একটি এলিজির জন্ম

কলেজের অল্পবয়েসি স্যারদের সাধারণত কেউ পা ছুঁয়ে সালাম করে না। আমি করতাম। আমরা ২ ভাই বাসা থেকে ভাত খাওয়ার ব্যাপারটা যেরকম অভ্যস্ততায় শিখেছি, স্যার-ম্যাডামদের পা ছুঁয়ে সালাম করার ব্যাপারটাও একই অভ্যস্ততায় শিখেছি। এজন্যে স্যারদের কাছে ‘ভদ্র ছেলে’ বলে আমার আদর ছিল। ‘ভদ্র ছেলে’ ইমেজ ধরে রাখার চেষ্টা করাটা খুবই অস্বস্তিকর আর বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। ‘ভদ্র ছেলে’দের অনেক কষ্ট। চিটাগাং কলেজে পড়ার সময় ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পরিসংখ্যান প্রাইভেট পড়তাম কামরুল হাসান স্যারের কাছে। উনি আমার দেখা খুব মজার একজন মানুষ। বিচিত্র সব গাঁজাখুরি গল্প বানিয়ে-বানিয়ে বলতে পারতেন। স্যার বুঝতেন, আমরা ধরে ফেলছি, তবু এতটুকুও ইতস্ততবোধ না করে গল্প প্রসব করে যেতেন। স্যারকে আমরা খুব পছন্দ করতাম ৩টা কারণে। এক। উনি ক্লাসে খুব একটা পড়াতেন না, গল্পই করতেন বেশি। প্রায় গল্পেই এক বা একাধিক ‘রূপসী কন্যা’ (উনার ভাষায়) থাকত। কিশোর বয়সে সুন্দরী মেয়ের গল্প অতি উপাদেয়। দুই। প্রচুর হোমওয়ার্ক দিলেও সেগুলো কখনোই চেক করতেন না। পরীক্ষার আগের ক্লাসে কোনো মেয়ে একটু ঢং করে অনুরোধ করলেই ডেট পিছিয়ে দিতেন। পরে আমরা সবাই মিলে ওই মেয়েটাকে আইসক্রিম খাওয়াতাম। তিন। গার্ডিয়ানদের কাছে উনি বলতেন, আপনার ছেলে অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন। ও বড় হয়ে অনেক দূর যাবে। গার্ডিয়ানরা এতে খুব খুশি হতেন এবং স্যারকে আরো স্টুডেন্ট এনে দিতেন। এরকম অনেক ‘অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন’ ছেলে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালে পরিসংখ্যানসহ ৬টার মধ্যে ৪টাতে ফেল করেছিল। আমাদের সময় চিটাগাং কলেজে ‘ফার্স্ট ইয়ার, ড্যাম কেয়ার’ ভাব ছিল পুরোমাত্রায়, ফার্স্ট ইয়ার শেষে একটাই পরীক্ষা হত আর পরীক্ষায় ডজনে-ডজনে ফেল মারত। এখন হয়তো অবস্থা বদলেছে। ছেলেমেয়েরা আগের চাইতে বেশি পড়াশোনা করছে, বেশি এপ্লাস পাচ্ছে, এবং ইন্টার পাস করার পর কোথাও চান্স না পেয়ে প্রাইভেটে ভর্তি হচ্ছে।

আমি স্যারের কাছে ভর্তি হওয়ার পর স্যারকে সবার সামনে অভ্যাসবশত পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। আবেগে স্যারের চোখে পানি চলে এল। ক্লাসের বিটলা পোলাপান হিহি করতে লাগল। স্যারের চোখে পানি, স্টুডেন্টদের মুখে হাসি। অভূতপূর্ব দৃশ্য! আমার খুব হাসি পাচ্ছিল। যথাসম্ভব হাসি চেপে রেখে স্যারের দিকে ভদ্রভদ্র অ্যাপিয়ারেন্সে তাকিয়ে থাকলাম। স্যার খুব রেগে গিয়ে বললেন, এই বেয়াদব ছেলেরা! তোমরা হাসছ কেন? এই ছেলেকে দেখে শিখ। দেখবে, এই ছেলে অনেক উন্নতি করবে। আমি ওকে একশো পারসেন্ট দোয়া করে দিলাম। স্যারের একটা মজার ব্যাপার ছিল, উনি সবসময় পারসেন্টে হিসেবে দোয়া করতেন। সবসময়ই সবচেয়ে কম পারসেন্টেজে দোয়া পেতো যে ছেলেটা, সে আমাদের সময় বোর্ডস্ট্যান্ড করেছিল। মেয়েদের দোয়ার পারসেন্টেজ ছিল সবচেয়ে বেশি। স্যার জানতেন, মেয়েরা এসব ব্যাপার একটু কম বোঝে। মেয়েরা মিষ্টি কথায় পটে যাওয়ার জন্যই জন্ম নেয়। একবার আযান দেয়ার সময় এক মেয়ে মাথায় ওড়না দিল। স্যার খুশিতে গদগদ গলায় বললেন, এই মেয়ে অত্যন্ত ভাল মেয়ে। এই মেয়েকে কোনোদিন বিবাহ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এই মেয়ের ভাল বিবাহ হবে। মেয়েটা বিমর্ষ মুখে স্যারের দিকে তাকালো। স্যার বললেন, কী ব্যাপার? কী সমস্যা? মন খারাপ কেন? তোমাকে এতো ভাল একটা বিবাহ দিলাম! শুকরিয়া আদায় কর। বল, শুকরিয়া! এরপর থেকে ওর নাম হয়ে গিয়েছিল, ভাল-বিবাহ। স্টুডেন্টরা স্যারদের আর ক্লাসমেটদের বিশ্রীবিশ্রী নাম দেয়ার অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। ভাল-বিবাহ মেয়েটার সেদিন মন খারাপ থাকার কারণ ছিল, মেয়েটার ৩ নম্বর বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেদিন সকালেই ওর ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিল।

চকবাজারের জয়পাহাড় নিয়ে অনেক স্বরচিত কবিতা স্যার আমাদের ক্লাসে অনেকটা জোর করেই শোনাতেন। আমরা, স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন না, এই খুশিতে ওইসব অখাদ্য হাসিমুখে হজম করতাম। অবশ্য, স্যারের কাব্যপ্রতিভার মেইন টার্গেটই ছিল ক্লাসের আর্টসের সুন্দরী মেয়েরা। ওদের দেখতে-দেখতে আমার নিজেরই একটা সময়ে ধারণা হয়ে গিয়েছিল, আর্টসের মেয়েরা দেখতে সুন্দরী হয়। চিটাগাং কলেজে পড়ার সময় আমি মনেমনে ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমার মেয়ে হলে মেয়েকে আমি অবশ্যই আর্টসে পড়াব। উনার সব কবিতায় হয় জয়পাহাড় কান্না করতো অথবা উনি নিজে কান্না করতেন। সব কবিতাই ছিল জয়পাহাড়ের কান্নাজাতীয় কবিতা। কবিতায় উনাকে ছ্যাঁকা দেয়ার কারণে উনার দুঃখে জয়পাহাড় পর্যন্ত কান্নাকাটি করছে, এই জাতীয় সমস্যার কথা ছিল। জয়পাহাড়ের কান্না শুনে…….আমি জয়পাহাড়ের কান্না দেখেছি…….জয়পাহাড়ের কষ্ট আজ কান্না হয়ে ঝরে……. ভুলভাল উচ্চারণে আবৃত্তির এক পর্যায়ে আবেগে উনার চোখে পানি চলে আসত। আর্টসের সুন্দরীরা হিহি করে হাসতে থাকত। এরপর থেকে উনার একটা পুরনো ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়—সুন্দরীমাত্রই নির্দয়। দয়ামমতা ও সৌন্দর্য পরস্পর ব্যস্তানুপাতিক। স্যারের কবিতা আবৃত্তির ঢং ছিল উনার কবিতাগুলোর চাইতে বহুগুণে বাজে। অবশ্য উনার ধারণা ছিল, কবিতা লেখা আর আবৃত্তি করা, দুটোই তাঁর সহজাত প্রতিভা। আমরা মনেপ্রাণে দোয়া করতাম, আল্লাহ্! স্যারের প্রসববেদনা আর না উঠুক! একবার কথায়-কথায় স্যারকে বোল্ড করার জন্যে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার, আপনার বাড়ি কি পাবনা? কাকতালীয়ভাবে স্যারের বাড়ি ছিল আসলেই পাবনাতে। স্যার মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সুশান্ত, তুমি কীভাবে বুঝলে? আমি দ্বিগুণ উৎসাহে বললাম, স্যার আপনার বাড়ি পাবনা না হওয়াটা সম্ভব না। স্যার হেহে করে হাসতে-হাসতে বললেন, এই তোমরা দেখেছ, এই ছেলে বিরল প্রতিভার অধিকারী। ওর আইকিউ অনেক শার্প। সুশান্ত, শোনো, তুমি কি কখনো নছিকাঁথার গান শুনেছ? সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, কী নাম বললেন? স্যার বললেন, কেন? নছিকাঁথা!! এই ছেলের গান শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি। ও নাকি নিজেই গান লেখে, সুর করে, গায়। বিরল প্রতিভা! আমি মনে করি, ওকে গানে একটা নোবেল প্রাইজ দেয়া দরকার। তোমরা কী বল? ও আচ্ছা, তোমরা তো শুনই নাই। ওর গান শুনে আমি ঠিক করেছি, আমিও গান লিখা শুরু করব। কী বল? আইডিয়াটা কেমন? হেহে…… কালকে ওর গান শুনে একটা ‘স্বরচিত গান’ (স্যার এভাবেই বলতেন) লিখেছি। তোমাদের শোনাই। ……. আমরা সবাই অতি আনন্দিত। বুঝলাম, স্যার সেদিনও ‘সংশ্লেষ ও নির্ভরণ’এর কোয়েশ্চেন রেডি করতে ভুলে গেছেন অথবা পারেননি। পরীক্ষা হবে না, এটা জগতের সবচেয়ে খুশির খবর। এ খুশি উপলক্ষে প্রয়োজনে, মানুষ সাপ হয়, সাপ মানুষ হয়-জাতীয় সাপের নাচওয়ালা বাংলা সিনেমাও দেখা যায়। আর গান? সে তো অনেক ভাল জিনিস! স্যারের গানের গলা মেজাজ খারাপ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট—সেদিন বুঝলাম।

স্যারকে আমার মনে আছে অন্য একটি কারণে। ওখানে শতাব্দী নামের একটা মেয়ে পড়ত। ও আমাকে অসম্ভব পছন্দ করত; পরে বুঝেছি, ভালোবাসত। আমাদের সময়ে গ্রেডিং সিস্টেম ছিল না। সায়েন্স আর্টস কমার্স প্রতিটা গ্রুপ থেকে মেরিটলিস্টের প্রথম ২০ জন স্ট্যান্ড করত। স্ট্যান্ড করা মানে ওই বোর্ডে প্রথম ২০ জনের মধ্যে থাকা। (আমাদের পবিত্র দায়িত্ব ছিল, স্ট্যান্ড-করা স্টুডেন্টরা দিনে কয়বার টয়লেটে যেত, সেটাও যত্ন সহকারে মুখস্থ করে ফেলা, এবং সে অনুযায়ী টয়লেট করা। পেপারে যতটুকু বাড়িয়ে সম্ভব ততটুকু বাড়িয়ে ওসবকিছু লেখা হত এবং বাসায় মা-বাবা হাতে পেপারটা ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ভাল করে দেখ! তোকেও এর মত হতে হবে। ……. দুনিয়ার সবচেয়ে কষ্টকর দোয়া হল, কারও মত হতে বলা। এই দোয়া করার চাইতে কোনো দোয়া না করাও অনেক ভাল। নিজেকে হতে হয় নিজের মত কিংবা তার চাইতে ভাল। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সাধনাই সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা। অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করলে আত্মতৃপ্তি কিংবা হীনমন্যতা কাজ করে। সে ক্ষেত্রে আর এগোনোই যায় না।) ও চিটাগাং কলেজে আর্টস থেকে স্ট্যান্ড করেছিল। শতাব্দী আমার সামনাসামনি দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে; এখনো পর্যন্ত। ও হাসলে গালে টোল পড়ত। বিকেলের শেষ আলোটা ওর গোলাপি গালে এসে পড়লে মনে হত, একটু ছুঁয়ে দেখি। আমি চিটাগাং কলেজে পড়ার সময় ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম, খুব কম ছেলের সাথেই মিশতাম, মেয়েদের সাথে মেশার তো প্রশ্নই ওঠে না। মেয়েদেরকে মনেমনে প্রচণ্ড ভয় পেতাম। আর ভাব দেখাতাম, ওদেরকে আমি পাত্তাই দিই না, ওদেরকে পছন্দ করার মত বাজে সময় আমার হাতে নাই। মেয়েদের বিরুদ্ধে লেখা যাবতীয় লেখা খুঁজে-খুঁজে পড়তাম। আমার অভিজ্ঞতা বলে, টিনএজ মেয়েরা ছায়ার মতন। পিছু ছুটলে, দৌড়ে পালায়। দৌড়ে পালালে, পিছু ছোটে।

চিটাগাং কলেজে প্রথম দিনে বাংলার ক্লাসে খুব সিনিয়র একজন ম্যাডাম আমাদের সবাইকে একজন-একজন করে দাঁড় করিয়ে কলেজে প্রথম দিনের অনুভূতির কথা জানতে চাইলেন। যে যার মত করে বলতে লাগল। ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে সবসময় একটা ব্যাপার কাজ করে; সেটা হল, যেকোনো কিছুকেই অন্য দশজনের মত করে না ভেবে ভিন্নভাবে ভাবা, ভিন্ন স্টাইলে বলা। সেদিন আমার অনুভূতি সম্পর্কে আমি বলেছিলাম—রোমাঞ্চকর। ক্লাসে সবাই হোহো করে হেসে উঠলো। ক্লাসে কাউকে অপমান করার জন্যে হাসাটাও এক ধরনের স্মার্টনেস ছিল। কয়েকজন হাসলেই হল, বাকিরাও হাসতে শুরু করে; এমনকি, যে কথাটার জন্যে হাসছে, সে কথাটা না শুনলেও ওরা হাসে। হাসিমাত্রই সংক্রামক। ম্যাডাম সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তোমরা যে এভাবে হেসে উঠলে, দেখি বল তো, ‘রোমাঞ্চকর’ শব্দটার অর্থ কী? কেউ-কেউ বলার চেষ্টা করল, ঠিকভাবে হল না। ম্যাডাম পরে আমাকেই বলতে বললেন। আমি বললাম, ম্যাডাম, এটা হল, অজানা অনুভূতি আর ভালো-লাগার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। (ঠিক এই উত্তরটাই দিয়েছিলাম।) শুনে সবাই চুপ। ম্যাডাম বললেন, অসাধারণ হয়েছে! এই ছেলেরা! তোমরা এখন চুপ কেন? সবাই হাততালি দাও হাততালি দাও। সবাই হাততালি দিলো। তখন থেকেই আমি ছিলাম অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে মুহূর্তের মধ্যে তাৎক্ষণিক সংজ্ঞা, উদ্ধৃতি বানানোর অসীম চাপাবাজিটাইপ প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ। ইংরেজি আর বাংলা কঠিন-কঠিন শব্দ দিয়ে বানিয়ে-বানিয়ে কমলকুমার কিংবা জয়েস স্টাইলে দুর্বোধ্যভাবে লিখতে পারার জন্যে কলেজে সবাই-ই আমাকে কমবেশি চিনত। Almost every saint has got a devil’s spirit! আমি মেয়েদের দিকে তাকাতামই না, কিন্তু এসব করতাম ওদেরকে ইমপ্রেস করার জন্যে। কেউ-কেউ ইমপ্রেস হতও। কিন্তু হায়! ওরা ছিল বেশিরভাগই আঁতেলটাইপের মেয়ে! শুধু নোট নেয়ার জন্যেই প্রেম করে-টাইপ মেয়ে।

শতাব্দীর কথা বলছিলাম। ওকে আমাকে প্রথম দেখিয়ে দেয় বিখ্যাত আমিন-সালওয়ার ফর্মুলার আবিষ্কারক আমার এক বন্ধু। বন্ধুর সম্প্রতি অতিফুটফুটে এক কন্যাসন্তান হয়েছে। কন্যাসন্তানের পিতার, মেয়েদের সালওয়ার-গবেষক হওয়াটা, ঠিক মানায় না। তাই ধরে নিচ্ছি, বন্ধুর কোনো নাম নেই, বন্ধুর নাম বন্ধু। (চিটাগাং কলেজের ২০০২ ব্যাচের কেউ জানলেও কমেন্টে বলে না দিক।) অক্লান্ত গবেষণার পর ও একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করল, মেয়েদের সালওয়ারের নিচের অংশদুটি কখনোই একই উচ্চতায় থাকে না। ও, আমি এবং আমাদের আরো কয়েক সহপাঠী মিলে চিটাগাং কলেজের প্যারেড কর্নারে বসেবসে দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক পর্যবেক্ষণে এই আবিষ্কারের কোনোরূপ ব্যত্যয় পাইনি। গবেষণা চলছিল। সেইদিন শতাব্দীর মায়াবী মুখ, কোমর অবধি ঘনকালো চুল, টানাটানা বড়োবড়ো কালো চোখ-এ আমার গবেষক চোখ আটকে যায়। কোনো মেয়েকে ভাল লেগে গেলেও এরপর ওর আরো খবরটবর নেয়ার ব্যাপারটা আমার স্বভাবে ছিল না। এসব বিষয়ে কোনোদিনও কোনো উৎসাহ ছিল না। এখন বুঝি, ভুল হয়েছে। অল্প বয়সের অদ্ভুত অহংকারি ইগো ভাবতে শেখায়, পৃথিবীর সব শবনম-মার্গারিট আমার জন্যে হাঁ করে প্রতীক্ষায় বসে আছে। মেয়েদের পাত্তা না দেয়াটা জগতের সবচেয়ে সুখকর অনুভূতি। সেদিন শতাব্দী এসেছিল, হাঁটছিল, চলে গেল। আমাদের দিকে একবার ফিরেও তাকায়নি। পরে জেনেছিলাম, ও ছেলেদের দিকে তাকায় না, কথা তো বলেই না! সেই ওর সাথে আবার দেখা পরিসংখ্যান প্রাইভেট পড়তে গিয়ে। ও আমাকে আগে থেকেই চিনত। চিনত মানে, আমার খোঁজখবর নিয়েছিল। ও পড়ত আর্টসে। মাঝে-মাঝে সি সেকশনে এসে বাংলা-ইংরেজি ক্লাস করত। আমি সি’তে ছিলাম। পরে বুঝেছি, কেন আসত।

কামরুল হাসান স্যারের প্রাইভেটে ও ছিল অন্য ব্যাচে। (পরে ও স্যারকে বলে আমাদের ব্যাচে চলে আসে।) ওদের ব্যাচ ছিল সকালের ব্যাচ। ব্যাচ শেষে ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত, দূর থেকে আমাকে দেখবে বলে। ওদের ব্যাচ ছুটি হত কবীর স্যারের ব্যাচ ছুটি হওয়ার ১৫ মিনিট আগে। হাসান স্যার আর কবীর স্যার একই গলিতে পড়াতেন। কবীর স্যার শরীরটাকে হেলিয়েদুলিয়ে কীভাবে যেন নেচেনেচে পড়াতেন। স্যার আমাকে পছন্দ করতেন ২টা কারণে। এক। আমি ক্লাসে বসেই ইন্সট্যান্টলি ইংলিশ প্রৌস-পোয়েট্রি’র যেকোনো কোয়েশ্চেনের নোট তৈরি করে দিতে পারতাম। খুব সুন্দর কোনো বাক্য মাথায় এনে প্রথম লাইনটা কাগজে লিখে ফেলতাম, বাকি লাইনগুলি এমনিই মাথায় চলে আসত। প্রতি লাইনেই কঠিন-কঠিন সিনোনিম ইউজ করতাম। বাক্যের গঠন নিয়েও নিজের ইচ্ছে মত খেলতাম। আমি স্যারের নোট পড়তাম না। ওগুলো খুব সহজ মনে হত, তাই পাবলিক লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসেবসে বইপত্র ঘেঁটেঘুটে কোটেশনটোটেশন দিয়ে নিজেনিজে নোট করতাম। পরে ওগুলোও শিখতাম না, লেখার সময় বানিয়ে-বানিয়ে লিখতাম। ওইসময়ে আমার কিছু ফ্রেন্ডের সাথে আমি ইংলিশ ভোকাবুলারি গেম খেলতাম। কে কত বেশি ওয়ার্ড শিখতে পারে সেটার কম্পিটিশন। আমি জানতাম না যে ডিকশনারি মুখস্থ করা সম্ভব নয়, তাই আমি দিনরাত লংম্যান-অক্সফোর্ড-চেম্বার্স-সংসদ ডিকশনারি, রজেটস-পেঙ্গুইন থেসারাস এসব নিয়ে পড়ে থাকতাম। গাধার মত ভাবতাম, সব ওয়ার্ড মুখস্থ করে ফেলব। শেখার সময় বোকা হওয়া ভাল, এতে বেশি শেখা যায়। অতি বুদ্ধি প্রতিভাকে নাশ করে। যে ছেলে কিংবা মেয়ে ম্যাট্রিক-ইন্টারেই নিজেকে সেয়ানা ভাবতে শুরু করে, সে বেশি দূর যেতে পারে না। আমাদের বাসায় এ টি দেব থেকে শুরু করে অনেকগুলো ডিকশনারি ছিল। আমার এখনো মনে আছে, কোনো সিনোনিম কিংবা অ্যান্টোনিম থেসারাসে না থাকলে আমি ওখানে পেন্সিল দিয়ে লিখে দিতাম। প্রচুর পরিশ্রম আর ধৈর্য সহকারে ডিকশনারি পড়তাম আর অনেক বিদেশি গ্রামার বই সলভ করতাম। আমি ইন্টারে পড়ার সময় যতোগুলো ইংরেজি ওয়ার্ড জানতাম, এর অর্ধেকের অর্ধেকও এখন জানি না। দুই। স্যার যে যে নিয়মে গ্রামাটিক্যাল এক্সারসাইজ সলভ করাতেন আমি সেভাবে না করে করতাম অল্টারনেটিভ রুলগুলো ফলো করে। ইংলিশ নভেলটভেল পড়তাম। আমি ইংলিশ শিখেছি যতোটা গ্রামার দিয়ে তার চেয়ে ঢের বেশি সেন্স দিয়ে। সেই ক্লাস সেভেনএইট থেকে বাবার কাছে নেসফিল্ড, রেন অ্যান্ড মার্টিন, স্ট্যান্ডার্ড অ্যালেন, থমসন অ্যান্ড মার্টিনেট, মাইকেল সোয়ান, রেমন্ড মারফি, ইস্টউড, পি কে ডি সরকার সলভ করার অর্জন হল, মেয়েদের মুগ্ধতা অর্জন করা। বাবাকে ধন্যবাদ। স্যার আমার গল্প বিভিন্ন ব্যাচে করতেন। অনেকেই আমাকে চিনত না, কিন্তু সুশান্তকে চিনত। স্যার আমাকে মজা করে জিজ্ঞেস করতেন, কী ব্যাপার সুশান্ত! আমরা যেসব নিয়মে গ্রামার করি, ওগুলো একটাও তোমার পছন্দ হয় না? স্যারকে কীভাবে বোঝাই যে নিয়ম দিয়ে গ্রামার শেখা আমার কাজ নয়। আমি গ্রামার শিখেছি প্র্যাকটিস করে-করে সেন্স দিয়ে।

কবীর স্যারের কাছে ইংরেজি পড়ে বের হয়ে চিটাগাং কলেজের পেছনের গেইট দিয়ে কলেজে ঢুকতাম। মেয়েদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমি মাথা নিচু করে হাঁটতাম। এরকমও হয়েছে, রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটার সময় দূর থেকে যদি দেখতাম, কোনো পরিচিত মেয়ে আসছে, আমি রাস্তা পার হয়ে অন্য পাশে সরে যেতাম, যাতে দেখা হয়ে না যায়, কথা বলতে না হয়। তাই, শতাব্দীর সাথে আমার আগে দেখা হয়নি। একেবারে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, অথচ দেখা হচ্ছে না। মজার না? এখনো ভাবলে হাসি পায়। ও আমার এইসব কিছু জানত। কলেজের এক হিজাব-পরা অতি রূপবতী ছোটোখাটো গড়নের দুষ্টু মেয়ে আমার নাম দিয়েছিল রোবোট। তখন বিটিভি’তে রোবোকপ দেখাতো। আমার হাঁটার স্টাইল, তাকানোর স্টাইল, বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর স্টাইল, ঘাড় ফেরানোর স্টাইল, কথা বলার স্টাইল, মাথা দোলানোর স্টাইল—সব……সবকিছু নাকি ছিল রোবোটের মত। ওই হিজাব-পরা দুষ্টু মেয়েটাকে আমি কখনো কোনো মেয়ের সাথে হাঁটতে দেখিনি। ও ছিল মনিকা লিউনাস্কির মত দেখতে। তাই ছেলেরা ওর নাম দিয়েছিল মনিকা। ওই নামটা এতটাই পপুলার ছিল, আমরা অনেকেই ওর আসল নামটা জানতাম না। ও প্রায়ই হাঁটত আমাদের আরেক কাছের বন্ধুর সাথে। আমরা সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে ওর আকিকা করাই ক্লিনটন নামে। এই জাতীয় আকিকায় খাসি জবাই হয় না, যার আকিকা, সে-ই জবাই হয়। আমাদের ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হয়নি, ডাক্তার হয়েছে, অতি সম্প্রতি এফসিপিএস কমপ্লিট করেছে। মনিকার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী ছিল আরেক দুষ্টের শিরোমণি। ওর নাম ছিল আম্মাজান। বলা বাহুল্য, এই নামের কোনো কৃতিত্ব ওর ফ্যামিলির কারোরই ছিল না। ওকে পছন্দ করত আমাদের আরেক হাবাগোবা টাইপের বন্ধু। আমরা মহানন্দে ওর নাম দিয়ে দিই আব্বাজান। আব্বা-আম্মা’র কখনোই বিয়ে হয়নি, অথচ ওরা চিরদিনের জন্য আমাদের সবার আব্বা-আম্মা হয়ে রইল।

বলছিলাম শতাব্দীর কথা। বারবারই ঘুরে ফিরছি অন্য কথায়। ওর সব কথা সরাসরি লেখার মানসিক শক্তি বা সামর্থ্য কোনোটাই আজ আমার নেই। কেন নেই, সেকথায় পরে আসছি। আমাকে রোবোট বলা, আমার ভঙ্গিগুলোকে মিমিক্রি করে দেখানো, এগুলো ছিল আমার বন্ধুদের এবং হতে-পারত এমন বান্ধবীদের অত্যন্ত প্রিয় কাজ। আমি আশেপাশে আছি, অথচ আমাকে রোবোট বলে হাসাহাসি করছে না, এটা ছিল একটা বিরলতম ঘটনা। বাংলায় ডাবিং করা রোবোকপের স্টাইলে বলত, শহরে অপরাধীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ওদের খুঁজে বের করতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি…….. আর হাসির রোল পড়ত। একদিন ওরকম চলছিল। মেয়েরা কামরুল হাসান স্যারের প্রাইভেটে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। স্যার আসেননি তখনও। ওইসময়ে বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, চলন্তিকা, বঙ্গীয় শব্দকোষ, যথাশব্দ এসব নিয়ে থাকতাম। যাবতীয় ফিকশন আর ননফিকশনে বাসা বোঝাই ছিল। খুব কঠিন স্টাইলে বাংলা লিখতে পারতাম। এটা নিয়েও সবাই ঠাট্টা করতো। ওরা বলতো, রোমাঞ্চকর রোবোট! আমাদের ‘শকুন্তলা’ পাঠ্য ছিল। সেদিন মেয়েরা বলছে, আমাদের রাজা দুষ্মন্ত আসে না কেন? আমাদের রোবোকপ অভিযানে নামল নাকি? শতাব্দী ওখানে ছিল। ও চিৎকার করে বলল, বাজে কথা বলবে না। ও তোমাদেরকে পাত্তা দেয় না বলে তোমরা যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পার না! ও তোমাদের কী ক্ষতি করেছে? মেয়েরা ফোড়ন কাটল, আহারে! বেচারি শকুন্তলা! তোমাকে তো রাজা মনেই রাখবে না! হিহি……. আমি এই ঘটনা পরে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছি।

শতাব্দীর সাথে কথা বলতে গিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি লাগত। একে তো মেয়ে, তার উপর ও কথা বলত একেবারে প্রমিত উচ্চারণে। ওর গ্রামের বাড়ি ছিল ওপার বাংলায়; শান্তিনিকেতনের কাছেই। আমাদের কলেজের ক্লাসছুটির পর স্যারের প্রাইভেট শুরু হওয়ার আগে হাতে অনেকক্ষণ সময় থাকত। স্যার যেখানে পড়াতেন আমরা সেখানে গিয়ে স্যারের অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, গল্পগুজব করতাম। যেদিন-যেদিন পরিসংখ্যান প্রাইভেট থাকত, সেদিন-সেদিন শতাব্দী কলেজে ওদের লাস্ট ক্লাসটা মিস করত; আমার সাথে গল্প করতে দৌড়ে চলে আসত। ওই সময়ে আমি প্রচণ্ড আদর্শবাদী টাইপের ছিলাম। একদিন আমি ওকে কথায়-কথায় বলছিলাম, বাবার টাকায় গাড়িতে চড়ার ব্যাপারটা আমার পছন্দ নয়। এতে আত্মসম্মানবোধ থাকে না। ওইদিনের পর থেকে সে আর কোনোদিন গাড়িতে চেপে আসেনি; রিকশায় আসত। ও যে স্যান্ডেলটা পরত, সেটা পুরোপুরি ফ্ল্যাট ছিল না, পেছনের দিকটা একটু উঁচু; তবে সেটাকে কোনোভাবেই ‘হিল’ বলা যায় না। ওর হিল পরার প্রয়োজনও ছিল না, ওর হাইট ছিল আমার কাছাকাছি। ওইসময় আমি পাঁচ ফুট নয়টয় ছিলাম বোধ হয়। মেয়েদের হিল পরাটা আমার পছন্দ না, এটা ওকে এমনিতেই একদিন কথায়-কথায় বলেছিলাম। এরপর থেকে ও সবসময়ই ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরে আসত। আমি বাম হাতের অনামিকায় এমনিতেই শখ করে নকশা-করা শাঁখার আংটি পরতাম। আমার দেখাদেখি সেও কলকাতা থেকে ওরকম আংটি আনিয়ে নিয়েছিল, যাতে করে সবার আমাদের একজনকে দেখলে অন্য জনের কথা মনে পড়ে। এতে আমি রেগে গিয়ে ওর সামনেই আমার আংটিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিই। ও সেদিন ঠোঁট উল্টেউল্টে অনেক কেঁদেছিল। ওকে আরো কাঁদিয়েছিলাম। আমি ওইসময়ে ব্যাগে গীতবিতান রাখতাম, ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে লুকিয়ে পড়ার জন্য। ও এটা জানত। ও আগে থেকেই রবীন্দ্রসংগীত গাইত, আমাকে খুশি করার জন্যে ও রবীন্দ্রনাথ পড়াও শুরু করেছিল। আমার জন্মদিনে আমাকে না জানিয়েই ও আমার জন্যে একটা সঞ্চয়িতা কিনে নিয়ে আসে। আমি কারও কাছ থেকে গিফট নেয়া পছন্দ করতাম না; মেয়ের কাছ থেকে তো নয়ই। ও ওটা নিয়ে আমার হাতে দিলে আমি প্রচণ্ড রিঅ্যাক্ট করি এবং মুক্তোর দানার মতন গোটাগোটা চোখের জল গোলাপি গাল বেয়ে নামছে, চিবুক ভিজিয়ে দিচ্ছে, এরকম এক কিশোরীকে নির্বোধের মত সঞ্চয়িতা ফিরিয়ে দিই। উফফ! কী নির্দয়তা! ভাবা যায়! আমি একদিন জ্বরের কারণে কবীর স্যারের ইংলিশ ক্লাসে যেতে পারিনি। সেদিন স্যার বেশ কিছু নোট দিয়েছিলেন। ও ২ সেট নোট ফটোকপি করে নিয়েছিল; ওর নিজের জন্যে এক সেট, আমার জন্যে এক সেট। আমি ২ দিন পর ক্লাসে গেলে ও খুব হাসিখুশি চেহারায় আমাকে নোট দিতে এলে আমি বলি, তুমি ফটোকপি করেছ কেনো? আমি করে নেবো। তোমারটা আমার লাগবে না। ও অনেক সরিটরি বলে অনুরোধ করার পরও আমি ওর কাছ থেকে ওটা নিইনি। কী অসম্ভব রকমের ফালতু তীব্র মধ্যবিত্ত আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেঁচে ছিলাম যেটা মানুষকে কষ্ট দেয়! কোনো মানে হয়! এখন ভাবি, সেইসব দিনগুলোতে কী ভীষণ রুড ছিলাম! অথচ, এত সব কিছুর পরও ও আমায় ছেড়ে যায়নি। যাবেই বা কীভাবে? ভালোবাসত যে! একদিনের ঘটনা বলি। আমরা হাসান স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে ফটোকপির দোকান থেকে শীট নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছি। হঠাৎ আমার পুরোনো স্যান্ডেলটা কীভাবে যেন ছিঁড়ে গেলো। এটা নিয়ে সবাই হিহিহাহা করতে লাগলো। ও বিরক্তির সুরে বলেছিল, তোমাদের সমস্যাটা কী? একটা ছেলের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলে এরকম বিশ্রীভাবে হাসতে হয়? এরপর ও নিজেও ওর স্যান্ডেলজোড়া পাশের ড্রেনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে লাগল। এইচএসসি’তে পড়ার সময় আমি জুলফি রাখতাম, প্রায়ই পাঞ্জাবি পরতাম, আমার মাথায় মাইকেলের ভূত চেপেছিল। একদিন ও আমার জন্যে শাদা ফিনফিনে একটা পাঞ্জাবি নিয়ে আসে। বলে, এটা পুরোপুরি আমার টাকায় কিনেছি। মামণির দেয়া রিকশাভাড়ার টাকা জমিয়ে-জমিয়ে কিনেছি। তোমাকে অনেক মানাবে। নাও, প্লিজ নাও। এই অসীম ভালোবাসার বিনিময়েও আমি ওকে যথারীতি আবারো কাঁদাই। ওর সমস্ত অভিমান ভাষা খুঁজে ফিরত ওর বিষণ্ণ মায়াবী চোখজোড়ায়। তাকানো কঠিন; তাকালে শুধুই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।

পরে অসংখ্যবার ভেবেছি, আমি কি ওকে ভালোবাসতাম না? বাসতামই তো! খুব বাসতাম! খুউব! তবে কেন ফিরিয়ে দিয়েছি সবসময়ই? মা শুনলে বকবে, তাই? কে কী ভাববে, এটা ভেবে? প্রেম করলে সবাই খারাপ ছেলে বলবে, এইজন্যে? পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে? মেয়েদের ভয় পেতাম, এটাই কি? ধরেই নিয়েছিলাম, আমি সুপিরিয়র; নো গার্ল ডিজার্ভস মি, এরকম কিছু? নাকি, ভালোবাসলে রেজাল্ট খারাপ হবে, এই ভয়ে? ওর তো কোনো দোষ ছিল না। ও শুধু ভালোবেসেছিল। তাই, শুধুই ভালোবাসা চেয়েছিল; আর কিছুই না। ভুল মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা চাওয়াটা খুব বড় একটা বোকামি। এটা কষ্টই বাড়ায় শুধু। সবচেয়ে বড় কথা, ও আমাকে চেয়েছিল ওর মত করে নয়, পুরোপুরিই আমার মত করে। কত কিছুই তো ছেড়েছিল ও আমার জন্যে। পুরনো অভ্যেস, বাবার গাড়ি, বনেদিআনা, না-পড়ার স্বাচ্ছন্দ্য; এমনকি, অল্প বয়সের ইগো পর্যন্ত! আর আমি কিনা! ছিঃ!

আমি অনেক অনেক অনেক দিন পর ওর খোঁজ নিয়েছিলাম, খুঁজে পেয়েছিলামও। হায়! এর অনেক আগেই আমার ছেড়ে-দেয়া ওর হাত শাঁখা পরতে শুরু করেছে; যে কপালে ওর শত অনুরোধেও কখনো একটাও চুমু খাইনি, সে শুভ্র কপাল সিঁদুররাঙা হয়েছে বহু আগেই। ওর বিয়ে হয়েছিল দিল্লিতে; আজ থেকে প্রায় ৭ বছর আগে। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এই ৩ নাকি বিধাতাই লিখে দেন। ওর ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। ৫ মাসের সন্তান গর্ভে নিয়ে ও নিজেই চলে গেছে না-ফেরার দেশে। সবাই বলছে, সুইসাইড; বিষ খেয়ে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও তা-ই এসেছে। ওর বর উচ্চশিক্ষিত; আইআইটি থেকে গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স আইআইএম থেকে; বড়ো মাইনের চাকরি করতেন, ক্যারিয়ার মদ আর মেয়েমানুষ, এ ৩-ই ছিল তাঁর ভুবন। উনি ধরেই নিয়েছিলেন, সব মেয়েই শুধু শাড়ি আর গয়নাতে বাঁচে, ভালোবাসায় নয়। শুনেছি, উনি ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ছিলেন, শতাব্দীকে প্রায়ই মারধর করতেন। মারতে-মারতে ওর শরীর থেকে রক্ত ঝরাতেন, ওকে অজ্ঞান করে ফেলতেন। ও যেদিন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, সেদিনও ওকে ঘরের মেঝেতে ফেলে বুকে, পেটে অনেক লাথি মেরেছিলেন। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, কতটা অভিমানী ছিল ও। অভিমান নিয়ে চুপ করে বসে থাকবে, ঠোঁট উল্টে ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কাঁদবে, প্রয়োজনে চলেই যাবে; তবুও ওর চোখে বিধাতা যে ভাষা দিয়েছেন, সেটা যে বোঝে না, তাকে সে ভাষা কখনোই ও বোঝাতে যাবে না। হে বিধাতা! না হয় এত সুন্দর করে গড়ো না, তবুও একটা সুন্দর জীবন অন্তত দিয়ো।

আমরা চাই, এইসব মৃত্যুর পোশাকি নাম সুইসাইড না হয়ে খুন হোক।

পুনশ্চ। সঙ্গত কারণেই এই গল্পের চরিত্রের নামগুলো কাল্পনিক। তবে, গল্পটা কাল্পনিক নাও হতে পারে।