একটা ‘আপনি’ নামের মনকেমন

 
এই কয়েকদিন ধরে নিজেকে বোঝাচ্ছি, আপনাকে ‘তুমি’ ডাকার ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে যাবে শেষপর্যন্ত। পৃথিবীতে এসে যে ইচ্ছেগুলি অপূর্ণ রেখেই বাঁচতে হচ্ছে, হয়তোবা মরতেও হবে এই অপূর্ণতা নিয়েই, সেইসব চিরঅপূর্ণ ইচ্ছের লিস্টটা এবার আরও একটু দীর্ঘ হলো, স্পষ্ট বুঝতে পারছি।


দেখলাম, সেদিন বউ-বাচ্চাসহ আপনি কোথায় জানি ঘুরতে গিয়েছেন। কোনও এক নদীর পাড়ে। নৌকায় চড়ে। ওদের সাথে নিয়ে ভারি মজা করে টংয়ের দোকানের চা-ও খাচ্ছেন। ছবিতে দেখেছি। আমি তো কেবলই দেখতে পারি, এর বেশি কিছু নয়।
এদিকে আমার ঘরে সন্ধে ঘনাল, রাত নামল। আপনি সেই সকাল থেকে রাত অবধি কোনও টেক্সট দেননি। নেটে এসেছেন, কিন্তু আমার টেক্সট দেখেনওনি।
আপনার ওয়ালে দেখেছি, পরিবার নিয়ে বড্ড ব্যস্ত আপনি। একটা একটা করে সবকটা ছবি দেখছিলাম। আপনাকে ও আপনার সাথে যা-কিছু হয়, তা দেখতে আমার বরাবরই ভালো লাগে। তবু কী জানি কেন, সেদিন আমার বুকটা হু হু করে উঠল! আমার মধ্যে ঈর্ষা নেই, এটাই জেনে এসেছি। সেই আমার মধ্যেও ঈর্ষা জমতে শুরু করল। ভাবতে পারেন!
একটা ছবিতে বউ আপনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছবিমাত্র, আর কিছু নয়! সামান্য হাতটা ধরেরাখা, অথচ এই ছবিটাই আমার ভাঙাচোরা জগতটাকে আরও ভেঙে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে! ইচ্ছে করছে, ওর হাতটা এখুনিই, এই মুহূর্তেই আপনার হাত থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে এখুনিই আপনাকে টেনেহিঁচড়ে আমার কাছে নিয়ে আসি! ছবিগুলি থেকে তার হাতটা আপনার হাত থেকে সরানো যাচ্ছিল না। আমার অপূর্ণইচ্ছে আরও একটা বাড়ল।


আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখতে দেখতে কেন জানি কষ্ট বাড়ছিল। তাই, ছবিটাতে ওর পাশটায় আঙুল দিয়ে ওকে ঢেকে রেখে আপনাকে জুম করে করে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এই মুখ, এই চোখ, এই ঠোঁট, এই গাল, এই কপাল, এই বুক, এই পা, এই পেট…এই সবকিছুই আমার, একান্তই আমার, এখানে আর কারও একফোঁটাও ভাগ থাকতে পারে না, আপনি পুরোপুরিই আমার একার একটা মানুষ!
পরক্ষণেই আঙুল সরিয়ে পাশেথাকা আপনার বউকে দেখলাম। এবার তার দিকে নজর ঠেকিয়ে ভাবছি, এই হাত প্রতিদিন আপনাকে ছোঁয়, এই চোখ প্রতিদিন ঘুমভেঙে আপনাকে প্রথম দেখতে পায়। ওর কণ্ঠটা প্রতিদিন আপনি শুনতে পান, এই মুখটা প্রতিদিন আপনার সামনে থাকে।
দেখলাম, এবার অসহায় লাগছে, নিঃস্ব লাগছে, শূন্য লাগছে, বড্ড একা লাগছে।


এসব ভাবতে ভাবতে আমার দুঃখ বাড়ছে, কষ্টরা দ্বিগুণ থেকে কোটিগুণ হচ্ছে, আমার নিশ্চুপনগরীতে নেহায়েত নাম-না-জানা এক টর্নেডো আমার বড় কষ্টের তৈরি ছনের চালার ঘরদোর ভেঙেচুরে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ভাবতে লাগলাম, এই মানুষটি আগাগোড়াই কেন আমার নয়? কেন মানুষটাকে পাবার বেলায় সমাজের, ধর্মের, রীতির এত বেড়াজাল? আমি চাইলেই কেন অমন করে ছুঁতে পারি না? চাইলেই কেন হুট্‌ করে মানুষটার গালে একটাও চুমু লেপটে দিতে পারি না? কেন কারও পাশে সারাজীবনই নিজের নিয়মে বাঁচতে গেলে কেবল ভালোবাসা-থাকাটাই যথেষ্ট নয়?
আমার সকালটা কেন এত শূন্যতা নিয়ে শুরু হয়? আমার রাতটা কেন এমন ঘোরঅন্ধকার নিয়ে গোটা মহাপৃথিবীর চেয়েও ঢের বেশি শূন্যতাকে সঙ্গী করে আমার ঘাড়বেয়ে চোখে ওঠে, আর সেখানেই আটকে থাকে অনন্তকাল? এই রাতের নির্জনতায় কেন আপনি নেই? মধ্যরাতে ঘুমভেঙে ঘুম ঘুম চোখে কেন আপনার বদলে একরাশ একাকিত্ব আর শূন্যতা বুকে জড়িয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তে হয় আমাকে?
এই রাতের শূন্যতার বুকচিরে কেন জোনাকির একবিন্দু আলোর শরীরে আপনি নেই? এপাশে নেই, ওপাশেও নেই…কোথাও নেই আপনি!
…অথচ সে কেন এপাশ থেকে ওপাশ ফিরলেই আপনার মুখ, গাল, চিবুক, বুক ছুঁতে পায়? সে না চাইলেও পায়, না চাইতেই পায়, আর আমি এত চেয়েও কেন শুধুই হারাই!


সেদিন কেন জানি দরজা-জানলা বন্ধ করে, লাইট নিভিয়ে আপনার শুয়েথাকা জায়গাটায় মুখ ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদেছিলাম। বালিশের পেটের মধ্যে মুখ চেপে ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। সেদিন সারারাতই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি।
কেন অমন করে কাঁদলাম সে-রাতে? সে আপনাকে ছোঁয় বলে? না কি আমি আপনাকে ছুঁতে পারি না বলে? না কি দুই কারণেই?
আমার বারবার ইচ্ছে করছিল, দৌড়ে গিয়ে আপনার শার্টের কলার চেপে ধরে টানতে টানতে আমার ভাঙাঘরটায় নিয়ে এসে খাটে বসিয়ে, আপনার দুইহাঁটুর উপর আমার মাথা উপুড় করে চেপে ধরে ঘণ্টাখানেক কাঁদি। চিৎকার করে করে, বুক ভাসিয়ে কাঁদি।…স্রেফ বলতে ইচ্ছে করছে বলেই এসব বলছি না, আমার সত্যিই এমন করতে ইচ্ছে করে!


আমি পারি না, আমি আপনার ভাগটা আর কাউকে দিতে পারি না! আপনাকে হাতে বা নজরে কেউ সামান্যতমও ছুঁক, তাতে আমার মন কিছুতেই সায় দিতে চায় না। অথচ দেখুন, পৃথিবীর কোনও কিছুর প্রতিই একটুও লোভ-না-থাকা এই আমিই আপনার বেলায় ক্রমেই কেমন হিংসুটে আর ভয়ংকর লোভাতুর হয়ে উঠছি! এই লোভের কথা আপনাকে কখনও জানানো হয়নি। আপনি সামনে এলে আমার আপনাকে কিছুই জানাতে মনে থাকে না।
আমার ইচ্ছে করে, এই সমাজের নিয়ম ছিঁড়ে, ধর্মের সকল কাঁটাতার ডিঙিয়ে আপনাকে নিয়ে দূরে, অনেক অনেক দূরে কোনও এক সাহারা-মরু বা নির্জন কোনও এক বালুচরে গিয়ে সেখানে একান্ত একটা ঘর বানাই। খুব সাদামাটা আমাদের ওই ঘরটায় অভাবের টানাপোড়েন থাকবে, তবু সে-ঘর ভালোবাসা আর ভালোথাকায় ঠাসা থাকবে।
…আপনাকে ভালোবাসার আগে এতটা গভীরে গিয়ে কাউকে কখনও ভাবিনি।


এই তো সেদিন, একটা টেক্সট পাঠিয়েছিলেন: দেন, শুড আই লিভ ইউ টু লেট ইউ লিভ?
আপনি জানেন না, সেইদিন সেই মেসেজটা পড়ে অনেক কেঁদেছি।
মেসেজটা পড়ার সাথে সাথে বুকটা ধক্‌ করে কেঁপে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আপনি আমায় ছেড়ে-যাবার ফন্দি আঁটছেন, এই বুঝি আমার সংসারটা ভেঙে দিয়ে আপনি দূর থেকে আরও দূরে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছেন, এই বুঝি আমার প্রাণটা কলজে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে, যেন আমি জোর করে হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে প্রাণটাকে আবার এই বুকটায় পুরে দিচ্ছি!
ভাবছিলাম, তুচ্ছ ওই একটা মেসেজের এত শক্তি! আমায় বাঁচাতে আপনি আমায় ছেড়ে দিতে চান, অথচ একবারও ভাবলেন না---এক আপনিই যে আমার বেঁচেথাকা! আপনি জানেন না, আপনি আমার একটা সংসার!


সেদিন ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল। আপনাকে হারিয়ে-ফেলার ভয়ে। হ্যাঁ, যাঁকে এ জীবনে কখনও পাওয়া হবে না, তাঁকেই হারিয়ে-ফেলার ভয়ে!
দুইচোখ বন্ধ করে কল্পনা করছিলাম, আপনাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে ঠিক কেমন লাগবে!
চোখ বন্ধ করলাম। দেখতে পেলাম, একটা নির্জনদ্বীপ। তার ডানে ধু-ধু একটা মরুভূমি, তার বামে বিস্তৃত একটা বালুচর, মাথার উপরে খাঁখাঁ রৌদ্রের শূন্যআকাশ, আর পায়ের নিচে থই থই করা মহাসমুদ্র। এই সবকিছুর মাঝখানে আমি একা দাঁড়িয়ে…যেন কোথাও আর কেউ নেই। এক-পা এগুতে চাইলে ধপাস করে পড়ে কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি! বামে হাত বাড়াতেই কিছু নেই, ডানে হাত বাড়াতেই কিছু নেই, উপরে চোখ ফেলতেই নেই কিছুই এক আমি ছাড়া!
এমন টলোমলো অবস্থায় আমি যেন অন্ধকার কোনও গলির পথ ধরে নিঃসঙ্গতার বুক ঠেলে ঠেলে কোথায় জানি হারিয়ে গেলাম! আমি নিজেকে খুঁজছি…খুঁজেই যাচ্ছি হন্যে হয়ে, কিন্তু কোথাও আমি নেই।
সেদিন বুঝলাম, আমি আর আমার নেই, আপনার অস্তিত্বে আমার অস্তিত্ব মিশে গেছে, আপনার থেকে-যাওয়ায় আমার বেঁচে-থাকা আটকে আছে। এই আমি নই আর আমার একার, এখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে আপনার একনায়কতন্ত্রে আমার গোটা পৃথিবীই বেদখলে চলে গেছে!
চোখ খুললাম। খুলে দেখলাম, আমার বুক ভিজে গেছে চোখের জলে। চোখ থেকে টলটল করে জল গড়িয়ে কখন যে বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে, আমি টের পাইনি।


আপনি চলে যাচ্ছেন, এইটুকু ভাবতেও যে আমি এতটা টুকরো টুকরো হয়ে নিমিষেই তলিয়ে গেলাম কোন যে অতলে, সে-ই আমার পৃথিবীতে সেদিন কি আর ভোর হবে আদৌ, যেদিন আপনি সত্যি সত্যি চলে যাবেন?
সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আমি থেকে যাব আপনার সাথে। না থাকুক কোনও সংসার, না থাকুক এই সম্পর্কের কোনও নাম, না থাকুক কোনও ঘরকন্না, তাতে কী এসে যায়? আমার এত এত না-থাকাজুড়ে কেবল আপনি থাকুন। দুইদিনেরই তো জীবন, ঠিকই কেটে যাবে বাকিটা সময়!
সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আমি আবারও পড়ব। ভালো করেই পড়ব। নিজের একটা ক্যারিয়ার তৈরি করব। অনেকদিন সুস্থশরীরে বাঁচব। অনেকগুলি সুখস্মৃতি নিয়ে আমি আপনার সাথে বুড়ো হব। আপনার হাত ধরে, গলা জড়িয়ে, বুকে বুক ঠেকিয়ে একটাবার সুখীহবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারব এই জীবনটাকে, সাথে এই সমাজটাকেও!
…আমায় একটু ঠাঁই দেবেন ওই বুকটায়? আমি জন্ম থেকে দাউ দাউ করে জ্বলছি, প্রতিমুহূর্তেই পুড়ে পুড়ে ছাই হচ্ছি। আমি কষ্টের রঙে নিজের রং মিশিয়ে-বাঁচা একজন ব্যর্থ মানুষ। আমায় ফেলে দেবেন না, মিনতি করে বলছি, আপনি আমায় বাঁচান!


যে ভালোবাসাটা আমি সারাজীবন ধরে পেতে চেয়েছি, সে ভালোবাসাটাই আমি তোমাকে দেবো।
যে মানুষটাকে আমি নিজের জন্যে খুঁজেছি হন্যে হয়ে, আমি তোমার জন্যে সে মানুষটাই হয়ে উঠব।
যে পৃথিবীটা দেখব বলে আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম, আমি তোমার জন্যে সে পৃথিবীটাই তৈরি করব।
যে স্বপ্নটা পূরণ হবে না, এ ভয়েই আমি বাঁচি প্রতিমুহূর্তেই, আমি তোমার জন্যে সে স্বপ্নটাই ছুঁয়ে দেখব।
যে জীবনটা কেবলই আমার কল্পনাতে ছিল, তোমায় পেলে এই জীবনেই সে জীবনে বেঁচে থাকব।
…এতকিছুর পরও, আপনি থেকে যাবেন না আমার পাশে আমার একটা ‘তুমি’ হয়ে?