আমাদের কারওই জানা হয়নি। দুর্জয় শুধু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়ে খানিক বাদে বাদে ভয়ে ভয়ে কাঁদছে। সে কেন যে কাঁদছে, তার সঠিক কারণ সে নিজেও জানে না। তার এখনও জানার বয়স হয়নি। বিজয় ঘরের গলিতে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলছে। জীবন কী, তা বুঝার আগেই মৃত্যুর সাথে তার প্রথম পরিচয় ঘটে গেছে।


শোরগোল বাড়ছে, বউমার একমাত্র ভাই এসেছেন। এবার বউমা উঠে দাঁড়ালেন, দৌড়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে গলাফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। ভাইটি তাঁর অল্পবয়সী বোনের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না, জড়িয়ে ধরে কী বলবেন ঠিক বুঝে উঠতেই পারছেন না। বউমা এবার ভাইয়ের বুকে বুকফাটিয়ে বলে উঠলেন, “আমার সংসার ভেঙে গেল, ভাইয়া, আমার বাগান ভেস্তে গেল, আমার সব শেষ!” আমরা সবাই দেখছি, তাঁর বুকের পাথরগুলি এক এক নামছে যেন!


দুপুরের পর আঙ্কেলকে খাটিয়ায় করে নিয়ে যাওয়া হলো। বাবার পাশে মুজতবা আঙ্কেলকে সমাহিত করা হলো। একসময়, সবাইকেই বাবার পথে হাঁটতে হয়।


একজন মানুষের চিরবিদায়। একজন সাদামনের মাটির মানুষ মাটিতেই মিশে গেলেন।


এবার সবার ভাবনা---এই পরিবার চলবে কী করে? কীভাবে বেঁচে থাকবে?


আঙ্কেলের কফিল নিয়মিতই সব কিছুর খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, মেয়ের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত, ছেলে উপার্জনক্ষম না হওয়া পর্যন্ত ওই পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রতিমাসে দশ হাজার করে টাকা পাঠানো হবে।


এদিকে বউমা দ্বিতীয় বিয়ে করবেন কি না সিদ্ধান্ত হচ্ছিল। তিন সন্তান নিয়ে বউমা বিয়ে না করারই সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন বউমার ভরাযৌবনকাল, রূপ যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। এদিক ওদিক থেকে সম্বন্ধ আসতে শুরু করল। কিন্তু বউমা সন্তানদের কথা ভেবে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।


দিন গড়াল। সমস্ত শোক শক্তি হয়ে উঠল। মৃত্যুও কিছুই আটকে রাখতে পারে না। ফাইজা, দুর্জয়, বিজয় বড় হয়ে উঠছে। প্রতিমাসে আর্থিক সহায়তা আসে বাহারাইন থেকে, পাশাপাশি আঙ্কেলের ভাইও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেন। পরিবারে তেমন আর্থিক দোটানা নেই। জীবন থেমে নেই, চলছে…


আঙ্কেলের মৃত্যুর পর তাঁর মা, যাকে আমরা দাদু ডাকতাম, পাগলপ্রায় হয়ে যান। তিনি হাসেন না, খান না, কারও সাথেই কথা বলেন না। হয় মাটির দিকে, কিংবা যে তাঁর সামনে যায় তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। ঘরের দরজায় বসে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন, হয়তো ভাবতেন, নিজের হাতে গড়া জীবনমূর্তিটি মাটির গায়ে ধুলো হয়ে মিশে আছে। ছেলে কীভাবে খিলখিল করে হেসে তাঁকে ডাকত, তাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তাঁকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেত---এক এক করে সব মনে পড়ে যায় তাঁর। খিদে পেলে খাবার চাইত মায়ের কাছে…ছেলের বুঝি এখন আর খিদে পায় না, কত দিন ধরে ছেলে না খেয়ে আছে। কীভাবে আছে?


দাদুর অসুস্থতা বাড়তে লাগল। আঙ্কেলের মৃত্যুর পরের বছরই দাদু মারা গেলেন। তাঁকে কবর দেওয়া হলো ছেলের কবরের ঠিক পাশেই। মধ্যরাত্রিতে ছেলের জন্য বিলাপ করে কেঁদে-ওঠা মা এখন ছেলের পাশেই ঘুমিয়ে আছেন। ছেলের মতোই মায়ের কান্না, শোক, যন্ত্রণা সব কিছু থেমে গেছে চিরতরে। এখন তিনি নীরব, এখন তিনি বিশ্রামে। পৃথিবীর সবচাইতে অস্থির মানুষটিও একদিন আশ্চর্য রকমের শান্ত হয়ে যান।


সেই ছোটবেলার মতো করে পাশাপাশি তিনটি মানুষ ঘুমিয়ে আছেন---বাবা, ছেলে, মা। বাবা-মা আজও ছেলেকে তাঁদের মাঝে পরম যত্নে আগলে রেখেছেন।


তার পর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে আমি বড় হয়ে গেলাম। “কেউই না”-হওয়া ওই মানুষটির জন্য মধ্যরাতে এখনও হু হু করে কেঁদে উঠি। এখনও ভাবি, কিছু সত্য মিথ্যে না হয়ে যাবার যন্ত্রণা মৃত্যুর মতোই কঠিন। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে দেখা জীবন মনে পড়ে যায় বারবার। বুঝতে পারি, জগতের মুজতবা আঙ্কেলদের মতো নিখাদ মানুষদের জন্য এখনও অনেক মানুষ কাঁদে। কিছু মানুষের স্মৃতি মৃত্যুতেও মলিন হয় না। আবার পরক্ষণেই মাথায় আসে---আচ্ছা, আমার মৃত্যুর পর আমার জন্য এই পৃথিবীর কোথাও কি কেউ লুকিয়ে কাঁদবে কখনও?


কখনও কখনও কিছু মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ মরে যাবার পরও বেঁচে থাকেন শরীরহীনতায়। কারও কারও ভালোবাসায়, কারও কারও অমর স্মৃতিতে।


ফাইজা বড় হচ্ছে, মায়ের মতো ফাইজাও রূপে অপ্সরী হয়েছে। আঙ্কেলের শেষইচ্ছা ছিল বাঁধন ফুফির ছেলে বিলুর সাথে ফাইজার বিয়ে দেওয়া। কিন্তু বিলু আর ফাইজা বয়সে এক বছরের বড় ছোট মাত্র। বাঁধন ফুফি দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে বিয়ের পর থেকেই বাপের বাড়ির পাশে একটা ঘরে থাকতেন। ফুফি আর তাঁর স্বামী পালিয়ে বিয়ে করায় বরপক্ষ মেনে নিচ্ছিল না। ফলে বিয়ের পর থেকে ঘরজামাই হিসেবেই থেকে গেছেন ফুফা। বাড়ির পাশে অতিরিক্ত একটা জায়গায় ঘর তুলে উনারা থেকে গেছেন। এই সুবাদে বাঁধন ফুফির তাঁর বাপের বাড়িতে যাতায়াত ছিল প্রতিদিনই।


যদিও বিলু আর ফাইজার বিয়ের কথা বলে গেছেন আঙ্কেল, ওরা দুজন দা-কুমড়ো সম্পর্কে ছিল, সারাক্ষণই ঝগড়ায় লিপ্ত থাকত। একজন আর একজনের সামনে পড়া মানেই রীতিমত একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়া। ফাইজা যত বড় হচ্ছে, তার সৌন্দর্যও তত বাড়ছে। আঙ্কেলের মেজো বোনের ছেলে ফরিদ। বয়সে ফাইজার বেশ বড়। পড়াশোনা তেমন করেনি, দেখতেও বদখত। দিন যত গড়াচ্ছে, ফাইজার প্রতি ফরিদের আকর্ষণ ততই বেড়েই চলছে। ফাইজার সাথে বেমানান দেখতে ফরিদ বউমার ঘরের সকল দায়িত্ব নিতে উঠে পড়ে লাগল। ফাইজার জন্য এটা পাঠানো, ওটা পাঠানো, ফাইজাকে কেউ বিরক্ত করছে কি না, কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না, সব ধরনের খোঁজখবর সে রাখে। কিন্তু এত কিছু করার পরও কিছুতেই যেন ফাইজার মন পায় না। ফরিদ ফাইজাদের বাসায় এলে ফাইজা কারণে অকারণে বের হয়ে যায়। ফরিদের সামনেই পড়ে না সে। কেমন জানি সহ্যই করতে পারে না সে ফরিদকে।


ফরিদের পরিবার থেকে ফাইজার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলা হলো। ফাইজা কিছুতেই রাজি না। এদিকে ফরিদ সাফ সাফ জানিয়ে দিল যে, ফাইজাকে না পেলে সে আত্মহত্যা করবে নিশ্চিত, ওদিকে ফাইজাও সাফ সাফ জানিয়ে দিল, ফরিদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কোনও কথা বললেই সে নিজে আত্মহত্যা করে ফেলবে এবং এর জন্য ওদের সবাইকে দায়ী করা হবে।


বাঁধন ফুফি মেয়েদের ভার্সিটি আর বিলুকে কলেজে ভর্তি করানোর জন্য শহরে শিফট করেন কয়েক বছর আগে। এখন আর বিলু ফাইজার আগের মতো ঝগড়া হয় না, তবে বিয়ের হবার মতো সম্পর্কও ওদের মধ্যে হয়নি। দুজনের বয়সের গ্যাপ অনেক কম হওয়ায় বিয়ের ব্যাপারে কোনও প্রশ্নই উঠে না! বিলু এবার ইন্টার পরীক্ষা দিবে। ফাইজা ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। বয়সের গ্যাপ মাত্র এক বছর।


এদিকে ফাইজা পাশের বাড়ির এক চাচাত ভাইয়ের প্রেমে পড়ে যায়। ওদের বয়সের গ্যাপ তিন-চার বছর। গোপনে ওদের প্রেম চলছে। কত দূর গড়ায় এ সম্পর্ক তার কোনও হদিস নেই। বিলুর মধ্যে ফাইজার ব্যাপারে তেমন আগ্রহবোধ আসেনি, দেখা হলে এখনও আগের মতো মাঝে মাঝে ঝগড়াঝাঁটি বেধে যায়। কখনও সুযোগ পেলেই দুজন দুজনকে গালাগালি, মারামারি করতে শুরু করে দেয়। একে অপরকে অপমান করা চলতেই থাকে। বিলু দেখতে কিন্তু রাজপুত্রের মতো, তবে সব রাজপুত্রকে তো আর রাজকন্যারা সহ্য করতে পারে না, তাই ওদের মধ্যে কিছু হয়ও না। আসলে ওদের ভেতর দুজন দুজনের জন্য প্রেম জিনিসটা ঠিক জেগে ওঠেনি। প্রেম ভেবেচিন্তে হয় না, বলেকয়েও আনানো যায় না। এমনকি, খুব চেষ্টায়ও প্রেম জিনিসটা আসে না।


এদিকে ফাইজাকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে ফরিদ।


একদিকে নিজের পছন্দ মামুন, অন্যদিকে বাবার পছন্দ বিলু, আর একদিকে ফুফির পছন্দ ফরিদ---এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে কে জিতবে কে হারবে, তা স্বয়ং বিধাতাই জানেন! স্রষ্টা কারও জন্য প্রেম জাগিয়ে দিয়ে তোলপাড় করে দেন, অন্যদিকে কারও জন্য অপ্রেম মেখে দিয়ে হিসেবে গরমিল করে দেন। কোনও কিছুতেই যেন যোগসূত্র মিলে না। দেখেশুনে, হিসেব কষে প্রেম হয় না, বড়জোর ব্যবসা হয়! জীবনের অনেক হিসেবই সূত্রে চলে না, কখনও কখনও জীবনের হিসাব মেলাতে হয় অনুসিদ্ধান্ত দিয়ে। হায় জীবন, সে আজীবনই এক অমীমাংসিত অঙ্ক! অনিশ্চিত এর চূড়ান্ত হিসাব!